খানসাহেবের খণ্ডজীবন :: পর্ব ৫ । সিরাজুদ দাহার খান
প্রকাশিত হয়েছে : ২৭ অক্টোবর ২০১৬, ৯:০২ পূর্বাহ্ণ, | ১৭৬৬ বার পঠিত
জল ও জঙ্গলে তাহাদের ২৮ বছর # ২য় কিস্তি
[যাদের ‘জেনেশুনে বিষ পান করেতে’ আপত্তি নেই, এবং যাদের হাতে ‘অকেজো জিনিশ’ পাঠ করার মতো সময় বা আগ্রহ আছে, তাদের জন্য এ লেখা মুক্ত করা হলো। এটা না-ছোটগল্প, না-স্মৃতিচারণ, না-সাহিত্যপদবাচ্য কোনো কিছু। এটা খানসাহেবের অন্যান্য ঘটনার মতো সারকাসটিক বা রম্যরচনাও নয়; এটি তাঁর জীবনাকাশ থেকে খসে-পড়া একটি মহার্ঘ দিনের দীর্ঘ-আলেখ্য! তাঁর ফরমায়েশে তাঁর নিজের জন্যই লেখা। কেউ যদি এটা পড়ে বিন্দুমাত্র কোনো আনন্দ-বেদনাজাত নৈকট্য অনুভব করেন, তাতে তিনিও আনন্দ পাবেন; কৃতার্থ হবেন। কেউ যদি বিরক্ত হন, তিনি তাঁর নিজগুণে স্বেচ্ছায় নিজেকে বিরক্তিমুক্ত করে নেবেন বলেই খানসাহেবের বিশ্বাস! সহৃদয় পাঠকের ধৈর্যসীমা বিবেচনায় নিয়ে ৩ কিস্তিতে ভাগ করে এটা — জল ও জঙ্গলে তাহাদের ২৮ বছর খণ্ডাংশ — মুক্ত-আকাশে উড়িয়ে দেয়া হলো। আজকে ২য় কিস্তি]
১ম কিস্তির শেষাংশ
তারপর দু’তিন দিন কেটে গেছে; কনফার্ম করার কথা সবাই ভুলে বসে আছে। বুধবারের আগের দিন ২৬ জুলাই উপমা তার বাবাকে কনফার্ম করার দায়িত্ব দিয়ে ভার্সিটিতে চলে যায়। খানসাহেব যথারীতি তার দায়িত্ব পালন করলেন। প্রথমে ফোনে আবারও বিস্তারিত তথ্য নিলেন এবং তাদের ফরমায়েশমতো এসএমএস করে সবার নাম-ঠিকানা-পেশা লিখে পাঠালেন। ফোনে নিশ্চিত হওয়ার পরও আবারও এসএমএস লিখলেন : আমরা কিন্তু আপনাদের ওখানে গিয়ে ব্রেকফাস্ট করব? জবাবে ওরা লেখে : “হ্যাঁ করবেন তো”! একই বিষয় ৩/৪বার জানতে চাওয়ায় ওরা বেশ কৌতুক বোধ করে। তারা জল ও জঙ্গলের রোডম্যাপ পাঠায় এসএমএস-এ।
২য় কিস্তি # শুভসকালে শুভযাত্রা
পরদিন কোনো জার্নি থাকলে রাতে ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুলেও খানসাহেবের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে। সকাল সাড়ে ৬টায় রওনা দিতে হবে—এ চিন্তা তাকে অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। তদুপরি, রাতে ২বার ঘুম ভেঙে দেখেন, তার পুত্রধন যথারীতি টেলিফোনে অথবা ফেসবুকে বন্দি। অথচ ও প্রমিজ করেছিল — রাত ১২টার মধ্যে ঘুমাতে যাবে। এমনিতেই দেশে রাতজাগা তরুণদের নিয়ে ইদানীং দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। সব মিলিয়ে মাঝরাতে খানসাহেবের মেজাজ বিগড়ে যায়। ঠিকমতো ঘুম হয় না।
