সিগনেচার । ইউসুফ হিরণ
প্রকাশিত হয়েছে : ০৭ মার্চ ২০১৮, ১২:২০ পূর্বাহ্ণ, | ১৯৯১ বার পঠিত
মতিন সাহেবের উদাসীনতা প্রতিদিন পাল্লা দিয়ে বাড়ে। শেষ কবে রাশেদার সাথে একটু আহ্লাদ করে কথা বলা হয়েছে মনে পড়ে না, কিন্তু নির্লিপ্ততার সাথে আশ্লেষের শেষ যেন তার নাই। কত বর্ষা আসে ফাল্গুন আসে, মদন সাহেব ধরাতে নানান শরীরে ঝংকার উন্মাদনা সঞ্চার করতে ক্লান্ত, আর মতিন সাহেব তখন কিনা মরণাপন্ন। ধ্যান ব্যবসায়ীদের একটা সেমিনারে যাওয়ার সুযোগ অবশ্য তার হয়, এক কলিগ অলমোস্ট জোর করে তুলে নিয়ে যায়। গোপনাঙ্গের মালিশ বিক্রেতার মত অসাধারণ কনফিডেন্স নিয়ে বলে, “ভাই, সিরিয়াসলি কইতেছি, উপকার পাইবেন।” উপকার হবে কি হবে না সে পরের বিষয়, তার চাইতে বড় বিষয় কোথায় কখন কোন রত্ন লুকিয়ে থাকে বলা তো আর যায় না। টেকের পয়সা দু চার খরচ করলে অন্তত পয়সার মায়ায় কিছুটা উপকার না হয় সে শুষে নিল। এই ভাবনা মাথায় বুলিয়ে একটা সেমিনারে সে এটেন্ড করেই ফেলে। সুললিত ঠান্ডা কন্ঠে ধ্যানগুরুর নানান সাজেশনের নহর বয়ে যায়, ব্যাকগ্রাউন্ডে রিলাক্সিং মিউজিক। কিন্তু তার আত্মবিশ্বাস এখন ফাটা ডিমের মত, ওতে তা দিয়ে বাচ্চা পয়দা হবে না। তার চেয়ে ভাল ডিমটা ভেঙ্গে হালকা গোলমরিচের ছিটা দিয়ে ওমলেট বানিয়ে খেয়ে ফেলা। সেটাও যে হবার না। মতিন সাহেব আরো নেতিয়ে যায়। ক্যারিয়ার নিয়ে আদৌ কি কোন মাথা ব্যাথা আছে তার? ধ্যানগুরু বলে, “যখন কেউ জিজ্ঞেস করে, ‘আপনি কেমন আছেন?’, দ্বিতীয়বার চিন্তা না করে বলুন, ‘আলহামদুলিল্লাহ্, আমি ভালো আছি।’ ‘আমি’ শব্দটা জোর দিয়ে বলবেন। কর্মজীবনের চ্যালেঞ্জগুলো ইতিবাচকভাবে দেখবেন।” গুরু অবশ্য ভুল বকে বলে তার মনে হয় না, সেমিনারে যারা অংশগ্রহণ করে তাদের বেশিরভাগই পারিবারিক, দাপ্তরিক, প্রেম-ভালবাসা ইত্যাদি উদ্ভূত হতাশা নিয়ে মাথা ঠুকে। তারা ঠিক অসুস্থ না, আরোগ্য লাভের আশাও তাদের নাই। বরং সেলফ-ম্যানেজমেন্ট একটা প্রোগ্রামে তালিকাভুক্ত হওয়াটা জরুরি বলে অনেকে প্রকাশ করে। সমস্যাটা ম্যানেজমেন্টজনিত। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা বিশেষ মূল্য ছাড়ে এটেন্ড করে তার সাথে। যে গতি আর স্রোতে সবকিছু চলছিল তাদের জীবনে, তা থেকে হঠাৎ ছিটকে পড়ে কোন না কোন কারণে। আবার অনেকে হয়ত নতুন সময় আর ইস্ট্যাব্লিশমান্টে প্রবেশের পূর্ব-প্রস্তুতি হিসাবে ব্যাপারটা বিবেচনায় নেয়, সদ্য এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে অনেক ছাত্র যেমনটা করে, কলেজের প্রস্তুতি হিসাবে আগে থেকেই ব্যাচে প্রাইভেট পড়া শুরু করে। তারা আবার নতুন করে ফিট খাওয়ার ইচ্ছা থেকে অথবা পূর্ব-প্রস্তুতির প্রতিজ্ঞা থেকে নাম লিখায়। মতিন সাহেবের সমস্যা তার নিজের কাছেই পরিষ্কার না। কোন অটোসাজেশনের মালিশে উপকার পাবার আপাত সম্ভাবনা যে নাই, তা সে নিশ্চিত।
