এক গুচ্ছ কবিতা । মাজুল হাসান
প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ জুন ২০১৭, ১২:১০ অপরাহ্ণ, | ২২২২ বার পঠিত
ঝরে পড়া পুংকেশরগুলো
কি হবে যখন জানবেন, আপনার পায়ের জুতা দাবি করেছে ওই আপনাকে ওর পৌনে নয় ইঞ্চি খোপে থাকাতে দিয়েছে এতোদিন। আর আপনি দেখলেন চিরচেনা রাস্তাটাও এক জোড়া টায়ারের চপ্পল পরে কোথাও পালিয়েছে। ভগ্ন মনরথে আপনি একটা গাছের দিকে তাকালেন। দেখলেন সবুজ, পাখি, উড়াল। কিন্তু ওরা আপনাকে বলল, আপনি যা দেখেছেন ভুল দেখেছেন। চোখ আপনার, কিন্তু সবুজ উড়াল দেখার অধিকার আপনার নেই। ওরা আপনার চোখের মণি দুটো নিয়ে লোফালুফি করতে করতে জানালো—আপনার অধিকৃত নারী চোখের মালা পরতে ভালোবাসেন। কিন্তু আপনি নিজের মনকেও বিশ্বাস করতে পারছেন না। আপনার মন বলছে ভালোবাসার রঙ সবুজ। কিন্তু আপনি দেখছেন কালো—
২
জনৈকা মলিনতাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি টিটিপাড়ার ত্রিবেণী জংশনে। খিতিশপাখির মতো, খিতিশপাখির ডাকের মতো— অধিবাস্তব। অতএব দূর হও হে অ্যাম্বুলেন্স। অঙ্কের জাহাজে চড়ে ফিরে গেছে সত্যযুগের কেরানি। রবীন্দ্রবিদ্বেষ ও কাদম্বিনীর স্যুসাইট নোটের প্রসঙ্গ অন্যদিন হবে। এখন একাএকা দু’কানে এয়ারফোন ঠুসে একই সাথে বিটোফেন ও চিত্রাঙ্গদা শোনা। অতএব সত্বর দূর হও হে অ্যাম্বুলেন্স। গলাগলি থাকতে দাও প্রলম্বিত হেমন্ত, পান কর, একাগ্র ধ্যানীসুঁচে সিলগালা হোক গ্যালাক্সি, রোহিনী, ছায়াপথ। এই সেই আধোভৌত মোড় এবং ৩ বছর ২১ দিন—পূর্ব অপরাহ্ন। অথচ কতো ঝাপসা হাত-পা, ছিন্ন ধড়-কান্নাগ্রন্থি। চেনা ফতুয়ার মতো চলে যাচ্ছে ৮ নম্বর কর্নওয়ালিশের লোকাল। জনৈকা মলিনতা— রক্ত ছাড়া ঘোরে না কোনো চাকা, না পূর্ব অপরাহ্ন, না অন্ধকার, না বিষাক্ত বিছার মতো দয়ালু সূর্য—
৩
সিড়িঘর দেখছি, দেখছি সিড়িঘর থেকে, ইসকন মন্দিরের দীঘি অবরোহন করে পাতাল হতে পদ্ম তুলে আনছে কিশোর। পদ্ম একটি খোলারহস্য, ততোধিক গুপ্ত সন্তরন। ওদের স্কুলে বেটাছেলেদের ঢুকতে বারণ। ব্যতিক্রম শুধু হংসশিশু। কী তুলতুলে, থাপুসথুপুসগুলো! হংসমাতার পিঠে চেপে ওরা পদ্মের গোসলখানাতেও ঢুকে পড়তে পারে। সেদিন, দুপুরবেলা গোড়ালিতে কী সুন্দর সোনার ডিম—
৫
প্রখর রোদে কিশোর নিজেই একটা স্বপ্ন। উল্টো পা’য়ে আসো লাল। তবে সাবধান, কামভরে তাকিও না রূপসী ডবল ডেকারদের দিকে। বরং ততোক্ষণে সান্দ্র খুঁড়ে বের করো হল্কা, কেটে ফ্যালো লতানো গোলাপের আদিশেকড়। থোকা থোকা চোখ ফুটেছে রাস্তায়—মার্বেল ফুসফুস, জগ্যডুমুর, নাটকপাড়া। এতো যে দৌড়ঝাপ—তৃষ্ণা জাগিয়ে অগভীর কুয়োর কাছে খঞ্জনা ও মেঘস্খলন প্রার্থনা, তবু ছায়াকাটা হাড়। নত হও কিশোর, নত হও হেটমুণ্ডে, সমবয়সী খালাদের উপহার দাও কচুরিপানা, শুধু কাস্পিয়ান ভেবে লোডশেডিংয়ের রাতে ডুব দিও না কুঁচকিতে। ওখানে বন্ধ ঘড়ি, গোধূম সায়াহ্ন, চিরকালীন—
