সিনট্যাক্স-ভাঙা শহর ও একজন গল্পওয়ালা । রাজিব মাহমুদ
প্রকাশিত হয়েছে : ১৪ জুন ২০১৮, ১:০৬ পূর্বাহ্ণ, | ১৮১৮ বার পঠিত
রাত প্রায় পোনে বারোটা। কচি ডাবের টাটকা পানির মত ঘাম-বিন্দু ল্যাপ্টানো একটা সাদা শার্ট গায়ে বাসে’র ঠিক মাঝামাঝি’র ডান কোণা’র জানালা সিটে বসে আছে সজীব। গন্তব্য শেষ স্টপেজ। মনের সব ঝালগুলো মুড়ির মতো মুঠোয় পুরে কারো মুখে ছুঁড়ে মারার ইচ্ছে নিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে সে। আজকে অফিসে সজীবের বস অনুপস্থিত একজনের পাওনা ধমকটা উপহার দিয়েছেন সজীবকে। এক প্যাচে পরা শাড়ি’র মতো কায়দা করে ও সূক্ষ্মভাবে তাকে যা বলা হল তার ভেতরের কালি-ঝুলি’র পোড়া শরীরটা এরকম-সজীব দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো মউজ করে ছুটি কাটিয়েছে এবং একেবারে ইচ্ছে করেই ফোন ধরেনি। ফোনটা ধরলে ঐ সহকর্মীটি’র কাছ থেকে মিটিং মিনিটগুলো বুঝে নেয়া যেত আর এটুকু করলে ওর ছুটির মায়েরে বাপ হত না।
বাইরে কানে বাড়ি দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাস ছুটছে ফরফরিয়ে। রাস্তার ডিভাইডারে লাগানো গাছগুলো উল্টোদিকে নুয়ে পড়তে পড়তে আবার সোজা হচ্ছে। একটা নীরব তোলপাড় যেন শুরু হতে যাচ্ছে। এরপর দেখতে না দেখতে কিছু বুঝে ওঠার আগেই জানালার কাঁচে পিন পিন করে তৈরি হতে থাকে কুমারী বৃষ্টির স্বচ্ছ রোগা টিপ।
ঘটাং! পেছনের সিটের ভদ্রলোক নিজের জানালাটি বন্ধ করে সজীবেরটাও বন্ধ করে দিলেন নিজ দায়িত্বে। অন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া দেখাতে দেরি হলেও জানালা বন্ধ করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে ইনারা একটুও দেরি করেন না।
ওপারে হলুদ এনার্জি-আলোর শহর আজকের দিনের মত জাল গোটাচ্ছে- ফুটপাত-লাগোয়া মিষ্টির দোকানে সাজিয়ে রাখা ভেজাল ছানার অসুখী চমচমগুলো ক্রাম ক্রাম শব্দ করে বন্ধ হওয়া শাটারের পেছনে হারিয়ে যাচ্ছে; বড় রাস্তা ঘেঁষে দেশি-বিদেশি সিগারেটের প্যাকেটের ছবিওয়ালা অস্থায়ী পান-সিগারেটের দোকানগুলো ঢাকা পড়ছে শক্ত তেরপলে; ফুটপাথের কোণায় যেখানে মানুষ চলাচল সবচেয়ে বেশি সেখানে বসে থাকা খোঁড়া ফকিরটা বিড় বিড় করতে করতে লাঠি হাতে এগিয়ে যাচ্ছে এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে যাওয়া শহরের সবচেয়ে বড় বিরানির দোকানটার সিঁড়ির দিকে; পাশের ফুলের দোকানটার সাথে লাগোয়া ড্রেনটার সামনে শুয়ে থাকা ঘেয়ো হাড় জিরজিরে পোলকা-ডটেড কুকুরটা ঘাঁউউউ উঁয়য়য় করে আচমকা বৃষ্টির কাণ্ডজ্ঞানহীন ঝরে পড়ার কুকুরীয় প্রতিবাদ জানায়।
বাসটা প্রায় ফাঁকা-ই বলা যায়। যাত্রী সজীব সহ চার-পাঁচ জন এর বেশি হবে না — ওর পেছনের ভদ্রলোক ছাড়া বাকিরা সবাই বাসের ভিন্ন ভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে আছেন। থেকে থেকে হঠাৎ করা ব্রেক-এ বা চাকার সাথে স্পিড-ব্রেকারের সংস্পর্শ-পরবর্তী ঝাঁকুনিতে একটা পাতলা তন্দ্রা’র সর চোখের নিচে জমতে গিয়েও জমছে না। মধ্য রাতের এই ঠাণ্ডা-ভেজা শুনশানতায় যাত্রীদের কারও মধ্যে কথা বলার উৎসাহ দেখা যায় না।
একটা স্টপেজে’র সামনে হালকা ব্রেক করে বাসটা। অপেক্ষমাণ কোন যাত্রী না থাকায় ফের গতি বাড়াতে যেতেই বাসে’র হাতল ধরে পাদানিতে লাফিয়ে ওঠে একজন। মধ্যবয়সী ভগ্ন-স্বাস্থ্যের একজন মানুষ; তেল দেয়া ঘোড়ার লেজের মতো চকচকে চুলের গোছাটা রাবার ব্যান্ড জাতীয় কিছু দিয়ে মাথার পেছনে টেনে বেঁধে রাখা। পরণে একটা কালো ঢোলা ফতুয়া আর চেক লুঙ্গি, গলায় মাঝারি শামুকের মালা আর ঘাড় বেষ্টন করে আছে একটা গ্রামীণ চেক গামছা যেটা ফতুয়া ছাড়িয়ে নেমে গেছে ঊরুসন্ধি বরাবর।
অন্য অনেক সিট ফাঁকা থাকা সত্ত্বেও লোকটা এসে সজীবের পাশেই বসল। মুহূর্তেই হাকিমপুরি জর্দা আর কাঁচা তামাক পাতার তীব্র ঝাঁঝালো একটা গন্ধ উড়ে এল। লোকটা সিটে হেলান দিয়ে বসে চপ চপ শব্দ করে আগে থেকেই মুখে থাকা পানটা চিবাতে থাকে।
হুমকিটা ক্লিয়ার-তাকে ভোট দিয়ে পুনঃনির্বাচিত না করলে এসব অপরাধ চলতেই থাকবে। এই দু’জনের কাছেই আমরা অর্থাৎ ক্রেতারা বা নাগরিকেরা ‘ব্লাডি কনসিউমার’ বা ‘ব্লাডি সিটিজেন’ ছাড়া আর কিছুই না। অর্থাৎ লাভের গুঁড়ের পাশে, সেটা টাকার বা ক্ষমতার যেটারই হোক না কেন, সব মানবিক গুণাবলী সিঁটিয়ে যাওয়া মুড়ির মতো অনাকর্ষণীয়, তুচ্ছ, ও নিতান্তই অপ্রয়োজনীয়!’
