লুইস গ্লুকের একগুচ্ছ কবিতা । আল ইমরান সিদ্দিকী
প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ অক্টোবর ২০২২, ১২:১৯ পূর্বাহ্ণ, | ৩৯৭ বার পঠিত
অমেয়
এক গ্রীষ্ম ছিল
যে বারবার ফিরে এসেছে
এক ফুল ছিল, যা একেক সময় একেক ভঙ্গিতে ফুটেছিল।
মোনার্ডা ফুলের ক্রিমসন রং, দেরিতে ফোটা গোলাপের ম্লান সোনালি রং
এক ভালোবাসা ছিল
এক ভালোবাসা ছিল, অনেক রাত ছিল
মক অরেঞ্জ গাছের গন্ধ
জুঁই এবং লিলির করিডোর
তখনও বাতাস বইছে।
অনেক শীতকাল ছিল, কিন্তু আমি চোখ বন্ধ করেছিলাম
দ্রবীভূত ডানাসহ শীতল সাদা বাতাস ছিল।
একটা বাগান ছিল যখন তুষার গলতো
আকাশি এবং সাদা; আমি বলতে পারিনি
ভালোবাসা থেকে আমার নির্জন দূরত্বের কথা-
এক প্রেম ছিল; তার অনেক কণ্ঠস্বর ছিল
এক ভোর ছিল; কখনও কখনও
আমরা একসাথে সে ভোর দেখেছি
এখানে ছিলাম আমি
এখানে ছিলাম আমি
এক গ্রীষ্ম ছিল, যা বারবার ফিরে আসছিল
এক ভোর ছিল
দেখতে দেখতে বুড়ো হয়ে গেলাম।
মক অরেঞ্জ
শোনো বলি, চাঁদ নয়
ওই ফুলগুলিই মূলত বাগান আলো করে রাখছে।
ঘৃণা করি আমি তাদের।
ঘৃণা করি ওই ফুলগুলিকে, যেমন
ঘৃণা করি আমি যৌনমিলন—
একজন পুরুষের মুখ আমার মুখকে সিলগালা করে দিচ্ছে—
শরীরকে অবশ করে দেয়া পুরুষের শরীর।
ওদিকে কান্না কেবল নিজেকে লুকিয়ে ফেলে—
যৌথতার কী হীন, অবমাননাকর ভিত্তি!
নিজের অন্তর্দেশে, আজ রাতে, আমি শুনতে পাই
প্রশ্ন আর প্রশ্নের যথাযথ উত্তর—
ক্রমাগত জলের মতো ফুলে-ফেঁপে উঠছে
আর ধ্বসে গিয়ে বিভক্ত হয়ে পড়ছে পুরনো সব পরিচয়ে, সত্তায়।
ক্লান্তিকর প্রতিহিংসা। দেখোনি তুমি?—
আমাদের বোকা বানিয়ে রেখেছে
আর জানালা দিয়ে গন্ধ ভেসে আসছে মক অরেঞ্জ ফুলের।
কীভাবে শান্ত থাকবো, বলো?
কীভাবে স্বস্তিতে থাকা যায়
যখন পৃথিবীতে আজো এমন অসহনীয় গন্ধ থেকে গেছে?
