খানসাহেবের খণ্ডজীবন :: পর্ব ১০ । সিরাজুদ দাহার খান
প্রকাশিত হয়েছে : ০২ মার্চ ২০১৭, ৮:০৪ পূর্বাহ্ণ, | ১৬০৭ বার পঠিত
খানসাহেবের সাপুরেজীবন কিস্তি-২
বিশ্ববিদ্যালয়জীবনেও খানসাহেবরে ধ্যান-জ্ঞান ছিল নাটক-কবিতা-সাংস্কৃতিক আন্দোলন। ততদিনে তিনি যুক্ত হয়েছেন বদরুদ্দিন উমর, আনু মুহম্মদ ও আবরারভাই-আফসার ভাইদের নেতৃত্বে পরিচালিত ‘বাঙলাদেশ লেখক শিবির’-এ। পরবর্তীতে তিনি এর কেন্দ্রিয় কমিটি সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মূলত লেখক শিবির-ই তাকে রাজনৈতিক ও পথনাটক করতে প্রণোদিত করে। একসময় গণমানুষ ও ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টির তাগিদ তার মধ্যে এমন প্রবল হয় যে, এ ধরনের নাটক নিয়ে তার মাতামাতি বেড়ে যায়; একপর্যায়ে তা মঞ্চমুক্ত হয়ে সড়কনাটকে রূপ নেয়। এবং মঞ্চনাটকের পাশপাশি নিয়মিত পথনাটক করতে থাকে। ‘সড়ক নাট্য দল’ নামে একটি পথনাটকের দল-ও গঠন করে এবং সে পাবনার রাস্তায় রাস্তায় নাটক প্রদর্শন শুরু করে।
লেখক শিবিরের ব্যানারে ‘সাপের খেল’ নামে আবদুল কাইয়ুম খোকন ভাইয়ের লেখা নাটক তখন হায়দারে নাট্যজীবনের অপরিহার্য অংশ জুড়ে জড়িয়ে ধরেছে। প্রলেতারিয়েত বা সর্বহারা মানুষের মুক্তির প্রেরণায় প্রণোদিত হায়দার তখন সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে বুঁদ হয়ে সময় যাপন করে। নাটক, সঙ্গীত, কবিতা, পুঁথিপাঠ- সবকিছুর মধ্যেই সে রাজনীতির পাঠ পড়তে উদগ্রীব ও উৎকণ্ঠায় থাকে। নাটকটি ছিল স্বৈরাচারী এরশাদের আমলের প্রতিকী রূপ। এ নাটকে খানসাহেব তথা হায়দার অভিনয় করত সাপুড়ের। নাটকটিতে সে এতটাই আচ্ছন্ন ছিল যে, যেকোনো সময় যেকোনো স্থানে বিনাস্ক্রিপ্টে বিনা প্রস্তুতিতে নাটকটির প্রদর্শন বা মঞ্চায়ন করতে পারত। এখনও মুখস্ত তার প্রায় প্রতিটি সংলাপ। অভিনয় করত বাক্সভর্তি ছোটবড় তরতাজা সাপ ও হাতে আরও ভয়ংকর একটা বড় বিষধর(!) সাপ নিয়ে।
সাপুড়ে হিসেবে প্রশিক্ষণ গ্রহণপর্ব :
এ নাটকটিতে প্রথম দিকে অভিনয় করতেন নাট্যকার আবদুল কাইয়ুম খোকন স্বয়ং এবং সেটা হতো মঞ্চে- লেখক শিবিরের কোনো অনুষ্ঠান, সেমিনার বা সম্মেলন শেষে। তখন লেখক শিবিরের ভরা যৌবন। কিশোর তরুন বয়স্ক আর পরিপক্ক ও প্রাজ্ঞজনদেদের তারুন্য ও উচ্ছ্বলতায় উজ্জ্বল ও উদ্বেল। অনুষ্ঠান শেষে ‘জনৈক শামসুর রহমান’, ‘রফিক আযাদের ‘ভাত দে হারামজাদা’ আর সবশেষে আবছার ভাইয়ের গণসঙ্গীত দলের রক্ত টগবগকরানো গান আর আবদুল কাইয়ুমের সাপের খেল ছিল অবধারিত। কথিত আছে, এ নাটকটি লেখা ও অভিনয় করার আগে খোকন ভাই ৩ মাস ঢাকার সাভারে সাপুড়েদেরে সাথে কাটিয়েছেন। সেখান থেকেই এ নাটকের সাপুড়ের চরিত্র হায়দারকে মন্ত্রমুগ্ধ করে। অবশ্য এর আগে জামিল চৌধুরির গণনাট্য কর্মশালায় অংশগ্রহণ তাকে পথনাটক ও রাজনৈতিক নাটকের প্রতি আকৃষ্ট ও চিন্তাচেতনায় শাণিত করেছে।
