গণ আন্দোলনে গুজবের ভূমিকা । আলমগীর নিষাদ
প্রকাশিত হয়েছে : ১৪ জুন ২০১৮, ১২:৪৫ অপরাহ্ণ, | ২৩৬৭ বার পঠিত
ফরাসি বিপ্লবের উৎসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল গুজব। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধেও গুজবের উপস্থিতি লক্ষণীয়। পাক বাহিনীর মধ্যে ভীতি সঞ্চার ও সাধারণ মানুষের মনোবল বৃদ্ধিতে এর ভূমিকা ছিল অপরিসীম। মুক্তিবাহিনী কর্তৃক পাকবাহিনীর পর্যদস্তু হওয়ার নানা গুজবে সয়লাব ছিল একাত্তরের বাংলা। এমনকি স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের চরমপত্র থেকেও পরিবেশিত হয়েছে বীররসাত্মক নানা কল্পিত আখ্যান। গুজবের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল ভারতের প্রথম জাতীয়তাবাদী আন্দোলন- সিপাহী বিদ্রোহ। ব্রিটিশ সরকার এনফিল্ড নামক এক ধরনের রাইফেলের ব্যবহার শুরু করে। এই রাইফেলের কার্তুজ পশুর চর্বি দ্বারা আবৃত থাকতো। তখন গুজব ছড়িয়ে পড়ে কার্তুজে গরু ও শূকরের চর্বি মাখানো আছে। দাঁত দিয়ে কেটে বন্দুকে ভরতে হতো কার্তুজ। মুসলমান সৈনিকেরা শূকরের চর্বি এবং হিন্দু সৈনিকেরা গরুর চর্বি মুখে নেওয়ার গুজবে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এর ধারাবাহিকতায় সংগঠিত হয় ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ।
শাহিদ আমিনের ‘গান্ধি যখন মহাত্মা’ নিবন্ধে গণ আন্দোলনে গুজব কীভাবে ক্রিয়া করে তার সুবিন্যস্ত বর্ণনা আছে। গৌতম ভদ্র ও পার্থ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘নিম্নবর্গের ইতিহাস’ বইয়ের ওই নিবন্ধে শাহিদ আমিন দেখান, ১৯২১ সালে উত্তর প্রদেশের গোরখপুরবাসী স্রেফ গুজবের ওপর দাঁড়িয়ে ইংরেজ শাসন ও স্থানীয় কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। গোরখপুর জেলায় গান্ধি একদিনেরও কম সময়ের একটা সফর করেন। এই সফর ব্যাখ্যাতীতভাবে ওই অঞ্চলের কৃষকচৈতন্যকে স্পর্শ করেছিল। স্বপ্নে গান্ধি-দর্শন ও গান্ধির দৈব আদেশের গুজব যথাক্রমে মদ- মাংস ত্যাগ, জমিদারের বেগার খাটায় আপত্তি, ফসলের সমান ভাগ, বাজারে ন্যায্যমূল্য প্রতিষ্ঠা, ভোট বয়কট থেকে জমিদারপ্রথা ও ব্রিটিশ রাজত্ব বিলোপের প্ররোচক হয়। পুরো গোরখপুরে শত শত গুজব দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে, এমনকি মেইনস্ট্রিম পত্রিকাতেও সেসব গুজব প্রকাশিত হয়। সেই গুজবের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে সেই সময়ের গোরখপুরের সবচেয়ে বড় সমাজ সংস্কার আন্দোলন।
গণ আন্দোলনে গুজবকে জনগণের মিডিয়া হয়ে উঠতে দেখা যায়। মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার বিরুদ্ধে যেহেতু তথ্য গোপন ও এমবেডেড সাংবাদিকতার অভিযোগ থাকে তাই আন্দোলনকালে গুজব-তরঙ্গের মাধ্যমে জনগণ নিজেদের মধ্যে খবর সরবরাহ করে। আন্দোলন-সংগ্রামে গুজব জনগণের আকাঙ্ক্ষা ও কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী সৃষ্টি হয় বলেই তা দ্রুত গ্রহণ করে মানুষ। এর লক্ষ্য জনগণকে এক চেতনায় সংগঠিত করা। এভাবে গণচৈতন্য মেইনস্ট্রিম মিডিয়াকে পরাস্ত করে বিকল্প মিডিয়া গড়ে তোলে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, আন্দোলনের উত্তুঙ্গ মুহূর্তে খবরের জন্য জনগণ মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার বদলে স্যোশাল মিডিয়ার দারস্থ হয়েছে।
