খানসাহেবের খণ্ডজীবন :: পর্ব ১৩ । সিরাজুদ দাহার খান
প্রকাশিত হয়েছে : ২৩ এপ্রিল ২০১৭, ৮:২৬ পূর্বাহ্ণ, | ১৬৫০ বার পঠিত
সাপের খেল, আব্বার মৃত্যু এবং তারপর :: কিস্তি-৫
সাপের খেল ও আব্বার মৃত্যু
১৯৮৪র কথা। ততদিনে হায়দার খান অনুশীলন উনাশি(যা এখন অনুশীলন নাট্যদল নামে রূপান্তরিত) ছেড়ে সমকাল নাট্যচক্রে যুক্ত হয়েছে। লেখক শিবির তো আছেই তার রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-তাত্ত্বিক অনুশীলনের প্ল্যাটফরম হিসেবে। সামনেই ১৬ তারিখে তার মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষা। প্রিয় শিক্ষক-সুহৃদ-মাবাবা-স্বজনেরা জানেন, হায়দার ফাইনাল পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। বাস্তবে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুমহল ও সমকালকর্মীরা জানে, সে ব্যস্ত সাপের খেলের মহড়া নিয়ে। ব্যস্ত সাপুড়ে হিসেবে নিজেকে এবং বিশেষ করে ভয়ংকর রাজনৈতিক সাপ হিসেবে uগড়ে তুলতে। এর আগে বেশ কয়েকটি শো হয়ে যাওয়ায় তার নিজেকে তৈরি করা নিয়ে কোনো চিন্তাই সে করছে না।
সপ্তাখানেক মহড়া দিয়ে নাটক প্রদর্শন-উপপোযোগী হয়ে ওঠে। বর্তমানে রবীন্দ্র কলাভবন তখন নির্মিয়মাণ। তার পাশেই কয়েকটি ক্যান্টিন। আশপাশে আড়ালে দাঁড়িয়ে মেকাপ নিয়ে সবাই প্রস্তুত। সমকাল ও লেখক শিবিরের রাজনৈতিক ধ্যনধারণায় মিল ও সাংগঠনিক সমন্বয় থাকায় প্রচুর দর্শক সমাগম হয়েছে। তখনকার ক্যাম্পাসকাঁপানো ছাত্র সংগঠন ফজলে হোসেন বাদশার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ছাত্র মৈত্রীর সাথেও ছিল সমকালের সাজুয্য-সেতুবন্ধ। এর অনেকেই ছিল মৈত্রীর কর্মী। যাহোক, টানটান উত্তেজনায় ‘সাপের খেল’ সফলভাবে সম্পন্ন হলো এবং দর্শকদের মধ্যে ব্যপক ঝড় তুললো।
নাটক শেষে দুপুরের খাবার খেয়ে বন্ধু মুস্তাগিস বাবুকে নিয়ে হায়দার শেরে বাংলা হলে নিজের রুমে শুয়ে শুয়ে নাটকটির কাঁটাছেড়া এবং ভবিষ্যত পরিকল্পনা করছে। তখন শেরে বাংলা হলে তার কাছে ফোন আসে :
‘তোমার আব্বাকে চিকিৎসা শেষে পাবনায় বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে।’ তাকে দেখার জন্য তাকে পাবনায় ফিরে যাওয়ার জন্য বার্তা দেয়া হয়্। হায়দার নাটক এবং সামাজিক বিপ্লবের চেতনায় বুঁদ হয়ে ভুলেই গিয়েছিল তার বাবা ঢাকায় পিজি হাসপাতালে আজ ১৮ দিন চিকিৎসাধীন। তার ছোট ভাই মুনির তাঁর কাছে আছে; দেখাশোনা করার জন্য।
