আওয়ামী রাজনীতি মোকাবিলায় ভ্রান্তি । আলমগীর নিষাদ
প্রকাশিত হয়েছে : ২১ জুন ২০১৮, ১০:৩৯ অপরাহ্ণ, | ২৪৩৩ বার পঠিত
বাংলাদেশের রাজনীতির একটা বড় সংকট হলো আওয়ামী লীগকে ডিল করতে না পারা। মওলানা ভাসানীর মতো মহীরুহ আওয়ামী লীগ পরিত্যাগ ও বিরোধিতা করে জাতীয় রাজনীতি থেকে হারিয়ে গিয়েছেন। অথচ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি হওয়ার হক নিয়ে তিনি জন্মেছিলেন। বিপরীত দিকে আওয়ামী লীগের পক্ষাবলম্বন ও সহায়তা করে সিপিবির মতো উদ্ভিন্নযৌবনা দলও আবেদন হারিয়েছে, যারা ছিল বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল হওয়ার দাবিদার।
পরিতাপের কথা, বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই ফ্যালাসি এখনো বহাল। এখনো আওয়ামী লীগের সঙ্গে যাওয়া আর না-যাওয়া এবং বিরোধিতা সমানভাবে দুরুহ। এদেশের কোনো রাজনৈতিক গোষ্ঠীই আওয়ামী লীগের এই পরিস্থিতিকে আমলে নিতে পারেনি। এটা আওয়ামী লীগের এক বিরাট শক্তির জায়গা, এখানে তাদের বাঁচোয়াও। এ কথা তো তারা প্রকাশ্যেই বলে, আওয়ামী রাজনীতি বিরোধিতাকারীদের শেষ পরিণতি হলো মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শিবিরে অধিষ্ঠিত হওয়া। আওয়ামী লীগ এই সুবিধা এখনো পুরোমাত্রায় গ্রহণ করে যাচ্ছে।
আওয়ামী লীগ ডিলিংয়ের ব্যর্থতার কারণ থেকে এদেশে অসুস্থ ভারত বিরোধিতা ও অসুস্থ ভারতপ্রেমের উদ্ভব ঘটেছে। বিকৃত পাকিস্তান বিরোধিতা ও বিকৃত পাকিস্তানপ্রেমও একই কারণে। বাংলাদেশের রাজনীতির প্রধান অকৃতকার্যতা হলো আওয়ামী লীগ মোকাবেলার পরিণতি হিসেবে বিএনপির জন্ম লাভ। বিএনপি যে আওয়ামী বিরোধী ক্ষমতার সিন্ডিকেট মাত্র, পলিটিক্যাল নয়, তা রাজনীতিবিজ্ঞানের কাছে পরিষ্কার। এই দলের জন্মলগ্নে আবদুল গাফফার চৌধুরীর মতো আওয়ামীপ্রেমী মানুষও সম্ভাবনা দেখেছিলেন। আহমদ ছফাও বিএনপির সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রাজনৈতিক হওয়ার সুযোগ বিএনপি গ্রহণ করেনি। এই দল সম্পর্কে বলা যায়, শেখ মুজিবুর রহমানকে অস্বীকার করার কেবল একটি পলিসির কারণেই তাদের রাজনীতি অঙ্কুরে মৃত্যুবরণ করেছে। আওয়ামী রাজনীতি বিরোধিতার আরেক লজ্জাকর পরিণতি হলো এদেশে জামায়াত রাজনীতির পুনর্জাগরণ। এসব সুবিধা রীতিমতো প্রকল্প আকারে গ্রহণ করে আওয়ামী লীগ তার ক্ষমতায় থাকার পক্ষে নৈতিক বয়ান তৈরি করে নিয়েছে।