সকাল বেলায় ঠিক সময়মতো গাড়ি এসে হাজির। সবাই রেডি। কিন্তু পুত্রধনের কোনো বিকার নেই। তিনি শুয়েছেন ভোর ৩টায়। ঘুম থেকে টেনে তোলা হলো ৬টায়। গড়াতে গড়াতে ৭টা; তার পর সাড়ে সাতটা। একঘণ্টা লেট। খানসাহেবের এমনিতেই সময় মেপে চলার বাতিক আছে। ওদিকে মেয়ের বন্ধু সাতসকালে উঠে নাস্তা না-করে তাদের জন্য অপেক্ষমাণ। লেট করলে খানসাহেবরে কথা শুনতে হবে — এ ভয়ে ড্রাইভারসাহেবও নাস্তা না করেই চলে এসেছেন। সময়মতো হাজির হতে গিয়ে তিনিও অভুক্ত।
এবার খানসাহেবের মেজাজ গেল চড়ে। বাসায় গৃহযুদ্ধের কাছাকাছি অবস্থা। তবে এরকম শুভদিনে খানসাহেবের এহেন আচরণে মিসেস খান বেশ বিরক্ত হলেন। দিনটাকে নিরাপদ ও শান্তিময় রাখতে তিনি কোনোমতে নিজেকে সামলে নিলেন।
ইতিমধ্যে অপেক্ষা করতে করেতে অধৈর্য্য হয়ে উপমার বন্ধু শুভ্রা রিক্সায় চড়ে রওনা দিযেছে উপমাদের বাসার দিকে। খানসাহেবরা অবশেষে পোনে আটটার দিকে রওনা হলেন। রাস্তা থেকে শুভ্রাকে তুলে নিয়ে সবাই শান্ত হলো। যাত্রাপথে বেশ কিছু মজার আলাপচারিতা এবং জায়গাটা কেমন হবে এ নিয়ে গবেষণা শুরু হলো। শুভ্রা জানালো :
তার এক আত্মীয় ওখানে দু’বার গিয়েছেন। জায়গা কেমন লাগবে তা নির্ভর করছে যার যার অভিরুচির ওপর। তবে খাবারের তালিকা শুনলে মুখে পানি চলে আসবে। ওরা যত আইটেম দিবে, তা খেয়ে শেষ করা যাবে না। নানা পদের বাঙালি খাবার।
: মাংস দিবে না মাংস? — সামনের ছিট দখল করে বসে থাকা প্রদীপ্ত এতক্ষণে মুখ খুললো। মাংসই তার ধ্যান-জ্ঞান। আলোচনায় রসভঙ্গ ঘটালেন খান সাহেব। আচমকা রসিকতা করে তিনি জিজ্ঞেস করলেন —
: ও ভালো কথা, তোমরা সবাই তোমাদের এন্ট্রি ফি আনছো তো?
অতিআগ্রহী স্কুলছাত্রীর মতো হাত তুলে শুভ্রা বলে : আমি আনছি, আমি আনছি।
খানসাহেব হতাশার সুরে বলেন : ইশ! দিলা তো কনফিউশনে ফেলে। এখন তো আমাকে আবার মাথা খাটাতে হবে — তোমার ফি নিব কি নিব না! না আনলেই ভালো করতে; আমাকে কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়তে হতো না।
খানসাহেবের এমন রসিকতায়-কথাবার্তায় পরিবারের সবাই অভ্যস্ত। তারপরেও মেয়ের ছোটবেলার বন্ধুর সাথে এমন অস্বস্তিকর রসিকতা মিসেস খানের পছন্দ হলো না। তিনি চাপাস্বরে খানসাহেবকে ঝাঁকুনি দিলেন : তোমার এখনও কোনো ধার-ভার হলো না। তিনি তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে বললেন
: না না শুভ্রা! তোমার আংকেলের কথা তুমি গায়ে মেখো না। তোমার সাথে ঠাট্টা করছে।
: আন্টি! আপনিও দেখছি, আমার মতো বোকা হয়ে গেছেন। আমি কি সত্যি সত্যি টাকা দিতাম নাকি! আমি আংকেলকে একটা ডজ দিলাম। বোকা বনে যাওয়া শুভ্রা এবার আঙ্কেলকে বোকা বানানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে।
সবাই হো হো করে হেসে ওঠে! পরিবেশটা হাল্কা হয়ে যায় নিমেষে। এবার ড্রাইভার সাহেব মুখ খোলেন —
: আপনেরা টাকা লেনদেন পরে করেন। যাইবেন কই আগে সেইডা কন।
: জল ও জঙ্গলের কাব্য! — বেশ ভাব নিয়ে কথাটা বলেন খানসাহেব ও তার কন্যা।
: কোন জঙ্গলে?
