ছোটদের গৌতম বুদ্ধ ‘পর্ব ৪’ । অদিতি ফাল্গুনী
প্রকাশিত হয়েছে : ১৩ নভেম্বর ২০১৮, ২:৩১ অপরাহ্ণ, | ২১৬০ বার পঠিত
বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণ
দীর্ঘ সাতাশ বছর আনন্দ বুদ্ধের সহচর ছিলেন। তিনি ছিলেন খুব ভালো একজন সংগঠকও। যেই বুদ্ধকে দেখতে আসুক না কেন, আনন্দ ঠিক তার জন্য একটা সময় বের করে ফেলতে পারতেন। বিশেষত যে ভিক্ষুরা বহু দূর থেকে আসত, তারা বুদ্ধের সাথে কথা বলার আগে আনন্দের সাথে কথা বলতে বেশি পছন্দ করত। কারণ, আনন্দের ব্যবহার ছিল খুবই আন্তরিক। শাস্ত্রজ্ঞানে অনভিজ্ঞ বৌদ্ধরা আনন্দের ধর্মোপদেশ শুনতে ভলোবাসত। আনন্দ তাঁর তিন রত (বুদ্ধ-ধম্ম-সংঘ) সম্মান করতে, পঞ্চশীল পালন করতে, বাবা মায়ের প্রতি বাধ্য হতে এবং ভিক্ষু সংঘকে দান করতে বলতেন। এভাবেই আনন্দের বয়স পঞ্চাশ হলো। আর বুদ্ধের বয়স ততদিনে আশি হয়েছে। নির্বাণ লাভ করার পর তাঁর পঁয়তাল্লিশ বছর পার হয়ে গেছে।
বুদ্ধ উত্তর করলেন, ‘আনন্দ, নির্বাণ অর্জন করতে চাইলে কখনোই মেয়েদের কথা ভাববে না। যদিও তোমার এখন বয়স হচ্ছে, তবু মেয়েদের দিকে না তাকানোই ভালো। যদি কোনো নারীর সংস্পর্শে আসতেই হয়, তবে সে বৃদ্ধা হলে তাকে মা, বয়সে অল্প বড় হলে বড় বোন ও বয়সে ছোট মেয়ে হলে ছোট বোন ভাববে ।’
পালি ধর্মশাস্ত্রের `মহাপরিনিব্বাণা সুত্ত’ অনুযায়ী ৮০ বছর বয়সে বুদ্ধ ঘোষণা দিলেন যে দ্রুতই তিনি `পরিনির্বাণ’ অর্জন করবেন। ‘পরিনির্বাণ’ হলো মৃত্যুহীন সেই অবস্থান যখন মানুষ তাঁর নশ্বর দেহ ছেড়ে চলে যায়। এই ঘোষণা দেবার পরপরই বুদ্ধ তাঁর শেষ আহার গ্রহণ করেন। কুন্ড নামে এক কামার তাঁকে এই খাবার দিয়েছিলেন। আহার গ্রহণের পরপরই বুদ্ধ ভয়ানক অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিন্তু বুদ্ধ তখন প্রিয় শিষ্য আনন্দকে ডেকে কুন্ডের পক্ষে নিয়ে বলেন যে, তাঁর দ্রুত মৃত্যুর সাথে কুন্ডের দেওয়া খাবারের কোনো সম্পর্ক নেই। বরং বুদ্ধকে তাঁর জীবনের শেষ খাবার দেবার জন্য কুন্ডকে সারাজীবন মানুষ মনে রাখবে। ইতিহাসবিদ মেত্তানন্দ এবং ভন হিনুবেরের মতে, বুদ্ধ খাবারের বিষক্রিয়া নয়, বরঞ্চ বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন।
