মোহন রায়হান: ইতিহাস মনোনীত কবি । আলমগীর নিষাদ
প্রকাশিত হয়েছে : ২৮ জুলাই ২০১৮, ১১:২৪ অপরাহ্ণ, | ২৬২৪ বার পঠিত
মোহন রায়হানকে দ্রোহ-সংগ্রামের কবি বলা হয়। এই অভিধা মোটেই অমূলক নয়। কিন্তু সমস্যা হলো, যখন বাংলা কবিতার রাজনৈতিক সচেতনতাকে এই স্টেরিওটাইপে মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়। ভাষা ও নৃজাতিত্বের বাইরে বাংলাদেশের বাঙালি জনগোষ্ঠী হলো পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ একটি ‘রাজনৈতিক জাতি’। এমন রাজনৈতিক জনগোষ্ঠীর শিল্পসাধনায় দীর্ঘদিন ধরে নজরুল, সুকান্ত থেকে স্বাধীনোত্তর মোহন রায়হানও এই মিসরিডিংয়ের শিকার হয়েছেন। প্রত্যক্ষ রাজনীতি-মিছিল-যুদ্ধ ও তীব্র রোমান্টিকতা যেন মানব জীবনের দ্বিতীয়-সত্য, তা যেন সম্পন্ন জীবন নয়। মুক্তিযুদ্ধে সৃষ্ট একটি জনগোষ্ঠীর এই শিল্পসিদ্ধান্ত খুবই পরিতাপের। দীর্ঘদিনের এই ট্যাবু ভেঙ্গে বাংলা কবিতার নতুন মূল্যায়ন দরকার। নইলে বাঙালি জনগোষ্ঠী তার আত্মা থেকে বিচ্ছিন্ন হবে, চ্যুত হবে জাতীয় চৈতন্যের ধারা থেকে।
বাঙালির রাষ্ট্রবাসনার ধারাবাহিকতায় মোহন রায়হানের কবিতা স্বাধীনোত্তর বাংলাদেশের জাতীয় আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে মূর্ত হয়েছিল। কেবল সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ নয়, মোহন রায়হানের কবিতার দ্রোহমগ্নতার উৎস আরো গভীরে। তিনি আমাদের আবহমান অস্তিত্ব সংগ্রামের দহন থেকে উঠে আসা ইতিহাসের অনিবার্য কণ্ঠস্বর। কীভাবে- সেটা বলছি। ১৯৭১ সাল হলো হাজার বছরের বাঙালি জীবনের এক অত্যুচ্চ জাগরণ কাল। আহমদ ছফার ভাষায় মহাসিন্ধুর কল্লোল। কিন্তু যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই সমাজকাঠামো পুনর্গঠনের প্রশ্নে দেখা দেয় বিরোধ। স্বাধীন বাংলাদেশে আবার অস্ত্র হাতে ঘর ছাড়ে একদল তরুণ। পুনরায় আর হলো না বাড়ি ফেরা, নিখোঁজ সংবাদ, জেলখানা থেকে ফেরা, গেরিলা কনভয়- প্রভৃতি অনুসঙ্গে চঞ্চল হয় দেশ। একাত্তরের মুক্তি সেনাদের এই বিবাদ বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ঘটনা। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী আমাদের সেই জাতীয় আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্নের স্বদেশ গঠনের ব্যর্থতার বিক্ষোভগুলি সক্রিয় কবি মোহন রায়হানের কবিতাকে ধারণ করে সেদিন মূর্ত হয়েছিল। একাত্তর সাল যেমন শামসুর রাহমানের ‘স্বাধীনতা তুমি’, ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’ কবিতার মধ্যদিয়ে উচ্চারিত হয়, মোহন রায়হানের ‘সাহসী মানুষ চাই’, ‘ফিরে দাও সেই স্টেনগান’ কবিতার মধ্য দিয়েও তেমনি স্বাধীনোত্তর বাংলাদেশের সংগ্রামাকাঙ্ক্ষা আত্মপ্রকাশ করে।
এই মিথষ্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অনুসন্ধান ছাড়া নিছক সমাজ বদলের হাতিয়ারপন্থী অথবা তথাকথিত কলাকৈবল্যবাদীর কাছে মোহন রায়হানের কবিতা সম্যক বুঝে ওঠা সম্ভব হয় না। আমাদের ইতিহাসকালের এক উজ্জ্বল মুহূর্ত ছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। হাজার বছর ধরে শাসকশ্রেণী থেকে বিচ্ছিন্ন বাংলাদেশের মানুষ কখনোই তার আপন ইতিহাসের নিয়ন্তা হতে পারেনি। যে কারণে স্বাধীনোত্তর সমাজ পুনর্গঠনের ব্যর্থতা আমাদের অস্তিত্বের মর্মমূলে দগ্ধ করে এক ভয়াবহ সংকট। মোহন রায়হান আমাদের সেই ব্যর্থতার জরায়ু থেকে জন্ম নেওয়া, অব্যবহিত সামরিক বুটের নিচে পিষ্ট বাংলাদেশের ইতিহাসের মনোনীত কবি। উপনিবেশ বিরোধী সংগ্রামে কাজী নজরুল ইসলামের ‘অগ্নিবীণা’, মুক্তিযুদ্ধে শামসুর রাহমানের ‘বন্দীশিবির থেকে’ এবং স্বাধীনোত্তর রাষ্ট্রীয় পুনর্গঠনের লড়াইয়ে মোহন রায়হানের ‘ফিরে দাও সেই স্টেনগান’ একটি জাতির একই রাজনৈতিক চেতনার ধারাবাহিক উচ্চারণ।
মোহন রায়হানের জীবনেতিহাস আসলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ইতিহাস। তাদের চোখের সামনে মুক্তিযুদ্ধের মতো বিরাট একটি আত্মপরিচয় ছিনতাই হয়ে যায়। এ সেই সময়, যখন জনগোষ্ঠী নিজেই রচনা করছে তার আওয়াজ। ‘একাত্তরের হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার’, অস্ত্র জমা দিয়েছি ট্রেনিং জমা দেইনি’ প্রভৃতি স্লোগানে প্রকম্পিত দেশ। এরই ধারাবাহিকতায় ‘ফিরে দাও সেই স্টেনগান’ একটি জাতির চেতনার ভেতর থেকে উঠে আসা বিপন্ন স্বর, যা মোহন রায়হানের কণ্ঠে ভর করে গর্জে উঠেছিল।
‘রেসকোর্সের সবুজ গালিচায় বিরহ কাতর
প্রেমিকের মতো জমা দিয়েছিলাম অজানা আশঙ্কায়
প্রিয়তম সেই হাতিয়ার;
ফিরে চাই, ফিরে চাই সেই স্টেনগান।রাখালের প্রিয় বাঁশীর মতন সারাক্ষণ
আগলে রেখেছি নয়মাস, ফুলথ্রু করেছি প্রতিদিন
কুমারী-খোঁপায় ফুল গোঁজার মতন সজ্জিত করেছি
গুলি ভর্তি ম্যাগজিন।
ফিরে চাই, ফিরে চাই সেই স্টেনগান।ফিরে দাও সেই স্টেনগান, ফিরে দাও সেই স্টেনগান
যে-চেতনার আলোকে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল এবং যে-চেতনার আলোকে রাষ্ট্রীয় পুনর্গঠনের সংগ্রাম আজও আমাদের চৈতন্যপ্রবাহে ক্রিয়াশীল, মোহন রায়হানের কবিতার মধ্যে বস্তুত সেই ভূমিষ্ঠ বাংলাদেশের তুরীয়সংগ্রাম চেতনার একটা গ্রহণ লেগেছিল। তখন চতুর্দিকে শুরু হওয়া ইতিহাসের পঁচন আর মানুষের ভেঙে পড়া প্রতিরোধে দগ্ধ কবি খুঁজে বেড়ান সাহসী মানুষ—
‘বুর্জোয়া অর্থনীতিকের ডাটা আমি দু’পায়ে মাড়াই-
কারা বলে ব্যর্থ মাটি, এই্ জল, ব্যর্থ এই মানুষ- লাঙ্গল?
এই্ শষ্যের বৈভরে খাদ্য ঘাটতির কথা আমি মানি না, মানি না।
সাম্রাজ্যবাদ আর তার বুকে লাথি মারি
আজ আমাদের শুধু সাহসী মানুষ চাই, শুধু সাহসী মানুষ চাই।‘সাহসী মানুষ চাই, জ্বলে উঠি সাহসী মানুষ
বাংলাদেশের সমকালীন কবিতার ইতিহাসে মোহন রায়হানের ভূমিকার শিল্পতত্ত্ব এখানে, কবিকে কখনোই তার সামাজিক অস্তিত্ব থেকে আলাদা করে না। অর্জিত প্রিয়তম স্বদেশের যে বিপন্নতা, গলিত জটিল আর্ত সময়ের বিরুদ্ধে তার কবিতায় মানুষের সেই প্রগাঢ় প্রতিরোধের ভাষার উপর্যুপরি নির্মাণ ঘটেছে। তার বোধের আদ্যন্তে ‘ঘাতকেরা ক্ষমতার কালো কেদারায় বসে রাইফেল তাক করে আছে আমাদের প্রতি’ (বসু, তোমাকে মনে পড়ে যায়/ ফিরে দাও সেই স্টেনগান)। সক্রিয় সংগ্রামের কবি হিসেবে মোহন রায়হান পৃথিবীর সেই সব বিরল কবিদের একজন, যিনি বাংলা কবিতায় মানুষের আবহমান সংগ্রামকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে নির্ধারিত সংগ্রামে উত্তীর্ণ করেছেন নতুন স্বদেশীয় ভাষায়। একই সাথে তিনি হাজির করেছেন কবিতার নয়া শিল্পতত্ত্ব।
‘তোমাদের লোভাতুর জিভ টেনে ছিঁড়ে নেব আমি আজ
অলীক উচ্চারণে যারা নিজেদের ভেবে থাকো কবি
ভূমিতে শিকড়হীন; যে বৃক্ষ বাড়েনি তার মূলের মাটিতে
সেই শিল্পতরু আজ আমাদের প্রয়োজন নেই।
আমাদের জীবনের জন্যে আজ শিল্প চাই, ফিরে চাই মাটির আঘ্রাণ
তপ্ত অঙ্গীকার বুকে নিয়ে আমি সেই শোভন আগুন আজ
ছড়াব সময়ে।তোমাদের মাথা থেকে দৃঢ় হাতে খুলে নেব কবির শিরোপা
তোমাদের মুখে আমি থুতু দিই, থুতু দিই, থুতু দিই
এতটুকু সম্মান দিতে আজ রাজি নই, মুখচোরা ভীরুটে শিক্ষক,
বেজন্মা-দালাল বুদ্ধিজীবী তোমার মাথার খুলি আমি
আঘাতে উড়িয়ে দেব।‘সাহসী মানুষ চাই, জ্বলে উঠি সাহসী মানুষ
এই নির্মাণ তার পক্ষে সম্ভব হয়েছে, কেননা তিনি ছিলেন যোদ্ধা-কবি। রণাঙ্গণের ম্যাগজিন আর কবিতার ম্যাগাজিন তার হাতে নেচেছিল সমান ছন্দে। তার সমকালে প্রকৃত কবির তিলক শোভা পেত কেবল প্রকৃত যোদ্ধার ললাটে।
মোহন রায়হানের রাজনৈতিক জীবনের পরিধির সামনে তার কবি-পরিচয়টি অনভিপ্রেতভাবে বারবার খণ্ডিত হতে চেয়েছে, যেখানে বাংলা কবিতার মূল সুরসন্ধান থেকে এক বিচ্ছিন্নতার ফাঁদ আমাদের জন্য ওঁৎ পেতে আছে। মোহন রায়হানরা এক সময় বাংলাদেশের ইতিহাসকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিল। সাহিত্যের সত্যের চেয়ে রাজনৈতিক সত্যকেই দিয়েছিলেন উর্ধ্ব-স্থান। এতদসত্বেও কবি পরিচয়ই মোহন রায়হানের একমাত্র সত্য। কেননা মোহনের কবি হয়ে ওঠার মধ্য দিয়েই বাংলাদেশ তার রাষ্ট্রীয় পুনর্গঠনের স্বপ্ন ও সংগ্রামকে উচ্চারণ করেছিল।
মোহন রায়হান তার প্রথম কবিতার বই ‘জ্বলে উঠি সাহসী মানুষ’ উৎসর্গ করেছিলেন ‘রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী পিতা ফরহাদ হোসেনকে’। এই উৎসর্গ পঙক্তির মধ্যে লিপিবদ্ধ আছে বাঙালির রাষ্ট্রবাসনার গোটা ইতিহাস, সমগ্র রাজনৈতিক অভিজ্ঞান। তার ‘জ্বলে উঠি সাহসী মানুষ’ থেকে ‘সামরিক আদালতে অভিভাষণ’, ‘আর হলো না বাড়ি ফেরা’, ‘ফিরে দাও সেই স্টেনগান, ‘নিরস্ত্রীকরণ কবিতা’ প্রভৃতি গ্রন্থে ধরা আছে বাংলাদেশের রাষ্ট্রসংগ্রামের প্রতিটি বাঁক, সমস্ত চড়াই-উৎড়াই, প্রত্যেক যোগ্য মুহূর্তের ধারণা। বাংলা কবিতার জাতীয় ইতিহাসে মোহন রায়হানের ভূমিকার অবিশেষ তাৎপর্য এখানে।