খানসাহেবের খণ্ডজীবন :: পর্ব ১২ । সিরাজুদ দাহার খান
প্রকাশিত হয়েছে : ০৬ এপ্রিল ২০১৭, ১২:৪৬ পূর্বাহ্ণ, | ১৯১৪ বার পঠিত
সাপের খেল ও দৃষ্টিমিলন :: কিস্তি-৪
জীবিকার ধান্ধায় হাতিয়া গমন
আগের পর্বে হায়দারের ভীতসন্ত্রস্ত সাপের খেল-এর কথা আপনাদের মনে আছে নিশ্চয়! আক্কাস মিয়ার দেয়া একগ্লাস পানি ঢকঢক করে এক চুমুকে গলধকরণ করে নাটকের বাকি অংশ সাবলীলভাবে সম্পন্ন করে সে। করতালিতে মুখরিত হয়ে পড়ে পুরো ক্যাম্পাস। তার সহপাঠিরা তাকে প্রশংসায় ভাসিয়ে, করমর্দন করে; কেউ কেউ বুকে জড়িয়ে ধরে। এরপর সে বীরদর্পে অভিনয় চত্বর থেকে বেরিয়ে আসে। বাদশা তাকে আলিঙ্গনাবদ্ধ করে। দু’জনের চোখেই জল চলে আসে বিজয়সাফল্যে আর হায়দারের তাৎক্ষণিক বুদ্ধিমত্তা দেখে!
বেশ কিছুদিন পরের কথা। নানা কেচ্ছা-কাহিনি করে বিবাহকার্য সম্পন্ন করে সে তখন হাতিয়ায় ফিরে গিয়ে পেশাগত দায়িত্ব পালন করছে। তার প্রায়-অস্বাভাবিক বিবাহকাণ্ডবিষয়ক খণ্ড কোনো এক সুযোগে শোনা যাবেখন। উল্লেখ্য, বিয়ের আগে এবং হাতিয়ায় যাওয়ার আগে ও পরে দেশের অপ্রতিদ্বন্দ্বী অভিনেতা হুমায়ূন ফরীদির সাথে বেশ সখ্য ছিল তার। কীভাবে তার সাথে সখ্যতা গড়ে উঠেছিল তা আর মনে নেই। হায়দার খানসাহেবের বিষয়টি বেশ অদ্ভূত! কখনো খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ভুলে যান আবার কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে রাখেন। তবে এটুকু মনে আছে, হায়দারের এক বন্ধু তার অভিনয় ক্ষমতাকে ফরীদির মতো মনে করত। ঠিক-বেঠিক যাই হোক, সে তা বিশ্বাস করে আরও মনোযোগী হয় অভিনয়ে। কারণ ফরীদি ছিলেন তখন টিভি-মঞ্চ দর্শকদের হার্ট-থ্রব! হায়দার তার বাসায় গিয়ে মাঝে মাঝে আড্ডা দিত। অবশ্য ফরীদি কাজ করতেন ঢাকা থিয়েটারে আর সে কাজ করত নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ে ১৯৮৫-এর দিকে। প্রথিতযশা অভিনেতা আবুল হায়াতের সাথেও তার সখ্য ও নিয়মিত আড্ডা ছিল; তার অফিসে ও মাঝেমাঝে তার বাসায়। সে কৌশলগত অথবা খামখেয়ালিবশত বেশ ক’জন নাট্যব্যক্তিত্বের সাথে নাটকবিষয়ক সখ্যতা ও আলোচনার ক্ষেত্র তৈরি করে রেখেছিল সে-সময়।
যাহোক, ফরীদি ভাই তাকে প্রথমত, ঢাকার নাট্যজগৎ ও লেখক শিবির ছেড়ে বিভুঁই-বিদেশ- তেপান্তর-কালাপানিতে যেতে নিষেধ করেছিলেন। হাতিয়া দ্বীপটি তখন হায়দারদের কাছে সেরকমই মনে হতো। ফরীদি ভাই কাজ করতেন বাচ্চু ভাইয়ের একটি কম্পানি বা ফার্মে। তার বেতন কত ছিল তা তার জানা ছিল না। মাঝে মাঝে যেত নতুন কোনো কাজের ধান্ধায় অথবা ঢাকা থিয়েটারে যোগ দেবে কি না তা আলাপ করতে। তখন হায়দার অর্থাৎ আমাদের প্রাণপ্রিয় খানসাহেব একটা প্রেসে ৬০০+৩০০=৯০০ টাকায় প্রেস ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেন খুব অনিচ্ছায়। থাকতেন জিগাতলায় এক দূরাত্মীয়ের বাসায়। কিন্তু মন পড়ে থাকতো তার নাট্যপাড়ায়। মাঝেমাঝেই ৫টা বাজলেই বিনা অনুমতিতে তিনি চলে যান বেইল রোড মহিলা সমিতি মঞ্চে; অথবা ভাস্বর বন্দোপাধ্যায় পরিচালিত শিল্পকলা একাডেমির নাট্য কর্মশালায়। এ নিয়ে তার প্রেস ও অ্যাডভারটাইজং ফার্মের মালিক রুহল ভাইয়ের বক্রোক্তিও শুনতে হতো : ‘হুঁ! প্রথম প্রথম এরকম ভূত সবার মাথায়ই চেপে থাকে। রক্ত গরম তো। ঠাণ্ডা হতে বেশি সময় লাগবে না।’— হায়দার মুখ বুঁজে বিদ্রোহ করত আর মনে মনে ভাবত— একদিন এর জবাব দেব।
কাকরাইলের কোনো এক ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির ভবন থেকে নামতে নামতে ফরীদি ভাই জানতে চাইলেন : বেতন কত দিবে?’ ‘ছয় হাজার’— বেশ উৎসাহের সাথে জবাব দিল হায়দার। ‘মাত্র ৬ হাজার!’— ভ্রু কোঁচকালেন ফরীদি। আমারে ১২ হাজার দিলেও যাইতাম না।’— বলে গটগট করে তার নিজস্ব হণ্টনভঙ্গিতে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে লাগলেন। হায়দারের কাছে ৬ হাজার টাকা ছিল অনেক বড় ব্যাপার। একবার তার এক প্রিয় বন্ধুর সাথে দেখা করতে গিয়ে তার বেতন ৩ হাজার এবং সে বিমানে যাতায়াত করে শুনে তার ক্লান্ত শরীর তন্দ্রায় অথবা হতাশায় ৪৫মিটের জন্য বিছনায় গা এলিয়ে দিয়েছিল। তখন ৩ হাজার টাকা বেতন ছিল তার কাছে স্বপ্ন!