বুদ্ধের শেষ খাবার কী ছিল তা বলা এখন কঠিন। থেরবাদী ধর্মগ্রন্থগুলোর মতে, বুদ্ধকে এক ধরনের শুকরের মাংস খেতে দেওয়া হয়েছিল। আর মহাযানীরা বিশ্বান করেন, তাঁকে ব্যাঙের ছাতা রান্না করে খেতে দেওয়া হয়েছিল। বুদ্ধের শেষ খাবার বিষয়ে থেরবাদী ও মহাযানী ধর্মগ্রন্থগুলোর এই মতানৈক্যই বৌদ্ধ ধর্মে ভিক্ষু ও সন্ন্যাসিনীদের কী ধরনের আহার গ্রহণ করা প্রয়োজন (আমিষ / নিরামিষ) সে বিষয়ে কিছু নির্দেশনা দেয়।
পরিনির্বাণে যাবার আগে আনন্দ মল্ল রাজ্যের কুশিনারার (বর্তমান ভারতের কুশিনগর) পরিত্যক্ত জঙ্গলে বুদ্ধের যাওয়ার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন। কিন্তু, বুদ্ধই আনন্দকে মনে করিয়ে দেন যে, একদা কুশিনারা ছিল এক ন্যায়বান চক্র ঘোরানো রাজার আনন্দে পরিপূর্ণ নগরী :
‘কুশবতী, আনন্দ, সারা দিন ও রাত জুড়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে দশ ধরনের শব্দে পরিপূর্ণ থাকত : হাতির বৃংহতি নাদ, অশ্বের হ্রেষা ধ্বনি, রথের চাকার ঘরঘর শব্দ, ঢোল বাদ্য, গীত ও বাদ্য, জনতার হর্ষধ্বনি, করতালি এবং খাও-পিও-আমোদ করোর হৈ চৈ।’
কাজেই বুদ্ধকে কুশিনারার শালকুঞ্জে নেওয়া হলো। অস্তগামী সূর্য যেমন রক্তিমাভা ছড়ায়, তেমনি পরিনির্বাণে যাবার আগে বুদ্ধের দেহেও অস্বাভাবিক দীপ্তি দেখা দিল। আনন্দ বুদ্ধের দেহের পাশে নতজানু হয়ে বসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘প্রভু! ভবিষ্যতে নারীর প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হওয়া উচিত হবে বলে আপনি মনে করেন? দয়া করে আমাকে আবার দিক নির্দেশনা দিন।’
বুদ্ধ উত্তর করলেন, ‘আনন্দ, নির্বাণ অর্জন করতে চাইলে কখনোই মেয়েদের কথা ভাববে না। যদিও তোমার এখন বয়স হচ্ছে, তবু মেয়েদের দিকে না তাকানোই ভালো। যদি কোনো নারীর সংস্পর্শে আসতেই হয়, তবে সে বৃদ্ধা হলে তাকে মা, বয়সে অল্প বড় হলে বড় বোন ও বয়সে ছোট মেয়ে হলে ছোট বোন ভাববে ।’
বুদ্ধ আনন্দকে নানা বিষয়ে বিশষত ভিক্ষু সংঘ গঠন বিষয়ে নানা উপদেশ দিতে শুরু করলেন। কোমল হৃদয় আনন্দ ভাবলেন বুঝি বুদ্ধের শেষ সময় উপস্থিত। তাই তিনি কাঁদতে শুরু করলেন। বুদ্ধের শেষ সময় উপস্থিত হয়েছে। এখন কার কাছেই-বা বোধি লাভের পরামর্শ চাওয়া যাবে?