: আরে নাহ! কোনো জঙ্গলে না। জল ও জঙ্গলের কাব্য! একটা রিসোর্টের নাম।
: এ আবার কী নাম রে বাবা! বাঘ-সিংহ আছে নাকি?
: না না। এখানে শুধু পানি-কাদা-মেঘ আর গাছপালা। আপুর পছন্দ, কতই-বা আর ভালো হইবো? সবকিছুতেই খালি বাঙালি আর দ্যাশাল ভাব! — সুযোগ পেয়ে খোঁচা মারে প্রদীপ্ত।
: স্যার! আপনেরা যেহানে মন চায় যান। আমারে খালি ঠিকানাডা কন। খানসাহেব তার সেলফোন বের করে জঙ্গল থেকে পাঠানো এসএমএসটা পড়ে শোনান :
Dhaka hotey Tongi station road ashe dandike kaliganj ghorashal roade 5 hote 6 kilometer ashar por ekti chourasta paben; dane bame na gie soja asben, 2 theke 2.5 kilo ashar porey ekti relcross paben; shekhan hotey bamey tran niey 3 kilometer ashben. Erpor kaukey bolben je aamra Demorpara jol o jongoler kabbe jabo. Na chinle bolben amra demorpara Pilot bari jabo.
ওখানে যাওয়ার রোডম্যাপ শুনে তো সবার আক্কেল গুড়ুম! এত ঘোরানো-প্যাঁচানো নির্দেশনা। ড্রাইভার সাহেব চুপ মেরে গেলেন। কয়েক সেকেন্ড পর মুখ খুললেন : আরেকবার কন তো স্যার!
খানসাহেব দ্বিতীয়বার পড়ে শোনান —
: Dhaka hotey Tongi station road ashe dandike kaliganj ghorashal roade 5 hote 6 kilometer ashar por ekti chourasta paben; dane bame na gie soja asben….
পড়া শেষ হওয়ার আগেই ড্রাইভার সাহেব থামিয়ে দেন : হ বুঝছি, আর কওন লাগব না। আপনেরা অহন ট্যাকা লেনদেন করেন। আমি লইয়া যাইতেছি।
খানসাহেব বাসা থেকে নিয়ে আসা একটি গানের সিডি দেন সামনে বসা তার ছেলের হাতে। ছেলে কিছুটা অনিচ্ছাসত্বেও ওটা হাতে নিয়ে অন্ করতে করতে বলে : এখন আবার মান্না দে, সতীনাথ শুনতে হইব। কোনো মানে হয়?
সিডি চালু হলে সত্যি সত্যিই মান্না দে’র মায়াবী গান বেজে ওঠে : জড়োয়ার ঝুমকো থেকে একটা মতি খসে পড়েছে, আমি কুড়িয়ে পেয়েছি। সবাই প্রথমে গানের সুরে মুগ্ধ হয়ে কয়েক সেকেন্ড চুপ হয়ে যায়। তারপর নিজেরা যার যার মতো গুনুগন করতে থাকে। খাসনসাহেব মাঝেমাঝে আওয়াজ দেন — আহা কী গান!
