খানসাহেবের খণ্ডজীবন :: পর্ব ৬ । সিরাজুদ দাহার খান
প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ নভেম্বর ২০১৬, ১০:১৪ অপরাহ্ণ, | ১৮৪২ বার পঠিত
জল ও জঙ্গলে তাহাদের ২৮ বছর # ৩য় কিস্তি
[যাদের ‘জেনেশুনে বিষ পান করেতে’ আপত্তি নেই, এবং যাদের হাতে ‘অকেজো জিনিশ’ পাঠ করার মতো সময় বা আগ্রহ আছে, তাদের জন্য এ লেখা মুক্ত করা হলো। এটা না-ছোটগল্প, না-স্মৃতিচারণ, না-সাহিত্যপদবাচ্য কোনোকিছু। এটা খানসাহেবের অন্যান্য ঘটনার মতো সার্কাস্টিক বা রম্যরচনাও নয়; এটি তাঁর জীবনাকাশ থেকে খসে-পড়া একটি মহার্ঘ দিনের দীর্ঘ আলেখ্য! তাঁর ফরমায়েশে তাঁর নিজের জন্যই লেখা। কেউ যদি এটা পড়ে বিন্দুমাত্র কোনো আনন্দ-বেদনাজাত নৈকট্য অনুভব করেন, তাতে তিনিও আনন্দ পাবেন; কৃতার্থ হবেন। কেউ যদি বিরক্ত হন, তিনি তাঁর নিজগুণে স্বেচ্ছায় নিজেকে বিরক্তিমুক্ত করে নেবেন বলেই খানসাহেবের বিশ্বাস! সহৃদয় পাঠকের ধৈর্যসীমা বিবেচনায় নিয়ে ৩ কিস্তিতে ভাগ করে এটা মুক্ত-আকাশে উড়িয়ে দেয়া হলো।]
২য় কিস্তির শেষাংশ
গাড়ি ভেতরে ঢুকে বাম দিকে একটা ছোটখাটো শোভন বাঙলোর সামনে থামলো। সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। এই সুন্দর বিশাল বাঙলোকে নিজেদের রেস্টহাউজ ভেবে তুষ্টিবোধ করার আগেই সবাই জেনে গেল, ওটা ওদের না; ওটা পাইলটসাহেবের নিজস্ব বাঙলো ছিল একসময়। এখন কিছু ফার্নিচার রাখা আছে। এখানে আসলে পাইলট সাহেব অদূরেই আরেকটা রেস্টহাউসে থাকেন। এরপর কিছুদূর হাতের ডানে হাঁটতেই তাদের জন্য বরাদ্দকৃত রেস্টরুম দেখে সবার তো আক্কেল গুড়ুম! কোথায় বাঙলোবাড়ি? একটা বটগাছের ছায়ায় খড়পাতা আর বাঁশের ছাউনি দেয়া, চারদিক খোলা একটা ঘরে একটা সাদামাটা টেবিল, কয়েকটা সোফা আর একটা সিঙ্গেল বিছানা পাতা।
৩য় কিস্তি # জল ও জঙ্গলে গোধূলিলগ্ন
কিন্তু ধাতস্থ হতে সময় লাগলো না। প্রদীপ্ত যথারীতি সেখানে বিছানায় শুয়ে পড়ল। চারপাশের মনোরম পরিবেশ, জঙ্গলের নিস্তব্ধতা, সামনে বিরাট জলাশয়, একপাশে অবাধ জল-থৈথৈ প্রান্তর, পাখির গান আর দূরে বসা একজন পল্লিবাউলের টুংটুং সারিন্দার শব্দে, রেস্টরুম নিয়ে চিন্তা করার কথা নিজেদের অজান্তেই ভুলে যায় সবাই। উপমা ও শুভ্রা স্বগোতোক্তি করে ওঠে : ওয়াও! মিসেস খানও তাতে সায় দেন। কিন্তু প্রদীপ্ত যথারীতি অন্য সুরে কথা বলে : আর জীবনে আপুর বুদ্ধিতে বাঙালি নামের কোনো জায়গায় যামু না। কোথায় একটা ‘চিল্’ জায়গায় যাব, তা-না, আইলাম একটা জঙ্গলের মইধ্যে। তা-ও যদি দুই-একটা বাগভাল্লুক থাকত, তাইলে একটা কথা আছিল। একটু অ্যাডভেঞ্চার হইতো…
দিনের বাকি সময়টা কীভাবে কাটলো তা জানার আগে এ ‘কাব্যে’র একটা মোটাদাগের চিত্র জেনে রাখা ভালো।
দক্ষিণমুখী বড় গেট দিয়ে উত্তর দিকে ঢুকেই বামদিকে একটি সুন্দর বাঙলো। এ কাব্যের প্রতিষ্ঠাতা ও মালিক পাইলট কামালের জন্য ওটা সংরক্ষিত ছিল। এখন পুরোনো ফার্নিচার রাখা আছে। বাঙলোর পাশে একটি বড় পুকুর; ওটাকে দীঘি বা জলাশয় বললেও ভুল হবে না। সে-পুকুর বামে রেখে একটু এগোতেই ছোট খড়ের ছাউনি দেয়া উন্মুক্ত কটেজ; বিশ্রামঘর। একেবারেই গ্রামীণ পটভূমিতে গড়ে তোলা হয়েছে এই ‘জল ও জঙ্গলের কাব্য’। রাতে থাকার ব্যবস্থা থাকলেও ইটকাঠের কৃত্রিম রিসোর্ট না এটি। মনোরম মুক্ত পরিবেশ; অসীম প্রান্তর। গাছগাছালি, পাখপাখালি, জলাশয়, বিলপ্রান্তর, জলপ্রান্তর — সেখানে চলাচলরত দু-একটি ছোট ছোট ডিঙি নৌকা — মা ও মেয়ে সেটায় কাব্যের অতিথিদের জন্য রসদ নিয়ে আসছে।
খানসাহেবদের বিশ্রামছাউনির বাম পাশেই মুক্ত পরিসরে পরিচ্ছন্ন রন্ধনশালা। মাটির চুলায় কাঠখড়ি দিয়ে রান্নবান্না চলছে; কোনো গোপনীয়তা নাই। স্থানীয় নারী ও পুরুষেরা, বউ-ঝিয়েরা এখানে নিয়মিত-অনিয়মিত রান্না করে; প্রয়োজনমাফিক ডাক পড়ে তাদের। অতিথিরা যা যা খান ওনাদেরকেও একই খাবার দেয়া হয়। কারো মধ্যে বিরক্তির ছাপ নাই।
বিশ্রামছাউনির ডানপাশেই জলরাশির ওপর বাঁশের পাটাতন দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে একটা সংগীত ও বাউলমঞ্চ। সেখানে অতিথিদের জন্য অপেক্ষমাণ টুংটাংরত এক স্মিতহাস্য প্রশান্ত মনের নিঃসঙ্গ বাউল।
রাতে থাকার জন্য ছোট ছোট কটেজ তথা পল্লিকুটির আছে। এর মধ্যেই স্বাস্থ্যকর স্নানঘর। অন্যান্য দিন অনেক গেস্ট থাকে; সেদিন ছিল না। এদিন আর কোনো মেহমান না-থাকায় দিনটি ছিল আরও নিরিবিলি, ছিমছাম। যেন খানপরিবারের জন্যই দিনটি উৎসর্গ করা হয়েছে। ভালো লাগার রেশ শুরু হওয়ার আগেই প্রদীপ্তের কথার মাঝেই জঙ্গলকাব্যের লোকজন জানতে চায় —
: স্যার, ব্রেকফাস্ট দিয়ে দেই? খানসাহেব কিছু-একটা বলতে যাচ্ছিলেন, তার মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে প্রদীপ্ত মুখ ফসকে বলে ফেলে —
: আবার জিগায়!