গুজব হলো মিথ্যা তথ্য এবং আংশিক সত্যের ওপর নির্ভর করে তৈরি হওয়া খবর। খবরের মাত্রা বহুগুণ বাড়িয়ে প্রচার করাই গুজবের চরিত্র। এ বিষয়ে গুজবের বিচার হলো, মানুষের যে অভিযোগ ও বঞ্চনা দীর্ঘদিন ধরে সমাজ-রাষ্ট্রে উপেক্ষিত থাকে, তা সত্য বলে প্রমাণের জন্যই তাকে বাড়াবাড়ি হয়ে উঠতে হয়। বাড়াবাড়ি হওয়ার মধ্যদিয়ে তা আসলে প্রকৃত সত্যকে প্রতিষ্ঠা করে। প্রাকৃত সত্যকে যে কাল ও মাধ্যম ভেদে সত্য প্রতিষ্ঠার স্বার্থে বাড়াবাড়ি হয়ে উঠতে হয় এর পক্ষে যুক্তি দিয়েছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। ‘সাহিত্যের বিচারক’ নিবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘সাহিত্যের মা যেমন করিয়া কাঁদে প্রাকৃত মা তেমন করিয়া কাঁদে না। তাই বলিয়া সাহিত্যের মা’র কান্না মিথ্যা নহে। ..যখন সশব্দ বিলাপে পল্লীর নিদ্রাতন্দ্রা দূর করিয়া দেয় তখন সে যে শুদ্ধমাত্র পুত্রশোক প্রকাশ করে তাহা নয়, পুত্রশোকের গৌরব প্রকাশ করিতেও চায়। সুতরাং শোকপ্রকাশের জন্য যেটুকু কান্না স্বাভাবিক শোক-প্রমাণের জন্য তাহার চেয়ে সুর চড়াইয়া না দিলে চলে না। ইহাকে কৃত্রিমতা বলিয়া উড়াইয়া দিলে অন্যায় হইবে।‘ একইভাবে, মাধ্যম ভেদে গণ আন্দোলনেও সত্য প্রমাণের প্রয়োজনে সত্যকে ‘সুর চড়াইয়া’ গুজব হয়ে উঠতে হয়।
আহত হয় শতাধিক ছাত্র। ফলে একজন ছাত্রের গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ে স্বাভাবিকভাবেই। অন্যদিকে সাধারণ ছাত্রদের ওপর কয়েক দফা হামলার মধ্যদিয়ে ইতোমধ্যে ছাত্রলীগ এই আন্দোলনের প্রধান প্রতিপক্ষ রূপে আবির্ভূত হয়। হলসহ পুরো ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের জুলুমের ধারাবাহিক চিত্র সহজেই মোর্শেদার পায়ের গভীর আঘাতকে রগকাটার খবরে রূপান্তরিত করে। এছাড়া, রগকাটার তুলনায় ছাত্রী নির্যাতনের ক্ষত কম হলেও এশার অপরাধের মাত্রা কমে না।
রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যের মায়ের কান্না আর গণ আন্দোলনের গুজব আলাদা আলাদা ক্ষেত্রের একই পদ্ধতিগত পরিগঠন। উভয়ই সত্য প্রমাণের প্রয়োজনে আপনার কলেবর বৃদ্ধি করে প্রকাশিত হয়। মানুষের যে সত্য দীর্ঘদিন ধরে নিপীড়িত, অবদমিত ও মনোযোগ আকর্ষণে ব্যর্থ হয় সম্মিলন মুহূর্তে তা বৃহদাকার ধারণ করে প্রকৃত সত্যকে প্রতিষ্ঠা করে। রবীন্দ্রনাথের বয়ানে, ‘শোকাতুর মাতাকে তাহার পুত্রের প্রতি জগতের এই অবজ্ঞা আঘাত করিতে থাকে। তখন সে নিজের শোকের প্রবলতার দ্বারা এই ক্ষতির প্রাচুর্যকে বিশ্বের কাছে ঘোষণা করিয়া তাহার পুত্রকে যেন গৌরবান্বিত করিতে চায়। যে