প্রাত্যহিক জীবনের মানুষ না জেনেই তার ইতিহাস মুদ্রণ করে যায়। তবে ঐ জীবন বড্ড দুরূহ, ঘরে ফিরে শোকাতুর হয়ে, কখনো মেজাজ দেখিয়ে মাথাব্যাথা ঝেড়ে ফেলা মানে শান্তির ঘুম। কেউ কেউ আবার ঘুমোয় না, উন্মুক্ত ক্ষত যত্নআত্তির বাড়াবাড়িতে বড় তরতাজা হয়। বিষাদে ভর করে তারা আরো হতদরিদ্র হতে হতে বায়ুশূন্য বেলুনের মত চুপসে যায়। তবুও তারা শোকাতুর হয় না। মতিন সাহেবের ঘটনাটা যখন জানাই আছে, চেতনা ফুসফুস করে তার মগজে হুইসেল দেয়, সেলফ-মেইড ইগজ্যামপ্লারি একটা মাল হতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে তো ঐ কাজই করত- কবিতা আবৃতি, বিতর্ক, আর্ট গ্যালারী, তত্ত্বের ঝাঁজ- শালা কিছু বাদ ছিল নাকি! আচ্ছা, তাকেই কি সবকিছু ডিসাইড করতে হবে? নিজের টাইপিস্ট নিজেই হবে হুইসেলের বেসুরে? কোন এক জাদুমন্ত্রের বলে নিজের অক্ষমতা কাটিয়ে উঠা তার পক্ষে সম্ভব হয় না? সে কি উচ্চদরের চাকুরে বা আমলা হওয়ার খায়েশ লালন করত? ক্রিয়েটিভিটির লাইন ধরলে মন্দ কি? ব্যবসা? উহু, বেনিয়াগিরি চলবে না। তবে কি করা যায়? হাজারটা অপশন, সময় সীমিত। অবসাদ জিনিসটা সে তখনই টের পায়, জেনেশুনে তার ব্যক্তি টাইমলাইনের ইতিহাস মুদ্রণ চারটেখানি কথা নয়। ভেতরের আকারবিহীন কোন অস্পষ্ট অনির্বচণীয় আহ্বান আর প্রত্যাখ্যান যেন তাকে ন্যাংটো করে ছেড়ে দেয়।
গত কয়দিন ধরে অফিস থেকে সরাসরি বাসায় ফিরে না সে। অলিতে গলিতে অনর্থক হাটা, চায়ের দোকানে বসা অথবা গরম তেলে পেঁয়াজু ভাজা নিবিষ্ট নয়নে দেখা। পেঁয়াজু ভাজা দেখতে দেখতে পৃথিবীর বুকে তার মৃতপ্রায় হামাগুড়ি সম্পর্কে অনিশ্চয়তা আর আতঙ্ক আরো তীব্র হয়। সে কি কারণে কোথায় হাটে, বসে, হুট করে দাঁড়িয়ে পড়ে, অথবা বাসায় ফিরবে কি ফিরবে না, অথবা বাসায় ফিরলে কোন পথে কিভাবে ফিরবে, নিশ্চিত না। তবু মতিন সাহবে বাসায় ফিরে, কৈফিয়তের ব্ল্যাংক চিরকুট কুচিকুচি করে ছিঁড়ে অরক্ষিত। বাসায় ফিরে দরজা বন্ধ করে একা একা অন্ধকারে বসে থাকে ঘন্টা খানেক।