প্রদীপ্ত উসখুস করতে থাকে : এটা কী গান আব্বু? এর মধ্যে আছে কি? এইডা কিছু হইলো — জড়োয়ার ঝুমকো থেকে একটা মতি খসে পড়েছে…।
উপমা মোক্ষম সুযোগ পেয়ে প্রদীপ্তকে খোঁচা মারে —
: তোর রুচিতে এসব গান ভালো না লাগারই কথা। তুই তো শুনিস হৃদয় খান, আসিফ।
প্রদীপ্ত এসব মন্তব্য পাত্তা দেয় না।
: আব্বু, অঞ্জন দত্ত নচিকেতা তো অ্যাট-লিস্ট রাখবা?
: আরে সব আছে। এক এক করে সব পাবি। আগে কয়েকটা মান্না-হেমন্ত শুনে নে।
মিসেস খান পথের দৃশ্য ও যাতায়াতপথের ম্যাপিং করাই বেশি পছন্দ করেন। খানসাহেব ও ছেলেমেয়েদের তালকানাভাব তাঁর পছন্দ হয় না। তিনি বারবার বলতে থাকেন : এসব গান নিয়ে কথা বাদ দিয়ে রাস্তাঘাট দেখতে দেখতে, চিনতে চিনতে যাও। তাঁর কথায় কেউ তেমন কান দেয় না।
অনেক কষ্টে ছেলে পুরোনো দিনের গান হজম করে। এক সময় হেমন্তের হৃদয় নিঙড়ানো গান বেজে ওঠে : কোনো এক গাঁয়ের বধুর কথা তোমায় শোনাই শোনো, রূপকথা নয় তো সে, জীবনের মধুমাসের কুসুম ছিঁড়ে গাঁথা মালা শিশিরভেজা কাহিনি শোনাই শোনো… গান পজ্ দিয়ে প্রদীপ্ত আবারও বাদ সাধে : এইসব পল্লীগীতিমার্কা গান বাদ দাও তো আব্বু।
খানসাহেব বাধ্য হয়ে ওকে গানের শানেনজুল বুঝিয়ে বলেন —
: ৪৩-এর মন্বন্তরের পরে মানুষের বিষাদময় জীবন নিয়ে লেখা সলিল চৌধুরির কালজয়ী এ গান। একটু মন দিযে শোন; তোর ভালো না লেগেই পারে না। অবশ্য একটু বড় গান। শুনতে ধৈর্য লাগে; ইতিহাস ও সমাজসচেতনতা লাগে।
এরপর বেশ মন দিয়েই ছেলে এবার পুরো গানটা শোনে। শেষের দুটো লাইন শুনে সবারই মন বিষণ্ন হয়ে যায় :
‘আজও যদি তুমি কোনো গাঁয়ে দেখ ভাঙা কুটিররেও সারি,
জেনো সেইখানে সে-গাঁযেরও বধুর আশা-স্বপনেরও সমাধি!!’
গান শেষ হলে সবার মধ্যে বিষাদময়তা পেয়ে বসে; সবা্ই চুপ মেরে যায়। মিসেস খান হঠাৎ করে কিছু-একটা খুঁজে পাওয়ার মতন উচ্ছ্বসিত হয়ে আপন মনে বলে ওঠেন : তা লা ট্ টি য়া আ!
