খানসাহেবের খণ্ডজীবন :: পর্ব ১৪ । সিরাজুদ দাহার খান
প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ আগস্ট ২০১৭, ১১:৫৫ পূর্বাহ্ণ, | ১৬৪৩ বার পঠিত
মাদুলিবিক্রেতা পাগলা হায়দার
বেশ কিছুদিন খানসাহেব ও আমি দুজনেই যার যার রুটিরুজি ও পারিবারিক কাজে ব্যস্ত থাকায় আমাদের মধ্যে দেখা-সাক্ষাত নেই। সেদিন রাতে তিনি হঠাৎ আমাদের বাসায় এসে হাজির।
“ভাবি! শুনলাম শ্রীমঙ্গল বেড়াতে গিয়ে বাগানের তরতাজা এবং এক্সপোর্ট কোয়ালিটি চা নিয়ে এসেছেন। তো তা কি নিজেরা একাই সাবাড় করবেন।”
“খানভাই, একটু বসেন। আমি আপনাদের জন্য চা নিয়ে আসছি। কী চা খাবেন? রং না দুধ চা।”
“কীসব ফালতু প্রশ্ন করেন! আপনার ভাবির হাতে রং চা খেতে খেতে জিবের আসল রং চটে গেছে। দুধ চা দেন, দুধ চা। কাপভর্তি করে।”
খানসাহেব সোফাটেবিলের ওপর পা ছড়িয়ে রিল্যাক্স হয়ে বসেন। চোখ বুঁজে কী যেন ভাবেন। এরই মধ্যে চা আর পাঁপড় ভাজির সাথে বেগুনি নিয়ে হাজির হয় দৃষ্টি, মানে আমার জীবনসঙ্গী। ও নিজেও বসে আমাদের সাথে। খানভাবির খবরাখবর, তার স্বাস্থের খবর আর দুএকটা এ কথা ও কথার পর দৃষ্টি আসল প্রসঙ্গে আসে-
“খানভাই অনেকদিন ধরে আপনার মাদুলি বিক্রির ঘটনাটা শোনাতে চাচ্ছেন, আজকে আপনার রেহাই নাই। শোনাতেই হবে।”
চায়ের মধ্যে পাঁপড় ভিজিযে আলতো করে একটা চুমুক দিয়ে তিনি ধীরে ধীরে নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া এক অভাবিত এবং বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যাওয়ার ঘটনা বলতে ভনিতা শুরু করেন। তিনি প্রায় ৫-১০মিনিট ধরে টানা যা বললেন, তা এরকম :
১৯৮০র দশক। হায়দার খান ও তার সহযোদ্ধারা তখন নিজ জন্ম-শহর পাবনাতে নবনাট্য আন্দেলন গড়ে তুলতে জীবনপাত করছেন! তখনো আধুনিক নাট্যধারায় প্লাবিত হয়নি এ শহর। বলতে গেলে, এর সূচনাই তেমনভাবে হয়ে ওঠেনি। অবশ্য ইতোমধ্যে পাবনা থিয়েটার ৭৭ গড়ে উঠেছে। সুলতান মুহম্মদ রাজ্জাকের একটি নাটক সম্ভবত ‘বেহুলা’ ব্যাপক জনপ্রিয় হয়েছে এবং এবং নতুন ধাঁচের নাটক রচনায় তিনি প্রাগ্রসর হয়ে উঠতে শুরু করেছেন।
ইতোমধ্যে ঢাকায় মঞ্চস্থ বেশ কিছু আধুনিক নাটক পাবনার নাট্যমঞ্চে এসেছে এখানকার নাট্যকর্মীদের হাত ধরে। আবদুল্লাহ আল মামুনের ‘এখন দুঃসময়’, জিয়া আনসারির ‘চোর চোর’, সৈয়দ জাকির হোসেনের একটি বিশেষ নাটকও(নাম মনে নেই) মঞ্চস্থ হয়। এসবের মাধ্যমে নাটকের নতুন ধারা পাবনার দর্শকসমাজে পরিচিত ও গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে শুরু করে।
আমি অভ্যস্ত হলেও আমার স্ত্রী খানসাহেবের এসব ইতিহাস ও তত্ত্বকথা শুনতে শুনতে অধৈর্য হয়ে ওঠেন : “খানভাই আসল ঘটনা বলেন। হাতে অনেক কাজ। আপনাদের তো আড্ডাবাজি ছাড়া আর কোনো কাজ নাই। আমাদেরকে সংসারে অনেক কিছু সামলাতে হয়।”
“নাহ! ভাবি আপনাকে তো খুব নাট্য ও শিল্পরসিক মনে করেছিলাম। একটু ধৈর্য্য তো ধরতেই হবে। এই ইতিহাসটুকু না জানলে তো আপনি আসল ঘটনার রস পাবেন না। তাছাড়া, ইতিহাস তো জানতেই হবে। আজকাল তো আবার ইতিহাস ভোলানোর যুগ চলছে।”
অগত্যা দৃষ্টি চা-নাস্তার ট্রে কিচেনে রেখে এসে আবার বসে।
খানসাহেব আবার আয়েস করে বলতে থাকেন ৮০র দশকে তরুনবয়সে দেখা নাট্যজীবনের কথা।
“অভিনয়শৈলী ও নাট্যআঙ্গিক নিয়ে ঢাকায় তখন বেশ ভালোরকম আলোড়ন তৈরি হয়েছে। এবং গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের জোয়ার বইতে শুরু করেছে। টিভিনাটকেও তার ছাপ পড়তে শুরু করেছে। ৮০র দশকের নাট্যকর্মী এবং টিভি ও মঞ্চদর্শকেরা হয়তো দ্বিমত করবেন না যে, সেসময় এরশাদবিরোধী চেতনাও নাট্যজাগরণে প্রাণসঞ্চার করতে জলসিঞ্চন করেছিল যথেষ্ট পরিমাণে। সে জলরাশির ছিটেফোঁটা জেলা শহরেও ছড়িয়ে পড়ে।”
দৃষ্টি আর ধৈর্য্য রাখতে পারে না। সে আবারও তাড়া দেয় : ‘খানভাই আসল কথায় আসেন। আপনার মাদুলিবিক্রির ঘটনাটা বলেন।’
খানসাহেব সে কথা আমলে না নিয়ে আপন মনে বলে যান :
“যাহোক, ঢাকায় গড়ে ওঠা নাট্যকলা বিকাশের রেশ ধরে অন্যান্য শহরের পাশাপাশি পাবনা শহরেও প্রচলিত নাট্যগোষ্ঠীগুলো তাদের রূপ-রং পাল্টাতে শুরু করে। পাবনার কেন্দ্রীয় নাট্য ও শিল্পচর্চাকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত বনমালী ইন্সটিটিউট অবশ্য তখনো এ ধারায় যুক্ত হওয়ার মতো সংস্কৃতিমানস গঠন করতে পারেনি। এর কর্ণধাররা পুরোনো ধাঁচের নাট্যপাণ্ডুলিপি ও মঞ্চায়ন নিয়ে পরে ছিল। উল্লেখ্য, তখন সাধারণত একটি নাটকের একটিমাত্র প্রদর্শনীই প্রচলিত ছিল। তবে পাবনা থিয়েটার ৭৭ তাদের নাটকের কয়েক দফা মঞ্চস্থ করত। সম্প্রতি বিশেষ করে গণেশ ঘোষের কাছে জানলাম- তার নেতৃত্বে পাবনার প্রতিবাদী নাটকের দল ‘গণমঞ্চ’ তাদের একটি নাটকের(কোর্টমার্শাল)৫০টিরও বেশি শো করেছে।”
এবার আমি নাক গলাই : “খানভাই আপনার যে পথনাটকের দল গড়েছিলেন পাবনাতে এবং একটি সিনেমাহলের সামনে মাদুলি বিক্রি নিয়ে কী একটা নাটক করতে গিয়ে বেশ বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছিলেন, সেটা বলেন। আর কেনই বা এত কিছু রেখে পথনাটক করতে নামলেন; তাও আবার পথে পথে, সিনেমা হলের সামনে এসব একটু বলেন।’
আমার কথায় তিনি কিছুটা জগতে ফিরে এলেন :
“আমরা ইতোমধ্যে ‘সড়ক নাট্যদল’ নামে পথনাটকের একটা দলও গড়ে তুলেছি। সেখানে ২/১টি নাটক প্রস্তুত ও প্রদর্শনও করেছি। পাবনাতে এটি ছিল একটি মিশ্রধারা। পথনাটক পাবনাতে তখনো তেমন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি; বিশেষ করে নাট্যমহলে। অনেকটা পাগলামিও মনে হতো কারো কারো কাছে। তবে দর্শকমহলে পথনাটক নিয়ে কিছুটা কৌতুক কিছুটা কৌতূহল দেখা যাচ্ছিল।”