নকটার্ন
কাল রাতে মা মারা গেছে,
মা কখনো মরে না।
বাতাসে ছিল শীত,
অনেক মাস দূরে
কিন্তু তবুও বাতাসে শীত ছিল।
সেদিন মে মাসের দশ তারিখ ছিল।
হাইসিন্থ এবং আপেল ফুল
ফুটেছিল পিছনের বাগানে।
আমরা শুনতে পাচ্ছিলাম
চেকোস্লোভাকিয়ার গান গাইছে মারিয়া —
‘আমি কত এক’—
এরকমই একটা গান।
‘আমি কত একা’,
মা নেই, বাবা নেই—
তারা নেই বলে মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে।
পৃথিবী থেকে সুগন্ধ মুছে গেছে;
বাসন-কোসন বেসিনে ছিল,
ধোয়া হয়েছে কিন্তু গুছিয়ে রাখা হয়নি।
পূর্ণিমার নিচে
মারিয়া ধোয়া কাপড়গুলি ভাঁজ করছিল;
বিছানার মোটা চাদর যেন
চাঁদের আয়তক্ষেত্রকার শুকনো সাদা আলো।
‘আমি কত একা, কিন্তু গানে
আমার নির্জনতাতেই আমার আনন্দ।’
সেদিন ছিল মে মাসের দশ তারিখ
নয় বা আট তারিখের মতোই একটা দিন।
মা তার বিছানায় শুয়েছিলেন,
তার হাত প্রসারিত, তার মাথা
প্রসারিত দুই হাতের ঠিক মাঝ বরাবর।
নস্টোস
এই ঘাসে ভরা বাড়ির পিছন দিকটায়
একটা আপেল গাছ ছিল—
সে প্রায় চল্লিশ বছর আগের কথা।
ছিল স্যাঁতসেঁতে ঘাসে অবিরল ক্রোকাসফুল।
আমি জানালায় দাঁড়ালাম:
এপ্রিলের শেষ হয়ে এলো প্রায়।
প্রতিবেশীর উঠানে বসন্তকালীন ফুল।
সত্যিই কতবার গাছ ফুল ফুটিয়েছে
আমার জন্মদিনে, ঠিক জন্মদিনে,
একদিন আগেও না, না একদিন পরে?
যা বদলায় না মোটেও
তার বিকল্প হিসেবে তারা ফুটতে থাকে।
অবিশ্রান্ত, অপরিবর্তনীয় পৃথিবীকে ঘিরে
আমাদের ধারণার অদল-বদল ঘটাতে চাওয়া শুধু।
এই জায়গাটা সম্পর্কে আমি কীই-বা জানি!
গাছের জায়গা দশকের পর দশক ধরে
দখল করে আছে একটা বনসাই,
টেনিস কোর্ট থেকে আওয়াজ আসছে।
গন্ধ আসছে নতুন করে কাটা উঁচু সব ঘাসের।
একজন গীতিকবির কাছে সবাই যেমনটা আশা করে।
আমরা শৈশবে একবার পৃথিবীর দিকে তাকাই।
বাদবাকি সব স্মৃতি।
উপবিষ্ট শরীর
মনে হচ্ছিল, তুমি যেন হুইলচেয়ারে বসে থাকা একজন মানুষ
যার পা হাঁটু অব্দি কাটা।
কিন্তু আমি খুব করে চেয়েছিলাম তুমি যেন হাঁটো।
আমি চেয়েছিলাম, গ্রীষ্মের সন্ধ্যায়
হাতে হাত রেখে হাঁটতে,
এবং সেই চাওয়া আমার কাছে এতটাই স্বাভাবিক বলে মনে হয়েছে যে,
আমি চুপ থাকতে পারিনি, আমাকে কথা বলতে হয়েছে,
দাঁড় হবার জন্য তোমাকে চাপ দিতে হয়েছে। —
কেন আমাকে তুমি কথা বলতে দিলে?
তোমাকে নিয়ে এগিয়ে যাবো বলে
আমি তো তোমার নীরবতাকে নিয়েছিলাম,
যেমন নিয়েছিলাম তোমার মুখের যন্ত্রণাকে।
মনে হচ্ছিল—
আমি চিরতরে দাঁড়িয়ে আছি, নিজেরই হাত ধরে।
এবং পুরোটা সময় জুড়ে, আমি যা-কিছু দেখেছি
তা যতটা আমি গ্রহণ করতে পেরেছি, তার থেকে বেশি
নিরাময় তুমি নিজেকে এনে দিতে পারতে না জেনো।