কিছুটা অস্বাভাবিকতা রাশেদার খেয়ালে ধরা দেয় আগেই। রাতে বাচ্চারা শুয়ে পড়লে, হালকা সাজে, এনিমেল প্রিন্ট অন্তর্বাসে মতিন সাহবের গায়ে ঘষাঘষি করে, কিন্তু মর্দের বিকার নাই। খাটের চারপাশে কিছুক্ষণ ঘুরঘুর করে সুবিধা না পেয়ে কামদেবতার নীরব প্রস্থান। দেহের পালায় ব্যর্থ রিক্ত হয়ে বাঘিনী অতপর তার খোলস ছেড়ে শুয়ে পড়ে। দুটো বাচ্চাই সিজারে হয়েছে, তলপেট ফাটা দাগে একটূ ঝুলে, তারপরও অতোটা অনাকর্ষণীয় সে না। খুব সহজেই নিতান্ত হাবাগোবা ছেলেটাও কাত হতে পারে, শিকারিগুলার কথা তো বাদই। বদমাশগুলা চোখ দিয়েই ভিতরের সবকিছু স্ক্যান করে নেয়। ত্রিশ থেকে পয়ত্রিশ বছর বয়সী কিছুটা মেদহীন নারী শরীরের প্রতি ছেলেগুলোর ফ্যান্টাসি তো আর কম নাই, প্রতিদিনই তো সে টের পায়, তাদের দৃষ্টি কখনো মেকি নয়। মতিন সাহেবের তাতে কোন বিকার দৃশ্যমান না। শরীর তার লাশের মত ঠান্ডা, বিন্ধুমাত্র উত্তাপ নাই। ঘুমের ঘোরে মাঝরাতে গোঁ গোঁ শব্দ করে ধীরে ধীরে নিষ্প্রাণ।
অফিসের বিনয় বাবু কয়েকটা ফরওয়ার্ডিং লেটার টেবিলে রেখে যায়। মতিন সাহেবের খেয়াল যে কোন দিকে? চা আর সিগারেটের দিকে বোধ হয়, সামনে রাখা লেটারগুলোতে দস্তখত যে দিতে হবে তা বেমালুম। বিনয় বাবু অতি সাবধানে টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে, “স্যার, ১২ টায় মিটিং, যাবেন না? পনের মিনিট লেইট।” মিটিং হলরুম তার কাছে এক আতুরঘর। আতুরঘরে বসে অস্থির হয়ে মতিন সাহেব ঝিমায়, তার গলা খুব একটা শোনা যায় না। কারো সাথে ভদ্রতার খাতিরে দৃষ্টি বিনিময়ও হয় না। নানান রকম ব্যর্থতা সে প্রতিদিন গিলে, আর তার শরীর অবশ হয়। এমন এক দূর্বোধ্য পুস্তকে পরিণত হয় যে তাকে তর্জমা করে মুশকিল। অথচ প্রাত্যহিক জীবনে তার উচিত নিজেকে তর্জমা করা, আর বিনা বাক্য ব্যয়ে নানারকম তফসির মেনে নেয়া। লোকমান সাহেব তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলে, “আপনার ঘর-সংসার টিকে আছে কিভাবে? এতোটা বেখেয়ালি হলে হয়? চাকরী তো করেন একেবারে দায়সারা, যেন দয়া করছেন। যে কাজে আপনার রুটি-রুজি আসে, সেটাকে অন্তত একটু সম্মান তো করবেন। অদ্ভুত চিড়িয়া তো। কিছু বলছেনও না। স্যরি ট্যরি কিছু একটা তো বলবেন। এমন আনফিট মানুষ আমি আমার কর্মজীবনে দেখি নাই। ট্র্যাক রেখে চলেন, you have to be ready to confront all upcoming challenges. নইলে ছিটকে পড়বেন, লিখে রাখুন। আপনি আর কি লিখবেন! কাকে কি বলি! শুনেন, ব্যক্তিক, সাংসারিক, দাপ্তরিক, রাজনৈতিক, আধ্যাত্মিক যা কিছু আছে, বিষয়গুলা আলাদা রাখার চেষ্টা করেন। একটার ইফেক্ট আরেকটার উপর ফেলবেন না। আপনি আমার সামনে থেকে যান তো। সহ্য হচ্ছে না।”