আমি ও দৃষ্টি এ পর্যায়ে নড়েচড়ে বসি বহুদিনের কাঙ্খিত ঘটনাটা শোনার জন্য। খান সাহেব আপন মনে বলে যান:
‘সাপের খেল’ তো ছিলই আমাদের ছেলের হাতের মোয়া। এর সাথে আরও দুএকটি রাজনীতিসচেতন পথনাটক প্রস্তুত করি আমরা। এবং সময়সুযোগ পেলেই যত্রতত্র সেসব প্রদর্শন করতাম। একদিনের ঘটনা আমার মনে এখনও রোমাঞ্চকর-ভয়ংকর স্মৃতি হিসেবে গেঁথে আছে।
পাবনাতে ‘বাণী হল’ নামে একটি ঐতিহ্যবাহী সিনেমা হল ছিল, এখনও আছে। তখন ‘রূপকথা’ আর ‘বাণী হল’ ছিল পাবনার চলচ্চিত্র দর্শকদের দুইমাত্র ভরসা। প্রতিটা শো দর্শকে গমগম করত। তখনো টিভি ঘরে ঘরে আবির্ভূত হয়নি। হল-ই একমাত্র বিনোদনের কেন্দ্র। বিদগ্ধ মহলে বনমালিও ছিল নাট্যদর্শকদের একমাত্র মঞ্চ ও ভরসা। ওই বাণী হলে প্রচুর দর্শকসমাগম হতো। ম্যাটিনি শো ভাঙতো সন্ধ্যার পরপর। আমরা সেই সুযোগটাই গ্রহণ করি। হলের শো শেষ হওযার মিনিট পাঁচেক আগে হলের সামনে নাট্যকলাকুশলী নিয়ে হাজির হই এবং ডুগডুগি বাজিয়ে নেচে গেয়ে আসর জমানোর চেষ্টা করি; কিছুটা সফলও হই। কৌতূহলী জনতার পাশাপাশি হলফেরৎ দর্শকদের ভিঁড় বাড়তে থাকে ‘সড়ক নাট্যদলে’র নাচগানের সামনে। কেউই কোনো কিছু আঁচ করতে পারে না- কী ঘটতে যাচ্ছে এখানে। কারণ এটি অভূতপূর্ব অর্থাৎ আগে কখনো এখানে এরকম অদ্ভূত ঘটনা তারা কেউ কখনো ঘটতে দেখেনি। আগে কখনো এরকম পাগলামির আসর বসায়নি কেউ। কেউ মনে করছে- গানের দল কেউবা মনে করছে- কোনো ওষুধের ক্যানভাসার হবে।
যাহোক, মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই হলের শো ভাঙলো। হুড়মুড় করে সব বের হচ্ছে। বের হওয়ার পথেই বাধা পেল বা ধরা পড়লো তারা আমাদের কাছে। একপাশের পথ আগলে আছে আমাদের কর্মীবাহিনী; আরেকপাশ মুক্ত। আমরা হলফেরৎ অনেক দর্শককে আটকে ফেলেছি অদ্ভূত সব কাণ্ডকীর্তি দিয়ে। কেউ কেউ বিরক্ত হয়ে পাশ কাটিয়ে চলেও যাচ্ছে। কিন্তু যারা একবার উঁকি দিয়ে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়েছে তাদের আর রক্ষে নেই। ব্যস আটকে গেল! মিনিট দুয়েকের মধ্যেই পূর্বপ্রস্তুতকৃত পথনাটকের প্রদর্শনী শুরু হয়ে গেল কোনো এক অজ্ঞাত ঈশারায়।
হুবহু মনে না থাকলেও ঘটনাটা এরকম (কারও ঘটনাটা হুবহু মনে থাকলে খানসাহেবকে বা আমাকে জানালে পরবর্তীতে শুধরে নেব) :
“এক মাদুলি বিক্রেতা তার এক তেলেসমাতি মাদুলি বিক্রির জন্য ক্যানভাস করছে। গ্রাম থেকে আসা তিন বেকার বন্ধু-হরিহর আত্মা- রোজগারের ধান্ধায় শহরে এসেছে। তারা এই ক্যানভাস দেখতে দেখতে এবং মাদুলির গুণগান বুঁদ হয়ে শুনতে থাকে- ‘দুনিয়ার এহেন উপকার নাই- যা এ মাদুলি থেকে পাওয়া যায়না। এ মাদুলি যার কাছে থাকবে, সে আর বেকার তো থাকবেই না; বরং অনেক টাকা পয়সার মালিক হয়ে যাবে।’