কিছুদিন আগে খান আতাউর রহমানকে নিয়ে নাসির উদ্দিন ইউসুফের একটি বক্তব্যে বিরাট প্রতিক্রিয়া হলো। সেখানে নাসির উদ্দিন ইউসুফের রাজাকার শব্দের সহজিপ্রয়োগের ভুল ও বিপদ সম্পর্কে আলোচনার বদলে দেখলাম, দুর্বল চিত্ত ও বিতর্কিত ভূমিকার খান আতাকে গেরিলা বাচ্চু কমান্ডারের ‘বাপ’ প্রমাণের চেষ্টা করা হচ্ছে। অথচ নাসির উদ্দিন ইউসুফের এই বক্তব্য ধরে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের বহু অমীমাংসিত জট খোলার মহাযাত্রা শুরু হতে পারত। মুক্তিযুদ্ধে নাগরিকের ভূমিকার একটা টাইপ-বয়ান এদেশে প্রচলিত আছে, কিন্তু বাঙালি মুসলমানের রাষ্ট্রবাসনার পথ এতটা সরলরেখায় ছিল না। এই জটিল পথ পরিক্রমণের কারণেই একদা পাকিস্তান দাবির সোচ্চারকণ্ঠ শেখ মুজিবুর রহমান শেষপর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক হয়েছেন।
এ কথা সত্য ১৯৭১ সালে এদেশের এলিট সমাজের অধিকাংশই বিতর্কিত ভূমিকা পালন করেছেন। অনেকে যেমন পরিস্থিতির চাপে, নৈতিক দুর্বলতার কারণে শান্তি কমিটিতে গেছেন বা নিশ্চুপ থেকেছেন। অনেকে আবার সেখান থেকে মুক্তিবাহিনীকে সহায়তাও করেছেন। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ইতিহাস শুধু পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালির অস্ত্রধারণ আর ভারতের মৈত্রী- এতটুকুতে আটানো যাবে না। মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সংহতির পক্ষে খান আতার দস্তখতওয়ালা একটি বিবৃতিপত্রে মুনীর চৌধুরীর নাম থাকার পরেও, মুনীর চৌধুরীর স্থান হয়েছে শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকায়। আহসান হাবীবও হয়েছেন পূর্ববাংলার কবিতার স্বতন্ত্র আত্মপরিচয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সরকারের সংবাদপত্রে কাজ করেও শামসুর রাহমানের বুক হলো বাংলাদেশের হৃদয়। এসব টেক্সেটের পাঠ নির্মাণ হয়নি। মুক্তিযুদ্ধে নাগরিকের ভূমিকার এই অধ্যায়ের আলোচনা মাঝপথে থামিয়ে আমরা পঞ্চাশ বছর অতিক্রম করে ফেলেছি।
আবার, স্বাধীনতাযুদ্ধে প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকারী বিরাট গোষ্ঠী দাগ লুকিয়ে পুনর্বাসিত হয়েছে। অনেককে আমরা নিজেরাই মাফ করে দিয়েছি, অনেককে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে হয়েছে। অনেক কিছু ভুলেও গেছি। জানতেও পারিনি কীভাবে একজন সেনা কর্মকর্তা মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত থেকেও বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান পর্যন্ত হয়েছেন। এমন বহু আলোচনা বকেয়া আছে। ইতিহাসের স্বার্থে এসব প্রসঙ্গের মীমাংসা হওয়া দরকার। অথচ, নাসির উদ্দিন ইউসুফের বক্তব্য ধরে এসব বকেয়া প্রশ্নের উত্তর খোঁজার বদলে একজন অবিমৃষ্যকারী বললেন- খান আতা তোর বাপ হয়। আর অনেকে তাকে আসল নায়ক বলে হাততালি দিলো।!
