জলধি সম্পাদক, কবি ও গল্পকার নাহিদা আশরাফীর সঙ্গে আলাপ
প্রকাশিত হয়েছে : ০১ মে ২০২৩, ১০:৫৯ অপরাহ্ণ, | ৮৩৫ বার পঠিত
প্রবেশক
নষ্ট দ্রাঘিমায় এসে গেছি হে দেবদূত!
অস্থিতে মজ্জায় হিম জমে গেছে অজস্র কর্দম
কী করতে কী করে ফেলি বুঝি না পূর্বাপর
কেচো খুড়ে অজগর!বুকের ভেতর যেন অহরহ টমটমের শব্দ
শুনতে পাই।
প্রাগৈতিহাসিক অন্ধকূপে পড়ে থাকি
বিকল জন্তুর মতো পঙ্গুতায়-আর
স্তব্ধ পরাধীনতায়।
ছায়াকে কায়াকে যুগপৎ করে তুলি শত্রু
পারি না এড়াতে অলৌকিক রাক্ষস সন্দেহ
রক্তের গভীরে যেন ঘাই মারে বিষধর শিং।
ঊরুর আগুনে চেপে যৌবন বল্লম
কেপে উঠি মধ্যরাতে—
স্বপ্নের ডানার মতো নেমে আসে সংখ্যাহীন সিল্কের বালিশ
হাতের কলম দড়ি ছিড়ে
সাপ হয়ে যায়
সাপ, ময়ূর।অতঃপর,
ফুলের কঙ্কাল থেকে নিঃসৃত সৌনভ
তরল মৃত্যুকে পান করে
বিষাদে বিনাশে হই পূর্ণাঙ্গ পুরুষ।‘স্বগতোক্তি’, অশেষ প্রস্তরযুগ, শোয়েব শাদাব
প্রোলোগ
র্যল্ফ ওয়াল্ডো এমার্সন এবং মার্গারেট ফুলার, ১৯৪০ সালের যে দিনটিতে, ‘দ্য ডায়াল’ লিটল ম্যাগাজিনটি প্রকাশ করেন, তখন অমাবস্যা না কি ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’ আমরা জানি না; বহুবছর পর, শহীদুল জহির নামের একজন লেখক সুহাসিনী গ্রামের লোকদের নিয়ে ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’ উপন্যাসটি লিখবেন, আর, তারপর- আরও আরও গল্প; এবং আরও হাঁটবেন একদম স্রোতের বিপরীতে। কবি শোয়েব শাদাব লিখবেন অশেষ প্রস্তরযুগের কবিতাগুলো, আর আমরা পথ হাঁটতে হাঁটতে মিথকথার ফিনিক্স পাখির কথাও জেনে যাব…সে-পাখির ডানায় জন্ম নেবে আরও আরও লবণাক্ত পালক, মানে সল্টেড ফেদার্স; তখন, ছোট কাগজ কিংবা লিটল ম্যাগাজিন, পূর্ণিমা আর অমাবস্যার যাত্রা শুরু হবে পরস্পরের হাত ধরাধরি করে!
লিটল ম্যাগাজিন ‘জলধি’র সর্বশেষ সংখ্যা ছিল কবি শঙ্খ ঘোষের জীবনকীর্তি; জলধি দুরন্ত সাহসে বিরল ব্যতিক্রমী এই কবিকে গদ্যে, কবিতায় ধারণ করতে চেয়েছিল… এর মধ্যে এলো পরবর্তী সংখ্যার ঘোষণা। সম্পাদক তাঁর ফেইসবুক পেজে লেখা চেয়ে পোস্ট দিয়েছেন- ‘জলধির পরবর্তী সংখ্যা ‘সদরঘাট সংখ্যা’। বাংলাদেশের ছোটকাগজের ইতিহাসে এমন কাজ এই প্রথম এমন দাবি করবো না তবে সদরঘাট নিয়ে ছোটকাগজের কাজ এই প্রথম। সদরঘাটকে কেন্দ্র করে লিখে ফেলুন আপনার গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, ভ্রমণগদ্য, স্মৃতিগদ্য, সাক্ষাৎকার কিংবা আরো কিছু। লিখুন এবং এই ইতিহাসের অংশী হোন আপনিও।’ তিনি আরও লিখেছেন- ‘সদরঘাট ঘুমায় কখন? এই প্রশ্নটা আমাকে অনেকদিন ঘাই মেরেছে। লঞ্চ, জাহাজ, যাত্রী, কুলি, সারেঙ, সুকানি, কেবিন মাস্টার, বয়, চা-পান-সিগারেট, ছোট ছোট হোটেল, রেস্তোরাঁ, হাঁক-ডাক… বলতে বলতে আমিই ক্লান্ত হই। সদরঘাট ক্লান্ত হয় না। আমাদের গঙ্গাবুড়ি শহরের সমস্ত গ্লানি বয়ে বয়ে ক্লান্ত, তবু সে অবিরাম পরিচর্যায় সন্তানের যত্ন নিতে ভোলে না।’
তো, এই সদরঘাট সংখ্যার প্রস্তুতি এবং পূর্বাপর নিয়ে রাশপ্রিন্ট-এ ছাপা হলো জলধি সম্পাদক, কবি ও গল্পকার নাহিদা আশরাফী’র একটি বিশেষ সাক্ষাৎকার—
বিস্তার
এমদাদ রহমান: সদরঘাট সংখ্যা করবার কথা কখন, কীভাবে ভাবনায় এসেছিল?