বুদ্ধ তখন আনন্দকে আবার বললেন, ‘আনন্দ, দুঃখ করো না। আমি কি তোমাকে বারবারই বলিনি যে, এ পৃথিবীতেহ সবকিছুই অনিত্য? জীবন থাকলেই মৃত্যু থাকবে। তুমি আমাকে দীর্ঘদিন সেবা করেছ। তুমি অত্যন্ত পরিশ্রমী এবং সহিষ্ণু। আমি তোমার এই সৎ কাজের অবশ্যই পুরস্কার দেবো। আত্মার উন্নতির জন্য আরো পরিশ্রম করো।’ এরপর বুদ্ধ অন্য ভিক্ষুদের দিকে ফিরে বললেন, ‘ভিক্ষুগণ, আনন্দ দীর্ঘদিন আমার প্রতি অনুগত থেকে আমাকে সেবা করেছে। সে খুবই শান্ত এবং দয়ালু। তার স্মৃতিশক্তি প্রখর। তার মেধাবী কাজকর্ম পৃথিবীকে আলো দেবে।’
র্ঠিক এই সময়ে শালবনে চাঁদ দেখা দিল। চাঁদের আলোয় বুদ্ধের প্রশান্ত ও গভীর মনের দীপ্তিও উপস্থিত সব ভিক্ষুদের মাঝে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। নীরবে সবাই কাঁদতে থাকল। আনন্দ খুবই বিষণ্ণ হয়ে উঠলেন। যা হোক, কেঁদে তো সময় নষ্ট করা যাবে না। বুদ্ধ তাঁর শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করার আগেই তাঁর কাছ থেকে পরবর্তী যাবতীয় দিক নির্দেশনা নিতে হবে। কাজেই ভিক্ষুরা তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন,‘প্রভু, প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে আপনার নির্বাণের পর আমরা কাকে আমাদের নেতা মানব? দ্বিতীয়ত, আপনি পৃথিবী থেকে বিদায় নেবার পর আমরা কীভাবে বাঁচব? তৃতীয়ত, আপনার নির্বাণ লাভের পর আমরা মন্দ মানুষের সাথে কেমন আচরণ করব? চতুর্থত, আপনার নির্বাণ লাভের পর আমরা আপনার শিক্ষা কীভাবে মানুষের মাঝে আরো বেশি করে ছড়িয়ে দেবো?’
বুদ্ধ তাঁর স্বভাবসিদ্ধ দরদি কণ্ঠে বললেন, ‘সতীর্থ ভিক্ষুরা আমার। পঞ্চশীল তোমাদের প্রভু আর ধম্ম (সত্য) তোমাদের আশ্রয়দাতা। শুধুমাত্র এভাবেই তোমরা ধর্মের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতে পারবে।’
বুদ্ধ এরপর তাঁর সঙ্গী সকল ভিক্ষুকে ডাকলেন যে, তাদের মনে আর কোনো প্রশ্ন আছে কিনা। ভিক্ষুরা বললেন, তাদের মনে আর কোনো প্রশ্ন নেই। বৌদ্ধ শাস্ত্র অনুযায়ী এরপরই বুদ্ধ পরিনির্বাণ গ্রহণ করেন। বুদ্ধের শেষ কথা ছিল : ‘পৃথিবীতে সকলই অনিত্য। আপন মুক্তির জন্য ধৈর্যের সাথে সংগ্রাম করো।’
এরপর ধীরে ধীরে বুদ্ধ তাঁর শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন। বুদ্ধ আর পৃথিবীতে নেই শোনে সবাই তাঁকে শেষবারের মতো দেখতে এল। আনন্দ ভাবলেন যে, বুদ্ধ বেঁচে থাকতে খুব স্বল্প সংখ্যক নারীই তাঁকে কাছ থেকে দেখার ও তাঁর কথা শোনবার সৌভাগ্য অর্জন করেছে। কাজেই সবার আগে আনন্দ ভিক্ষুণী ও নারীদের বুদ্ধের প্রতি তাদের শেষ শ্রদ্ধা জানাতে সুযোগ করে দিলেন।
