আসুন যাঁরা সত্যিই ভালোবাসেন কবিতা ও সাহিত্যকে এই পোস্টে চোখ রাখতে আহ্বান জানাই।
বন্ধু, রঞ্জিত সিংহ চ’লে গেলেন। রেখে গেলেন যে কাজ তার জন্য কোনো মূল্যায়নই যথেষ্ট নয়। আমি আমার উদ্যোগে ওঁর অসামান্য কাজগুলোকে প্রকাশ করতে চেয়েছি। পর পর তিন দিন আমি বন্ধুদের জন্য আমার লেখা ভূমিকাসহ আমার সম্পাদনায় তিনটি কাজ সামনে আনবো।
সামান্য কিছু কথা সূর্যোদয়ের আগে …
নিরন্তর খোঁজ ও বিস্ময় একজন শিল্পীর মধ্যে সেই বীজ বপন করে যা তাঁর সৃষ্টির উপকরণ। তাঁর অনুভবে কোনো মাধ্যমই বাদ যায় না, সেখানে অঙ্কন, সঙ্গীত, সাহিত্য, চলচ্চিত্র, ভাস্কর্য মিলেমিশে তৈরি হয় এক ভিন্ন দৃষ্টি, বিশ্লেষ ও সংশ্লেষ ক্ষমতা। বিস্ময় ফুরোলে সৃজনশীলতাও অন্ধকারে ডোবে, তাকে গ্রাস করে দমবন্ধ ঘেরাটোপ। তাই সেতু একটি নয়, অসংখ্য জেগে উঠুক, সাহস নিয়ে হাঁটবো নিজেকে জানতে। সাহসে বাঁধবো সেই নতুনের সুর যা অভ্যাসের শত্রু । আসুন কবির আত্মযাত্রার তরঙ্গ লাগুক পাঠকের ভেতরে।
একটি গদ্যের শুরুতে লিখেছিলাম —
নাম: রঞ্জিত সিংহ।
ধাম: ৩৬, বালিগঞ্জ প্লেস
বয়স: গাছ-পাথর আছে।
ছবি তুলে নিরুদ্দেশের উদ্দেশে দিলে লোকে ভাবতে পারে ‘জমিদারবাবু জমি হারিয়েছিলেন সেই কবে’। মজা করছি না কালো ফ্রেমের চশমা পরা এই মানুষটি জমি নিয়ে আর ভাবেন না। তবে একদা জমি ছিলো টের পাওয়া যায়।
অ্যানালিটিকাল প্রবন্ধ লিখতে গেলে যে গুণগুলো থাকা দরকার, সেই গুণগুলোই তাঁর কলমকে শিক্ষিত করেছে ধীরে ধীরে। সামগ্রিকভাবে কবিতার ধারাকে জানতে গেলে তাঁর প্রবন্ধ অবশ্য পাঠ্য বলেই মনে হয়। অ্যানালিটিকাল প্রবন্ধ লেখা কঠিন ও গভীর শ্রমের, সেই সাথে প্রয়োজন- পাঠ অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে বিচারের দৃষ্টি। যা এই লেখকের সম্পদ বলেই মনে করি।অথচ সেখানে অ্যাকাডেমিক কোনো গতানুগতিক ঢং নেই। তাঁর লেখা ট্রিগার করে আপনাকে, উস্কে দ্যায় আপনার নিজস্ব মতকে। তিনি বলেন ‘সমালোচনার রীতি ও প্রয়োগ সম্পর্কে ধরতাই বুলি আওড়ে যাওয়া হয়তো আজকের দিনে কঠিন নয়। ‘মূল্যায়ন’ শব্দটির নিহিতার্থ থেকে দূরে অবস্থান করেও ওই শব্দের প্রতি মৌখিক প্রীতি দর্শাতে পারি।
রঞ্জিত সিংহ-এই নামটির সাথে অনেকেই পরিচিত, অনেকেই নন। সেটাই স্বাভাবিক, বাংলাসাহিত্যের খ্যাতনামা কবি ও প্রাবন্ধিকদের চেয়ে তাঁর কাজ যথেষ্ট মেধাযুক্ত ও উল্লেখযোগ্য হলেও তাঁর কাজের প্রতি নীরব থাকলেন সমসাময়িক বন্ধুরা ও উত্তরসূরীরা। আসলে ওঁর আভিজাত্য, প্রবল আত্মসম্মানবোধ, বিকিয়ে না যাওয়ার মানসিকতা- এসবই বোধ হয় কারণ। রঞ্জিত সিংহ’র কথায় ‘খ্যাতি,যশ, অর্থ সবাই চায়। আমিও ব্যতিক্রম নই। কিন্তু দোরে দোরে ভিক্ষা করে এই খ্যাতি,অর্থ আমি পেতে চাই না। এটা আমার অহংকার নয়,আত্মসম্ভ্রমবোধ।এইটি আমার জন্মবীজ বলতে পারেন। এর বেশি আমি আর কী বলতে পারি।”