নাহিদা আশরাফী: ছোটকাগজ মূলত নতুন চিন্তা এবং নিরীক্ষার কাজ। আমার মনে হয়, সব কিছুর থেকে আলাদা করে ভাবনার একটা জায়গা থাকে লিটল ম্যাগাজিনে আর সেই চিন্তা থেকেই্ এমন ভাবনা। প্রতিবারেই লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে একটু অন্যরকম করে ভাবনা থাকে জলধি’র। সেই ভাবনার উন্মেষ ঘটল প্রায় দু-বছর আগে; কোনও একটা কারণে— যতদূর মনে পড়ে—তখন, করোনাকাল চলছিল, এবং স্বাভাবতই, মনস্তাত্ত্বিকভাবে আমরা কেউই খুব একটা ভালো ছিলাম না। ভালো না থাকার এই সময়টাতে- আমি একবার সদরঘাটে যাই, এবং দীর্ঘক্ষণ সেখানে বসে থেকে এক অদ্ভুত অনুভূতি হয়। সেখানকার জীবনযাত্রা, প্রাত্যহিক কাজকর্মগুলো— মানে, লঞ্চ বা জাহাজ ভেড়ার দৃশ্য, কুলির হাঁকডাক, যাত্রীর ব্যস্ততা…মানে, এই বিষয়গুলো আমি অনেকদিন ধরেই দেখেছি কিন্তু ওইদিন খুব অসহায়ের মত লক্ষ্য করলাম কেমন যেন ঝিমিয়ে আছে সদরঘাট। আমার ভেতরটা কেঁপে উঠলো। মনে হল, কালের গর্ভে কত কিছুই তো হারায়। সদরঘাট যদি আর না থাকে? যদি তার এই রূপ আর না দেখি? তখনই মাথায় এলো, আমরা আসলে ছোট কাগজে কতো বিষয় নিয়েই না কথা বলতে পারি, আমাদের তো হাত পা বাঁধা নেই, আমাদের চোখ খোলা, আমাদের মুখে কুলুপ আঁটা নেই; কাজেই এমন তো জরুরি নয় যে সব সময় ছোটোকাগজ শুধুমাত্র সাহিত্য নিয়ে কথা বলবে, লেখক নিয়ে কথা বলবে, বই নিয়ে কথা বলবে; তার বাইরে গিয়েও তো কথা বলা যায়! এবং সেই কথা বলার জন্য একটা প্রাণ দরকার, সেই প্রাণটা যেখানেই সঞ্চারিত হোক না কেন, সেটাই ছোট কাগজের বিষয় হতে পারে। আমার কাছে সদরঘাটকে তখন ঠিক তেমনই মনে হয়েছিল, মনে হয়েছিল অদ্ভুত এক প্রাণময় জায়গা। সদরঘাট সংখ্যার ব্যাপারে লিখতে গিয়ে লিখেছিলাম— যে প্রশ্নটা আসলেই আমার মাথায় উঁকি দিয়েছিল– সদরঘাট ঘুমায় কখন? প্রতিনিয়ত সে জেগে থাকে, প্রতি মুহূর্তেই সে চঞ্চল, কর্মব্যস্ত; তো, এই কর্মব্যস্ত একটা জায়গাকে কখনওই আমি প্রাণহীন দেখিনি। আরেকটি কথা যা বলছিলাম, ছোটকাগজ বিষয়ে লিখতে গিয়ে— আমাদের লিটল ম্যাগাজিনের একটি প্রধানতম উৎস ‘হাজারী লেন’, সে-জায়গাটাও সেই সদরঘাটের কাছাকাছি; আমাদের বিউটি বোর্ডিং, আমাদের পুস্তক