মিসেস খান ছেলের এহেন কথায় বিব্রত বোধ করেন। তিনি ছেলেকে চোখ রাঙান। তাতে ছেলের মধ্যে কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। সে আবার বললো, : তাত্তারি করেন, তাত্তারি করেন! সেই রাতের থেকে না-খেয়ে আছি আপনাদের মজার ব্রেকফাস্টের জন্য। আব্বু কী বলো?
নিজের মনের কথা বলায় খানসাহেব পুত্রের কথায় দ্রুত সায় দেন। তিনিও অত্যন্ত ক্ষুধার্ত। কোথাও বেড়াতে বের হলেই তার ঘনঘন খিদে পায়। এ নিয়ে তাকে মিসেস খানের কাছে কথাও শুনতে হয়। কিন্তু আজকে মিসেস খানও সায় দেন। খানসাহেব সবাইকে হাতমুখ ধুয়ে আসতে বলেন। নিজে দ্রুত ফ্রেশ হয়ে খেতে বসে যান; ছেলে হাতমুখ না ধুয়েই এটা-ওটা বিশেষ করে মাংসের বাটিতে হাত ডুবায়; কয়েক টুকরা মুখে পুরতে থাকে।
ওহ্, কত পদের নাস্তা! উপমা ও শুভ্রার চোখেমুখেও স্নিগ্ধতা ঝিলিক দিয়ে ওঠে। লুচি, চালের রুটি, স্পেশাল সবজি, অসাধারণ সুস্বাদু চিকেনকারি, পায়েস, জিবে জল চলে আসার মতো মুগ-বুটের ডাল সবাই গোগ্রাসে গিলতে থাকে। স্বল্পাহারী ও এটিকেট মেইনটেন করায় অভ্যস্ত মিসেস খানও এ গোত্রভুক্ত হয়ে যান। এমনকি, উপমা, যাকে বাসায় পেট পুরে খাওয়াতে বাবা-মাকে হিমশিম খেতে হয়, সেও কম যায় না
: আম্মু, এই রকম রান্না করবা। দেখ আমি সবজিও খাচ্ছি। শুভ্রা বলে : আসলেই, কোনটা রেখে কোনটা খাব বুঝতে পারছি না।
খানসাহেব চুপচাপ খাওয়ায় মনোযোগ দেন। ছেলের নজর প্রধানত লুচি আর মাংসের দিকে : আচ্ছা এই সবগুলান খাবারই তো আমাদের। যা বাঁচবে তা নিয়ে যেতে পারব না? একটা টিফিন ক্যারিয়ার আনলে ভালো হতো।
সে আয়েস করে খেতে থাকে। মিসেস খান তার চিরাচরিত অভ্যাসে খাবারের রেসিপি আর রন্ধনপ্রণালি শুনতে ব্যস্ত হয়ে যান। তা দেখে খানসাহেব ও উপমা চোখাচোখি করেন। মৃদু হাসেন। খানসাহেব কী-একটা নেতিবাচক কমেন্ট করতে যাচ্ছিলেন, উপমা চোখের ইশারায় তাকে থামিয়ে দেয়।
একসময় নাস্তা শেষ করে সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়ে। শরীরে আলসেমি দেখা দেয়। কিন্তু না! এখানে আলসেমি করে সময় নষ্ট করা যাবে না। ইতোমধ্যে উপমা শুভ্রাকে নিয়ে বাঁশের তৈরি পাশের খোলা মঞ্চে বাউলের দরবারে হাজির হয়েছে। একটু পরে খানসাহেবও যান এবং যথারীতি বাউলের পাশে রিল্যাক্সে শুয়ে পড়েন। বাউল টুংটাং বাজাতে থাকে; ৩জনে গান ধরে। প্রথম দিকে বাউল ওদের গানের তালে থাকলেও, পরে প্রায়-বেসুরো গলায় নানা ধরনের গানের জগতে সবাই বিচরণ শুরু করে। একটু পরে মিসেস খান এসে তাঁর অভ্যাসের ব্যতিক্রম ঘটিয়ে বিনা আুনরোধেই তার পুরোনো সংগীতচর্চা ঝালাই করতে থাকেন এবং একসময় তিনি হয়ে ওঠেন মধ্যমণি। কিন্তু বাউলের ঝঙ্কার আর অন্যদের অ-বাউল গানের সুরমুর্ছনার মধ্যে ঐকতান না ঘটায় আসর তেমন জমে ওঠে না।