আব্বাকে পাবনা থেকে ঢাকায় নেয়ার পর থেকেই তাকে বারবার খবর দেয়া হচ্ছিল তাকে দেখতে যাওয়ার জন্য। তার যে একবারে অনিচ্ছা ছিল তা নয়। তবে একদিকে পরীক্ষা অন্যদিকে সাংগঠনিক কাজ নিয়ে ডুবে থাকায় আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। আর আত্মকৈফিয়ত তো ছিলই- সামনে ১৫/২০ দিন পরেই ফাইনাল পরীক্ষা। যদিও বাস্তবে পরীক্ষা-প্রস্তুতি নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথাই ছিল না। যত মাথাব্যথা ছিল তার একনিষ্ঠ বন্ধু রোমান্টিক অথচ জীবনসংগ্রামী বন্ধু প্রদীপের। সে-ই প্রতি বিকেলে হাযদারের কাছে নোট পৌঁছে দিত। হায়দার ওই নোট নিয়ে আলোচনা করত এবং অন্য বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দিযে তাদের প্রস্তুতি সম্পর্কে জানার ছলে নিজের প্রস্তুতি সেরে ফেলত।
ওদের মধ্যে চুক্তি ছিল দুজন জুটি বেঁধে প্রস্তুতি নেবে এবং দুজনেই তাকলাগানো রেজাল্ট করবে। প্রদীপ ও হায়দারের এক প্রিয় শিক্ষক(নাম উল্লেখ করা হলোনা) চাইতেন এবং দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন হায়দার একটু চেষ্টা করলেই ফার্স্ট ক্লাস পাবে। তবে এ আশাবাদে হায়দারের এতটুকুন আস্থা ছিল না; চেষ্টা তো ছিলই না। এমনকি সদিচ্ছাও ছিল না; কমিটমেন্ট তো দূরের কথা! হায়দারের জীবনদর্শনেও লেখাপড়া নিয়ে ভিন্ন ভাবনা ছিল। জীবনের অর্থ কী –এ নিয়েও ছিল তার একেবারেই ভিন্ন চিন্তা। সে চিন্তার সাথে ভালো রেজাল্ট করার প্রচেষ্টা তো যায়ই না, এমনকি এসব রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক-সামজিক-পারিবারিক বৈষয়িক কোনো কিছুই যায় না। তারপরেও সে যে কেন এগুলোতো ডুবে থাকত তার কোনো সন্তোষজনক ব্যাখ্যা তার কাছে তখন ছিল না; এখনও নেই। ফলত তার কথিত জীবনদর্শনকে প্রদীপ এবং দুএকজন ছাড়া প্রায় প্রত্যেকের কাছেই একটা স্রেফ ভাঁওতাবাজি বা মিস্টিরি বা হায়দারের একটা পলায়নবাদি চাল মনে হতো।
যাহোক, হল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে পাবনা ফেরৎ যাওয়ার বার্তা পেয়ে হায়দারের মাথায় রাজ্যের ভাবনা, চিন্তা, দুঃশ্চিন্তা ঘুরপাক খেতে লাগল। সে বুঝে যায়- প্রকৃত সত্য। কিন্তু না বোঝার ভান করে নিজেকে শ্বান্ত রাখে। ১৬দিন পরেই মাস্টার্স ফা্ইনাল পরীক্ষা। তার অতি কাছের মানুষ বন্ধু প্রদীপকে নিয়ে রওনা দেয় পাবনায়। সামনে পরীক্ষা থাকা সত্বেও প্রদীপের দিদি ওকে হায়দারের সাথে পাবনায় যেতে বলে। সে কথা মনে হলে এখনও কৃতজ্ঞতায বরে ওঠে তার মন। যাওয়ার পথে প্রদীপ তাকে সান্ত্বনা দেয়ার কোনো ভাষা খুঁজে পায়না।
