কেন লিখতে হয় কবিতা । ঋতো আহমেদ
প্রকাশিত হয়েছে : ০১ মে ২০২৩, ৭:৩০ অপরাহ্ণ, | ৭৩৭ বার পঠিত
আজকের দিনে সাহিত্যের উপযোগিতা আসলে কোথায়? কেন লিখতে হয় একজন কবির কবিতা? মেসেঞ্জারে এইরকম দুটি প্রশ্ন এসে গেঁথে আছে অনেকক্ষণ, কাজের ব্যস্ততায় খেয়াল করতে পারিনি। কিংবা হয়তো খেয়াল করলেও তখন তাৎক্ষণিক উত্তর করা যেত না বলেই এখন এই রাতের নিরবতায় চোখ ও মনের সামনে খুলে ধরলাম এদের। কী উত্তর করা যায় এর? কোন দায় থেকে লেখেন একজন লেখক? আত্মিক না সামাজিক? সুধীরদা লিখেছিলেন, ‘যখন কেউ কবিকে তাঁর সামাজিক দায়ের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চান, তিনি যেন অন্তঃশীলভাবে সমাজমনস্ক পথের পাঁচালিকারকে গণশত্রুর রূপকার হতে নির্দেশ দিচ্ছেন।’ তিনি আরও লিখেছেন, সমাজের আলো-অন্ধকারকে কে কীভাবে শিল্পে নিয়ে আসবেন তা একান্তভাবে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির উপর নির্ভর করে।… কবিতার কবিতা হয়ে ওঠা ব্যতিরেকে অন্য কোনও দায় আছে বলে আমার জানা নেই।’ ফ্রাঞ্জ রাইট বলেছিলেন, কবিতা লিখতে তাঁর বিশেষ মুহূর্তের প্রয়োজন হয়। সব সময় তা লিখতে পারেন না। অপেক্ষায় থাকেন, কখন সেই বিশেষ মুহূর্তটি আসবে তাঁর কাছে। নিজেকে সব সময় সতর্ক রাখতেন, প্রস্তুত রাখতেন। কেননা, যে কোনওভাবে, যে কোনও সময় সেই মুহূর্তটির অবতারনা ঘটতে পারে। ‘ওয়াকিং টু মার্থাস ভিনিয়ার্ড’—এর অধিকাংশ কবিতা তিনি লিখেছিলেন গির্জার প্রার্থনা-সভায় যেতে যেতে কিংবা সেখান থেকে ফিরতে ফিরতে। না, তখনই লিখে ফেলেননি। স্পার্ক পয়েন্টটা মনে রাখতেন শুধু। পরে, বাসায় ফিরে সাথে সাথে টাইপরাইটার নিয়ে বসে যেতেন।
কখনও এমনও প্রশ্ন আসে মনে, কবিতা রচনার মানে কী দাঁড়ায় তবে? ‘বস্তু পৃথিবীতে বেঁচে থাকার যে কর্কশ একঘেঁয়েমী, অন্তহীন ক্লিন্নতা, তার থেকে, তার নিষ্ঠুর নখর থেকে মননের ভেতর যে নান্দনিক দিক, রস ও অমৃত বেঁচে আছে তা দিয়ে একটি সুন্দর পদ্মফুলের মতো সৃষ্টি ও নির্মাণকে বাঁচিয়ে রাখা?’ অন্তর্গত মুক্তিবাসনার অবিশ্বাস্য আগুন উদ্বোধিত করতেই কি তবে লেখেন কোনও কবি কবিতা?
আমার ক্ষেত্রে অবশ্য সে রকম নির্দিষ্ট কোনও পদ্ধতি নেই। চাইলেই ভাবতে পারি না; চাইলেই লিখতে পারি না। অতোটা প্রতিভা আমার নেই। আমি যা করি তা হচ্ছে, আমি সব সময় আমার অগ্রজ আর সমসাময়িক কবিদের সৃজন-কৌশল নিয়ে ভাবি। ভাবি ওগুলো ছাড়াও আর কি কি কৌশলে লেখা যেতে পারে। আমার এই ভাবনা সব সময়ই চলে আমার ভেতর। সব সময়ই এক ধরনের নিরীক্ষার ভেতর দিয়ে যেতে ভালো লাগে আমার। প্রাত্যহিক জীবনের মগ্নতার মধ্যে থেকেও যখনই কোনও ভাবনার উদয় হয় মনে, যখনই কোনও আপাত ঘটনা বা দৃশ্যের আড়ালে দেখতে পাই কোনও সত্য-কে, অনুভব করতে পারি কোনও আশ্চর্যকে, তখনই… তখন থেকেই তা আমার মাথার ভেতর ঘুরপাক খেতে থাকে। খুঁজতে থাকে তার প্রকাশের উপযুক্ত সৃজন-কৌশল। ইনস্ট্যান্টলি অবশ্য কবিতার ওই মুহূর্তটিকে ধরে রাখার জন্য প্রথম দু’একটা লাইন টুকে রাখি গুগল দস্তাবেজে। পরে সময় করে ফিরে আসি আবার। তবে, সব সময় যে এটা খুব কাজে দেয় তা নয়। স্তিমিত হয়ে পড়ে কিংবা বলা যায় প্রায়শই হারিয়ে যায় ওর সূচনা মুহূর্তটির সেই আবেদনটুকু। কেবল যেগুলো তা উৎরাতে পারে, সেগুলোই কবিতার আকার পেয়ে যায়।
আবার, কখনও এমনও প্রশ্ন আসে মনে, কবিতা রচনার মানে কী দাঁড়ায় তবে? ‘বস্তু পৃথিবীতে বেঁচে থাকার যে কর্কশ একঘেঁয়েমী, অন্তহীন ক্লিন্নতা, তার থেকে, তার নিষ্ঠুর নখর থেকে মননের ভেতর যে নান্দনিক দিক, রস ও অমৃত বেঁচে আছে তা দিয়ে একটি সুন্দর পদ্মফুলের মতো সৃষ্টি ও নির্মাণকে বাঁচিয়ে রাখা?’ অন্তর্গত মুক্তিবাসনার অবিশ্বাস্য আগুন উদ্বোধিত করতেই কি তবে লেখেন কোনও কবি কবিতা? ‘একজন দার্শনিক যেমন সত্য উদ্ঘাটনের জন্য খুঁজে বেড়ান পৃথিবী থেকে পৃথিবীর বাইরের বিভিন্ন ঘটনার, কিন্ত তাঁর প্রকাশভঙ্গি হয় বিমূর্ত। তেমনি একজন কবি সেই বিমূর্তকে যথাক্রমে মূর্ত করে তোলেন জাগতিক বা পরাজাগতিক, বাস্তবিক বা পরাবাস্তবিক ভাবনা ও চিন্তার বোধায়নে।’ কবিতার মানে তবে তো বিশেষ রসসৃষ্টির মাধ্যমে এক-একটি সত্যের উন্মোচন আর বৃহৎ স্বপ্নের নির্মাণও। আর, কবিতার দৃশ্যাতীত সেইসব সত্য, আমাদের জীবন-অভিজ্ঞতার সত্য। আমরা যেই সত্যকে জানতে পেরে আশ্চর্য হই, অভিভূত হই।