প্রণোদিত হয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখায় হায়দার ও তার সহযোদ্বারা শাপের খেল প্রযোজনার সিদ্ধান্ত নেয়। বলা বাহুল্য, উদ্যোক্তাদের মধ্যে পাভেল চৌধুরি ও ফয়জুল হাকিম বাদশার(ওর পরিবারপ্রদত্ত্ব নাম- বাচ্চা সাহেব; ‘বাচ্চা’ ততদিনে সবার কাছে বাদশা হয়ে গেছে)কথা এ মুহূর্তে মনে পড়ছে। লেখক শিবিরে বাদশা আর হায়দার ছাড়া তেমন কেউ-ই নাটকে পারদর্শী ছিল না। অগত্যা নাটকের মূল চালিকাশক্তি সাপুড়ে চরিত্রটি রূপায়নের ভার হায়দারের ওপর অর্পিত হয়। এ অভিনয়টি হায়দারের কাছে ছিল অভিনব ও আকর্ষণীয়। কিন্তু এর মূল চ্যালেঞ্জ ছিল— জ্যান্ত সাপ নিয়ে খোলামাঠে ব্যপক দর্শকদের মধ্যে নির্ভয়ে ও দাপটের সাথে সাবলীলভাবে অবিকল সাপুড়ের মতো অভিনয় করা। এখানে নিজের ও দর্শক সবার জীবন হায়দারের হাতের মুঠোয় বন্দি থাকতো। এ ছিল এক ভয়ংকর চ্যালেঞ্জ! কারণ হায়দার তো আদৌ কোনো সাপুড়ে বা সাপুড়ে পরিবারে সন্তান নয়। বরং আবাল্য সে সর্প, কুকর, বজ্রাঘাতের ভয় বুকের ভেতর পুষে নিয়ে পথ চলতো দিনেদুপুরে-রাতবিরেতে। এই নিয়ে তার মামারা তাকে ক্ষ্যাপাতো জন্য তার এক আপনপ্রিয় নানা তাকে অভয় দিয়ে বলতেন, ‘যে সাপ-কুত্তা আর ঠাডার(বজ্রপাত)ভয় না করে, সে পাগল।’
যাহোক, সিদ্ধান্ত পাকা হওয়ার পর কযেকদিন সাপমুক্ত পরিবেশে মহড়া চলল নির্ভয়ে শান্তিতে।স্ক্রিপ্ট আত্মস্থকরণ, চরিত্রায়ন, নাটকের মূল ভাবনা ও বক্তব্য উপলব্ধি, সংলাপ থ্রোংয়িং, পারস্পরিক বোঝাপড়া, সমন্নয় ও প্রাথমিক কোরিওগ্রাফির মতো সাধারণ কাজগুলো চলল ৫/৭দিন। ভালোই চলছিল। হঠাৎ করে মূল সংগঠকদের একজন, সম্ভবত পাভেল বলে উঠলো— ‘সাপের খেল-এর আসল জিনিস কই? বেশি সময় তো হাতে নাই।’ নাটক মাঠে নামাতে হবে তাড়াতাড়ি। প্রথমে একটি হকচকিয়ে গেলেও হায়দারের বুঝতে অসুবিধা হলো না— আসল জিনিস মানে কী? তার পিলে চমকে উঠলো! এবার তাহলে সত্যিসত্যিই আসল সাপ নিয়ে অভিনয় করতে হবে। দুদিন সে ভয়ে রিহার্সেলে যাওয়া বন্ধ রাখলো। এ নাটকের নির্দেশনার দায়িত্বও ছিল বাচ্চা সাহেব ও তার নিজের ওপর।