অথচ এই মানুষটি উপকারের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন বিভিন্ন সময় কবি বন্ধুদের জন্য, পাশে থেকেছেন যে কোনো প্রয়োজনে সবসময়। সেভাবে দীর্ঘ সময় কোনো বড় প্রকাশকও এগিয়ে এলেন না তাঁর কাজকে সামনে আনার জন্য। অথচ প্রায় ৮৭ বছরের জীবনে ৬৭ বছর তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেছেন সাহিত্য সেবায়। শঙ্খ ঘোষ, আলোক সরকার, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, মণীন্দ্র গুপ্ত, দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রমুখ— যে আলো পড়লো তাঁদের উপর, সেই আলো কোনো অংশেই কম পড়া উচিত ছিলো না রঞ্জিত সিংহের উপর। আসলে এই বাংলায় আজও মিডিয়া হাউসের আলো যার উপর না পড়ে সে থেকে যায় সাধারণ, বাকিরা ‘অসাধারণ’। তার আর ‘বুদ্ধিজীবী’ হয়ে ওঠা হয় না।তবুও কোথাও প্রশ্ন থেকেই যায় এই দীর্ঘ নীরবতা নিয়ে। আমরা জানি কবিতাচর্চায় রঞ্জিত সিংহ এক স্বতন্ত্র স্বরের অধিকারী। এই দীর্ঘ ৬৭ বছর কবিতাচর্চার সাথে সাথে গভীর প্রজ্ঞা, পর্যবেক্ষণ, আত্মানুসন্ধান, বাংলা ও বিশ্বসাহিত্য পাঠ, সম্পাদনার অভিজ্ঞতা, কবিতার শিকড়কে মস্তিষ্ক দিয়ে আত্মস্থ করার যে প্রক্রিয়া তিনি চালিয়ে গ্যাছেন, তারই ফলশ্রুতি হিসেবে আমরা পেয়েছি অসামান্য সব প্রবন্ধ গ্রন্থ যা বোধে, অনুভবে, মননশীলতায় আলোড়িত করতে পারে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে। সমালোচনার নামে যে একদেশদর্শী লেখা আমরা পাই যা মূলত লেখকের স্তুতি ছাড়া কিছু নয়, সেখানে দাঁড়িয়ে তাঁর লেখা সমালোচনার জগতে আলোকবর্তিকার মতো। জীবনের সুদীর্ঘ সময় কাব্যরচনা করতে গিয়ে তিনি যে পথ দিয়ে হেঁটেছেন, সেই পথ-নিরীক্ষণের ফসল ফলেছে তাঁর প্রবন্ধে। সময় ও সীমাকে উপলব্ধি করেছেন গভীর অবলোকনে। আত্মজিজ্ঞাসা ও খননে তা হয়ে উঠেছে তাঁর নিজস্ব কাব্যবিশ্বাসের ভিত। অবশ্যই তা কতটা পোক্ত সে উত্তর দেবেন দীক্ষিত পাঠক। তিনি বলেন ‘সৎ কবির মতো সৎ পাঠকও হামেশা জন্মগ্রহণ করে না’। তিনি বিশ্বাস করেন স্পষ্ট, স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গীতে। ভ্রান্তির জায়গাকে দূরে সরিয়ে নিজস্ব মতেই তাঁর আস্থা। চোখ যার দৃষ্টি তারই হোক— আমার এই ভাবনায় তাই তাঁর সমর্থন। অন্যদিকে ‘রাবীন্দ্রিক স্বরবৃত্তের উত্তরাধিকার’ প্রবন্ধের একটি অংশ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য—’যে কবির অতীত অনিশ্চিত ভবিষ্যতও তাঁর অস্বচ্ছ।… সাহিত্যের ভবিষ্যৎ নির্ণয় করতে গিয়ে এক বিস্মৃতপ্রায় যুগ থেকে ঈশ্বর গুপ্তকে উদ্ধার করলেন বিষ্ণু দে খুব আন্তরিক কারণে। বিংশ শতাব্দীর তিরিশের দশকের একজন কবির কাব্যস্বভাবে ঈশ্বর গুপ্ত পুনর্জন্ম লাভ করলেন।” এখানে আলোকিত হয়ে ওঠে লেখকের বিশ্বাস, পরম্পরার প্রতি, ঐতিহ্যের প্রতি।
