সত্যাসত্য । রাজিব মাহমুদ
প্রকাশিত হয়েছে : ২৪ জানুয়ারি ২০১৮, ১০:৩৭ অপরাহ্ণ, | ২১১১ বার পঠিত
ঘটনার শুরুটা গ্লাস থেকে ছলকে পড়ে যাওয়া এক ফোঁটা পানির মতই সাধারণ। আমার স্কুল-বন্ধু হাসিব আর আমি একুশে বইমেলার মূল ফটকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খাচ্ছিলাম। আমি ফুচকা আর হাসিব শিঙাড়া। নিজের আধ-খাওয়া শিঙাড়াটাতে সব মনোযোগ উপুড় করে দিয়ে হাসিব হঠাৎ-ই বেশ উত্তেজিত গলায় বললো—
‘আচ্ছা দোস্ত, বল তো শিঙাড়ার ভিত্রে আলু ঢুকলো ক্যাম্নে? ’
আমার খাওয়া থেমে গেলো। দাঁতের নিচে ক্রাশ ক্রাশ ভেঙে যাওয়া ফুচকার স্বাদু শব্দের ভেতর এরকম একটা কাঁটা-প্রশ্ন। প্রসঙ্গের কি দুর্ভিক্ষ লেগে গেলো? এ সপ্তাহের রাজনীতি বা ক্রিকেট নিয়ে কিছু বলা যেতো। ভেতরে বইমেলা চলছে; নতুন আসা বই নিয়ে একটা আলোচনা জমে উঠতেই পারতো। আচ্ছা এসব না হয় বাদ-ই দিলাম; সামনে দিয়ে এইমাত্র যে সুন্দর মেয়েটা হেঁটে গেলো তার সৌন্দর্য নিয়ে একটা বাক্য বলা যেতো। সেসব কিছু না, বলে কি-না শিঙাড়ার ভেতর আলু কীভাবে ঢুকলো! শালার আঁতলামি দেখে মাথাটা এই মাঝ-দুপুরে একাডেমীর ঐ জংধরা গেটটার মতই তেঁতে উঠলো। বললাম—
‘তুই ঝিঙ্গা ঢুকা, চিচিঙ্গা ঢুকা। মানা করসে কে?’
আমি শফিক রায়হান। বয়স ২৯ এবং বিবাহিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে এম এ শেষ করেছি মাস তিনেক হলো। এক মাস আগে মাঝারি মানের একটা প্রাইভেট ফার্মে ম্যানেজমেন্ট শিক্ষানবিশ হিসেবে ঢুকেছি। যা পড়ে এসেছি আর যে কাজ করছি এ দু’টোর আতঙ্ক জনক পার্থক্য নিয়ে আলোচনায় আমার কণামাত্র আগ্রহ নেই; বেকার যে বসে নেই তাতেই আমি মহা খুশি। গায়ে এখনো ক্যাম্পাসের নির্ভার সময়টার গন্ধ লেগে আছে; দায়িত্ব-টায়িত্ব নেয়ার কথা ভাবতে পারতাম না এই ক’মাস আগের অবিবাহিত জীবনেও। বিয়ের পরেও যে রাতারাতি দায়িত্ববান হয়ে উঠেছি তা-ও নয়। তবে হাসিব এখনো আগের নির্ভার পাখিটিই আছে। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনশাস্ত্রে পাশ করে সে এখনো চাকরি খুঁজছে। বলা যায় খোঁজার ভান করছে। এবং অবশ্যই অবিবাহিত। আমরা কাছাকাছি এলাকাতে থাকি; মাসে ২/৩ বার দেখা হয় আমাদের। কখনো ক্যাম্পাসে আবার কখনো আশেপাশের নানা রেস্টুরেন্টে। যেখানেই দেখা হোক না কেন, খাবারের বিলটা সব সময় আমাকেই দিতে হয়।
আমার বিরক্তির উত্তরে হাসিবের ঠোঁটে একটা নৌকা-হাসির কোণা দেখা যায়। নিতান্তই বেহায়া ধরণের হাসি। সে তার শিঙাড়া থেকে বেশ ডাঁশা সাইজের একটা আলুর টুকরো তুলে নেয়। এরপর ওটা দু’আঙুলে ঝুলিয়ে টুপ করে মুখে ছেড়ে দেয়-অনেকটা টম এন্ড জেরির টম এর স্টাইলে। এরপর গলায় একটা খুশি খুশি পানের পিক-জমা তারল্য এনে বলে—
‘কথা তো সেইটা না রে বন্ধু! যে কোন একটা র্যানডম সবজি ঢুকায়ে দিলেই তো আর হইলো না…ব্যাপারটার আদি কার্যকারণ জানা দরকার না! আলু-ই ক্যান…অন্য কিছু না ক্যান?’
‘দামে সস্তা, খাইতে স্বাদ, বেশির ভাগ মানুষ পসন্দ করে…’
‘এইগুলান তো মনে কর বুঝলাম…কিন্তু এর বাইরে আর কোন কারণ নাই? সস্তা আর খাইতে ভালো তো আরও অনেক সবজি আসে…আলু-ই ক্যান?’
‘আলুতে তোর প্রব্লেম কি?’
‘প্রব্লেম তো মনে কর আছেই… আমি আদি কার্যকারণে বিশ্বাসী…যেইডা যেম্নে চইলা আইতাসে হেইডারেই স্বাভাবিক ধইরা নিতে চাই না…এইভাবে ধইরা নিলে তো কোন কিসুর গভীরে মানে ভিত্রে ঢুকা যায় না, দোস্ত…তুই শুধু মচমচ কইরা শিঙাড়া খাইয়া যাবি অথচ ভিতরের আলুগুলার আদি কার্য-কারণ জানবি না-এইটা একটা কথা হইলো না-কি কি হওন উচিৎ? তুই-ই ক!’