আমরা খান আতার প্রতি নাসির উদ্দিন ইউসুফের নিষ্ঠুরতার বিরোধিতা করতে পারি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, নাসির উদ্দিন ইউসুফের সমালোচনাকারীদের মধ্যে আমি ছুঁপা রাজাকারের জেগে ওঠাই দেখতে পেলাম। এই হলো বাংলাদেশে আওয়ামী রাজনীতি বিরোধিতার পরিণতি।
মুক্তিযুদ্ধে শেখ মুজিবুর রহমানের স্ট্র্যাটেজির পাঠনির্মাণ করা হয়নি আজো। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে পাকিস্তান আপ্রাণ চেষ্টা করেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামকে বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রকল্প হিসেবে হাজির করার। এ ধরনের প্রচেষ্টার একটা উদাহরণ হলো- আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। বাংলাদেশ আন্দোলনকে বিচ্ছিন্নতাবাদী তকমা দিতে পারলে পশ্চিম পাকিস্তান বৈধভাবে সামরিক আক্রমণ পরিচালনা করতে পারত। অন্যদিকে, ভারত বারবার চেষ্টা করেছে বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করুক। যাতে সামরিক অভিযানের মুখে পূর্ব পাকিস্তান স্বেচ্ছায় ভারতের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। এ ধরনের প্রচেষ্টার উদাহরণ হলো- সিরাজুল আলম খানদের স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য শেখ মুজিবকে জোরাজুরি করা। কিন্তু শেখ মুজিব এ দুই তরফের প্রচেষ্টাকে বিচক্ষণতার সাথে মোকাবিলা করেছেন। শেখ মুজিবের এই নিয়মতান্ত্রিক স্ট্র্যাটেজির কারণে পাকিস্তান পূর্ববাংলা আক্রমণ করামাত্রই মুক্তিযুদ্ধ আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায় করতে সক্ষম হয়। পৃথিবীর কোনো গেরিলা বাহিনীই এত দ্রুত মুক্তিবাহিনী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। শেখ মুজিব ক্ষমতার সব রকম নৈতিক বৈধতা আদায় করে নিয়েছিলেন। তার এ পলিসির কারণে স্বাধীনতার আগেই পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মনে বাংলাদেশের মাত্রচিত্রের অভ্যুদয় ঘটে।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। এতে গোটা পাকিস্তান রাষ্ট্রের ম্যান্ডেট আওয়ামী লীগ অর্জন করে। তাই রাজনৈতিকভাবে পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্ন হতে চাওয়া বা স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার প্রশ্নটি অবান্তর ছিল। ‘যুদ্ধদিনের কথা ১৯৭১’ বইয়ে মহিউদ্দিন আহমদ লিখেছেন, ‘তিনি (শেখ মুজিব) মনে করতেন, তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের নেতা। তিনি কেন বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে পরিচিত হবেন? তিনি জানতেন, তাঁর অনুপস্থিতিতে স্বাধীনতার লড়াই চলবে। এটি চলেছেও। সমঝোতার মাধ্যমে পাকিস্তানে একটি কনফেডারেশন হলেও পরে বাংলাদেশ আলাদা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হতো, এই বিশ্বাস তাঁর ছিল। বঙ্গবন্ধু যদি স্বাধীনতা ঘোষণা করতেন, তাহলে কী হতো? এ নিয়ে অনেক আলোচনা ও বিতর্ক হতে পারে। পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে মনে হয়, তাঁকেও অন্যদের সঙ্গে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে যেতে হতো। এটি তিনি চাননি। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা চেয়েছিলেন তারঁ নিজের শর্তে, তাঁর নিজের ক্ষমতায়।‘
শেখ মুজিবুর রহমান ভারত ও আমেরিকার কাছে কখনো সুবোধ ছিলেন না। কেননা মুজিবের জননেতার গরিমা ছিল। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে একজন জননেতার বদলে ভারত-আমেরিকার দরকার ছিল ব্যুরোক্র্যাটিক সরকার। তাই শেখ মুজিবের হত্যার গল্পটি মোটেই সরলরৈখিক নয়।