রাস্তা মোটামুটি জনশূন্য। বৃষ্টি-ভেজা কালো রাস্তায় কঁকর কঁকর শব্দ তুলে নিজের ভুতুড়ে ছায়াটাকে কাঁপাতে কাঁপাতে বাসটা একসময় শহরের একটা অভিজাত এলাকায় ঢুকে পড়ে। এই এলাকার প্যাগোডা’র মত শান্ত অথচ ভীষণ গম্ভীর বাড়িগুলো তাদের ঘুমন্ত বাসিন্দাদের ভেতরে লুকিয়ে রেখে বিশাল-বপু সামন্ত-ভৃত্যের মতো দাঁড়িয়ে আছে আধা-খেঁচড়া অন্ধকারের ভেতর।
‘বৃষ্টি হলে এই শহরটাকে বিষণ্ণ প্রেমিকার মতো লাগে আমার।’
সজীব কিছু না বলে জানালাটা অল্প খুলে দিল। এটুকু জায়গা পেয়েই সূক্ষ্ম-তীক্ষ্ণ বৃষ্টি-ফোঁটাগুলো ওর চোখে-মুখে ঝাঁপিয়ে পড়ে সূঁচ ফোটাতে শুরু করে দেয়।
লোকটা এবার জিজ্ঞেস করল-
‘আপনার ভালো লাগে এই শহর?’
‘হুম, এই তো।’ সংক্ষেপে বলে সজীব।
‘আমারো লাগত একসময়। কিন্তু আধুনিকতার ভেজাল লাগতে শুরু করার পর থেকেই এই আধা মফস্বল শহরটা আমার স্নায়ুতে চেপে বসতে শুরু করেছে। তবে কিছু পুরনো আবেগ হয়ত রয়ে যায়। যেমন প্রায়ই হাঁটতে বের হলে শহরটার নানা কোণে, গলিতে, দালানের ছায়ায় নিজের শৈশবকে হাঁটতে দেখি, এর পাকা-আম রোদে দেখি জীবনের প্রথম সেই আমপাতা-জোড়া-জোড়া প্রেমকে, আবার এর-ই আশেপাশের অন্ধকারে দেখতে পাই ওঁৎ পেতে থাকা শ্বাপদ। আবার থেকে থেকে বেশ একটা সুরও ভাঁজে আপাতঃ জড় এই শহর-গভীর সুষুপ্তি’র ভেতর বাজতে থাকা টানা স্যাক্সোফোনের মতো করুণ-কোমল লঘু একটা সুর।
অনেকবার চেষ্টা করেও ছেড়ে যেতে পারিনি এই শহর ছেড়ে। আমার নানা মাত্রার ছায়াগুলো টুকরো টুকরো বন্দী হয়ে আছে এর ঘাড়ে-বুকে-নাভিতে। মাঝে মাঝে ছায়াগুলোকে ফেলেই পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। বলতে পারেন সব মিলিয়ে একটা লাভ এন্ড হেইট সম্পর্কে আটকে গেছি এই রাবিশ শহরটার সাথে।’
‘ওকে।’
‘আগে এখানে একটা প্রাণের ঐকতান ছিল। মানুষগুলো এক অন্যের সাথে খুনসুটিতে মেতে থাকত আবার প্রয়োজনে পাশে গিয়েও দাঁড়াত। এখন কারও বিপদ দেখলে সন্দেহের চোখে তাকাতে তাকাতে যে যার যার বাড়িতে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়।’
‘কারণটা কী?’
‘সবকিছুর শুরু মাস ছয়েক আগে ঐ মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানিটা আসার পর।’
‘ওটা আবার কী করল?’ ও যে ঐ কোম্পানিটাতেই কাজ করে সেটা চেপে যায় সজীব।
‘আপনি তো এই শহরেই থাকেন। খেয়াল করেননি কিছু?’
‘যেমন?’
‘ঐ কোম্পানিটা আসার পর মানুষগুলো কেমন যান্ত্রিক আর স্বার্থপর হয়ে উঠতে শুরু করেছে। আগে অফিসগামী মানুষগুলো ছোট ক্যারিয়ারে করে দুপুরের খাবার নিয়ে যেত। ওতে লেগে থাকত গৃহস্থালীর একটা মায়া মায়া গন্ধ। ঐ মাল্টি-ন্যাশনাল আসার পরপরই গজিয়ে উঠলো বাল্বের আলোতে গরম রাখা ফ্রাইড খাবারের ফাস্টফুড দোকান। আর এসব দোকান ক্রেতা-বিক্রেতা’র সম্পর্কের প্যারাডাইমটাই দিল পাল্টে।’
‘কীরকম?’