এই গভীর দার্শনিক প্রশ্ন করার কয়েকদিনের মাথায় হাসিব এক ছিপছিপে শ্যামবর্ণা রূপসীর প্রেমে পড়ে গেলো। আমি ধরে নিলাম যে তার শিঙাড়া বা আলু বিষয়ক আগ্রহে বিদ্যুৎ-প্রবাহ কমে গেছে। কিংবা হয়তো স্থায়ী লোডশেডিং-ই হয়ে গেছে, কে জানে! বেকার মানুষের মাথায় কখন কোনটা ঢুকে পড়ে তা আগে থেকে অনুমান করা মুশকিল। তবে কথা সেটা হলেও আসল কথা সেটা না। আসল কথাটা হলো হাসিবের এই বাজে প্রশ্নটা আমার মগজ নিয়ে নিলো কোন যাচাই বাছাই ছাড়াই। আর মগজে ঢুকেই প্রশ্নটা একটা মিহি যন্ত্রণা হয়ে কিটকিট করতে থাকলো। নিজেকে একটা লম্বা প্রশ্নবোধক ছায়ার ভেতরে আটকা পড়া অবলা জীবের মতো লাগছে। যত দিন যায় এই ছায়া ততই দীর্ঘ হতে থাকে।
প্রতিদিন বেলা এগারোটায় অফিস থেকে বের হয়ে রাস্তা পার হই। উল্টো দিকের ‘বাবার দোয়া’ রেস্তোরায় ঢুকে চা-শিঙাড়া খাই। মাঝে মাঝে শুধু ‘লবণ কেন কম’ আর ‘আলু কেন আধা সেদ্ধ রয়ে গেলো- এই দু’টো বিরক্তি প্রকাশক প্রশ্ন ছাড়া শিঙাড়া-বিষয়ক আর কিছু নিয়ে কখনো অভিযোগ করেছি বা ভেবেছি বলে মনে পড়ে না। আমার এই মনোভাব যে শুধু শিঙাড়া প্রসঙ্গেই সীমাবদ্ধ তা নয়। চারপাশের সবকিছু যেমন একটা স্রোতে চলছে, সে একটু উনিশ-বিশ বা অনুকূল-প্রতিকূল যাই হোক, তাতে মোটামুটি ভেসে থাকতে পারলেই আমি সুখী ছিলাম। গভীরতা-টতা’র ধার ধারি না খুব একটা।
মাঝখানে হাসিবের এই বাক্ওয়াজ প্রশ্নটা সব বানচাল করে দিলো— ডিগবাজি দিয়ে ঢুকে পড়লো দৈনন্দিনতার চিন্তা-স্রোতে। ইদানীং শিঙাড়ায় প্রথম কামড় দেয়ার সাথে সাথে মুখের ভেতরে ঢুকে যাওয়া আগুন-গরম ধোঁয়াটাকে হা হু হা হু করে সামলাতে না সামলাতেই আমার চোখ অবধারিত ভাবে আটকে যাচ্ছে শিঙাড়ার ভেতরের আলুগুলোতে। আজও ঘটলো একই ব্যাপার। চশমার ফাঁক দিয়ে দেখি মচমচে খোলসের ভেতর বেশ গাদাগাদি করে বসে আছে ছোট ছোট নরম-হলুদ আলুগুলো; আর ওগুলোকে পেঁচিয়ে-জড়িয়ে আছে সেদ্ধ-সবুজ ধনেপাতা-প্রতিদিনের এই চেনা দৃশ্যটা এতোদিন চোখের বাইরেই ছিলো। এখন সুযোগ দৃশ্যটা চোখের দেয়াল ছ্যাঁদা করে করোটির দেয়ালে ধক-ধক প্রতিধ্বনি তুলতে শুরু করে দিলো। প্রসঙ্গ সেই আলু আর সেই আদি কার্য কারণ।
এরই মধ্যে আমাকে কান ধরে দুই সিঁড়ি টেনে তুলে কে যেন প্রশ্ন করে, ‘আচ্ছা এই আলুগুলোর জীবনের সত্য কি?’ প্রশ্নের এই পরিবর্ধন আমার ভেতরে বেশ কম্পনশীল একটা ঝাঁকি দিয়ে গেলো। বিড়বিড় করে বললাম-‘সত্য! আলুর সত্য!’ এসময় রেস্তোরার পিচ্চিটা এসে হলুদ দাঁত বের করে হেসে জিজ্ঞেস করলো, ‘স্যার, চা খাইবেন?’
পিচ্চির নাম অন্তর। তার এই বিগলিত হাসির দাম খুব বেশি না-পাঁচ টাকা। কখনো কখনো দশ টাকা। বিল ত্রিশ টাকার কম হলে ওকে পাঁচ টাকা দেই আর বেশি হলে দশ টাকা। শিঙাড়ার সাথে চা খেলে বিল ত্রিশ টাকা ছাড়িয়ে যায় আর সেই কেও কারাডং-এ ওঠাই অন্তর মিয়ার লক্ষ্য থাকে।
পিচ্চির বয়স আট ছাড়াবে না কিছুতেই। ওর নেশাখোর বাবা কিছুদিন আগে ওর মা আর ছোট দুই ভাই-বোনকে ছেড়ে গিয়ে আরেকটা বিয়ে করেছে। কোন খোঁজ-খবরই রাখে না ওদের। কিন্তু এরপরও বাবাকে ভীষণ ভালোবাসে অন্তর। বাবা তাকে একবার কাঁধে চড়িয়ে মেলা থেকে একটা লাল খেলনার লঞ্চ কিনে দিয়েছিলো। পরে এক বৃষ্টির দুপুরে বাপ-বেটা মিলে তাদের বস্তির পাশের খালে সেই লঞ্চ চালিয়েছিলো ভট ভট শব্দ করে। এই দৃশ্য ওর মনে এমনভাবে গেঁথে আছে যে সে চাইলেও বাবাকে অপছন্দ করতে পারে না; ঘৃণা করা তো অনেক পরের ব্যাপার। বরং ওর সব রাগ ওর নতুন মায়ের ওপর; সেই মহিলাই পিতা-পুত্রের সম্পর্কের আদি ও অকৃত্রিম রসায়নে পানি ঢেলে দিয়েছে। অন্তরের ভাষায়, ‘বেডিডা এমন খাচ্চোর স্যার, কি কইতাম! আমার বাজানের মাথাটা আউলাইয়া দিসে।’
এদিকে ওর বাবা ওদেরকে ছেড়ে যাবার পর ওর মা তিন বাসায় ছুটা বুয়ার কাজ করে। বাবা থাকার সময় অন্তর একটা স্কুলে পড়তো। এখন ওকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে এই রেস্তোরায় কাজে লাগিয়ে দিয়েছে ওর মা। এতে অবশ্য অন্তর যে খুব একটা অখুশি তা না। এখানে সে টুকটাক ভালোমন্দ খেতে পায়, বখশিশও জোটে খারাপ না। স্কুল তার কাছে ভালো লাগতো না কখনোই। এর কারণ হিসেবে ও বলে, ‘ঐহানে কুনু বিচার নাই স্যার। পরা পারলে গাইল্লায় আর না পারলে মারে।’ পড়া পারলেও কেন গালি দেয় এ বিষয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলে জানা যায় যে একদিন পড়া পারার পরে স্যার ওকে বলেছিলো, ‘ঐ ফইন্নির পুত…অহন পারলি তো কাইল পারলি না ক্যান? কাইলকা কি তরে কুত্তায় কামরাইসিলো?’