ওদিকে আয়েসে পুরো মংসের বাটি ফিনিশ করে বেশ পরে প্রদীপ্ত হেলেদুলে এসে দলে যোগ দেয়। এবং প্রায়ব্যর্থ গানের আসর যখন ভেঙে যাওয়ার পথে তখন বেসুরো গলায় দরাজ কণ্ঠে গেয়ে ওঠে : ওরে নীল দরিয়া, আমায় দে রে দে ছাড়িয়া। মুহূর্তেই আসর আবার জমে ওঠে। খানসাহেব পুত্রধনের এহেন প্রতিভা দেখে খুশিতে গদগদ হয়ে শোয়া থেকে উঠে প্রথমে বসেন; তারপর কখন যেন দাঁড়িয়ে যান এবং ছেলের সাথে আরও দরাজ কণ্ঠে নিজের সংগীতপ্রতিভা প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। নিরিহ বাউল তার দোতারার সুর-তাল-লয় হারিয়ে ফেলেন।
এপর্বে উজ্জীবিত হয়ে একটু পরে পরবর্তী পর্বে যাত্রা শুরু করেন সবাই। জল ও জঙ্গলের রূপ-রস-গন্ধ ও যাবতীয় সৌন্দর্য উপভোগ ও মনের গভীরে গেঁথে নেয়ার জন্য ৪জন সামনের মস্ত বড় একটা জলাশয়ের ধার ধরে ডানদিকে হাঁটতে থাকেন। প্রদীপ্ত যথারীতি গতরাতের কম ঘুমের ক্লান্তি আর জলকাব্যের নাস্তার শ্রান্তিতে বাউলের পাশে গভীর ঘুমে ডুবে যায়।
‘এখানে একটু নৌকায় চড়ে ভাসতে পারলে ভালো হয়’ — খানসাহেব প্রস্তাব করেন। সবাই হৈহৈ করে ওঠে। মিসেস খান নিরুৎসাহিত করেন। তিনি নৌকায় চড়তে ভয় পান। অন্য কেউ চড়লেও ভয়ে তার বুক দুরু দুরু করে। যদিও মাসকয়েক আগেই উপমা ও খানসাহেবের চাপাচাপিতে আর মাঝির অভয় বাণীর ওপর ভর করে তিনি সিলেটের সুন্দরবন রাতারগুলের গভীর জলে চিকন একটা ডিঙি নৌকায় ২ ঘণ্টা চড়ে উতরে এসেছেন। তবুও প্রস্তাব ভেস্তে যায়।
জলকাব্যের লোকেরা সমস্যার সমাধানে জানায় : নৌকাভ্রমণ এখন না; বিকেলে ভালো হবে।
ইতোমধ্যে উপমা আর শুভ্রা অপূর্ব প্রকৃতি-নিসর্গের ছবি আর সেলফি তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মিসেস খানকে নিয়ে খানসাহেব একটা দোলনায় বসে বসে দোল খাচ্ছিলেন। তিনি বেমক্কা বলে ওঠেন : তোরা শুধু তোদের ছবি তোলা নিয়েই ব্যস্ত হয়ে গেলি। আজকে কাদের ম্যরেজ ডে? তোদের, না আমাদের?
তাঁর রসিকতায় ওরা দু’জনেই অভ্যস্ত হলেও এতটার জন্য ওরা প্রস্তুত ছিল না। প্রথমে একটা ধাক্কা খেলেও পরমুহূর্তেই ওরা সামলে ওঠে। এবং হাসতে হাসতে আক্ষরিক অর্থেই মাটিতে গড়িয়ে পড়ে। এরপরে মা-বাবার যুগলবন্দি করতে আর ভোলে না। ওদের আনন্দের আর সীমা থাকে না। ঘুরেফিরেই প্রকৃতিবন্দনা শুরু করে। খানসাহেব বানিয়ে বানিয়ে ওদের সাথে তাল মেলান; মিসেস খান এত কথা পছন্দ করেন না। তিনি নীরবে এসব উপভোগ করতে পছন্দ করেন। মুখে খুব কম মন্তব্য করেন আর খানসাহেবের হাতে হাত রাখেন। তবে হঠাৎ তাঁর মনের অর্গল খুলে গেলে তিনি বেশ গুছিয়ে অন্যের কাছে প্রকৃতিকে সাজাতে পারেন।
অদ্ভুত সুন্দর এ রাস্তাটা! বামপাশে বিরাট দীঘির মতো জলাশয়। মাঝে মাঝে দু একটা গাছ তাকে ছায়া দিচ্ছে। বেশ কিছু গাছে তরতাজা থোকা থোকা আমড়া ধরে আছে; নুয়ে পড়েছে দীঘির জলের দিকে। জল ঝিকমিক করছে খরতাপে দগ্ধ হয়ে। দুয়েকটা নৌকা বাঁধা। এপার থেকে ওপারটা কেমন মায়াবী লাগছে।
: যদি ওপারে যেতে পারতাম!