অংশে শোক নিজের সে অংশে তাহার একটি স্বাভাবিক সংযম থাকে, যে অংশে তাহা পরের কাছে ঘোষণা তাহা অনেক সময়েই সংগতির সীমা লঙ্ঘন করে। পরের অসাড় চিত্তকে নিজের শোকের দ্বারা বিচলিত করিবার স্বাভাবিক ইচ্ছায় তাহার চেষ্টা অস্বাভাবিক উদ্যম অবলম্বন করে। আমার হৃদয়বেদনায় পৃথিবীর যত বেশি লোক সমবেদনা অনুভব করিবে ততই তাহার সত্যতা প্রতিষ্ঠিত হইবে। আমি যাহা একান্তভাবে অনুভব করিতেছি তাহা যে আমার দুর্বলতা, আমার ব্যাধি, আমার পাগলামি নহে, তাহা যে সত্য, তাহা সর্বসাধারণের হৃদয়ের মধ্যে প্রমাণিত করিয়া আমি বিশেষভাবে সান্ত্বনা ও সুখ পাই। সুতরাং এইখানেই বাড়াবাড়ি হইবার সম্ভাবনা। দূর হইতে যে জিনিসটা দেখাইতে হয় তাহা কতকটা বড়ো করিয়া দেখানো আবশ্যক। সেটুকু বড়ো সত্যের অনুরোধেই করিতে হয়। নহিলে জিনিসটা যে পরিমাণে ছোটো দেখায় সেই পরিমাণেই মিথ্যা দেখায়। বড়ো করিয়াই তাহাকে সত্য করিতে হয়।‘
অনেকটা কামান চাইলে পিস্তলটি পাওয়া যায়-এর মতো আন্দোলনে প্রান্তিকজন তাদের অস্বীকৃত সত্য বহুগুণ বাড়িয়ে তুলে ধরে সার্বিকের মনোযোগ ও প্রকৃত সত্যের স্বীকৃতি আদায় করে নেয়। খবরের বাড়াবাড়ি হয়ে ওঠার আরেকটি কারণ হলো, দীর্ঘদিন ধরে প্রতিকার না-হওয়া অপরাধকে বর্তমান ঘটনার মধ্যে সন্নিবেশ করে জনগণ একযোগে তার বিচার করতে চায়। কর্তৃত্বের সমগ্র বকেয়া অপরাধের হিস্যা একসাথে চুকিয়ে ফেলাই গণউত্থানের প্রকৃতি।
কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে গুজবের উপস্থিতি দেখা যায় সব সময়, সব সমাজে। কোটা সংস্কার আন্দোলনেও গুজবের প্রণিধানযোগ্য উপস্থিতি গণ আন্দোলনের অপরিহার্য শর্ত পূরণ করেছে। এই আন্দোলনে সর্বাধিক আলোচিত দুটি গুজব হলো-
১. একজন শিক্ষার্থীর আহত হওয়ার খবর মৃত্যুর খবর হিসেবে প্রচার হওয়া
২. সুফিয়া কামাল হলের ছাত্রলীগ সভাপতি কর্তৃক আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী কয়েকজন মেয়েকে নির্যাতনের ঘটনা একজনের পায়ের রগ কাটার খবর হিসেবে প্রচার হওয়া
এখানে দুটি ঘটনারই এটেম্পট-অস্তিত্ব বিদ্যমান। কেবল খবরের মাত্রা বৃদ্ধি ঘটেছে কিন্তু তা স্বল্প সময়ের জন্য। খবর নিশ্চিতকরণের আগে নানা মাত্রায় পাওয়া এসব খবরকে যদিও বিশুদ্ধ গুজব বলা যায় না। এ হলো খবরের অথেনটেসিটি অনুসন্ধানকালীন পরিস্থিতি। যা যেকোনো খবর নিশ্চিতকরণের আগে স্বল্প সময়ের জন্য বিরাজ করে। এখানেও খবরের বর্ধিত কলেবর প্রকাশিত হওয়ার শর্ত উপস্থিত ছিল। স্থানিকভাবে ওইদিন পুলিশ উপর্যুপরি টিয়ারশেল, রাবার বুলেট ছোঁড়ে। আশিকুর রহমানের গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনাটিও ওই রাতের। আহত হয় শতাধিক ছাত্র। ফলে একজন ছাত্রের গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ে স্বাভাবিকভাবেই। অন্যদিকে সাধারণ ছাত্রদের ওপর কয়েক দফা হামলার মধ্যদিয়ে ইতোমধ্যে ছাত্রলীগ এই আন্দোলনের প্রধান প্রতিপক্ষ রূপে আবির্ভূত হয়। হলসহ পুরো ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের জুলুমের ধারাবাহিক চিত্র সহজেই মোর্শেদার পায়ের গভীর আঘাতকে রগকাটার খবরে রূপান্তরিত করে। এছাড়া, রগকাটার তুলনায় ছাত্রী নির্যাতনের ক্ষত কম হলেও এশার অপরাধের মাত্রা কমে না।
