এলিস মুনরো’র সাক্ষাৎকার । ভাষান্তর : এমদাদ রহমান
প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ আগস্ট ২০১৮, ১২:২০ পূর্বাহ্ণ, | ২২০৩ বার পঠিত
গল্পে পাঠক যেন নিজেকে খুঁজে পায় — দুর্মর এ আকাঙ্ক্ষা থেকেই গল্পগুলি প্রাণ পায়; আর তাই এলিস মুনরো’র গল্প সম্পর্কে ক্রিটিকরা বলেন — জীবনের রেখাগুলিকে তিনি এমনভাবে এঁকেছেন যেখানে তার সমস্ত ক্যানভাস জুড়ে কেবল মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের কথা। তার রচিত সাহিত্য পুঙ্খানুপুঙ্খ এক একটি প্রতিকৃতি যেখানে আছে সূক্ষ্ম সব অনুভব এবং গভীর দৃষ্টিকোণ।
ন্যাশনাল বুক ক্রিটিক সার্কেল অ্যাওয়ার্ড-প্রাপ্ত পাণ্ডুলিপি ‘দ্য লাভ অব এ গুড উইম্যান’ প্রকাশের পর ‘ভিন্টেজ এন্ড এংকর বুকস্ রিডিং সেন্টার — এর সদস্যরা মুনরো’র এই সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন, সাক্ষাৎকারটি রিডিং সেন্টারের সাইটে প্রকাশিত হয় ২০১০-এর আগস্টে।
ভাষান্তর : এমদাদ রহমান
সাক্ষাৎকারী
উপন্যাসের বিরোধিতা করেই কি গল্পগুলি লিখেছেন? আপনি কি ভেবে নিয়েছেন যে ছোট- ফর্মের-লেখায় এমন কিছু করতে পেরেছেন উপন্যাসের পক্ষে যা সম্ভব নয়?
এলিস মুনরো:
গল্পগুলিকে আমি এমনভাবে ঘুরিয়ে দিতে পছন্দ করি যাতে ছোটগল্পের চালু ফর্মগুলি ভেঙে যায় আর এভাবেই আমি উপন্যাসের গতির নিয়মকে অগ্রাহ্য করি। লেখার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনও ফর্ম নিয়ে আমি চিন্তা করি না, আমার চিন্তা ফিকশন নিয়ে, ফিকশনকে ভাঙতে চাই, ফিকশনের বিভিন্ন অংশ নিয়ে চিন্তা করি। আসলে কী করতে চাই আমি? একটি গল্প বলতে চাই। গল্প বলার পুরোনো নিয়ম অনুযায়ী কারও সঙ্গে ‘কী ঘটবে’ দিয়েই গল্পটি সমাপ্ত হতো, কিন্তু আমি চাই ‘কী ঘটবে’র অপ্রত্যাশিত বিপিত্ত, অভাবিত মোড়, ধারণাবহির্ভূত অভিজ্ঞতা এসে যুক্ত হোক। পাঠকের কাছে চাওয়া থাকে — সে এমন কিছু অনুভব করুক যা বিস্ময়কর, শুধু ‘কী ঘটবে’ নয় কিন্তু সবকিছুই ঘটবে একটা সুসংবদ্ধ নিয়মে। এভাবে আমার গল্পগুলি যে-আখ্যানরীতি তৈরি করে সেটা আমার কাছে শ্রেষ্ঠ।
সাক্ষাৎকারী:
গল্প এবং চরিত্রের ধারণা কোথায় পান?
এলিস মুনরো :
কখনও বিশেষ কোনও স্মৃতি থেকে আবার কখনও বাস্তব ঘটনা বা ব্যক্তির কাছ থেকেও গল্পের বীজ পেয়ে যাই কিন্তু এক সময় স্মৃতি, ব্যক্তি, ঘটনা ইত্যাদি হারিয়ে যায়; গল্পটির চূড়ান্ত পাঠে দেখি কোনো কিছুই আমার চেনা নয়, সব অচেনা।
সাক্ষাৎকারী:
আপনার প্রতিদিনের লেখালেখি, পড়াশোনার রুটিন সম্পর্কে বলুন। লেখার কাজে কম্পিউটার ব্যবহার করেন? প্রতিদিনই লেখেন? দিনের কোন সময় লিখতে বসেন? একটি গল্প সম্পূর্ণ করতে কতদিন লাগে?