এমন বেদনাদায়ক একটা গানের শেষে অকস্মাৎ এমন উদ্ভট ধ্বনিতে সকলের ঘোর ভাঙে। সাইনবোর্ডে লেখা একটা জায়গার নাম দেখা যায়, তালাটিয়া। তালাটিয়া বাজার। এরকম গানের শেষে মিসেস খানের এ ধরনের আচমকা বেমানান ধ্বনিতে সবাই প্রথমে একটু অস্বস্তি বোধ করে; তারপর হো হো করে হেসে ওঠে।
তিনি গান শুনতে শুনতে এতক্ষণ রাস্তার দু’পাশের সাইনবোর্ড্ পড়ছিলেন। সবার হাসিতে বিব্রত ও বিরক্ত হয়ে বলেন —
: হাসির কী হলো! একটু পরেই তো জঙ্গল থেকে ফোন আসবে — আপনার কোথায় আছেন? — তখন তো আমাকেই সব লোকেশন বলতে হবে। তোমরা তো সব তালকানা।
একথা শুনে সবার হুঁশ ফেরে কিন্তু আবার হেসে ওঠে। প্রদীপ্ত গাঁয়ের বধু গানটার ছন্দময় অংশটুকু গুনগুন করতে থাকে —
: ডাকিনী যোগিনী এল শত নাগিনী এল পিশাচীরা এল রে…
এরপর ওদের সবার পছন্দের অঞ্জন-নচিকেতা তালে তালে গাইতে গাইতে সবাই আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে। শোনা ও গাওয়া গানের দার্শনিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ চলতে থাকে। প্রতিটি গানেই প্রদীপ্ত তার নিজস্ব অভিনব ব্যাখ্যা দাঁড় করায়; অন্যেরা মেনেও নিতে পারে না; ফেলেও দিতে পারে না।
প্রথমে ‘হ্যালো, এটা কি ২৪৪১১৩৯…’।
এরপর অতি জনপ্রিয় ‘রঞ্জনা আমি আর আসব না’ শুরু হয়।… এ গানের এক জায়গায় এসে খানসাহেব গান থামিয়ে দেন —
‘ধর্ম আমার আমি নিজে বেছে নিইনি, পদবীতে ছিল না যে হাত…।’ এ লাইনটার নিগূঢ় অর্থ কী — এ ব্যাপারে সবার বিশেষ করে ছেলেমেয়েদের মতামত জানতে চান। সবাই কাছাকাছি মতামত দিলেও তাঁর মনমতো হচ্ছিল না — কেমন যেন ভাসাভাসা; যেন ধরি মাছ না-ছুঁই পানি। হঠাৎ করে ড্রাইভার নবীভাই বলে ওঠেন, ‘আরে বাবারা, এই সোজা কতাডা বুঝলা না! কারো ধর্মই কেউই নিজে ইচ্ছা কইরা বাইছা লয় নাই। আল্লা যারে যেডা বানাইছে, সে সেইডা লইয়া জন্মাইছে। হে হেইডা মাইনা চলে। হের জন্যে হে দায়িক না। সবই আল্লার ইচ্ছা! হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ-ইহুদি—সবই তার বানানো।’
সাবাই তার অন্তর্দৃষ্টি দেখে অবাক হয়ে যায়। খানসাহেব উচ্ছসিত হয়ে কী যেন যোগ করতে যাচ্ছিলেন সেদিকে কান না দিয়ে নবীভাই তাঁর মতো বলে যান :
এই যে দ্যাখলেন না, পয়লা জুলাই যে গুলশানে জঙ্গীরা ২০/২২জন অমুসলিম মাইরা ফেলাইলো, কামডা কি ঠিক করল! হেগো তো আল্লাই সৃষ্টি করছে, হেগো ধর্ম দিয়া। আমাগো ধর্মে কি তাগোরে মারতে কইছে? এইডা কি জায়েজ হইলো? হইলো না।
খানসাহেব তাঁর তারিফ করতে থাকেন। সবাই কিছুক্ষণ চুপচাপ হয়ে যায়। যার-যার মতো করে বিষয়টা ভাবতে থাকে। একসময় প্রদীপ্ত আবার গান ছাড়ে। এক পর্যায়ে বেজে ওঠে আরেকটি চিত্তাকর্ষক গান —
‘তুমি না থাকলে সকালটা এত মিষ্টি হতো না…
তুমি না থাকলে রবীন্দ্রনাথ, কালির দোয়াত মাথায় ঠুকে হতো কুপোকাৎ’ —
অঞ্জন দত্তের এ গানের তুমিটা কে এ নিয়েও বিস্তর গবেষণা চলে… কেউ বলে, এ তুমি হচ্ছে — শিল্পীর প্রেয়সী-প্রেম-ভালোবাসা; কেউ বলে, এ হচ্ছে — গান; কেউ বলে, এ তুমি হচ্ছে — সুর; কেউ বলে, এ হচ্ছে — টাকা; কেউ বলে — এ তুমি কেমন তুমি। অনেকক্ষণ চুপ থেকে প্রদীপ্ত বলে ওঠে : এই তুমি হচ্ছে — প্যাশন! খানসাহেব না-বোঝার ভান করে হাল্কা সুরে বলেন : “ফ্যাশন?”— প্রদীপ্ত বাবার ঠাট্টাকে পাত্তা না দিয়ে বিজ্ঞের মতো বলতে থাকে : “প্যাশন। মানে কোনোকিছুর জন্যে একটা অদম্য ইচ্ছা বা ডেডিকেশন…”
খানসাহেব কথা কেড়ে নিয়ে বলে : “তো সেই কিছুটা কী?”
