নদীমাতৃক পৃথিবী মেঘমাতৃক আকাশ / মুহম্মদ ইমদাদ
প্রকাশিত হয়েছে : ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৪, ৭:২১ পূর্বাহ্ণ, | ৭২৫৯ বার পঠিত
জল
জলের শরণার্থী
যে ছিল প্রথম
মুখ তার মনে পড়ে
মানুষের মতো নয় তবু
ভাবতে ইচ্ছে করে
সে ছিল মানুষের ভাই
জলের প্রতিভা যখন
জলের দামে বিকোয়
বিজনে ও ভিড়ে
জলকেই মনে হয়
প্রেমের প্রতিভা তোমার
এবং প্রথম নদীর পায়ে
ফুল নীরবে রেখে
পৌত্তলিক হতে
একটু স্বপ্ন আসে মনে।
অসুখ
ডালিম, ফুল না ফলের গাছ
ফুলের মতো মনে হলে
আমরা অপাপবিদ্ধ তারা।
চাও কেউ এসে ডালিম ভাঙার মতো
ভেঙে যাক তোমাকে
খেয়ে নিক খুলে খুলে হাড়
ফুল নও
তুমি আজ যতটুকু তুমি তার পুরোটাই তোমার অসুখ
দেশপ্রেমিকা
দেশপ্রেমিকা সে
কথা বলে মায়ের কণ্ঠে।
বলে, ‘তুই আমার ভালোবাসার সন্তান,
তোর গায় লেগে আছে মাটি, জলের গন্ধ;
তুই একদিন গাছে-গাছে পাখির ভাই হয়ে
করেছিলে শস্য-সন্ধান।’
দেশপ্রেমিকা সে
কথা বলে মায়ের কণ্ঠে। বলে :
‘তুই স্বপ্ন থেকে ঝরা সুর, তোকে জড়িয়ে
তবে এইদেশ গীতময়; তুই এই দেশ
ভালোবেসে থাকিস অমর, এ দেশের
উঠোনে এসে দেখিস শান্ত নক্ষত্রের বন।’
দেশপ্রেমিকা সে
আমি তার কনিষ্ঠ সন্তান;
আজ ঘুম ভেঙে জেগে দেখি
পায়ের তলা থেকে সরে গেছে মাটি;
মা ডেকে আকুল হলাম।
কেউ এসে তোলেনি কোলে;
তার পর উড়ে যেতে চেয়ে
ডানাহীন পড়ে আছি এ দেশেরই জল-ধারে
যেন এক নিহত রাত্রি
মাটির কবরে তোমায় রেখে আসি;
তারপরও কে যেন ডেকে বলে
‘একমুঠো মাটি দিয়ে যা’
মানুষের অন্তিম ভালোবাসা
আজও মাটির, মাটি দিয়ে গড়া।
মাটির কবরে তোমায় রেখে আসি;
তারপরও কে যেন ডেকে বলে
‘একমুঠো মাটি দিয়ে যা’
অনন্ত
মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল আদিম কোনও কাল
কোনও প্রস্তর যুগ থেকে আসতে এত দেরি
সূর্যকরোজ্জ্বল বৃক্ষ ও বৃষ্টিবিরল সভ্যতায়
ভেবেছিলাম শব্দ হবে, উড়বে কিছু নিরল পাখি
হঠাৎ পড়বে ছায়া; শীতের মতো ধীরে
কার্তিক-অঘ্রান জুড়ে কিছু কিছু করে…
কিন্তু না, মুখ-ফস্কে হঠাৎ-বলা কথার মতো
অজান্তে এলে এবং চলে গেলে গন্তব্যের দিকে
মনে হচ্ছে আদিম কোনও কাল, কোনও প্রস্তর যুগ থেকে
অনুসরণ করছি তোমাকে এবং পৌঁছতে পারছি না সভ্যতায়
বনডোলা
বনডোলা পাতায় যদি স্বাদু হয় ডালভাত
তোমার আপত্তি সব উড়িয়ে হাওয়ায়
আমি পুরাতন গরিব থেকে যাব;
গৃহতল লেপে দেব গোবর-মৃত্তিকায়
তুলসীর রস আর দখিনা বাতাস
ফুল থেকে মধু চুষে, চিবিয়ে থানকুনি-নিম
নির্জর থেকে যাব চিরদিন যুবক…
সুন্দর চিনে নেব, কেঁপে যাব পাতার মতন
তোমার আপত্তি সব উড়িয়ে হাওয়ায়
বনডোলা-গ্রামে
রচনা করব আমি সমাধি, সংসার!