মুনরো:
বছরখানেক হবে লেখার কাজে আমি কম্পিউটার ব্যবহার করছি, আসলে প্রযুক্তির এই সুবিধাগুলির সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়েছি একটু দেরিতেই, এজন্য আমি এখনও একটি মাইক্রোওয়েভ ওভেনের মালিক হতে পারিনি। হ্যাঁ, কম্পিউটারে লিখি তো বটেই, কিন্তু কীবোর্ডে যাওয়ার আগে গল্পটিকে কয়েকবার হাতেই খসড়া করতে হয়। এভাবেই কাজ করতে আমি অভ্যস্ত। একটি গল্প দুই মাসের মধ্যে লেখা শেষ হতে পারে; ভাবনার শুরু থেকে শেষ, তারপর লিখতে থাকা, কিন্তু একটি গল্পের জন্য মাত্র দুই মাস বিরল ঘটনা। খুব সম্ভবত ছয় থেকে আট মাস লেগে যায় একটি গল্পের চূড়ান্তে পৌঁছতে; অনেক পরিবর্তন, কাটাকাটি, ভুল পথে চলে যাওয়া তারপর গল্পের গতিপথ বদলে দেওয়া, ভাবনার কিছু হয়ত এসেছে কিছু আর খুঁজেই পাওয়া যায় না, কিছু তো চিরতরে হারিয়েই যায়। লেখাটি আমার জন্য যন্ত্রণাদায়ক হয়ে যাওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত আমি টানা লিখতে থাকি, ঘুম ভাঙতেই লেখার কাছে ফিরে যাই, এক মগ কফিও তৈরি হয়ে যায়; তারপর জীবনের নানামুখী ব্যস্ততা ঝাপটে ধরার আগ পর্যন্ত কয়েকঘণ্টা লেখায় ডুবে যাওয়ার চেষ্টা করি।
সাক্ষাৎকারী:
তরুণ লেখকদের কোন পরামর্শটি দিবেন?
মুনরো :
আমার পক্ষ থেকে তাদেরকে পরামর্শ দেওয়া একেবারেই অসম্ভব কারণ তরুণ লেখকরা একেবারেই ভিন্নধর্মী, অন্য রকম। তাদেরকে এ-কথাটা বলতে পারি- ‘পড়ুন’, কিন্তু একজন লেখককে পড়ার কথা না বললেও সে ব্যাপক পড়াশোনা পড়তে পারে, পড়তে পড়তে নেশাগ্রস্ত হয়ে যেতে পারে; এমনও হতে পারে সে এত কিছু পড়বে না, এতকিছু ভাববেও না, শুধু লিখবে; আর এর ফল হবে- কাগজের একটি ননসেন্স পর্বত। আপনি যদি লেখক হতে শুরু করেন তাহলে আপনি খুব স্বাভাবিকভাবেই বেশকিছু ভুল করে ফেলবেন, এবং তারপর একদিন যখন লেখাটি শেষ করার জন্য লিখতে বসেছেন, লেখাটি তখন নিজ থেকে ভাল থেকে আরও ভাল হতে শুরু করবে, কারণ আপনি নিজেই চাচ্ছেন লেখাটি ভাল হোক, শ্রেষ্ঠ একটি লেখা হোক, এমনকি, আপনি যখন বৃদ্ধ হবেন আর ভাববেন এখনও এমন কিছু বাকি রয়ে গেছে লোকে যা হতে চায়, আপনি সেই হতে চাওয়াকে এড়িয়ে যেতে পারবেন না।
সাক্ষাৎকারী:
আপনার ওপর কোন লেখকের প্রভাব সবচে বেশি? প্রিয় লেখক কারা?