বুদ্ধের মৃত্যুর পর তাঁর দেহ দাহ করা হলো এবং অস্থি, নখ, চুল প্রভৃতি বৌদ্ধ নানা স্থাপনা এবং স্তূপে রাখা হলো যার কিছু আজও অবধি বিদ্যমান রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। উদাহরণস্বরূপ শ্রীলঙ্কার ‘দাঁত মন্দির’ বা —‘দালদা মালিগাওয়া’-র কথা বলা যায় যেখানে অনেকেই বিশ্বাস করেন যে, বুদ্ধের ডান দাঁতের ভগ্নাংশ রাখা আছে।
বুদ্ধের পরিনির্বাণের পর আনন্দ তিন দিন বিশ্রাম গ্রহণ করলেন। এরপর তিনি দ্রুতই রাজারহে গেলেন বৌদ্ধ ধর্মের প্রথম সঙ্গীতী (সম্মেলন) —তে অংশগ্রহণের জন্য। যাতে করে বুদ্ধের শিষ্যদের ধর্মের যাবতীয় সূত্র, বুদ্ধের উপদেশ এবং বিশ্বাসীদের জন্য পঞ্চশীল গ্রন্থনার কাজটি শুরু করা যায়। আনন্দ যদিও বোধি লাভ করেননি, তবু বুদ্ধের অন্যতম শিষ্য হিসেবে তিনি অনুভব করলেন যে, এমন বড় একটা কাজে সবাইকে সাহায্য করা তাঁর দায়িত্ব।
শ্রীলঙ্কার পালি ঐতিহাসিক ধারাপঞ্জী অনুযায়ী বুদ্ধের মৃত্যুর ২১৮ বছর পর ‘দীপবংশ’ এবং ‘মহাবংশ’ বা সম্রাট অশোকের অভিষেক সম্পন্ন হয়। চীনা ভাষায় সংরক্ষিত পুথি অনুযায়ী বুদ্ধের মৃত্যুর ১১৬ বছর পর শ্রীলঙ্কায় সম্রাট অশোকের অভিষেক সম্পন্ন হয়। সুতরাং থেরবাদী শাস্ত্র অনুযায়ী বুদ্ধের পরিবার্ণের তারিখ ৪৮৬ অব্দ এবং মহাযানী শাস্ত্র অনুযায়ী বুদ্ধের পরিনির্বাণের তারিখ ৩৮৩ অব্দ। যা হোক, দীর্ঘদিন ধরে থেরবাদী দেশগুলোয় বুদ্ধের মৃত্যুর তারিখ ৫৪৪ অথবা ৫৪৩ অব্দই ধরা হয়ে থাকে যেহেতু অশোকের রাজ্যাভিষেকের যে তারিখ বর্তমানে দেখানো হয়, তার প্রায় ৬০ বছর আগে অশোক সিংহাসনে বসেছিলেন বলে অনুমান করা হয়।
বুদ্ধের মৃত্যুর পর এ কথা সর্বজন সম্মতভাবে বিশ্বাস করা হয়ে থাকে যে, বুদ্ধ তাঁর অনুসারীদের বলেছেন যে, তাঁদের কোনো নেতাকে মান্য করা দরকার নেই। মহাকাশ্যপ প্রথম বৌদ্ধ পরিষদ কর্তৃক সংঘের সভাপতি নির্বাচিত হন। বুদ্ধের মৃত্যুর আগেই অবশ্য তাঁর প্রধান দুই শিষ্য মৌদগলন্য এবং সারিপুত্তর মৃত্যু হয়। বুদ্ধের জীবদ্দশায় তাঁকে প্রধানত ‘বুদ্ধ’, ‘মুনী,’ ‘ভান্তে’ এবং ‘ভো’ ডাকা হতো। তবে তাঁর পরিনির্বাণের পর তাঁকে ‘অর্হৎ’, ‘ভগবান’, ‘জিনেন্দ্র,’ ‘শাস্ত্র’, ‘সুগত’ এবং বিভিন্ন শাস্ত্রগ্রন্থেই `তথাগত’ হিসেবে সবচেয়ে বেশি সম্বোধিত।
আনন্দ তাঁর শিষ্যদের মাঝে বিশেষত সনকবাসের কাঁধে যাবতীয় দায়িত্ব দিয়ে পরিনির্বাণের জন্য উত্তরে গঙ্গা নদীর লক্ষ্যে হাঁটতে থাকেন। এ সময় মগধের রাজা অজাতশত্রু বৈশালীর সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। আনন্দ ভাবলেন এ দুই রাজ্যের যে কোনো এক রাজ্যে মৃত্যুবরণ করা তাঁর ঠিক হবে না। কারণ দুই দেশের মানুষই মৃত্যুর পর তাঁর দেহ ভষ্ম চাইবে। কাজেই তিনি গঙ্গা নদীর মধ্যবর্তী সীমানায় প্রবেশ করলেন।
