খানসাহেবের খণ্ডজীবন :: পর্ব ৩ । সিরাজুদ দাহার খান
প্রকাশিত হয়েছে : ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১১:০৯ অপরাহ্ণ, | ২১৮২ বার পঠিত
খানসাহেবের ঈদের প্ল্যান
খানসাহেব তার ছোটবেলার ঈদের আনন্দের কথা কিছুতেই ভুলতে পারেন না! এমনকি বিয়ের পরের বেশ কয়েক বছর পরের ঈদের দিনগুলোও ভুলতে পারেন না! ছোটবেলায় অন্যরা যেসব আনন্দ করে থাকে তিনিও তা-ই করতেন। তখনো তিনি খানসাহেব হন নাই। নামাজে যেতেন পাবনা আরিফপুর সদর গোরস্তান ঈদগাহ ময়দানে নানা-মামার হাত ধরে। বড়মামা ছোটমামা নিলুমামা পিলুমামা সব দলবেঁধে যেতেন জায়নামাজ কাঁধে ফেলে। বাড়ি থেকে যাওয়ার পথে বাড়ির কাছেই পড়ত তৎকালীন পাকিস্তান ঈদগা ময়দান (বর্তমানে বাংলাদেশ ঈদগা ময়দান)। সেটা ছিল আহলে-হাদিসওয়ালাদের। ওখানে তাদের নামাজ পড়া নিষেধ ছিল। সেখানে নারীরাও জামাতে নামাজ পড়তেন, পর্দার পেছনে; একই ইমামের পেছনে। তার কাছে বিষয়টা গোলমেলে লাগত। বড় হয়ে শুনেছেন, খানসাহেবরা হানাফি মাযহাবের। তাই আহলে-হাদিসদের ওখানে নাকি নামাজ পড়া জায়েজ না!
ওই ঈদগার সামনেই বিক্রি হতো লালমোন-পানতোয়া এবং আরও হরেক রকমের খাবার। নামাজে যাবার সময় ওগুলোতে বিশেষ নজর থাকত তার। যাওয়ার সময়েই বায়না দিয়ে রাখতেন মামা-নানাকে। নামাজ শেষে ফেরার পথে ওই পানতোয়া ছিল তার বড় আকর্ষণ। বাড়ি ফিরে যথারীতি সালাম-সেলামি-খিচুড়ি-পোলাও-মুর্গির মাংস। তারপর নতুন পোশাক প্রদর্শনের জন্য পাড়ায পাড়ায় বেড়ানো। তিনুমামা চারুমামা আন্নুমামাদের সাথে দেখা করা ছিল বেশ মজার। তাদের গৃহশিক্ষক এবং সম্পর্কে নানী ‘সোলেমানমামার মা’ বিশেষ ধরনের ভিন্ন স্বাদের ফিরনি রান্না করতেন। সেটি তাদের সবার কাছে ছিল অমৃত। তার স্বাদ এখনও যেন অনুভব করেন খানসাহেব। তারপর এবাড়ি-ওবাড়ি ঘোরাঘুরি। এভাবে দিনটা যে কোনদিক দিয়ে কেটে যেত টেরই পেতেন না।
আরেকটু বড় হলে দেখলেন প্রতি ঈদের আগে বাড়িতে ঈদের প্ল্যান-পরিকল্পনা হতো। সেই থেকে খানসাহেবের মধ্যেও ঈদপরিকল্পনার ঝোঁক তৈরি হয়। পরবর্তীতে এনজিওতে কাজ করার ফলে ফ্যুল্ পরিবারকে নিয়ে ‘অংশগ্রহণমূলক প্ল্যান’ তৈরির বাতিক পেয়ে বসে তার মধ্যে। তিনি আবার ইতোমধ্যে এ-ব্যাপারে তথাকথিত এক্সপার্টের খ্যাতি অর্জন করেছেন।
বিয়ের পরেও বেশ কয়েক বছর ঈদ সহ সবকিছু পরিকল্পনামাফিক চলত। তখন ঈদ ছাড়াও বাকি দিনগুলো কী রোমান্টিক আর ফুরফুরে ছিল! কখন সকাল হতো আর সন্ধ্যা নামতো বোঝাই যেত না। দুজন একা একা কত বেড়ানো কত ঘোরাঘুরি হাসিঠাট্টা আর টকঝালমিষ্টিতে কেটে যেত দিনরাত-সকালসন্ধ্যা। বিয়ের পরপর বলা নেই কওয়া নেই তাকে চমকে দিয়ে তার পরিবার খানসাহেবের ভাইবোনদের সাথে নিয়ে চলে আসেন হাতিয়ায়; সেখানে কর্মরত খানসাহেবের অফিস-কাম্ রেসিডেন্সে। দিনসাতেক কাটিয়ে সবাই দেশের বাড়িতে ফিরে গেলে তাদের নতুন জীবন শুরু হয়। হাতিয়া চষে বেড়ানো; ভক্ত-অনুরাগী-বন্ধুবান্ধবদের বাসায় বেড়ানো; ট্রলার নিয়ে দিগন্তবিস্তৃত