খানসাহেবের খণ্ডজীবন :: পর্ব ৯ । সিরাজুদ দাহার খান
প্রকাশিত হয়েছে : ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ৮:১৯ অপরাহ্ণ, | ১৯০৪ বার পঠিত
ধান ভানতে শিবের গীত : খানসাহেবের নাট্যবেলা কিস্তি-১
[সেদিন সন্ধ্যায় হাঁটতে বেড়িয়েছি নিয়মিত অভ্যাসের অংশ হিসেবে। খানসাহেবরে পাল্লায় পড়ে আমার-ও এ হণ্টনের বাতিক পেয়ে বসেছে। তার সাথে পাড়ার ছোটবড় অনেকের বেশ প্রাণখোলা ও মজাদার সম্পর্ক। তার সাথে ঘুরলে বা হাঁটলে বেশ মজার মজার অভিজ্ঞতা হয়। তিনি এক বিচিত্র মানুষ! কিছুটা উদ্ভট-ও বটে! কখনো আমুদে, কখনো আহাম্মক, কথনো শিশুরমতো বোকা ও সরল-সহজ, কখনো নিরস-রাগী, কখনো আপনভোলা! তিনি আসলে কেমন তা এখন-ও ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। মিসেস খান-ও তা বুঝে উঠতে পেরেছেন— এটা আমার প্রত্যয় হয়না। তাঁর এক ৩৫-৪০ বছরের পুরোনা বন্ধু তাকে পুরোটাই বুঝতে পেরেছেন বলে দাবিদার। এমন কি খানসাহেবের চাইতেও তিনি খানসাহেবকে ভালোভাবে চেনেন— এমন দাবি করতেও এতটুকু কুণ্ঠিত হন না। খানসাহেব এসব শুনে মনে মনে হাসেন; মুখে সায় দিয়ে যান।
যাহোক, সেদিন হাঁটতে বের হয়ে ওনাকে খুঁজে না পেয়ে একটা আলোছায়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ, আমার পাশ দিয়ে কে যেন কী একটা আওড়াতে আওরাতে আপন মনে চলে যাচ্ছিল। প্রথমে ভয় পেয়ে যাই; কোনো অপ্রকৃতিস্থ মানুষ বোধ হয়। গা ছমছম করে ওঠে! ওই ব্যক্তি ৪/৫ কদম চলে যাওয়ার পর আমি সচকিত হই এবং তার পায়ের নীলসাদা হণ্টনকেডস এবং চলার ভঙ্গিতে সম্বিত ফিরে পাই : ‘আরে হায়দার ভাই না!’ তিনি কোনো জবাব না দিয়ে হাত পা নেড়ে নেড়ে কীসব আবোলতাবোল বকতে থাকেন এবং একটু পরে আমার দিকে ব্যাক করেন।
‘খানসাহেব! হায়দার ভাই! আরে আমাকে চিনতে পারছেন না।’ —বলে তাকে পথরোধ করে থামিয়ে দেই। তিনি জগতে ফিরে আসেন। ‘আরে কী হয়েছে আপনার? শরীর-মন ভালো তো? পাগল হয়ে গেলেন নাকি।’
‘নাহ! তেমন কিছু না। একসময় সাপুড়েজীবন কাটিয়েছি তো। তারই স্মৃতিচারণ করছিলাম আর কি!’ ‘সাপুড়েজীবন! বলেন কী? আপনি তো অদ্ভূত মানুষ!’