‘তাহলে আামার চলবে কীভাবে? আপনারা তো কিছুই করতে পারলেন না।’ ফরীদিকে সে অসহায়ভাবে প্রশ্ন করে।
‘তাইলে কী আর করবে? যাও! তো নাটকটা ছেড়োনা। ঢাকায় এলেই যোগাযোগ কোরো।’
এরপর হায়দার চলে যায় হাতিয়ায়। সময়টা ১৯৮৬/৮৭ হবে। সেখানে তার কাজ খুব জটিল ছিল না। সেভ দ্য চিলড্রেন পরিচালিত একটা মা ও শিশুস্বাস্থ্যবিষয়ক প্রকল্পের প্রকল্প সমন্নয়ক। দুর্গম এলাকা হলেও হায়দারের কাছে অসামান্য অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ করে দেয় দ্বীপটি। ঢাকা থেকে যাতায়াত পথও ছিল দিবারাত্রিব্যাপী ও কোমড়ভাঙানিয়া। পাবনা থেকে লাগত টানা ২ দিন। সে খুবই উপভোগ করত। ঢাকা থেকে প্রথমে নোয়াখালি মাইজদি এবং হোটেলে রাত্রিযাপন। পরদিন সকাল ৯টার ট্রলার ধরতে ভোর ৭টায় ভাঙাচোরা রাস্তায় অধিকতর ঢড়ঢড়ে বাসে যাত্রা। ট্রলার আসার এবং ছাড়ার আগ পর্যন্ত ছোট একটা হোটেলে নদীর ইলিশ-পাঙাশ-বাটা মাছ দিয়ে দেড় থালা ভাত সাবাড় করা। আর নোয়াখালির নানা ধরনের মানুষের সাথে তাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক-আচারবিচার-কুসংস্কার নিয়ে আলাপচারিতা ও নিজেকে ভিন্ন ধারায় আলোকিত করা।
হাতিযায় লেখক শিবির ও নাট্য আলোড়ন
ঢেকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে! হাতিয়ায় গিয়েও অল্পসময়ের মধ্যে হায়দার জড়িয়ে পড়ল শিল্প-সাহিত্য-নাট্যচর্চ্চায়। সারাদিন অফিসের কাজ। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়মিত বিরতিতে ২/১টি করে স্বাস্থ্য ও পুষ্টিবিষয়ক আনন্দপাঠ পরিচালনা করত। (পরবর্তীতে তার ‘মাইন্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাপ্রোচ’ নামে ভিন্নধারার প্রশিক্ষণ অ্যাপ্রোচ উদ্ভাবনের পেছনেও এসবের অবদান আছে বলে তার ধারণা)। আর সন্ধ্যার পর বন্ধুমহলে আড্ডা। ওখানে স্থানীয় একটি সাংস্কৃতিক সংগঠেনে যাতায়াত করতে করতে অল্পসময়েই একসময় সেটাতে নিয়মিত ও যুক্ত হয়ে গেল। এরপর নিজের ধ্যানধারণা বিনিময় করে একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পটভূমি তৈরি করার চেষ্টা করতে থাকে সে এবং বেশ অল্প সময়ের মধ্যে প্রগতিশীল মহল ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদেরকে প্রণোদিত করতে সক্ষম হয়।
কিছুদিন গেলেই হায়দার লেখক শিবিরের মতাদর্শ প্রচারে সযত্নে সময় দেয়। পরে কয়েজনকে নিয়ে লেখক শিবির, হাতিয়া শাখা গঠন করেন। নিয়মিত বিভিন্ন চেতনাসঞ্চারি দিবস পালিত হতে থাকে। মনে আছে, একবার শহীদ আসাদ দিবস পালিত হয়। ঢাকা থেকে আনু মুহাম্মদ ও আখতারুজ্জামান ইলিয়াস অংশ নেন। ঘড়ির কাঁটা ধরে যেকোনো অনুষ্ঠান শুরু করা ছিল হায়দারদের একটা রেওয়াজ। এ ধরনের ১ম অনুষ্ঠানটির কথা এখনও খানসাহেবরে চোখের ভেতরে গাঁথা হয়ে আছে। সে অনুষ্ঠানটি ৭:৩১-এ শুরু হয়ে ৮:৩০-এ শেষ হয়। সামগ্রিক অনুষ্ঠান বিন্যাসের অভিনবত্ব ও গতিশীলতা দর্শকদেরকে মন্ত্রমুগ্ধ করে ফেলে। ইরাক স্যার নামে পরিচিত এলাকার সর্বজনশ্রদ্ধেয় একজন বিখ্যাত প্রগতিশীল মানুষ পুরো অনুষ্ঠান স্বপরিবারে দেখে হায়দারকে আলিঙ্গণাবদ্ধ করেন এবং বলেন : দাহার সাহেব! আই অ্যাম মুভড।’ এরপর থেকে তিনি লেখক শিবিরের প্রেমে পড়ে গেলেন।