: আমরা তো ওপারের দিকেই যাচ্ছি। মিসেস খান বলেন —
: দেখ দেখ! মেঠো পথে গাছের পাতা ঝরে পড়ে আছে। মনে হচ্ছে, পাতার বিছানা পাতা। সারি সারি ঘনগাছ। যেন দীঘিটাকে বাইরের জগৎ থেকে আড়াল করে রেখেছে। ওপরে স্বচ্ছ আকাশ। কতদিন পরে এমন দৃশ্য চোখে পড়ল। তার চোখে আনন্দবিন্দু দেখা যায়। মিসেস খানের এত সুন্দর প্রকৃতি-অনুভূতি ও তার নিপুণ বর্ণনা শুনে সবাই মুগ্ধ হয়ে যায়। খানসাহেবকেও স্ত্রীর প্রতি মমতা ও মুগ্ধতা জড়িয়ে ধরে। খানসাহেব তাকে কাছে টেনে নেন।
“আন্টি, আপনি এত সুন্দর করে দৃশ্যবর্ণনা করলেন। অদ্ভূত সুন্দর বর্ণনা! আপনি লেখালেখি করলেও পারতেন।” — শুভ্রার প্রশংসায় তিনি একাধারে অস্বস্তি ও প্রশান্তি লাভ করেন। তার মন ভরে যায়। খানসাহেব সহ পুরো পরিবেশটাই তার কাছে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। খানসাহেবের মধ্যেও সে-আনন্দ সঞ্চারিত হয়। তার ভালোলাগা দ্বিগুণ হয়ে ওঠে। এ-সময় তিনি তাঁর ছেলের অভাব বোধ করতে থাকেন। কী মিসটাই না করল ছেলেটা আমার! — তিনি স্বগতোক্তি করেন। আবার ভাবেন — ঠিক আছে! ও রাতে ঘুমায়নি। এখন একটা ডাঁশা ঘুম দিয়ে উঠলে পরে ওর কাছে সবকিছুই মনোরম মনে হবে।
হাঁটতে হাঁটতে একসময় পথ থেমে যায় একটা ঝোপের মাথায়। অন্যরা থেমে যায়। কিন্তু খানসাহেবের মধ্যে ঘোর লাগে; হাঁটতে হাঁটতে পুরো জলাশয়টা ঘুরে আসার নেশা পেয়ে বসে তাঁকে। তিনি কখন মিসেস খানের হাত ছেড়ে দিযে সামনের দিকে এগোতে থাকেন, তা নিজেই টের পাননি। ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে বেশকিছুদূর এগিয়ে গেছেন। হঠাৎ পেছন থেকে একটা কোমল হাত তাকে আচমকা চেপে ধরে। তিনি যন্ত্রচালিতের মতো থেমে যান। পেছনে তাকিয়ে দেখেন তাঁর উদ্বিগ্ন স্ত্রী। তিনি সম্বিত ফিরে পান!
ইতোমধ্যে ওরা দু’বন্ধু ফিরতি পথ ধরেছে। খানসাহেবেরাও তাদের পেছনে পেছনে হাঁটতে থাকেন; পরম আপন হয়ে। সবাই আবার ফিরে আসেন বাউলঘরের কাছে। তাদের ছেলে তখনও নিশ্চিন্তে ঘুমায়। তারা ওখানে না গিয়ে ফিরে যান তাদের বিশ্রামছাউনিতে। চা রেডি ছিল। মিনিট পনেরো বিশ্রাম নিয়ে তারা এবার বামদিকে হাঁটতে শুরু করেন।
এবার দু’গ্রুপ দু’দিকে। উপমা ও শুভ্রা চলে যায় বামপাশের বিলপ্রান্তর-জলরাশির দিকে। খানসাহেব ও মিসেস খান জলাশয়ের পার ঘেঁষে আবার হাঁটতে থাকেন। এবার অন্য দিকে। সচেতন-অবচেতনেই দুই জুটি আলাদা হয়ে যায়; নিজেদের জগতে নিজেদের মতো কাটানোর জন্য। খানসাহেব ও মিসেস খান হাত ধরাধরি করে পাশাপাশি হাঁটতে থাকেন। কিছুদুর যাবার পরেই খানসাহেব আবারও দীঘির অপর পারে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু আবারও ঝোপঝাড়ের কারণে বাধাগ্রস্ত হন। তিনি একটু বিচলিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন শূন্য দৃষ্টিতে। কয়েক সেকেন্ড কী যেন ভাবেন! তারপর একটা খুব নিরিবিলি জায়গা দেখে পাশাপশি রাখা দুটো চেয়ারে দু’জন বসেন।
সামনের জলাশয়ের টলটলে জল। পাড়ে কী একটা ফুলের গাছ! বারবার শোনার পরেও কোনো ফুল-গাছ চিনতে পারেন না তিনি। মিসেস খান উৎসাহ নিয়ে একটা একটা করে গাছ চিনিয়ে দেন; নাম মনে করিয়ে দেন। একটা গাছ থেকে একটা ফুল ছিঁড়ে এনে স্ত্রীর চুলে গুঁজে দিতে চান। কিন্তু এই জঙ্গলকাব্যের নিয়ম ভঙ্গ হয় কি না এটা ভেবে নিজেকে নিবৃত্ত করেন।
‘ফুলগুলো গাছেই ভালো লাগছে’—মিসেস খান তাকে সান্ত্বনা দেন। নিজেদের অজান্তেই দু’জনে সময়টাকে উপভোগ করতে থাকেন; পরস্পরকে অনুভব করেন। চমৎকার প্রশান্তিতে তাদের মন ভরে ওঠে। কতদিন এরকম একাকীত্ব নাই! বিয়ের পরের সুন্দর জীবন ও দিনগুলোর কথা দুজনের মনে ছবির মতো ছায়ার মতো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কী নিটোল-নির্ভেজাল ছিল সময়গুলো। মিসেস খান গুনগুন করে গান গাইতে থাকেন। একসময় খানসাহেবও সুর ধরেন। তার কণ্ঠে গানের সুর ও তাল ভালোই আসে — কেউ কেউ এ-রকম বলে থাকে; কিন্তু কোনো গানেরই পুরো কথা মনে রাখতে পারেন না তিনি। তা সত্বেও মিসেস খান আবিষ্ট হয়ে তার আধাআধি গাওয়া সুরেলা গানগুলো শুনতে থাকেন। তাঁর কাঁধে মাথা রাখেন। খানসাহেবও তাকে কাছে টেনে নেন নিবিড়ভাবে।
দূরে প্রদীপ্ত এখনও ঘুমিয়ে আছে; উপমারা নিজেদের বন্ধুত্বকে নতুন করে ঝালাই করছে; নানা স্মৃতি ওলোটপালট করে দেখছে। এ দৃশ্য দেখে মিসেস খানের মন ভরে যায়; তিনি নিশ্চিন্ত মনে খানসাহেবের সাথে নিজস্ব সময় উপভোগ করেন। তবে ঘুরেফিরেই ওদের প্রসঙ্গ চলে আসে; দেশের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ও রাজনীতির প্রসঙ্গ আসে। সাম্প্রতিক জঙ্গী হামলার বিষয় উঠে আসে। বেদনায় দুজনেই চুপ হয়ে যান; মনে অশান্তি বোধ করেন।
কিন্তু খানসাহেব সময়টাকে একান্ত নিজেদের জন্য ধরে রাখতে চান। নিজেদের ভুবনে থাকতে চান। সুখের স্মৃতিগুলো আঁকড়ে ধরতে চান। আজকের বিশেষ দিনটিকে অম্লান রাখতে তিনি প্রসঙ্গ পাল্টান। মিসেস খানের মধ্যেও একই অনুভব : আজকে আমার খুব ভালো লাগছে। আজকের দিনটা অনেকদিন মনে থাকবে!