‘হ্যা! আসলেই আমার জীবন বড় অদ্ভূত-উদ্ভট। পেটের তাগিদে জীবনে কত কিছুই না করতে হয়েছে আমাকে।’
‘ঘটনাটা খুলে বলেন তো। ঝেড়ে কাশুন।’ —শুনেই তিনি বিরক্তিকর ভঙ্গিতে শব্দ করে কাশতে শুরু করলেন। ‘আরে না না! আপনাকে কাশতে বলিনি। কেন কবে কীভাবে সাপুরেজীবন কাটিযেছেন—তা খুলে বলুন।
আপনাদেরকে আগেই বলেছি, তার কাছ থেকে সহজে আসল কথা আদায় করা যায়না। হয় ভনিতা করবেন; না হয় ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে অনেক পরে আসল কথা বলবেন। কথনো কথনো ২/৩ দিনও পার করে দেন। এবারেও তাই হলো। উনি ধান ভানতে শীবের গীত গাইতে শুরু করলেন। আমিও তার একমাত্র একনিষ্ঠ শ্রোতা হিসেবে তার শীবের গীত ২/৩দিন ধরে শুনে আসল কথা পেলাম। তিনি ইনিয়ে বিনিয়ে যা বললেন, তা স্বল্পসংক্ষেপে :]
খানসাহেবের সাপুড়েজীবন
‘শোনেন দাহার সাহেব! আপনারা আমার সম্পর্কে অনেক কিছুই জনে না। আজকে আমার জীবনের আরেকটা অধ্যায় অল্পকথায় বলছি।’ —এটুকু ভূমিকা দিয়ে তিনি শুরু করলেন :
“পাবনা জেলার শালগাড়িয়া নামের জন্মপাড়ায় বেড়ে উঠেছি আমি। ছোটবেলায় মা-বাবাছাড়া হয়ে নানীর কাছে মানুষ। ১৯৫৬ মতান্তরে ১৯৫৭ সালে জন্মের পর থেকে ৭০-৭১ সাল পর্যন্ত টানা প্রায় ১৫ বছর নানা-নানীর সাথে থাকতাম।
পাড়ায় নিয়মিত নাটক হতো। নাটক এবং নাটকে অভিনয়কে আমার কাছে স্বপ্নের জগত বলে মনে হতো। বাড়িতে যাকে আমুদে মামা হিসেবে দেখতাম, মঞ্চে তাকে অন্যরূপে দেখে ঘোরলাগা চোখে অবাক হয়ে চেয়ে থাকতাম। এভাবেই অতি দ্রুত আমার মধ্যে অভিনয় ও নাট্যপ্রীতি জন্ম নেয়।
শালগাড়িয়ায় দু’-তিনটি পাড়ায় নাটক হতো। প্রতিটি নাটক-ই আমার মনে দাগ কাটতো। মনে হতো, এ এক বিস্ময়কর জগত! সেসব যাদুর মতো আকৃষ্ট করতো আমাকে। কোনোটা হাসির, কোনোটা কান্নার, কোনোটা হাসিকান্না-আনন্দ-বেদনা মেশানো। সে-সময় নাট্যচর্চায় এখনকার মতো অ্যাকাডেমিক কোনো কিছুরই সূচনা হয়নি। হাসির নাটকগুলোকে কমিক নাটক, আর দুঃখের নাটকগুলোকে প্যাথেটিক নাটক বলা হতো। কেউ কেউ দুঃখভারাক্রান্ত মনকে হালকা করতে সেসব নাটক দেখে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলতেন : কী প্যাথোজ!
তিনু মামা ছিলেন পাড়ার অনেকের নাট্যগুরু; আমার মতো এ-পাড়ার অনেকের নাট্যযাত্রা তাঁর হাতে শুরু; তাঁর হাতে হাতেখড়ি! এদের বেশ কয়েকজন জাতীয় ও অঞ্চলিক নাট্যবলয়ে এখন লব্ধ-প্রতিষ্ঠিত; অভিনেতা, নাট্যনির্মাতা, নির্দেশক ও সংগঠক। অবশ্য ক’জন সেকথা মনে রেখেছে—তা আমার কাছে এক বেদনা জাগানিয়া প্রশ্ন ও আক্ষেপ! সে আক্ষেপ আমাকে এখনও তাড়া করে ফেরে। মানুষ দ্রুতই অতীতের মানুষদেরকে অতীত করে দেয়।”