হায়দারকে জানপ্রাণ দিয়ে সহযোগিতা করতেন বুদ্ধিদীপ্ত তিবরিজ ভাই। মনে আছে, ঘড়ির কাঁটায় ৭:৩১-এ অনুষ্ঠান শুরু করার ব্যাপারে তিনি ও তিবরিজ ভাই ছিলেন বদ্ধপরিকর। ঠিক ৫ মিনিট আগে কারেন্ট চলে গেলে তিবরিজ ভাই তার হাই পাওয়ার হোণ্ডার আলো জ্বালিয়ে মিলনায়তনে ঢুকিয়ে দেন এবং হোণ্ডার ফ্রণ্টলাইটের আলোতেই অনুষ্ঠান ঘড়ির কাঁটায় শুরু হযে যায়; যা ছিল দর্শকমণ্ডলী তো বটেই এমন কি হায়দারেরও ধারণার বাইরে। দেখাদেখি আরও দু’একজন তাদের হোণ্ডা মিলনাতেনে ঢুকিয়ে দেয়। ওদিকে ৭:৩১-এর বিষয়টি বাত-কি-বাত মনে করে এলাকার অনেকেই সাড়ে আটটার দিকে মিলনায়তনে আসা শুরু করে এবং ততক্ষণে দীর্ঘপ্রতীক্ষিত অনুষ্ঠনটি শেষ হয়ে গেছে দেখে তারা যথারীতি হতাশ, ক্ষুব্ধ, বিস্মিত ও হতবিহ্বল হয়ে ফিরে যেতে থাকে। এরপর থেকে তারা আর কখনো লেখক শিবিরের কোনো প্রোগ্রামে নির্ধারিত সময়ের পরে আসত না। সময় মতো শুরু করার এ বিষয়টি গোটা হাতিয়ার সাংস্কৃতিক মহলে ভীষণ নাড়া দেয় তখন। এবং অনুষ্ঠানের আয়োজন, বিন্যাস, কনটেন্ট, উপস্থাপনা ও একটার পর একটা সিনেমার পর্দার মতো ঘটে যেতে দেখে গোটা মিলনায়তন আবিষ্ট হয়ে পড়ে।
এরপর হায়দার ও তার সহযোদ্ধাদের দিন চলতে থাকে সমাজ রূপান্তরে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ বেশ কিছু তরুনের তরতাজা কর্মচাঞ্চল্য ও বুদ্ধিদীপ্ত কর্মযজ্ঞের মধ্যে দিয়ে। সারাদিন আফিসের ব্যস্ততার পর সন্ধ্যা থেকে রাত অবধি চলে আলাপ-আলোচনা-অনুশীলন। একদিন সবাই প্রস্তাব করে একটা গণনাট্য-কর্মশালা আয়োজন করার; এবং তা পরিচালনার ভার অর্পণ করা হয় হায়দারের ওপর। প্রতিদিন বিকেলে হোমওয়ার্ক করে সন্ধ্যা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত চলতো সে কর্মশালা। আক্ষরিক ভাবেই এটি আবালবৃদ্ধবনিতার আত্মনিবেদনের আঙিনায় পরিণত হয়। মা-মেয়ে-বাবা এবং লেখক শিবিরের প্রায় সবাই অংশ নিয়ে এটাকে জীবন্ত করে তোলে। ইরাক স্যার, তিবরিজ ভাই স্বয়ং এতে অংশ নেন। একেবারে নবীশ থেকে শুরু করে প্রচলিত নাট্যধারায় অভিজ্ঞ সব ধরনের নাট্য ও সমাজকর্মী এটাকে সফল করে তোলে। অনেক প্রশ্ন ও সমস্যা হায়দার ধৈর্য্য, নিষ্ঠা ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্বসহকারে সমাধান করে। ৩ দিনের কর্মশালা শেষে ৩টি প্রোডাকশন তৈরি হয়। এবং সেসবের পারফরম্যান্স আমন্ত্রিত অতিথি ও অংশগ্রহণকারীদেরকে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়। হায়দার ঘাম দিয়ে জ্বর ছোটে; শরীর হালকা হয়ে আসে। সে মনে মনে এবং সমাপনী ভাষণে এর সফলতার সিংহভাগ জমা দেন আগামি দিনের তরুন নাট্যকর্মীদেরকে এবং আরণ্যক, জামিল চৌধুরি ও বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নাটকের ওপর প্রকাশিত ছোট্ট বইকে।
