সিগন্যাল | ইউসুফ হিরণ
প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ অক্টোবর ২০২২, ৩:৩২ পূর্বাহ্ণ, | ৪০০ বার পঠিত
জামরঙ্গা সন্ধ্যা তখন কালশিটে। সদ্য বিধবা নারীর কান্নার মতো বৃষ্টি হচ্ছিল থেমে থেমে। ছন্দপতন হয় প্রতিদিনের ফিকির শেষে ফিরতে থাকা মানুষের। ভীষণ ব্যস্ততা কারো, কেউ বেরোয় সন্ধ্যা দেখতে, কেউ শপিঙে। অপেক্ষমাণ রিকশা সিএনজির যাত্রীরা তীব্র যানজটে ব্যাকুল। চালকেরা অবিচলিত। রাস্তা তাদের মা-বাপ।
পলিথিনে মোড়া আলাউদ্দিন ইমদাদ রিকশায় বসে ক্লেদযুক্ত তাড়া অনুভব করতে পারত। বাসায় পৌঁছে ফ্রেশ হয়ে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সোঁদা গন্ধে সিমরানকে নিয়ে প্রেম প্রেম ভাবনায় মজে এক কাপ চা খেতে পারত। সেটা তখন হবার নয়।
বিকালে ছিল মিনহাজ স্যারের ফেয়ারওয়েল। কলেজের পিয়ন আব্দুর রহিম বলল, “স্যার একজন ভালো মানুষ। স্যারের মত ভালো মানুষ হয় না। স্যারের কথা কি বলব? আমি ভাষা পাইতেছি না। স্যার খুব ভালো মানুষ। এই বলে আমি আমার বক্তব্য শেষ করলাম।” তারপর আলাউদ্দিন ইমদাদের সিরিয়াল। নাক মোছা বন্ধ করে টিস্যু হাতে দাঁড়িয়ে আলাউদ্দিন ইমদাদ শুরু করে, “অবশেষে আমরা সবাই একসাথে আজ। বিদায়ী বন্ধুর উদ্দেশ্যে আমাদের ছোট আয়োজন। একটু পর মিষ্টিমুখ করব সবাই। সারাজীবন জেনেছি সুখের সংবাদে মিষ্টিমুখ করতে হয়, কিন্তু আজ মিষ্টিমুখ করব বিচ্ছেদের যাতনায়। মিনহাজ স্যার সম্পর্কে কি বলব? স্যার শহরের পরিচিত মুখ। কোথাও ঝামেলায় পড়লে মিনহাজ স্যারের কলিগ বলে পরিচয় দেই, ঝামেলার সমাধান নিমিষে হয়ে যায়।” পাশে বসে থাকা আরেক শিক্ষক আলাউদ্দিন ইমদাদের শার্টে আলতো টান দেয়, “স্যার যেখানেই থাকবেন, ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন। কামনা করি স্যার আমাদের মাঝে আবারো ফিরে আসবেন। ধন্যবাদ।”
ফেয়ারওয়েল শেষে বাসায় ফিরতে পারত দর্শনের শিক্ষক আলাউদ্দিন ইমদাদ। কিন্তু পৃথিবীতে কীভাবে কী ঘটে তা বোঝা মুশকিল। সবকিছু প্রেডিক্ট্যাবল হলে কোনো সমস্যাই থাকত না। বিপরীতও হতে পারে—সবকিছু প্রেডিক্ট্যাবল করতে গিয়েই যত দুর্দশা। ফেয়ারওয়েল শেষে মিষ্টিমুখে সে ছোটে ইংরেজি টিউশনে। যেতে যেতে তার মনে হয় আজ বোধ হয় সিগন্যালটা পাওয়া যাবে।
সিমরান অনাগ্রহী। আলাউদ্দিন ইমদাদও সিরিয়াস মুডে পড়ায়। অথচ আলাউদ্দিন ইমদাদের বিধ্বস্ত হৃদয়ে সিমরানের আগমনের কাল ও হেতু অজানা। সিমরান নামটা তার ভালো লাগে, পাঞ্জাবী নাম, ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে’ সিনেমাতেও সিমরানকে তার ভালো লেগেছে। আলাউদ্দিন ইমদাদের মনে হয় যে-কোনো মুহূর্তে সিমরান পায়ে পা ঘষে সিগন্যাল দিবে। সে প্রতিবার গোলাপ সাথে টিউশনে যায়, সিগন্যাল পেলেই নগদে ব্যাগ থেকে বের করে সারপ্রাইজ দিবে। তরতাজা ফুল প্রতিবার তার উচ্ছ্বাসের সাথে শুকিয়ে মরে।
শৈশব, কৈশোর ও তারুণ্য এক লহমায় পেড়িয়ে আলাউদ্দিন ইমদাদ খেয়াল করে যে সে বুড়িয়ে যাচ্ছে, মাথার চুল পাতলা। প্রথম অভিজ্ঞতা বিশ্রী ছিল, প্রতিদিনের অভ্যস্ত চেহারা ঠেকেছিল অপরিচিত।
আলাউদ্দিন ইমদাদের পার্থিব আকাঙ্ক্ষা নাই। সহকর্মী গণিতের শিক্ষক মিজানুর রহমানের পকেট ব্যাচ পড়িয়ে ভারী। দর্শনের মতো সিরিয়াস বিষয়ে সবার অনাগ্রহে সুখ তার ভেতর বঙ্কিম হয়। ছোট ছোট মানুষের ছোট ছোট বৈষয়িক আনন্দ, দুশ্চিন্তা ও অন্ধত্ব তার ভেতর অনুকম্পা সঞ্চার করে।
লিখতে বসে সে, আজ লিখতেই হবে সিমরানের জন্য চিঠি। সে লিখে, “ছোট মানুষ বিশালতার ভ্রমে তার ক্ষুদ্রতাকে ঢাকার ব্যার্থ প্রচেষ্টায় মগ্ন থাকে। আর মহান মানুষ তার ক্ষুদ্রতা ঠিক ঠিক অনুধাবন করে।” আলাউদ্দিন ইমদাদের কলম থেকে আর বাক্য বেরোয় না।
খটমটে সেই চিঠি আলাউদ্দিন ইমদাদ সিমরানকে দেয় নাই। যে চিঠি দিয়েছিল সেটা সিমরানের বাবা নিজাম তালুকদারের হাতে।
“সিমরান,
অনাত্মীয়ের ভিড়ে তোমাকে আমার আত্মীয় মনে হয়েছে সে কবে! মনে নেই।
বেদনা ঝড়ো শীতল পৃথিবীতে পুরোদস্তুর
নগ্নতায় তুমি এসেছিলে
শুয়েছিলে সকলের চাইতে নিঃস্ব শীতল তুমি
যতক্ষণ না জড়ালো তোমায় চাদরে এক নারী।
ব্রেখটের কবিতার চারটে লাইন। তোমাকে ভেবে মাত্র অনুবাদ করলাম। আর কী লিখব বুঝতে পারছি না।
ইতি
আলাউদ্দিন ইমদাদ”
“এটা কী? কীসব লিখেছেন? মেয়ের বয়েসি ছাত্রীর কাছে এসব লিখতে লজ্জা করে না?”
কোনো কথাই আলাউদ্দিন ইমদাদের কানে যাচ্ছিল না, চোখে তীব্র যন্ত্রণা।
সিমরানের বড় ভাই বলে, “আব্বা, পত্রিকার লোকদের খবর দিব? লুচ্চায় দেশ ভরে গেছে।”
“দেয়া কি ঠিক হবে? আমাদের নামও তো চলে আসবে, মান সম্মানের ব্যাপার।”
“মান সম্মান যাওয়ার মত কিছু ঘটে নাই আব্বা।”
“যা ভালো মনে করো। মরেটরে গেল কি না দেখো, কোন সাড়া শব্দ তো পাই না। পালসটা একটু চেক করো।”
“ভং। আরো কয়েকটা দিলে……….।”
“থাক, দরকার নাই। উল্টা ফেঁসে যাবো।”
চোখ একটা খুলে আলাউদ্দিন ইমদাদ তার চারপাশে মানুষের ভিড় দেখে। পৃথিবীর গর্জন মৃদু থেকে মৃদুতর হচ্ছে। নেহারীর ঝোলে রুটি ভিজিয়ে খেতে তার খুব ইচ্ছা করে। মতিন হাজির সাথে সাথে। ছেলেটা কাজের। মতিন সরিষার তেল মৃদু গরম করে আলাউদ্দিন ইমদাদের মাথায় ম্যাসাজ করে। আরামে তার চোখ ঢুলুঢুলু করে।
মতিন বলে, “আমার বাপে আছিল এক আউলা। মায়ে কয় আমি যখন পেডে আছিলাম হালায় গেছে গা মায়েরে ছাইড়া। কেন ছাইড়া গেছে জানেন স্যার?”
“কেন?”
“মায়ে অনেক বছর বাদে আমারে পেডে দরছে। পোলাপাইন অয় না বইলা বাপে দুঃখে গেছে গা। আমার মা আরেক বেক্কল। আমি যে পেডে আছি হেইডাও বাপেরে কয় নাই। হগলে মায়ের পেডের খবর জানত হুদা আমার বাপেই জানত না।”
ঢুলুঢুলু চোখে আলাউদ্দিন ইমদাদ মতিনকে জিজ্ঞেস করে, “মতিন, তুই এতো ভালো রান্না শিখেছিস কার কাছ থেকে?”
“আমার ওস্তাদের কাছ থেইকা শিখছি।”
“ওস্তাদের নাম কি?”
“নাম বলা নিষেধ আছে স্যার।”
“এ আবার কেমন কথা? নাম বললে কি ওস্তাদ লজ্জা পাবে?”
“আপনেরে দিলে দরলে ওস্তাদ নিজে আইয়াই মোলাকাত করব স্যার।”
আলাউদ্দিন ইমদাদ মতিনের মাথায় চাটা মারে। মতিন খিলখিল হাসে।
“তোমাকে আমার ভালো লাগে।”
“আপনাকেও আমার ভালো লাগে স্যার।”
“আগে বলো নি কেনো?”
“বলেছি তো। আপনি কি ওসব খেয়াল রাখেন? মেয়েরা ভালো লাগার কথা একটু ঘুরিয়ে বলে। ছেলেরা মাথামোটা, কিচ্ছু বোঝে না।”
আলাউদ্দিন ইমদাদ ব্যাগ থেকে ফুল বের করে সিমরানের হাতে দেয়। শুকিয়ে যাওয়া ফুল দেখে সিমরান রিনরিন হাসে।
দরজার বাইরে অপেক্ষমাণ বিস্ময়ের ব্যাপারে আলাউদ্দিন ইমদাদের ধারণা ছিলো না। সিমরানকে দেখে আলাউদ্দিন ইমদাদের মনোজগত আলোড়িত ও বিস্মিত। গতসন্ধ্যার নির্বুদ্ধিতার পরিণতির কথা ভেবে সে বিচলিত, অথচ তার ইচ্ছা করে সিমরানের শুদ্ধ অবয়বের ভেতর বিলীন হতে।
সিমরান চিঠি হাতে বলে, “বোকার মত তাকিয়ে আছেন কেন?”
আলাউদ্দিন ইমদাদ চুপ।
“প্রেমের কবিতা না বোধ হয়। ঠিক বলেছি স্যার?”
“লেখাটায় কেমন জানি মাতৃত্বের গন্ধ আছে। আপনি আমাকে স্নেহ করেন। বাসার কেউ বুঝেনি। অঘটনটা তাই ঘটে গেল।”
“ভিতরে আসতে বলবেন না স্যার?”