বুদ্ধের মৃত্যুর পর প্রথম বৌদ্ধ সঙ্গীতী বা সম্মেলন
আনন্দ যখন রাজারহতে পৌঁছলেন, তখন প্রথম সঙ্গীতী (সম্মেলন) শুরু হতে যাচ্ছে। মহাকাশ্যপ সঙ্গীতীতে অংশ নেবার জন্য পাঁচশ ভিক্ষুকে পছন্দ করলেন। এদের সবাই ‘অর্থৎ’ বা যারা বোধি পেয়েছেন। আনন্দ যেহেতু বোধি পাননি, সেহেতু তাঁকে মহাকাশ্যপ নিলেন না।
প্রকৃতপক্ষে মহাকাশ্যপ আনন্দের শক্তির দিকটি বুঝেছিলেন। বুদ্ধের আশীর্বাদে তর্ক-বিতর্কে আনন্দের স্মৃতিশক্তি ছিল খুবই প্রখর। কাজেই মহাকাশ্যপ ভাবলেন, ‘অর্থৎ’ দের বিতর্কে বোধি লাভ না করা আনন্দের যোগদান করাটা ভুল হবে। অন্য ভিক্ষুরা যেহেতু আনন্দকে খুব পছন্দ করত, কাজেই সবাই আনন্দকে ভোট দিল। কিন্তু মহাকাশ্যপ বিরোধিতা করলেন।
আনন্দ মনে মনে খুব আঘাত পেলেও হতাশ হলেন না। রাতের বেলায় তিনি গভীর ধ্যানে বসলেন এবং মাঝ রাতে তিনি `বোধি’ লাভ করলেন। সকাল বেলায় দেখা গেল সম্মেলনের আলোচনা সভায় আনন্দ বসে আছেন। আনন্দকে তখন সূর্যের আলোয় উজ্জ্বল পদ্মফুলের মতো দেখাচ্ছিল। মহাকাশ্যপের নেতৃত্বে আনন্দকে অন্য ভিক্ষুরা সিংহাসনে বসালেন এবং আনন্দ তাঁর স্মৃতি থেকে আবৃত্তি শুরু করলেন। আনন্দ বৌদ্ধ ধর্মোপদেশ ‘ধম্মোপদ’ থেকে আবৃত্তি শুরু করলেন।
বুদ্ধের মৃত্যুর পরবর্তী বিশ বছর মহাকাশ্যপই বৌদ্ধ ভিক্ষুদের নেতা ছিলেন। কুড়ি বছর পর মহাকাশ্যপের বয়স একশর বেশি গলে তিনি পাহাড়ে চলে যান চির নির্বাণের জন্য। চলে যাবার আগে আনন্দকে তিনি সব দায়িত্ব দিয়ে যান। আনন্দের বয়স তখন আশি।
আনন্দের পরিনির্বাণ লাভ
আনন্দ তাঁর শিষ্যদের মাঝে বিশেষত সনকবাসের কাঁধে যাবতীয় দায়িত্ব দিয়ে পরিনির্বাণের জন্য উত্তরে গঙ্গা নদীর লক্ষ্যে হাঁটতে থাকেন। এ সময় মগধের রাজা অজাতশত্রু বৈশালীর সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। আনন্দ ভাবলেন এ দুই রাজ্যের যে কোনো এক রাজ্যে মৃত্যুবরণ করা তাঁর ঠিক হবে না। কারণ দুই দেশের মানুষই মৃত্যুর পর তাঁর দেহ ভষ্ম চাইবে। কাজেই তিনি গঙ্গা নদীর মধ্যবর্তী সীমানায় প্রবেশ করলেন।
রাজা অজাতশত্রু আনন্দের নির্বাণের খবর পেয়ে তাঁর মানুষজন নিয়ে গঙ্গা নদীর তীরে ছুটলেন। নদীর তীর অবধি পৌঁছতে পৌঁছতে আনন্দ ততক্ষণে নৌকা বেয়ে গঙ্গা নদীর মধ্যভাগে পৌঁছে গেছেন। অজাতশত্রু মাটির উপর পড়ে গিয়ে চিৎকার করলেন, ‘হে জ্ঞানী! আমাদের করুণা করুন। আমাদের তিন রতের আলো দিন। ফিরে আসুন।‘
