কচ্ছপ ও জলদানো । আল ইমরান সিদ্দিকী
প্রকাশিত হয়েছে : ০১ মে ২০২৩, ৯:৫৯ পূর্বাহ্ণ, | ৫১৬ বার পঠিত
এতিমখানা থেকে দুই দফায় মোট সাতটা কোরান শরিফ হাওয়া হয়ে গেল। এতিমখানা থেকে পূর্বদিকে, একটু এগিয়ে গেলে যে দোকানগুলো আছে, সেখানেও কোরান-হাদিসসহ বিভিন্ন রকম ধর্মীয় বইপত্র পাওয়া যায়। আগরবাতি, তসবি, গোলাপজল, জায়নামাজ বিক্রির দোকানটার পাশে যে দোকানদারটা আছে, মানে যে চা-পান বিক্রি করে, সে একদিন এতিমখানার নাম নিয়ে প্রশ্ন তুললো, ‘ইসলামী নাম বাদ দিয়া এইডা কী রাখলো, হিন্দু-ফিরিঙ্গি নাম!’ অনেকের মনেও ঐ একই প্রশ্ন, নতুন নামের কারণে ধর্মগ্রন্থ এখানে থাকছে না। দোকানগুলো থেকে পশ্চিমে, এতিমখানার দিকে পা বাড়ালেই হাতের বায়ে বিশাল পুকুর, তারপর মসজিদ, হাতের ডানে অর্থাৎ মসজিদের ঠিক উল্টোপাশে সাদমান শাহ মাজার। আরও একটু এগিয়ে গেলে মাজার ও মসজিদের মাঝা বরাবর এতিমখানা। এতিমখানার বারান্দায় দাঁড়িয়ে মসজিদের বড় হুজুর মেসওয়াক করছেন সকালবেলা। ফজরের আগে একবার মেসওয়াক করেন তিনি আর নাস্তা খাবার পর আরো একবার। বড় কামেল লোক, দেশের বাইরে যাওয়ার প্রস্তাবও পেয়েছিলেন তিনি, কিন্তু এই জায়গাটা তার এতো পছন্দ, তিনি ছেড়ে যেতে রাজি না। তার পরামর্শেই বাহারউদ্দিন এতিমখানা’র নাম বদলে ‘বাহার উদ্দিন শিশুসদন’ রাখা হয়েছে। হুজুর ভাবলেন, বাচ্চার ঢুকতে আর বের হতে এতিমখানার নাম দেখবে আর তাদের বারবার মনে পড়বে তারা এতিম, দরকার কী? তার সাথে মসজিদ কমিটির লোকেরা একমত হয়ে নাম বদলে ফেললো। বছর সাতেক আগে এতিমখানাটা যেদিন প্রতিষ্ঠিত হলো, তার পরের দিনে মাজারের পুকুরে বেশ কয়েকটা কাছিম দেখা গেল।
সকালবেলায় একটা কাছিম দোকানের দিকটায় পুকুরপাড়ে ভেসে আছে। দু-একটা সবুজ, কিন্তু বেশির ভাগই হলুদ ও গেরুয়া, এমন সব কাঁঠালপাতা পুকুরের পানিতে ভাসছে। এই কাঁঠালগাছ কয়েকটা বড় আশ্চর্য রকমের! একটিও ঠিক সোজা দাঁড়িয়ে নেই; সব ক’টা মসজিদের দিকে পিঠ রেখে পুকুরের দিকে ঝুঁকে আছে। কাঁঠালগাছের বিপরীত প্রান্তের দোকানগুলির প্রত্যেকটির পেছনের অর্ধেকটা পানির ওপর, বাঁশ ও শালকাঠের খুঁটির ওপর দাঁড়িয়ে। সকালবেলা হালকা সব জলতরঙ্গ ওইসব খুঁটির কাছে গিয়ে শেষ হচ্ছে। কুরবান আলী পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে কাছিমটার দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ পিঠ চুলকালো। তারপর অস্বস্তি নিয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে সোজা এতিমখানার দিকে হাঁটা দিল। হুজুরও পুকুরের দিকে আসছিলেন মুখ ধুতে। ‘হজুর একটা কথা ছিল’ কুরবানের কথা হুজুর