স্মৃতিচারণের দোলায় চারদিকের জল ও জঙ্গল তাদের কাছে সত্যিসত্যিই কাব্যময় হয়ে ওঠে! দু’জন বেশকিছুক্ষণ চুপচাপ কাটিয়ে দেন। সময়সচেতন মানুষ মিসেস খান একসময় জানতে চান : দেখ তো কয়টা বাজে? ৩টা! চলো উঠি।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও দুজনকে উঠতে হয়। আবার ফিরতে থাকেন তাদের জন্য নির্ধারিত খোলামেলা বিশ্রামছাউনিতে। কিছুদুর ফিরতেই মিসেস খান গাছ থেকে পেয়ারা পাড়েন। তিনি মেয়েবেলায় গেছো স্বভাবের ছিলেন। তাঁকে তা পেয়ে বসে। গাছে উঠতেও চেষ্টা করেন; কিন্তু নিজেকে সামলে নেন।
এরপর দু’জনে একটু সামনে এগিয়ে জলপ্রান্তরের কোলঘেঁষা একটা সাঁকো বেয়ে একটা মুক্তমঞ্চে গিয়ে দাঁড়ান। ইতোমধ্যে তাদের রসভঙ্গ করতে উপমারা দু’বন্ধু এসেও হাজির হয়েছে। কিন্তু প্রদীপ্তকে কোথাও দেখা যায় না। উপমাদেরকে ওখানে রেখে দু’জনে প্রদীপ্তকে খুঁজতে বাউলমঞ্চের দিকে যেতেই দেখেন —
প্রদীপ্ত জলাশয়ের ধার ধরে আপন মনে একা একা হাঁটছে। কখন-যে ও ঘুম ভেঙে উঠে গোটা জলাশয়ের চারদিকে ঘুরে এসেছে কেউই টের পায়নি। নিজের জগতে সে বিচরণ করছে এবং প্রকৃতিকে তার ভেতরে গেঁথে নিচ্ছে। যেন আশপাশে কেউ নাই। কোনোদিকে তার মনোযোগ নাই। একমসময় খানসাহেবদের পাশ দিয়ে সে ধীরে ধীরে হেঁটে চলে যায়। অনেকটা ভবঘুরে-দার্শনিকের মতো শূন্য দৃষ্টি। খানদম্পতি ছেলের এ প্রকৃতিপ্রেম দেখে মুগ্ধ হয়ে যান। এবং নিশ্চিন্ত মনে মিসেস খান নামাজের বিরতি নেন।
খানসাহেব একটু বিশ্রাম নিয়ে বিরাটপ্রান্তরে বর্ষায় জমে থাকা জলরাশিতে ডুবসাঁতারে নেমে পড়েন। মেয়ের ধমক ও শক্ত নিষেধাজ্ঞাকে উপেক্ষা করে সাঁতরাতে সাঁতরাতে বেশ দূরে হারিয়ে যান। একসময় জররাশির মাঝামাঝি স্থাপিত একটি মুক্ত-ছাউনিতে উঠে বসেন। তাঁর দেখাদেখি লোভ সামলাতে না পেরে প্রথমে শুভ্রা পরে নামবোনা-নামবোনা করে উপমাও নেমে পড়ে জলরাশিতে। গায়ে পানি বসে যাওয়ার ভয়ে খানসাহেব অল্পসময় পরেই নিচে নেমে আসেন। এবং একসময় ওরা দু’ বন্ধু ওই ছাউনিতে উঠে বসে।
ইতোমধ্যে মিসেস খান ও তাদের দার্শনিক পুত্রধন পাড়ে এসে দাঁড়ায় এবং উসখুস করতে থাকে — নামবে কি নামবে না — এ দ্বিধাদ্বন্দ্বে তারা বিচলিত হয়। খুব ইচ্ছা থাকা এবং খানসাহেবের পীড়াপীড়ি স্বত্ত্বেও মিসেস খান জলে নামেন না। জলে নামতে গেলে অনেক হ্যাপা। শাড়ি পাল্টাতে হবে; এখান থেকে উঠে আবার ওয়াশরুমে গিয়ে ২য় বার গোছল করতে হবে, আবার শাড়ি পাল্টাতে হবে…; এদিকে খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে। খানসাহেব এ বিশেষ রোমাঞ্চ থেকে বঞ্চিত হওয়ায় কিছুটা নিষ্প্রভ হয়ে পড়েন।
পুত্রধন তার চিরাচরিত স্বভাব অনুযায়ী উদ্ভট সিদ্বান্ত ঘোষণা করে : “হুদাই এইটুক পানিতে গোসল করুম ক্যান্? তার চাইতে কাইল ভার্সিটিতে যায়া পুকুরে সাঁতার কাটুম।”
প্রদীপ্তের এমন উদ্ভট মন্তব্যে অবাক হয় শুভ্রা; বিরক্ত হয় উপমা : “কী যে বলিস না-বলিস! এটা কোনো পুকুর না, এটা একটা অসীম জলরাশি। একদম আকাশ পর্যন্ত চলে গেছে পানি!” প্রদীপ্তের এমন উদ্ভট মন্তব্যে মিসেস খানও ঠোঁট বাঁকান : “আসলে তুই একটা আলসেপুরি! তোর আসল সমস্যা হচ্ছে : তুই গতরে ঘা দিতে চাস না।”
হতোদ্যম হয়ে খানসাহেব তাড়াড়াড়ি উঠে পড়েন। ফ্রেশ হয়ে মিসেস খানকে নিয়ে সোজা গিয়ে বসেন খাবার টেবিলে। একটু পরে ছেলে-মেয়েরাও এসে হাজির হয়। হরেক রকম খাবার দেখে জিবে পানি চলে আসে। কালবিলম্ব না করে সবাই সাবাড় করতে শুরু করে। সাদাভাত পোলাও মাছভাজি মাংসের ভূনা ও রোস্ট, নিজেদের জলাশয় থেকে ধরা তরতাজা খলসে মাছের চচ্চরি শুটকিভর্তা দুই পদের শাকভাজি…। কী রেখে কী খাব — তা সিদ্বান্ত নিতে হিমশিম হয়ে হৃদরোগে আক্রান্ত খানসাহেব শেষমেশ তার জন্য যা যা নিষিদ্ধ সেগুলো দিয়েই শুরু করেন — পোলাউ ও মাংসের রোস্ট — এ-জাতীয় খাবার। মিসেস খান বেছে নেন — সাদাভাত আর মাছ, পরে মাংস। তার দেখাদেখি পোলাউ শেষ করে আবার ভাত, তারপর আবার পোলাউ — এভাবে চালাতে থাকেন খানসাহেব। ড্রাইভার নবীভাইও একসাথেই খেতে বসেছেন; একটু দূরত্ব বজায় রেখে।