এক পর্যায়ে ৩জনই এই মাদুলি পাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে। তাদের পরস্পরের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় এটা কেনার জন্য; পাওয়ার জন্য। তর্ক লেগে যায়। মাদুলিওয়ালা মুচকি মুচকি হাসে। মোক্ষম সময় বুঝে সে তার কূটচাল চালে। সে বলে :
‘আচ্ছা ঠিক আছে। তোমাদের কোনো একজনকে আমি এটা দিয়ে দেব। এমনকি, আমি তাকে এটা বিনামূল্যে দিয়ে দেব। শুধু একটা শর্ত। তোমরা নিজেরা আলোচনা করে ঠিক কর, তোমাদের মধ্যে কে এটার হকদার বা ন্যায্য দাবিদার।’
দৃষ্টির মধ্যে সাসপেন্স তৈরি হয়। উদগ্রীব হয়ে জানতে চায় :
“এরপর কী হলো খান ভাই? তাড়াতাড়ি বলেন।” খানসাহেব দৃষ্টির কথায় কান না দিয়ে নিজের মতো বলে চলে :
“ব্যস! মাদুলি পাওয়ার জন্য ওদের তিনজনের মধ্যে লেগে যায় তর্ক; বেদম তর্ক। তর্ক একপর্যায়ে রূপ নেয় ঝগড়ায; ঝগড়া রূপ নেয় হাতাহাতি; এবং অনৈক্যে; এবং শেষমেষ বন্ধুত্বে ফাটল ধরার উপক্রম। তবে, কিছুতেই তারা কোনো একক সিদ্ধান্তে তারা আসতে পারে না। ফলত, মাদুলিটা কেউই পায়না। মাঝখান থেকে এতদিনের আশৈশব বন্ধুত্বে ভাঙন ধরে। এবং ওদেরকে দোষারোপ করে ওদের কেউই ওই মাদুলি পাওয়ার যোগ্য না- এরকম রায় দিয়ে মাদুলিওয়ালা কেটে পড়ে!”
নাটকের এটুকু বয়ান দিয়েই তিনি থামার পাত্র নন। এর রাজনৈতিক ভাষ্যটুকুও জুড়ে দিলেন আমার আর দৃষ্টির কাছে-
‘‘এভাবেই আমাদের সমাজে শোষিত-নিপীড়িত শ্রেণির মধ্যে ফাটল ধরিয়ে তাদের অনৈক্যের সুযোগ কাজে লাগিয়ে জোতদার-মহাজন-কারখানার মালিক- এরা সবাই শ্রমিক-কষক-সাধারণ মানুষকে প্রতাড়িত করে এবং লুটে নেয় সমস্ত মুনাফা, সুযোগসুবিধা। সাধারণ মানুষের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি করে নিজেদের বিজয়রথ ও প্রভূত্ব বজায় রাখে।”
একথাটুকু বলে খানসাহেব দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেন! সম্ভবত তাঁদের অতীতের বিপ্লবীচেতনার ক্রমহ্রাসমান গতিধারা মনে পড়ে গেছে তার। আমি তাকে আলতো ধাক্কা দেই: “কী হলো খান ভাই! বলেন তারপর কী হলো? সেই বিব্রতকর কী হয়েছিল সেইটা বলেন।” তিনি সচকিত হয়ে আবার শুরু করলেন:
“তো নাটক শুরু হওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে দর্শকদের মধ্যে সাড়া পড়ে গেল। দৃশ্যপট অনুযায়ী তারা হাসে, কাঁদে, রাগ হয়, দুঃখ পায় এবং ক্ষুব্ধ হয়। ২০ মিনিটের নাটক ৫মিনিটেই জমে ওঠে। দর্শক বাড়তে থাকে, পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে কৌতূহল, রহস্যময়তা ও মুগ্ধতা! ইতোমধ্যে, অনেকেই এটাকে নাটক না মনে করে সত্য ঘটনা ভাবতে শুরু করেছেন। কারো কারো কাছে দ্রুত কারো কারো কাছে ধীরে ধীরে ঘটনা পরিষ্কার হতে থাকে। কেউ কেউ ধরতেই পারে না যে, এটা একটা একটি পথনাটক বৈ কিছু নয়! পুরো বিষয়টিই বেশির ভাগের কাছে অভিনব এবং রহস্যময় মনে হয়। দ্রুতগতিতে নাটক এগিয়ে চলেছে।
নাটক শুরুর আগে আমাদের প্রায় সবার মধ্যেই অনিশ্চয়তা ও দুরুদুরু ভাব থাকলেও আমরা সবাই মজা করে এনজয় করে নির্ভয়ে অভিনয় করে যাচ্ছি। প্রথম প্রথম যে অনিশ্চয়তা ছিল তা ইতোমধ্যেই কেটে গেছে। কলাকুশলীরা দর্শকদের সাথে মিলেমিশে পারফরম করছে। দর্শকরাও কোনো কোনো সংলাপের জবাব দিচ্ছে। বেশির ভাগই খুব এনজয় করতে থাকে অভিনব এবং কিছুটা উদ্ভট এই নাট্যকৌশল। ঘটনা কোনদিকে এগোয় তা দেখার জন্য সাসপেনস্ তৈরি হয়; দর্শক এক নিঃশ্বাসে অপেক্ষা করতে থাকে এর পরিণতি দেখার জন্য।
কলাকুশলীরা সবাই পারিপার্শ্বিকতার দিকে নজর রেখে দিলদরিয়াভাবে অভিনয় করে যাচ্ছে। নাটকের মাধ্যমে মূল মেসেজ প্রত্যেকের মগজে ও হৃদয়ে গেঁথে দেয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে তারা।
ভালোই চলছিল; ধুমছে চলছিল রাজনৈতিক পথনাটক! হঠাৎ এক অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটল।
দর্শকদের মধ্য থেকে আমার চাইতে বছর পাঁচেক বড় একজন যুবক বিদ্যুৎগতিতে ছুটে এসে অভিনয়বৃত্তের মধ্যে ঢুকে পড়ল এবং সবাইকে হতচকিত করে দিয়ে আমাকে জাপটে ধরল- কেউ কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই। দর্শকদের মধ্যে কেউ কেউ ভাবল, এও বুঝি এই নবধারা নাটকেরই একটা অভিনব কায়দা; নাটকেরই অংশ। আমি ঘটনার আকস্মিকতায় চমকে উঠি; মুহূর্তের জন্য কিংকর্তব্যমিূঢ় হয়ে যাই। লোকটি আমার নাম ধরে ত্রস্ত হয়ে বলে ওঠে :
“হায়দার ভাই! এই হায়দার ভাই! আপনে মেন্টাল হয়্যা গেলেন নাকি! বাড়িত্ চলেন, বাড়ি্ত্ চলেন।”
আমি বিহ্বলতা কাটিয়ে চোখের পলকে লোকটাকে একনজর দেখে নিই। এবং তাকে চিনে ফেলি- ছাদেক ভাই। আমার একজন অতি ঘনিষ্ঠজন, বন্ধু। কয়েকদিন আগেও আড্ডা দিয়েছি। আমি দ্রুত তার মনস্তত্ব বুঝে ওঠার চেষ্টা করি। দর্শকরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমি তাকে হতচকিত করে দিয়ে এক ধাক্কায় বৃত্তের বাইরে ঠেলে বের করে দেই। কিন্তু ‘ছাদেক ভাই’ হাল ছাড়বার পাত্র নন। তিনি ইতিমধ্যেই বুঝে ফেলেছেন আমি কোনো কারণে ছিটগ্রস্ত হয়ে গেছি; ‘মেন্টাল’ হয়ে গেছি। তিনি খুবই বিস্মিত, উদ্বিগ্ন এবং চিন্তিত হয়ে ওঠেন। তাঁর চেহারায় এরকম ভাব ফুটে ওঠে : ‘৩দিন আগেই দেখল্যাম, হায়দার ভাই সুস্থ-স্বভাবিক; হঠাৎ কী হল্যা!’