নোয়াখালিতে সাপের খেল
এরপর শুরু হলো সুযোগ পেলেই যেকেনো ঘটনাকে কেন্দ্র করে তাৎক্ষণিক নাটক তৈরি ও তা রাস্তায়, স্কুলে বিভিন্ন দোকানে দোকানে হঠাৎ করে পরিবেশন। সে এক চমকজাগানিয়া আলোচ্যবিষয়ে পরিণত হলো এমনকি সাধারণ মানুষের কাছেও। হাতিয়ার লেখক শিবিরের নবনাট্য ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নবীন নাট্যকর্মীদের মধ্যে সে কী উদ্দীপণা! চলছিল বেশ রমরমা ইম্প্রোনাটকের মহড়া; অর্থাৎ তাৎক্ষণিক ঘটনায়ার প্রতিক্রিয়ায় বিনা প্রস্তুতিতে নাটক প্রস্তুতি ও তার পারফরম্যান্স। এরই মধ্যে একদিন নোয়াখালি থেকে হায়দারের বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের এক বন্ধু আনসার একাডেমির পরিচালক খাদেমুল ইসলামের কাছ থেকে অনুরোধ এলো তাদের আয়োজিত অনুষ্ঠানে একটি নাটক পরিবেশনের। সাংগঠনিক কমিটিতে জানানো মাত্রই সোৎসাহে তা অনুমোদিত হলো; দু’একদিনের মধ্যেই শুরুর হলো নাটক বাছাই ও প্রস্তুত করার প্রস্তুতি। দু’-এক দফায় আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত হলো- ‘সাপের খেল’ পরিবেশন করা হবে। ‘অবিরাম পাউরুটি ভক্ষণ’ ‘বায়োস্কপ’ কিষণ চন্দরের ‘চাপা পড়া মানুষ’ এমন কি হায়দারের স্ক্রিপ্ট ‘আদিম থেকে আজকে’— এগুলোও আলোচনায় এলো। তবে শেষমেশ কিছু অনুকূল বিষয় ও হিসেব বিবেচনায় ‘সাপের খেল’ মহড়া দেওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হলো।
প্রণব দা’র প্রয়াত বাবা ছিলেন একজন গৃহসন্ন্যাসি— মহর্ষী প্রেমানন্দ; ১৯৮২তে প্রকাশিত ‘সত্য সংবীক্ষণ’-এর লেখক। গীতা ভারতী মিশন ছিল তার প্রতিষ্ঠিত একটি সর্বধর্ম সমন্বয় প্রটচষ্টার মিলনকেন্দ্র। এখানে প্রায়শ আরোচনা ও যজ্ঞ চলত। প্রণব দা ছিলেন এক জীবন্ত হিউমার। সময় করে তার কিছু হিউমার পরে খানসাহেবর কাছ থেকে জেনে নেয়া যাবে। একেবারেই নবীশদের নিয়ে মহড়া শুরু হলো প্রণব দা’দের ওই মিশনের বৈঠকখানায়। উল্লেখ্য, গণনাট্যকর্মশালাও এখানেই হয়েছিল। যাহোক, দিন সাতেক খাটাখাটনির পর নাটকটি একটা শেপ নিল। দু একজন পারফরমার ড্রপআউট হলেও তাতে থেমে থাকল না এর ধারাবাহিকতা ও গতি। দিন ঘনিয়ে এলো। নোয়াখালি যাবার প্রস্তুতি সম্পন্ন হলো। সাথে নেয়া হলো ঋণকরা আসল সাপুড়ে। টিমের মধ্যে অদম্য কৌতূহল! বেশির ভাগই এই প্রথম নোয়াখালি যাচ্ছে; তা-ও আবার ক্ষ্যাপে নাটক করতে। রেমাঞ্ছ আর থ্রিল কাজ করছে সবার ভিতর; ভীতিও। হায়দারও মনে মনে আশংকায় আছে; বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সাপের সাথে লড়াইয়ের স্মৃতি মনে করে মাঝে মাঝে তার হৃতকম্পও দেখা দিচ্ছে। একসময় তারা সবাই হাজির হলো নোয়াখালিতে এবং বন্ধু খাদেমুলের আফিসে। বন্ধুর অকৃত্রিম অভ্যর্থনা ও আপ্যায়নে সবার ক্ষুণ্ণিবৃত্তি হলো; আতিথেয়তায় সবাই মুগ্ধ হয়ে গেল!