উলটো দিকের তীরে বৈশালীর মানুষেরাও একইভাবে চিৎকার করছিল। নৌকায় বসে আনন্দ বললেন, ‘তোমাদের দুই দেশের ভেতরের যুদ্ধের কথা ভেবেই আমি নদীর মাঝখানে এলাম। যাতে আমার নির্বাণের পর তোমরা আমার দেহটি দু-টুকরো করতে পার।’
এ কথা বলে আনন্দ চতুর্থ ধ্যানে নিমগ্ন হলেন এবং তাঁর পবিত্র দেহটি মন্ত্রবলে তিনি নিজেই দুই দেশে দু-টুকরো করে দিয়ে দিলেন যাতে দুই দেশের মানুষই তাঁকে উপাসনা করতে পারে। আনন্দের এই ব্যবহারে মগধ ও বৈশালীর মানুষেরা যুদ্ধ করা কত যে অন্যায় আর লজ্জার কথা তা বুঝতে পারল। তারা যুদ্ধ থামাল আর বেঁচে গেল হাজার হাজার সাধারণ মানুষ।
বুদ্ধের শারীরিক বৈশিষ্ট্যসমূহ
বৌদ্ধ ধর্মীয় শাস্ত্রসমূহে বুদ্ধের সৌন্দর্যের বর্ণিল বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। জন্মগতভাবে একজ ক্ষত্রিয় হিসেবে বেড়ে ওঠার সময় তাঁকে সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে হয়েছে এবং শাক্য ঐতিহ্য অনুযায়ী বিয়ে করার আগে তাঁকে যোদ্ধা হিসেবে পরীক্ষা দিতে হয়েছে। কিংবদন্তি অনুসারে পিতা শুদ্ধোদন ছাড়াও অপর আর এক রাজা তাঁর শালপ্রাংশু দেহ সৌষ্ঠব দেখে মুগ্ধ হন এবং তাঁকে তাঁর সেনাবাহিনীর সেনাপতি হিসেবে নিযুক্ত হতে অনুরোধ করেন। এ ছাড়াও বৌদ্ধরা বিশ্বাস করেন যে, বুদ্ধের মহৎ মানবের ৩২টি লক্ষণ ছিল।
সনানন্দ নামে এক পুরোহিতের মতে বুদ্ধ ছিলেন সুদর্শন, প্রিয়দর্শন এবং অস্ত্যন্ত উজ্জ্বল বর্ণের অধিকারী। দেবতার মতো দেহ সৌন্দর্য ছিল তাঁর। কোনোভাবেই অনাকর্ষণীয় বলা যায় না!
‘গৌতম কী অদ্ভুত প্রশান্ত আর সুন্দর দেখতে! তাঁর দেহের বর্ণ স্বচ্ছ আর ঝকঝকে। শরৎকালের রোদের মতোই তিনি সোনালি। খোসা ছাড়ানো তাল ফলের মতো পরিষ্কার ও আভাময়, স্বর্ণকারের নিপুণ হাতে গড়া রক্তিমাভ স্বর্ণ যা গেরুয়া কাপড়ের উপর চকচক করে, তেমনি তাঁর গাত্রবর্ণও স্বচ্ছ ও ঝকঝকে।‘
বাক্কালি নামে তাঁর এক শিষ্য যিনি কিনা পরে একজন ‘অর্হৎ’ হয়েছেন তিনি বুদ্ধের সৌন্দর্যে এতটাই মোহিত ছিলেন যে, বাধ্য হয়ে বুদ্ধ তাঁকে বলতে হয়েছিল যে, বাহ্যিক সৌন্দর্যে নয়, বরং বুদ্ধকে তাঁর প্রচারিত `ধম্ম’—এর আলোকেই তাদের দেখা উচিত।
যদিও খ্রিস্ট পূর্ব প্রথম শতক পর্যন্ত বুদ্ধের মানবীয় মূর্তি দেখা না, তবু ‘দিঘা নিকায়া’র ‘লক্ষণ সূত্র’তে বুদ্ধের শারীরিক সৌন্দর্যের বর্ণনা রয়েছে। উপরন্তু বোধি অর্জনের পর কপিলাবাস্তুতে বুদ্ধ ফেরার সময় গৌতমের স্ত্রী যশোধরার পুত্র রাহুলকে তাঁর বাবার সৌন্দর্য বিষয়ে বলেন। এর বিশদ বিবরণ `নরসিংহ গাথা’-য় রয়েছে।
বুদ্ধের শারীরিক সৌন্দর্যের ৩২টি লক্ষণের মধ্যে ‘নীল চোখ’ সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
