৫টি কবিতা : বদরুজ্জামান আলমগীর
প্রকাশিত হয়েছে : ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৪:৪৫ পূর্বাহ্ণ, | ৬০ বার পঠিত
|| আমি বলতে পারিনি ||
আমি বলতে পারিনি আমি বাস থেকে
লাফিয়ে পড়েছিলাম
কারণ বাসটি চলছিল, আমার বাচ্চাটা কোলে
আমি তা জানতাম না। আমি আমার নিজস্ব
গল্পে সেঁটে থাকি:
আমি হড়কে পড়েছিলাম, অথবা এমন হতে পারে
যেই আমার পা বাড়িয়েছি— বাস চলতে শুরু করে
মনে পড়ে না যে, আমার চোয়াল শক্ত করে রেখেছিলাম
ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ছিলাম, মনে হচ্ছিল— আমার বাসস্ট্যান্ড পার হয়ে যাবে।
হাত ফসকে বাচ্চাটা বাতাসে ভাসতে থাকে
আমি ছিটকে পড়ে হাঁটু থেঁতলে ফেলি
গোড়ালি মচকে যায়
বাস ঘুন্নি খেতে থাকে, ড্রাইভার হুড়মুড়িয়ে লাফিয়ে নামে
আমার মেয়েটি খিলখিল করে হাসে-
আবার এমন করো, এমন করো!
জীবনেও তা আবার করিনি
আমি ভীষণ সাবধানী হয়ে উঠি।
এই এক তরুণী, হয়ে ওঠা জননী— খানিক লাফে
চলতি বাস থেকে নামে
নির্ধারিত স্থির রাস্তায় পা রাখে—
হাতের বেড়ে একটি ছোট বাছা, জীবনের কোলে জীবন।
Sharon Olds : I could not tell.
|| জননাঙ্গ বদলানো চিকিৎসকের অপারেশন কামরার বাইরে ||
জননাঙ্গ বদলানো চিকিৎসকের অপারেশন
কামরার বাইরে
একটি পাত্রে কিছু লিঙ্গ রাখা আছে।
একদম সাফসুতরো— রক্তের দাগ নেই। এ ভিয়েতনাম, চিলি, বুকেনওয়াল্ড নয়।
এলাকাটা অবশ করে ওদের অস্ত্রোপচার করে নামিয়ে আনা হয়েছে।
ওরা পরস্পর নিপাট সামাজিক দূরত্বে শোয়া।
এনেস্থিসিয়ার ধাক আস্তে আস্তে কমে আসছে। রূপালি পাত্রের উপর লিঙ্গের মুথাগুলো পড়ে আছে।
একজন বলে, আমি হাতিয়ার এক, আমাকে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে,
ভালোই হলো— মারামারি কাটাকাটির একটা কিনারা হোক।
একজন বলে, আমি এক বুড়াআঙুল, বিকট যাঁতিকলে কাটা পড়েছি।
হাওয়ায় ঢলে সবুজ ডগা, আমার আর কাজ ঠেলতে হবে না।
তিন নম্বরের বুলি— আমি মুখের ঠুলি কাপড়— সরিয়ে ফেলানো হয়েছে। এবার সে দিব্যি চারপাশ দেখতে পারে।
চতুর্থটি বলে, আমার ইচ্ছা জেরিকো আমাকে আঁকুক,
ব্রাশের পোঁচে জড়জীবন— অ্যাপোলোর মাথা,
ছোট বাণ্ডিল আইভির পাতা।
পঞ্চম জনে কয়, আমি ছিলাম ছোট নোংরা কুকুর,
আমি জানতাম
সে আমাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে পারতো।
ছয় নাম্বার জনের জবান— আমি বিপদমুক্ত। আমাকে আর কেউ জখম করতে পারবে না।
কেবল একজনকে দেখি অসুখী ভীষণ, বিধ্বস্ত
শুয়ে শুয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে— বাবা, বাবা!
Outside the operating room of the sex-change Doctor.
|| আগুনের কাজ ||
শীতকালে কোন জরাজীর্ণ ভাঙাচোরা দালানের
পাশ ঘেঁষে যাবার সময়
তুমুল হিমে জমাট আবর্জনা থেকে উঠে আসা দুর্গন্ধ
ঠিকই বুঝে ওঠে— আমি ওদিকটা মাড়াচ্ছি না।
আমি ফুলকপি আর ডিম্বাকার মাশরুমের সাথে
মাটিতে শুয়ে থাকবো না— যাতে মনে হবে
আমার নাভিমূল থেকে পুঁই মেলে একটি উঠতি ভ্রূণ
ধীরে মুখ বাড়িয়ে ধরছে,
আমার মুখমণ্ডল জলসিঞ্চনে পূত করে তোলে
আমার ক্যালভিনি তরিকার ঠোঁট— ছোট ব্রোকোলি
তরতাজা ফুটে ওঠে, চুল তরতরিয়ে বাড়ে
নখ বেড়ে বেড়ে রূপ নেয় নখরের
এভাবেই আমার কবরের ভিতর কিছু না কিছু
অবিরল নড়েচড়ে।
পোকামাকড় যদি ঈশ্বর হতো—
তারা আমার দেহমর্মে মৃদু লয়ে লাফিয়ে উঠতো
আর তাতে মূর্ছিত হতো সঙ্গীত।
আমি একদম কাছ থেকে
শারীর রূপান্তরের এই রসায়ন দেখেছি
রাত ভ’রে আমার বাবার অদলবদল আমি ধরেছি।
অতঃপর আমি আমার নিজেকে আগুনে পুড়াতে যাচ্ছি
আমি আমার দেহ বিলিয়ে দিতে যাচ্ছি
আগুনের বিস্তারে,
সবকিছু গোটানোর ভিতর যন্ত্রণা টেরই পাবো না আমি।
করোটির চারপাশে আমার চুল পটপট আওয়াজ তোলে
আমার পকেটে তখনও এককোয়া রসুন—
আমি নির্মাণে মিলে যাচ্ছি আগুনে।
আমি জানি হাঁপরে কী ঘটে,
মাত্রাধিক উত্তাপে কনুইয়ের ট্যান্ডনে টান পড়ে—
মৃত আমি, ভাবি তা-ও : হাত গুটিয়ে উঠে দাঁড়াই,
এগিয়ে যাই বুক বেঁধে মুষ্ঠিযোদ্ধা এক।
Sharon Olds : By Fire.
|| আমি বলতে পারি না আমি করিনি ||
আমি বলতে পারি না আমি জন্মানোর কথা বলিনি
মায়ের আকর্ষণীয় চেহারার কাছে বলেছি
তার টাকাপয়সার কাছেও বলেছি আমি।
আমি বাবার কামনার কাছে বলেছি
বলেছি যেন তার শুক্রাণু সক্রিয় হয়ে ওঠে
আর মায়ের টাকাপয়সা তো আছেই।
আমি দোলনার কাছে বলেছি
যে দোলনায় আমার বড়বোন শুয়ে বসে বড় হয়ে উঠেছে।
আমি মায়ের পুত্রসন্তানের জন্য যে উতলা ভাব
তার কাছে বলেছি।
আমি পুরুষতান্ত্রিকতার কাছে বলেছি
মায়ের দুধ ঠসঠসে স্তনের কাছে বলেছি
যে-মাই থেকে উজানো দুধ বের করে নিতে হয়,
জামাটি মেঝের উপর পড়েছিল
আমি আমার বোনের ওই জামার কাছে বলেছি।
আমি জ্যামিতির কাছে বলেছি
বলেছি কাগজের ফুল আর নৌকার কাছেও
সাঁতার কাটা, সেলাইয়ের ফোঁড়
আমার মন সম্ভাব্য যা যা করতে চাইবে
তাদের সবার কাছে বলেছি।
আমার বাচ্চাকাচ্চা লতাসত্তর— আহলাদে তাদের বলেছি
বাচ্চাদের বাচ্চা, তাদেরও বাচ্চাদের কাছে আমি বলেছি।
আমি কী আমার ছোটমোটো ফুসফুসকে বলেছি—
সে যেন বেশি বেশি বাতাস টানে?
আমি কী মাটির কাছে খানিকটা জায়গা চেয়েছি
যেন আমার প্রাণহীন দেহ একটু আরামে জিরোতে পারে?
মাটির দেহ মাটি থেকে উঠে আবার
মাটি বসতির দিকে নামে।
Sharon Olds : I can not say I did not.
|| নিরাময় ||
ওর জ্বর আসেনি, কিন্তু মনে হচ্ছিল
একদম কাবু হয়ে আছে, ফ্যাকাশেও লাগছিল
বিছানার উপর বসে আছে ও,
পরনের টি-শার্ট দলামোচা, রিডিং গ্লাসেরও তাল নাই,
গলার ভিতরটা জ্বালাপোড়া করছে, তারমধ্যেও কেমন
একটা উড়ো উড়ো ভাব— গতরাত থেকেই ফুরফুরে।
আমি রান্নাঘরের দিকে হেঁটে যাচ্ছি— কেমন অচেনা নীরবতা
মাত্র যাচ্ছি ওদিকটায়, কিন্তু মনে হচ্ছে অনেকক্ষণ ধরে
আমি আছি ওখানে।
বোয়াম খুলতে যাই— পারি না
হাত কেমন অবশ লাগে, হাঁটুও বুঝি আমাকে আর
ধরে রাখতে পারছে না— অস্বস্তি হচ্ছে
হাঁটুতে একদম জোর পাচ্ছি না। টেবিলের উপর থেকে
আমি সবচেয়ে ঘরোয়া ধরনের ছোরাটা হাতে নিই—
আমাদের ঘরে এই ছোরা পঁচিশ বছর ধরে আছে,
আমি বোয়ামের মুখের ছোট মাথাটি
খানিক ঘুরিয়ে খুলতে পারি— ভিতরে ঘন খয়েরি মধু
বোয়ামের উপরে ছোট কর্কের একটি বোঁটা
তারপর আরও একটি।
আমার চকিতে মনে হলো— আরে, ব্যাপারটি তো এমনই-
বোঁটার ছোট মাথা কাপড়ে ঢাকা—
এই কাপড় বুনেছে মৌমাছি তাঁতি,
স্তনে উদ্ভাস আছে, আছে আমন্ত্রণও
মৃদু তারা জরি রাঙতায় ফুটে থাকে— যেখানে দুধের মজুদ
মধুও থাকবে চাকবেঁধে একদিন—
শিশুমুখ আহারে টানে,
পাকা কারবারি সেখানে ডাকাতি করতে নামে
আমার প্রাণ চমকে চমকে কেঁদে ওঠে
এভাবেই আমরা দুজনে একটি আঁতুড় ঘরের দিকে যাই—
একটি নয়া শিশু আমাদের নামে ইতিউতি কেঁদে ওঠে।
Sharon Olds : The Remedy.