ঘণ্টাখানেক বিশ্রাম নিয়ে সবাই অরেকবার মহড়া করে নিল। টাইট টিমওয়ার্ক। কোথাও কোনো ফাঁক নেই; না অভিনয়, না সংলাপ থ্রোয়িং, না প্রযোজনাসংক্রান্ত অন্যান্য আয়োজনে। সন্ধ্যার পর সবাই দলবদ্ধ হয়ে মিলনায়তনে গিয়ে সমবেত দর্শকের ভীড় দেখে একটু যেন নার্ভাস ও অপ্রস্তুত হলো টিমের বেশির ভাগ অভিনেতা-শিল্পি। হায়দার তাদেরকে নিয়ে গ্রিণরুমে বসলো; আবশ্যক কিছু টিপস দিল, ভিতরে ভিতরে নিজের ভয়-টেনশন চেপে রেখে। ততক্ষণে অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে; বিভিন্ন আলোচনা চলছে আনসার একাডেমির বাৎসরিক কার্ক্রমের অংশ হিসেবে। আয়োজক ও দর্শককুলের মধ্যে ‘শাপের খেল’ নিয়ে ব্যাপক কৌতূহল! কখন শুরু হব সবাই এই প্রতীক্ষায়। পূর্ব নির্দ্ধারিত সময় হওয়ার ২০মিনিট আগে থেকেই হায়দার তাগাদা দিতে শুরু করে। তখন সে ছিল একটু গোঁড়া ও গোঁয়ার প্রকৃতির; বিশেষ করে সময় মেনে প্রোগ্রাম শুরু করার ব্যাপারে। তার অপছন্দ অন্যদের নিয়মকানুন প্রচলিত প্রথা সম্মানিলোক হর্তাকর্তা কিছুই মানতো না সে। এ নিয়ে হাতিয়ার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তার হাতে কত যে হেনস্থা হয়েছে— সে গল্পের শেষ নাই। সেসব আরেকদিন শোনা যাবে। কী আর করা! তার চাপে পড়ে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে একাডেমির আলোচনা মাঝপথেই মুলতবি রেখে হায়দার ও সাপের খেলের প্রশংসাসূচক দু’কথা বলে নাটক শুরুর ঘোষণা দিল একাডেমির পরিচালক বন্ধু খাদেমুল ইসলাম। তার মঞ্চে আসছে লেখক মিবিরের শাপের খে….ঘোষণা মাটিতে পড়ার আগেই হায়দার তার দলবল নিয়ে ঢুকে পড়লো দর্শকঠাসা মিলনায়তনের মঞ্চে!
এমনিতেই নতুন নাটক, নতুন টিম; তারপর দর্শকঠাসা মিলনায়তন এবং সবচেয়ে বড় কথা একাডেমির নিয়ম-প্রথা ভেঙে পরফরম্যান্স! দর্শকঠাসা মিলনায়তনের মাঝপথ ভেদ করে ডুগডুগি বাজাতে বাজাতে লাফ দিয়ে মঞ্চে ওঠে হায়দার ও তার দলবল। ঝ তার সেই অতিপরিচিত ভঙ্গিতে মঞ্চের মাঝখানে দাঁড়ায়। নীরবে দু চোখ বন্ধ করে কয়েক সেকেন্ড পাথরের মূর্তির মতো স্তব্ধ হয়ে থাকে; পুরো হল এবং দর্শকও থমকে যায়। পরিবেশ নিজনজরে নিয়ে আসার মতলব আর কি! হঠাৎ বলা নেই-কওয়া নেই অতি আকস্মিকভাবে হায়দার গগণবিদারি চিৎকার করে ওঠে— ‘আ-আ-আস্তে! সাপুড়েরূপী হায়দার কণ্ঠস্বরের বেজ থেকে বিড়বিড় করে মন্ত্রপাঠের মতো সংলাপ আওড়ানো শুরু করলো—
‘আস্তে আস্তে শুরু কর, ধীরে ধীরে দেখাবি’- বলতে বলতে ধীরে ধীরে গলার গামছা ঝাঁকি দিয়ে মহড়া মাফিক মঞ্চের চারদিকে চক্কর দিতে গিয়ে আচমতা পেছনের টেবিলে আর সামনে রাখা ৩টি মাইক্রোফনের স্ট্যান্ডে বাধাপ্রাপ্ত হয়। সে ভীষণ হোঁচট খায় তার অভিনয়ের স্বচ্ছন্দ গতিতে!(মঞ্চে টেবিল ও মাইক স্ট্যান্ড না সরানোর জন্য মনে মনে ভীষণ বিরক্ত হয তার বন্ধুর ওপর)। কিন্তু তাতে থমকে না গিয়ে সে তার মধ্যে তখনও জীবিত নার্ভাসনেস মেরে ফেলতে এ বাধাকে কাজে লাগায়। আকস্মিকভাবে সে এক ধাক্কায় টেবিলটাকে পেছনে ফেলে দেয়। কণ্ঠস্বর চড়িয়ে সংলাপ বানায় : ‘এইসব মাইক ফাইক চটকায়া ফালায়া দেন।’ বলেই সে নিজেই একটা মাইক অবলীলায় ডানদিকে ফেলে দেয়। এরপর টানা কথা বলে যায : ‘এইসব কেডা লাগাইছে। এইডা আমার আর আমার উস্তাদের জন্য বিরাট ইনসাল(ইনসাল্ট)।(বুকে থাপ্পর দিযে হুংকার ছাড়ে) ‘আমি জান্দাল সাপুড়ে; আমার উস্তাদ আসামের জংগলে থাকে। আমাগো কহনো মাইক-ফাইক লাগেনা। আমার নিজের গলার জোরের কাছে এইসব মাইক-ফাইক কিচ্ছু না। আপনেরা কী কন? কতা হাচা কইচি না?’ সবাই যন্ত্রচালিতের মতো সমস্বরে বলে ওঠে : ‘হ হ ঠিক কইছেন। ঠিক কইছেন। আপনের কাছে এসব মাইক-ফাইক কিচ্ছু না।’ সাপুড়ের মতিগতি ভালো না দেখে তড়িৎ-গতিতে লাফ দিয়ে মঞ্চে উঠে মাইকওয়ালা তার স্ট্যান্ড নিয়ে আবারও লাফ দিয়ে হুড়মুড় করে নিচে নেমে জানে বাঁচে।
দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রেণে নিয়ে আসে হায়দার। এরপর মুখস্ত সংলাপ দর্শক-উপযোগী করে আওড়াতে থাকে আর মঞ্চে পাক খায়- ‘আশা কইরা আইসে মানুউউষ! মাইনষেরে তুই খুশি কইরা দিস! মনে রাখিস! মাইনষেরে খুশি করতে না পারলে সাপের বংশের কলংক হয়া যাবি তুই। হে..এ…এ…রে রে…রাহ্’। সাপুড়ে হায়দার পুরোনো মুকস্ত কায়দায সাপের বাক্সের ওপরে হঠাৎ স্বশব্দে বাম হাত দিয়ে থাপ্পর মারে। আচমকা অওয়াজে দর্শকবৃন্দ চমকে ওঠে এবং হায়দার আবার ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। দাঁড়াতে দাঁড়াতে চারদিকে আবার তার রক্তাক্ত চোখ বুলিয়ে নেয়। তারপর বাকি সংলাপ বলে চলে :
‘জনাব! বহুদিন আপনেগো এইখানে আহি না। আগে খুব ঘনঘন আইতাম। আইজকাল একটু কমকম আহি। দিনকাল খুব খারাপ যাইতাছে। পুব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণ কিছু দিশা পাওন যায় না। …তয় আইজ যহন আইছি এককালে খালি হাতে আহি নাইকক্যা। আইজ আপনেগো জান শান্তি কইরা যামু। যত্ত খুশি শাপ দেকপেন। চোক্ষু বুঁইজা মন ভইরা শাপ দেকপেন। হে..এ…এ…রে রে…রাহ্!’
এভাবে সে নাটকের বাকি অংশ চালিয়ে যায় অবাধ ও অবলীলায়। হায়দারের হাতে বাক্স থেকে বের করা জীবন্ত সাপ দেখে সবার আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে যায়। এবঙ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো কোনো দুর্ঘটনা ছাড়াই অনায়াসে সহিসালামতে নাটক শেষ করে। একাডেমির হর্তাকর্তারা পর্যন্ত স্তব্ধ ও হতবাক হয়ে যায়। করতালিতে মুখর হযে ওঠে মিলনায়তনে। বন্ধু খাদেমুল ও তার সিনিয়র কর্মকর্তারা মঞ্চে উঠে হায়দার ও তার দলবলকে প্রশংসায় আপ্লুত করে। খাদেমুলকেও ধন্যবাদ জানায় এরকম একটি পাকাপোক্ত নাট্যদলকে একাডেমির অনুষ্ঠানে এন তা সমৃদ্ধ করার জন্য।
সাপুড়ের দৃষ্টিমিলন
ভালোয় ভালোয় নাটক শেষ করে হায়দার দলবলসহ রাতে খাওযা ও থাকার জন্য আগে থেকে বুক করে রাখা হোটেলে যায়। মেকআপ খোলার কথাও ভুলে যায়। সাথে ছিল বাবুল। আগে থেকেই বুক করে রাখার কথা ছিল তার। তার মাধ্যমে স্থানীয় সহযোগিরা রেখেছিলও তাই। কিন্তু হোটেলে গিয়ে শোনে আজ বিকেলেও তা কনফার্ম না করায় কোনো ছিট খালি নাই। হঠাৎ আবির্ভূত ১০/১২জনের একটা দল তা দখল করে নিয়েছে। মাথায় বাজ পড়ে সবার। বাবুল তো বাকরুদ্ধ ও ক্রুদ্ধ হোটেল ম্যানেজারেরর ওপর। অন্যকে দেয়ার আগে তাকে কেন জানানো হয়নি – এই বলে অহেতুক হম্বিতম্বি করতে লাগল। তাতে কোনো ফায়দা হলো না। কাকে কোথায় রাখা যায়— এ নিয়ে অন্য সংগঠকেরা ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কেউ কেউ আত্মীয়স্বজনের বাসায় চলে গেল। হোটেল ম্যানেজারের সাথে কিছুটা কথাকাটাকাটি কিছুটা বচসা কিছুটা আধিকারের লড়াই কিছুটা নিয়মকাননু নিয়ে বিতর্ক চলতে থাকে। নেগোসিয়েশনের চেষ্টাও চলে হায়দারের সহযোগী বাবুলের পক্ষ থেকে। খবর পেয়ে আনসার একাডেমির পরিচালকবন্ধুও এলো সহযোগিতা উদ্ধার করতে; নিদেন পক্ষে তার বাসায থাকা যাবে– এই ভেবে। ঘটনা অনুসন্ধান শুর হলো। কে বুকিং দিয়েছিল, কার নামে দিয়েছিল, কখন দিয়েছিল, কত তারিখের জন্য বুকিং ছিল, কীভাবে তা হাতছাড়া হয়ে গেল- এসব নিয়ে বিস্তর গবেষণা, তর্কবিতর্ক হাতাহাতির পর্যায়ে পৌঁছালো। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। কোন কুল কিনারা করা গেল না।