মায়াবী নদী-খাল-বনপ্রান্তর ছাড়িয়ে নিঝুম দ্বীপ যাওয়া এবং সেখানে রাত্রিযাপন; বিস্মিত চোখে সেখানে বনের ভেতরে দলে দলে মুক্ত হরিণ ও অন্যান্য প্রাণী ঘুরে বেড়াতে দেখা; বিচিত্র পাখপাখালির কলকাকলি শোনা; দ্বীপের শেষপ্রান্তে গিয়ে অসীম আকাশ দেখা ও অকূল সাগরের কল্লোল শুনে নিজেদেরকে আরও আপন করে নেয়া — সবকিছু তার চোখের সামনে ভাসে। রাস্তার পাশে ফসলের খেতের মধ্যে বসে তাজা চিনেবাদাম তুলে খাওয়া; অজানা কোনো গ্রামের মধ্যে গিয়ে প্রেমিক-প্রেমিকার মতো বসে আড্ডা দিতে গিয়ে সে-গ্রামের সাধারণ সজ্জন মানুষদের জেরার মুখে পড়া এবং পাশের বাড়ির নারীমহলের হস্তক্ষেপে উদ্ধার পাওয়া ও আন্তরিক অ্যাপ্যায়ন — এখনও ভুলতে পারেন না তিনি!
পরে ধীরে ধীরে সবার অজান্তেই ঈদের পরিকল্পনায় ভাটা পড়তে থাকে। রাজা আসে রাজা যায়; ঈদ আসে ঈদ যায়। সংসারে সন্তান আসে। প্রথমে মেয়ে; বছর পাঁচেক বিরতি দিয়ে ছেলে। পরিবারেরর মধ্যে আলো ঝলমল করে ওঠে। পরিকল্পনাহীন ঈদও ভালোই কাটতে থাকে। খানসাহেব ও তার পরিবার দুজনেই কর্মজীবী। তার পরিবার বেশিরভাগ সময় পারিবারিক ও অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকেন। ছেলেমেয়েকেও সামলাতে হয় তাকেই। খানসাহেব তো অফিসে কোনোমতে দিনটা পার করেই ভাবেন — দুনিয়া উদ্ধার করে ফেলছেন। এনজিওতে বিভিন্ন প্রশিক্ষণে পরিবারকে সহায়তা করা বা সংসারের বাস্তব কাজে সমান অংশগ্রহণের প্রচারণা চালালেও তিনি নিজের সংসারে তার বাস্তব প্রয়োগে অসফল। সংসারের যাবতীয় কাজে নাস্তানাবুদ ও বিপর্যস্ত হয়ে তার পরিবারও তাকে আগের মতো আর বেশি সময় দিতে পারেন না।
২
এভাবে কয়েক বছর যাবার পর বিশেষ করে ঈদ বিষয়টা তার কাছে একঘেয়ে লাগতে শুরু করে। আবারও প্ল্যান করে ঈদ-আনন্দ করার পোকা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তার পরিবারের মতে এসব প্ল্যান করে কোনো আনন্দ হয় না। হলে এমনিতেই হবে। না-হলে হবে না। তাছাড়াও বেশ কিছুদিন হলো তিনি খানসাহেবের এসব এনজিওমার্কা নাটুকেপনা একদম পছন্দ করেন না। কিন্তু খানসাহেব নাছোড়বান্দা! রোজার মাস হলে প্রতি সন্ধ্যায় ইফতার করার পর তার পরিবার নামাজে বসেন। তার নামাজ শেষ হতে-না-হতেই তিনি — খানসাহেব — সেখানে গিয়েই আসর জমানোর চেষ্টা করেন। ছেলেমেয়েরা যার যার মতো ব্যস্ত থাকে। কেউ পড়ালেখায়; কেউ ফেসবুকে।
তিনি প্রথমে ইনিয়েবিনিয়ে একথা-ওকথা বলে পরিবারের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন। নানা ধরনের হাস্যরসের উদ্রেক করে অন্যদেরকে দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করেন। মাঝে মাঝে নিজেই নিজের রসবোধসম্পন্ন কথায় অট্টহাসিতে ফেটে পড়েন। তার পরিবারও তার সাথে যোগ দেন। হাসিতে পাশের ঘরে অধ্যয়নরত মেয়ে ছুটে আসে — কী না কী যেন মজার কথাবার্তা মিস হয়ে গেল! পরিবেশ কিছুটা অনুকূলে এলে তিনি ছেলেকেও ডাকাডাকি শুরু করেন।