আমার বাবা কাদের খান পাবনার এক উপজেলা আটঘরিয়ার বড় সরকারি আফিসার ছিলেন; অত্যন্ত হৃদয়বান, দয়ালু, পরপোকারী, হিউমারারস এবং সর্বোপরি, সর্বজন শ্রদ্বেয়। আমি নিজেও বন্ধুবৎসল হিসেবে হিসেবে বন্ধুমহলে সমাদৃত ছিলাম। হঠাৎ আমার এই অধঃপতন এবং মানসিক বিকারগ্রস্ততা সাদেক ভাইকে হতবিহ্বল করে তোলে। আমার বাবার সাথেও ছাদেক ভাইয়ের ভীষণ সখ্য। তাই সে মরিয়া হয়ে ওঠে- পাগল হয়ে ওঠার লক্ষণসম্পন্ন ‘হায়দার ভাই’কে রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে তার বাবার কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য! এরই মধ্যে তিনি নিশ্চিত হয়ে গেছেন- আমাকে পাবনা মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।
দর্শক ঘটনা বুঝে ওঠার আগেই আমি আবার অভিনয়ে ফিরে আসি। টিমের সদস্যরাও তথৈবচ! বিপ্লবী চেতনাপ্রসারে পথনাটক করছে; নিছক অভিনয় করা নয়; শিল্পি হয়ে ওঠা নয়। তাদের লক্ষ্য আলাদা ও সুনির্দিষ্ট- “এ সমাজ পুরোনো সমাজ, এ সমাজ ভাঙতে হবে।” তারা অনায়াসে পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নেয়। আবার চলতে শুরু করে নাট্যঘটনাপ্রবাহ।
কিন্তু সাদেক ভাই ছাড়বার পাত্র নন। তিনি কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে দ্বিগুণ শক্তিতে দর্শকব্যূহ ভেদ করে আবারও অভিনয়সার্কেলে ঢুকে পড়ে এবং কেউ বুঝে ওঠার আগেই আরো শক্ত করে জাপটে ধরে আমাকে : ‘‘ও ভাই, ওই হায়দার ভাই! আপনে মেন্টাল হয়্যা গেলেন ক্যান? কী হয়ছে আপনের? আপনের আব্বা আপনেক আইজ কয়দিন খুঁজ্যা পাচ্ছেনা। চলেন বাড়ি চলেন।”
আমি এবার সত্যি সত্যি প্রমাদ গুনি! এবার যে নাটক ভেস্তে যাবে সে-ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে যাই। কিন্তু হাল ছেড়ে দেইনা। বিদ্যুৎগতিতে মাথায় বুদ্ধি খেলে যায়। আমি দুই চোখ বিস্ফারিত করে চিৎকার দিয়ে উঠি : ‘কিডা তুই! খুন কর্যা ফ্যালবো তোক।’- বলেই এক ঝটকায় সাদেক ভাইকে দর্শকদের বাইরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেই। সে হুমড়ি কেয়ে মাটিতে পড়ে যায়। দর্শকদের উদ্দেশ্যে বলি-
‘ওনাক বান্ধেন, যাব্যার পারে না যেন।’
বলেই যথারীতি বাকি অভিনয়াংশ শুরু করি। সে আর ৩য় বার আমাকে বাধা দিতে পারে না।
আমি ভয়ে ভয়ে মিনিট দশকের মধ্যেই নাটক শেষ করে হাঁফ ছেড়ে বাঁচি!
তারপর আমাদের রীতি অনুযায়ী, দর্শকদের সাথে আমাদের নাট্যকুশলীরা মতবিনিময় করে। কেমন লাগল, কী শিখলাম, শোষণমুক্তির জন্য কী করতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। তারা দর্শকদের প্রতিক্রিয়া এবং নাটকের মূল বক্তব্য নিযে ভাব বিনিময়ের চেষ্টা করে।
আমি এই ফাঁকে দর্শকসারি থেকে বের হয়ে দ্রুত ছাদেক ভাইয়ের কাছে যাই। ঘটনাটা বুঝিয়ে বলি এবং আমার দুর্ববহারের জন্য ক্ষমা চাই। অবশ্য ততক্ষণে সাদেক ভাইয়ের কাছে বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে গেছে- ‘হায়দার ভাই আসলে মেন্টাল হয়্যা যায় নাই। এটা তার এক ধরনের পাগলামি!’