কোটা সংস্কার আন্দোলনে আলোচিত গুজব দুটি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সমাজে বিদ্যমান অভিজ্ঞতা এবং ছাত্রসমাজের ঐক্যের আকাঙ্ক্ষার অনুকূলে তা সৃষ্টি হয়েছে। প্রথম গুজবটি আন্দোলনকে অপ্রতিরোধ্য করে তোলে ও দেশব্যাপী সংক্রমণ ঘটায়। দ্বিতীয় গুজবটি আন্দোলনকে বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেয়। পূর্বাপর তথ্য সন্নিবেশ ও গতি-প্রকৃতি বিশ্লেষণ সাপেক্ষে বলা যায় গুজব দুটি ষড়যন্ত্রমূলকভাবে ছড়ানো হয়নি। একটি ন্যায়সম্মত দাবির পক্ষে এবং বিশেষভাবে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত সাধারণ ছাত্রদের চৈতন্যই আকস্মিক গুজব দুটি নির্মাণ করেছে। যে কারণে কোটা সংস্কার আন্দোলন শেষ পর্যন্ত ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ রূপেও বিকশিত হয়। এই আন্দোলনের বিজয়ে তাই সবচেয়ে বিপর্যস্তও হয় ছাত্রলীগ। আন্দোলন দীর্ঘায়িত হলে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ সংকট বেড়ে যেত। সুফিয়া কামাল হলের ঘটনায় ছাত্রলীগের ২৪ নেতাকর্মীর বহিষ্কার সংগঠনটির এই টানাপড়েনকে সমর্থন করে।
৮ এপ্রিল মধ্যরাতে ছড়িয়ে পড়া প্রথম গুজবটির স্থায়ীত্ব ছিল এক ঘণ্টারও কম সময়। খবরটি সঠিক নয় এটি নিশ্চিত হওয়ার পর দুঃখপ্রকাশ করে স্ট্যাটাস প্রত্যাহার করে নেন পরিবেশকেরা। খেয়াল করতে হবে, গুজবটি কেন্দ্র করে আন্দোলনকারীরা দলে দলে রাস্তায় নেমে এলেও তারা কোনো সহিংসতার ঘটনা ঘটায়নি। অর্থাৎ গণ আন্দোলনের অনিযার্য হাতিয়ার হিসেবে গুজবটি কেবলমাত্র আন্দোলনকে বিকশিত করার কাজটিই করেছে।
দ্বিতীয় গুজব ১০ এপ্রিল মধ্যরাতের। সুফিয়া কামাল হল ছাত্রলীগ সভাপতি আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী কয়েকজন ছাত্রীর ওপর নির্যাতন চালায়। এতে ওই হলের ছাত্রলীগ সহসভাপতির পায়ের আঘাতটি রগকাটার খবর হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে। যাকে কেন্দ্র করে সাধারণ ছাত্ররা ছাত্রলীগের নিপীড়ন-রাজত্বের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। শাস্তিস্বরূপ নিপীড়ক সভাপতিকে জুতার মালা পড়িয়ে লাঞ্ছিত করে। এই ঘটনাটি হলো ক্যাম্পাসে দীর্ঘদিন ধরে চলা ছাত্রলীগের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের বিরুদ্ধে সাধারণ ছাত্রদের পূঞ্জিভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ও প্রতিশোধ। আন্দোলনের ভেতরে থাকা মব সুফিয়া কামাল হল ছাত্রলীগের সভাপতিকে লাঞ্ছিত করে ছাত্রলীগের কর্তৃত্ব ও অহমিকাকে চূর্ণ করতে চেয়েছে। বিচার হাতে তুলে নেওয়ার কারণটি আমাদের বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকেই আসা, উপরন্তু ছাত্রলীগ-কর্মীদের বিচার