‘এদিকে আয় তো বাবা। খুব মজার বিষয নিয়ে আমরা কথা বলছি।’ কোনো সাড়া না পেয়ে একটু দূরের ঘরে ফেসবুকে বুঁদ হয়ে থাকা ছেলেকে ডাকতে মোবাইলে মেসেজ পাঠান : কাম শার্প! ইমার্জেন্সি মিটিং।
ছেলে ঘরে ঢুকেই সতর্কবার্তা জারি করে : তাত্তাড়ি বলো, তাত্তাড়ি বলো। হাতে সময় নাই। খুব ব্যস্ত আছি।
ছেলের অস্থিরতায় তিনি কিছুটা হতোদ্যম হন। যেভাবে রসিয়ে প্রস্তাবটা দিতে চাইছিলেন তাতে ভাটা পড়ে। তার পরিবারের মধ্যেও তেমন আগ্রহ দেখা যায় না। অগত্যা দায়ে ঠেকে তাকে খুশি করতেই যেন সবাই মিলে ঈদের প্ল্যান করতে বসল। নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে তিনি মিটিং-এর অ্যাজেন্ডা পেশ করেন : কখন কোথায় যাওয়া হবে; কী খাওয়া হবে; বাড়িতে কী কী আইটেম হবে; কী কী প্রোগ্রাম হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। যথরীতি যার যার মতো সবাই মতামত দিতে থাকে। পরিবারের চারজনের চার রকম মত।
ছেলে : আমার প্ল্যান আমার মতো। আমি তোমাদের সাথে নাই। তোমরা হুদাই এদিক-ওদিক ঘোরো; এর কোনো মানে নাই। মিনিংলেস। এসব কাহিনি বাদ। বেশি করে পোলাও-মাংস বানাবা। যেন ৩ দিন ধরে খেতে পারি।
মেয়ে : ঈদের দিন আমারা সবাই মিলে বাইরে বাইরে ঘুরব। কোনো রান্নাবান্নাই হবে না। আর পরের দিন একটা সুন্দর গাড়ি ভাড়া করে ফাঁকা ঢাকায় ঘুরব। ফ্লাইওভারগুলো দেখব। মাঝে মাঝে থামব। রাস্তায় খাব।
হৃদয়বান পরিবারভক্ত খানসাহেবের পরিবারের কোনো বায়না নাই। পরিকল্পনাও নাই। তিনি প্রায় নির্বিকারভাবে বলেন,
— শোনো, তোমরা যা ভালো মনে করো তা-ই করো। তোমাদের যা খুশি তা-ই করো। যেখানে ইচ্ছা যাও।
খানসাহেব : আর তুমি? তোমাকে ছাড়া তো আমাদের ঈদ-ই হবে না।
পরিবার : একদিন আমি একটু নিজের মতো করে শান্তিতে সময় কাটাব। রান্নাবান্না সেরে দুপুরের পরে ঘরের মেঝেতে শুয়ে শুয়ে টিভি দেখাই আমার ঈদ। তবে ঈদের পরের দিন গোটা ঢাকা শহর বেড়ানোর আইডিয়াটা খারাপ না।
খানসাহেব : চলো, তারচাইতে এক কাজ করি, বন্ধুবান্ধব-আত্মীয়স্বজনদের বাসায় যাই। তাদের সাথে আড্ডাবাজি করে দিনটা পার করে দেই। এমনিতে তো আমাদের আর আগের মতো কোথাও বেড়ানোও হয় না। — বলে ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন খানসাহেব নিজের অজান্তেই। বিশেষ করে পরিবারকে সাথে নিয়ে আগের মতো দু্-একটা বাসায় বেড়াতে তার খুব ইচ্ছা।
শেষমেশ কেউ একমত হতে পারেন না। এবং প্ল্যানও কমপ্লিট হয় না।
৩
খানসাহেব হাল ছাড়েন না!
ইফতার শেষে প্রতিদিন সন্ধ্যার পরে যথারীতি বৈঠক ডাকেন তিনি। বৈঠক প্রতিদিনই হাফডান। কোনোমতেইে একমত হতে পারে না সবাই। খানসাহেবের পরিবারকে একটু পর পর বৈঠক ছেড়ে উঠতে হয়, ‘যাই, অনেক কাজ পড়ে আছে। তোমাদের সাথে সময় নষ্ট করার সময় আমার নাই।’ — এ-কথা শুনে খানসাহেব অসহিষ্ণু হয়ে ওঠেন এবং যথারীতি কথাকাটাকাটি লেগে যায় এবং তা প্রায়শ ঝগড়ায় পরিণত হওয়ার আশংকা দেখা দেয়। তার পুত্রধন তড়িৎগতিতে সটকে পড়ে। মেয়ে ঘোষণা করে : মিটিং সাসপেন্ডেড। এবং নিজের জগতে ফিরে যায়। বৈঠক পণ্ড!
