মাহমুদ দারবিশের বক্তৃতা । ভাষান্তর: এমদাদ রহমান
প্রকাশিত হয়েছে : ১১ নভেম্বর ২০২৩, ৩:৩৫ পূর্বাহ্ণ, | ৪১৭ বার পঠিত
২০০৮ সালের ১৩ আগস্ট ফিলিস্তিনের রামাল্লায় মাহমুদ দারবিশের লাশবাহী গাড়িটি যখন ধীর গতিতে চলছিল, অশ্রুসিক্ত হাজারও মানুষের হাঁটার গতিও সেদিন ধীর গতির ছিল, তাদের বুকে ছিল প্রতিরোধের সেই অদ্ভুত কবিতা- তুমি চাইলেই সোনালি রোদ, তুমি চাইলেই রূপকথার পুতুল, তুমি চাইলেই ঘর; আমার কিছুই নেই…
আজীবন উদ্বাস্তু ছিলেন দারবিশ, তাই তিনি পৃথিবীর সমস্ত উন্মুল উদ্বাস্তু মানুষের মুখে ভাষা দিয়ে গেছেন; জন্মভূমি ছেড়ে পালাতে হয়েছে লেবননের শরণার্থী শিবিরে, তারপর- কায়রো, মস্কো, বৈরুত, দামেস্ক, তিউনিস, প্যারিস, হিউস্টন… মানুষের যখন নির্বাসনের ভাষা খুঁজতে হলো, দারবিশ লিখলেন তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘ডানাহীন পাখি’; লিখলেন অদ্ভুত এক স্বপ্নের কথা- পৃথিবীর হৃদয় তার মানচিত্রের চেয়েও বড়! তিনি প্রতিরোধের কবি। তাঁর কণ্ঠ এককের নয়, কোরাসের; যারা জন্মভিটে হারিয়েছেন, বিচ্ছিন্ন হয়েছেন, সেই অজস্র উদ্বাস্তু মানুষের কণ্ঠ মাহমুদ দারবিশ। তাঁর কবিতার ভাষাই তাঁর দেশ, বহু মানুষের দেশ, প্রতিরোধের ভাষা।
নেদারল্যান্ড সরকারের ‘প্রিন্স ক্লস সম্মাননা’—২০০৪ গ্রহণের দিনে, ২০০৪ সালের ১ ডিসেম্বর, রয়েল প্যালেস অ্যামস্টারডাম-এ মাহমুদ দারবিশ তাঁর বক্তৃতায় এই কথাগুলো বলেছিলেন—
ইওর ম্যাজেস্টি…ইওর রয়েল হাইনেস…ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ,
কবিতা-যাপনের এই অসামান্য দিনে, আজ এখানে, আপনাদের মধ্যে স্থান পাওয়া আমার জন্য আনন্দ ও সম্মানের বিষয়, এমন এক অদ্ভুত সময়ে আমরা শুধুমাত্র কবিতাকে যাপন করছি যখন তাকে বিচ্ছিন্ন ও অনাত্মীয় মনে করা হয়।
যে কবিকে আজ এখানে সম্মানিত করা হচ্ছে, তার হয়ে কথা বলতে গিয়ে আমি শঙ্কিত, কেবল এই কারণে যে এখানে কবি ব্যক্তিটি তিনিই যেখানে তিনি নিজেকে নিয়ে কথা বলছেন, এই ক্ষেত্রে, তিনিই নিজেকে সম্বোধন করছেন। কীভাবে একই সঙ্গে ‘আমি’ এবং আমার আমির ‘অপর’ মিলে আজ এখানে মিলিত হয়েছি? দিন শেষে কবিতা কি কবির ‘আমি’ এবং তার অপরের-এর মিলিত স্বর নয়?
কোনও একজন লেখক যখন এমন একটি আন্তর্জাতিক সম্মাননা পান, তখন এই সম্মাননাকে শুধুমাত্র তার একক প্রচেষ্টার স্বীকৃতিই বোঝায় না, এই সম্মাননা বরং একটি বন্ধনেরও উদযাপন যা তাঁর একক সৃষ্টির কাজকে অন্য লেখকদের কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত করে; এ সম্মাননা যে কোনও লেখকের জন্য একটি বিশেষ নান্দনিক এবং মানবিক মূল্যবোধের স্বীকৃতি যার মাধ্যমে তাঁর সৃষ্টি বিপুল বিশ্বসাহিত্যকে হয়ত একটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি উপহার দিতে পারে যা সাহিত্যকে কোনও বিশেষ কেন্দ্রে বন্দি করে না, দূরবর্তী প্রান্তদেশে মুদ্রিত সাহিত্যকেও ছোট করে দেখে না।
ফিলিস্তিনি হওয়া খুব কঠিন আর একজন ফিলিস্তিনির জন্য কবি হওয়া আরও কঠিন! শব্দ ও পারিপার্শ্বিকতার মধ্যকার অবারিত সমন্বয় বিঘ্নিত না করে কীভাবে তিনি গান গাইতে পারেন? কীভাবে তিনি একই সময়ে সৌন্দর্য সৃষ্টি এবং তার উপযোগিতা নিয়ে ভাবতে পারেন?
মাননীয়া,
আজ যে সম্মান আমাকে দেওয়া হয়েছে তা একই সঙ্গে আমার আবার আমারও নয়। এ সম্মাননা আমি গ্রহণ করেছি কারণ কবিতাগুলোয় আমি মাহমুদ দারবিশ, স্বাক্ষর করেছি। কিন্তু স্বাক্ষর করলেও, এ কবিতা কেবলই আমার নয়, কারণ এ কবিতাগুলোয় অনেক কণ্ঠস্বর এবং হারানো স্থানের কথা আছে যাকে এখন আর কেউ মানচিত্রে খুঁজে পাবেন না… এ শুধু আমার একার কণ্ঠ নয়, বরং তা অনেকের এমন কিছু কথা যা ভিকটিম হিসেবে নিজেকে এবং পুরো বিশ্বকে বলা, যা এমন কিছু কথা আক্রান্ত ব্যক্তিটি যেখানে নীরবতাকেও স্বীকার করে না, এমনকি মৃত্যুকেও স্বীকার করতে সে আর রাজি নয়, এমন কী স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার এবং শান্তির আশার ব্যাধি থেকে নিরাময়েরও আশা সে আর করতে চায় না। এখানে, আমার যে কণ্ঠকে স্বতন্ত্র কণ্ঠ হিসেবে পাওয়া যায় তা কেবল কবিতার ছন্দ ধরে রাখবার একটা উপায় ছাড়া আর কিছুই নয়!
একজন ব্যক্তি শুধুমাত্র একটি জায়গায় জন্মগ্রহণ করেন, কিন্তু তিনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে মারা যেতে পারেন : নির্বাসিত হয়ে, কারাগারে, এমন কি তিনি মারা যেতে পারেন তাঁর জন্মভূমিতে যা দখল ও নিপীড়নের ফলে ইতিমধ্যেই দুঃস্বপ্নে রূপান্তরিত হয়েছে। সম্ভবত কবিতাই সেখানে একমাত্র আশ্রয় যা আমাদের মাঝে মায়াজাল বিস্তার করে, আমাদের ভেতরের জাদুময় বিভ্রমকে লালন করতে শেখায়: কীভাবে বারবার এবং বারবার নিজেদের মধ্যে থেকেই নতুন করে জন্ম নেওয়া যায়, নিজেদের আত্মার ভেতরের শব্দদের দিয়ে গড়ে তোলা যায় এমন একটি আন্তরিক পৃথিবী, এমন একটি উপাখ্যানের পৃথিবী যা বাস্তব নয়, যা এখনও আমাদের স্বপ্নেই থেকে গেছে; আমাদের আত্মার ভেতরের এইসব শব্দকে ব্যবহার করে বিবাদমান পক্ষদের নিয়ে স্বাক্ষর করা যায় একটি শান্তিচুক্তি, যে-চুক্তিটি হবে স্থায়ী শান্তির দিকে যাত্রা, আমাদের সকলের জীবনের জন্য পরম আকাঙ্ক্ষা- শান্তি।
আপনি জানেন যে আমি ফিলিস্তিন থেকে এসেছি। ফিলিস্তিন- কী উত্তেজনাপূর্ণ এক নাম! দ্ব্যর্থক, অস্পষ্ট এবং প্রতিটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যার জন্য উন্মুক্ত এই নাম। এই নামটি আমাদের ভেতরে একটি নির্দিষ্ট আকাঙ্ক্ষা এবং সেই সঙ্গে একটি প্রতি-আকাঙ্ক্ষাও জাগিয়ে তোলে, করুণা আর ক্রোধকে চাঙা করে তোলে। আমাদের কল্পনায় থাকা প্রাচীন ফিলিস্তিন, যাকে ‘ভালোবাসা ও শান্তি’ দেশ বলা হয়, সে আমাদের নবীদের মা, পৃথিবী ও আকাশের মিলনস্থল, রক্তপাত ও কান্নামুখর প্রকৃত ফিলিস্তিনের সঙ্গে যা কোনওভাবেই সাদৃশ্যপূর্ণ নয়। এই ভূমিখণ্ড থেকে শান্তি বিদায় নিয়েছে চিরদিনের জন্য, এখানে জনগণ স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত; এ ভূমি ভালবাসাকে অস্বীকার করেছে কারণ এর জনগণ ন্যায়বিচার বঞ্চিত; এ ভূমি সুন্দর আগামীকে অস্বীকার করেছে, কারণ এর দখলকৃত বর্তমানকে ঘৃণার দীর্ঘ এক প্রাচীর ঘিরে রেখেছে যা এর জনগণকে দিনের পর দিন আশা থেকে বঞ্চিত করে।
ফিলিস্তিনি হওয়া খুব কঠিন আর একজন ফিলিস্তিনির জন্য কবি হওয়া আরও কঠিন! শব্দ ও পারিপার্শ্বিকতার মধ্যকার অবারিত সমন্বয় বিঘ্নিত না করে কীভাবে তিনি গান গাইতে পারেন? কীভাবে তিনি একই সময়ে সৌন্দর্য সৃষ্টি এবং তার উপযোগিতা নিয়ে ভাবতে পারেন?
ভাষাকে বিবরণীতে রূপান্তরিত না করে কীভাবে তিনি ভাষা দিয়ে দেশের কথা বলতে পারেন? কীভাবে তিনি কিংবদন্তির চাপ থেকে বাস্তবতাকে রক্ষা করবেন, কীভাবে তিনি বাস্তবতার চাপ থেকে কিংবদন্তিকে রক্ষা করবেন, ইতিহাসের অংশ হয়ে, একজন সাক্ষী হয়ে একই সময়ে তিনি কীভাবে এতকিছুর বিপুল চাপ তিনি সামলাবেন? সময় আমাদের প্রজ্ঞাবান হওয়ার শিক্ষা দেয় আর ইতিহাস আমাদের আয়রনি শেখায়। একজন কবি কীভাবে তাঁর ভাষা (কাউন্টার-ল্যাঙ্গুয়েজ) দিয়ে যুদ্ধ করতে পারেন? নির্বাসনকে কীভাবে তিনি সুপ্ত স্মৃতিতে পরিণত করবেন? তিনি কীভাবে–ফরাসি কবি রেনে শার যেমনটি বলেছেন–শত্রুকে প্রতিদ্বন্দ্বীতে রূপান্তরিত করবেন এবং কীভাবে তিনি সেই প্রতিদ্বন্দ্বীকে ইয়েটসের কবিতার দুটি লাইন মুখস্ত করতে রাজি করাতে পারবেন:
Those that I fight I do not hate,
Those that I guard I do not love;
এমন কঠিন সব প্রশ্ন… কেবল সাহিত্যই দিতে পারবে এইসব প্রশ্নের উত্তর… আমি জানি না… আর না জানাটা কী যে রোমাঞ্চকর যেখানে কবিতা হলো অজানার দিকে অ-বি-রা-ম যে-তে থা-কা।