শহর থেকে কয়েকদিন চেষ্টার পর সাপের ডালাসহ খুঁজে পাওয়া গেল একজন সাপুড়ে। তার নাম মনে নেই। ধরে নেয়া যাক আক্কাস মিয়া। তবে হায়দার ছোটবেলায় সাপুড়ে দেখে যেমন ভয় পেত তাকে দেখে তেমন কোনো অনুভূতি হলোনা। সে শুধু আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে রইলো সাপুড়ের দিকে। ছোট বেলায় এদেরকে যেমন যাদুকরি বা মায়াবি ভয়ংকর মনে হতো, তেমন কোনো কিছুই তার মনে এলো না জন্য একটু হতাশ-ও হলো। এতো দেখছি, একেবারে সাদামাটা; আর দশজনের মতোই সাধারণ মানুষ! তারপরেও তার ভেতর থেকে ভয় কাটলো না; জ্যান্ত সাপ নিয়ে দর্শকদের মাঝে অভিনয় করতে হবে। মনে হতেই তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসলো; দ্রুত নিঃশ্বাস পড়তে লাগলো। বুকের ভেতর বড়বড় বিট দিতে লাগলো। সবাই নিঃশব্দ নিঃশ্চুপ হয়ে গেছে।
আক্কাস মিয়া বিষয়টা বুঝতে পারলেন। তিনি হায়দারের ভয় কাটানোর জন্য বলা নেই কওয়া নেই বাক্সের ডালা ঝপ করে খুলে ফেললেন; লিকলিকে ফনা তুলে কয়েকটা ছোট ছোট ছোট সাপ প্রত্যেকের দিকে নজর বুলিয়ে নিল। তারপর তারা স্থির হয়ে তাকিয়ে রইলো আক্কাস মিয়ার দিকে; তারপর হায়দারের দিকে। হায়দারের তো নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার পালা। সাপুড়ে জিজ্ঞেস করল : ‘ওই তোরা কি কিচু খাইবি?’ সাপগুলো না-সূচক মাথা নাড়লো। এরপর হায়দারের দিকে দেখিয়ে জানতে চাইলো: ‘তোরা কি স্যাররে ভালো পাইস?’ ওরা আবার মাথা নাড়লো : ‘হ ভালো পাই?’ ‘স্যারের লগে থাকপি কয়দিন?’ ওরা আবার মাথা নাড়লো : ‘হ থাকুম।’ এরপর আদেশ করলো : ‘ওই তোরা অহন বাক্সের ভিতরে হান্দা।’ — বলে বাক্সে একটা আস্তে করে টোকা দিল। সাপগুলো মাথা নত করে এক এক করে বাক্সের ভিতরে ঢুকে গেল।
আক্কাস মিয়া এবার হায়দারকে বললো : ‘লন আপনের মাল আপনে বুইঝা লন।’- বলেই জোরে ধাক্কা দিয়া সাপের বাক্সটা হায়দারের দিকে ঠেলে দিল। ততক্ষণে মহড়া কক্ষে অনেক দর্শক ভিড় করেছে। হায়দারে কোনো দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। তার চোখের পলক পড়ে না। ‘স্যার, তব্দা মা্ইরা গেলেন নাকি? ধরেন, বাক্সটা হাত দিয়া ধরেন। ডর নাই!’ হায়দারের ততক্ষণে হুঁশ ফিরেছে। সে দ্রত ঘরের বইরে চলে যায়- মায়নাস পয়েণ্টের দিকে। বাদশা তার পেছনে পেছনে যায়। বাথরুম থেকে বের হয়; চোখেমুখে পানি দেয়। বাদশা তাকে বগলদাবা করে নিয়ে রুমে ঢোকে।
আক্কাস মিয়া ধৈর্য্য হারায় না। সে বাক্সের মুখ বন্ধ করে তা চোখের পলকে হায়দারের হাতে তুলে দেয়। হায়দার যন্ত্রচালিতের মতো বাক্সটা হাতে ধরে; থরথর করে কাঁপতে থাকে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বাক্সটা ধপাস করে হাত থেকে পড়ে যায় এবং যথারীতি বাক্সের মুখ খুলে যায়। সাপগুলো আবার লকলকে জিব বের করে বাইরে মুখ বাড়িযে দেয়। আক্কাস সাপুড়ে মন্ত্র পাঠ করতে শুরু করে। একটু পরে বাক্সে বেশ জোরে দুইটা থাপ্পর দেয়; সাপগুলো আবার ভিতরে চলে যায়। ততক্ষণে ঘর প্রায় ফাঁকা হয়ে গেছে। ঘরের ভেতরে শুধু হায়দার, বাদশা আর আক্কাস মিয়া— এ ওর দিকে তাকায়। সাপ বশ করার প্রশিক্ষণ আজকের মতো বাতিল ঘোষণা করে আক্কাস মিয়া।