একসময় হায়দার নিজেই মুখ খোলে। যেন তেমন কিছুই হয়নি- এমন ভাব করে। উল্টো প্রদীপকেই সান্ত্বনা দেয়ার ছলে নিজেকে বোঝায় : ‘আরে না! তেমন কিছু না। আব্বাকে ঢাকা থেকে চিকিৎসা শেষ করে পাবনায় নিয়ে এসেছে। আব্বা হয়তো আমাকে দেখতে চেয়েছেন। তাই আমাকে কায়দা করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।’ বেশ কষ্টে কথাগুলো শেষ করে হায়দার একদম চুপ করে যায়; প্রদীপও চুপ। অনেক পরে হায়দার আবার বলতে শুরু করে : ‘আচ্ছা! যদি খারাপ কিছু হয়, তাহলে তো আমাকে পাবনায় বাড়িতে থেকে যেতে হবে। এবার আর ফাইনাল পরীক্ষা দেয়া হবেনা। তোমরা ভালোমতো পরীক্ষা দিও। আমার তো এমনিতেই পড়ালেখার প্রতি তেমন আগ্রহ নেই। আব্বাকে খুশি করার জন্যই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম. আব্বাই যদি না থাকেন, তাহলে আর পরীক্ষা দিয়ে লাভ কী?….. কথা কেড়ে নেয় প্রদীপ : ‘বাজে বোকো না। আব্বা বেঁচে থাক বা না-থাক পরীক্ষা তোমাকে দিতেই হবে এবং ভালো রেজাল্টও করতে হবে। অন্তত আমার চাইতে ভালো। তোমার সাথে আমি এমনি এমনি যাচ্ছি না। তোমাকে ফেরৎ আনার জন্যই যাচ্ছি।’
৩/৪ ঘণ্টার পথ শেষ হতে চায়না। হায়দার কখনো চুপ মেরে থাকে, কখনো টানা কথা বলে যায়। নানা বিষয়ে। পারিবারিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাহিত্য ও নাটক বিষয়ে। দু-একবার দীর্ঘশ্বাসও বেরিযে আসে বুকের গভীর থেকে। আফসোস আর হাহকার মিশে থাকে তাতে : ‘যদি একবার ঢাকায় ঘুরে আসতাম। তাহলে হয়তো আব্বাকে শেষ দেখাটা দেখতে পারতাম।’
তখনকার উদিয়মান নাট্যকর্মী বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের অধ্যাপক ইসরাফিল শাহীন তখন আরণ্যকে কাজ করত। সে ঢাকায় থাকত এবং হায়দারের সাথে ভালো সখ্য থাকায় আব্বার খোঁজখবর নিত এবং তাকে যতটুকু সম্ভব খবরাখবর জানাত। সে একবার একটা চিঠি পোস্ট করেছিল তাকে আব্বার অবস্থা জানিয়ে। তাতেও অনুরোধ করেছিল, আব্বাকে একবার দেখে আসার জন্য। তখন সে নাটক নিয়ে লেখক শিবির নিয়ে এতটাই বুঁদ হয়ে ছিল যে, কোনো কিছুই আমলে নেয়নি। অথবা ভাবতো পরীক্ষাটা শেষ হলে অথবা নাটকের শো’টা শেষ হলে সে একবার ঢাকা যাবে আব্বাকে দেখতে। এখন অনেক কথাই এলোমেলো হয়ে যাত্রাপথে তার মাথার ভেতরে বুকের আনাচে-কানাচে তাকে খোঁচাচ্ছে।