‘সেদিন যেমন এরকম একটা দোকানের সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় শুনলাম একজন ক্রেতা চিকেনের একটা লেগ পিসের অর্ডার দিতেই দোকানি বেশ ভয় ধরিয়ে দেয়া গলায় বলল যে লেগ পিসে ব্লাড থাকতে পারে। আর তাই ব্রেস্ট পিস নেয়া নিরাপদ কারণ ওটাতে ব্লাড থাকার সম্ভাবনা নেই। এখন চয়েজ কাস্টোমারের- হয় সে ব্রেস্ট পিস অর্ডার করবে অথবা লেগ পিসে’র ব্লাড নিয়ে কোন অভিযোগ করতে পারবে না।
ঐ দোকানির চোখে একজন পাতক রাজনীতিবিদকে দেখতে পেলাম আমি। সে ব্লাডের ভয় দেখিয়ে ক্রেতাকে সাশ্রয়ী লেগ পিসের বদলে দ্বিগুণেরও বেশি দামের ব্রেস্টের পিস ধরিয়ে দিতে চাইছে। ঠিক যেমনিভাবে একজন ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদ তার প্রয়োজনেই বিরোধীদলের হত্যা-খুনের রাজনীতিকে টিকিয়ে রাখতে চায়। হুমকিটা ক্লিয়ার-তাকে ভোট দিয়ে পুনঃনির্বাচিত না করলে এসব অপরাধ চলতেই থাকবে। এই দু’জনের কাছেই আমরা অর্থাৎ ক্রেতারা বা নাগরিকেরা ‘ব্লাডি কনসিউমার’ বা ‘ব্লাডি সিটিজেন’ ছাড়া আর কিছুই না। অর্থাৎ লাভের গুঁড়ের পাশে, সেটা টাকার বা ক্ষমতার যেটারই হোক না কেন, সব মানবিক গুণাবলী সিঁটিয়ে যাওয়া মুড়ির মতো অনাকর্ষণীয়, তুচ্ছ, ও নিতান্তই অপ্রয়োজনীয়!’
‘সময়ের সাথে সাথে তো সব-ই পাল্টায়। পুরনোকে আঁকড়ে ধরে থাকলে তো আর চলে না।’ কিছুটা বিরক্ত হয়েই বলে সজীব।
‘তা পাল্টাক। কিন্তু সেই পাল্টে যাওয়াটা যদি একটা শহরের সিনট্যাক্সটাই ভেঙে দেয়, তবে?’
‘মানে?’
‘একটু পর একটা ঘটনা ঘটবে। তখন বুঝবেন।’
‘মানে? আপনি ভবিষ্যৎ-দ্রষ্টা না-কি?’
এই কথার জবাব না দিয়ে লোকটা বলে যায়, ‘শহরটাকে দেখলেই মনে হয় একটা ডিফর্মড জং ধরা মালগাড়ি ধুঁকতে ধুঁকতে টেনে নিয়ে যাচ্ছে জীবনের পোড়া জঞ্জাল।’
‘কীরকম?’ লোকটার বলার আগ্রহে বাতাস দিতে না চাইলেও অসচেতন ভাবেই নড়ে ওঠে সজীবের ঠোঁট।
“এক সময় বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ইংরেজি শেখাতাম। ভাষা শেখানোর ক্ষেত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো কন্টেক্সট বা প্রেক্ষাপট যেটা ছাড়া ভাষার সিনট্যাক্স বা বাক্য-প্রকরণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে শেখা যায় না। শুধু ছাড়া ছাড়া বাক্য দিয়ে আপনি একটা ভাষা শিখতে বা শেখাতে পারবেন না। বোঝানোর সুবিধার্থে ক্লিশেড একটা উদাহরণ দেই। যেমন ধরুন আপনি ছাত্র-ছাত্রীদের অনুবাদ করতে দিলেন কয়েকটা বাক্য: প্রথম বাক্যটি যদি দেন ‘রবীন্দ্রনাথ একজন বড় কবি’ আর পরের বাক্যটি যদি দেন ‘বাংলাদেশ একটি নদী-মাতৃক দেশ’ তাহলে এই দুই বাক্যের মধ্যে কোন যোগসূত্র থাকে না। আর তাই এরা কোন কন্টেক্সট বা প্রেক্ষাপট তৈরি করে না। আর তাই এক্ষেত্রে দু’টো বাক্যই রবীন্দ্রনাথ বা বাংলাদেশকে নিয়ে হওয়াটা জরুরি। যেমন দ্বিতীয় বাক্যটি হতে পারত, ‘তাকে বিশ্বকবি বলা হয়ে থাকে’। এভাবে তৃতীয় বাক্যটিও প্রথম দু’টি বাক্যের সাথে সম্পর্কিত হতে হবে…এভাবে চতুর্থ…পঞ্চম…”
‘আপনার এই উদাহরণের সাথে এই শহরের কী সম্পর্ক?’
“এই শহরটাও কিন্তু চলছে কনটেক্সট ছাড়াই। যেমন এই বাসটাতেই আপনি দেখবেন পাশাপাশি লেখা আছে, ‘১০০ ও ৫০০ টাকার ভাংতি নাই’ এবং ‘ব্যবহারেই বংশের পরিচয়’। অথচ এই বাক্য দু’টোর মধ্যে কোন সম্পর্ক নেই! ভাংতি না থাকার বিষয়টা আরেকটা সম্পর্কিত বাক্য দিয়ে বাসের একপাশে লেখা থাকতে পারত আর একইভাবে অন্যপাশে বংশ পরিচয়ের বাক্যটাও। এতে করে বোঝা যেত যে যাত্রীদেরকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে তাদের সাথে একটা মিনিংফুল কমিউনিকেশনের চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তা না করে কোনমতে দু’টো সম্পর্কহীন বাক্য দিয়ে শুধু মেসেজটাকে উগরে দেয়া হয়েছে যেটা আসলে আন্তঃমানবিক সম্পর্কের ক্ষয়কেই বোঝায়।”
‘এগুলো তো প্রতিদিনকার বাস্তবতা’রই অংশ।’
‘এগুলোকে আপনার ‘বাস্তবতা’ মনে হয় কারণ এই শহরের ইডিয়মে আপনি অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। আপনি নিশয়ই ভাবছেন এসব ছোটোখাটো ব্যাপার নিয়ে এতো প্যাঁচালের কি আছে, তাই না?