পড়া পারার পরেও একটা বাচ্চা ছেলেকে শিক্ষকের মার খেতে হচ্ছে। কেন? এর পেছনের সত্যটা কি? বাচ্চাটার দারিদ্র? ওকে মারলেও এগিয়ে এসে প্রতিবাদ করার কেউ নেই সেজন্য? না-কি এই ‘ফইন্নির বাচ্চা’র লেখাপড়া শিখে বড় কিছু হওয়ার সম্ভাবনাটাই শিক্ষকদের মাথায় আগুন ধরিয়ে দেয়?
যেদিন বাসা থেকে নানা কারণে খাবার আনা হয় না সেদিন আমি ‘বাবার দোয়া’তে খেতে যাই। তবে দুপুরের সময়টায় অন্তরকে টেবিল মোছার কাজে ব্যস্ত দেখা যায়। একদিন ও আমাকে চুপিচুপি বলেছিলো যে রেস্তোরার ‘ওস্তাদরা’ দুপুরে ওকে কোন অর্ডার নিতে দেয় না; ওকে দিয়ে শুধুই টেবিল পরিষ্কার করায়। এর কারণ দুপুরের খাবারের বিলে বখশিশ পাওয়া যায় বেশি আর তাই এই সময় প্রতিযোগিতাটাও অনেক বেশি।
‘বাবার দোয়া’ এর লাগোয়া একটা চীনা কাম থাই কাম দেশি খাবারের রেস্তোরা আছে, নাম ‘ড্যাডি’স কিচেন। বেশ কয়েকটা স্প্লিট এসি আয়েশি গুঞ্জন ছড়িয়ে সারাক্ষণ চলে ওখানে। খাবার টেবিলগুলো সুন্দর লাল কাপড়ে মোড়া। চেয়ারগুলোরও আছে চমৎকার সব নকশাদার জামা। মাথার ওপরের স্পিকার থেকে ভেসে আসে বিদেশি বাদ্যযন্ত্রের মিষ্টি সুর। ইউনিফর্ম পরা ওয়েটাররা এখানে বিনয়ে ঝুঁকে বিভিন্ন লাঞ্চ বা ডিনার আইটেম সার্ভ করে। স্টেইনলেস স্টিল অথবা কাঁচের পাত্রে স্পাইসি ফুড আইটেমগুলো শুয়ে থাকে বনেদি কায়দায়। ভারী কাঁচের দরজা বাইরের পৃথিবী থেকে এই রেস্তোরাকে আলাদা করে এর ভেতরে তৈরি করেছে এক শান্ত সৌম্য আভিজাত্য।
ওদিকে ‘বাবা’র দোয়া’তে এসব কিছু নেই। থেকে থেকে রেস্তোরা’র ‘মামা’দের হাঁক শোনা যায়, ‘ঐ দুই গরু এক খাসি চালু কইরা…ওওওই…খানা একটা…’। অর্ডার অনুযায়ী এক হাতে তিন ধরণের খাবার নিয়ে তারা টেবিলে টেবিলে যায়। তাদের পরনে ফুটপাথের সস্তা শার্ট ও লুঙ্গি; কেউ কেউ আবার প্যান্ট পরেও কাজে আসে। খাবার পরিবেশন করা হয় মেলামাইনের বাটিতে পুরনো কাঠের ন্যাংটো টেবিলে। কাউন্টার থেকে রেডিও’র খবর ভেসে আসে, ‘এদিকে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যে দেশের এই পরিস্থিতি একদিনে তৈরি হয়নি…’। সুর বলতে খবর-পাঠের এই সুরেলা ওঠানামাটুকুই। তবে ভেতরের রসুঁই ঘর থেকে মশলা-তেল-সবজি’র যে ঘ্রাণটা আসে সেটা মোটামুটি অপার্থিব। ঐ ঘ্রাণটুকুই এই রেস্তোরার সব অপূর্ণতার কথা ভুলিয়ে দেয়- ম-ম করে ভাসতে ভাসতে নাক ছাড়িয়ে ওটা ঢুকে পড়ে এখানকার খদ্দেরদের মগজে ও হৃদয়ে।
‘ড্যাডি’স কিচেন’-এ খাবারের দাম স্বাভাবিকভাবেই অনেক বেশি; শুধু যে চীনা বা থাই খাবারের দাম-ই বেশি তা নয়; দেশি খাবারের দামও এখানে ‘বাবার দোয়া’ এর তুলনায় অনেকটাই বেশি। খাবারের স্বাদ বদলাতে মাসে দুই-এক বারে ওখানে যাই, স্বাদ বদলায়ও বটে; তবে ওখানে খেয়ে ঠিক কেনো জানি আমি আরাম পাই না। আর পয়সাটা দেয়ার সময় বেয়ারাগুলো’র আলগা আদিখ্যেতা বিরক্ত লাগে। অবশ্য অন্তরও এটা করে। তবে ওর খাতিরদারিটা শুরু থেকেই থাকে, শুধু বিল নেয়ার আগে না। আর তাছাড়া ছেলেটার হাসিতে কোথায় যেন একটা অকৃত্রিম আন্তরিকতা আছে।