এটুকু বলেই তিনি চুপ মেরে যান; তার মধ্যে ভাবান্তর দেখা দেয়। দেখে মনে হয়, তিনি যেন অতীতচারী হয়ে গেছেন; তাকে নষ্টালজিয়ায় পেয়ে বসেছে। আমি তাকে তাড়া দেই : ‘কী হলো হায়দার ভাই? চুপ করে গেলেন যে!’ তিনি জগতে ফিরে আসেন। ‘নাহ! আজকে আর না। মনটা বিষণ্ণ লাগছে। পরে বাকিটুকু শুনবেন।’ বলেই আমাকে আর কোনো অনুরোধ করার সুযোগ না দিয়ে তিনি তার ঘরমুখো হন।
পরের দিন তাকে পাইনা। তারপর দিন সন্ধ্যার পর তার বাসায় হানা দিই। দেখি তিনি তার ছোট বয়সের ছবির অ্যালবাম হাতড়াচ্ছেন। নাহ! তেমন কিছু খুঁজে পেলেন না। আমি তাগাদা দেই তাঁর সাপুড়েজীবন শোনার জন্য। তিনি তাঁর সাপুড়ে জীবনের ধারেকাছে না গিয়ে যথারীতি আগের দিন নাট্যজীবনের যেখানে শেষ করেছিলেন সেখান থেকে শুরু করেন। এবং টানা বলে যান :
“অতি অল্পসময়ে আমি প্রাণপ্রিয় তিনু মামার পরিচালনায় অন্যান্য মামাদের সাথে অভিনয়ে সুযোগ পেয়ে যাই। পরবর্তীতে বকুল(নির্দেশক ও অভিনেতা) এবং তারও বেশ পরে এসে বকুলের বোন শেলী-ও যোগ দেয় আমাদের নাট্যদলে। উল্লেখ্য, তখনকার দিনে মেয়েদের চরিত্রে মেয়েদের অভিনয় ছিল বিরল ঘটনা। ছেলেরাই মেয়েদের চরিত্রে আভিনয় করতো এবং সেটা ছিল দর্শকদের জন্য বিশেষ কৌতূহলোদ্দীপক, উপভোগ্য ও আকর্ষণের বিষয়বস্তু।
আসল নাম হায়দার আলি খান হলেও আমি তখন পাড়ার সবার কাছে প্রাণপ্রিয় ‘ভাগনে’ হিসেবে ব্যাপক পরিচিত এবং সবার আদরের একজন হয়ে উঠি। আমি ছোটদের কাছে ‘মামা’ হিসেবে-ও সর্বজনপ্রিয়তা অর্জন করি। এবং বেশ অল্প বয়সেই আমার অভিনয়-কুশলতা দিয়ে পরিচালক, সিনিয়র সহ-অভিনেতা ও পাড়ার বন্ধুবান্ধব ও দর্শকদের মন জয় করে নেই।”- টানা কথাগুলো বলে তিনি বিরতি দেন।
অতি সংক্ষেপে, এই হলো খানসাহেবের নাট্যজীবনের সূত্র ও পটভূমি। পরবর্তীতে নানা অছিলায় তাঁর ছোটবেলায় বেড়ে ওঠা এবং নাট্যবেলার আরও কিছু দিক, চমকপ্রদ ঘটনা ও স্মৃতি আমরা খানসাহেবের বয়ানে শুনব।
আমি হায়দার সাহেবকে একযোগে উৎসাহ ও তাগাদা দেই : ‘আপনার নাট্যবেলার কিছু কথা শুনে খুব ভালো লাগলো। আপনার জীবনের নতুন একটা দিক জানলাম। এবার আপনার সাপুড়েজীবন নিয়ে আসল কাহিনি শোনান।’
তিনি আমার কথায় বিন্দুমাত্র আমল না দিয়ে আবার নাট্যকাহিনি জুড়লেন। এর মধ্যে মিসেস খান সান্ধ্য-জলপান পরিবেশন করলেন। ‘আর বলবেন না দাহার সাহেব, হায়দারের মুখে এই কাহিনি যে কতবার শুনেছি তার শেষ নাই।’ বলতে বলতে তিনি খাবার পরিবেশন করলেন। নিজেও বসলেন। এরপর খানসাহেব আবার শুরু করলেন :
“বেশ ক’ বছর পরে আরন্যকের মুক্তনাটক আন্দোলেনের কর্মশালা হয়েছিল পাবনাতে; ‘ইফা’ নামক একটি নাট্যশিল্পকলা চর্চাকেন্দ্রে। সেখানে ‘আদিম থেকে আজকে’ নামে একটি একখণ্ড নাটকও তৈরি এবং মঞ্চস্থ করি আমরা ক’জন। এটার আইডিয়া এবং নির্দেশনাও ছিল আমার। এটাতে তিনু মামা-ও অভিনয় করেছিলেন আমার নির্দেশনায়; মামার সাথে সেলিনা শেলী-ও ছিল- যতদূর মনে পড়ে।
একপর্যায়ে আমাদের বাড়ির আঙিনায় গড়ে তুলি ‘শিশু নাট্যম’। নাটকের রিহার্সেল, নাটক লেখা, অভিনয়, নির্দেশনা, প্রশিক্ষণ এবং বাড়িসংলগ্ন সবুজমাঠে নিজেদের হাতে মঞ্চ বানিয়ে নাটক মঞ্চায়ন শুরু করি। বিপ্লব ও জামান এ ছোট দুই ভাইকেও আমি এ-পথগামী করি। বোনেরাও আমার সাথে হাত লাগাতো, বিশেষ করে নীলা। নিয়মিত অসুবিধা হলেও মা কিন্তু অনিয়মিত বাধা দিতেন। তিনি ছিলেন দিনরাত নামাজি মানুষ। দিনেরাতে কত ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন আর দোয়া-দরুদ পড়তেন তার হিসাব ছিল না। তিনিও মাঝেমাঝে নামাজের ফাঁকে উকি দিয়ে এসে রিহার্সেল দেখতেন এবং চোখে পড়লে ভুল ধরিয়ে দিতেন; নির্দেশনা দিতেন। স্কুলবেলায় তিনি পাবনা গভারনমেন্ট গার্লস হাই স্কুলে পড়ার সময় পরবর্তীতে ভারতকাঁপানো নায়িকা সুচিত্রা সেনের সাথে স্কুল-নাট্যমঞ্চে অভিনয় করতেন। এটা নিয়ে তাঁর গর্বের শেষ ছিলনা! অমাদেরও তাই।
হায়! কোথায় হারিয়ে গেল সেই সোনালী বিকেল, স্নিগ্ধ সন্ধ্যা, মায়াবি সকাল, রাতের ঝলমলে-মঞ্চালো!”
এতটুকুন বলে তিনি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। বেশ কিছুক্ষণ অন্যমনষ্ক হয়ে রইলেন। মনে হলো তিনি পুরো নাট্যজীবনে একটা চক্কর দিচ্ছেন। আমিও আবিষ্ট হয়ে চুপচাপ বসে রইলাম। এরপর কথা আর বেশিদূর এগোলো না। আমার নিজের মনটাও ভারি হয়ে এলো। আর তার জীবনের এ অধ্যায়টুকু আরও বিস্তারিত জানার আকাঙ্খা তৈরি হলো: ‘আজ তাহলে উঠি। কালকে অপনার সাপুড়েজীবন শুনব।’ তিনি হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন। পরদিন তার সাথে আবার দেখা হলো পাড়ার মোড়েই; মিসেস খান-ও সাথে ছিলেন। তারঁ আজকের হাঁটাহাঁটির মধ্যে তেমন কোনো স্বাস্থসচেতন-ব্যস্ততার প্রকাশ নাই। স্ব-স্ত্রীক মধুআলাপে হাঁটছেন। আমার উপস্থিতি তাকে অপ্রস্তুত করল কিনা বোঝা গেল না। আমি কোনো কিছুর পরোয়া না করে আজকে তাকে তার সাপুড়েজীবন বলার জন্য একবোরে চেপে ধরলাম। মিসেস খান-ও তাতে সায় দিলেন : ‘বলো না! দাহার সাহেব যখন এত করে বলছেন, একটু শোনাও। এরপর তিনি ও মিসেস খান যে ২/৩টি ঘটনা শোনালেন তা শুনে তো আমার চক্ষু চড়কগাছ!
পরবর্তী কিস্তিতে তার সাপুড়েজীবন সম্পর্কে আমি যা শুনলাম তা আমি নিজমুখে আপনাদের শোনাব।