‘হ্যাঁ, কিছুটা সেরকমই ভাবছি।’ বেশ কর্কশ ভাবেই বলে সজীব।
‘দেখুন ছোটোখাটো ব্যাপারগুলো একটু বিশ্লেষণ করলেই কিন্তু বড় বড় অনিয়মগুলোর একটা চেহারা দাঁড় করানো যায়। একটা উদাহরণ দেই —
‘একটু আগে যে খাবারের দোকানগুলো’র উদাহরণ দিলাম ওগুলোতে গেলে দেখবেন কাউন্টারের সামনে লেখা আছে, ‘পে ফার্স্ট।’ অর্থাৎ কেউ খেয়ে উঠে বিল দেবে এটা দোকানি বিশ্বাস করে না। সে ভাবে ক্রেতারা খেয়ে উঠে দাম না দিয়েই কোন একটা অজুহাত দেখিয়ে কেটে পড়ার চেষ্টা করবে। অথচ এই শহরটা আগে এমন ছিল না। ভাতের হোটেলগুলোতে সবাই সবাইকে চিনত আর পয়সা নিয়ে ঝামেলা করার কথা কেউ চিন্তা করত না। ক্রেতা-বিক্রেতা’র সম্পর্কের ভেতরে একটা উষ্ণতা ছিল, বিশ্বাস ছিল। এরকম অবিশ্বাসী ‘পে ফার্স্ট’ ধরণের সাইনবোর্ড লাগানোর চিন্তাটাই ছিল বিব্রতকর।’
‘কিন্তু কেউ পয়সা না দিয়ে কেটে পড়ার ধান্দা তো করতেও পারে।’
অর্ধেক গ্লাস পানিতে কিছুই হলো না সজীবের । মুহূর্তেই আবার গলা শুকিয়ে ফিরে এল কেঠো শুষ্কতাটা। কেবিন ক্রুকে ডাকতে যেয়ে ওর গলা দিয়ে কোন শব্দ বের হল না। পাশের সিটের দিকে তাকিয়ে চমকে ওঠে সজীব — ঠোঁটে একটা ক্রুর কৌতুকের হাসি নিয়ে স্যুট পরে বসে এক মনে বই পড়ে যাচ্ছে গল্পওয়ালা।
‘শহরের ইডিয়মটাই এমন ছিল যে ওভাবে কেউ ভাবতো না। সমাজটাই এমন ছিল যে প্রত্যেকে প্রত্যেকের শ্রমের মূল্য বুঝত। ক্ষুধার্ত কেউ ফ্রি খাবার কথা চিন্তা করত না। কারণ ঐ খাবারটা যে বিক্রি করছে তাকে তো খাবারের সরঞ্জামগুলো কেউ ফ্রিতে দেয়নি। আর ঐ দোকানিও একজন ক্ষুধার্ত মানুষের সামনে ‘পে ফার্স্ট’ ধরণের নির্লজ্জ সাইনবোর্ডটি ঝোলাতে কুণ্ঠাবোধ করত। দুর্বলের জন্য স্পেইস রাখত অপেক্ষাকৃত সবলেরা…দশজন সামর্থ্যবান মানুষের কাছে খাবার বিক্রির লাভের টাকার ছোট একটা অংশ দিয়ে একজন দরিদ্র মানুষকে খাওয়ানোর কথা ভাবতো একজন খাবার-ব্যবসায়ী।’
‘এসব বাড়িয়ে বলছেন। আগেও ভিখিরি ছিল আর ওরা ফ্রি খাবার বা তার বদলে টাকা চাইত।’
‘মানছি। কিন্তু সেই ভিখিরিটাকেও সবাই সমাজের একজন বলেই মনে করত আর তাকে আদর করে বসে খাওয়াত।’
‘এখন এইভাবে তো আর সবসময় সম্ভব না, ভাই। এগুলো ইউটোপিয়ান চিন্তা। মানুষের সভ্যতা’র ইতিহাস কিন্তু একে অন্যকে পিষে সামনে এগনোর ইতিহাস।’
‘কিন্তু এই শহরটা একরকম ইউটোপিয়াই ছিল জানেন! আধুনিক হতে শুরু করার পর থেকেই…’
‘আপনি কী করেন?’-সজীব জিজ্ঞেস করে।
‘বললাম তো একটু আগে যে এক সময় অধ্যাপনা করতাম। এখন গল্প বিক্রি করি।’
‘আপনি লেখক?’
‘না, কথক।’
‘সেটা কীরকম?’
‘লেখকরা গল্প লিখে বিক্রি করে। আর আমি গল্প বলে বিক্রি করি।’
‘মানে?’
‘আমি দুইভাবে চার্জ করি: (১) মিনিট হিসেবে (২) গল্প-প্রতি। শুনবেন না-কি একটা গল্প?’
‘না ভাই, ও সামনের স্টপেজেই নেমে যাব।’
‘নেমে যাবেন? হা হা হা।’
‘এতে হাসির কী হলো?’
গল্পওয়ালা কিছু বলল না উত্তরে।
‘আপনার এই ব্যবসায় কেমন ইনকাম হয়?’ জিজ্ঞেস করে সজীব।
‘ভাল তবে ইনকাম বাড়ার সাথে সাথে কমে যাচ্ছে মনের শান্তি…’
‘কেন?’