সে অতিমাত্রায় স্বাভাবিক থাকতে গিয়ে বা স্বাভাবিকতা দেখাতে গিয়ে মাঝে মাঝে এলোমেলো বকছে। প্রদীপ ওর সাথে হাসিঠাট্টা করে ওকে সামলে রাখার চেষ্টা করছে। এর মধ্যে বাসের কন্ডাক্টরের সাথেও দু’কথা হয়ে গেল দু’জনের। যা আশংকা করছে ওরা তা যদি সত্যি হয়ে থাকে সেমতাবস্থায় পরীক্ষার গুরুত্ব, লেখাপড়া কেন ভালোভাবে করা দরকার- এসব প্রসঙ্গ ফিরেফিরে আসতে থাকলো প্রদীপের দিক থেকে। ও ছিল পোড়খাওয়া জীবন ও বাস্তবতাকে জয় করারর জন্য একজন আত্মপ্রতিজ্ঞাবদ্ধ মানুষ। ক্লাসের দু’একজন কথিত ভালো ছাত্রছাত্রীর ব্যাপারে ওর এলার্জি ছিল। (অবশ্য তারা এখন প্রথিতযশা; ধরাছোঁয়ার বাইরে অথবা আত্মগরিমায় মগ্ন!) ওর ধারণা ছিল, হায়দার চেষ্টা করলে অনায়াসেই ওদেরকে টপকে যেতে পারত। এখনও সময় আছে।
প্রদীপ যে কেন হায়দারকে এতটা পছন্দ করত অথবা পছন্দ না করলেও এতটা গুরুত্ব দিত তা আজও হায়দারের কাছে কৌতূহল বা রহস্য। একটা জবাব ওর ধারণায় আছে; কিন্তু তা সে নিজের কাছেও বিশ্বসযোগ্য করতে পারে নাই এ-যাবৎ।
যাত্রাপথে দু’জনের ব্যক্তিগত প্রেম ও প্রতিজ্ঞা নিয়েও আলাপচারিতা চলছিল। হায়দারের মাথায় একটা মেযের ছবি বারবার ঘুরেফিরে আসছিল এ সম্ভাব্য দুঃসংবাদের মধ্যেও।প্রদীপ সেটা আঁচ করতে পারে। হায়দারের দুটো বিষয় প্রদীপকে খুব ভাবিত করত; তাড়িত করত। একটা হচ্ছে, ওর নেতিবাচক জীবনবোধ এবং ওর ভালোবাসার নিশ্চিত সম্ভাব্য পরাজয়। যেটা মেনে নেয়া হায়দারের জন্য অত্যন্ত দুঃসহ ও ডিফিকাল্ট ছিল। হায়দারের এ দুটো ব্যাপারেই প্রদীপের ভেতরে নিদারুণ সংবেদনশীলতা ছিল। আব্বার সম্ভাব্য মৃত্যুমুখী অসুখের সংবাদ কিংবা একটু আগে পাওয়া প্রায়-নিশ্চিত মৃতূসংবাদ তাকে তাই অতটা বিচলিত করে নাই অথবা তাকে দুদিকথেকেই অস্বস্তিতে-অশান্ততে টানছিল; তাকে একবোরে অসহায় ও নিস্তেজ করে ফেলছিল।
ঘুম ভাঙলে পাবনা বাসস্ট্যান্ডে বাস থামে। দুজনে বাড়িমুখী হয় রিক্সায়। বাড়ির সামনে বেশ লোক সমাগম দেখে দুজনেই নিশ্চিত হয়ে যায় প্রকৃত সত্য। দুজনে বেশ স্বাভাবিকভাবে বাড়িতে ঢোকে। প্রত্যেকেই হায়দারকে নিয়ে খুব বেশি দুশ্চিন্তায় ছিল। হয়তো সে একেবারে ভেঙে পড়বে অথবা ভীষণ কান্নাকাটি করবে। বাস্তবে কিছুই ঘটে না। হায়দার ধীরে ধীরে ঘরে ঢোকে। কে যেন তাকে ধরে আব্বার কাফনে ঢাকা মুখটা দেখায়। কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে থাকে সে। চোখে জল ঝরে না; পাতা একটু যেন কেঁপে ওঠে। তার এ নিদারুণ নীরবতায় কেউ কেউ চিন্তিত হয়। অস্বাভাবিক আচরণ মনে হয়।
