খানসাহেবের খণ্ডজীবন :: পর্ব ৭ । সিরাজুদ দাহার খান
প্রকাশিত হয়েছে : ১৫ ডিসেম্বর ২০১৬, ১০:৪৪ অপরাহ্ণ, | ১৮১০ বার পঠিত
দ্বিতীয় আংটি প্রথম বিয়ের পর
বেশ কিছুদিন বিরতি দিয়ে সেদিন খানসাহেবের সাথে আমার দেখা। তাঁকে প্রায় নিয়মিত দেখা যায় পশ্চিমপাড়ায় আধা-জোরকদমে হাঁটাহাঁটি করতে। মাঝে মাঝে নিজের পাড়ায় অর্থাৎ পূর্বপাড়াতেও তাঁর সাথে দেখা হয়।
পায়ে বাটার নীলসাদা নর্থস্টার হন্টনকেডস। পরনে ঢিলেঢালা প্যান্টস, আর গায়ে ফতুয়া। এটা তাঁর ব্র্যান্ডিং। দূর থেকে দেখলেও তাঁকে চিনতে কষ্ট হয় না। শুধু আমি না; পাড়ার ছোট ছোট ছেলেমেয়েরাও তাঁকে দূর থেকে চিনতে পেরে মৌমাছির মতো ভিড় করে এবং যথারীতি তাঁর হাত ধরে হাঁটতে শুরু করে। তারপর তাঁর সাথে ওরা নানা মিষ্টিমধুর গল্প জুড়ে দেয়। ওদের সরলসহজ গল্প-কথা নিত্যনৈমিত্তিক জীবনাভিজ্ঞতা শুনতে শুনতে তাঁর হাঁটার সময়টাও নিটোলেপায়ে পার হয়ে যায়। তিনি এসব বেশ উপভোগ করেন এবং জীবনের বাকি সময়টার জন্য ওদের কাছ থেকে মূল্যবান রসদ কুড়িয়ে নেন। তাঁর ছোট ছোট দুষ্টুমিমাখানো হেঁয়ালিময় কথাবার্তায় ওরাও অভ্যস্ত হয়ে গেছে। এবং সেসব বেশ উপভোগ করে ওরা। আজকাল সুযোগ পেলেই ওরাও তাঁকে দু’একটা ‘হেঁয়ালি-কথা’ উপহার দেয়।
আজকেও এমন কিছুই চলছিল। হঠাৎ আমি হাজির হওয়াতে ওদের রসমধুর শিশুসূলভ জ্ঞানগর্ভ্ আলাপে যতিচিহ্ন পড়ল। ওরা কিঞ্চিৎ নিরাশ হয়ে আমাকে জায়গা করে দিয়ে আলগা হয়ে গেল। এবং পরক্ষণেই দলবেঁধে নিজেদের খেলাধুলায় মেতে উঠল।
খানসাহেব আমাকে পেয়ে যেন নতুন জীবনীশক্তি খুঁজে পেলেন। আমার সাথে তাঁর বেশ ভালো যায়। কারণ, তিনি তাঁর যত আজগুবি কথাবার্তা আর তাঁর জীবনের অম্লধুর কাণ্ড ও ঘটনাসঞ্চয় বিনা-পয়সায় বিতরণের এবং তা শ্রবণের লোক আমি ছাড়া খুব বেশিজনকে পান না। বন্ধুবান্ধব বেশিরভাগই আধুনিক ও যান্ত্রিক যুগযন্ত্রণায় কালাতিপাত করে জীবন কাটায়। তাদের হায়দার আলী খানের জীবনখণ্ড শুনে সময় নষ্ট করার সময় নাই। অবশ্য এসব নিয়ে খানসাহেবের কোনো আক্ষেপও নাই।
জিজ্ঞেস করলাম : কেমন আছেন খানসাহেব?
তিনি যথারীতি তাঁর অভ্যাসমতো জবাব দিলেন —
: ভালো আছি বলাই নিয়ম; তাই ভালো আছি!
: মানে কী!
: মানে আবার কী? যা বললাম তা-ই। আকেলমন্দ-কি লিয়ে ইশারাই ক্বাফি।
: মানে, আপনি আসলে ভালো নাই? ভালো অছি বলতে হয়, তাই ভালো আছি বলছেন — এই তো!