‘এখনকার গল্পের শ্রোতারা ভায়োলেন্স পছন্দ করে। বর্ণনার সৌন্দর্য, প্লট ডেভেলপ করার মুনশিয়ানা, চরিত্র চিত্রণের দক্ষতা, সংলাপ ও বর্ণনার সাযুজ্য এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারগুলো এখন তুচ্ছ। ভায়োলেন্সের কড়া মশলা ছাড়া এখন গল্প চলে না। আগে গল্পের ভেতর দিয়ে কিছু মেসেজ দেয়ার চেষ্টা করতাম। তবে এর মানে এই নয় যে গল্পকে আমি সরাসরি নীতিকথা চর্চার বাহন হিসেবে ব্যবহার করতাম। ইন ফ্যাক্ট আমার গল্পগুলোয় একটা প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত থাকতো আর আমি চাইতাম শ্রোতারা সেটা ধরতে পারুক।
তবে সেসব গল্পের বাজার দর এখন শূন্যের কোঠায়। আর এই বাজার দর বাড়াতে গিয়েই আমার গল্পগুলোর গোড়ায় পচনের শুরু। আস্তে আস্তে এই পচন ছড়িয়ে পড়ল এদের পুরো শরীরে। আর এসব কিছুর জন্য দায়ী এই মানবিক ক্ষয়ের শহরটা…’
‘একটু খুলে বলেন।’ কিছুটা আগ্রহ দেখায় সজীব।
‘আমি আমার গল্পের উপাদান সংগ্রহ করি এই শহরের অলি-গলি, রেস্তোরাঁ, দালান-কোঠা, গাড়ি-ঘোড়া আর বারো রকম মানুষগুলো’র তেরো রকম যাপিত জীবন থেকে। একটা উদাহরণ দেই। সেদিন এই শহরের এক নতুন রেস্তোরাঁয় দুপুরের খাবার খেতে ঢুকেছিলাম। আমার সব উদাহরণ ঘুরে-ফিরে খাবারে গিয়ে ঠেকছে। নিশ্চিত জানি না কেন এটা হচ্ছে। তবে হয়ত খাবারের মত পাঁড় মৌলিক একটা প্রসঙ্গ দিয়ে মানুষের আদিমতম সত্ত্বাটার স্বরূপ কিছুটা বোঝা যায় বলে। যাই হোক, খাবারের অর্ডার দিয়ে বসে আছি। তো এই সময় একটা ২৪-২৫ বছরের মেয়ে ঢুকল। খোলা চুল, পরনে সাধারণ সালোয়ার কামিজ, চোখে-মুখে ক্লান্তি ও ক্ষুধার ছাপ। মেয়েটা ঢুকতেই যেন হঠাৎ-ই পাল্টে গেলো রেস্তোরাঁর পরিবেশ।
বেয়ারাগুলোর চলাফেরায় একটা চাঞ্চল্যের ঢেউ আর চাহনিতে একটা চকিত ফিচেল হাসি ফুটে উঠল। তারা একে-অন্যের গা টেপাটেপি করে চোখ দিয়ে মেয়েটার দিকে ইঙ্গিত করে তার মাথার চুল থেকে ঊরু পর্যন্ত চেখে দেখার বিস্কিট দৌড়ে নেমে পড়ল। ভেতরের রান্নাঘর থেকে ভেসে আসা মশলার গন্ধ যেন বেয়ারাগুলোর চোখের লালা’র সাথে মিশে মেয়েটাকেই রান্না করার আয়োজন শুরু করে দিল। মেয়েটার বুক, উরু, পা আস্তে আস্তে বদলে গেলো সিনা, রান, ও পায়ায় আর মেয়েটা পরিণত হলো একটা জীবন্ত মিটশপে।’
‘তারপর?’
‘ইদানিং এই গল্পটা আমি এমনভাবে বলি যাতে শ্রোতা’র কামজ অনুভূতিতে সুড়সুড়ি জাগে। আগে হলে আমি ফোকাস করতাম মেয়েটার অসহায়তা আর পুরো ব্যাপারটার অমানবিকতার ওপর।’
সজীবের হাত-ঘড়ির শান্ত ঘিয়ে-রঙা ছোট কাঁটাটা ১২-এর থুতনিতে পৌঁছে বড় কাঁটাটার নিচে গিয়ে লুকিয়ে পড়ল। এ পর্যায়ে বাসটা আবারো থামল আর কেউ একজন উঠল বাসে। আলো-অন্ধকারে চেহারাটা স্পষ্ট না হলেও একটা মেয়ের অবয়ব বোঝা গেল বেশ। এ ব্যাপারে আরও নিশ্চিত হওয়া গেল আধো-অন্ধকারে বাসের কন্ডাক্টরের ঠোঁটের কাম-পিচ্ছিল হাসির ভেতরে তার হলুদ দাঁতগুলোকে সাদা হয়ে ফুটতে দেখে। এর সাথে সাথে কন্ডাক্টরের সাথে থাকা কিশোর এ্যাসিস্টেন্টটাও মুখ দিয়ে কেমন একটা স্রিত স্রিত লোল টানার মত শব্দ করতে থাকে। ড্রাইভারটিও বা আর একঘরে হয়ে থাকবে কেন? তাই সেও এদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে গলা খাঁকারি দিয়ে ইঙ্গিতপূর্ণ ভাবে কেশে ওঠে। মেয়েটা একদম সামনের সারির জানালা সিটে বসল।
শহরটা তলিয়ে গেছে গভীর ঘুমে। বেশ অনেকক্ষণ পরপর দু’একজন ভবঘুরের এলোমেলো মন্থর হেঁটে যাওয়া ছাড়া চোখে পড়ে টিম টিমে গ্যাসবাতিগুলোর নিচে শুয়ে থাকা ক্লান্ত বিষণ্ন কুকুরগুলোকে; শহরটাকে পাহারা দিয়ে যাচ্ছে যেন। রাস্তার মন্থকূপগুলোতে জমে থাকা বৃষ্টির পানিকে মনে হয় শহরের কালচে রক্ত। সারাদিনের ঘাম-ক্লেদ-রোদের ছোট ছোট গল্পগুলো পিচের নিচে লুকিয়ে রাস্তাগুলো যেন একটু ঘুমাতে চায়। তবে এদিক-ওদিক ভুতুড়ে ছায়ার মত ছুটে যাওয়া যানগুলো সেই ঘুমটুকুকে আসতে দেবে না কিছুতেই।
‘আপনি এখানে বসেছেন কেন?’ হঠাৎ-ই সামনের দিক থেকে তীব্র অভিযোগের সুরে নারীকন্ঠের প্রশ্ন শোনা যায়।
বাসের ভেতরের অন্ধকার আর ডিভাইডারে লাগানো গাছগুলোর ফাঁক গলে আসা নানা নকশার আলোয় একটা ভীতিকর হলুদ অন্ধকার তৈরি হয়েছে। সারি ধরে জোড়ায় জোড়ায় বসে থাকা বাসের সিটগুলোকে শূন্য আর পরিত্যক্ত মনে হচ্ছে। সজীব হঠাৎ-ই খেয়াল করল যে মেয়েটা, ও আর গল্পওয়ালা ছাড়া বাসে আর কোন যাত্রী নেই।
‘বইসি তো কী হইসে? এই সিট কি আপনে কিন্না লইসেন নি?’ মেয়েটার পাশে বসে থাকা কন্ডাক্টর জলীয় কৌতুক আর কেঠো ধমক মেশানো সুরে জানতে চায়।
‘পুরা বাস-ই তো খালি। অন্য সিটে গিয়ে বসেন।’
‘অইন্য সিট খালি দেইখাই তো তুমার পাশে বইসি…একা একা বইতে বালা লাগে না…’ এই ‘মোক্ষম’ জবাবে হর্ষ-ধ্বনি দিয়ে ওঠে বাসের এসিস্ট্যান্ট, কন্ডাক্টর আর ড্রাইভার।
আরও কিছু প্রশ্ন, ধমক, চিৎকার, গালি আর আর্তির টুকরো টুকরো ধ্বনি বাতাস ছিঁড়ে ফেলে একটা দ্রুত-লয়ের খেয়ালের মতো বাজতে থাকে চারপাশে।
‘চলেন তো দেখি। ওরা বোধহয় মেয়েটাকে একা পেয়ে অসভ্যতা করছে। আমাদেরকে খেয়াল করেনি হয়তো। চলেন…’- গল্পওয়ালাকে তাড়া দেয় সজীব।
গল্পওয়ালা নির্বিকার। সে তার ঝোলা থেকে পানের কৌটা বের করে সুপারি-জর্দা সহকারে পানের একটা নতুন খিলি তৈরিতে ব্যস্ত।
‘ইশ্ খয়ের কিনতে ভুলে গেসি…’ বলে চুক চুক শব্দ করে চোখে আফসোস নিয়ে সজীবের দিকে তাকায় সে।
‘ভাই আপনি পরিস্থিতিটা বুঝতেসেন? মেয়েটাকে ওরা…’
গল্পওয়ালা গভীর মনোযোগে পানের ত্রিভুজ খিলির চারপাশের পাতাগুলো ভেঙে ভাঁজ করতে থাকে।
আর থাকতে না পেরে গল্পওয়ালাকে হাত দিয়ে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বেরিয়ে যেতে চায় সজীব। গল্পওয়ালা বল্লো, ‘আরে বসেন বসেন! মেয়েটাকে আগে ভালো করে দেখেন।’
‘মানে?’
‘দেখেন আগে।’
বাসটা তখন সারবেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু সোডিয়াম বাতির সারি পার হচ্ছে। কয়েক সেকেন্ডের জন্য সামনের সিটগুলো আলোকিত হলে মেয়েটার চুল বাঁধার স্টাইলটা খুব চেনা মনে হয় সজীবের। এভাবে লম্বা চকচকে বেণী’র সামনে পড়ে থাকা অগোছালো চুল-চূর্ণ উড়ত কার? গোলাকার মুখের উপর থেকে বুড়ো আঙুল দিয়ে চুল সরিয়ে বার বার ঘাড় কাত করত পৃথিবীতে কেবল একটি মেয়েই।
সজীবের পায়ের ভেতর দিয়ে মাটির তলা থেকে উঠে আসা দ্রিমি দ্রিমি শব্দ যেন ফেটে পড়তে চায় পুরো শরীরে…
‘দীপা! ও তো দীপা’ বলে উঠে দাঁড়িয়ে সামনের সিটের ওপর পা তুলে দিয়ে বেরনোর চেষ্টা করে সজীব।
‘এখন গিয়ে লাভ নেই। যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে।’ গল্পওয়ালা নির্বিকার ভাবে পান মুখে দিয়ে বলে।
‘মানে? ওরা এখনো দীপার সাথে ধস্তাধস্তি করছে…দীপা…এ্যাই শুয়োরের বাচ্চারা…জানে বাঁচতে চাইলে ওকে ছেড়ে দে…’ চিৎকার করে ওঠে সজীব।
একেক জন পালাক্রমে গাড়ি চালাচ্ছে আর বাকি দু’জন দীপার কাছে আসছে।
‘ভাই, আপনি শান্ত হয়ে বসেন। এখন আর কিছু করার নেই। দেরি হয়ে গেছে।’
‘আপনি কি মানুষ? একটা মেয়েকে ওরা এভাবে…।’
গল্পওয়ালা নিষ্ঠুরভাবে হাসে। তার দাঁতের ফাঁকের জর্দা অস্পষ্ট আলোতেও তার সমস্ত কৌৎসিত্য নিয়ে ফুটে ওঠে।
‘আপনি এখন যা দেখছেন সেটা ৬ মাস আগের ঘটনা। মেয়েটাকে গ্যাং-রেপ করে বস্তায় ভরে শহরের বাইরের একটা জঙ্গলে ফেলে দেয়া হয়েছিল। ঘটনা জানাজানি হয় ২ দিন পর। তত দিনে লাশ পচে গন্ধ উঠেছিল।’
দীপা’র চিৎকার ওদিকে বেড়েই চলেছে…‘প্লিজ…আপনাদের পায়ে ধরছি…না…মা…ওমাগো…’
‘আমি আপনি শুধুই ছায়া। আমাদের কোন শরীরী অস্তিত্ব এখানে নেই। বিশ্বাস না হলে আমাকে বা নিজেকে ছুঁতে চেষ্টা করুন। পারবেন না কারণ ছায়াকে ছোঁয়া যায় না।’ সম্পূর্ণ নির্বিকারভাবে বলে গল্পওয়ালা।
‘মটাশ’ করে একটা ঘাড় মটকানোর শব্দ এলো সামনে থেকে। সেই সাথে একটা দীর্ঘ শেষ চিৎকার।
রাতের শহরটা আগের মতই চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে, হাই তোলে, বোর্ড্ হয়; এই চিৎকারে তার নিশ্ছিদ্র ঘুম ফুটো হয়ে যাওয়ায় সে যার পর নাই বিরক্ত।
২
বিমানের ভেতরটা ডিপ ফ্রিজের মতো ঠাণ্ডা। একজন সুন্দরী কেবিন ক্রু সামনে ঝুঁকে সজীবকে জিজ্ঞেস করল —
‘হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট ফর ড্রিংক্স্, স্যার?’