প্রদীপ তার পাশে পাশে থাকে। ওর চোখে জল দেখা যায়। আব্বার সাথে ওর ছিল ভীষণ সখ্য। অন্যতম কারণ হয়তো এই ছিল যে, আব্বার সহজ-সরল আনন্দপ্রিয়তা ও আতিথেয়তা; আপন করে নেয়ার ক্ষমতা। অন্যদিকে প্রদীপের হাতে হায়দার ভালোভাবে মানুষ হচ্ছে –এই ভেবে আব্বাও ওকে খুব আপন করে নিযেছিলেন। হায়দার অন্দরমহলে প্রবেশ করে; সম্ভবত ছোট ভাই বিপ্লবকে মেঝেতে শুয়ে ঘুমাতে দেখে। শীলা ও নীলাকে থামানো যায় না। শীলা তাকে জড়িয় ধরে ফুঁপিয়েওেঠে; এর কোনো সান্ত্বনা হয়না জেনেও হায়দার সান্ত্বনা দেয়। মায়ের কাছে গিয়ে বসে চুপচাপ। মা কোরান পাঠরত। প্রতিবেশিনীরা পাশে বসে আছে; দোয়া-দরুদ পড়ছে। তারা হায়দারকে যারপর নাই ভালোবাসতেন। হায়দারকে দোয়া-দরুদ পড়তে বলেন। সে তা পড়ে কি-না ঠিক বোঝা যায়না।
একটু পরে হায়দার প্রদীপকে নিয়ে বাড়ির বাইরে বের হয়ে আসে। তাকে সামাল দিতে তার পিছে পিছে অন্য দু’একজন আসতে নেয়; হায়দার তাতে সায় দেয়না। তে-মাথার মোড়ে গিয়ে আলো- আঁধারিতে দাঁড়ায় দু’জন। হায়দার উল্টো প্রদীপকে সান্ত্বনা দেয়। তার এ আচরণে প্রথমে প্রদীপ থতমত খেয়ে যায়। ওর আরও কান্না পেয়ে বসে। হায়দারের পিঠে জড়িয়ে ধরে। পরে দুজনেই ধাতস্থ হয়। একটু পরে ঘরে ফিরে অন্যদের সাথে অল্প আহার করে। রাতে পাশেই সোলেমান মামাদের বাসায় ঘুমাতে যায়। এত ক্লান্তির পরেও কারোরই ঘুম আসেনা। প্রদীপ আব্বার স্মৃতি রোমন্থন করে চলে। হায়দার চুপচাপ শুনে যায়।
পরদিন আটঘরিয়া থেকে বেশ কিছু মানুষ আব্বাকে দেখতে আসে। তাঁরা তাঁকে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে। হায়দারকে তা স্পর্শ করে। কারণ, তার ধারণা, তারা যখন সদর পাবনার পাশের থানা আটঘরিয়ায় ছিল তখন সেখানকার মানুষ-ছেলে-বুড়ো-তরুন-যুবা- সবাই আব্বার স্নেহ-ভালোবাসা-শ্রদ্ধা পেয়েছেন অনেক অনেক। আব্বাকে হায়দারের চাইতেও তারা বেশি ভালোবাসতেন হয়তোবা। হায়দার স্বগতোক্তি করে- ‘এখন বুঝতে পারছি; তখন বুঝতাম না। আটঘরিয়ার সেসময়ের মানুষ সহজে আব্বাকে ভুলতে পারবে না!’
একজন বলেন, ‘জি। ঠিকই বলেছেন। আপনার বাবার কাছে অনেক স্নেহ – ভালবাসা পেয়েছিলাম। আপনার বাবার সাথে আমার বাবার তেমনি ঘনিষ্ঠতা ছিল, যেমন ছিল আপনার সাথে আমার। শুধু তাই নয় – আটঘরিয়ায় আপনার বাবার কার্যকাল ছিল মনে থাকার মতো। আপনাদের-আমাদের অটঘরিয়া-জীবন ছিল অন্যতম শ্রেষ্ঠ সময়।’
আরেকজন বলেন, ‘আমরা কতকিছু করেছি। আপনার আব্বার সমর্থন পেয়েছি; সহযোগিতা পেয়েছি–আজ সবেই মনে পড়ছে’!