আজকে শিঙাড়া খাওয়ার পর চা আর খাই না কিন্তু কি মনে করে অন্তরকে দশ টাকাই দিই। সে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে সেনা কায়দায় কপালে হাত ঠেকিয়ে স্যালুটের মতো একটা ভঙ্গি করে। আমি হেসে ওর মাথা নেড়ে দিই। তবে আলুর শেষ ঠিকানা নিয়ে কোন সিদ্ধান্তে আসতে না পারার যন্ত্রণা নিয়েই অফিসের লিফটে উঠতে হয় আমাকে। আমি বসি সাত তলায়। লিফটে কাঁধে-কাঁধ-ধাক্কা-লাগা ভিড়। দরজা বন্ধ হবার ঠিক আগ-মুহূর্তে এ্যাকাউন্ট্স এর রিক্তা দৌড়ে এসে দরজার কাছে দাঁড়ানো একজনের গা-ঘেঁষে দাঁড়িয়ে যায়।
চোখে চোখ পড়ে গেলে দু’জনেই হাসি, বলি, ‘কি, তাড়া নাকি খুব?’। রিক্তা বল্লো, ‘না, এই নিচে গিয়েছিলাম চা খেতে। আজকে কাজের চাপ কম।’ রিক্তা এমনিতে বেশ রক্ষণশীল। পোশাকে সতর্ক রাখঢাক, কোন পুরুষ সহকর্মীর সাথে কথা বলার সময় পুরুষটির চোখের ভ্রমণ ফলো করা ও ক্ষেত্র বিশেষে নিজের কাপড় ঠিক করা, কোন পুরুষ বেশি ‘হে হে’ টাইপ ভাব দেখালে তাকে এড়িয়ে চলা- এ সব-ই রিক্তার চরিত্রের স্বাভাবিকতায় মিশে আছে। কেবল লিফটে উঠতে গেলেই তার এই রক্ষণশীলতায় যেন ছেদ পড়ে যায় কয়েক মিনিটের জন্য। এই যেমন এখন। চোখে-মুখে কোন অস্বস্তির ছাপ নেই। যেন কোনভাবে জায়গা করে নিয়ে উপরে উঠতে পারলেই জীবনের সব সমস্যার স্থায়ী সমাধান হয়ে যাবে। তাই এক্ষেত্রে পুরুষদের সাথে যদি একটু চাপাচাপি হয়েই যায় কী আর করা!
রক্ষণশীলতার এই সাময়িক ছেদের পেছনের সত্যটা কি?
সত্যের পোকা আমার পিছু ছাড়ে না। যেখানেই যাই, যাই দেখি, সবসময় সবকিছুর পেছনের সত্য নিয়ে প্রশ্ন করতে থাকি। এই যেমন সেদিন এক বিয়ের দাওয়াতে গিয়েছিলাম। আমার পাশে বসা লোকটা কাচ্চি বিরিয়ানির ডিশ থেকে বেছে বেছে খাসির নরম কুচকুচা হাড়ওয়ালা মাংসগুলো নিজের প্লেটে নিচ্ছিলো। পাশে বসা নিজের ১২-১৩ বছরের ছেলেটাকেও একই রকম হাড় তুলে দিচ্ছিলো। সেই হাড়গুলোকে মড়মড় শব্দে দাঁতের নিচে গুঁড়িয়ে দিতে দিতে পিতা পুত্রকে দুই হাড়ের মাঝখানে আটকে পড়া মাংস খাওয়ার কৌশল শেখাচ্ছিলো—
‘মাঝখানে বুইরা অঙ্গুল দিয়া মাংসটা উপ্রে ঠ্যালা দিয়া দাঁত দিয়া টাইন্না ছিরবি। তয় দাতে চর্বি লাইগা গেলে জিব্বা দিয়া প্যাচায়া ধইরা ‘থু’ কইরা ফালায়া দিবি, বুঝ্ছস?’
পুত্র গম্ভীর ভাবে ‘হ্যাঁ-সূচক’ মাথা নাড়ে। সে বুঝতে পেরেছে। পিতা-পুত্র দুইজনের-ই সারা মুখে ঘাম-কপালে, মাথার দুই পাশের চিপ-এ, গলায়, উপরের ঠোঁটের চারকোণা গর্তে। কিন্তু সেটা নিয়ে তাদের কোন হাত-পা ব্যথা নেই। গভীর অভিনিবেশে খেয়ে যাচ্ছে দু’জন। আমি পিতার কানের কাছে ফিশ ফিশ করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভাই যে খাসিটার মাংস খাচ্ছেন, তার জীবনের সত্যটা কি জানেন?’
‘এ্যাঁ!! কী??’ উনি একটা শক্ত হলদেটে হাড় চুষে ফকফকা সাদা করায় ব্যস্ত তখন।
আমি পুত্রকে বললাম, ‘খোকা, তুমি কি জানো?’ ছেলে খাওয়া বন্ধ করে ভীত চোখে তাকালো আমার দিকে। তখন পিতা আর থাকতে না পেরে খেঁকিয়ে উঠলো—
‘ভাই আপনের সমস্যা কি? কি ‘সত্য’ ‘সত্য’ লাগাইসেন?’
