২টি ছায়াছোট গদ্য । বদরুজ্জামান আলমগীর
প্রকাশিত হয়েছে : ১০ নভেম্বর ২০২৩, ৩:৩০ অপরাহ্ণ, | ৩৬৮ বার পঠিত
একফালি মায়ার দিকে
আকাশ যে হেলে পড়ে পশ্চিমের আকাশ আমি ভেবেই নিই যে-আকাশ হেলে পড়ে, পশ্চিমের আকাশ না হয়ে যায় না। কিন্তু আমার পাশে যে জ্যোতির্বিজ্ঞানী বসেছিলেন গোলাম রসুল— তিনি বললেন, তুমি যাকে পশ্চিমের আকাশ ভাবছো সে আসলে পূবের আকাশ। যারা দেশের বাইরে থাকে তারা এ ভুলটা হামেশাই করে কেননা, তারা সবকিছুই তাদের শৈশবের কম্পাসের সাথে, প্রাইমারি ইশকুলের মোড়ের সাথে মিলিয়ে দেখে।ঠিকাছে, পূব-পশ্চিমের এক্কাদোক্কার সমস্যা মিটে গেল; কিন্তু আজ হঠাৎ মনে হলো গাড়িওয়ালারা বেহুদা হর্ন বাজায়, এ ও-কে পাস করে যায়, ড্রাইভাররা ঠেক্কা দেয় একে অপরকে, মন বলে খুব অধৈর্য সবাই।আমি বলি, রব্বানী জানো আমার কী মনে হয়— এগুলো নেইভারহুড কালচার— ডারবিতে এমন হয়, তুমি ওয়েনে যাও— দেখবে একটি গাড়ি থেকে ভুল করেও হুঙ্কার দেয়া টু শব্দটি বেরুচ্ছে না;ব্যাপারটা আসলে আরও জটিল, অনেক ভিতরে ফজল— এদেশে ভিতরে ভিতরে ভয়ানক অর্থনৈতিক মন্দা চলছে, লোকেরা দেদারসে চাকরি হারাচ্ছে, ব্যবসা বসে যাচ্ছে, একের পর এক শপিং মল উঠে যাচ্ছে। অলক্ষ্যে এদেশ তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশ হয়ে গ্যাছে।
সবাই হন্তদন্ত কাজ থেকে, কাজের খোঁজ করে টায়ার্ড হয়ে বাড়ির দিকে যায়, আর গাড়ির মুখে মুখে সন্ধ্যা নামে।
অথচ আমরা এই অনিশ্চিত এক সন্ধ্যার মুখে বাড়ি ছেড়ে
একটি ছায়ার খোঁজে— দরজায় ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকা
একখণ্ড অভিবাদনের দিকে, একফালি মায়ার দিকে যাই।।
কাজাখ লোককথার নাপিত
অনেক বছর আগে পড়া একটি কাজাখ লোককথা
বড় মনে ধরেছিল আমার, এ সে—সব দিনের কথা—
সারাদুনিয়াকে মনে হতো একটা দুনিয়া— আমরা দুনিয়ার সবমানুষ পরস্পর খালাতো ভাই ফুফাতো বোন, কুটুম— বিলের জলে একঠ্যাঙে দাঁড়িয়ে থাকা বক, ইলেকট্রিকের খাম্বায় বাজতে থাকা শোঁশোঁকে মনে হতো হৃৎপিণ্ডের দাওয়াই, তখন যে সারাদুনিয়ার লোককাহিনী পড়ি, ঘুরে ঘুরে সিনেমা দেখি, মহাকাব্য পড়ি, তারমধ্যেই পড়েছিলাম এই কাজাখ লোকগল্প— এক জবুথবু নাপিত রাজার মাথার চুল কাটতে রাজদরবারে যায়, মহাশৃঙ্গ রাজাসনের পাশে দাঁড়িয়ে নাপিত চুল কাটতে লাগে, হঠাৎ দেখে কী— রাজা মানুষ নয়, দৈত্য আসলে, তার মাথায় দু’টি শিং। রাজা খুনের গলায় বলেন, শোন নাইপতা, আমার মাথার শিঙের কথা যদি কাউকে বলিস তো মুহূর্তে গর্দান যাবে!