শেখ মুজিব ভালো করেই জানতেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার লড়াইয়ে ভারতের সহায়তার বিকল্প নেই। কিন্তু পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্নতার ঘোষণা বাংলাদেশকে ভারতের তাবেদার রাষ্ট্রে পরিণত করবে। বাঙালি মুসলমান একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র চেয়েছে বলেই হাজার মাইল দূরের পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। পাকিস্তানের অধীনতামুক্ত ও ভারতের নিয়ন্ত্রণের বাইরে এক সার্বভৌম বাংলাদেশই চেয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। সেই নীতি ও কৌশলেই তিনি শেষ পর্যন্ত চলেছেন। কিন্তু পাকিস্তান আমাদের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিলে পায়ে হেঁটে ভারতের মাটিতে আশ্রয় ।ভিক্ষা করা ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের আর কোনো উপায় ছিল না। স্বাধীনতার পরে দেশে ফিরে বৈদ্যুতিক দ্রুততায় শেখ মুজিব ভারতের সেনাবাহিনীকে ফেরত পাঠিয়েছিলেন, পৃথিবীর ইতিহাসে যা নজিরবিহীন। কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মপ্রক্রিয়া ও ভৌগলিক অবস্থানের মধ্যেই আছে ভারত কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হওয়ার নিয়তি। ফলে এককভাবে আওয়ামী লীগের ভারতের বশংবদ হওয়ার প্রচারণা একটি একাত্তরীয় পাকিস্তানপন্থী প্রপাগান্ডা। শেখ মুজিবের মৃত্যুর পর ডানপন্থী হিসেবে পরিচিত জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ক্রমিক ক্ষমতারোহন যে ভারতের আগ্রহের বাইরে ঘটেনি তা রাজনীতির ছাত্র মাত্রেই ভালো করে জানেন। ভারতের নিয়ন্ত্রণে বাইরে থাকার উপায় স্বাধীনোত্তর বাংলাদেশের ছিল না, এখনো নেই। তবে তাজউদ্দীন আহমদের মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পরা ইত্যাদি ঘটনাকে শেখ মুজিবের ভারত-রুশ প্রভাব নিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টার একটা উদাহরণ হিসেবে দেখা যায়।
রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ঠিকুজি জানা তাই জরুরি। কিন্তু গত পঞ্চাশ বছরেও আমরা সে চেষ্টা আমরা করিনি। দলটির উদ্ভব, বিবর্তন, রূপ পরিগ্রহণ এবং এর চরিত্র ও শক্তির উৎস সম্পর্কে সম্যক ধারণা ছাড়াই আমরা বাংলাদেশের রাষ্ট্র-রাজনীতি পরিবর্তনের কাণ্ডজ্ঞান বিতরণ করছি!
গত শতকের চল্লিশের দশকে যখন সমগ্র ভারত কংগ্রেস-মুসলিম লীগে বিভক্ত হয়, তখন বাংলার প্রধান রাজনৈতিক দল ছিল কৃষক প্রজা পার্টি। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে শেরেবাংলা একে ফজলুক হকের কৃষক প্রজা পার্টি বিপুল আসন পায়। সে সময় মুসলিম লীগ জমিদার স্বার্থরক্ষার দল বলে ফজলুল হক প্রাদেশিক কংগ্রেস নেতা শরৎচন্দ্র বসুর কাছে গিয়েছিলেন কোয়ালিশন সরকার গঠনের প্রস্তাব নিয়ে। শরৎ বসুও তাতে সম্মত হন। কিন্তু মহাত্মা গান্ধির চানক্যনীতির কাছে এ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। ফলে মুসলিম লীগের সঙ্গে মিলে সরকার গঠন করে মুখ্যমন্ত্রী হন ফজলুল হক। সে সময় তিনি পরিতাপ করে বলেছিলেন, আমার কংগ্রেসি বন্ধুরা যত হিন্দু হলেন আমি ততই মুসলমান হলাম।