একজন মুরুব্বি আর্দ্র কণ্ঠে বলেন : ‘কিছু শুন্যতা কখনই পূরণ হবার নয় । বাবা-মায়ের চলে যাওয়া তেমনই এক বাস্তবতা । তাঁরা চলে যান, থেকে যায় তাঁদের ছায়া । আমরা সন্তানেরা সেই ছায়া আঁকড়ে কাঁদি এবং বাঁচিও । সেই ছায়া কেবলই দীর্ঘ হয় । মনে আসে কত কথা ।’
হায়দার মনে মনে বলে : “কতই না ঠুনকো বিষয় ছিল কিছু কিছু বিষয়; দ্বিমত না করে মেনে চললেও হতো!”
কে একজন টানা কথা বলে চলে আব্বার সহৃদয়তা, রসিকতা ও মানুষকে ভালোবাসর বিভিন্ন দিক নিয়ে। হায়দার মনে মনে বলে, প্রিয়তম বন্ধুগণ, কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!
তোমরা, তুমি ও রাকিব, সাথে ছিলে জন্যই হয়তো আমাকে কাঁদতে হয় নি সেদিন। রাতে নিজের অজান্তেই নিজেকে হালকা করতে চেয়েছি। মনের ভিতরে স্মৃতি, কান্না, ছায়া, মায়া, হাহাকার… সব একাকার হয়ে যাচ্ছে! বাবা না-থাকা খুব খুব বেশী কষ্টের ! স্মৃতি, শূন্যতা… বড় বেশি শূন্যতা…
পরদিন বন্ধু রাকিব আসে পাবনায়। আব্বার জানাযায় ব্যাপক লোক সমাগম হয় শালগাড়িয়া আর শিবরামপুরের মাঝামাঝিতে আবস্থিত বাংলাদেশ ঈদগাহ ময়দানে। প্রচলিত প্রথা অনুসারে জ্যেষ্ঠ্যপুত্র হিসেবে হায়দারকে জানাযায় সমবেত মুসল্লিদের কাছে আব্বার পক্ষ থেকে ক্ষমা চায়; কারো কোনো পাওনা থাকেলে তা তাকে জানাতে বলে। ছোট ভাই রুমি, মুনীর, জামান জানাযা শেষে কান্না থামাতে পারে না। শেষবারের মতো সবাইকে আব্বার মুখ দেখার সুযোগ দেয়া হয়। আব্বাকে শেষবারের মতো দেখি। অন্যদের সাথে হায়দার লাশবাহী খাটিয়ায় কাঁধ লাগায়; ভেতরে ভেতেরে সে গুমরে ওঠে। চোখের জল অন্তরেই নিভে যায়; বাইরে জ্বলে ওঠে না।
পাবনা সদর গোরস্তানে আব্বাকে দাফন করা হয়। অন্যদের সাথে রুমি আব্বার কবরে নামে। হায়দার কবরে মাটি ছড়িযে দেয় নিয়মমাফিক। সমবেত প্রায় সবাই নিরবে-সরবে হাহাকার করে ওঠে! হুজুর কাঁদতে নিষেধ করেন- এতে নাকি মুর্দার অকল্যাণ হয়। দোয়া পড়ে ফেরার পথে রাকিব প্রদীপকে বলতে থাকে : বাহ্! কী সুন্দর কবরস্তান! বাংলাদেশে আর দুটো পাওয়া যাবে কি-না সন্দেহ! ছায়াঘেরা; গাছগাছালিতে ভর্তি; প্রশান্তির ছাপ; গোছানো।
বন্ধুর জন্য সহমর্মিতা জানাতে হায়দারের আব্বার মৃত্যুর পর রাকিব পাবনায় তাদের বাড়িতে হাজির হয়েছে। সংবাদটি পেয়েছিল প্রদীপের কাছ থেকে। তার সাথে হায়দারের পরে যে সখ্যতা গড়ে ওঠে, তখনো ততোটা গভীর ছিলো না। তবুও আব্বার মৃত্যু রাকিবকে স্পর্শ করেছিলো। আব্বাকে পাবনার যে কবরস্থানে সমাহিত করা হয় সেটি এতো পরিচ্ছন্ন, শান্ত এবং সবুজে ঘেরা ছিলো যে, সেখানে গিয়ে রাকিবের মনে হয়েছিলো, মরনের পরে এমন জায়গায় থাকতে পারলে তা-ও অনেক শান্তির। কবরস্থানটি এখনও তেমন ছায়াঘেরা, মায়াভরা নিসর্গ হয়ে আছে। রাকিবের ধারণা, ‘হায়দার অনেক সংবেদনশীল মানুষ। সেই সময় আব্বার মৃত্যু তার মধ্যে অনেক শূন্যতা তৈরি করেছিলো। হয়তো আজও তা পূরণ হয়নি। এ জীবনে হয়তো তা হবারও নয়। হায় জীবন!’