সম্পর্ক
সম্পর্কচূর্ণ মিশে ঘোলা বড়পুকুরের জল;
ঘাটে কচু আর আকন্দ বিস্তার করেছে তাদের বন
তখন বাড়িফেরা যুবক মাটিতে দাঁড়াতে চেয়ে কিছুটা
ভেসে গেছে বাতাসে, তাকে ছেড়ে দিয়েছে মধ্যাকর্ষণ?
নিজের লঘুত্ব নিয়ে জনে-জনে ভাসে, দেখে স্বজনের
চেহারাগুলি বদলে গেছে অপরূপরকম, মাংস ও জামায়
তারা ভাবছে তৃতীয় বিবাহের কথা…; তখন
দেহপুকুরের পুরাতন রক্তগুলি ছেড়ে দিতে চেয়ে যুবক
টের পায় বরফ হয়ে গেছে শোণিত আর প্রাণে
বাসা বেঁধেছে লাল পিঁপড়ার দল;
সম্পর্কচূর্ণ মিশে ঘোলা বড়পুকুরের জল
বাড়ি
যে-জল মেঘনার, যে-জল যমুনার
একটিই দেহ শুধু দূরতার বিষ
ভাগ করে রেখেছিল মেঘনা-যমুনায়
সমুদ্রবৃক্ষে ছিল আমাদের নীড়।
শিরোনাম নেই
যেখানে গেলে দেশ ছেড়ে-যাওয়া ঘটে,
তার নাম বিদেশ; যাকে রেখে যাই পুরাতন
মাটির ঢিবির ওপর খাড়া তার নাম মা;
যে-গাছের নাম জানি না সে বুনো;
যার সঙ্গে ঘর করিনি সে নায়িকা, মিথুনবাহার;
যাকে ‘আমি’ বলে ডাকি সে জরাতুর জলরেখা;
এবং যার নাম ‘তুমি’,─সে চিরদিন আত্মভোলা,
অচিন বৃক্ষডালে ঝুলন্ত পিপাসা!
শহর
হাতে নাই কাঁটাজামিরের মায়া;
মনে তবু রয়ে গিয়েছিল ছায়া, শেষ পাখির;
গাছের কন্যা হতে চেয়েছিল মন
ঘিরেছে তারে আজ শহর;
হাতে শহর, শহর পায়ে…
চোখজল প্রসবিনী সাগরও শহরিনী সেজে
জলবোধ ভুলে যাবে, এইরূপ ভোলে
ফেরা
ফিরে আসার ইচ্ছা ও বিধান ছিল বলে যায়,
গিয়ে দেখে মনে নাই কোথায় ছিল বাড়ি;
তবু তারা যায় ফিরে আসার গহন বাসনায়; এবং
না-ফেরার বেদনায় ঝিরিঝিরি হাওয়া বয়,
ধীরে ধীরে ঝড় ওঠে, কালো কালো ঝড়,
. পথ মুছে যায়…
শিশু
অন্ধ পিতার হাত ধরে যে-শিশু বাড়ি-বাড়ি যায়;
কানাকড়ি পৌঁছে দেয় বাবার অন্ধ হাতে
সেও মেনেছিল জনকতা
ভিক্ষাপ্রভাতের লোভে দেখেছিল স্বপন
(বুনো লতাকে যেমন, তাকেও পৃথিবী দান করে
জাগিবার মেধা, যেহেতু ভিখারি না-থাকিলে
রাজাকে যায় না চেনা)
রাজঘরে জন্মিল যে বিনা ওজরে
. সেও পরেছিল মুকুট
ভাবতেও পারেনি ‘ছিলাম মানুষ’
জীবন
মৌচাক নহে তবু ডাকিছে শোনো
আকাশের তলে─পৃথিবী-বাতাসে
এলিয়ে শরীর
. গন্ধ নাও পিতৃদেহটির
. গন্ধ পাও পিতৃগৃহটির
পৃথিবীর জলে ডুবে স্নান করো
আদিম ক্লান্তি-ধোয়া জলে
যে-জলে লেগে আছে─
. বনপুরুষের মায়া-রক্ত-ঘাম;