দাঁড়িয়ে শুনলেন। ধীরে ধীরে আশেপাশের লোকজনও শুনলো কুরবানের কথা। এতিমখানার বাচ্চারাও শুনলো, রাতে তিন পিস ‘বুখারী শরীফ’,পাঁচ প্যাকেট তসবি ও দুইজোড়া ‘স্ত্রীর কর্তব্য’ উধাও হয়ে গেছে কুরবানের। দোকানের পেছন দিকের টিন একটু আলগা ছিল, সেটা ফাঁক করে কেউ নিয়ে গেছে। বেলা গড়ানোর সাথে সাথে চায়ের দোকানগুলায় কেউ বসে টিভিতে বাংলা সিনেমা দেখলো, সাদা লুঙ্গিপরা ভান্ডারির দোকানে পেপার রাখা হয়। কেউ কেউ পেপার পড়লো ,দেশের রাজনৈতিক অবস্থা, খুন-গুম নিয়ে টুকটাক আলাপের ফাঁকে ফাঁকে ধর্মীয় বইপত্র চুরির আলাপটাও মুখে মুখে ছড়ালো। লোকজন বলাবলি করছে, ‘জাহান্নামের প্রাণী’টা কে?’ আজকে গরম একটু বেশিই পড়েছে, পরিষ্কার আকাশ, রোদে ঝলমল করছে চারদিক। বাতাস যে একদমই নেই , তা নয়। যদিও ভাসমান কাঁঠাল পাতাগুলি নড়ছে না, কিন্তু গোলাপি-বেগুনির মাঝামাঝি রঙের বিস্কুটফুলের দিকে তাকিয়ে থাকলে মাঝে মাঝে টের পাওয়া যায় বাতাস একটু আছে। কলাবতী গাছের পাতা একদমই নড়ছে না।
চোর ধরা পড়ার পর থেকে ক্রমে মাজার এলাকায় লোক বাড়তে থাকলো। সেলুনের লোক, পানের দোকানে পান-বিড়ি কিনতে আসা লোক, ভাতের হোটেলে দুপুরের খাবার খেতে আসা লোক। আবার তমিজউদ্দিন বেহুশ হবার পর তার থেকেও দ্রুত গতিতে মানুষ কমতে থাকলো। শেষে যখন পুলিশ আসলো, তখন চোরসহ অল্প কয়েকজন লোক তমিউদ্দিনের পাশে। কিছু কৌতুহলী মানুষ শুধু দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে।
কলাবতী গাছ বাঁ-পাশে রেখে দাঁড়িয়ে থাকা, নানা ফুলের গাছ দিয়ে ঘেরা মাজারে তিনজন মহিলা প্রবেশ করলো। মাজারের ভেতর ফটকের বাইরে সিড়ির শেষ প্রান্তে বসে তারা মাজার জিয়ারত করলো; ভেতরের ফটক অতিক্রম করার অনুমতি নারীদের নেই। সারাদিনে ধরে করে কতো মানুষ কতো রকমের ইচ্ছা নিয়ে আসে, এটা-সেটা মানত করে। মাজারের কাছে দাঁড়ালে দূরে চায়ের দোকানের পাশে সেলুনে বাজতে থাকা পুরানো দিনের হিন্দি গান কানে আসে না। দূরত্ব সামান্য, তবু মাজার যেন সুনসান । দীর্ঘদিন এখানে থাকার কারণে সবাই যার যার মতো করে মাজারের সাথে তার দূরত্ব মেপে নিয়েছে। এই একটুখানি জায়গার মধ্যে শব্দ ও নৈঃশব্দের সহাবস্থান ওই হিন্দি গান, ওই সেলুনের চিরুনি-কাঁচি, ওই মানত-মোনাজাত, ওই বিস্কুটফুল, ওই পানির দিকে ঝুঁকে কাঁঠালগাছ, সব কিছুকে এক অদ্ভূত ছন্দে বেঁধে ফেলেছে। দুপুর আরেকটু গড়ালে সব দোকান একে একে বন্ধ হয়ে যায় ঘন্টা দুয়েকের জন্য। শুধু পান-দোকানী তার পানের ডালায় ঘন ঘন পানি ছেঁটাতে থাকে। উদরপূর্তি করে আসা দু-একটা লোককে পান-সিগারেট দেয়।