“যে-কোনো কিছু” — সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়ে চুপ মেরে যায় প্রদীপ্ত। মিসেস খান মৃদুচাপ দেন খানসাহেবকে। সম্ভবত ভালোবাসা বিনিময় করেন। তাঁরা বসেছেন পেছনের সিটে। আবেগে আপ্লুত হয়ে মাঝে মাঝে একে অপরকে কত ভালোবাসেন তা বোঝার এবং বোঝানোর চেষ্টা করেন।
ড্রাইভার নবীভাই হঠাৎ ব্রেক কষেন। সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়েন। গাড়ি আচমকা থেমে যায় একটা ছোট্ট বাজারে। তিনি জল ও জঙ্গল কোনদিকে তা জানার চেষ্টা করেন। এমন সময় জঙ্গল থেকে ফোন আসে —
: খানসাহেব, আপনেরা কতদূর? এখন কোথায়? আপনাদের ব্রেকফাস্ট তো ঠাণ্ডা হয়ে গেল।
খানসাহেব ভড়কে যান। এত জটিল লোকেশন তো দূরের কথা, নিজের বাসার লোকেশনই মাঝেমাঝে ভুলে যান। নিজেদের গলিতে না ঢুকে প্রায়শই অন্য গলিতে, অন্য বাসায় ঢুকে যান।
“আমরা তালাটিয়া বাজার ছেড়ে এসছি বেশ কিছুক্ষণ।” — এটুকু বলে তিনি আর বলতে পারেন না। তিনি নবীভাইকে ফোন ধরিয়ে দেন। পিছন থেকে মিসেস খান প্রম্পট করেন নবীভাইকে। তিনি ডিরেকশন বুঝে নিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিয়েছেন; গাড়ি সামনে চলা শুরু করেছে। এমন সময় মিসেস খান হঠাৎ হৈচৈ করে ওঠেন —
: এই, গাড়ি থামান, গাড়ি থামান! আমাকে নামতে হবে। সবাই ঘাবড়ে যায়।
খানসাহেব বলেন : এখানে কোনো মাইনাস পয়েন্ট নাই!
: ‘আরে না না! মাইনাস পয়েন্ট না। দেখো কত ফ্রেশ তরকারি। কিনতেই হবে। এসব ঢাকায় পাবে না।’ — মিসেস খান উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে যান।
রাস্তার মধ্যে গাড়ি থামিয়ে ২টাকা বাঁচানোর জন্য কাঁচাবাজার করা খানসাহেবের একেবারেই পছন্দ না। তিনি বিরক্ত হয়ে কোনো একটা কমেন্ট করতে গিয়ে তার মেয়ের দিকে চোখ যায়। মেয়ের ইশারায় তিনি নিজেকে সামলে নেন। মনে মনে বলেন : ওহ্ আজকে তো আমাদের ম্যারেজ ডে! তিনি সুলতান সুলেমানের উজিরে আজমকে নকল করে বলেন : আপনার যা আদেশ মহারানী!
মিসেস খান দ্রুত নেমে পড়েন। এরপর একে একে সবাই নামে। ৫/১০ মিনিটেও বাজার শেষ হয় না। লিস্ট লম্বা হতে থাকে। ফজলি আম, আনারস, বাতাবি লেবু, ডাঁটা…। উপমা আর শুভ্রার চোখ যায় লটকনের দিকে। দামদর করে কিনতে গিয়ে দোকানি খারাপ লটকন দেয়ায় লাগে ফ্যাসাদ!