অ্যানালিটিকাল প্রবন্ধ লিখতে গেলে যে গুণগুলো থাকা দরকার, সেই গুণগুলোই তাঁর কলমকে শিক্ষিত করেছে ধীরে ধীরে। সামগ্রিকভাবে কবিতার ধারাকে জানতে গেলে তাঁর প্রবন্ধ অবশ্য পাঠ্য বলেই মনে হয়। অ্যানালিটিকাল প্রবন্ধ লেখা কঠিন ও গভীর শ্রমের, সেই সাথে প্রয়োজন— পাঠ অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে বিচারের দৃষ্টি। যা এই লেখকের সম্পদ বলেই মনে করি।অথচ সেখানে অ্যাকাডেমিক কোনো গতানুগতিক ঢং নেই। তাঁর লেখা ট্রিগার করে আপনাকে, উস্কে দ্যায় আপনার নিজস্ব মতকে। তিনি বলেন ‘সমালোচনার রীতি ও প্রয়োগ সম্পর্কে ধরতাই বুলি আওড়ে যাওয়া হয়তো আজকের দিনে কঠিন নয়। ‘মূল্যায়ন’ শব্দটির নিহিতার্থ থেকে দূরে অবস্থান করেও ওই শব্দের প্রতি মৌখিক প্রীতি দর্শাতে পারি। এতে আমাদের বিবেকও তেমন বিদ্ধ হবে না। অবশ্য যতখানি ইতিহাসবোধ, নৈরাত্ম্যতা অথবা নিরাসক্তি অর্জন করলে এই শব্দের মৌল অর্থের অবহিতি সম্ভবপর তা দীর্ঘদিনের মানসিক সংগঠনের প্রয়াসপ্রসূ।’
তাঁর লালিত কাব্যবিশ্বাস, কাব্যজিজ্ঞাসা, বিচারের দৃষ্টিভঙ্গীকে সম্মান জানাতেই হোতো। তাই বলা ভালো, নিজেদের প্রয়োজনে তাঁর যাবতীয় গদ্য, দুটো খণ্ডে প্রকাশ করার চিন্তাভাবনা মাথায় আসে। স্বেচ্ছায় সে কাজ তিনি আমার হাতে তুলে দ্যান। আমি প্রথম খণ্ডে রেখেছি ‘শ্রুতি ও প্রতিশ্রুতি’, ‘কবিতা যখন আত্মকথা’, এবং দীর্ঘদিন ধ’রে বিভিন্ন পর্বে লেখা কবিদের কবিতা নিয়ে একটি বিশেষ আলোচনামূলক অংশ ‘তারুণ্যের কবিতা, কবিতার তারুণ্য’। ‘তারুণ্যের কবিতা, কবিতার তারুণ্য’-এই অংশে বেছে নিয়েছি প্রত্যেকের উপর আলোচকের একটি ক’রে উপযুক্ত লেখা ।
এই কাজে এগিয়ে আসে ‘তবুও প্রয়াস’ প্রকাশণীর পক্ষ থেকে সেলিম ও দেবোত্তম। তাদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। পাঠক আপনাদের স্পর্শে কবি, প্রাবন্ধিক রঞ্জিত সিংহের এই শ্রম সার্থক হবে এই আশা রাখি।
ভালোবাসায়
সব্যসাচী হাজরা ( আলিপুর, কলকাতা)
১.০৫.২০২১
লেখক পরিচিতি
শূন্য দশক, প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ- ‘তৃতীয় ফ্লাওয়ার শো’, ‘ওভ্যানোর ওভেনে’, ‘পসিবিলিটি ও টিলিবিসিপ’, ‘উটবিকার’-(প্রথম ও দ্বিতীয় প্রকাশ), ‘৯ আঁকা ০’, ‘আনুপাহাড়ের জলছবি’, ‘ঝরাপাখিদের চেকমেট’, ‘নির্বাচিত শূন্য’ , f(x) নামের লোকটা।