পরদিন যথারীতি মহড়া শুরু হয়। তখনও আক্কাস মিয়া আসে নাই। মনের আনন্দে সব মহড়ায় ব্যস্ত হয়ে ওঠে। বিরতির সময় আক্কাস মিয়া বাক্সপেটরা নিয়ে হাজির। প্রাণবন্ত হায়দারে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসে; বুক ধরফর করে; পানি খেতে নিচে নেমে যায়। বাদশা তার পিছু ছাড়ে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই হায়দারকে নিয়ে সে ফিরে আসে মহড়া কক্ষে। ‘হায়দার তুমি ডরাও কেন? এইডাতো পনির মতো সোজা কাম; এই সামান্য শাপেরে ডরাইলে বিপ্লব করবে কেমনে।’- কে যেন তাকে অভয় দেয়ার বৃথা চেষ্টা করে। হায়দারের মধ্যে কোনো ভাবান্তর দেখা যায় না। তাকে সাহস দেয়ার জন্য আক্কাস মিয়া নতুন পথ নেয়। তাকে নিয়ে বাইরে গিয়ে সাত-পাঁচ বোঝায়। হায়দার সাহস নিয়ে ঘরে ফিরে আসে; কিন্তু যেই সাপের বাক্সের দিকে তাকায়, তার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে। নো নড়নচড়ন!
উপায় না দেখে আক্কাস মিয়া এবার অন্য পথ নেয়। এতক্ষণ-ও সে আসল সাপ বের করে নেয়— যেটা হাতে নিয়ে হায়দারকে অভিনয় করতে হবে। সে এবার আরেকটা বাক্সে হাত দেয়; ধড়াস করে তার মুখ খুলে ফেলে; কিন্তু জিব লকলক করে ফনা তুলে কোনো সাপ মুখ বের করে না। এরপর বিড়বিড় করে মন্ত্র পাঠ করে বাক্সটা মাটিতে উপুড় করে রাখে সে। ভয়ে সবাই ঘর ছেড়ে পালায়; হায়দার ভয়ে নিথর হয়ে যায়; একপা-ও নড়ে না সে। এরপর আক্কাস মিয়া বাক্সটা আবার সোজা করে রাখে। এরপর হঠাৎ শূণ্যে তুলে ধরে উপুড় করে ধরে বাক্সটা। ফাঁকা। তা থেকে কোনো সাপ বের হয়ে আসে না। হায়দার নিঃশ্বাস ও সম্বিৎ ফিরে পায়। আক্কাস মিয়া সুযোগটা কাজে লাগায়; হায়দারের কাছে আসে এবং তার হাতে ফাঁকা বাক্সটা ধরিয়ে দেয়। হাযদার এরপরও ভয়ে ভয়ে ফাঁকা বাক্সটা হাতে নেয়। আক্কাস মিয়া বলে, ‘স্যার, ভিতরে হাত হানদায়া দ্যান। কোনো ডর নাই; বাক্স ফাঁকা।’