শ্যারন ওল্ডস।। শ্যারন ওল্ডস— এর কবিতায় শরীর থাকে কেন্দ্রে, থাকে শিহরণ ও আত্মমেহনের গ্র্যাফিটি। কামই নির্ধারণ করে প্রার্থনার ব্যাকরণগুলো ; তাঁর কবিতায় শরীর এক প্রত্ন যাদুঘর- তিনি এর নানা বাঁক, মোড় ও আড়াল থেকে যাদুকরের দক্ষতায় দেখান একাধিক স্ফূরণ আর প্রভা, প্রণতি ও ছোরা। প্রত্ন, ইতিহাস এবং নন্দনের শারীর বৈঠকী পাঠককে এক বীজধানের ওঙ্কারের দিকে আহবান করে। কখনো তাঁর কবিতা রাজনৈতিক রূঢ় চালচিত্রও অঙ্গীভূত করে। কবিতার কাছে সময়ের যে মৌল দাবি- তা তিনি এক ঝুঁকিপূর্ণ মুন্সিয়ানায় বিন্যস্ত করে তোলেন। শ্যারন ওল্ডসের একটি বই স্ট্যাগ’স লিপ সম্পর্কে আরেক অনন্য কবি ক্যারল অ্যান ডাফি বলেন : এটি ওঁর কবিজীবনের অনন্য মাইলফলক একটি বই। এখানে আছে শোভনতা, সেইসাথে এক নিজস্ব বেদনার আর্তি— যা তাঁকে দুনিয়ার সেরা কবিদের একজন করে তুলেছে। কবিতা হচ্ছে মানবজীবনের এক অন্তঃশীলা সঙ্গীত— এটি ওল্ডসের কবিতায় দারুণভাবে উপস্থিত।
এই শরীর বন্দনাকারী কবি জন্মেছিলেন ১৯ নভেম্বর ১৯৪২ সনে স্যানফ্রানসিসকো, ক্যালিফোর্নিয়ায়।
বদরুজ্জামান আলমগীর: কবি, নাট্যকার, অনুবাদক। জন্মেছেন ভাটি অঞ্চল কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে। পড়াশোনা বাজিতপুরে, পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বহুদিন দেশের বাইরে— যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ায় থাকেন।
বাঙলাদেশে নাটকের দল— গল্প থিয়েটার— এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য; নাট্যপত্রের সম্পাদক। নানা পর্যায়ে আরও সম্পাদনা করেছেন— সমাজ ও রাজনীতি, দ্বিতীয়বার, সাংস্কৃতিক আন্দোলন, পূর্ণপথিক, মর্মের বাণী শুনি, অখণ্ডিত।
প্যানসিলভেনিয়ায় কবিতার আসর— সংবেদের বাগান-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।
প্রকাশিত বই—
আখ্যান নাট্য : নননপুরের মেলায় একজন কমলাসুন্দরী ও একটি বাঘ আসে। আবের পাঙখা লৈয়া।
প্যারাবল : হৃদপেয়ারার সুবাস।
কবিতা : পিছুটানে টলটলায়মান হাওয়াগুলির ভিতর। নদীও পাশ ফেরে যদিবা হংসী বলো। দূরত্বের সুফিয়ানা।দূরত্বের সুফিয়ানা।
ভাষান্তরিত কবিতা : ঢেউগুলো যমজ বোন।
জালালউদ্দিন রুমি’র কবিতা : মোরাকাবা ও জলসংগ্রহ।
ছিন্নগদ্য : সঙ্গে প্রাণের খেলা।
প্রকাশিতব্য নিবন্ধ : আশ্চর্য বতুয়া শাক ও কাঁচা দুধের ডিসকোর্স।