মুনরো:
যখন ছোট ছিলাম, তখন থেকেই — ইউডোরা ওয়েলটি, কারসন ম্যাককালার্স, ক্যাথারিন এন পোটার, ফ্ল্যানারি ও’কনর, জেমস এগার আমার প্রিয়, তারপর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে- আপডাইক, জন চিভার, জয়েস ক্যারল ওটস, পিটার টেলর এবং আমার ভেতরে একটি বিশাল জায়গা জুড়ে এবং চিরদিনের জন্য যিনি তিনি হলেন — উইলিয়াম ম্যাক্সওয়েল। আরও আছেন — উইলিয়াম ট্রেভর, এডনা ও’ব্রায়ান, রিচার্ড ফোর্ড। প্রভাবের প্রশ্নে আমি তাঁদের কথাই বলব। এছাড়া আরও কয়েক ডজন লেখক আছেন যাদের লেখা আমার বিশেষ প্রিয়। আমার সর্বশেষ আবিষ্কার একজন ডাচ লেখক — সেইস নুটবুম। লেখকদের নিয়ে এরকম তালিকা করাকে আমি অপছন্দ করি। যখন দেখব বিস্ময়কর অনুভুতি দেওয়া অনেক লেখকের নাম উল্লেখ করতে ভুলে গেছি, তখন নিজে নিজের মাথা ফাটিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করবে। এ কারণে আমি কেবল তাদের কথা বলি যারা আমাকে প্রভাবিত করেছেন, কিন্তু যারা আজীবন আনন্দিত করেছেন সেইসব নমস্য লেখকদের কথা বলি না!
স্মৃতি হচ্ছে এমন একটি পদ্ধতি যার মাধ্যমে আমরা আমাদের গল্পগুলিকে আমাদেরকে বলি এবং সেই গল্পগুলিকে নানাভাবে, নানা সংস্করণে অন্যদেরকেও বলি। এভাবে আমরা একটি শক্তিশালী চলমান আখ্যান বর্ণনার মাধ্যমে আমাদের জীবনকে নিরন্তর চালিয়ে নিয়ে যাই। এইসব বদলে ফেলা, প্রেরণাদায়ক, অনুপ্রাণিত করা কিংবা বিনোদনমূলক গল্পগুলির গভীরে, আনাচেকানাচে আমরা অনুমান করি কিংবা টের পেয়ে যাই এমন এক বিস্ময়ের, এমন এক বিশেষ সত্তার, যাকে বলা হয় ‘সত্য’।
সাক্ষাৎকারী:
সিনথিয়া ওজিখ আপনাকে ‘আমাদের চেখভ’ বলে ডাকেন। এই তুলনাকে কিভাবে দেখেন?
মুনরো:
চেখভের বেশকিছু লেখা আমি আবারও পড়লাম। কী যেবলব! আমার জন্য এ এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। চেখভ শুধু যে আমাকেই প্রভাবিত করেছেন তেমন দাবি আমি করব না কারণ তিনি আমাদের সকলকে প্রভাবিত করেছেন। শেক্সপীয়ারের মতো তাঁর লেখা আলো ছড়িয়েছে।
সাক্ষাৎকারী:
বহু সমালোচক প্রশংসা করে বলেছেন যে আপনি এক পৃষ্ঠায় সম্পূর্ণ জীবন এঁকে ফেলতে সক্ষম হয়েছেন। কিভাবে এই কৃতিত্ব অর্জন করতে পারলেন?
মুনরো:
আমি আমার চরিত্রগুলোকে সবসময়ই একেবারে যাকে বলে গভীর থেকে জানা, আমি সেই গভীর থেকেই তাদের জানতাম। তারা যে পোশাক পছন্দ করত, স্কুলে কী কী করতে ভালোবাসতো এইসব… এবং আমি এটাও জানতাম আগে এবং পরে তাদের জীবনে কী কী ঘটবে যেভাবে যেভাবে তাদের নিয়ে আমি লেখায় মেতে উঠেছি! হয়ত এই মুহূর্তে আমি কিছুই দেখছি না, মুহূর্তের চাপের কারণে আমি হতবিহ্বল। আমার মনে হয় তাদেরকে আমি ঠিক ততটুকুই দিতে পারব যতটুকু দেওয়ার সামর্থ্য আমার আছে।
সাক্ষাৎকারী :
আপনার বেশিরভাগ গল্প বাড়ির আশপাশের মানুষদের নিয়েই লিখিত হয়, আপনার সেই নেটিভ অন্টারিও। কী এই মাটিকে এমন উর্বরাশক্তি দিয়েছে যে এতসব আশ্চর্য গল্প অন্টারিওর পটভূমিতে লিখতে পারলেন?
মুনরো:
নিজেকে আমি কোনও ভাবেই অন্টারিওর ইন্টারপ্রেটার বলে মনে করি না, যেখানে আমি বসবাস করি। যেখানে আমি বাস করি। তবে আমি মনে করি এখানে থাকার সবচে বড় সুবিধাটি হচ্ছে বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষ সম্পর্কে জানতে পারা যারা সকলে মিলে অন্টারিওতে একটি বড় কমিউনিটি তৈরি করেছে। ভাষাবন্ধন, আয়, শারীরিক গঠন সব মিলিয়েই তাদের আপনি বুঝতে পারবেন। আমি এখানকার ল্যান্ডস্কেপ ভালোবাসি, সে ভালোবাসা শুধু দৃশ্যের জন্য নয়, প্রকৃতির আপন আর অন্তরঙ্গ হয়ে ওঠার জন্য; আর এখানকার আবহাওয়া, গ্রাম আর শহরগুলি, তাদের সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকবার জন্য নয়, পৃথিবীর বুকের ভেতরের রস টেনে টেনে বৃক্ষদের মতো যেভাবে গড়ে উঠেছে তারা, সে জন্য। মানুষের জীবনাভিজ্ঞতা থেকে নিজেকে আলাদা ভাবতে পারি না, মানুষের প্রথা, অভ্যাস আর পারিপার্শ্বিকতাও যাপনের অংশ হয়ে ওঠে, রূপকথার জগতের কথা অবশ্য আলাদা।
সাক্ষাৎকারী:
স্মৃতি আপনার গল্পে প্রধান ভূমিকাটি পালন করে। স্মৃতির কী এমন শক্তি, কীভাবে আমাদের জীবনকে এত প্রভাবিত করে যে-কারণে আপনিও এত কৌতূহলী?
মুনরো:
স্মৃতি হচ্ছে এমন একটি পদ্ধতি যার মাধ্যমে আমরা আমাদের গল্পগুলিকে আমাদেরকে বলি এবং সেই গল্পগুলিকে নানাভাবে, নানা সংস্করণে অন্যদেরকেও বলি। এভাবেই আমরা পরস্পরের নিকট আখ্যান বর্ণনার মাধ্যমে জীবনকে চালিয়ে নিয়ে যাই, জীবনের চাকাগুলিকে গতিশীল রাখি। মুখ থেকে মুখে এভাবে বদলে যাওয়া, প্রেরণাদায়ক, অনুপ্রাণিত করা কিংবা বিনোদনমূলক গল্পগুলির গভীরে, আনাচেকানাচে আমরা কখনও অনুমান করি কখনও আবিষ্কার করি এমন এক বিস্ময়ের, এমন এক বিশেষ সত্তার, যাকে আমরা বলি- ‘সত্য’ (দ্য ট্রুথ)।
সাক্ষাৎকারী:
আপনার এমন কোনও গল্প কি আছে যে-গল্পগুলোকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করেন?
মুনরো:
সেই গল্পটিকে আমি সেরা মনে করি যে-গল্পটি এই মুহূর্তে লিখছি, তারপর দ্বিতীয় সেরা হচ্ছে সেই গল্পটি যে-গল্পটি এইমাত্র প্রকাশিত হয়েছে! সর্বশেষ প্রকাশিত বইয়ের ‘সেইভ দ্য রিপার’ এবং ‘মাই মাদার’স ড্রিম’ গল্প দুটি আমার অত্যন্ত প্রিয়; আবার পুরোনো গল্পের মধ্যে ‘প্রগ্রেস অব লাভ’, ‘লেবার ডে ডিনার’, আর ‘ক্যারিড এওয়ে’ অত্যন্ত প্রিয়, এছাড়া আরও বহু গল্প আছে যে গল্পগুলি একেবারে হৃদয়ের গভীর বন্ধনে জড়িয়ে আছে।
# # #