এর কয়েক বছরের মধ্যে কৃষক প্রজা পার্টি কর্পূরের মতো মুসলিম লীগে বিলীন হয়ে যায়। বাংলার রাজনীতির প্রধান তিন স্তম্ভ শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯৩৭ সালে মুসলিম লীগে যোগ দেন। সে বছরই মুসলিম লীগে যোগ দেন আবুল হাশিম, কাছাকাছি সময়ে সক্রিয় হন মওলানা আকরম খাঁ। ভারত ভাগের প্রাক্কালে ঐতিহাসিক প্রয়োজনে কৃষক প্রজা পার্টিসহ বাঙালি মুসলমানের সব রাজনৈতিক গোষ্ঠীরই এই রূপান্তর ঘটে। যে কারণে ১৯৪৭ সালে এই মুসলিম লীগ পুনরায় শরৎ বসুর সঙ্গে মিলিত হয়ে অখণ্ড বাংলা গঠনের চেষ্টা করে। জিন্নাহর কাছ থেকে তারা অনাপত্তিও আদায় করেছিল। কিন্তু এবারও গান্ধির কূটনীতিতে সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়। সে সময় প্রাদেশিক হিন্দু মহাসভার মুখপাত্র শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এর বিরুদ্ধে শোর তোলেন। তার দাবি ছিল, বাংলা অখণ্ড রাষ্ট্র হলে মুসলমানরা হিন্দুদের কোনঠাসা করে ফেলবে। ফলে শক্তিশালী রাষ্ট্রের নাগরিক হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় বাংলাদেশ পাকিস্তানেই যোগ দেয়। আর পাকিস্তান গঠিত হওয়ার অব্যবহিত পরে দলটি আওয়ামী লীগে রূপান্তরিত হয়। কৃষক প্রজা পার্টি থেকে মুসলিম লীগ, মুসলিম লীগ থেকে আওয়ামী লীগ- এই হলো বাংলাদেশের মানুষের রাজনৈতিক ইতিহাসের পরিক্রমণ। দেখা যাচ্ছে, এই দল-বংশের ভূমিকা এমন, জনগোষ্ঠীকে তারা প্রকৃত পথনির্দেশনা দিতে পারেনি কিন্তু বাঙালি মুসলমান যখন যে আকাঙ্ক্ষায় একাগ্র হয়েছে, তারা নিজেদের তখন সেই দলে রূপান্তরিত করে নিয়েছে। এটাই আওয়ামী লীগের জিনগত তাকত। ফলে এই দলকে মোকাবিলার জন্য প্রয়োজন যথোপযুক্ত শেলাস্ত্র। যা বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দল অর্জনের কথা ভাবেনি।
শেখ মুজিবুর রহমান ভারত ও আমেরিকার কাছে কখনো সুবোধ ছিলেন না। কেননা মুজিবের জননেতার গরিমা ছিল। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে একজন জননেতার বদলে ভারত-আমেরিকার দরকার ছিল ব্যুরোক্র্যাটিক সরকার। তাই শেখ মুজিবের হত্যার গল্পটি মোটেই সরলরৈখিক নয়। শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের উপলক্ষ্য যে কয়েকজন বিপথগামী সেনা কর্মকর্তার উষ্মা নয়, এ কথা আদালতের পর্যবেক্ষণেও আছে। কিন্তু কী সেই বিভূঁই ষড়যন্ত্র? তা অনুসন্ধান করার পরিস্থিতি হয়তো আমাদের এখনো আসেনি।
তবে এটা ভাবা অমূলক হবে না, মুজিব হত্যার পর শুরু থেকেই জিয়াউর রহমানের ওপরেই বাজি রেখেছিল মাস্টারমাইন্ডরা। ওই সময় জিয়ার পাদপ্রদীপে আসা আকস্মিক নয়। খেয়াল করলে দেখবেন, ৭ নভেম্বরে কর্নেল আবু তাহের জিয়াউর রহমানের নামে স্লোগান দিয়ে সমাজতন্ত্র কায়েম করতে চেয়েছিলেন। তাহের কী এতটাই রাজনৈতিক হতবুদ্ধি ছিলেন? ব্যাপারটা কী আসলে এত নিরীহ? জাসদের কর্মপরিকল্পনা ও পরিধিতে সিআইএসহ উপমহাদেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলির বিচরণের খবর গবেষকদের কাছে এখন আর অজানা নয়। ঊনসত্তরে গণঅভ্যুত্থানের সাফল্যের পর মওলানা ভাসানী যেমন চীনের পরামর্শে সত্তরের নির্বাচন বর্জন করেছিলেন, অনুমান করা যায় রহস্যময় কর্তৃপক্ষের পরামর্শে জাসদও ৭ নভেম্বর জিয়াকে অবলম্বন করে বিপ্লব করতে চেয়েছিল। নইলে খন্দকার মোশতাক সরকারকে উচ্ছেদকরা খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে জাসদকে কেন আখেরি অভ্যুত্থানে নামতে হলো? এ কথা বলতেই হবে, তাহেরের ভাগ্য ভালো যে তিনি জিয়ার হাতে নিহত হয়েছেন, নইলে বাংলাদেশের ইতিহাসে তিনি খলনায়ক হিসেবে বিবেচিত হতেন।
আওয়ামী লীগের রাজনীতির এইসব মর্ম বুঝতে পারা বাংলাদেশের বামনরাজনীতির পক্ষে দুষ্কর। আমাদের বামপন্থীদের এক অংশ আওয়ামী লীগ মোকাবিলা করতে গিয়ে বিএনপি হয়েছে। আরেক অংশ স্বাধীনতাবিরোধী রুখতে আওয়ামী লীগার বনেছে। আর যারা আওয়ামী লীগ-বিএনপি এড়াতে সক্ষম হলো, তারা বাঙালি মুসলমান সমাজের চৈতন্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তাদের রাজনৈতিক সম্ভাবনা নস্যাৎ করেছে।