হঠাৎ খানসাহেবের খেয়াল হয় — তাঁর পুত্রধন এ টেবিলে নাই। এদিক-ওদিক চোখ যেতেই দেখেন — তার ছেলে সামনে দৌড়াচ্ছে আর তার পেছেনে একটা কুকুর তাকে তাড়া করছে। একসময় কুকুর ও সে চোখের আড়াল হয়ে যায়। মিসেস খানকে বলার সাথে সাথে দ্রুত খাবার ছেড়ে উঠে যান। তাড়াহুড়ো করে উঠতে গিয়ে টেবিলে ধা্ক্কা লেগে তার সাধের শাড়িতে মাংসের ঝোল লেগে নষ্ট হয়ে যায়। তিনি কোনোদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে সোজা চলে যান রন্ধনশালায়। একে-ওকে জিজ্ঞেস করেন। জঙ্গলের লোকেরা বলে —
: আমাদের কুকুর খারাপ মানুষ ছাড়া কাউরে তাড়ায় না; কাউরে কামড়ায়ও না। আপনের ছেলে বোধহয় ওয়াশরুমে। তিনি হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন।
ফিরে আাসেন খাবার টেবিলে। কিন্তু খানসাহেবের মনখারাপ হয়ে যায়। ও ফিরে না-আসা পর্যন্ত খাবারে শান্তি পান না। মিসেস খান পরিবেশটাকে হাল্কা ও মজাদার করার জন্য বলেন —
: শোনো একটা মজার কথা শোনো। ওরা আমাকে জিজ্ঞেস করছিল,
: আপনার ছেলে কি বোবা?
: নাহ! বোবা হবে কেন?
: তাইলে কি একটু বোকা ধরনের? সারাদিনে তার কোনো সাড়াশব্দ নাই। একলা একলা আউলা-ঝাউলা হইয়া ঘুইরা বেড়াইতেছে। আপনেগো লগে ঘুরতেও দ্যাখলাম না। আপনেগো লগে খাইতেও বহে নাই! কুকুরে তাড়াইলো কোনো চিল্লাপাল্লাও করলো না। এইটা আবার কিছু হইলো?
: কি বলেন এসব! আমার ছেলের অনেক বুদ্ধি। ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে।
এটুকু শুনে সবাই হো হো করে হেসে ওঠে। উপমা বেশ একটা ভালো অস্ত্র পায় ভাইকে ঘায়েল করার জন্য। খানসাহেবের কিন্তু খুব মনখারাপ হয়! আহা রে বেচারা!
একটু পরে পুত্রধন নির্বিকার চিত্তে ফিরে আসে টেবিলে। কিন্তু খেতে বসে না। তার মোটেও খিদে পায়নি। সকালে যে নাস্তা করেছে তাই-ই হজম হয়নি।
: তুই কোথায় ছিলি এতক্ষণ? তোর আব্বু খুব চিন্তা করছিল। একটা কুকুর তোকে তাড়া করছিল দেখে ঠিকমতো খেতেও পারে নাই।
ও বলে : তোমরা এত্ত বোকা! কুকুরে তাড়া করলে আমি চিৎকার করতাম না!
তখন উপমা এখানকার লোকজনের সাথে ওকে নিয়ে মামনির কী কথা হয়েছে তা শোনালো। পুরোটা শুনে সে খুব মজা পেল। গর্বের সাথে বলে : ঠিক এই রকম একটা ইমপ্রেশনই আমি দিতে চাচ্ছিলাম। দেখলি তো তোদেরকে আমি কেমন বোকা বানালাম। বলে নিজেই নিজের বুদ্ধির প্রশংসা করে হাসতে লাগল।
খানসাহেব প্রসঙ্গ পাল্টান : আচ্ছা। ওপারে তো আমাদের যাওয়া হলো না। খুব আক্ষেপ থেকে গেল।
: আমি ওপার গেছিলাম। — প্রদীপ্ত বলে।
: কীভাবে গেলি? ওপারে যাওয়ার রাস্তাই তো আমরা খুঁজে পাই নাই। — উপমার কণ্ঠে অবিশ্বাসের সুর।
: আরে শোন! তোরাও গেছিস। কিন্তু যখন গেছিস, তখন বুঝিস নাই যে, তোরা যেখানে যেতে চাইছিস, সেখানেই গেছিস। বলে বেশ একটা কায়দা করে কথা বলেছে — এমন ভাব করল।
তখন সবাই খেয়াল করে দেখল — ঠিকই তো তারা সবাই ওই জায়গাটা ঘুরে এসেছে। বিষয়টা অনেকটা গোলকধাঁধার মতো মনে হলো সবার কাছে। তার কথায় সবার মধ্যে মুগ্ধতা ও বিস্ময় খেয়াল করে নিজের দার্শনিক ভাব ফুটিয়ে তুলে আরও ব্যাখ্যা করতে শুরু করে প্রদীপ্ত —
: কারণ, তোরা তখন এখন যেখানে বসে আছিস, এই জায়গাটার দিকে তাকিয়ে এখানে আসার কথা ভাবছিলি। — বলে সে আত্মবিশ্বাসের সাথে একটা চেয়ারে গা এলিয়ে দেয়।
সবাই যখন লাঞ্চ শেষ করে গা-হাত-পা ছড়িয়ে দিয়ে আড্ডা শুরু করল, তখন প্রদীপ্ত খেতে বসল। আয়েশ করে খেয়ে সেও অংশ নিয়ে আড্ডা জমিয়ে ফেললো। তুমুল আড্ডা; তর্ক; যুক্তির পিঠে যুক্তি। আড্ডায় নানা ইশ্যু উঠে এল। গান, রাজনীতি, জলজঙ্গল — কোনো কিছুই বাদ গেল না। খানসাহেব ভাতঘুম দেয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলেন। একটু পরে তার পাশে মিসেস খানও গা এলিয়ে দিলেন।
হঠাৎ খানসাহেবের ফোন বেজে উঠল … : আঙ্কেল! আপনেরা কোদ্দুর? — ওপার থেকে সাবরিনা রিসোর্টের সিইও পিন্টু খান।
খানসাহেব হতাশার সুরে জবাব দেন : শোন্, আমরা তো এখনও রওনাই দেইনি। এখন কয়টা বাজে?