সজীবের জিভটা শুকিয়ে মে মাসের সমুদ্র-সৈকত হয়ে আছে। দীপা’র শেষ চিৎকারটা এখনো টুকরো টুকরো বেজে চলেছে ওর কানের সুড়ঙ্গে। ধাতস্থ হওয়ার চেষ্টা করতে করতে ও বলে-
‘ওয়াটার প্লিজ, প্লেইন ওয়াটার।’
‘শিওর স্যার। হিয়ার ইউ গো।’ ক্রু মেয়েটা একটা স্বচ্ছ প্লাস্টিকের আধা-পূর্ণ গ্লাস এগিয়ে দেয়, মুখে একটা পেশাদার হাসি।
নিঃশব্দে গ্লাসটার দিকে তাকিয়ে থাকে সজীব। গলায় প্রচণ্ড তেষ্টা নিয়েও পানিটা খেতে পারছে না ও। সিটে হেলান দিয়ে মাথার উপরের রিডিং লাইটের দিকে তাকিয়ে এসি’র নীরব গুঞ্জন শুনতে শুনতে দীপা’র মুখটা মনে পড়ল ওর। বেণী করা চুলের ফ্রেমে বসানো গোলাকার মুখ, কপালে চুল-চূর্ণ।
প্রায় সাত বছর আগের প্রথম রিকশায় চড়ার দিনটার কথা মনে পড়ে গেল সজীবের । ঐদিন সকাল থেকে ঝোড়ো বাতাস আর বড়-ফোঁটার বৃষ্টি ওদের শহরে। এস এস সি’র আগে একই স্যারের কাছে অংক প্রাইভেট পড়ার সুবাদে দু’একবার চোখাচোখি হলেও তখনো কথা হয়নি ওদের। এরপর নাটক-সিনেমার মতো ঐ দিনটাতে পর্যাপ্ত রিকশা’র অভাবে একই রিকশায় চড়তে হয়েছিল ওদের।
এরপর দু’জন মফস্বলীয় কিশোর-কিশোরীর জীবনে যা হওয়ার কথা তা-ই হয়েছিল —
সে এক ঘুঙুর-নূপুর সময়। রান্নাঘরের এঁটো বাসনের পরিচিত টুং টাং বা বড় রাস্তার যানজটে থেমে থাকা কুৎসিত হলুদ ট্রাকটার শব্দ করে শ্বাস নেয়া- কানের কাছে বাজা সব আওয়াজ-ই যেন সরস্বতী নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তদারক করতেন-একটা স্বরগ্রামও যেন কোথাও ছিঁড়ে না যায়।
পুরো সময়টা সজীবের স্মৃতিতে একটা দামি তেলরঙের মাল্টিকালার ছবি — মাঠে-ঘাটে-রাস্তায়-রিকশায় দু’জনের দাঁতের নিচে কড় কড় করে গুঁড়ো হতো চিনা-বাদাম বা পোড়া ভুট্টা, টাটকা মাছের ঝোলের মতো মনের কোণে জড়ো হতো ঈষদুষ্ণ অভিমান, নতুন কাঁচা মরিচের মত একে অন্যকে করা তীক্ষ্ণ ঝাল-ঝাঁজের তিরস্কার, তৃতীয় কাউকে সন্দেহ করে ঈর্ষা, বিশ্রী কুযুক্তির ঝগড়া আর এর পর সপ্তাহের বেশি সময় ধরে গুম হয়ে থাকা, ও ‘তুমি এই কথাটা বলতে পারলা’-জাতীয় এবার-সুতোটা-ছিঁড়েই-গেল-বুঝি ধরণের তীব্র লাল-বাতি জ্বলা গোপন ভয়।
এভাবে একটা ঝাল-মিষ্টি-তেতো সময়ের ফুটকির ভেতর কেটে গেল দীর্ঘ সাত বছর।
ওদের শহরটারই একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রীটা একসাথে শেষ করে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিল ওরা। সজীবের রেজাল্ট ভালো হলেও চট করে শহর ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্তে ও নিজের কাছে সায় পেল না। কো-ইন্সিডেন্টালি ওদের শহরে তখন একটা মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানি তাদের অফিস খুলেছে; সেখানে বেশ ভালো বেতনে অনেক সুযোগ-সুবিধা সহ একটা চাকরি হয়ে গেল সজীবের।
ওদিকে দীপা রাজধানীর সেরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটা ডিপ্লোমা কোর্স করতে চাইল। সপ্তাহের তিন দিন বিকেলে শুরু হয়ে সন্ধ্যায় শেষ হতো ওর ক্লাস। রাজধানী’র ঐ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ওদের শহরের দূরত্ব ছিল দুঘণ্টা। ক্লাস শেষ হলে বাড়ি ফিরে আসত দীপা।
৬ মাস আগের সেই রাতটা ছিল স্বাধীনতা দিবসের রাত। পরের দিন ছুটি থাকায় রাস্তায় ছিল বাড়িমুখো মানুষের প্রচণ্ড ভিড়। দীপা ক্লাস শেষ করে বাসে উঠেই বিশাল জ্যামে পড়ে গেল। ওদের শহরের দশ কিলোমিটারের মধ্যে আসতে আসতে ঘড়ির কাঁটা বারোটা ছুঁই ছুঁই। দীপা ছাড়া বাসের শেষ যাত্রীটা নেমে যায়। আর এর পরপরই বাসের ড্রাইভার, এ্যাসিস্টেন্ট আর কন্ডাকটারের চোখের ও শরীরের ভাষা বদলে যেতে থাকে।
টেলিভিশনে তখন রাজধানীর শহীদ মিনারে প্রধানমন্ত্রীর পুষ্পস্তবক অর্পণের প্রস্তুতি দেখানো হচ্ছিলো। দীপা-সজীবদের মফস্বল শহরটার প্রধান শহীদ মিনারেও পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন জেলা প্রশাসক। তাকে নিয়ে স্বাধীনতা দিবসের মূল র্যালিটা পৌঁছে গিয়েছিল শহীদ মিনারে। তখন শুধু পৌরসভার ঘড়িতে ঢং ঢং করে বারোটা বাজার অপেক্ষা। বাতাসে উৎসবের বারুদ, কর্মজীবী মানুষগুলো’র মনে তখন মধুর আলস্য-কল্পনায় পরের দিনের ছুটির সকালের নাস্তার টেবিলের ছবি-গরম পরোটা-ভাজি, ধোঁয়া-ওঠা নেহারি আর ঘন কন্ডেন্সড মিল্কের চা।
বাসের মধ্যেও উৎসব চলছিল তখন। একটা মেয়েলী কণ্ঠের গলা-ছেঁড়া চিৎকার, তাকে ঘিরে ধরা উল্লসিত কুকুরগুলোর ঘাড়ে হাতে চকচকে সর্ষের তেলের মতো ঘাম। সব শব্দকে ডুবিয়ে দিতে বাসের সিডি প্লেয়ারটা বাজছিল চিৎকার করে।
স্বাধীনতা দিবসের উৎসব মুখরতা থেকে বাসটা তখন মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে।
দীপা’র বস্তাবন্দী লাশ পাওয়া গেলো ২ দিন পরে ওদের শহর থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরে একটা ঘন আশ শ্যাওড়া’র ঝোপের ভেতর। খবরটা কাগজে বেরোনোর পর কয়েক ঘণ্টার জন্য থমকে যায় শহরটা। এরপর নানা প্রাজ্ঞ অভিমত বা প্রতিক্রিয়া শোনা যেতে থাকে, যেমন —
‘এমন ধিঙ্গি মেয়ে’র রাতের বেলা একা একা আসার দরকারটা কী ছিল?’