হায়দার ভয়ে ভয়ে মাটিতে বসে বাক্সটা হাতে নিয়ে; ওটা মাটিতে রাখে। বাক্সের মুখ খোলে এবং আচমকা ওর মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দেয়। হাতে কোনো সাপ বিচ্ছু তেলাপোকা কিচ্ছু বাধে না। ‘কী স্যার? কিছু আছে? কিচ্চু নাই। লন হাতে সাপ ধরতে হইবো না, আপনে এই ফাঁকা বাক্সে সাপ আছে ধইরা লইয়া অভিনয়ের রিহার্সেল দ্যান।’ হায়দারের ভয় নিমেষে দূর হয়ে যায়। মহড়া চলতে থাকে সাবলীলভাবে। দুর্দান্ত সাপুড়ের মতো চারদিকে চক্কর দিয়ে দিয়ে হায়দার অভিনয় করতে থাকে। কয়েক পাক ঘুরে এসে হায়দার সাপ বের করার ভঙ্গিতে মন্ত্র পড়তে পড়তে অবলীলায় বাক্সের মুখ খুলে ফেলে এবং হাত ঢুকিয়ে দেয়। আচমকা ফোঁস করে ওঠে একটা তরতাজা সাপ; ছোট সাইজের না। একবারে ঢাউস সাইজের। আক্কাস মিয়া এরই মধ্যে কখন যে বাক্স পাল্টে দিয়েছে তা হায়দার কিচ্ছু বুঝতে পারে নাই।
মন্ত্র ও সংলাপ বন্ধ হয়ে যায় এক নিমেষে। হায়দার ছিটকে পড়ে যায় বেশ দূরে; দেয়ালে গিয়ে ধাক্কা খায়। বাক্স থেকে ফণা তুলে সাপ বের হয়ে আসে। দৌড়ে এসে সাপকে কব্জা করে ফেলে আক্কাস মিয়া। সাপটা প্রথমে তার হাতে পেঁচিয়ে ধরে; এরপর গলায়। সাপ হাতে নিয়ে নানা রঙ্গ করে, যেন একটা দড়ি নিয়ে যাদু দেখাচ্ছে। এরপর ধীরে ধীরে হায়দারের কাছে আসে। ‘লন স্যার! হাতে লন; ডর নাই। আমি মন্ত্র পইড়া দিছি। কাউরে কিচ্ছু কইবো না।’ —বলে নিজ গলা থেকে সাপ ছাড়িয়ে হায়দারের হাতে দেয়। হায়দার হাত থেকে বিদ্যুতগতিতে সাপটিকে মাটিতে ফেলে দিয়ে যথারীতি ছিটকে দূরে সরে যায়। ‘দূর মিয়া! অপনেরা দিয়া কিচ্ছু হইবোনা।’ আক্কাস মিয়া সেদিনকার মতো হতোদ্যম হয়ে মুখে এ কথ্ বললেও প্রশিক্ষণ আগামি কাল পর্যন্ত মূলতবি ঘোষণা করে; কিন্তু হাল ছাড়ে না।
পরদিন যথারীতি মহড়া শুরু হয়। তখন-ও আক্কাস মিয়া আসে নাই। মনের আনন্দে সব মহড়ায় ব্যস্ত হয়ে ওঠে। আগের দিনের মতোই বিরতির সময় আক্কাস মিয়া বাক্সপেটরাসহ আবার হাজির। কিছুক্ষণ বিরতি দিযে আজকে আবার আগের দিনের মতো কসরত চলে। আক্কাস মিয়া হায়দার নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করে। তারপর আবার হায়দারের হাতে সাপ দেয়; সে দু’এক সেকেন্ড হাতে ধরে রাখে; আবার মাটিতে ফেলে দেয়। এভাবে ৫/৬বার ব্যর্থ হওয়ার পর আক্কাস মিয়া হাল ছেড়ে না দিয়ে শেষ চেষ্টা করে :
‘স্যার, এই সাপ সেই পয়জোনাস সাপ না। এটা ঢোঁড়া সাপ, মানে দাঁড়াস সাপ। এর বিষ নাই; এই দেখেন দাঁত-ও ভাইঙা দিছি।’ বলে সাপের গলায় মৃদু চাপ দিয়ে তাকে হাঁ করে দেখায়— ‘এইযে দেখেন, কোনো দাঁত নাই।’ বাদশা তখন সাহস যোগায় ‘দোস্ত! ছেটবেলায় পড়ো নাই সুকুমার রায়ের ছড়া— যে সাপের চোখ নাই, নাক নাই, দাঁত নাই; করে নাকো ফোঁসফাঁস, মারে নাকো ঢুসঢাস’ — এইডা সেই সাপ।