এই লোকমান সাহেব কিনা সেদিন তার বাসায় পার্টির আয়োজন করে, বউয়ের জন্মদিন। আর ঢঙ্গি মাগীটার কারবার দেখো, কেকের মোমবাতিগুলো ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে ঠোঁট উলটে চোখে এক পরত লজ্জা ঝুলিয়ে ঢঙ করে যাচ্ছে অনবরত। সেদিন মতিন সাহেবের গলায় প্রথম টাকিলা চড়ে। এক পেগ টাকিলা গলায় চালান দিয়ে সাথে সাথেই লবণ মাখানো লেবুর একটা টুকরো মুখে পুড়ে দিতে হবে। ওসব ফরেন জিনিস তার কপালে জোটার কথা না, বন্ধুরা মিলে আগে শখ করে চাঁদা ফেলে কেরু এন্ড কোং গিলত নাক বন্ধ করে। কোথায় রাজরাণী আর কোথায় চুতমারানি! মাল মাথায় চড়ার পর পার্টির সব ধাড়ী মহিলাগুলোকে যুবতী রাণীর মত লাগে। ঠোঁট চোখা করে উল্বণ শব্দ করে গা মোচড় দিয়ে কিসব বলে যাচ্ছে। এসবের ভিড়ে লোকমান সাহেব কখন জানি এসে তার কাঁধে হাত রাখল, “যা দেখছেন, মোহ বুঝলেন। পার্টি শেষে যখন একা বসে ভাবি, দেখি যে আমার আসলে কিছুই নাই। আপনি যেরকম নিঃস্ব, আমিও তেমন। আমরা সবাই সমান। এই দুনিয়ায় আমি আপনার বস, কিন্তু ঐ দুনিয়ায় আপনি আর আমি এক কাতারে বিচারের অপেক্ষায়।” বলেই লোকমান সাহেব ফ্যাচ ফ্যাচ করে কাঁদে। শালার মাথায় মাল ভালোই চড়ে। মতিন সাহেবের ইচ্ছা করে টেবিলের উপর দাঁড়িয়ে প্যান্টের চেইন খুলে লোকমান সাহেবের মুখে মুতে দিতে। খুব রয়েসয়ে নিজেকে সে সামলে রাখে। আর সামলে রাখবেই বা না কেন? জীবনের প্রথম প্রেমটা যখন পাছা দুলিয়ে পরঘরনী হয়ে বলে গেল, “তুমি ছাড়া এই হৃদয়ে আর কোন পুরুষ দাগ কাটবে না”, খুব ফোঁসফোঁস করলেও তার ইচ্ছা হয় নাই বিপরীতে দু চার কথা শুনিয়ে দেওয়ার। আর এ তো অফিসের বস, দুই চার সিভিল খিস্তি দিয়ে কাজ আদায় করতেই তো বসেছে। সারাজীবন নিজেকে সামলিয়েই রাখার চমৎকার এক অভ্যাসও তার গড়ে উঠে। অন্যের বাতিকের নিরন্তর প্রবাহ নীরবে হজম করে ফেলা, নয়ত বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। এতো যে আত্মসংযম করে চলে, তারপরও কি তাদের দন্ডের সুখ মিটে না?
বাসার দরজায় টোকা না দিয়ে লক খুলে বিড়ালের মত শব্দহীন পদক্ষেপে ডাইনিং রুমের প্যাসেজটা পাশ কাটিয়ে তার ব্যক্তিগত রুমটাতে ঢুকতে গিয়েই রাশেদার মুখোমুখি হয় মতিন সাহেব, “এমন জঘন্য মানুষ আমি দেখি নাই। ফোনটা রাখো কই?”
মতিন সাহেব কথা গুছিয়ে নিতে পারে না, “বাইরে বাতাসটা চমৎকার ছিল তো, ভাবলাম একটু হাইটা আসি। ফোন সাইলেন্ট ছিল, খেয়াল করি নাই।”
“ওহ, রঙ তামাশা সব একলাই করো। শেষ কবে আমাকে নিয়া একটু ঘুরতে গেছ, মনে আছে তোমার?”