ভেবে কূল পাই না কতবছর পর আমিই কীভাবে কাজাখ নাপিত হয়ে উঠি। আমারও পেটের ভিতর যাদের নুনভাত খাই তাদের ব্যাপারে একটি কথা খালি ঘুরপাক খায়, গুমলে গুমলে ওঠে, আমি দিগ্বিদিক ছুটতে থাকি, কিন্তু কোথাও বনের দেখা নাই— দাবদাহে, পুঁজির উন্মত্ততায়, মুনাফার পাপে বনভূমি ছারখার; আমি জানি, যদি গভীর জঙলায় একটি কুয়ার দেখা পাই- কুয়ার ভিতর হয়তো আমারই ছায়া, বা নোয়াম চমস্কির দেখা পাবো— মনে বড় আশা পাবো কুয়া এক, আর অতি সাবধানে বলবো— ইজরায়েল বলো, ফিলিস্তিন বলো— আমেরিকা, রাশিয়া, চীন কী ভারত বলো— তারা পরিপ্রেক্ষিতের দাস,
নাপিতের আইঢাই দশা— ঘুম নাই, খাওয়া নাই দাওয়া নাই— পেটের ভিতর কথাটি খালি চক্কর পাড়ে, কিন্তু প্রাণভয়ে কাউকে বলতে তো পারে না, কথা খালাশ করতে না পেরে
নাপিতের পাগলপারা দশা, কথাটা হাঁসফাঁস আটকে পড়ে নাপিতের পেট ফুলে ঢোল— বেদিশা নাপিত গভীর জঙ্গল পাথারে ছুট লাগায়, হঠাৎ দেখে কী— গহন জঙলার ভিতর এক নিরালা কুয়া— কুয়ার ভিতর নাপিত নজর করে চায়— দেখে জলের নিচে একটি তার মতই মানুষ; এবার নাপিত অতি সাবধানে চেপে চেপে বলে— রাজা মানুষ নয়, আদতে সে দৈত্য এক, তার মাথায় খাড়া খাড়া দুটি শিং— নাপিত যেই না মনের কথাটা বলে উঠতে পারে— তার পেট চুপসে আগের মতই স্বাভাবিক রূপাকার পায়।
দুনিয়ার অবস্থা ত্রাহি ত্রাহি, টালমাটাল প্রশান্ত মহাসাগরের পাড় তওরাত, বাইবেল, কোরান কথিত কেনান ভূমিজুড়ে মানুষের মৃত্যুতে কবরখানা সয়লাব, ছুটছে মানুষ, ছুটছে শিশু ও নারী, কার হাতে একলহমা সময় আছে যে একটু জিরাতে দাঁড়াবে? দৌড়াতে গিয়েই মনে হয়, পায়ের নিচে পাথর পড়েছে, না এ পাথর নয়— এ মানুষের মাথার খুলি, বা হাড়; কী মনে হয়, পথে পথে ঝড়ে অনেকগুলো গাছ পড়ে আছে, কিন্তু আসলে এরা মানুষ— গুলি ও বোমার আঘাতে ছিন্নভিন্ন মানুষ ; পথ এতো পিচ্ছিল কেন— জঙ্গলে, রাস্তায়, মোড়ে এতো জল কোত্থেকে এলো? না, এ জল নয়— মানুষের রক্তে মাটি এমন নরম এঁটেল, আর পিচ্ছিল হয়ে আছে।
ভেবে কূল পাই না কতবছর পর আমিই কীভাবে কাজাখ নাপিত হয়ে উঠি। আমারও পেটের ভিতর যাদের নুনভাত খাই তাদের ব্যাপারে একটি কথা খালি ঘুরপাক খায়, গুমলে গুমলে ওঠে, আমি দিগ্বিদিক ছুটতে থাকি, কিন্তু কোথাও বনের দেখা নাই- দাবদাহে, পুঁজির উন্মত্ততায়, মুনাফার পাপে বনভূমি ছারখার; আমি জানি, যদি গভীর জঙলায় একটি কুয়ার দেখা পাই— কুয়ার ভিতর হয়তো আমারই ছায়া, বা নোয়াম চমস্কির দেখা পাবো— মনে বড় আশা পাবো কুয়া এক, আর অতি সাবধানে বলবো- ইজরায়েল বলো, ফিলিস্তিন বলো— আমেরিকা, রাশিয়া, চীন কী ভারত বলো— তারা পরিপ্রেক্ষিতের দাস, তারা গোলাম, আসল মালিক— ঈশ্বরের জিভ, সুউচ্চ জিকিরে এককাট্টা লাফিয়ে ওঠে— মুনাফা, ও মুনাফা,
তার মূল কারখানা নিত্যনাম আমেরিকা, আমেরিকা।।