দাফন সম্পন্ন করে সবাই বাড়ি ফিরে আসে। আব্বাকে নিয়ে সবাই স্মৃতিচারণ করে। দুলাভাই আব্বার খুব প্রিয়জন ছিলেন; আব্বাও তাই। আব্বার মৃত্যুসংবাদ পেয়ে তাঁর মানসিক অবস্থা কেমন হয়েছিল তা বলতে গিয়ে তার চোখ ভিজে আসে; তিনি ফুঁপিয়ে ওঠেন। অন্যরাও নিজেকে সামলাতে পারেনা। হায়দার অবিচল দৃষ্টিতে সবার কথা শুনতে থাকে। কোনো মন্তব্য করেনা।
রাকিব ও প্রদীপকে নিয়ে হায়দার রাতের খাবার খায়। অন্যদেরকে খেতে সহায়তা করে। শীলাকে- নীলাকে প্রবোধ দেয়া কঠিন হয়ে পড়ে। মনে আছে, শীলা প্রায়-অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়ে। ওকে স্বভাবিক করতে নানানরকম কলা কৌশল প্রয়োগ করতে হয়েছিল। যতদূর মনে পড়ে, ওকে স্বভাবিক করতে পরে বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে নিযে যাওয়া হয়; কিছুদিন বরিশালেও রাখা হয়েছিল; আব্বার জন্মস্থান। নীলা ছিল অত্যন্ত পরিমিত ও বিবকবিবেচনাসম্পন্ন; তদুপরি, দায়িত্ববোধসম্পন্ন। ও নিজেকে কয়েকমাসের মধ্যে সামলে নেয়। এবং সংসারের পারিবারিক কাজের হাল ধরে।
রাতের খাবার এবং আনুসঙ্গিক কাজ সেরে হায়দার প্রদীপ এবং রাকিবকে নিয়ে পাশের সোলমান মামার বাড়ি ঘুমাতে যায়। সোলেমান মামার মা ছিলেন হায়দারের ছেটবেলা এমন কি সে বয়সের-ও গাইড। তিনি ছিলেন অত্যন্ত মিষ্টভাষী-শুদ্ধভাষী মানুষ। সে সময় ওই পাড়ায় এমকি গোটা এলাকায় তার মতো ভাষাভাষী মানুষ পাওয়া ছিল দুষ্কর। তার কাছেই হায়দার বাল্যশিক্ষা নিয়েছে; লেখাপড়া শিখেছে। যাহোক, তিনি হায়দাররকে নানান পরামর্শ দিলেন- ভবিষ্যতে সংসারের হাল ধরতে হবে; এখন আগের মতো বহেমিয়ান হয়ে চললে হবে না—ইত্যাদি ইত্যাদি।
তিনি চলে গেলে ৩ বন্ধু কথা বলতে বলতে একসময় গোটা বাড়ি নিঝঝুম-চুপচাপ হয়ে আসে অথবা ঘুমিয়ে পড়ে। ঘণ্টাখানেক হয়ত চলে গেছে। ঘরের কোণে কার যেন গোঙানিতে ওদের ঘুম ভেঙে যায়। প্রদীপ ও রাকিব বুঝে ওঠার আগেই টের পায়, ঘরের কোণে নয়, প্রদীপকে জড়িয়ে ধরে হায়দার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে অঝোর ধারায় কাঁদছে! একসময় হাউমাউ করে ডুকরে কেঁদে ওঠে সে। সান্ত্বনা দেয়ার কোনো ভাষা খুঁজে পায় না কেউই। ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে প্রদীপ। এ দুদিনের জমানো চাপাক্রন্দন হঠাৎ হায়দারের বুক ফেটে বেরিয়ে আসে। বেশ সময় লাগে ওকে শান্ত করতে। শান্ত হলে হায়দার আব্বার লেখা আব্বার একটা চিঠির কথা ওদেরকে শোনায় :