“আরে, যাব বাপ। একটু ঘুছাইয়া নেই।”
শালা শুয়োর, তোকে বিয়ে করতে গিয়ে অনেক ভালো ভালো প্রপোজাল ফেলে দিছি। তখন তো খুব রঙের আলাপ করতি, ‘জান, সব ঠিক হয়ে যাবে। জান, এক ছাদের নিচে আসলে আন্ডার্স্ট্যান্ডিং বাড়বে।’ তোর আসল রঙ তো এখন দেখা যায়। শুয়োরের জাত।
“এত বছরে গুছাইতে পারো নাই, আমি মরলে পরে খাটিয়া নিয়া ঘুরতে যাবা। আগে একটু যন্ত্রের মত বাধ্য হয়েও টুকটাক কেয়ার দেখাইতা, এখন বাল এক কোণায় নেতিয়ে পড়ে থাকো।”
মতিন সাহবে কিছু না বলে কাপড় চেইঞ্জ করাতে ব্যস্ত।
“তুমি কোন টাইপের মানুষ, জানো? যারা বউয়ের কাছ থেকে গন্ডা গন্ডা হিসাব করে বুঝে নেয়, কিন্তু বউ কি চায় আর না চায় তা নিয়া ভাবার সময় নাই। কাগজপত্তরে লেইখা তো নিয়া আসছ, ফিক্সড ডিপোজিট হয়ে গেছি। লাভের মাখন তুলে খাও। নিজের ঠ্যালা উঠলে কুত্তার মত গন্ধ শুকা শুরু করো, ঘেন্না লাগে তখন। কিন্তু আমার বেলায় শূণ্য, সবই শূণ্য।” রাশেদা বিলাপে বিসংবাদ।
“বাদ দাও তোমার ঘ্যানর ঘ্যানর।” নিবিষ্ট নয়নে মতিন সাহেব সিলিং ফ্যানের চক্কর দেখে শুয়ে।
“এখন তো ঘ্যানর ঘ্যানর লাগবেই। আমি তো ফ্রিতে খাটনি দিতেছি। শালা শুয়োর, তোকে বিয়ে করতে গিয়ে অনেক ভালো ভালো প্রপোজাল ফেলে দিছি। তখন তো খুব রঙের আলাপ করতি, ‘জান, সব ঠিক হয়ে যাবে। জান, এক ছাদের নিচে আসলে আন্ডার্স্ট্যান্ডিং বাড়বে।’ তোর আসল রঙ তো এখন দেখা যায়। শুয়োরের জাত।”
“তুই তোকারি করবা না তো। ফালতু বস্তিমার্কা অ্যাটিটিউড কোনখান থেকে যে নিয়া আসছ।”
রাশেদা কথা না বাড়িয়ে ধপাস করে দরজাটা বন্ধ করে চলে যায় রান্নাঘরে। এই রান্নাঘরে রোমাঞ্চ করার কত খায়েশ যে মতিন সাহবের ছিল। জয়েন্ট ফ্যামিলিতে তো আর রান্নাঘর দাপড়ে বেড়ানো যাবে না। প্রতি সপ্তাহে বৃহস্পতিবার যখন অফিস কোনরকমে সেড়ে ট্রেন বা বাস কিছু একটাতে চড়ে বাড়িতে যেত, সমস্ত উত্তেজনা আর শীৎকার গিলে ফেলে ধীর শব্দহীন নিঃশ্বাসে কাজটা সেড়ে ফেলত, পাশের ঘরটা মায়ের। প্রথম বাচ্চাটা হলো আর এর মধ্যে ইনক্রিমেন্ট কিছুটা বেড়ে বেতনটা বেড়ে গেল। রাশেদাকে নিজের কাছে নিয়ে আসা যায় এখন। কিন্তু ইতোমধ্যে পুঁচকেটাও বড় হয়ে গেছে, তার আফসোসের আর শেষ নাই। রাতে খাবার টেবিলে রাশেদা রাগ ক্ষোভ কিছুটা ভাঁজ করে রেখে দিয়ে পরেরদিন তার কলেজের বান্ধবীর বাসায় পার্টির কথাটা জানায়। তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফিরতে হবে। ফোন তো দিয়েছিল সেটা জানাতেই, কিছু একটা কিনতে তো হবে। খালি হাতে যাবে নাকি? আশ্চর্য!