দুই মাস পর। আমার সত্যানুসন্ধান তখনো অব্যাহত। এটা নিয়ে অফিসে ও বাড়িতে বেশ হাসাহাসি চলছে। এরই মধ্যে একদিন দুপুরে ‘বাবার দোয়া’ তে খেতে গিয়ে শুনি এই রেস্তোরার মালিক আর রেস্তোরার স্পেসটার মালিকের পাঁচ বছরের চুক্তি শেষ হয়ে যাচ্ছে আগামী মাসেই। আর এই সুযোগে ‘ড্যাডি’স কিচেন’ এর মালিক অনেক বেশি অগ্রিম ও মাসিক ভাড়ার প্রস্তাব দিয়ে একটা নতুন চুক্তি করতে চাইছে ‘বাবা’র দোয়া’র স্পেস মালিকের সাথে। এটা করা গেলে দুই রেস্তোরার কাস্টোমারকে এক রেস্তোরায় বসিয়ে দ্বিগুণ মুনাফা নিশ্চিত করা যাবে। যদিও ‘ড্যাডি’স কিচেন’ এর মালিক ভালো করেই জানেন যে তার হোটেলে খাবারের দাম বেশি হবে; সব কাস্টোমার তিনি পাবেন না। তবে কাছে-ধারে আর কোন রেস্তোরা না থাকায় এদিককার অফিসগুলোর অনেকেই বাধ্য হবে বেশি দাম দিয়ে তার রেস্তোরায় খেতে।
এদিকে ‘ড্যাডি’স কিচেন’- এ চাকরি পাওয়ার জন্য ‘বাবা’র দোয়া’র স্পেস মালিকের কাছে এই রেস্তোরার কর্মচারীরা গোপনে তদ্বির শুরু করে দিয়েছে। এই চীনা-থাই-দেশি রেস্তোরায় বেতন ও অন্যান্য সুবিধা তুলনামূলক ভাবে বেশি হওয়ায় বাংলা রেস্তোরার কর্মচারীরা উপরে উপরে তাদের বর্তমান মালিকের পক্ষে জোর সাফাই গাইছে ঠিক-ই; তবে ভেতরে ভেতরে উল্টো পথে হাঁটছে তারা। গরমে কাজ করতে করতে কল্পনায় ফ্রি এসি’র বাতাস খেতে খেতে তারা প্রায়-ই কাজের মাঝে ঘুমিয়ে পড়ছে।
আজকে দুপুরে খেতে আসার পর থেকে দেখছি অন্তরের মন খুব খারাপ। কারণ জিজ্ঞেস করার পরে শুনলাম যে চীনা রেস্তোরায় তার বয়সের কোন কর্মচারীর প্রয়োজন নেই। পিচ্চি লাগে শুধু বাংলা রেস্তোরাগুলোতে। তাই অন্য ‘ওস্তাদ’দের মত তার নতুন চাকরি পাবার আশা নেই।
আজ অর্ডার করেছি ভাত আর পাঙ্গাশ মাছ। কিন্তু খবরটা শোনার পর থেকে খেয়ে কোন স্বাদ পাচ্ছি না। সকালে এই রেস্তোরার গরম মচমচে শিঙাড়া আর দুপুরে হলুদ-মশলা-পেঁয়াজের ঘনীভূত ঘ্রাণের সাথে কেমন একটা অভ্যস্ততা গড়ে উঠেছে। ক’দিন পরে এগুলো আর থাকবে না এখানে বরং এখানে এসি চলবে ঘর ঘর করে আর নাকে আসবে বনেদী খাবারের অভিজাত গন্ধ-এটা ঠিক মেনে নিতে পারছি না।
আমার খাওয়া যখন মাঝ পর্যায়ে তখন এক ভদ্রলোকের আবির্ভাব। আমার সামনের চেয়ারটার দিকে ইঙ্গিত করে ভদ্রলোক জানতে চান ওখানে কেউ বসেছে কি-না। আমি মাথা নেড়ে ‘নাা’ বলতেই তিনি চেয়ারটা টেনে বসে পড়েন। আমার প্লেটের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললেন, ‘মাছটা কি ভালো? তাহলে আমিও একটা অর্ডার দিতাম।’
আমার কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পেয়ে তিনিও ভাতের সাথে পাঙ্গাশ মাছ অর্ডার করেন। খাবারের জন্য অপেক্ষা করতে করতে তিনি বেশ কয়েকটা ফোন করে নিলেন; বেশির ভাগই আইনি ঝামেলা সংক্রান্ত। একটা ফোনে উনার কথা শুনে আমি চোখ তুলে তাকাই। শুনলাম উনি বলছেন, ‘দেখেন এই রেস্তোরাটার জন্য কিছু করা যায় কি-না। এখানের রান্না ভালো, দামও কম। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এখানে খেতে আসে। পাশের চাইনিজ রেস্তোরাটা টাকার জোরে এই রেস্তোরার স্পেসটা নিয়ে নিতে চাইছে। দেখুন তো কিছু যদি করা যায়…’
আমি ঢক ঢক করে পানি খেয়ে ভদ্রলোককে ভালো করে দেখি। এই মে মাসের গরমেও ফুল-হাতা শার্ট পরা। হাতে বড় ডায়ালের ঘড়ি আর চোখে কালো চশমা। হাতের ঘড়িটি খুব সাধারণ হলেও চোখের রোদ-চশমাটা দেখে বেশ দামি মনে হলো। হাতেও মোটামুটি দামি একটা এ্যাটাচি কেস। উনার ফোনে কথা বলা শেষ হলে আমি ‘বাবার দোয়া’ দখলের প্রসঙ্গটা নিয়ে একটা আলাপ তোলার আগ্রহ দেখাই—
‘দ্যাখেন তো কি অন্যায়! শুধু টাকার জোরে এই জায়গাটা নিয়ে নেবে!’
‘তা-ই তো হয়, ভাই।’
‘কিন্তু সেটা হওয়া উচিৎ না।’ আমি অধৈর্য হয়ে বলি।
‘উচিৎ? হা হা হা। এটা একটা আরোপিত শব্দ।’
‘মানে?’
‘পরে বলছি। আগে বলেন এ ব্যাপারে আপনার সত্যানুসন্ধান কি বলে?’
