প্রেম ও মাংস । রাজিব মাহমুদ
প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ আগস্ট ২০১৭, ১১:০৪ অপরাহ্ণ, | ২৯৮১ বার পঠিত
ঢাকার একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পিওনের চাকরি করে দিদার। বৌ চামেলি থাকে দেশের বাড়িতে দিদারের মা’র সাথে। বিয়ে করেছে বছর দেড়েক হয়ে গেলো। এখনো ছেলে-মেয়ে হয়নি। আর চামেলির বয়সও খুব-ই কম। নিজের থাকা-খাওয়ার খরচের পর দিদারকে মা-বৌয়ের জন্য দেশে টাকা পাঠাতে হয়। তাই মাসের শুরুতেই তার বেতন অর্ধেকেরও বেশ নীচে চলে যায়। এজন্য মাসের প্রথম সপ্তাহে দিদারের মেজাজ থাকে সপ্তমে। এদিকে চামেলি একটু আহ্লাদী টাইপ; বৈষয়িক ব্যাপার-স্যাপার বুঝতে চায় না। প্রায় প্রতি রাতেই দিদারকে ফোন করে এটা-ওটা কিনে দেবার জন্য বায়না ধরে। ইদানীং খুব করে বায়না ধরেছে দিদার যাতে তাকে ঢাকা নিয়ে আসে বেড়াতে। তবে ঢাকা’র প্রসঙ্গটা চামেলি সরাসরি তোলে না। মাসের প্রথম সপ্তাহের তিন তারিখে (দিদার ততদিনে টাকা পাঠিয়ে ফতুর) তাদের কথোপকথন নিম্নরুপঃ
চামেলিঃ হুনসি ঢাকার হোটেলে সুগন্ধি চাইলের চাইলের ভিতরে বড় গোস্ত দেওয়া পুলাউয়ের লাহান খাওন পাওয়া যায়।
দিদারঃ গ্যালে কী?
চামেলিঃ না, কিসু না। আপনে ঐ পুলাউ খাইসেন?
দিদারঃ খাইলে কী?
বৌঃ কী আর! কিসুই না…।
দিদারঃ তাইলে হুদাহুদি জিগাস্ ক্যান?
বৌঃ জিগাইলেও দোষ? খাইতে তো আর চাই নাই।
দিদারঃ এহ্ বিরানি খাইবো হ্যায়! আমি খাই ডাইল আর শাক আর নবাবজাদি আইসে বিরানি খাইতে!
বৌঃ চ্যাতেন ক্যান? আমি খাওনের কথা কইসি?
দিদারঃ আমি কি চদু? তোমার রং-ঢং কইর্যা ইশারা দেওন বুঝি না আমি?
বৌঃ আইচ্ছা যান্ খাওয়াইতে হইবো না। একবার খালি ঢাকার একটা হোটেলের সামনে লইয়া যায়েন। খারাইয়া বিরানির চেহারা দেখ্মু আর বাস নিমু।
দিদারঃ দ্যাখ্ মেজাজ খারাপ করবি না কইলাম…।
দিদার ফোন কেটে দেয় রাগ করে। একটু পরে আবার ফোন দেয় চামেলিকে। চামেলি ধরে না। ৩-৪ বার বাজার পরে ধরে বলে, “কি হইসে? এতবার ফোন দ্যান্ ক্যান?”
“খাইসস্ তুই?”
“খাইলে কী?”
“কি আর! এম্তেই জিগাই”
“কিসু না অইলে হুদাহুদি জিগান ক্যান?”