: সাড়ে ৫টা
: বলিস কী! রেডি রেডি। হারিয়াপ! এই সবাই রেডি হও। পিন্টু ফোন দিয়েছে। এর আগেও দিয়েছিল ঘণ্টাখানেক আগে।
: আঙ্কেল, পিন্টু কে?
: সাবরিনা ট্রাভেলস এন্ড ট্যুরসের সিইও; সাবরিনা রিসোর্টের তত্ত্বাবধায়ক। আমার ভাস্তে। এটা শেষ করে ওখানেও যাব আমরা। বোঝো নাই? এক ঢিলে দুই পাখি মারা আর-কি! — বলে নিজের বুদ্ধিকে নিজেই প্রশংসা করতে থাকেন। আর শোনো, জায়গাটার নামও কাব্যময় — মেঘডুবি।
: আব্বু, তাইলে আমাদের নৌকাভ্রমণ? এটা কিন্তু বাদ দেয়া যাবে না। উপমার দৃঢ় উচ্চারণ। অন্যদেরও একই দাবি; খানসাহেবের নিজেরও তা-ই ইচ্ছা। কালবিলম্ব না করে তিনি মাঝিকে নৌকা রেডি করতে বলেন। সবাই দ্রুত উঠে পড়ে নৌকায়। ওঠার আগে থেকেই ছবি তোলা শুরু হয়ে যায়। মিসেস খান খুবই সাবধানে জড়োসড়ো হয়ে খানসাহেবের হাতে ভর দিয়ে নৌকায় ওঠেন। অবশ্য, বেশিরভাগ সময় খানসাহেবই তার কাঁধে ভর দিয়ে চলেন; কখনো ইচ্ছায়, কখনো অনিচ্ছায়, কখনো নিজের অজান্তে! নৌকাভ্রমণে মিসেস খানেরও খুব সাধ; — কিন্তু হাঁটুপানিতে!
ইতোমধ্যে নৌকা চলতে শুরু করেছে। কিছুদূর যেতেই ভয়ঙ্কর এক ভূতের গল্প ফেঁদে বসেন মিসেস খান। সম্প্রতি কোন এক চ্যানেলে যেন দেখেছেন।
“এক নৌকায় দু’জন মিলে এক নারীর লাশ নিয়ে যাচ্ছিল। শান্ত নদীতে ঢেউ নাই; নৌকাতে দোলা নাই। হঠাৎ করে বলা-নাই কওয়া-নাই লাশটা নিজে নিজেই নৌকা থেকে গড়িয়ে নদীতে পড়ে ডুবে গেল। ওদিকে সূর্যও ডুবুডুবু।”
এটুকু শুনেই উপমার চোখ-মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। ও শুভ্রার গা ঘেঁষে বসে। কিন্তু গল্প শোনার লোভ সামলাতে পারে না : “মামনি সন্ধ্যা হওয়ার আগেই গল্পটা তাড়াতাড়ি শেষ করো।”
“এরপর লাশ খুঁজতে গিয়ে ক্ষতবিক্ষত হয়ে নৌকায় ওঠে তার স্বামী। পরদিন সন্ধ্যায় সেই লাশ খুঁজে পায় একটা কচুরিপানার দলে; সেও ক্ষতবিক্ষত। তারপর লাশ বাসায় নিয়ে যায; পরদিন জানাজা হবে। হঠাৎ রাতের বেলায় গোঁঙানির শব্দে জেগে উঠে দেখে তার মরা বউ পাশের ঘরের ভেতরে দিব্যি হেঁটে বেড়াচ্ছে…
“আর বলতে হবে না আন্টি! প্লিজ!!” প্রদীপ্ত খুব মজা পায় —
“আম্মু শেষ করো, শেষ করো। খুব মজা পাইতাছি।”
“জানো সেদিন টিভিতে ওই ঘটনাটা দেখে আমি খুব ভয় পাইছিলাম — রাতে ঘুমাতে পারি নাই ঠিকমতো। একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন হতেই দেখি — একটা ভূত আমার গলা চেপে ধরছে। আমি তড়াক করে উঠে জোরে ধাক্কা দিতেই তোমার আংকেল বিছানা থেকে ফ্লোরে গড়িয়ে পড়ল।”
এটুকু শুনে মাঝিসহ সবাই হো হো করে হেসে ওঠে। কোন এক ফাঁকে প্রদীপ্ত নৌকার মাঝখানে দাঁড়িয়ে যায়; নিজের অজান্তেই চারদিকের স্নিগ্ধতা বুক ভরে নেয়। একসময় হঠাৎ করে নৌকা এদিক-ওদিক দোলাতে থাকে। উপমা ও তার মা একসাথে বলে ওঠে : পাগল, নৌকা দোলাবি না। ওরা যত নিষেধ করে ও তত বেশি করে দোলায়। উপমাদের মনের ভেতরে তখন লাশের নদীতে পড়ে যাওয়ার ছবি ভেসে ওঠে। খানসাহেব বিশেষ কৌতুক বোধ করেন। ওদিকে মিসেস খানের প্রাণ ওষ্ঠাগত! অবশেষে মাঝি নৌকা ডুবে যাওয়ার ভয় দেখিয়ে ওকে নিবৃত্ত করে।
ইতোমধ্যে নৌকা হাঁটুপানি ছাড়িয়ে ডুবসাঁতারে চলে গেছে — তা খানসাহেব ছাড়া কেউই বুঝতে পারেনি। মিসেস খান ডুবে গেছেন নিসর্গে। বিরাট জলপ্রান্তর সীমানা ছাড়িয়ে আকাশ ছুঁয়েছে। যদিও শরতের আকাশ তবুও রৌদ্রোজ্জ্বল; মেঘ আছে কি নেই। ঝলমল করছে। দুপাশে ছোট দু’একটা ছাউনি-কটেজ। সামনের কটেজে যাওয়ার তীব্র ইচ্ছা হয় তাদের। কিন্তু নৌকা বাঁক নেয় ডানে; একটু গিয়ে আবার বাঁয়ে।
প্রদীপ্ত চিৎ হয়ে শুয়ে আছে নৌকার মাঝ বরাবর। মাঝে মাঝে ভ্রমণআনন্দ প্রকাশ করছে তার নিজস্ব বাকভঙ্গিতে —
: আপু দেখ্, আকাশের সাথে কিন্তু মাটির একটা সম্পর্ক আছে; আছে দূরের হাতছানি। দিগন্তে আকাশ ও পৃথিবী মিলে গেছে মনে হলেও — এ দুয়ের কখনোই মিলন নেই!