অপারেশন টেবিলে শুয়ে-থাকা একজন বাইপাস সার্জারি করা হার্টের পেশেন্টের এ-রকম আচমকা রসিকতায় তিনি খুব মজা পেলেন! তাঁর মৃদুশব্দ হাসিতে সেটা অস্পষ্ট অনুভব করলাম আমি। আমার হৃদয়তন্ত্রীতে তা নরম শিহরণ জাগালো! তিনিও কম গেলেন না…
জবাবে তিনি হো হো করে হেসে উঠলেন। আমিও তার সাথে অনিচ্ছায় যোগ দিলাম।
জিজ্ঞেস করলাম : ভাবীর সাথে কিছু হয়নি নিশ্চয়ই!
তিনি তো অমায়িক মানুষ! আমার কথায় তিনি বেশ আমোদিত হলেন এবং স্ব্ভাবসুলভ ভঙ্গিতে বললেন —
: তা বটে! আপনার ভাবী না থাকলে এতদিনে আমি কোন সাগরে ভেসে যেতাম! তখন এখানে না; আপনার সাথে আমার দেখা হতো মহাসাগরে, বুঝলেন দাহারসাহেব! সমুদ্রমন্থন আর-কি!
বলে কী-একটা দামী সাহিত্যিক বচন বলেছেন — এ-রকম একটা ভাব নিয়ে তিনি আবারও হেসে উঠলেন। শেষ কথাটার আগামাথা কিছু না বুঝেই আমিও নিরুপায় হয়ে বেচারার সাথে হাসতে লাগলাম, অর্থহীনভাবে। একসময ওনার হাসি থামলে আমি আবারও জানতে চা্ইলাম —
: আসলেই আপনি কেমন আছেন জানতে ইচ্ছে করছে, হায়দার ভাই, অনেকদিন পর দেখা হলো। ভাবী কেমন আছেন? তিনি সংক্ষেপে জবাব দেন —
: ভালো।
: আপনি?
: কেটে যাচ্ছে; কিন্তু রক্ত বেরোচ্ছে না।
এ-রকম সাধারণমানের প্রচলিত রসিকতা তিনি সাধারণত করেন না। সেটা নিজেই বুঝতে পেরে হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন তিনি। আমি একটু ভড়কে গিযে বললাম : বাদ দেন এসব কথা। আসেন, আমরা অন্য গল্প করি। জীবনের ভালো কোনো স্মৃতিকথা শোনান।
আমার নতুন প্রস্তাবে তিনি যেন একটু ধাতস্থ হলেন। বললেন —
: শুনবেন! আজ তাহলে একটা রোমান্টিক গল্প শোনাই।
: না না, রোমান্টিক না! আপনার ওসব হাত-বানানো রোমান্টিক গল্প অনেক শুনেছি। আজকে ভাবীর সাথে কীভাবে আপনার পরিচয় হলো সেই গল্পটা শোনান। কোথায় কীভাবে প্রথম দেখা হলো; কীভাবে প্রেম হলো, পরিণয় হলো — এসব শোনান। আজ অনেকদিন ধরে শোনাব শোনাব করেও শোনাচ্ছেন না।
: দিলেন তো মুডটা নষ্ট করে। আমি কখনো হাত-বানানো রোমান্টিক গল্প বলি না, তা আপনি ভালোভাবেই জানেন। আর আজকে যেটা শোনাব সেটা ঠিক গল্প না, সত্যি ঘটনা।
আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। নিজেকে সামলে নিয়ে দ্বিগুণ উৎসাহ প্রদর্শন করলাম। বেশ উৎসুক কণ্ঠে বললাম, ‘আরে না না হায়দার ভাই। আমি আসলে কথার কথা বলেছি। আপনি একজন খাঁটি মানুষ। কখনো হাত-বানানো কাহিনি বলেন না। তবে মাঝে মাঝে একটু হেঁয়ালি করেন বলেই লোকে বিভ্রান্ত হয়; আপনাকে কেউ কেউ ভুল বোঝে।’
খানসাহেব ততক্ষণে নিজের মুডে ফিরে এসেছেন। বললেন, ‘তাহলে আপনিই বলেন, কী গল্প শুনতে চান আজ। একটুও বানিয়ে বলব না; হেঁয়ালিও করব না।’
‘শুনলাম। কয়েকদিন আগে ২৮তম হানিমুন করতে ভাবীকে নিয়ে কোন জঙ্গলে গিয়েছিলেন। খুবই নাকি রোমান্টিক ছিল সেটা। ওইটা লোকের মুখে শুনেছি। আজকে আপনার নিজের মুখে শুনব।’