৬
রাত্রি পরিশুদ্ধ। অন্ধকারের খিড়কি-কুলিঙ্গ নাহি। অনুপস্থিত তদ্রূপ দিগন্ত রেখা। অখণ্ড। সান্ত্বনা ও গূঢ়কামনার থেকে দূরে, লাইটহাউজ কতো নিঃসঙ্গ! বেজে ওঠে মৌন। হেথায় বর্ণহীন অন্ধ জ্যোছনা। অতএব রেচনমুখি। চলো পুলক পাই, অদ্য…
৭
একটা সময় আসবে যখন ফিলামেন্ট ঠেসে যাওয়া ২৬ ওয়াটের বাল্বের মধ্যে কার্যত কোনো তফাৎ থাকবে না। অর্থাৎ অগ্নিবিচ্ছুরক কোনো গোলাপই থাকবে না তখন, না কোনো পেন্ডোরাবক্স। তবু সার-সার কুশন, টরের হালকা পর্দায় ভেসে উঠবে বনস্থালী। আর তেমনটা হবে কোনো এক রাত দু’টা সতের মিনিট ছয় সেকেন্ডে। সকাল আসবে। সুহৃদ, আফিমখোর পায়রাগুলোতে ঠিকঠাক চাবি দিয়ে নিন—
৮
এই রাত নগরীর মুখচ্ছবি। শঙ্কিত কপর্দকহীনের হুহু উল্লাস। কোথাও কোনো গৈরিখ নেই, পাখি নেই ঝলমলিয়ায়; শুধু বিকল ঘড়ি—ফুর্তিবাজ নারী যিনি ঝলসানোটা পছন্দ করেন আর আমার টোটা বন্দুক। ঠা ঠা। গুলি করলে বেরিয়ে আসবে—কোমল; পানকোয়ার পালক…
৯
আমার লাপাত্তা থাকা নিয়ে বৌমনি স্ট্যাটাসে কোনো ‘নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি’ দেয়নি। এখন কোনো স্বহৃদয়বান/বতী কি আছেন, যিনি আমাকে বাড়ি পৌঁছে দেবেন? বাড়িটার সামনে কাঁটাঅলা পদ্মঝিল ও পার্কিংলটে একটা বিরলপ্রজ পেন্ডা আছে। ঠিকানা বলতে এইটুকুই। কেউ আছেন? পুংকেশরের মতো ভেঙে পড়ছে ছায়া। আর আবছা আলোয় সমকামী দেবদারুটার নিয়তও ভালো ঠেকছে না—
১০
কার্তিক—আমার অফিসের কেরানি। কোনো কাজের না। সেদিন এক প্যাকেট ব্যানসন আনতে বললাম আর নিয়ে আসলো একবাক্স হতাশা। ভাবছি ওটাকে খেদাতে হবে। আসি-আসি করে বসন্ত ছেলেটাও আসছে না। ওর খোঁজে হেয়ারব্যান্ডের মতো উড়ালসেতু পর্যন্ত ঘুরেঘুরে হয়রান। জানা গেলো, এইসব বহুবিধ লুপঅলা উড়ালসেতু আশলে বয়ঃসন্ধির নিষ্পাপ কিশোরী। ওর দেহের প্রতিটি সড়কে যেসব লাশ পাওয়া যায় তাদের সবার নাম-ই হেমন্ত; বাড়ি হেমন্তনগর। গতরাতে হেমন্তের উন্মাদ মা স্বপ্নে আমাকে অভিশাপ দিয়েছে—আসছে শস্যমৌসুমে আমি যাতে একটা ফাঁকা করিডোর হয়ে যাই। হুহু করে শীত আসবে আর বসের দরজার বাইরে কেঁপে উঠব শীৎকারে। আর আমাকে রপ্ত করতে হবে পাখির শিস নকল করে বজরায় সংকেত পাঠানোর কৌশল।
১১
যানজট মন্দ জিনিস নয়, রিক্সায় বসে এই সময়টা ভাববার জন্য উত্তম। শূন্য পত্রালী ও বিবিধ দৌড়বিদও এই সময় বানান করে লিখতে শেখে ‘একা’। এই সময়টাতে সে জনাকীর্ণ নৈঃশব্দ ব্যাপারটা উপলব্ধি করতে শুরু করে। হঠাৎ গাড়ি চলতে শুরু করলে সে দম ছেড়ে বাঁচে; কিন্তু বিযুক্ত ও খণ্ডিত হয়।
মরলে আমার খণ্ডিত দেহটাকে তোমরা সমাহিত করো চাকাযুক্ত কবরে। তাতে কী-লাভ হবে সেটা এখনই বলতে পারছি না। সামনে জটলা। আশা করছি তখন এতদসম্পর্কিত বিষয়ে ভাবনার অবকাশ পাওয়া যাবে—