প্রকাশনার জায়গা, আমাদের আহসান মঞ্জিল, আমাদের বুড়িগঙ্গা, এবং আরও অনেক কিছু; মানে— সব কিছু মিলিয়ে না সদরঘাট একটা অনন্য ও ঐতিহাসিক অবস্থানে রয়েছে। অতএব জলধি সদরঘাট নিয়ে কাজ করতেই পারে এবং এই চিন্তা থেকেই পরবর্তীতে মাথায় এলো যে সদরঘাট শুধু কেন, কমলাপুর নিয়ে কাজ হতে পারে, সায়েদাবাদ নিয়ে হতে পারে। এ-রকম বেশ কিছু কাজ নিয়ে আমরা ভাবতে পারি। চিন্তাটা বাস্তবায়ন করতে একটু দেরি হয়ে গেল, কারণ- সবাই জানেন যে একটা বিবমিষাকাল আমাদের গিয়েছে, যে-কারণে আমরা কোনও কাজই খুব সুস্থিরভাবে করতে পারছিলাম না, অর্থনৈতিক টানাপোড়েনেরও একটা ব্যাপার রয়েছে, পর্যাপ্ত লেখা পাওয়ারও একটা ব্যাপার রয়েছে; কারা লিখবেন, কী লিখবেন, বিষয়গুলো কেমন হবে- অনেক কিছুই ভাবনার ছিল। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত আমরা ২০২৩-এ এসে সাহসটা করে ফেললাম। যতো ভাববো, ততোই আরও দেরি হবে, আর আমি আসলে একটা জিনিসে খুব বিশ্বাসী, সেটা হচ্ছে- স্টপ ড্রিমিং এন্ড স্টার্ট ডুয়িঙ। যত বেশি স্বপ্ন দেখব, কাজটা বোধ হয় আরও বেশি পিছিয়ে পড়বে, তারচেয়ে শুরু করে ফেলাটাই ভালো কারণ প্রস্তুত হতে গেলেও কাজ শুরু করে দিতে হয় । শুরু করলে একটা না একটা সময় শেষ হবেই। এই চিন্তা থেকেই এবং মূলত ওই দিন থেকেই আসলে ‘সদরঘাট সংখ্যা’ করার ইচ্ছেটা মাথায় ঘুরপাক খায়।
সদরঘাট সংখ্যার বেশকিছু লেখা নিয়ে লেখকদের সাথে কথা বলছিলাম, বেশ কিছু কবিতা ফেরতও দিচ্ছিলাম;… কয়েকজন লেখক দেখলাম বেশ উন্নাসিক হয়ে উঠছেন যে কেন লেখা ফেরত দিচ্ছি। হ্যাঁ। এই যে, লেখকদের মধ্যে একটা উন্নাসিক ব্যাপার চলে এসেছে। নিজেদের বোঝার বাইরে আসলে আমরা আর কিছু বুঝতে চাচ্ছি না- এ ধরনের অনেকগুলো বিষয় ছোটোকাগজের সঙ্গে জড়িত হয়ে যায়। ছোটোকাগজ একটা ঐকতানের নাম, ঐক্যবদ্ধতার নাম, হ্যাঁ, ছোটোকাগজ একটা সম্মিলনের নাম, একটা সম্মিলিত প্রচেষ্টার নাম। সেই প্রচেষ্টাগুলো আমরা আসলে সব ভেঙে ভেঙে এখন আমরা সবাই, মানে… সেই অনেকদিন আগে একটা প্রবন্ধে বলেছিলাম যে বাংলাদেশ সরকার একবার ঘোষণা করেছিল- এক বাড়ি এক উঠোন।
এমদাদ রহমান: ছোটকাগজে সদরঘাটকে কীভাবে ধরতে চান?