বিকালের আলো যখন মসজিদলাগোয়া বিস্কুট ফুলের গাছ থেকে সরে গেছে, তখন হুজুর পুকুরপাড়ে বসে ভাবছেন, বাঁচা গেল এতিমখানার নাম নিয়ে ছড়ানো কথার হাত থেকে। এই প্রথম কোনো চুরির ঘটনা তাকে কিছুটা স্বস্তি দিল। কিন্তু অবাক হয়ে তিনি ভাবছেন, আল্লার কালাম চুরি করে কে! পেটের দায়ে নাকি নেশার দায়ে? এলাকার লোকজন বিকাল হলেই অনেকে বাচ্চা নিয়ে পুকুর পাড়ে চলে আসে। মাজারের চারপাশে কলাবতী গাছগুলোতে কী সুন্দর লাল ও হলুদ রঙের ফুল ধরেছে! সামনের দিকে বিস্কটু ফুল ও আরও কতো রকমের দেশি-বিদেশি ফুলের গাছ; মন ভালো হয়ে যায়। সারাদিন প্রচন্ড গরমের পর বিকালবেলা একটু বাতাস পাওয়া যায়। কিন্তু বাচ্চাগুলোর আকর্ষণ সবচেয়ে বেশি থাকে পুকুরপাড়ে। কাছিমগুলাকে তারা খুব পছন্দ করে, আর বাচ্চারা আসলে কাছিমগুলোও যেন ব্যাস্ত হয়ে উঠে। পুকুরের সিড়ির কাছ পর্যন্ত চলে আসে, বিশেষ করে বাচ্চা কাছিমগুলো। বাব-ভাইয়ের সাথে আসা বাচ্চাগুলোকে আরো বেশি আনন্দ দিতে যেন অস্থির হয়ে ওঠে এতিমখানার বাচ্চাগুলো। তারা কয়েকটা কাছিমের নামও দিয়ে দিয়েছে। এর মধ্যে একটার নাম ‘লাইলি’ , আরেকটার নাম ‘মজনু’। সারাদিন ধরে শব্দ ও নৈঃশব্দের যে সহাবস্থানের খেলা চলে পুকুরের চারপাশে, বিকালের পর তা ভেঙে যেতে থাকে।
দিন কয়েক পরে আব্দুল্লাহপুর ওভারব্রিজের উপর যখন দ্বিতীয়বার উঠেছে তেহেরান মোল্লা, তখন টপটপ করে ঘাম পড়ছে তার কালো দাড়ি বেয়ে। বাস থেকে নেমে ব্রিজের অপর দিকে গিয়ে সে বুঝেছে, যে দোকানটা সে খুঁজছে, সেটার জন্য ব্রিজে ওঠার দরকার ছিল না, বাস থেকে যে পার্শ্বে সে নেমেছে, সে দিকেই ছিল দোকানটা। শুধু একটু এগিয়ে গেলেই হয়। কিন্তু এই প্রচণ্ড ঘামঝরানো রোদে, শত মানুষের ভিড়ে, এক ধরণের অস্থিরতা কাজ করে; ঠান্ডা মাথায়, ভেবে-চিন্তে পা ফেলা যায় না। দোকানের সামনে দাঁড়িয়েই সে সালাম দিয়ে দোকানি তমিজউদ্দিনকে বললো, ‘আমারে মাজার মসজিদের বড় হুজুর পাঠাইছে, আপনারে জরুরি তলব করছে… আগে এক গ্লাস পানি খাওয়ান… বোতল থাকলে দেন, মুখ না লাগায় পানি খাই একটু।‘ দোকানি হুজুর গোছের মানুষ। আরেক হুজুরের প্রতি তার আন্তরিকতার ঘাটতি নাই। তেহেরানের সাথে তার সখ্যতা না থাকলেও পরিচয় আছে। আনারস খাচ্ছিলো সে। আনারসের বাটি এগিয়ে দিয়ে বললো, ‘ভাই, আনারস নেন… আসেন আনারস খাই… আল্লার নেয়ামত… দেখেন গরমকালের সাথে মিলায়া কী সুন্দর আনারস উপহার দিছে… হুজুর কী কারণে তলব করছে বলছে কিছু?’ তেহেরান মোল্লা না-সূচক মাথা নাড়িয়ে বললো , ‘শুকরিয়া ভাই, আমার হাতে বেশি সময় নাই… এই পোলা কি আপনের?’ দোকানের শোকেসের উপর বাসানো চার বছরের ছোট বাচ্চাটার মাথায় হাত বুলিয়ে দোকানি বললো, ‘হ, আমার পোলা, একটাই, পরপর তিনটা বাচ্চা আল্লায় নিয়া গিয়ে পরে এরে দিছে… অর মায়ের বড় আদরের ধন… একজীবনে বহুত কষ্ট পাইছে বেচারী’। আনারস খাওয়া শেষ করে তেহেরান বললো, ‘ভাই, দোকানে আর কেউ নাই, ডাইকা বসায় দিয়া চলেন যাই। ময়মনসিং গেছিলাম বড় বোনের বাড়ি। ফিরা টঙ্গি পর্যন্ত আইতে না আইতে হুজুরের ফোন দিয়া উত্তরায় আপনার এইখানে নামতে কইলো… তা আপনের ফোনের কী হইছে?‘ তমিজউদ্দিন বাচ্চার মুখ মুছে দিতে দিতে বললা, ‘না রে ভাই, লোক রাখার টাকা কই, আপনে পাশের দোকানে একটু বসেন, আমি দোকান বন্ধ কইরা বাচ্চাটা বাসায় রাইখা আসি। সারাদিন বইসা থাকি, বিক্রিবাট্টা নাই।’ তারপর দোকান বন্ধ করতে করতে সে বললো, ‘মাজারে আবার কবে ওয়াজ মাহফিল হইবো ভাই? গতবার ভালোই লাভ হইছে দোকান দিয়া, তয় আপনাগো মাজারের দোকানিরা আমার লগে যে ব্যবহারটা করছিল, সেইটা ভুলতে পারি নাই, রুজি-রুটি আল্লাহর হাতে… ও হ, ফোনডা পোলায় ভাইঙ্গা ফ্যালসে।’
তেহেরান ও তমিজউদ্দিন মাজারে এসে দেখে ভরদুপুরে পুকুরপাড় সরগরম। চোর ধরা পড়েছে। শব্দ ও নৈঃশব্দের সহাবস্থান ভেঙে গেছে। পুকুরপাড়ে, সিঁড়ির উপর ঝুঁকে থাকা যে চার-পাঁচটা কাঠালগাছ আছে, তার একটার সাথে চোর বাঁধা। ‘ও মাগো,আমি আর করুম না, ছাইড়া দেন গো’ বলছে চোর মাথা হালকা কাত করে, যেন ঘুমঘোরে কথা বলছে। অনেক মারধোর করার পর সে স্বীকার করেছে সে কিতাব চুরি করছে। মারধোরের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় এও স্বীকার করছে সে কিতাব কার দোকানে বিক্রি করেছে। ঘটনাস্থলে এসে ধর্মীয় বইপত্রের দোকানি তমিজউদ্দিনের আর বুঝতে বাকি নাই তার সামনে বিশাল বিপদ। কমিটির লোক দুই-একজন যারা এলাকায় উপস্থিত ছিল, তারা বিচার-সালিশ, চর-থাপ্পর দিয়ে বিষয়টার মীমাংসা করতে চাইলো, কিন্তু কে শোনে কার কথা? দোকানের লোকজন কেউ কেউ জোর দাবী জানালো ডাকা হোক তমিজকে, ‘অর চেহারাটা একবার দেখি’। গাঁজাখোর ধর্ম বোঝে না, কিন্তু তমিউজউদ্দিনের মতো লোক, হুজুর মানুষ হয়ে কিভাবে চুরি করা কিতাব কিনে! তমিজউদ্দিন আসলে ওয়াজ মাহফিলের সময় যে দোকানদারের সাথে তার প্রায় হাতাহাতির পর্যায়ে চলে গিয়েছিলে, সে বলে বসলো, ‘গাঞ্জা খাইলে মাইনষে ধর্মের বই আর অধর্মের বইয়ের ফারাক বুঝে না, তুই তো বুঝস… কিনলি কেন? ধর্মের কলঙ্ক… টুপি-পাঞ্জাবির ইজ্জত রাখস নাই…! ’তোপের পর তোপ, চড়-থাপ্পড়ের মুখে তমিজউদ্দিন প্রতিবাদ করার চেষ্টা করে বললো, ’আমি তো জানি না ভাইজান সে যে চুরি করছে; সে কইলো মেঘডুবিতে সরকারী গাড়ি আইসা অবৈধ দোকান ভাঙনের সময় দোকানদার এই কেতাব তার কাছে রাখতে দিছিলো। পরে বেইচা কয়টা টাকা দিয়া দরগায় চেরাগ জ্বালাইতে কইছে আর বাকিটা দিয়া বৌ-বাচ্চার মুখে ভাত দিতে কইছে।‘