এক পর্যায়ে মূল ম্যানেজার সাহেব এসে এ বিতর্ক ও সমস্যা সমাধানে যুক্ত হলেন। হাতিয়া থেকে যিনি বুকিং দিয়েছিলেন তিনি হোটেল মালিকের সাথে কথা বললেন। মালিকও ততদিনে হায়দারকে ভালোমতো চিনে গেছেন। তিনিও হাতিয়াতেই থাকেন। এক পর্যায়ে হায়দারের মনে হতে থাকে, অজকে ফিরতে পারলে ভালো হতো। দরকারে হাতিয়ায় যাওয়ার ট্রলার ঘাটে গিয়ে রাত কাটাতে পারলে তাও বাঁচা যেত। কিন্তু তা সম্ভব হয় না। যোগাযোগব্যবস্থা আদৌ সহায়ক নয়।
এমতাবস্থায় কী মনে করে কোনো সম্ভাবনা না-থাকা সত্বেও হায়দার ম্যানেজারের কাছে জানতে চান : ‘আপনাদের এতগুলো সিট হঠাৎ করে বুকড হয়ে গেল কীভাবে? সিট তো প্রায়ই ফাঁকা থাকে।’ ‘কী আর কইত্ত্ম, স্যার! ঢাকাদ্দে একটা বিরাট ফ্যামিলি আইচে; হেভবি! সব দখল কইরা লইচে।’—ম্যানেজার সাহেব কাঁচুমাচু করে জানালেন। একটু বিস্তারিত বললে ঘটনাটা এরকম। প্রায় ১০/১২ জনের একটা পরিবার মাইজদিতে এসে হঠাৎ আটকা পড়েছে; তারা যাবেন হাতিয়ায়। তারা কেউই পথঘাট কিছুই জানেন না; চেনেন না। তাদের ধারণা ছিল, ওই দিনই তারা হাতিয়ায় পৌঁছে যাবেন; যা একটা দুঃস্বপ্ন মাত্র! এরা গত পরশু রাজশাহী না পাবনা কোথা থেকে রওনা হয়ে ঢাকায় পৌঁছেছে। সেখানে স্টপেজ নিয়ে ১দিন রেস্ট করে আজকে নোয়াখালি হয়ে হাতিয়া পৌঁছাবে মনে করে মাইজদিতে এসে পৌঁছেছে।
এমনভাবে কেঁদেকেটে পড়েছে যে, ম্যানেজার সাহেব আর না করতে পারেন নি। হঠাৎ তার মনে পড়ল- সপ্তাখানেক আগে হাতিয়া থেকে কে যেন ৮/১০জনের জন্য অ্যাডভান্স করে রেখেছিল। তিনি ওই বুকিংটাই এই ঢাকা একাদশকে দিয়ে দেন। হায়দার একটু কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইলেন : ‘আচ্ছা! কে বুকিং দিয়েছিল? কাদের জন্য?’ ‘হায়দার সাহেব নামে একজন দিছিলেন। তার বড় বোন আর ফ্যামিলির জন্য ২২ নভেম্বর। এ দলে একজন নববধুও আছেন। হেভবি!’- ম্যানেজার সাহেব তখনও বুঝে উঠতে পারেননি যে তিনি হায়দার সাহেবের সাথেই কথা বলছেন।
এ কথা শুনে তো হায়দারের মাথা ঘুরে পড়ে যাবার পালা।‘আজই তো ২২ নভেম্বর।’– এতো তার-ই দেয়া বুকিং; বেমালুম ভুলে বসে আছে যে আজকে তার নববধুকে নিয়ে তার বড় বোন এবং ছোট ভাইবোন সবার হাতিয়া পৌঁছানোর কথা। সে মুহূর্ত-এ চলে গেল গত ২৭ জুলাই বিকেল-সন্ধ্যা-রাতের স্মৃতিতে পাবনাতে; তাদের জন্মজেলায়। তাদের বিবাহরজনীর স্মৃতি তার মনে পড়ে গেল। একে একে নাটকের দৃশ্যের মতো ৪মাস আগের প্রতিটি মধুময় দৃশ্য মনে পড়ে গেল তার।
‘কী দোস্ত! কী হলো তোমার?’- পাশ থেকে খাদেমুল ধাক্কা দেয় তাকে। ‘নাহ! কিছু না।’ ম্যানেজারকে জিগ্যেস করে- ‘আচ্ছা! ওনারা কত নম্বরে আছেন? কিছু ফুল পাওয়া যাবে কোথায়?’ আশপাশে তাকিয়ে দেখে পাশের বাগানেই থোকা থোকা ফুল ফুটে আছে। কোনো সম্মতির তোয়াক্কা না করে বাগান থেকে সে টুপ করে তুলে ফেলে এক গোছা ফুল। বিনিময়ে ম্যানেজারের কাছ থেকে পেলেন কিঞ্চিত বিরক্তিমাথানো কুঞ্চিত দৃষ্টি। সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে উঠে গেলেন ৩ তলায় নির্দষ্ট রুমে। ততক্ষণে হোটেলে আগতেরাও জেনে গেছে এ আকস্মিক নাটকীয় ঘটনার কথা। জামান, বিপ্লব, নাহিদ, জাহিদ, শাহীদ, বড় আপা- সবাই। কাঙ্খিত রুমের সামনে এসে হায়দার নিজেকে একটু প্রস্তুত করে নেয়। দরজায় কয়েকবার টোকা দেয়ার পর ভেতর থেকে একটি কোমল নারীকণ্ঠ প্রশ্ন করল : ‘কে?’ হায়দার কোনো জবাব না-দিয়ে আবারও টোকা দিল।
এবার একটু কড়াকণ্ঠ : ‘কে? কাকে চান?’