প্রচলিত আইনে সম্ভব নয় এমন ধারণা সমাজে বদ্ধমূল। এখানেও সম্ভাবনা থাকা সত্বেও কোনো সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি। সেই রাতের পরিস্থিতির সুযোগে কোনো সহিংসতা না ঘটা এই গুজবের পিছনের ষড়যন্ত্র তত্ত্বকে বাতিল করে দেয়। অর্থাৎ দুটি গুজবই ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনকে বিকশিত করা ছাড়া আর কোনো দিকে আগায়নি। গণ আন্দোলনের অনিবার্য ও অপরিহার্য উপাদান হিসেবেই তা সৃষ্টি হয়েছে সম্মিলিত চেতনা থেকে।
তৃতীয় আরেকটি গুজবের কথা বলা যায় ২০ এপ্রিল রাতের। আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী তিন ছাত্রীকে মধ্যরাতে আকস্মিকভাবে সুফিয়া কামাল হল থেকে বের করে দেয় কর্তৃপক্ষ। এখানেও খবর রটে যে অন্তত পঞ্চাশ ছাত্রীকে বের করে দেওয়া হয়েছে। এমনকি অনেক মেইনস্ট্রিম মিডিয়ামও এই সংখ্যা প্রকাশ করে। পঞ্চাশ ছাত্রীর বদলে তিন ছাত্রীকে বের করে দেওয়ার অপরাধ ও ভয়াবহতা একই। তবুও এই্ সংখ্যাধিক্যের প্রচার তাৎক্ষণিক ঘটনাকে বড় করে দেখায়। মানুষকে দ্রুত প্রতিবাদে সংগঠিত করে। হুলুস্থূল পরিস্থিতি এড়াতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ চব্বিশ ঘণ্টার আগেই তিন ছাত্রীকে হলে ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হয়। এইভাবে ঘটনাকে বড় করে, কর্তৃত্বের ভাষায় ‘গুজব’ তৈরি করে গণচৈতন্য তার লড়াইকে সংগঠিত করে।
অপরপক্ষে, কোটা সংস্কার আন্দোলন বিরোধীদের পক্ষ থেকে ছড়ানো গুজব ও প্রপাগান্ডা ছিল ষড়যন্ত্রমূলক। আন্দোলন-সংগ্রামে গুজব তৈরি হয় প্রাকৃতভাবে, তেমনি কর্তৃত্বও কাউন্টার গুজব তৈরি করে আন্দোলনকে প্রতিহত করতে চায়। কোটা সংস্কার আন্দোলন দমাতেও শক্তিপ্রয়োগসহ অনৈতিক তকমা দেওয়ার এমন কোনো চেষ্টা নেই যা কর্তৃপক্ষ করেনি। এর মধ্যে প্রধান চারটি গুজব ও প্রপাগান্ডা হলো-
১. আন্দোলনকারীদের মধ্যে মুখ ঢাকা কিছু মানুষের একটি ছবি (জামায়াত-শিবিরের দিকে নির্দেশ করে) ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া, পরে জানা যায় ছবিটি পশ্চিমবঙ্গের
২. টিয়ার শেল থেকে বাঁচতে আন্দোলনকারীদের চারুকলায় পয়লা বৈশাখের সরঞ্জামের বাঁশ নিয়ে আগুন জ্বালানোর ঘটনাকে ইসলামি সাম্প্রদায়িক হামলার উদাহরণ হিসেবে প্রচার করা
৩. এই আন্দোলন সংগঠন ও পরিচালনায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী বা জামায়াত-শিবির জড়িত রয়েছে- এমন প্রচারণায় কয়েকটি মিডিয়াসহ আওয়ামী লীগের নেতা ও সরকারের একাধিক মন্ত্রীর অংশগ্রহণ
৪. ‘কোটা সংস্কার আন্দোলনের সেই চার নেতার একজন শিবিরের সক্রিয় কর্মী’- শিরোনামে জাতীয় দৈনিক ইত্তেফাকে সংবাদ প্রচার। পরে খবরটি প্রত্যাহার করে পত্রিকাটি দুঃখ প্রকাশ করে
অর্থাৎ এই আন্দোলনকে ডিমরালাইজড করতে সবচেয়ে সক্রিয় ছিল আন্দোলনবিরোধীদের ছড়ানো গুজব ও প্রপাগান্ডা। কিন্তু সাধারণ ছাত্রদের দাবির নৈতিক বৈধতা ও সম্মিলনের কাছে পরাজিত হয় কর্তৃত্বের সব চেষ্টা।