. বনরমণীর শালদুধ,
. বনেলা কেশের মৃদু ঘ্রাণ;
মৌচাক নহে তবু ডাকিছে শোনো
গগনের তলে─
বাতাস বহিতেছে এলো-এলোমেলো
ইতিহাস
শ্রাবণ থাকিবে না, মেঘ থেকে মুছে যাবে তার নাম।
তবু দুয়ারখোলা স্বপ্নসমাজে বসে আছি;
বৃষ্টির ঝরা থেকে কুড়িয়ে জলগান, গাইছি;
তোমার কানে নয় যেন মধুমতি ফুলের কানে;
যেন আমি পুরুষমৌমাছি;
তুমিও গাইছ জলগীত যেন
আমার অন্তরে ঝুঁকে খুঁজিতেছ মধু;
যেন আমরা শূন্য এক মৌচাক রচনা করেছি
বনের শরীরে, যেন এক প্রতিশ্রুতি;
আজ খুঁজিয়া চলেছি
একে অন্যের কাছে তার পূর্ণতা-আশ্বাস।
কেউ জানিবে না শ্রাবণ ছিল
. মেঘ থেকে মুছে গেছে তার নাম
হাওয়া
গাছ থেকে গাছে, লুটিয়ে পড়ছে সে ঘাসে ও জলেও;
যেন জড়ভার ঝরে গেছে, উথালপাতাল সে
পাগল পাখির রূপে প্রকৃতির পরতে পরতে
ছড়িয়ে দিচ্ছে তার দেহ কণা কণা─
হাওয়ার আজ এমনই প্রকার─
জানিত না যাহা কোনো হাওয়াবিৎ─
ছাতিমের গন্ধ এনে শহরে ছড়িয়ে যায়
বনের পরিবেশ!
মেঘেরাও নামিতেছে দল বেঁধে, জল ঝরিতেছে
অচিন আবেগে, কানে কানে বাজিতেছে
ঘুণে-ধরা বিরহের গীত;
হাওয়া প্রেমে-পড়া বালিকার মতো
জড়ভারহারা, উড়িতেছে পাতায়
অধিকার
অভিধান থেকে ধান শব্দটিকে
গুজব বলে উড়িয়ে দেওয়া হলো
রুমালের মতো একটুকরো ছোট্ট হাওয়ায়;
শব্দটি এতিম শিশুর মতো যেতে যেতে পড়ল
জলে, হলো তার জলসমাধি।
জনকজননী তার রাজকুকুরের কামড়ে,
জল-আতঙ্কে মরে গিয়েছিল
সেই সকালে, যখন হাসপাতালের ঘুম ভাঙেনি,
. খোলেনি ইশকুল-দুয়ার…
অভিধান থেকে ধান শব্দটিকে
. উড়িয়ে দেওয়া হলো
কথা
অনেক কথা বলেছি আজ আর বলার কথা দেখি নাই।
কখন শেষ হলো জানাও গেল না, আজ হঠাৎ তোমার
প্রতি মুখিয়ে-থাকা মুখে আমার নিঃশব্দের থাবা!
জাগিয়ে রেখেছ তবু কান─স্নিগ্ধ, নির্জর;
ঝিমঝিম নীরবকেই ঘুমপাড়ানি গান ভেবে ধীরে চলে যাচ্ছ
দেখি নিদ্রানগর─যেখানে জাদুকর দেখিয়ে চলেছে স্বপ্ন;
আর তুমি সম্মোহিতা, জাদুকরের পায়ে পড়ে দেখতে চাইছ
স্বপ্নটি আবার; যেখানে আমার মুখ ঝরনার মতো নিরন্ত
কথা বলে চলেছে তোমাকে স্বপ্নে, স্বপ্নময়…
নদীমাতৃক পৃথিবী মেঘমাতৃক আকাশ । প্রকাশক চৈতন্য । বারুতখানা, সিলেট tzchoitonno@yahoo.com । ০১৭১৮ ২৮৪৮৫৯, ০১৭১৪ ৬১০০৬১ । প্রচ্ছদ রুবাইয়াত ইসলাম, দাম ১৫০ টাকা