কণ্ঠস্বর একটু বদলে ফেলে হায়দার : ‘আপনি আমাকে চিনবেন না। আপনার সাথে একটু দরকারি কথা আছে।’
‘আপনি একটু ওয়েট করুন।’
‘না মানে আপনার কোনো ভয় নেই। আসলে হয়েছে কি, এ রুমটায় আমার থাকার কথা। সপ্তাখানেক আগেই বুকিং দিয়ে রেখেছিলাম। এ নিযে আপনার সাথে একটা নেগোসিয়েশনে আসা যায় কি না তা নিয়ে আপনার সাথেই আমাকে কথা বলতে হবে।’
‘আমি ম্যানেজার সাহেবকে খবর দিচ্ছি। উনি আমার সহযাত্রীদেরকে জানাবেন। আপনি ওনাদের সাথে কথা বলবেন।’
‘প্লিজ আপিনি একটু দরোজাটা খুলুন। আমার সাথে ম্যানেজার সাহেবও আছেন।’
এবার ভেতর থেকে আলতো করে দরোজা খুলে একটু আড়াল হয়ে দাঁড়ালেন এক দীর্ঘাঙ্গিণী অভিনব সুন্দরি; অপূর্ব গ্রীবাভঙ্গি তার; ডান ঘাড়টা একটু কাত করা।
হায়দারের দিকে না চেয়েই তিনি বিনীত কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠে জানতে চান : ‘কে আপনি, কী চান, কাকে চান?’
‘আপনাকে।’ হায়দার তার ভনিতা ভুলে গিয়ে নিজস্ব স্প্ষ্টস্বরে জবাব দেয়।
অন্দরমহলের নারী এবার হায়দারের কণ্ঠ চিনে ফেলেছেন। কিন্তু না-চেনার সুরে একটু গ্রীবা বাঁকিয়ে ঝাঁঝিয়ে ওঠেন : ‘হেঁয়ালি না করে যা বলার বলে ফেলুন।’
হায়দার-ও ততক্ষণে নিশ্চিত হযে গেছে— এ নারীকণ্ঠীকে! সে অকস্মিকভাবে তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। দৃঢ়চেতা নারী এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িযে নিয়ে তাকে দরোজার দিকে ঠেলে দেয়। এবং মুখ ঘুরিয়ে সোজাসুজি হায়দারের দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। সাপুড়েবেশে হায়দারকে দেখে সে রীতিমতো বিরক্ত হয় কিন্তু না-চেনারে এবং চোখে শষ্যের ফুল দেখছে— এমন ভাণ করে। সে নিজেকে এ অদ্ভূত আজগুবি লোকের হাত থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য চিৎকার দিয়ে ওঠে। দৃষ্টি ও হোটেলবয়দের উত্তমমধ্যম থেকে বাঁচার জন্য হায়দার নিজের মুখ থেকে সাপুড়ের মেকআপ একটানে খুলে ফেলে। দৃষ্টি ভূত দেখার মতো চমকে ওঠার ভাণ করে : ‘হা য় দা র! তুমি? তুমি কীভাবে এখানে? তোমার মুখে এসব কীসের মেকআপ, পোশাকের এ কি হাল?’
হায়দারের তখনও সাপুড়ের পোশাক। দৃষ্টির দিকে ফুলগুচ্ছ এগিয়ে দেয় : ‘আমি স্যরি। ভুলেই গিয়েছিলাম আজ ২২ নভেম্বর; তোমাদের হাতিয়া আসার কথা।’
দরোজার বাইরে ততক্ষণে একঝাঁক মানুষ। দৃষ্টি দরোজার ওপারে তাকিয়ে দেখে তার সাথে আসা সহযাত্রীরা— জামান, বিপ্লব, নাহিদ, জাহিদ, শাহীদ, বড় আপা- সবাই। পাটখড়ির মতো লম্বা ঢ্যাঙা জামান(হায়দারের ছোট ভাই)মাথা ঝাঁকিয়ে হাত-পা নেড়ে নেড়ে দৃষ্টিকে বললো : ‘কী ভাবী! এখুন আমার কথা বিশ্বেষ হল্যে তো! আমি আগেই কইচিলেম না, চিন্তা করেন না; দাদা আইসে।’
‘তোমার দাদা দরজায় নক করার সাথে সাথেই আমি বুঝেছিলাম। তোমার দাদাতো নিজেকে বিরাট একজন অভিনেতা মনে করে, আমিও যে অভিনয় জানি, তা প্রমাণ করে দিলাম।’— মৃদু অহংকারের সাথে দৃষ্টি কথাগুলো বলে : ‘কী কেমন ঘাবড়ে গিযেছিলে, সত্যি করে বলতো!’
হায়দারের মুখে কোনো কথা জোটে না।