‘আকাশের গান মানুষ কী মনে রাখে!
নীরবে নীরবে রঙধনু শুধু দিগন্তে ছবি আঁকে।’…
এ-রকম ঘোরলাগা সন্ধ্যায় খানসাহেবের গাওয়া গানের কথাগুলো মিসেস খানকে ছুঁয়ে যায়; স্বামীর প্রতিও তার একটা আলাদা ভালোলাগা বেদনা লাগে। সবাই এটা-ওটা মন্তব্য করলেও মিসেস খানের যেন কোনো দিকে খেয়ালই নেই; কোনো রা নেই! তিনি খানসাহেবের করতল মুষ্টিবদ্ধ করে অবগাহন ও অনুভব করছেন নিটোল প্রকৃতি — নির্ভেজাল, শান্ত, মায়াবী বিকেল থেকে দ্রুত রূপান্তরিত গোধুলি লগ্ন। চেখের সামনে ঘটে যাচ্ছে সময়ের ও মনের রঙের রূপান্তর। খোলা আকাশে তরতাজা সূর্যের রং-বদল; আলোআঁধারিতে লুকোচুরি ও তার যাদুকরী হাতছানি; পৃথিবীর অন্য দিগন্তে স্নিগ্ধতা ছড়িযে সূর্যের পশ্চিমে ডুব।
সবাই বিহ্বল হয়ে গেছে; ঘাটে ফেরার কথা, বাড়ি ফেরার আকুলতা, গল্পের ফুলঝুরি, ভাইবোনের খুনসুঁটি সবকিছু তলিয়ে গেছে — মোহনীয় গোধূলিলগ্নের সাঁঝের মায়ায়! খানসাহেবের ফোন আবারও বেজে ওঠে —
: “আঙ্কেল। আপনারা কোদ্দুর? কাছাকাছি আইয়া আমারে ফোন দিয়েন।”
সবাই যেন কেমন অশান্তি বোধ করে। “আব্বু, আজকে সাবরিনায় না-গেলে হয় না?” খানসাহেব জবাব না দিয়ে মাঝিকে সঙ্কেত দেন : “নৌকা ঘাটে ভেড়ান।”
অগত্যা অনিচ্ছাসত্ত্বেও সবা্ই নৌকা থেকে নেমে পড়ে। বিশ্রামছাউনিতে ফিরে দ্রুত কাপড়চোপড় গুছিয়ে নেয়। একফাঁকে মিসেস খান মাগরিবের নামাজ শেষ করেন। জলকাব্যের মুহূর্তগুলো মনে গেঁথে নিয়ে সবাই একে একে গাড়িতে ওঠে। গোধুলিলগ্ন বিষণ্ন চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকে। ‘জল ও জঙ্গলের কাব্য’ ওদেরকে পদ্যময় বিদায় জানায়। গাড়ি স্টার্ট দেন নবীভাই। সবাই চুপচাপ; খানসাহেবও।
মিনিট দশেক পর আবার কথা শুরু করে উপমাগ্রুপ। কেমন কাটলো সারাদিন জল ও জঙ্গলে — এসব নিয়ে রোমন্থন চলে কিছুক্ষণ। সবাই যার যার মতামত দেয়। প্রদীপ্ত চুপচাপ। মিসেস খান উপমাকে বিশেষ ধন্যবাদ জানায় এ ধরনের অভূতপূর্ব ‘কাব্য’ নির্বাচনের জন্য। শুভ্রা কাকে ধন্যবাদ দিবে বুঝে উঠতে পারে না। জল ও জঙ্গল ছাপিয়ে পুরো দিনটাকে একটি ‘পোয়েটিক ডে’, আর গোটা পরিবারটাকেই তার কাছে আশ্বর্য সুন্দর মনে হয়! খানসাহেব এবার মিসেস খানের পাশ ঘেঁষে একেবারে নিবিড় হয়ে বসেন। মিসেস খান খানসাহেবকে আপন মনে আজকের দিনের ভালোলাগার মুহূর্তগুলো মনে করিয়ে দেন। অতীতের মধুমাখা দিনগুলোর কথাও একে একে মনে পড়ে তাদের; মনে পড়ে যায় দাম্পত্বজীবনের আনন্দ-বেদনা-রাগ-অনুরাগ-মান-অভিমানমাথানো ভালোমন্দ-জড়ানো বিশেষ মুহূর্তগুলো। তাদের যৌথজীবনের বিভিন্ন মুহূর্ত বিভিন্নভাবে দোলা দেয় তাদের মনের গভীরে — কখনো টলটলে স্নিগ্ধ জল; কখনো মেঘাচ্ছন্ন জঙ্গল। কাব্যময়-গদ্যময়! এভাবেই কেটে যায় একটি পরমতম ভালোলাগার দিন এবং তাহাদের সুখ-দুঃখের সংক্ষিপ্ত আঠাশ বছর! মিসেস খান গুনগুন করে গাইতে থাকেন :
“খোলা আকাশ কী এত ভালো লাগতো
যদি কিছু কিছু মেঘ নাহি থাকতো!”