মেজাজ ভালো থাকলে চামেলি জন্য একটু একটু মায়া হয় তার। এইটুক একটা মেয়ে মা-বাবা-ভাই-বোন ছেড়ে ওর সাথে থাকতে আসছে। আবার এটাও ভাবে ছেমড়ির শখ এট্টু বেশি-ই।
কিছুদিন পর চামেলিকে ঢাকায় নিয়ে আসে দিদার। কয়েকদিন আগে অফিসের বড় সাহেবের মেয়ের বিয়েতে রান্নার দেখাশোনার কাজ করে ওর পনেরো দিনের বেতনের সমান বখশিশ পেয়েছে ও। তাই মনটা দারুণ ফুরফুরা। ওর মেসে চামেলির জিনিষপত্র রেখেই ওকে নিয়ে যায় একটা বড় বিরানির দোকানে। একটা টেবিলে বসার পর চামেলি চোখ বড় বড় করে চারপাশে তাকায়। তার মুখ-ভর্তি উজ্জ্বল হাসি। এদিকে দিদার বেশ সাহেবি ভঙ্গিতে চেয়ারের উপরে পা তুলে বসে হোটেলের বেয়ারাকে ডেকে ১ প্লেট কাচ্চি বিরানি দিতে বলে। বিরানি এসে গেলে দিদার চামেলি দিকে প্লেট এগিয়ে দিয়ে হাসিমুখে বলে, “নেও খাও”। তার মেজাজ ভালো থাকলে সে বৌ’কে মাঝে মাঝে ‘তুমি’ বলে। আর তাছাড়া ঢাকা শহরে সাহেবেরা বৌ’দের ‘তুমি’ বলে এটা সে দেখেছে। তবে বৌগুলাও যখন নির্লজ্জের মত স্বামীদের ‘তুমি’ বলে দিদারের ব্রহ্মতালু পুড়ে যায়। চামেলি অবাক হয়ে বলে, “খাও মাইনে? আপ্নেরটা কই”। দিদারের হাতে ২ জনের খাওয়ার যথেষ্ট টাকা থাকলেও সে এত টাকা খরচ করতে নারাজ। মুখে বলে, “আরে আমি তো এডি খাই-ই যহন- তহন। তুমি খাও”
“আপনে কইলেন আর আমি হুন্লাম্” চামেলি খৈ এর মত ফুটতে ফুটতে বলে ওঠে।
“আরে খাও না…আইচ্ছা আমি এট্টু খামুনে তুমার লগে” দিদার একটা সমাধান দেবার চেষ্টা করে। ভাতের ভেতর থেকে বড় মাংসের টুকরাটা বের করে চামেলি প্রথমেই দিদারের মুখে তুলে দেয়। দিদার চারপাশে তাকিয়ে লজ্জা পায় কেননা আশেপাশের সবাই আলাদা আলাদা প্লেটে বিরানি খাচ্ছে। মুখে বলে, “আরে করো কী…আহা…”
দু’জনের মুখেই স্বর্গ জয়ের হাসি। চামেলি মুখের চারপাশে ভাত নিয়ে বোকার মত হাসতে থাকে। এইরকম সুগন্ধি বাসনাই চালের পোলাও কোনদিন খায়নি সে। একটাই টুকরা মাংসের। সেটাই ছিঁড়ে ছিঁড়ে একে অন্যের দিকে এগিয়ে দিচ্ছে। ওরা দু’জনেই ভাবে, “ আহা! জীবন কী সুন্দর।”
যেটা ওরা জানে না সেটা হলো এর-ই মধ্যে ওদের দাঁতের ফাঁকে ফাঁকে লেগে যাওয়া মাংসের শিরা-উপশিরাগুলোর ভেতরে যে প্রাণীটার গরগর চীৎকার মিশে আছে সেটা একটা বড়সড় নেড়ি কুকুর। কাল রাতেই অত্যন্ত গোপনে জবাই করা হয়েছে কুকুরটাকে। এরকম কুকুর মাঝে মধ্যেই হোটেলের মালিক নিজেই সরবরাহ করে থাকে। তিনি এই বছর বছর হজ্ব পালন করে আসার পর থেকে ভাবছেন এই কাজ আর করবেন না। কিন্তু কুকুরের বিরানি বেচা টাকায় যখন ক্যাশ ড্রয়ার ভরে যায় তখন চকচকে চোখে উপরের দিকে চেয়ে বলেন, “আল্লাহ মালিক। তওফিক দাও মা’বুদ যাতে এই কাম আর না করি। আমিন।”