“তরুন বয়স থেকেই প্রচলিত অনেক কিছু মানতে চাইতাম না। অন্যদের দৃষ্টিতে আমি ছিলাম কিছুটা অপ্রচলিত-প্রথাবিরোধী এবং অনেকের দৃষ্টিতেই কিছুটা অস্বাভাবিক প্রকৃতির। গতানুগতিক ধারার বাইরে ছিল আমার জীবনবোধ, ধর্ম-দর্শন ও জীবনযাপন। ফলে পরিবারের কিছু বিষয়ে প্রায় সবার সাথে বিশেষ করে আব্বার সাথে আমার দ্বিমত হতো। এখন বুঝতে পারছি, সেগুলো কতই না ঠুনকো বিষয় ছিল; দ্বিমত না করে মেনে চললেও সমাজের কোনোই শোনায় ক্ষতিবৃদ্ধি হতো না! কতই না কষ্ট দিয়েছি তাঁকে! –
একটা কথা আমি কিছুতেই ভুলতে পারছি না। কোনো এক কারণে মতপার্থক্য হওয়ায় অভিমান করে বেশকিছু দিন বাড়ি যাওয়া বন্ধ রেকেছিলাম। একটা চিঠিতে আব্বা তাঁর নির্মিত নতুন বাড়ির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ‘দয়া করে’ হাজির হতে আমাকে দাওযাত করে একটি চিঠি লিখেছিলেন–যার শেষ কথাটা আমাকে এখন আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে; ভীষণ পীড়া দিচ্ছে । অব্বা লিখেছিলেন :
“তুমি না আসলে আমি খুব কষ্ট পাব; আসলে ধন্য হব”
ইতি
তোমার আশির্বাদক
আব্দুল কাদের খান
আব্বার মৃত্যু হায়দারকে বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করায় এবং সে একটু একটু করে বদলাতে শুরু করে।
এখন যখন নিজের সন্তানের কাছে মাঝে মাঝে একইরকম কষ্ট পেতে হয়; তখন আব্বার কথা খুব মনে পড়ে তার! মুক্তিযুদ্বের সময় তারা যেখানে পালিয়ে ছিল, সেখানে এবং সর্বত্র আব্বা ছিলেন সর্বজনপ্রিয় একজন মানুষ। তাঁর কিছু প্রিয় দিক হায়দারও পেয়েছে। কিন্তু তারমতো হতে পারেনি।
[আগস্ট শোকের মাস। খানসাহেবের পারিবারিক জীবনেও এটা ব্যাথাতুর একটি মাস। যখন হায়দার খান রাজশাহী বিশ্বদ্যিালয়ে ‘সাপের খেল’ নামক একটি রাজনৈতিক নাটকে সাপুড়ের অভিনয় করছে, তখন ১৯৮৪’র ১ আগস্ট তাঁর মেনটর ও অনুসরণীয় আব্বা তাঁদের ছেড়ে চলে যান। সে যখন সাপের খেল দিয়ে ক্যাম্পাস কাঁপাচ্ছে, তখন তার বাবা তার অজান্তে ঢাকায় মৃত্যুকে আলিঙ্গণ করছেন।]