রাশেদার ঘনিষ্ট বান্ধবী সুলেখার পার্টিতে মতিন সাহবে কি কাণ্ডটাই না করল। কারো সাথে একটু হাসিমুখে ভালমন্দ জিজ্ঞেস করলে কি জাত চলে যায়! নাহ, আমাদের এলিট মহাশয়ের সাইত্রিশ বছর বয়সী কপালে আশি বছরের বৃদ্ধ মুদ্রাঙ্কিত, নাক সটান উঁচু করে এক কোণে বসে আছেন। আরে বেটা, এখানে যে লোকজন এসেছে তারা তোমার মত ফকিন্নি নাকি? পার্টির সুবাদে তারা তোমার সাথে এক ছাদের নিচে এক টেবিল শেয়ার করছে। এমনিতে কি মতিন সাহেব কখনো তাদের নখের দেখা পাওয়ার যোগ্যতা রাখে? মতিন সাহেবের ‘সাহেব’ সম্বোধনও তো খুব একটা সাহেবি চালের না। বড় কর্তারা ছোট কর্তা কর্মচারীদের ‘সাহেব’ সম্বোধন করে একটু সম্মানজনক উপায়ে হিউমিলিয়েট করে।
মতিন সাহেবের আর কি করার থাকে? এসব পার্টি সম্পর্কে তার ধারণা আরামদায়ক না। সুলেখার স্বামী যেমন বলল, “মতিন সাহেব, কোন কাজই কিন্তু ছোট নয়। আপনি যখন কাজের মনোহারিতা পেয়ে যাবেন, দেখবেন ছোট কাজই তখন ভালো লাগছে। যেখানেই যাবেন, সিগনেচার বয়ে বেড়াবেন, নিজেকে একটা ইউনিভার্সাল পাসপোর্ট বানিয়ে ফেলবেন। যেকোন পরিস্থিতি, যেকোন জায়গায় বিচরণের সক্ষমতা না হলে কি চলে?” তার ইচ্ছা করে শালার বীচি বরাবর লাথি কষাতে। ছাত্রাবস্থায় থাকলে কাজটা করে ফেলতেও পারত। ঐ সময়টায় তার মনে হত, জীবন একটা লহমা শুধু, যখন সে অসম্ভব স্বাধীন। তখন নানান মুখোশের দুয়ার খুলে যায়, আরো গভীরে একের পর এক মুখোশের আড়ালে মুখোশের মালিক ফেরারি, আড়ালে সকল কলকাঠি নাড়ে। অনন্ত সম্ভাবনা জাল পেতে অপেক্ষমাণ। শুধু সঠিক জালটাতে টান দিতে হবে, সঠিক মুখোশের সাথে একই টেবিলে চা সিগারেট হাতে আলাপ জমবে। অনন্ত সম্ভাবনায় সে তখন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যেত। যদি এই হারামজাদাকে কোনভাবে ঐ সময়টাতে নিয়ে নিজের সামনে দাঁড় করানো যেত, কোন জাল টানাটানি না করে পূর্ণ সজ্ঞানে ও স্বাধীনতায় বেটার ল্যাওড়াটা বরং থেতলে দেয়া যেত। সেটা হবার নয় বলে তার আফসোস হয়।
রাশেদাও যে কিভাবে এই আহাম্মকের প্রশংসা করে, মতিন সাহেব অসংখ্যবার ভেবেছে। রাশেদার ভাষায়, “শফিক ভাই অমায়িক, সভ্য ও চমৎকার একজন মানুষ। এটিকেট দেখেছ তার, পিউর জেন্টলম্যান, পোশাকআশাকে কথায়-চলনে রুচির প্রশংসা না করে উপায় কি আছে? আশেপাশের মানুষদের মোটিভেটেড রাখতে তার ক্লান্তি নাই। বউ বাচ্চা নিয়ে প্রায়ই বিদেশ ঘুরে বেড়ায়।” আর সে কি না এক মাল, সেই মধুচন্দ্রিমা ছাড়া জীবনে একবারও বালুকাবেলায় বসে সূর্যাস্ত দেখে নাই। তাও সময়টা ভালো কাটলে একটা কথা ছিল, মোমেন্টস, আহা ঝগড়া করেই বর্বাদ হয়ে গেল। থাইল্যান্ড থেকে আসা চিনি মাখা রাবারের মত জঘন্য খেতে জেলো চিবোতে চিবোতে সে কল্পনা করে, থাই মেয়েদের স্তন ধরতে না জানি কেমন। ঐ বেটা নিশ্চয়ই জানে। বেটার সিগনেচার আছে- নম্র আদবকায়দা থেকে মাগীবাজি সবই করতে পারে।
ঝামেলাটা বাঁধে রাশেদা যখন আড়ালে ডেকে নিয়ে বলে শফিক ভাইয়ের সাথে একটু ভালো সম্পর্ক রাখতে, একটু অভিনয় করে হলেও কার্টেসি মেইনটেইন করতে। শফিক ভাইয়ের চ্যানেল ভালো, পরিচিতিও ভালো, বড় বড় জায়গায় আসা যাওয়া। কখন কে কোন কাজে লেগে যায় তার কি কোন ঠিক আছে? বিপদ-আপদ মানুষের তো লেগেই থাকে। খোদা না করুক এমন কোন বিপদ ঘটে গেল যে শফিক ভাইয়ের কাছে ধরনা দিতে হলো। তখন কোন মুখে শফিক ভাইয়ের মুখোমুখি হবে? লোকটার মনটাও তো ভালো, উপকার করবে ঠিক। তবুও নিজের খচখচানি তো আর কাটবে না। তাছাড়া মতিন সাহেবকে তো আর সবার সাথে এরকম হাত কচলে বিনয়ী হতে হবে না। নেটওয়ার্কের বড় বড় নৌডগুলোতে একটু কাচুমাচু হয়ে থাকতে হবে, লেজ নাড়তে হবে। কিছুটা নমনীয় হলে তো ক্ষতি নাই, চলতে ফিরতে নিজের মাঝে তো নানান রকম পরিবর্তন নিয়ে আসতে হয়, একটু শিখে নিতে হয়। “লক্ষ্মী সোনা, আমি তোমাকে কখনো কিছু রিকোয়েস্ট করেছি? অন্তত এই রিকোয়েস্টটা রাখো আমার জন্য।”
আকারে প্রকারে পরিচিত-অপরিচিতের মিশেলে শহরটা হঠাৎ খানাখন্দে ভর্তি হয়ে যায়। তাদের দুজনের মাঝে রচিত স্থবির নদীর বাতাস আরো থমথমে হয়ে শব্দ বাক্যে সুড়সুড়ি দেয়। তারা একে অপরকে যাই বলেছে তা পরিবর্ত সাধন হয়ে অন্য কোন সংবাদ আরো জটিলতার সূত্রপাত করে। অন্যকোন আলাদা সত্তা নিজের নিয়মে টিকে আছে তাদের মাঝে। নিজের নিয়মে নিঃশ্বাস নিচ্ছে আর তাদের শোচনীয় দশা থেকে স্বাদ আর শক্তি নিয়ে আরো বলীয়ান হয়ে গ্রাস করে যায় প্রতিদিন। সে তো অসংখ্যবার ভেবেছে নরম ঘাসে শুয়ে অথবা মাটি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অনেক উঁচুতে ভসমান কোন ছোট ঘরের দরজার গোঁড়ায় পা ঝুলিয়ে বসে তার অসুস্থতা থেকে সমস্ত মিষ্টতা শুষে একটু স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে, মুমূর্ষ আত্মায় শিষ গজাতে। সে তা করে নাই। নিজের প্রতি তার অশ্রদ্ধা আসে। সে না নিজে মুক্ত হতে পারল, আর রাশেদাকে সঙ্গে নিয়ে মেয়েটার জীবন এলোমেলো করে দিল। রাশেদার গল্পটা সুন্দর হতে পারত, আরামদায়ক আর সাবলীল। বিদেশ ঘুরে ঘুরে সঠিক উচ্চারণে সঠিক সমুদ্র তটের নামটা উচ্চারণ করে আশেপাশের ঈর্ষাকাতর মানুষদের তাক লাগিয়ে দিতে পারত। বিদেশের কোন রেস্টুরেন্টে কোন আইটেমটা না খেলে জীবন একেবারে বাজে খরচা হয়ে যাবে, তার একটা ফিরিস্তি দাঁড় করিয়ে সবাইকে চমকের উপর চমক দিয়ে একটা উষ্ণ আমেজ ঠোঁটে ঝুলিয়ে কথা বলতে পারত। খুবই স্মুথ আর নুইস্যান্সওয়ালা জীবন। আর পেছনে পেছনে অন্য কোন মেয়ে, তার ভেজা ক্ষত থেকে থকথক করে বেরিয়ে আসা পুঁজের দূর্গন্ধ ছড়িয়ে রাশেদার স্বামীর এটিকেট আর মনোহারিতা নিয়ে প্রশংসা করতে পারত। সুলেখার মত সে নিজেও ছাইপাশ উপদ্রব দর্শনের বিরক্তি আর আনন্দের মিশেলে বিশেষ টনিক সেবনে খাঁটি সুখী জীবনযাপনে মজে থাকত।
