খানসাহেবের খণ্ডজীবন :: পর্ব ৮ । সিরাজুদ দাহার খান
প্রকাশিত হয়েছে : ২৬ জানুয়ারি ২০১৭, ১২:৩৫ পূর্বাহ্ণ, | ১৬০৮ বার পঠিত
জনৈক সুন্দরী এবং খানসাহেব
স্বাস্থ্যসচেতন এবং সদাসর্বদা ছোটবড় রোগাক্রান্ত ও অসুখভীতু মানুষ খানসাহেব। কিছুদিন হলো, পরিবার-আত্মীয়স্বজন এমনকি পরিচিত ডাক্তাররাও তার ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন। একটার পর একটা কমপ্লেইন তার লেগেই আছে। কয়েকজনের ধারণা, তিনি কয়েকটা বড় ধাক্কা খেয়েও শক্তপোক্ত না হয়ে দিন দিন আরও নাজুক হয়ে পড়ছেন- মানসিকভাবে। তার বেশির ভাগ স্বাস্থ্যগত অভিযোগ ডাক্তারসহ বেশিরভাগ মানুষই সাইকোসোমাটিক বা মনোদৈহিক ভাবতে শুরু করেছেন।অর্থাৎ তার দেহের সমস্যা মনে প্রভাবিত হচ্ছে এবং তারপর মনের সেই সমস্যা দেহে প্রভাবিত হচ্ছে; একটা কুচক্রের মতো! যাকে বলে ভিসিয়াস সার্কেল!
যাহোক, এরপরও খানসাহেব হাল ছাড়েননি! তার সমস্যাগুলোকে অবহেলা না করে সযত্নে লালন করে চলেছেনে এবং ফলত ক্রমাগত নতুন নতুন আলামত নিয়ে পরিবার-স্বজন-চিকিৎসককে অস্বস্তিকর অবস্থায় ফেলছেন।
চিকিৎসকের পরামর্শে নিয়মিত নিরানন্দে বিকেলে-সন্ধ্যায় হাঁটাহাঁটি করেন। শীতকালে ধুলাবালি থেকে রেহাই পেতে ‘না-খোশ’ পড়েন। তাতে নাকমুখ ঢেকে যায়; চোখে ভালো করে দেখতেও পান না তখন। গত মাসের শেষ সপ্তাহে মাথার নিচের দিকে এক সাইকোপ্যাথ বা যমদূত-প্রতিনিধির হাতে চাপাতি-কোপ খাওয়ার পরে খুব সাবধানে হাঁটেন, যেন কারো সাথে বা কিছুর সাথে ধাক্কা খেয়ে নতুন বিপত্তি না ঘটান।
সেদিন সন্ধ্যার পরপর আপন মনে হাঁটছেন আর সাতপাঁচ ভাবেছেন — আলো-অন্ধকারের মধ্যে। বলা নেই কওয়া নেই, হঠাৎ এক ছায়ামূর্তি তার পথ আগলে ধরলো; তিনি একাধারে হতচকিত ও আশঙ্কিত হলেন। রিফ্লেক্স অ্যাকশনে একটু পিছিয়ে গেলেন। ছায়ামূর্তিও একপা এগিয়ে এলো; মিহিকণ্ঠে বলে উঠল- ‘আঁপনের খুঁব ডঁর কঁরে, নাঁ?’ রীতিমতো পেত্নীকণ্ঠী!
সেকেন্ড দেড়েকের মধ্যে সম্বিত ফিরে পেয়ে তিনি বুঝতে পারলেন সেটি একটি নারীকণ্ঠ! তিনি প্রথমেই উদ্বেলিত হলেন এবং পরমুহূর্তেই ঘাবড়ে গেলেন। আধাবোরখা পরিহিতা এক সাধারণ অথচ সুন্দরি নারী; সপ্রতিভ; কনফিডেন্ট। চোখের পলকে মনে পড়ে গেল দুদিন আগের চাপাতিকোপের কথা। নিজের অজান্তেই ও্ই নারীর দু’ হাতের দিকে তাঁর চোখ গেল চকিতে। নাহ! চাপাতি না; তার দুই হাতে শীতবস্ত্র ও অন্যকিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় পোটলা।
‘আপনের দম আটকায়ে যায় না’ তার ২য় প্রশ্ন বুঝতে একটু সময় লাগলো। তিনি খানসাহেবরে নাকেমুখে পড়া ‘নাখোশ’ দেখে নাখোশ হয়ে খানসাহেবের মাস্কের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করলেন।
‘নাহ্’!- তিনি প্রথমে আমতা আমতা করে ভীতকণ্ঠে, এবং দ্বিতীয়বার স্বকণ্ঠে জবাব দিলেন — নাহ! দম আটকাবে কেন?’