নাহিদা আশরাফী: এই সংখ্যাটা কীভাবে সাজাব- এটা নিয়ে এখনও খুব স্পষ্টভাবে যে ভেবেছি, এটা বলা যাবে না, তবে, সদরঘাট নিয়ে গল্প হতে পারে, সদরঘাট নিয়ে কবিতা হতে পারে, সদরঘাট নিয়ে প্রবন্ধ, নিবন্ধ, ভ্রমণ, আলোচনা, স্মৃতিগদ্য সবকিছুই হতে পারে; মূলত— যেহেতু এটা একটা সংযোগ মাধ্যম, এবং এই জায়গাটা এমন একটা প্রসিদ্ধ জায়গা যেখানে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে আমাদের লিটল ম্যাগাজিন, আমাদের শিল্প-সাহিত্য, আমাদের জনজীবন- সবকিছু খুব প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে আছে। এই সদরঘাটে, যারা মূলত এই জায়গাটায় কাজ করেন— সারেঙ, সুকানি, মাস্টার, কেবিন বয়, হোটেল বয়, হোটেল মালিক, কুলি; তারপরে— ঘাট নিয়ন্ত্রণকারী, মানে, এখানে হাজারও রকম মানুষের মুখ এবং তাদের ক্রিয়াকলাপ আপনি দেখতে পাবেন। আমরা চেষ্টা করছি জলধির পক্ষ থেকে বেশ কিছু সাক্ষাৎকার নিতে, মূলত যারা এখানে প্রতিনিয়ত কাজ করছেন— তিনি হতে পারেন একজন কুলি, হতে পারেন একজন ফল বিক্রেতা, হতে পারেন একটা লঞ্চ বা জাহাজের মাস্টার। আমরা লেখকদেরকে অনুরোধ করেছি এই জায়গাটাকে ঘিরে যাদের স্মৃতিগদ্য বা ভ্রমণের উল্লেখযোগ্য স্মৃতি আছে তা তুলে ধরতে। এসব নিয়েই সাজাতে চেষ্টা করছি। আমার ধারণা ছিল যে সদরঘাট নিয়ে লেখার মধ্যে হয়তো কবিতাটাই কম পাবো। কিন্তু আমাদের অবাক করে দিয়ে অলরেডি প্রায় ১০টার উপরে কবিতা চলে এসেছে, যদিও সেই ১০টার মধ্যে আমরা কিছু সংখ্যক কবিতা সংশোধনের জন্য লেখকদের অনুরোধ করেছি কিন্তু বাদবাকি কবিতা পড়ে আমি রীতিমতো অবাক হয়েছি যে সদরঘাটকে কবিতায় কতো সুন্দর করে ধরা যেতে পারে! তো, জলধি’র ঘোষণার মাধ্যমে এই যে লেখার স্পৃহা তৈরি হল, এটাও অনেক বড় একটা ব্যাপার। গল্প পেয়েছি আমরা ইতিমধ্যে প্রায় ৪টির মতো, দু’টো গল্প তো অসাধারণ; প্রবন্ধ এসেছে বেশ কিছু। আমরা আস্তে আস্তে আমাদের নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই তৈরি হয়ে নিচ্ছি। দেখা যাক কী কী আসে। সংখ্যাটিকে আমরা মূলত ৩পর্বে ভাগ করতে চাচ্ছি— সদরঘাট নিয়ে লেখাপত্র, সদরঘাট ঘিরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এবং ছোটো কাগজ, এবং সদরঘাটের ইতিহাস । সিদ্ধান্ত বদলও হতে পারে। এখনই নিশ্চিত করে কিছু বলা যায় না। সদরঘাট মূলত একটা জার্নি, আবার নিজেও সে অনেক জার্নির সাক্ষী। আমরা সেই জার্নির ইতিহাস তুলে আনতে সচেষ্ট থাকবো।
আরেকটি বিষয়, সদরঘাটকে ধরতে গেলে শুধুমাত্র যে মানুষ বা জনজীবন বা লঞ্চ, জাহাজ, নৌকো— তা কিন্তু নয়। বুড়িগঙ্গা, যার বুকের উপর এই সদরঘাটটা দাঁড়িয়ে আছে, সেই বুড়িগঙ্গা বা গঙ্গাবুড়িকে নিয়েও প্রচুর লেখার আছে, এবং এই নদী বুড়িগঙ্গা বুক পেতে দিয়ে কীভাবে একটা শহরকে রক্ষা করেছে এবং এখন নিজেই মরে যাচ্ছে রক্ষা করতে করতে— এই বিষয়টাও আসবে আমাদের সদরঘাট সংখ্যায়।