প্রদীপ্ত সেই ফ্যাসাদ মিটাতে এলে তা আরও খারাপ রূপ নেয় : পাল্টাইয়া দেন। না দিলে কিনুম না।
দোকানি মুখ ভ্যাচকায় : হালায় আমনেগো কাচে বেচুমই না। এমতেই তো কয়টা খাইছেন। অহন যানগা।
খানসাহেব বুঝিয়েশুনিয়ে তার কাছ থেকেই লটকন কেনার চেষ্টা করেন। কিন্তু দোকানির এক কথা : আমনেগো কাচে বেচুমই না।
বিক্রেতা তরুণের এহেন কথা শুনে মেজাজ ঠিক রাখতে পারেন না খানসাহেব। এমনিতেই পচা লটকন গছাতে চাচ্ছিল; তারপর আজেবাজে কথা বলছিল। এহেন অবস্থায় বিষয়টা মিটমাট করতে এসে তিনি আরও বিপত্তি ঘটান। পচা লটকন গছানোর চেষ্টা করার জন্য দোকানিকে ‘চোর’ বলে গালি দেন। পুলিশের সাথে কোনো কানেকশন না থাকলেও পুলিশে দেয়ার হুমকি দেন।
তাঁর হার্টের সমস্যা আছে; আছে ব্লাড প্রেশার সহ আরও কিছু শারীরিক জটিলতা। তাকে উপমা ও তার মা থামানোর চেষ্টা করেন। তিনি আরও বিগড়ে যান। পরে অন্য এক দোকানি এসে লটকনওয়ালা তরুণকে বকা দিয়ে খানসাহেবকে শান্ত করেন।
সবার মুড নষ্ট হয়ে যায়; চুপচাপ গাড়িতে ওঠে সবাই। শুভ্রা অপরাধী মনে করে নিজেকে : স্যরি আন্টি, স্যরি আঙ্কেল! আমার জন্যই দোকানে ঝগড়া লাগলো। আমি লটকন না কিনতে চাইলে… মিসেস খান ওকে থামিয়ে দেন : তোমার আঙ্কেলই তো বেশি বেশি যুক্তি-তর্ক দেয়। দরকার কী ওদের সাথে কথা বাড়ানোর?
গাড়ি আবার স্টার্ট নেয়। গাড়ির ভেতর সুনসান নীরবতা নেমে আসে। বেশ কিছুক্ষণ সবাই চুপ। খানসাহেব মনে মনে নিজের সমালোচনা করেন। তাঁর মতো একজন সিনিয়র সিটিজেন; দোকানি যতই বাজে ব্যবহার করুক, এরকম আচরণ করাটা মোটেই উচিত হয়নি। বিশেষ করে মেয়ের বন্ধুর সামনে; নিজের বন্ধুবান্ধবদের সামনে হলে তা-ও একটা কথা ছিল। বন্ধুদের কথা মনে হতেই তাঁর এক বিশেষ অভিজাত বন্ধুর কথা তাঁর মনে পড়ে যায়। বন্ধুমহলে সে-বন্ধুর এটিকেট বিশেষভাবে প্রশংসিত ও অনুসরণীয়; তাঁর রুচিবোধ খানসাহেবের রুচি তৈরিতেও নির্দিষ্ট ভূমিকা রেখেছে। সেই প্রিয় বন্ধুটি হলে কখনোই সামান্য লটকনওয়ালার সাথে এরকম করত না। সে শুনলে তাঁকে খুব বকাঝকা দিবে। এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে তিনি সংকুচিত হয়ে যান।
এরমধ্যে ওপার থেকে আবারও ফোন : অপনেরা কদ্দুর? নাস্তা তো ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। খানসাহেব গজগজ করে ওঠেন : অহেতুক কাঁচাবাজারে নামার জন্য মিসেস খানের ওপর রাগ ঝাড়তে গিয়ে প্রমাদ গোনেন এবং কথা ঘুরিয়ে দেন : এ-সবকিছুর জন্যই দায়ী প্রদীপ্ত। ও দেরি করে না উঠলে এত কিছু ঘটত না। ঘুরেফিরেই তার ওপর দোষ চাপানোতে প্রদীপ্ত শুধু বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে। কোনো উত্তর দেয় না।
গাড়ি কিছুদূর চলার পর ধীরে ধীরে পরিবেশ স্বাভাবিক হয়ে আসে। আবার শুরু হয় গান-গল্প আর নানা ভ্রমণঘটনার স্মৃতিচারণ। এসবরে তালে পড়ে কখন যে তারা জল-জঙ্গল ক্রস করে যায় তা টেরই পায় না।
: আপনারা কদ্দুর? এদিক-ওদিক সাইনবোর্ড্ দেখে মিসেস খান লোকেশন বলেন।
জঙ্গল থেকে বলে : আপনারা তো ক্রস করে গেছেন। ব্যাক করেন। ব্যাক করেন। পিএসসিসির উল্টোদিকে আমাদের জল ও জঙ্গল। একটা বড় বন্ধ গেট দেখবেন। ওই গেটে এসে আমাকে ফোন দিয়েন।
: সাইনবোর্ডে কী লেখা অছে?