আমার কথা শুনে খানসাহেব খুবই হৃষ্টচিত্ত হয়ে উঠলেন। তার চোখেমুখে আমি পুলক দেখতে পেলাম। কিন্তু তিনি কথা ঘুরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আরে আপনি তো খুব বেরসিক মানুষ। নিজের স্ত্রীর সাথে কতবার হানিমুন হয়? আজকে এমন একটা ঘটনা শোনাব যে আপনার অপূর্ণ সাধ পূর্ণ হয়ে যাবে।’
‘আজকে তহেলে নিশ্চয়ই ভাবীর সাথে কীভাবে আপনার পরিচয় হলো সেই গল্পটা শোনাবেন। কোথায় কীভাবে প্রথম দেখা হলো, কীভাবে প্রেম হলো, পরিণয় হলো — এসব শোনাবেন।’
‘ওটা আরেকদিন হবে। আজকে খাঁটি রোমান্টিক ঘটনা শোনাব।’ বলেই তিনি তাঁর গল্প বলা শুরু করলেন —
গল্পের একটা রোমান্টিক শিরোনামও দিলেন — ‘দ্বিতীয় আংটি প্রথম বিয়ের পর’! শিরোনাম শুনেই আমি বিশেষ কৌতূহলী হয়ে উঠলাম। খানসাহেবরে জীবনের কোনো গোপন অধ্যায় আজ ফাঁস হবে — এই ভেবে কিছুটা অস্বস্তিও বোধ করতে লাগলাম। তিনি আমার চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটালেন —
: আজ থেকে বছর তিনেক আগের ঘটনা। …
: ৩ বছর! মানে দুই হাজার ত্যা …
তিনি আমাকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না-দিয়ে টানা বলে গেলেন তাঁর রোমান্টিক গল্প। তিনি আবেগ মিশিয়ে তাঁর জীবনের আমার-অজানা একটা ছোট্ট গল্প শোনালেন —
“চাহিদা ছিল ৫টা। পেলাম মাত্র ৩টা। অনেক দাম দিয়ে কিনতে হলো। পরানো হচ্ছিল বেশ যত্ন করে। বিয়ের আগে বা পরে বা বিয়ের সময়ও এতগুলো রিং কখনো পরতে হয়নি। যে সুন্দরী ম্যাডাম আমার প্র্থম বিয়ের পর দ্বিতীয়বারের মতো রিং ৩টা অতি যত্ন সহকারে পরাচ্ছিলেন, তাঁকে মোলায়েম সুরে বললাম —
: ভালোবেসে খুব দামি রিং পরাচ্ছেন; দেখবেন যেন খুলে পড়ে না যায়।
অপারেশন টেবিলে শুয়ে-থাকা একজন বাইপাস সার্জারি করা হার্টের পেশেন্টের এ-রকম আচমকা রসিকতায় তিনি খুব মজা পেলেন! তাঁর মৃদুশব্দ হাসিতে সেটা অস্পষ্ট অনুভব করলাম আমি। আমার হৃদয়তন্ত্রীতে তা নরম শিহরণ জাগালো! তিনিও কম গেলেন না। বললেন —
: এ আমার যত্ন ও ভালোবাসার রিং। কোনো ডাক্তারও হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে আপনার হৃদয়ে আমার লাগানো আংটি কখনো খুলতে পারবেন না! টেক ইট ফর গ্যারান্টেড!”
গল্পটা একনিঃশ্বাসে শেষ করে আমাকে বোকা বানিয়ে খানসাহেব মুচকি মুচকি হাসতে লাগলেন।
কোথায় ভাবীর সাথে তার প্রেমকাহিনি অথবা এক্সট্রাম্যারিটাল কোনো গল্প বা তাঁর জীবনের অন্য কোনো গোপন কাহিনি শুনব! তা না, আমাকে হতাশ করে এবং বোকা বানিয়ে তাঁর হার্টে রিং পরানোর মতো একটা নিরস ঘটনায় রোমান্টিকাতর চাদর পরিয়ে আমাকে তা উপহার দিলেন। আবার বিজয়ের হাসি হাসছেন।
আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলাম!