গুচ্ছ কবিতা । মুহম্মদ ইমদাদ
প্রকাশিত হয়েছে : ১৪ জুন ২০১৮, ১১:২৩ পূর্বাহ্ণ, | ১৬৪৬ বার পঠিত
গ্লাসে পানি খেতে খেতে আপনি অনেকটা গ্লাস হয়ে গেছেন
মালি শুধু মালি না কিছুটা ফুলও
সৈনিক শুধু সৈনিক না, একটু রাইফেলও।
ড্রাইভার একটু গাড়িও।
ফলে কী হয়?
ফলে আপনি আমার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে
আশা করেন, আমি একটু আপনার মতো
মানে আপনার চোখের মতো দেখি ধান পাখি নারী আকাশ ও স্বপ্ন।
কিন্তু আমি আমার চোখ দিয়ে হয়তো কিছুই দেখি না।
হয়তো দেখি আপনার অসুখ ও মৃত্যুর সম্ভাবনা।
ফলে আপনি ভয় পেয়ে যান।
আমার থেকে দূরে সরে যেতে যেতে ভাবতে থাকেন,
প্রতিটি মানুষই একটা একটা ভিন্ন প্রাণি
কেউ হরিণ কেউ বাঘ কেউ শুয়োর কেউ মাছ
কেউ গাছ কেউ জিরাফ কেউ সাপ কেউ শকুন কেউ মাছরাঙা কেউ…
কারণ কসাই একদিন নিজেরে জবাই করবে আমরা জানি
কারণ শিকারি একদিন নিজেরে গুলি করবে আমরা জানি
কারণ জেলে একদিন নিজেরেই আবিষ্কার করবে তার জালে আমরা জানি
কারণ শিক্ষক একদিন পড়া না পারার অপরাধে নিজেরেই পেটাবে আমরা জানি
নো ম্যানস ল্যান্ডের কবিতা
আমরা যে গাছের নিচে দাঁড়ায়েছিলাম
তাতে শুধু ফুল ধরতো। ফল ধরতো না।
ক্ষুধার জ্বালায়
ফল গাছের দিকে একবার দৌড় দিছিলাম
পায়ে গুলি করে দিছিলো কে বা কারা
ফলে আমরা ঐ ফুল গাছের নিচেই থেকে যাই
প্রথমে চেষ্টা করছিলাম ফুলের গন্ধ খেয়ে বাঁচবো
দেখি বাঁচা যাবে না।
মানুষের ক্ষুধার সঙ্গে ফুলের গন্ধের সম্পর্ক নাই
পরে পাতা খেয়ে
পরে বাকল খেয়ে
পরে ফুল খেয়ে
পরে গাছ খেয়ে
বাাঁচার চেষ্টা করে
আমরা মরে যাই।
আমাদের মরা নিয়ে ফল গাছের তলের লোকেরা খুব নাকি হাসাহাসি করছিলো
হাসতে হাসতে নাকি আমাদের লাশ তাদের কুকুরদের
খেতে দিছিলো
কুকুরগুলো খায় নাই
আমাদের টেনে টেনে নিয়ে নাকি কবর দিছিলো।
তিনি যাচ্ছেন, সাথে যাচ্ছে একটা অরব কুকুর
নিজের জন্য একটা দেশের খোঁজে তিনি বের হলেন
তার পিছু পিছু যাচ্ছে একটা অরব কুকুর
কুকুর জানে তার যেমন কোনো দেশ নাই
উনারও নাই। কিন্তু সে নিঃশব্দ চরণে যাচ্ছে
একদিন তারা পৃথিবীর সব দেশ পরিভ্রমণ শেষ করে
একটা বিহ্বল নদীর তীরে এসে সূর্য়ের অস্তগমনের কালে
জানতে পারলো : তাদের জন্য কোনো দেশ অবশিষ্ট নাই।
কুকুর এবার কথা বলে উঠলো : প্রভু, আমরা তাহলে কোথায় যাব?
তিনি আকাশের দিকে চেয়ে বললেন : আমাদের তো ডানা নাই।
কুকুর জানতে চাইলো : প্রভু, আপনার ক্ষুধা পেয়েছে না? পিপাসা?
তিনি বললেন : পৃথিবীর কোনো ফসলে-জলে আমাদের অধিকার নাই।
কুকুর বললো : আপনি আমার অশ্রু পান করুন।
তিনি তা-ই করলেন। এবং কুকুরের মরু হয়ে যাওয়া জিবে
তিনিও দান করলেন ক’ফোঁটা অশ্রু।
প্রভু এবার বললেন : হে আমার প্রেম হে মহান কুকুর,
চলো, আমরা নদীতে মিশে গিয়ে পানি হয়ে যাই
তারপর মেঘ হয়ে আকাশে খুঁজে নেব দেশ, বাড়ি, ঘর, সংসার, পরিবার
স্ত্রী, পুত্রকন্যা, এবং মৃত্যুশয্যা
চলুন, বলেই ককুর ঝাঁপ দিলো নদীতে
পিছু পিছু ঝাঁপ দিলেন প্রভুও।
তারা মেঘ হয়েছিলো, না তিমির খাদ্য হয়েছিলো
আমরা তা জানি না। কিন্তু এই কথা জানি যে
পৃথিবীর ফুলবনে ফোটা কোনো ফুলের মধুই যে তারা
পান করতে পারেনি
এর কারণ ফুল নয়, ফুলের ধর্ষক।
মৃত্যু পর তা-ই হবে, জন্মের আগে যা ছিলে
তুমি জানতে না তুমি কে। এখনো জানো না।
কিন্তু তুমি মনে করেছ তোমার পরিচয় তুমি জানো।
এবং এই মিথ্যা জানাকে তুমি জ্ঞান মনে করেছ।
নিজেরে জ্ঞানী মনে করেছ।
এবং, এর ফলে, প্রথমে তুমি ঘৃণা করতে শিখেছ তোমার ভাইকে
এবং একসময় নিজেরে মনে করেছ স্বয়ম্ভূ
মানে, ভাবতে শুরু করেছ যে তুমিই সৃষ্টি করেছ তোমাকে
অথচ একটা ভাত
মাত্র একটা ভাত
সৃষ্টি করতে পারে না, পারবে না
পৃথিবীর সমস্ত মানুষের জ্ঞান
তুমি জানো না।
ভাত কেন, এক মুঠো মাটি সৃষ্টির জ্ঞান তোমার নাই
জুতা বানিয়ে পায়ে পরার জ্ঞান দিয়ে তুমি বুঝতে চেষ্টা করেছ
ইউনিভার্স
অথচ বিস্ময়াভিভূত হয়ে তোমার ঘাসফুল দেখার কথা ছিলো
কথা ছিলো, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেরে দেখা
দেখতে দেখতে ভাবার কথা ছিলো
এই দেহ আমার না
কার যেন? কার?
কিন্তু না,
অমর আকাশের নিচে গোরস্তানের পাশে দাঁড়িয়ে
তুমি বরং
কন্ট্রাসেপটিভ আবিষ্কারের বুদ্ধি নিয়ে অহংকার করেছিলে
এবং এই অহংকারের পাপে অন্ধ হয়েগিয়েছিলে
কিন্তু
নিজের জন্য আরেকটি চোখ তুমি সৃষ্টি করতে পারোনি
অন্ধ অবস্থায় তুমি রাজা হতে চেয়েছিলে
অন্ধ রাজার গল্প মানুষকে জানাতে চেয়েছিলে
তবু তুমি মরতে চাওনি। কে চায়?