বুদ্ধের শিক্ষা ও বৌদ্ধ ধর্ম
পালি ধর্মশাস্ত্রে বুদ্ধের ঐতিহাসিক শিক্ষার মূল সারাৎসার পাওয়া যায়। খোদ বুদ্ধের মুখের বাণীও এতে পাওয়া যায় বলে অনেকে বিশ্বাস করেন। পালি ধর্মশাস্ত্র মহাযানী সূত্রের আগেই উৎপন্ন। আদি বৌদ্ধ ধর্মের গ্রন্থসমূহ অবশ্য সময়ানুযায়ী মহাযানী আগেই রচিত হয়েছে। পশ্চিমাদের মতে, মহাযানী বৌদ্ধ শাস্ত্রের চেয়ে হীনযানী শাস্ত্রই গৌতম বুদ্ধের মূল উপদেশ এবং ঐতিহাসিক শিক্ষার সারাৎসার বহন করে।
বৌদ্ধ বিশ্বাস অনুযায়ী এক জটিল প্রক্রিয়ার স্বভাবজাত উৎপাদন হিসেবে মনই দুঃখ তৈরি করে। বৌদ্ধ ধর্মীয় বিশ্বাসের কলমা সুত্ত অনুযায়,
—অনিচ্চ (সংস্কৃত : অনিত্য) : —পৃথিবীর সবকিছুরই একটা পরিসমাপ্তি আছে।
—দুঃখ (সংস্কৃত : দুঃখ) — পৃথিবীর কোনো কিছুই সুখের নয়।
—অনত্ত (সংস্কৃত : অনতমন) — অভিজ্ঞতার পৃথিবীতে কোনো কিছুকেই ‘আমি’ বা ‘আমার’ বলা যায় না।
—নিব্বানা (সংস্কৃত : নির্বাণ) —সত্তার পক্ষে সচেতনতার একটি স্তর বোঝা সম্ভব যা সম্পূর্ণ অসংগঠিত এবং শাস্তিপূর্ণ এবং চারপাশের পৃথিবীর সাথে মনকে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে উদ্বুদ্ধ করে।
যা হোক কিছু মহাযান স্কুল বা মত অনুযায়ী উপরিউক্ত ভাবনাগুলো কম-বেশি গৌণ। গৌতম বুদ্ধ কী শিখিয়েছেন এবং ভিক্ষুদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নানা শৃঙ্খলনামূলক আচরণ বিধি নিয়ে ধর্মমতের গুরুত্বপূর্ণ শাখাগুলোর মাঝে মতভেদ রয়েছে। এ কথা বিশ্বাস করা হয় যে, বুদ্ধ সংঘের ভিক্ষুদের জন্য কিছু শৃঙ্খলাপূর্ণ আচরণ বিধি শিখিয়েছেন।
বৌদ্ধ ঐতিহ্য অনুযায়ী বুদ্ধ নীতিশিক্ষা এবং সঠিক বোঝার ব্যাপারে গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি দৈবীতা এবং মুক্তি বা নির্বাণের বিষয়ে সম্পৃক্ত প্রতিটি বিষয়কেই প্রশ্ন করেছেন। তিনি আরো বলেছেন যে, মানুষ এবং ঈশ্বরের মাঝে কোনো মধ্যবর্তী শক্তি (পুরোহিত শ্রেণি) নেই। বুদ্ধ মানুষের জন্য শুধুই একজন শিক্ষক ও পথ প্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেন।
অন্যান্য ধর্মে বুদ্ধ
হিন্দু ধর্মে বুদ্ধকে বিষ্ণুর দশমাবতার মনে করা হয়। আহমদীয়ারাও বুদ্ধকে একজন নবী বলে মনে করেন। প্রাচীন চৈনিক তাও দর্শনে বুদ্ধকে লাওৎ-সু’র অবতার মনে করা হয়। খ্রিস্ট ধর্মে সন্ত জোসাফতের জীবন প্রকৃতপক্ষে বুদ্ধের জীবনীর আলোকেই সন্তু জোসাফতের জীবনী রচিত বলে মনে করা হয়। সংস্কৃত ‘বোধিসত্ত্ব’ থেকে আরবিয় ‘বোধসফ’ এবং গ্রেগোরিয় `ইয়োদাসফ।‘
‘বারলাম এব জোসাফত’ গল্পটি মূলত বুদ্ধর জীবনীর উপর ভিত্তি করেই রচিত বলে মনে করা হয়।
সমাপ্ত