দাসোচিত একটা মনোভাব তাকে কুড়েকুড়ে খায়। দূর্বল দাসদের মতো সেও লোকমান সাহেবের সামনে কাচুমাচু হয়ে পিছনে গিয়ে গাল দেয়। ব্যাকগ্রাউন্ডে চালু থাকে নীরব প্রতিরোধের চর্চা। রাশেদা তেমন খারাপ প্রস্তাব তো আর দেয় নাই। সে ব্যাকগ্রাউন্ডে নীরবে শফিক ভাইয়ের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করতে পারে। প্রথমটা চাকরি খোয়াবার ভয়ে, দ্বিতীয়িটা উপরি কিছুর আশায়। এই যে মতিন সাহেব মনে মনে হারামজাদাকে ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করছে, অবাকই হয় সে। নিমিষেই ব্যাপারটা ঘটছে কিভাবে? ব্যাকগ্রাউন্ডের লিরিক আর টোন যদি একটু বদলে দেয়, তাহলে কিরকম অনুভূতি হতো? মনের সমস্ত পীড়া ঝেড়ে পরিষ্কার করে সিম্পলি একটা স্নব হয়ে শ্রদ্ধা আর অবজ্ঞার মিশেলে নিভাঁজ শান্তিতে প্রতিটা দিনকে আরো করুণভাবে আশ্লেষের ইচ্ছাটা উঁকি দেয়। মনের ব্যাধির কি হবে? অসন্তুষ্ট শহরে মনের ব্যাধিতে ধুলোর থাক জমে। সন্ধ্যার আলোর জাদুর ছোঁয়ায় ব্যাধিরা বরং অবসন্ন হয় কিছুক্ষণের জন্য অথবা আমৃত্যু, ধুলোর স্তর আরো উঁচু হতে হতে ঐ উঁচু শপিংমলে স্পর্শ করে। সেখানে সন্ধ্যা অথবা রাতের সিনেমা শো শেষে মানুষেরা ক্লান্তি ঝেড়ে হাজারো প্রতিজ্ঞার বাহুল্যতায় একে অপরকে শান্ত করে রাখে।
রাশেদার সাথে হেঁটে মতিন সাহেব বাসার দিকে ফিরে। এক ঝাঁক বিদ্যুৎ বৃষ্টি শেষে বাতাসটা মোহনীয়। তার সামনে আগামীদিনের একটা রূপরেখা ক্রমশ উন্মোচিত হয়, একটা যৌক্তিক বশ্যতা তাকে পরাভূত করে। সে এতোদিন বিস্ফোরিত হয় নাই, একটা দেয়াল সামনে তুলে আত্মরক্ষা করে যায়। মোহনীয় বাতাসে রাশেদার হাত ধরে সামনের দেয়ালটা মতিন সাহেব ভেঙ্গে ফেলে। ছোট ছোট ধাপে দুজনে হাটে। দুপাশের বাসাগুলো সদ্য আলো নিভিয়ে দেয়ার একটা আবহ ছড়িয়ে দেয়। কিছু কিছু রুমে আলো জ্বলে, মাস্টার বেড। ঐ রুমগুলো হয়ত শীৎকারের প্রস্তুতি নেয়, বিছানাগুলো উষ্ণ আর এলোমেলো হওয়ার জন্য পরিপাটী হয়। অতীত আর ভবিষৎ যখন মুখোমুখি, অতীত স্মৃতির গরলে তার ভয় হয়। প্রেম তখন অবেলায় ক্ষয়ে যায়, প্রত্যেক চুম্বন মুমূর্ষ। তার চেয়ে ভালো শীৎকার আর ঘামে নেয়ে দুঃস্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা আর নৈরাশবিহীন চমৎকার একটা ঘুম- সিগনেচার।