আমার বুকের ঠিক মাঝখানটা ঝাঁ করে খালি হয়ে যায়-এই অপরিচিত লোক আমার সত্যানুসন্ধানের ব্যাপারটা জানলো কি করে? তাকে আগে কখনো দেখেছি বলে তো মনে পড়ে না। চোখ তুলে আবারও ভালো করে তাকিয়ে দেখি তাকে। ঠোঁটে মোলায়েম একটা হাসি ঝুলিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি। চোখ দুটো চশমার কারণে দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু মনে হলো ওগুলোতে বিদ্রূপ নেচে বেড়াচ্ছে।
তার সদ্য-প্রাক্তন প্রেমিকাকে নিয়ে সে ‘ড্যাডি’স কিচেন’ -এ খেতে গিয়েছিলো। খাওয়ার এক পর্যায়ে একজন ওয়েটার এসে তাদেরকে বল্লো যে তারা দিন ধরণের শিঙাড়া নিয়ে কাস্টোমারদের মধ্যে একটা ফ্রি সার্ভে করছে। এরপর ওদের দুই জনকে তিনটা করে শিঙাড়া, একটার ভেতর ঝিঙা, একটার ভেতর পেঁপে ও একটার ভিতর করল্লা, ফ্রি টেস্ট করার জন্য দেয়া হলো। সাথে দেয়া হলো একটা মিনি সার্ভে ফর্ম যেখানে এই তিন শিঙাড়ার স্বাদ অনুযায়ী এদেরকে নম্বর দিতে হবে। শুনে আমি কিছু না বুঝে তাকিয়ে থাকি․․․
‘জ্বি?’ আমি কোন রকমে বলি।
‘ঘাবড়ে গেলেন নাকি?’ ঠোঁটের হাসিটা ধরে রেখেই বললেন।
‘না…তা না…’
‘শুনুন আমাকে যদি জিজ্ঞেস করেন তো বলবো সত্যটত্য বলে কিছু নেই। যা হয় বা ঘটে তা-ই সত্য। পুরোটাই একটা র্যানডম ব্যাপার।’
আমি চুপ করে থাকলাম। তিনি বলে গেলেন—
‘ফিলোসফিতে একটা কথা আছে-‘Truth is constructed’। আমি বলি-‘Truth is whatever happens’। আজকে যদি ‘ড্যাডি’স কিচেন’ জিতে যায় তাহলে দুই দিন এই ‘বাবার দোয়া’র জন্য শোক করে তিন দিনের দিন আপনারা ঐ ‘ড্যাডিস কিচেন’-এই খেতে যাবেন। আপনাদের শ্রেণির শহুরে মানুষেরা ঝামেলা পছন্দ করে না। তবে নানা বই টই পড়ে ধূমায়িত চা-কফি’র সাথে একটু-আধটু প্রতিবাদ-টদিবাদ করা বা এ নিয়ে আলোচনা করতে তারা বিশেষ পছন্দ করেন না। তাই কিছুদিন একটু হাল্কা শ্রেণি-সচেতন প্রতিবাদ বা লুতুপুতু মন খারাপ ছাড়া শেষ-মেশ আর তেমন কিছুই হবে না। আর তাছাড়া আইনও ওদের পক্ষে। অতএব এটাই সত্য হিসেবে দাঁড়িয়ে যাবে।
‘আর যদি ‘ড্যাডি’স কিচেন’ হেরে যায়?’
“সে সম্ভাবনা বলিউডের নায়িকাদের কোমরের মতই ক্ষীণ। তবে যদি সেটা হয়ে যায় কোনভাবে তাহলে সত্য বদলে যাবে। এই রেস্তোরার কর্মীরা তাদের কর্মস্থলের প্রতি বিশ্বস্ততা দেখানোর নৌকা বাইচে নেমে পড়বে। আপনারা যারা এখানে কম পয়সায় খান তারা খুশি হবেন। হয়তো একটা আনন্দ মিছিলও বের করবেন। খাওয়ার পর দাঁত খিলাল করতে করতে বলবেন, ‘সত্যের জয় হয়েছে।’ হা হা হা”
‘তাহলে কি দাঁড়ালো?’
‘দাঁড়ানো-টাঁড়ানোর তো কিছু নেই, স্যার। ঘটনা, দুর্ঘটনা, দৈব-ঘটনা এসবের পর তলানিতে যা রয়ে যায় সেটাই সত্য। আর সেই সত্য আবার একেক জনের কাছে একেক রকম। একে চিরায়ত ভাবার যেমন কোন যুক্তি নেই, তেমনি একে কাব্যময় করে তোলার প্রচেষ্টাও হাস্যকর। তাই ঐ যে কবি কীট্স বলেছেন ‘সত্যই সুন্দর’ বা ‘সুন্দরই সত্য’-আমি তার সাথে একমত নই একেবারেই- এগুলো সত্যের ওপর আরোপ করা নীতিকথা ছাড়া আর কিছুই না। কেননা শেষ-মেশ যা টিকে থাকে তাই সত্য বলে মানুষ মেনে নেয়। এটা একটা অবস্থা মাত্র। আর এই অবস্থাটা তৈরি করে বিজয়ীরা, বিজিতরা নয়- প্লেইন এন্ড সিম্পল।
কথাগুলো খুব রুক্ষ শোনায়। তবে কোথায় যেন একটা নাড়া খাই। এর মধ্যে ভদ্রলোকের খাবার এসে গেছে। তিনি খাবার নিয়ে আসা ছেলেটাকে ধন্যবাদ দিয়ে খেতে শুরু করেন। আমার খাওয়া অবশ্য শেষ। টেবিল মুছতে এসে অন্তর খুব আগ্রহ নিয়ে ভদ্রলোককে দেখতে থাকে। আমি হাত ধুতে উঠে যাই।
ফিরে এসে আমার খাবারের বিলের অংক লেখা নিউজপ্রিন্ট কাগজের টুকরোর তল থেকে গুয়া মুড়ি তুলে নিতে নিতে আড়চোখে তাকিয়ে দেখি ভদ্রলোককে। তিনি একমনে খেয়ে যাচ্ছেন। আমি মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করে বিল দিতে যাব এমন সময় মুখ-ভর্তি খাবার নিয়ে উনি হঠাৎ-ই গমগম করে বলে ওঠেন—
‘আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?’