‘হারামজাদা মিছা কথা কস কেন?’তমিজউদ্দিনকে উদ্দেশ্য করে একজন এই কথা বলে চোরকে মারতে চলে গেল। আধবেহুশ অবস্থায় চোরও সায় দিল তমিজউদ্দিন জেনেশুনে এই বই কিনেছে। তারপর বাপদায় দেয়া ছাড়া তমিজউদ্দিনের আর কোনো উপায় থাকলো না। তর্কাতর্কি ,চড়-থাপ্পড়ের এক পর্যায়ে সিঁড়ির জন্য বানানো সিমেন্টের মোটা-শক্ত ডান্ডার আঘাত তার বুকে এসে লাগলে ‘আব্বা’ বলে চিৎকার করে ধীরে বেহুশ হয়ে গেল তমিজউদ্দিন। লোকে মায়ের নাম নেয় প্রচণ্ড আঘাতে… ‘মা’ বলে ডাক ছাড়ে আর সে বাপেকে স্মরণ করলো। হতে পারে তার ছোট বাচ্চাটাকে সে স্মরণ করেছে। স্মরণ করে বেহুশ হয়ে গেল।
চোর ধরা পড়ার পর থেকে ক্রমে মাজার এলাকায় লোক বাড়তে থাকলো। সেলুনের লোক, পানের দোকানে পান-বিড়ি কিনতে আসা লোক, ভাতের হোটেলে দুপুরের খাবার খেতে আসা লোক। আবার তমিজউদ্দিন বেহুশ হবার পর তার থেকেও দ্রুত গতিতে মানুষ কমতে থাকলো। শেষে যখন পুলিশ আসলো, তখন চোরসহ অল্প কয়েকজন লোক তমিউদ্দিনের পাশে। কিছু কৌতুহলী মানুষ শুধু দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে।
পুলিশ তমিজউদ্দিনের লাশ গাড়িতে উঠালো। আশেপাশের দোকানগুলো সময়ের আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। পরের দিন থেকে এলাকার অনেক প্রভাবশালী লোকজনকে আর এলাকায় দেখা গেল না। দোষীদের পাশাপাশি অনেক নির্দোষ লোকও উধাও হয়ে গেল। কারণ ‘গং’ দিয়ে কেস ফাইল করা হয়েছে; কাকে ধরে আর কাকে না ধরে, তার ঠিক নাই। গত তিন-চার দিনে পুলিশ কয়েকবার এসেছে, কয়েকজনকে ধরে নিয়ে গেছে।
বিকালে যখন বড়হুজুর পুকুর পাড়ে বিষণ্নমুখে বসে আছেন, যখন দোকানগুলো বন্ধু, তখন দূরে কলাবতী গাছগুলো খুব সুন্দর ফুল ধরে আছে, ভারি পাতা, ভারি কান্ড, ভারি ফুল- সহজে সে বাতাসের অস্তিত্বের জানান দেয় না। শুধু বিস্কুট ফুলের গাছ বাতাসে বেসামাল হচ্ছে থেকে থেকে। এতিমখানার বাচ্চারাও কেউ বের হয়নি। অথচ হুজুরের মনে হলো তমিজউদ্দিন যে জায়গায়টায় মারা গেছে, সেখানে একটা বাচ্চা দাড়িয়ে আছে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন, না কেউ নাই, মনের ভুল। তমিজউদ্দিনকে বাঁচাতে না পারায় নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে তার। বহুকাল পর হুজুর এমন সব বিকালের দেখা পেলেন, যখন বাচ্চারা পুকুরপাড়ে আসে না, বাচ্চাদের চাচা-মামারাও কেউ আসে না। তারা পুকুরপাড় থেকে দূরে আছে। দূরে কথা ছড়াচ্ছে, খুনের ঘটনার পর থেকে নাকি মাজারের পুকুরে আর কাছিমগুলোকে দেখা যায় না…