এমদাদ রহমান: এর আগে জলধি দু’টি পাঠ-পর্যালোচনা সংখ্যা করেছিল…
নাহিদা আশরাফী: জলধি এই তার দীর্ঘ, দীর্ঘ বলা যাবে না, নাতিদীর্ঘই বলি— লিটলম্যাগের ক্ষেত্রে আসলে দীর্ঘ বলে কিছু নেই। তো, এই সংক্ষিপ্ত জীবনে মোট ১১টি সংখ্যা উপহার দিয়েছে পাঠককে। ১১টি সংখ্যার মধ্যে দু’টি নয় মোট ৩টি সংখ্যা পাঠ-পর্যালোচনা সংখ্যা ছিল, এবং এই পাঠ-পর্যালোচনা সংখ্যায় যে বিষয়টি, তা হচ্ছে- আমরা এতো বেশি সাড়া পেয়েছিলাম যে তা সত্যিই মনে রাখার মতো। সত্যি কথা বলতে কি, বুড়িগঙ্গা যেমন রুগ্ণ হয়ে গেছে, আমাদের সাহিত্যে সমালোচনা সাহিত্যটাও ঠিক তেমনি রুগ্ণ হয়ে গেছে, এবং কিছুটা দুর্গন্ধময়। এজন্যই বলছি যে— আমরা আসলে, লেখকরাই বলি বা পাঠকেরা, সমাচোলনাটাকে ঠিক ওইভাবে, ওই শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে ধরতে পারছি না। যার জন্য সমালোচনা ঠিক সমালোচনা না থেকে কখনও বইয়ের বিজ্ঞাপন হয়ে যাচ্ছে আর না হয় কখনও ব্যক্তি রোষ চলে আসছে; মানে— সমালোচনা, সমালোচনার যে-শৈল্পিক-বিষয়টা বা আর্টটা, সেই আর্টটিকে আমরা হারিয়ে ফেলেছি। তো এই জায়গাটা থেকে আমরা চেষ্টা করেছিলাম, জলধি চেষ্টা করেছিল বা ভবিষ্যতেও করবে— এমন নয় যে এই ৩টি সংখ্যাই শেষ, ভবিষ্যতে আর করার ইচ্ছে নেই— আমাদের ভবিষ্যতে আরও বড় ধরনের কাজ করার ইচ্ছে আছে সমালোচনা সাহিত্য নিয়ে। তো যাই হোক, এই চেষ্টাটা আমাদের ছিল, এবং কাজটা আমরা শুরু করেছিলাম একটু ভিন্ন আঙ্গিকে। প্রতি বছর ভারতের পশ্চিমবঙ্গে এবং বাংলাদেশের বইমেলায় যে-নতুন-বইগুলো বের হয়, সেই নতুন বইগুলো থেকে বাছাইকৃত কিছু বই, বিশেষত নতুনদের বই নিয়ে আমরা আলোচনাটা শুরু করেছিলাম এবং আলোচনাটার মধ্যে একটা খুব দারুণ ব্যাপার ছিল। আমরা বাংলাদেশের বইগুলো তুলে দিয়েছিলাম পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের হাতে এবং পশ্চিমবঙ্গের বইগুলো বাংলাদেশের লেখকদের হাতে। এতে যা হয়েছিলো— দুই দেশের এই নবীন লেখকদের লেখা লেখকরা পড়তেন এবং তাদের মাধ্যমে একটা যোগাযোগ তৈরি হতো। একটা সংযোগ বলা যায়। সাহিত্য মানেই তো একটা সংযোগ-সেতু। এই সংযোগ-সেতু তৈরি করার চেষ্টাটা একটা লিটলম্যাগের থাকা উচিত। এবং সেই প্রেক্ষাপট থেকে আমরা চেয়েছিলাম এই চেনাজানার পরিধিটা আরও বাড়ুক। এটা খুব চমৎকারভাবে সাড়া ফেলেছিল। করোনা অতিমারি না এলে বা এই দুর্দশাটা আমাদের জীবনে নেমে না এলে হয়তো অনেক কিছুই আমরা আরও স্বাভাবিকভাবে করতে পারতাম। তারপরও আশা করছি সব কাটিয়ে উঠে নিশ্চয়ই আগামী দিনগুলোতে আরও ভালো কিছু কাজ করতে পারব আমরা, অন্তত সমালোচনা সাহিত্যের উপরে খুব নিরীক্ষাধর্মী কিছু কাজ করার ইচ্ছে জলধি’র রয়েছে, এবং জলধি স্বপ্ন দেখে কাজগুলো একদিন আলোর মুখ দেখবে।
এমদাদ রহমান : ‘শঙ্খ ঘোষ সংখ্যা’ কবিকে কতোটা ধারণ করতে পেরেছে?
নাহিদা আশরাফী: জলধি শঙ্খ ঘোষ সংখ্যা নিয়ে বলতে গেলে যেটা বলতে হয় সেটা হচ্ছে— আপনার প্রশ্নটা হল কবিকে কতোটা ধারণ করতে পেরেছি— আসলে একজন কবিকে ধারণ করা কি এতো সহজ! একটা মানুষ যখন তার সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেন কিছু অক্ষরের কাছে, কিছু শব্দের কাছে, তখন সেই পুরো জীবনটা ধারণ করা আমার মনে হয় লিটলম্যাগ কেন, কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। তারপরও ছোট কাগজের একটা চেষ্টা থাকে। বিভিন্ন দিক থেকে আলো ফেলে, তাঁর সৃষ্টিকর্মগুলোর বিবিধ বিশ্লেষণ করে আলোচনা করতে পারি, আলোচনায় আনতে পারি। আলোচনায় আলো ফেললে প্রতিফলিত হয়ে বা প্রতিসরিত হয়ে আরও কিছু নতুন সৃষ্টি করতেও পারে। এই ইচ্ছেটা মূলত লেখক বা পাঠক বা কবি দ্বারাই তৈরি হয়। কাজেই, যারা ছোট কাগজে শঙ্খ ঘোষকে নিয়ে লিখেছেন, আপনারা জানেন— শঙ্খ ঘোষ আসলে আমাদের মাঝে এমন এক প্রভাব বিস্তারি কবি যিনি দু-বাংলাতেই সমান জনপ্রিয়— জনপ্রিয় শব্দটা ঠিক গেল না এখানে— দু-বাংলাতেই উঁনি কবি-হৃদয় শুধু নয় আমি বলবো পাঠক হৃদয়ে এমন এক অনন্য অবস্থান তৈরি করেছেন, যে অবস্থানটা ঠিক পরিমাপযোগ্য নয়। হ্যাঁ। অন্তত দেশভাগ নিয়ে তাঁর যে কাজ, তাঁর যে চিন্তা, তাঁর যে মননশীল অবস্থান সেখানে দাঁড়িয়ে ভাবলে বুঝতে সহজ হবে। একটা মানুষ যখন দু’টো দেশকে তাঁর ভেতরে ধারণ করে, দু’টো দেশকে লালন করে, এবং ভাঙনের শব্দটা বুকে নিয়েই যার বসবাস, সেই মানুষটাকে একটা ছোটকাগজ ধারণ করতে পারে না, মানে, আসলে সম্ভব না। তারপরও আমাদের চেষ্টা ছিল নিবিড় পর্যবেক্ষণের, গভীর অনুধাবনের। তাঁর কাছের মানুষ থেকে দূরের মানুষ, সাথের মানুষ থেকে লেখার মানুষ, বন্ধু থেকে অবন্ধু, সহকর্মী থেকে সহমর্মী সকলের কাছে তো সম্ভব নয়, তবু যতটা পারা গেল, একটা পৌঁছানোর চেষ্টা ছিলো জলধির। জলধি শঙ্খ ঘোষ সংখ্যাটি যতো মানুষের হাতে পৌঁছেছে, অন্তত প্রতিজন এই দাবিটা করতে পেরেছেন যে ঠিক যেমনটি চেয়েছিলাম বা যেমন করে ভেবেছিলাম যে শঙ্খ ঘোষকে নিয়ে একটা সংখ্যা হোক, ঠিক তেমনই একটা সংখ্যা হয়েছে, এবং এটা জলধির জন্য অনেক আনন্দের, আশাবাদের। ভবিষ্যতে জলধি হয়তো আবারও কোন একজন লেখককে নিয়ে কাজ করবে। শঙ্খ ঘোষ সংখ্যাটি আমরা পর্যাপ্ত পরিমাণে ছাপিয়েছিলাম, কিন্তু আনন্দের বিষয় হচ্ছে, পাঠক এটাকে এতো ভালোবেসে গ্রহণ করেছেন যে এই মুহূর্তে প্রথম সংস্করণটি একেবারেই শেষ, আশা করছি খুব দ্রুতই দ্বিতীয় সংস্করণটি পাঠকের হাতে তুলে দিতে পারবো। একজন লেখককে পাঠককূল কতোটা ভালোবেসে গ্রহণ করতে পারে তা এই সংখ্যাটি করে বুঝতে পেরেছে জলধি। এটা জলধির জন্য আনন্দের এবং অনুপ্রেরণার । কাজটি করতে পেরে আমরা খুবই তৃপ্ত। যে ছোটখাটো ভুল-ভ্রান্তি আছে সেগুলো সংশোধন করে দ্বিতীয় সংস্করণটা বের করতে পারবো আশা করছি।
এমদাদ রহমান: দুই বাংলায়, লিটল ম্যাগ আন্দোলন কিছুটা কি স্থিমিত হয়ে এসেছে?
নাহিদা আশরাফী : এই প্রশ্নটার উত্তর দেওয়াটা খুব সহজ, আবার একদিকে খুব জটিল। জটিল এই জন্য যে এটা মেনে নেওয়া আমার জন্য খুব কঠিন, কিন্তু আবার যেহেতু সত্যটা মেনে নিতে হবে, কাজেই সত্যটা মেনে নিয়ে যেভাবে ভাবা যায় আর কী। আসলে সাহিত্যের যে সৃজনশীলতা, এটাকে দ্বিধাহীন চিত্তে গ্রহণ বা নবচিন্তা ও চেতনার অগ্নিস্ফুলিঙ্গের সঞ্চার, ব্যক্তি ও সামগ্রিক মূল্যবোধের যে মূল্যায়ন— এসব নিয়ে বা তারুণ্যের চিৎকারকে স্বাগত জানানো, মানে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাম্প্রদায়িক বৈষম্য ও শোষণের বিরুদ্ধ একটা শক্তি হিসেবে সাধারণত লিটলম্যাগ কাজ করে থাকে বা এই অবস্থানটাকে সে পরিস্কার করে বা সে তার সোচ্চার কন্ঠে এটা জানান দেয়; এবং এই জানান দেয়াটা, হ্যাঁ এই জানান দেয়াটাই কিন্তু মূলত একটা লিটল ম্যাগের বৈশিষ্ট্য বা লিটলম্যাগের প্রধানতম আচরণ হতে পারে। এই উপস্থাপনটাই তাকে আর সব কিছু থেকে আলাদা করে; কাজেই- যে কোনও সংঘাতে ও সংগ্রামে লিটলম্যাগটা হচ্ছে এমন একটা অস্ত্রাগার, যেখান থেকে যারা সত্যি সত্যি ছোট কাগজকে ভালোবাসেন, তারা নির্দ্বিধায় বা নিঃসংকোচে এগিয়ে যেতে পারে সেই অস্ত্রাগারের অস্ত্রকে কাঁধে তুলে নিয়ে। আচ্ছা, যেটা বলছিলাম, লিটলম্যাগ নিয়ে তো এই লড়াই নতুন কিছু না, আর এটা আমরা দেখে আসছি সেই তিরিশের দশক থেকে। এ অব্দি লিটলম্যাগের সংগ্রাম অন্তহীন, মানে সেই গানের মতো করে বলতে হয়— অন্তবিহীন পথ চলাই জীবন। থেমে যাবে কখনও, বন্ধ হয়ে যাবে, কখনও মুখ থুবড়ে পড়বে আবার কখনও শিরদাঁড়া উঁচু করে দাঁড়াবে। বুক টানটান করে দাঁড়াবে। তো যা-ই হোক, এসব নিয়েই চলছে। এখন যে প্রশ্নটা আমাদের সামনে দাঁড়াচ্ছে, সেটা হচ্ছে- দুই দেশের লিটলম্যাগের ভবিষ্যৎ কী? দুই দেশের লিটলম্যাগ কী হচ্ছে? মানে, যেটা হয় কী, জানেন, পুঁজিবাদের একটা খুব নির্মম আর নিষ্ঠুর চেহারা আছে। তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে, মানে স্রোতের সেই বিপরীতে দাঁড়িয়ে চলাটা, খুব কঠিন, খুবই কঠিন এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। আমরা বলছি না যে লিটল ম্যাগাজিন তিরিশের দশকে বা চল্লিশের দশকে, পঞ্চাশের দশকে যেমন ছিল এখনও তেমনই থাকবে। এটা থাকা সম্ভব না। সময়ের সাথে সাথে যে কোনও কিছুর চেহারা, পট পরিবর্তন হবে বা বদলে যাবে কিন্তু সেই বদলানোটা কতোটুকু? সেটা সময়ের স্রোতে গা ভাসিয়ে দেয়া নয় বা সেটা হ-য-ব-র-ল টাইপ কিছু নয়, বা ওরকম করে ভাবারও কিছু নেই। একটা নির্দিষ্ট জায়গাতে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বা বোমা নিক্ষেপ করে সেই জায়গাতে একটা বিস্ফোরণ তৈরি করাটা লিটলম্যাগের প্রধান কাজ। কিন্তু সেই জায়গাটা থেকে অনেকটাই সরে এসেছেন লিটলম্যাগ সম্পাদকরা। কারণ— একটা জিনিস কিন্তু আমরা এখন খুব গরমিল করে ফেলছি, যে-গড়মিলটা আমাদের ষাট, সত্তর দশক পর্যন্ত ছিল না— আমরা এখন সংকলক আর সম্পাদকের পার্থক্য ভুলতে