নারীমূর্তির মনমতো হয়নি জবাব। জবাব গ্রহণ না করে তিনি পালটা প্রশ্ন করলেন: মরণের ভয়ে নাকেমুখে এডা কী পড়ছেন।’
তার মোটিফ তখনও বুঝে উঠতে পারেননি। তিনি স্বাভাবিক কৌতূহল নিয়ে জবাব দেন — ‘এইডার নামা নোজ মাস্ক মানে না-খোশ’ — আপনার কোনো সমস্যা?
‘নাহ্! আমার আবার কী সমস্যা্? সমস্যা তো আপনের। আপনে মরনের ভয়ে মুখোশ পইড়া দম আটকায়া হাঁটতাছেন।’
‘মরনের ভয়ে না; ধুলাবালি থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য’- খানসাহেবের এ জবাবে কোনোরকম পাত্তা না দিয়ে তিনি হেদায়েতি ভাষায় তাঁকে সবক দিয়ে যাচ্ছেন —
‘কেউ-ই বাঁচাইতে পারবনা আপনেরে। যেদিন আল্লা মরণ লিখ্যা রাকছে সেদিন কেউ ঠেকাইতে পারবোনা। আজরাইল যখন আইবো….’
‘মরন ঠেকাইতে এইডা পরি নাই; পারছি কষ্ট ঠেকাইতে। ধুলাবালি নাকে ঢুকলে নানারকম রোগবালাই হইতে পারে; তাতে কষ্ট বাড়বো। যতদিন বাঁইচা আছি, ততদিন তো ভালো থাকোনের চেষ্টা করতেই হবে। না-কি?’ — খানসাহেব এবার বেশ দৃঢ়তার সাথে জবাব দেন। কিন্তু ওই সন্ধ্যানারীর মুখস্ত বুলি আওড়ানো থামে না তাতে—
‘কষ্ট করতেই হইবো। আল্লার দুনিয়ায় যত দিন আছেন, ততদিন আপনেরে কষ্ট করনই লাগবো। আল্লা অাপনেরে পরীক্ষা করতেছে।’
এবার খান সাহেবের মেজাজ চড়ে যায়। তাকে দমিয়ে দেয়ার মতো খুব অপমানজনক একটা উপমা মুখে এসে গেলেও তা জেন্ডার-অসংবেনশীল হতে পারে বিধায়, তিনি নিজেকে সংযত করলেন এবং কথা ঘুরিয়ে তরা হাতে দিকে তাকিয়ে বললেন—
‘আপনের দুই হাতে কী?’
‘কম্বল’ — নারীকণ্ঠ তাকে জবাব দেয়।
‘কেন কম্বল কী করবেন?
‘রাইতে শীতে কষ্ট অয়; কষ্ট কমানোর লা্ইগ্যা!”
‘আমারে দিয়া যান।’ বলে খানসাহেব ওই নারীর কম্বলের দিকে হাত বাড়িয়ে দেন। এবং কম্বল ধরে বসেন।
হেদায়েতকারিণী এবার বাস্তব জগতে ফিরে এসেছেন। এক ঝটকায দই পা পিছিয়ে যান —
‘কেন, আমার কম্বল আপনেরে দিমু কেন? আমি শীতে কষ্ট পামু না।’
খানসাহেব দুইপা এগিয়ে গিয়ে ওই নারীর চেকে চোখ রেখে টেনে টেন সুর করে বলেন
‘কঁষ্ট কঁরতেই হঁইবো। আঁল্লার দুনিয়াঁয় যঁত দিন আছেন, তঁতদিন আঁপনেরে কঁষ্ট করন-ই লাঁগবো। আল্লা আপনেরে পরীক্ষা কঁরতেছে।’ — খানসাহেব তার কথা তাকেই ফিরিয়ে দেন এবং ছবক — নারীর মুখ বন্ধ করে দিয়ে আবারও নাকেমুখে ‘না-খোশ’ পরে আত্মতৃপ্তি নিয়ে সদর্পে হাঁটতে থাকেন। ৫ কদম হাঁটার পর পেছন ফিরে একনজর তার কথার আছর কতটা হলে তা বোঝার চেষ্ট করেন।
ওই নারী খানসাহেবের গমনপথের দিকে তাকিয়ে থেকে আপন মনে বলে : ‘লোকডা খুউব ঠ্যাঁডা!’