‘করেন।’
‘আপনি তো মোটামুটি ভালো মানের একটা চাকরি করছেন, বিয়েও করেছেন। সুখেই তো আছেন। হঠাৎ এই ‘সত্য’ নিয়ে পড়লেন কেন?’
আমি চুপ করে থাকি।
কিছুক্ষণ থেমে উনি আবার বললেন, ‘আরেকটা কথা বলি?’
‘জ্বি।’
‘আপনার মনে আছে আপনি কয়েক বছর আগে এক শীতের রাতে মালিবাগ বিশ্বরোডের পাশে একটা বস্তির সামনে চৌদ্দ-পনেরো বছরের একটা মেয়েকে আগুন পোহাতে দেখেছিলেন?’
আমার বিস্মিত দৃষ্টি উপেক্ষা করে তিনি বলে গেলেন—
‘মেয়েটার শরীরে গরম কাপড় ছিলো না দেখে আপনার কষ্ট হয়েছিলো। কিন্তু তার পাশাপাশি মেয়েটার পিঠ-খোলা শরীর দেখে আপনার মধ্যে কামভাবও জেগেছিলো। এখন এই দুটোর মধ্যে আপনি কোনটাকে সত্য বলবেন?’
আমি মাথা নিচু করে টেবিলের উপর রাখা একটা গ্লাস আঙুল দিয়ে আঁচড়াতে থাকি।
‘আরেকবার আপনি মুরগি কিনতে গিয়ে মুরগি-ওয়ালা যখন আপনার কেনা মুরগিটাকে ঠিকমত জবাই না করেই ওটার একটা পা কেটে ফেলেছিলো তখন আপনি খুব আহত হয়েছিলেন। মুরগি বিক্রেতাকে বারবার বলছিলেন, ‘এইটা কি করলেন, ভাই? ইশ্শ্!’ অথচ সেদিন দুপুরে সেই মুরগিটারই কশানো মাংস আপনি ভীষণ তৃপ্তি নিয়ে খেয়েছিলেন। মুরগিটার পায়ের আঙুলগুলো দাঁত দিয়ে গুঁড়ো করতে করতে বেঁচে থাকার অপার স্বাদ গ্রহণ করেছিলেন। এই দুটো ঘটনার মধ্যে সত্য কোনটাতে লুকিয়ে আছে বলতে পারেন?’
আমি হঠাৎ-ই কেমন শক্ত হয়ে যাই। একটা অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতির চার দেয়ালে আটকা পড়ে হাঁসফাঁস করতে থাকি। এই রাগ হচ্ছে, তো এই আবার লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছি। হঠাৎ-ই আবার দৌড়ে বেরিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। নিজেকে লোকটার সামনে নগ্ন-অসহায় একটা প্রস্তরযুগের মানুষ বলে মনে হচ্ছিলো। এই প্রথমবার আমি ভেতর থেকে উপলব্ধি করে উঠলাম যে আমি নিজেকে কতোটা কম চিনি বা একেবারেই চিনি না। নিজের ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা সত্যগুলোকে গুম করে দিয়ে আমি কি-না সত্য খুঁজছি শিঙাড়ার আলুতে?
এ পর্যায়ে পাশে মুখ ঘোরাতেই দেখি হাসিব দাঁড়িয়ে আছে। মুখ-ভর্তি সেই পরিচিত নৌকার কোণা হাসি। কোন কথা না বলে ও আমাকে প্রায় জোর করে পাশের টেবিলটায় টেনে নিয়ে গেলো। ভদ্রলোককে যেন সে দেখতেই পায়নি। উঠে আসার সময় ভদ্রলোক আমার সাথে বাঁ হাত মিলিয়ে তার নাম বলে বল্লেন—
‘আপনারা কথা বলেন। আমি বরং খেয়ে নেই। পরে কখনো হয়তো কথা হবে। কিছু মনে করবেন না। অনেক উল্টা-সিধা কথা বলে ফেলেছি।’ এরপর আমার দিকে একটানা কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে যে হাসিটা দিলেন তাতে আমার পিলে চমকে গেলো।
আমার মাথা-ভর্তি অসংখ্য ঘর্মাক্ত সাপ হিশ হিশ করছে। এতোক্ষণে যেন ভদ্রলোককে খেয়াল করলো হাসিব। পাশের টেবিল থেকে আড়চোখে তাকে দেখতে দেখতে হাসিব বললো—
‘কীরে শালা! তোর তো কোন খবর-ই নাই’
মুখে জোর করে হাসি ফুটিয়ে কোন রকমে বলি—
‘আমার খবর আবার কী!’
‘ক্যান কি হইসে?’
‘বাদ দে। তোর প্রেমিকা কেমন আছে?’
‘আর প্রেমিকা! শালা দুনিয়াটাই চইদ্দো নাম্বার।’
‘ক্যান কি হইসে?’
‘আরে শালি পুরা দুই নাম্বার। আমার সাথে প্রেম প্রেম খেলা শুরু কইরা আরও দুই পোলার লগে প্রেম করতেসিলো। ফোনের কল লিস্ট বাইর কইরা ক্যাঁক কইরা ধরসি।’
কথা বলতে বলতে হাসিব ভদ্রলোকের দিকে একটু পর পর তাকাচ্ছে আর আপনমনে মিটিমিটি হাসছে। কি যেন একটা বলতে গিয়েও বললো না পাছে ভদ্রলোক শুনে ফেলেন।
‘কস্ কি মোমিন?’
আমি একটা নতুন উত্তেজনার প্রসঙ্গ খুঁজে পেয়ে সহজ হতে শুরু করেছি।
‘বাদ দাও। তোমার খবর কও চান্দু।’
আমি একটু থেমে হঠাৎ বল্লাম—
‘তুই কি শিঙাড়ার ভিতরে এখনো আলু ঢোকার রহস্য নিয়া ভাবোস?’
‘না, ধুর্!’
‘ক্যান তোর না এতো আদি কার্যকারণ জানার আগ্রহ?’
‘জানসি তো’
‘তাই নাকি? তো কি জানসস্?’