বা
‘মেয়েটার কাপড়-চোপড়ে আগে থেকেই একটা দেখানো দেখানো ভাব’
বা
‘আরে মেয়ে মানুষের এতো পড়ালেখার দরকারটা কী? যতসব ঢং…’
শহরে আসা মাল্টি-ন্যাশনাল শহরটার বাইরের চেহারায় যতো পরিবর্তনই আনুক না কেন-এর অধিবাসীদের মনের আদি ও অকৃত্রিম দৃষ্টিভঙ্গিতে চিড় ধরাতে পারে নি একটুও।
এরপর শুরু হয় থানা-পুলিশ, পোস্টমর্টেম, উকিল, মামলা, সাক্ষী, বাদী-বিবাদী, হাজিরা ইত্যাদি। এই একেকটি পর্বের সাথে সাথে অমানুষিক স্মৃতি-কাতরতার নির্দয় ভ্রমণটুকু করতে করতে একসময় ক্লান্ত হয়ে উঠল সজীব। শহরটা’র মানুষগুলোর মিলিত কণ্ঠস্বরে এক সময় গলা মিলিয়ে ও-ও ভাবতে শুরু করল যে দীপা’র পোশাক আর উচ্চাকাঙ্ক্ষাই ওর এই পরিণতির জন্য দায়ী। মুরুব্বীরা পরামর্শ দিলেন, ‘তুমি এসবের মধ্যে থেকো না। গোটা জীবনটাই তো পড়ে আছে তোমার। চলে যাও এখান থেকে। নিজের জীবনটা গড়ে নাও।’
দীপা’র কবরের পাশে প্রতিদিন ভোরে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে সজীব বুঝে উঠল যে দীপা সত্যিই অতীত হয়ে গেছে। ওর ভালোবাসা বা দুঃখবোধ কোন কিছুই দীপাকে আর কখনো স্পর্শ করবেনা। যে অনুভূতি কাউকে স্পর্শ করার ক্ষমতা হারিয়েছে তার জন্য অনাগত একটা টাটকা জীবনকে দূরে ঠেলে রাখাকে একটা জীবনের দুর্দান্ত অপচয় ছাড়া আর কিছু না। দীপা’র খুনি ও ধর্ষকদের ছবি পত্রিকায় দেখে সজীব দিনের পর দিন অসহ্য যন্ত্রণায় ক্ষত-বিক্ষত হলো ঠিক-ই কিন্তু আস্তে আস্তে সেসব অনুভূতি একদিন নিস্তেজ হয়ে পড়ল -ওর সামনে ভবিষ্যতের ঝাঁ চকচকে ট্রেন স্টেশন ছাড়ি ছাড়ি করছে।
সজীব সিদ্ধান্ত নিলো এসব থেকে মুক্তি দেবে নিজেকে — শুধু এই শহর নয়, এই দেশ ছেড়ে চলে যাবো। শুরু হলো জি আর ই, টোফেল নিয়ে যুদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্রের একটা বিশ্ববিদ্যালয় ওকে পূর্ণ বৃত্তি দিয়ে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে তাদের ছাত্র করে নিতে রাজি হয়ে গেলো।
অর্ধেক গ্লাস পানিতে কিছুই হলো না সজীবের । মুহূর্তেই আবার গলা শুকিয়ে ফিরে এল কেঠো শুষ্কতাটা। কেবিন ক্রুকে ডাকতে যেয়ে ওর গলা দিয়ে কোন শব্দ বের হল না। পাশের সিটের দিকে তাকিয়ে চমকে ওঠে সজীব — ঠোঁটে একটা ক্রুর কৌতুকের হাসি নিয়ে স্যুট পরে বসে এক মনে বই পড়ে যাচ্ছে গল্পওয়ালা।
হঠাৎ-ই ওর মনে হলো ওর বিমানের বহু নিচ থেকে আঁকা-বাঁকা বৃষ্টি-ভেজা রাস্তা, সারবাঁধা গ্যাসল্যাম্প, ডিভাইডার, মন্থকূপ, মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানি’র অফিস, বাতি জ্বালিয়ে খাবার গরম রাখা রেস্তোরাঁ, ওর বিশ্ববিদ্যালয়, শহীদ মিনার, আশ শ্যাওড়া’র ঝোপ পেরিয়ে তীরের বেগে একটা উড়ন্ত সাপের মতো ওর দিকে ছুটে আসছে ওর পালিয়ে আসা শহরের গভীর সুষুপ্তি’র ভেতর বাজতে থাকা টানা স্যাক্সোফোনের মতো সেই করুণ-কোমল লঘু সুর-ওর গলাটা শক্ত করে পেঁচিয়ে ধরবে বলে।