মাজুল হাসানের ইরাশা ভাষার জলমুক থেকে ৭টি কবিতা
প্রকাশিত হয়েছে : ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, ৯:০১ পূর্বাহ্ণ, | ২৫৭৭ বার পঠিত
কবিতায় কোনো চূড়ান্ত রঙ নেই, তাই হাজারো রঙে আঁকা যায় তার শরীর ও জলমুক। বাতাসের বাইনোকুলার বই দিয়ে মাজুল হাসান যে সুরভি ছড়িয়েছিলেন পাঠকের মননে, তার রেশ এখনো কাটেনি। ‘অদ্য মেঘজন্ম। এখন আমার কোটরসহ মণির রঙ অগ্নিপাটল / সমস্ত চিত্ত-সবুজ ও হরিৎ-সবুজ নিয়ে / আমার প্রেমিকারা পাড়ি জমিয়েছে সুদূর হাইওয়ের দিকে…’ এমনই কিছু কবিতা নিয়ে এবারের বই মেলায় আমাদের কবি ও গল্পকার মাজুলের ৩য় কাব্যগ্রন্থ ‘ইরাশা ভাষার জলমুক’ ফের পাঠকের মুখোমুখি হচ্ছেন, এর কয়েকটি কবিতা পড়ে ভাষার কতো-কতো রঙ দেয়া যায় তা জানা হবে পাঠকের। বইটি প্রকাশ করছে চৈতন্য প্রকাশনী। প্রচ্ছদ ও কবিতা অবলম্বনে ড্রইং করেছেন রাজীব দত্ত। রাশপ্রিন্ট
মাজুল হাসানের ইরাশা ভাষার জলমুক থেকে ৭টি কবিতা
মার্থা গঞ্জালেস
মাহিদা ফেরদৌস ঋণীকে প্রথম যেদিন মার্থা গঞ্জালেস বলে ডেকেছিলাম—সেদিনই কুড়িয়ে পেয়েছিলাম
একটা মাউথঅর্গান। মৃদঙ্গ নয়, সমীরছিদ্র বক্রবংশী নয়, মৃদু কিংবা ত্রিকালকম্পী রাজশঙ্খও নয়।
একটা একতারাও তো হতে পারতো। কিন্তু সব থুয়ে ক্যানো মাউথঅর্গান?
ভেবেছি, আর সকালটা অপেক্ষা করেছে হলুদ কার্ডিগানের, বিকেল পালিয়েছে কেতকীদের গোধূলি দালানে
আর ছুমন্তর বলে সন্ধ্যা হয়েছে আফিম-নিস্তব্ধ। ঋণীকে বলা হয়নি কোনোদিন—মার্থা গঞ্জালেস এক
অনিন্দলাস্য ও ফুটোন্মুখ গোলাপের নাম। শ্বেতশুভ্র মেষ চরে বেড়ানো ককেশীয় পর্বতরাজি নয়তো ল্যাতিন
অরণ্যের কোনো নিভৃত নিদ্রাটিলায় ওর জন্ম। অথবা কোথাও এই নামে কোনো ফুল নেই।
খুব করে মনে হয়—রাগ ইমন আর ঋণীদের কোনার ঘরটার একটা যোগসূত্র আছে। রোজ রাতে গানের
মাস্টার আসে। কী মলিন জামা! অথচ ফেরার পথ কী হীরকদ্যুতিময়! রোজরোজ অমন ঝকঝকে ঈর্ষা
দেখে অন্ধ হবার জোগাড়। সেই কবে নক্ষত্রবাগান তছনছ করে গেছে পাগলা হাতি। বিধ্বস্ত তারা ছড়িয়ে
পড়েছে চতুর্দিক, একান্ত গোপনে কাঠবাদামের অন্তরেও হয়েছে লহু-লুব্ধক ক্ষরণ। সেই সমুদ্দুর অবশ্য
পেরিয়ে গেছি পাগলা হাতির পিঠে চেপেই। গেছি ককেশীয় পর্বতরাজিতে, নয়তো ল্যাতিন অরণ্যের
নিভৃত নিদ্রাটিলায়। (অথবা যাইনি)।
রাজশঙ্খের মতো মৃদুস্বরে ডেকেছি—মার্থা গঞ্জালেস, মার্থা—ও ম্যারি! কী আশ্চর্য, মাউথঅর্গান কিংবা
চার্চ মিউজিক নয়, ঠিক তখনই ভেসে এসেছে রাগ ভৈরবী।
মনার্ক
সাড়ে ৩ হাজার মাইল দূর থেকে উষ্ণ মেঘমালা এনেছিল মনার্ক প্রজাপতি
আমরা হিমার্দ্র প্রেমিক-প্রেমিকা—চিৎ হয়ে শুয়েছিলাম জীবন্ত রামধনু মাঠে
পৃথিবীর শেষ প্রাকৃত গানটি আমাদের ভীষণভাবে কামাতুর করেছিল
তীব্র ক্ষুধায় আমি কামড়ে দিয়েছিলাম মাই(ন)
আর প্রেমিকা গিলে খেয়েছিল সোনারঙ দুপুর
বস্তুতপক্ষে আমরা সাবাড় করেছিলাম হাত-পা-লিঙ্গ-স্তন; রাজপোশাক
এভাবেই পুরনো শূককীট থেকে জন্ম নেয় নব-নবতর মনার্ক প্রজাপতি
এখন পূর্বজন্মের শাদাকালো বাড়িতে ফিরতে হলে