‘জানসি যে এইসব ভুয়া। আলু ছাড়াও শিঙাড়ার ভিতরে অন্য সবজি ঢুকতে পারে এইটা বুঝছি। শালা তোর কথাই ঠিক রে।’
‘কি কস্ ব্যাটা!’ আমি মনে মনে খুশি হয়ে উঠলাম।
এই পর্যায়ে আমি আড়চোখে দেখলাম ভদ্রলোক খাওয়া শেষ করে অন্তরের সাথে কথা বলছেন। কিছুক্ষণ পর হাত ধুতে উঠে গেলেন তিনি।
হাসিব বললো যে কিছুদিন আগে তার সদ্য-প্রাক্তন প্রেমিকাকে নিয়ে সে ‘ড্যাডি’স কিচেন’ -এ খেতে গিয়েছিলো। খাওয়ার এক পর্যায়ে একজন ওয়েটার এসে তাদেরকে বল্লো যে তারা দিন ধরণের শিঙাড়া নিয়ে কাস্টোমারদের মধ্যে একটা ফ্রি সার্ভে করছে। এরপর ওদের দুই জনকে তিনটা করে শিঙাড়া, একটার ভেতর ঝিঙা, একটার ভেতর পেঁপে ও একটার ভিতর করল্লা, ফ্রি টেস্ট করার জন্য দেয়া হলো। সাথে দেয়া হলো একটা মিনি সার্ভে ফর্ম যেখানে এই তিন শিঙাড়ার স্বাদ অনুযায়ী এদেরকে নম্বর দিতে হবে। শুনে আমি কিছু না বুঝে তাকিয়ে থাকি। শালা বলে কী!
আমিও এর মধ্যে ড্যাডি’স কিচেনের নতুন চুক্তির বিষয়টা খুলে বললাম হাসিবকে। শুনে ও বল্লো, ‘ও, এই ব্যাপার! শালারা এই হোটেলের শুধু দুপুরের খাওয়ার কাস্টোমার না বরং সকালের শিঙাড়ার কাস্টোমারগুলানও ধরতে চায়। নিশ্চয়ই পয়সা দিয়া এই বাবুর্চি আর কর্মচারীগুলানরেও হাত কইরা ফালাইসে। ব্যবসা মামা, এরই নাম ব্যবসা! কি করলা জীবনে!’
ভদ্রলোক হাত ধুয়ে ফিরে এসে বিল দিচ্ছেন। একটু পর আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বেরুবার দরজার দিকে এগিয়ে যান তিনি।
ভদ্রলোক শ্রুতি ও দৃষ্টিসীমার বাইরে যেতেই হাসিব বলে—
‘এইবার কও মামা আসল কথা’
‘কি আসল কথা?’
‘এই শাড়ি পড়া চোখ ধাঁধানো সুন্দরীটি কে?’
‘সুন্দরী!! মানে?
‘আহা হা! সুন্দরী কি বুঝে না! তুমি যার লগে এই পাশের টেবিলে বইয়া খাইতেসিলা সেই সুন্দরী… এইমাত্র তোমার দিকে তাকাইয়া মধুর হাসি দিয়া যে বাইর হইয়া গেলো সেই সুন্দরী…কও চান্দু এই রাজকন্যাটা ক্যাঠা।’
‘আচ্ছা লোকটা কি তরে নিজের নাম বলসিলো? নাম শুইনা যদি এ্যাট লিস্ট বুঝা যায় হালায় ব্যাডা না বেডি…’ সে এখনো আশা ছাড়তে রাজি নয়।
‘চোখের কি মাথা খাইসস্? উনি তো রীতিমত একটা পুরুষ মানুষ। সুন্দরী পাইলি কই? আর শাড়িই বা দেখলি কই? ফুল শার্ট আর সানগ্লাস পরা ছিলো।’
এ পর্যায়ে হাসিব দৌড়ে দরজার কাছে যায় ভদ্রলোকটিকে অথবা সুন্দরী মেয়েটিকে আবার দেখে নিয়ে নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা করতে পারার আশায়। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে ততক্ষণে। তাকে আর কোথাও দেখা গেলো না।
আমাদের মধ্যে আরও বেশ কিছুক্ষণ তর্ক-বিতর্ক হয়। কিন্তু কোন সুরাহা না হওয়ায় অন্তরকে ডাকা হলো কেননা তাকে ঐ ব্যক্তির সাথে কথা বলতে দেখা গেছে। কিন্তু অন্তর দেয় সম্পূর্ণ ভিন্ন এক বর্ণনা। তার বর্ণনা শুনে আমাদের মনে ভাঙা চোয়াল, তেল না দেয়া কাঁচা-পাকা চুল, ময়লা শার্ট আর চেক লুঙ্গি পরা একটা লোকের ছবি ফুটে উঠলো। যে দেখতে একদম অন্তরের বাবা’র মতো আর যার চোখে অন্তরের জন্য গাঢ় মমতার ছায়া ছিলো।
আমি এরপর কি বলবো ভেবে পেলাম না। মনে হচ্ছে কোন পারলৌকিক যাদুর ইহলৌকিক দর্শক হয়ে হাবার মত বসে ভাবছি কীভাবে কি হয়ে গেলো।
হঠাৎ হাসিব বলে—
‘আচ্ছা লোকটা কি তরে নিজের নাম বলসিলো? নাম শুইনা যদি এ্যাট লিস্ট বুঝা যায় হালায় ব্যাডা না বেডি…’ সে এখনো আশা ছাড়তে রাজি নয়।
আমি নামটা মনে করার চেষ্টা করি এবং করতে পারি। গলার ভিতরে হঠাৎ-ই একটা শ্বাস আটকে যায় আমার।
‘কীরে! বলসিলো নাম?’
‘হুম।’কিছুক্ষণ থম ধরে বসে থেকে কোনমতে বলি।
‘কি নাম?’
শুকিয়ে চিড়ে হয়ে যাওয়া গলায় ফ্যাসফ্যাসে গলায় কোনরকমে জবাব দিই-
‘সত্য। সত্য চৌধুরী।’