অথচ তুমি মারতে চাইতে। মানুষ মারা ছিলো তোমার প্রিয় শখ।
এখন তুমি কোথায় হে বদমায়েশ
এইসব করার জন্য তোমাকে সৃষ্টি করা হয়নি
রে হারামি
হে ফুলগাছ
আপনার নির্গত সৌগন্ধে মাতাল হয়ে
একটা বাউল ও ক্ষুধার্ত পাখি
যদি ভূলুন্ঠিত হয়
আর গুলি খায়
আর মানুষ জবাই করে
গান ও ক্ষুধাসহ খেয়ে ফেলে
তবে হে ফুলগাছ,
আপনার খুব দুর্নাম হবে
অতএব, এই শিকারি সৌরভ নির্গমন
বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ুন
এবং উড়ে উড়ে
গান গাইতে গাইতে খাবার খুঁজতে
সহায়তা করুন পাখিদের
পৃথিবীর প্রকৃত কবিদের।
পৃথিবী
১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে আমি একবার পৃথিবীতে যাই
থাকি প্রায় ৬২ বছর।
তারপর ফিরে আসি যাওয়ার আগের অবস্থায়।
একজন মহিলার পেটে চড়ে আমি সেখানে যাই।
সময় লাগে প্রায় ১০ মাস ১০ দিন।
পৃথিবীতে পৌঁছে আমি এতটাই বেক্কল হয়ে যাই যে
আমার কোনো কাণ্ডজ্ঞান থাকে না প্রায় ৪ বছর।
ততদিন এই মহিলা আর তার প্রেমিক
আমি অাগুনে হাত দিতে চাইলে
মাটি খেতে চাইলে
পাহাড় থেকে ঝাঁপ দিতে চাইলে
মানা করেন এবং কোলে তুলে নেন
এবং আমাকে তারা কমলালেবুর রস না খেতে চাইলে
গরুর দুধ না খেতে চাইলে
আদর করে হাতে-পায়ে ধরে খাওয়ান
আমার কাণ্ডজ্ঞান হতে থাকে
পৃথিবীতে বসবাসের নিয়ম-রীতি রপ্ত করতে থাকি
অাগুনের ধর্ম আর পানির ধর্ম জেনে যাই
বুঝে ফেলে আমি মানুষ পৃথিবীতে এসেছি
এখানে বেড়ানো যায় না,কাজ
এখানে থাকতে হলে ভাত খেতে হয়
ভাত রোজগার করতে হয়
রোজগারের ধান্ধা করতে হয়
মিথ্যা বলতে হয়
জ্ঞান অর্জন করতে হয়
ডাকাতি করতে হয়
অন্যের ভাত কেড়ে আনতে হয়
এখানে কাঁচা থাকলে চলে না, পাকা
নগ্ন থাকলে চলে না, জামা
খালি পায়ে চলে না, জুতা
খালি হাতে চলে না, ছুরি, চাকু
এখানে অহংকার লাগে, হুংকার গর্জন লাগে
অামি ভাবলাম, আমার এসবের দরকার নাই
পাখির স্বভাবে কদিন বেড়িয়ে যাই
লোকে বলে চলবে না। তোমার বহু কাজ।
কাজ করলে টাকা। টাকায় ভাত। জামা। ছুরি।
অামার টাকা নাই। সবাই আমার ভালো চায়।
আমাকে তারা একটা উড়োজাহাজের পেটে ঢুকিয়ে দেয়
উড়োজাহাজের পেট থেকে অামি আমেরিকা নামক
অন্য একটা পৃথিবীতে পৌঁছে তাজ্জব হই।
অস্ত্র কারখানায় আমার কাজ হয়। টাকা হয়। ভাত হয়।
এবং এই অস্ত্র আমাকে একদিন বের করে দেয় পৃথিবী থেকে।
পৃথিবীর কথা আমার প্রায়ই মনে পড়ে।
মাঝেমাঝে মনে হয় আবার যাই।
যাওয়া কি ঠিক?
আম্মা আর আমি
একবার মধ্যরাতে আমি আর আম্মা
কুপি হাতে গুণতে গেছিলাম একশো সাতাশটি গন্ধরাজ।
দুইবার আমি আর আম্মা মধ্যরাতে
কুপি হাতে
দেখতে গেছিলাম বাঁশি;
আম্মা বলেছিলেন, ‘রাবেয়ার প্রথম স্বামী গৌতমের কাজ।’
তিনবার আমি আর আম্মা
বাবুবাড়ির নয়া বউ দেখতে দৌড়ে গেছিলাম জানলায়;
বিষাণের বিষাদসুরে আম্মা বলেছিলেন ‘হায় হায়!
নদী দেখতে যাই নাই। নদী এসেছিলো নিজে;
আমাদের দেখে গেছে, মনে মনে চেয়ে গেছে পানি;
এদেশ মরুভূমি হলে ফলবে না সোনার ফসল;
এই ভেবে কেঁদে গেছি আম্মা আর আমি