এরপর আক্কাস মিয়া হায়দারের হাতে আবার সাপটা দেয়। হায়দার সাহস করে হাতে নিয়ে যেই সংলাপ দিতে যাবে, ঢোঁড়া সাপ ঢোঁড়া থাকে না; সে ফনা তোলে। হতচকিত হয়ে হায়দার হাত থেকে মাটিতে ছেড়ে দেয় তাকে তড়াক করে। এবার আক্কাস মিয়া হাল ছেড়ে দেয়— ‘যান মিয়া! আপনেগো লগে কোনো কামই করুম না। আপনেরা ওই ইলাসটিকের সাপ দিয়াই নাটক করেন। জ্যান্ত সাপ দিয়া খেলা করতে বুকের পাটা লাগে।’ —বলে সে বসে পড়ে এবং দুম মেরে থাকে।
জ্যান্ত সাপ দিয়ে নাটক করার হাল ছেড়ে দিয়ে বাদশা আবার মহড়া শুরু করতে বলে। মহড়া চলতে থাকে আবার সচ্ছন্দে। সাপুড়ের মতো চারদিকে চক্কর দিযে দিয়ে হায়দার অভিনয় করতে থাকে। কয়েক পাক ঘুরে এসে হায়দার সাপ হাতে ধরে আছে— এই ভঙ্গিতে চোখ বন্ধ করে মন্ত্র পড়তে থাকে। এরপর চোখ খুলে পরের সংলাপ থ্রো করতে যাবে, এমন সময় আচমকা আক্কাস মিয়া তার মুখের ওপর জ্যা্ন্ত সাপটাকে ছুঁড়ে দেয়। থতমত খেয়ে যায় সে। মাথায় কোনো বুদ্ধি খেলে না। আত্মরক্ষার্থে কোনো দিশা না পেয়ে হায়দার খপ করে নিজের অনিচ্ছাতেই সাপটাকে হাত দিয়ে ধরে ফেলে। এবং মুহুর্তের মধ্যে সাপ তার হাত পেঁচিযে ধরে। উপায়ন্তর না দেখে ভয় কাটানোর জন্য সে আরও জোরে চিৎকার করে সংলাপ ও মন্ত্র উচ্চারণ করে যায়।(ছোটবেলায়, এমন কি বড় বেলায়-ও নিশাচর হয়ে রাস্তায় ঘোরাফিরা করার সময় হঠাৎ কুকুর বা সাপের সামনে পড়লে বা বাঁশঝাড়ের বাতাশে শেঁ শোঁ শব্দ শুনে ভূতের ভয় পেলে এমন-ই জোরে জোরে গলা ছেড়ে গান ধরা তার আত্মকৌশল)।
তার হাতের চাপে দ্রুত সাপ নরম হয়ে আসে; ফনা নামিয়ে ফেলে এবং বলা নেই-কওয়া নেই হায়দারের হাতে ছ্যারছ্যার করে মলত্যাগ করে দেয়। সাপের বিষ্ঠার ভালোবাসায় তার হাত ও জামাকাপড়ে মাখামাখি হয়ে যায়। সেদিকে তার ভ্রুক্ষেপ নাই! সে স্বাভাবিক ও সাবলীলভাবে সাপ নিয়ে কসরত করে যায়। তার নিজের আজান্তেই কখন যে হায়দারের মন থেকে সাপের ভয় একেবারে উবে গেছে সে বুঝতেই পারেনি। সবাই হাঁপ ছেড়ে বাঁচে; একযোগে করতালি দিয়ে ওঠে।
আক্কাস সুযোগের সদ্ব্যবহার করে— ‘স্যার! আপনের ভাগ্য তো সোনা দিয়া মোড়ানো। এই সাপ তো সহজে কারো গায়ে পায়খানা করে না। যার গায়ে ও পায়খানা করে তার কপাল খুইল্লা যায়। ও আপনেরে ভালোবাইসা ফেলসে! অপনে চালাইয়া যান।’
সাপুড়ের এই আজগুবি কথা শুনে সবাই একসাথে হো হো করে হেসে ওঠে। কেউ কেউ মনে মনে আক্কাসের ওই কথায় বিশ্বাস–অবিশ্বাসের দোলায় দুলতে থাকে। ভাবে, ‘হায়রে সাটা যদি আমার হাতে পায়খানা করত।’ এরই মধ্যে হায়দার ও আক্কাস মিয়া তাদের পারস্পরিক সফলতা উদযাপন ও ভাগাগাভাগি করতে একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে। খুশিতে কেঁদে ফেলে দু’জনেই!