বসেছি। হ্যাঁ, এখন খুব রুঢ় ভাষায় বলতে গেলে, আজকাল লিখে আর যখন খুব নাম করা যাচ্ছে না, তখন আমরা ধরেই নিচ্ছি যে ঠিক আছে, লেখার পাশাপাশি একটা ছোটকাগজ নামধারী মূলত আসলে ছোটকাগজের নামের আড়ালে ওটা এক ধরনের সংকলন আমি বলবো, বা সাহিত্য পত্রিকা, তো,— এই সাহিত্য পত্রিকা চালিয়ে নেই আর এখানে কিছু লোকজন গাদাগাদা লেখা পাঠাবে, মেইল ভরে যাবে লেখায়, হ্যাঁ, সেই লেখা কি হচ্ছে না হচ্ছে সেটা আমাদের দেখার বিষয় নয়, জানার বিষয় নয়।
সদরঘাট সংখ্যার বেশকিছু লেখা নিয়ে লেখকদের সাথে কথা বলছিলাম, বেশ কিছু কবিতা ফেরতও দিচ্ছিলাম;… কয়েকজন লেখক দেখলাম বেশ উন্নাসিক হয়ে উঠছেন যে কেন লেখা ফেরত দিচ্ছি। হ্যাঁ। এই যে, লেখকদের মধ্যে একটা উন্নাসিক ব্যাপার চলে এসেছে। নিজেদের বোঝার বাইরে আসলে আমরা আর কিছু বুঝতে চাচ্ছি না— এ ধরনের অনেকগুলো বিষয় ছোটোকাগজের সঙ্গে জড়িত হয়ে যায়। ছোটোকাগজ একটা ঐকতানের নাম, ঐক্যবদ্ধতার নাম, হ্যাঁ, ছোটোকাগজ একটা সম্মিলনের নাম, একটা সম্মিলিত প্রচেষ্টার নাম। সেই প্রচেষ্টাগুলো আমরা আসলে সব ভেঙে ভেঙে এখন আমরা সবাই, মানে… সেই অনেকদিন আগে একটা প্রবন্ধে বলেছিলাম যে বাংলাদেশ সরকার একবার ঘোষণা করেছিল— এক বাড়ি এক উঠোন। তো, এখন আমাদের হয়ে গেছে যে- একজন লেখক একটা সাহিত্য পত্রিকা এবং সেই সাহিত্য পত্রিকাকে আমরা আবার বেশ ঢাকঢোল পিটিয়ে নাম দিচ্ছি- ছোট কাগজ। যার ফলশ্রুতিতে কোনটা ছোটকাগজ, কোনটা সাহিত্য পত্রিকা, কে সংকলক, কে সম্পাদক- আমরা সব কিছু না জগাখিচুড়ি পাকিয়ে ফেলছি এবং সেটা উভয় দেশেই। উভয় বাংলা ভাষাভাষীর ক্ষেত্রে এই ঘটনাটা ঘটছে, যার জন্যে লিটলম্যাগের, আমার মনে হয়, লিটলম্যাগের যে মেজাজটা ছিল, যে-অহংকারটা ছিল, সেই অহংকারটায় কিছু আগাছা জন্মেছে। সেটা আমাদের কারণেই। তারপরও নিভু নিভু হয়ে যারা বাঁচিয়ে রেখেছেন তাঁরা অসম্ভব শক্তিশালী কাজ করছেন। সমস্ত সংগ্রামেই যখন ছোটকাগজ জ্বলে ওঠে, নিশ্চয়ই আশা করবো তেমনিভাবে আবার কোনও একটা সময়ে ছোটো কাগজের অদ্ভুত এবং অসম্ভব এক জাগরণ তৈরি হবে। মানুষ বুঝতে শিখবে। মানুষ জানতে শিখবে। এবং ছোটো কাগজ নিয়ে আরও চিন্তা ভাবনা করবে, ছোটো কাগজের এই নিরীক্ষা, এই যাত্রা, এই সংগ্রাম, এই বন্ধুর পথ দেখে মানুষ ভাবতে শিখবে যে ছোটোকাগজ খুব সহজ বিষয় নয়। ছোটোকাগজ এক ধরনের আত্মত্যাগের নাম। এক ধরনের আত্মনিবেদনের নাম। এই মুহূর্তে আমরা ছোটোকাগজ নিয়ে খুব সুবিধাজনক অবস্থানে নেই। আরেকটি বিষয়, অনেকেই এ প্রশ্নটা করে থাকেন যে ডিজিটালাইজেশনের প্রভাবে কি আমরা ছোটোকাগজ থেকে সরে আসছি? ডিজিটালাইজেশন পুরো বিশ্বকে হাতের মুঠোয় এনে দিচ্ছে সেখানে ছোটোকাগজের দৌড় তো অতদূর নয়। সে ঠিক আছে। এটা মানছি, কিন্তু— ওই যে-বই না ছুঁয়ে পড়া অনেকটা স্পর্শহীন অন্ধ হয়ে থাকার মতই। তাই বিশ্বাসটা রাখি, ছোটোকাগজ কখনোই তার আবেদন হারাবে না। আমরা একটা কঠিন সময় পার করছি। আশা করছি এ সময়টা পেরিয়ে আবার ছোটোকাগজ আলোর মুখ দেখবে।