আমাদের সাঁতরাতে হবে আরেকটি রামধনু, আরেকটি প্রাকৃত গান
আর সাড়ে ৩ হাজার পবনসমুদ্র
অধিকাংশ মনার্ক প্রজাপতি সেটা পারে না…
ব্যালকনি
ব্যালকনি থেকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে হরিদাস লেনের বেলিদের বাড়িটা
ওর ৩৪ ডিগ্রি ডানে চিত্রা নামের বর্ণালি বি-ক্যাটাগরির নাতিউজ্জ্বল তারা
এইমাত্র চোখ টিপলো। ওটাকে শিরিষপাতার জামা পরিয়ে
বেলিরা অন্যপাড়ায় চলে গেছে—সেও প্রায় ৩ লিপ-ইয়ার হলো
এখনো কতো টাটকা গৌতমবুদ্ধের দেশান্তরী হবার গল্প
অদূরে বাতিঘর। মেরুবিচ্ছুরণ ঠোঁট
অপেক্ষা করছে সমুদ্রঘুঘুরা
সামনের ত্রিশ ফিট সড়কটাকেও পোতাশ্রয়ের মতো দেখাচ্ছে
রিকশা। প্রচণ্ড জ্যাম।
ট্রাফিক বলল—শহুরে রাজহাঁসের মর্যাদা না দিলে
এইসব ত্রিচক্রযান আপনাকে কিছুতেই গভীর সমুদ্রে যেতে দেবে না…
হাইওয়ে
গেন্ডারি ক্ষেতে প্রেমিকাকে দলাই-মলাই করে আমি বায়ুশলাকায়
উৎপন্ন করেছিলাম ভ্রমরগুঞ্জরন। ঘুরঘুর হাওয়াকলে
ঘুরেছিল বিজলিখেলা একদিন শহর-উপকণ্ঠে।
এরপর নৈনিতাল। একটা মাদি ভেড়ার উলেল স্তন শুঁকে
বিনয় খুঁজে পেয়েছিল ঈশ্বরের বিশ্বাস। অথচ তার রৌদ্রজন্ম হয়েও
মনে ছিল লিঙ্গের পুনরুত্থান, জয়নিশানা উড়াব বলে
অন্য প্রেমিকাদেরও বারবার নিয়ে গেছি অরণ্যশৃঙ্গে
যখনই জয়নিশানা ওড়ানোর প্রয়োজন পড়েছে। ছুঁয়ে দেখেছি
চিত্ত-সবুজ এবং হরিৎ-সবুজ দু’বোনকে পাশাপাশি ফেলে
আঙুলে গেঁথে, শোষকাগজের মতো চেয়েছি চোখে জীবন ঘষে নিতে
অদ্য মেঘজন্ম। এখন আমার কোটরসহ মণির রঙ অগ্নিপাটল
সমস্ত চিত্ত-সবুজ ও হরিৎ-সবুজ নিয়ে
আমার প্রেমিকারা পাড়ি জমিয়েছে সুদূর হাইওয়ের দিকে…
ইউটার্ন
হেডলাইটের আলোতে হাইওয়ের আত্মা পড়ছি ভৃগু
বলেছি তো—বৃষ্টির নাম নাছোড়বান্দা। অথবা ডেডএন্ড।
ওকে তুলে নিয়েছি লোহারপুলের কাছের রেলক্রসিং থেকে
পেছনের সিটে বসে বসে শুধু ঘামছি এমত তপ্ত হাওয়ায়
দেখছি রেইনট্রির সারি, নদীর কোমরে ঢুকে যাচ্ছে লঞ্চ
একবার খুলছি আরবার লাগাচ্ছি ফাউন্টেন পেনের ঢাকনা
কাছেই সত্যের মতো নীল পোড়াচ্ছে জমাট অন্ধকার
মেয়েটির চোখ, নাকি গলে যাচ্ছি আমি—বুঝতে পারছি না
নিরালা মোড়ে ইউটার্ন নাও ড্রাইভার। বহুদূর দহগ্রাম…
পাঠশালা
লোকে বলে, ওটা ঈশ্বরের বাড়ি, যিনি ঘুঙুর কি
মোটরদানা থেকে সৃষ্টি করেছিলেন আপেল-পৃথিবী
জমিনে সেঁটে দিয়েছিলেন পাহাড়, স্তনকামনা—
. পিপাসা খররৌদ্রের
অতএব আমাকে যেতে হয়েছিল প্রমিত উপাসনালয়ে
বাঁধানো খিলানের কাছে
সেখান থেকে ফিরে এসেছিলাম কতগুলো উভলিঙ্গ হুর
আর তাম্বূল ঐশীবাণী নিয়ে
বস্তুতপক্ষে উপাসনালয় থেকে ফিরে এসেছিলাম
রংজ্বলা ছাতা মাথায়—বৃদ্ধ
অথচ জলসাঘরে আমি যৌবনপ্রাপ্ত হয়েছিলাম…
মহল্লা
বনমানুষই কাঠুরিয়াকে বসিয়েছিল বনজ মসনদে
তারপর গাছখুন আর বনমানুষের রোমশ চামড়া পরে
তিনি হয়ে ওঠেন অরণ্য-অধিরাজ
বিজ্ঞ মুকুটে শোভা বাড়ায় বনটিয়ার উজ্জ্বল পালক
এখন পুরো বনে শুধু একজনই বনমানুষ; সবুজ রক্ষক
বাকিরা সবাই একদার বনমানুষের মলিন কঙ্কাল
ওদের সঙ্গ দেয় উধাও-সবুজ; বনটিয়ার গলাকাটা গান…