: আমাদের কোনো সাইনবোর্ড নাই; লাগেও না। শুনে প্রদীপ্ত আবার খোঁচা মারে —
: তাইলে বোঝো, কোন জঙ্গলে যাইতেছি। আপুর কথায় আর নাচবা?
নবীভাই ব্যাক করেন। নানাজনের কাছে পাইলটবাড়ি কোথায় তা জানতে চান। অবশেষে একটা সাইনবোর্ডহীন বন্ধ গেটে এসে গাড়ি থামে। গেটে সাইকেল নিয়ে একজন ঢুকছিলেন। তিনি নিশ্চিত করলেন — হ্যাঁ, এটাই পাইলটবাড়ি। কিন্তু গাড়ি ভেতরে ঢুকতে দিলেন না; থামিয়ে দিলেন : ভিত্রে ফোন দেন। স্যার অর্ডার দিলে তারপর গেট খুলুম। বিরক্ত হয়ে খানসাহেব ফোন দিলেন। কয়েক সেকেন্ড পরে ভেতরের গ্রিন সিগন্যালে গেট খুলে গেল। সাধারণ একজন কেউ তাদেরকে রিসিভ করলেন। ধরে নেয়া হলো তিনিই আলাউদ্দিনসাহেব, যার কয়েক দফা জেরার শিকার ও নাস্তার খবরে নাজেহাল হয়েছেন মিস্টার অ্যান্ড মিসেস খান।
গাড়ি ভেতরে ঢুকে বাম দিকে একটা ছোটখাটো শোভন বাঙলোর সামনে থামল। সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। এই সুন্দর বিশাল বাঙলোকে নিজেদের রেস্টহাউজ ভেবে তুষ্টিবোধ করার আগেই সবাই জেনে গেল, ওটা ওদের না; ওটা পাইলটসাহেবের নিজস্ব বাঙলো ছিল একসম। এখন কিছু ফার্নিচার রাখা আছে। এখানে এলে পাইলটসাহেব অদূরেই আরেকটা রেস্ট হাউসে থাকেন। এরপর কিছুদূর হাতের ডানে হাঁটতেই তাদের জন্য বরাদ্দকৃত রেস্টরুম দেখে সবার তো আক্কেল গুড়ুম! কোথায় বাঙলোবাড়ি? একটা বটগাছের ছায়ায় খড়পাতা আর বাঁশের ছাউনি দেয়া, চারদিক খোলা একটা ঘরে একটা শাদামাটা টেবিল, কয়েকটা সোফা আর একটা সিঙ্গেল বিছানা পাতা।
[ যদি এখনও ধৈর্য, কৌতূহল ও আগ্রহ থাকে তাহলে ‘জল ও জঙ্গলে তাহাদের ২৮ বছর’ ৩য় কিস্তির জন্য অপেক্ষা করুন! — লেখক ]