খানসাহেব পরদিন আবার বসেন। আবার মতের অমিল। আবার হাফডান। কোনোমতেই ঐকমত্যে আসতে পারেন না তারা। প্রতিদিনই আইডিয়া পাল্টায় প্রত্যেকের। আগের দিন মেয়ে যা বলেছিল খানসাহেব সেইটা বলেন। খানসাহেবের পরিবার আরেকটা বলেন। মেয়ে পরের দিন আরেকটা বলে। ছেলে তার আগের সিদ্ধান্তেই অটল। খানসাহেব নিজেও তার মত পাল্টান বারবার। একটা জগাখিচুড়ি অবস্থা!
নানা মুনির নানা আইডিয়া শুনে খানসাহেব বিভ্রান্ত হয়ে যান। একদিকে তিনি চান বাড়িতে অতিথি সমাগম হোক, অন্যদিকে নিজেই অন্যবাড়ির অতিথি হওয়ার ইচ্ছা হয়। আবার, শুধু বউ-ছেলে-মেয়ে নিয়ে একান্তে ঘুরেবেড়ানোর প্ল্যানও মন্দ মনে হয় না। কিন্তু সব পরিকল্পনাই তার ছেলেবেলার-তরুণবেলার ঈদের স্মৃতিকে হার মানায়। ঠিক কী করলে সেই অকৃত্রিম আনন্দ পাওয়া যাবে তা তিনি বুঝে উঠতে পারেন না। সত্যি বলতে, মনের গভীরে ছেলেবেলার সেই লালমোন-পানতোয়া স্বাদের ঈদে ফিরে যাবার অবচেতন ইচ্ছাটা খানসাহেবের নিজের কাছেই অজানা। তাই কোনোকিছুতেই তার তৃপ্তি হয় না।
খানসাহেবের এই দ্বিধাদ্বন্দ্ব তার পরিবার ঠিকই বুঝতে পারেন। সুযোগ পেয়ে তাই ঠেস মারেন, ‘তোমার নিজেরই কোনো মতিগতির ঠিক নাই। তুমি কী চাও তা আগে নিজের সাথে বোঝাপড়া করে ঠিক করো। তারপর আমাদের নিয়ে বসো।’
খানসাহেব কী জবাব দিবেন হাতড়াতে থাকেন। তার আগেই তার পরিবার ঘোষণা দেন : ‘ঈদের দিন আমি দুপুর ২টা পর্যন্ত ব্যস্ত থাকব। তারপর তুমি যেটা বলবে সেটাই ফাইনাল।’
একেবারে কাটার-স্লোয়ার। খানসাহেব এবার বিপাকে পড়েন।
নিজের সমস্যা ধরতে না-পেরে খানসাহেব ঈদের রান্নাবান্নাকেই বড় সমস্যা হিসেবে মনে করেন। ফলে পরদিন খানসাহেব একটা অভিনব প্রস্তাব করেন : ‘বাসায বাবুর্চি ডাকা হবে। ওরা রান্না করবে। আমরা ঘুরে বেড়াব। তোমারও কাজের চাপ কমবে। তুমি আমাদের সাথে ঈদের আনন্দে অংশ নিতে পারবে।’
খানসাহেবের মেয়ে তার প্রস্তাবে দারুণ এক্সাইটডে হয়ে তার পক্ষে ওকালতি করে।
কিন্তু খানসাহেবের এ-রকম কাণ্ডজ্ঞানহীন প্রস্তাবে তার পরিবার তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন : ‘তাই আবার হয় নাকি? সংসারে আমাদের অনেক কাজ থাকে। বাড়িতে মেহমানও আসে। শোনো, জীবনটা নাটক না! তোমরা তো শুধু বসে বসে খাও। যাদের কোনো কাজ নেই, তারাই এ-রকম উদ্ভট কথা বলতে পারে। তাছাড়া বাসায় মেহমান আসলে তাদেরে কে আপ্যায়ন করবে?’
এভাবেই প্রতিদিন সভা হয়। দিনের পর দিন যায়। নিষ্ফলা বৈঠক চলে।
অবশেষে ঈদ আসে
ঈদের দিন তার পরিবার তার নিজের গতিতে চলতে থাকেন, ছেলে সকালে উঠে কোনোমতে নামাজে হাজিরা দিয়ে উধাও হয়ে যায়, মেয়ে ঘুমায় সকাল ১১টা পর্যন্ত।
খানসাহেব নামাজ থেকে এসে পরিবারের পাশে ঘুরঘুর করতে থাকেন। পরিবার তাকে পরম যত্নে ঈদের সেমাই-খিচুড়ি খেতে দেন। আনন্দে গদগদ হয়ে খেতে খেতে খানসাহেব আবারও ঈদের প্ল্যানের কথা তোলার চেষ্টা করেন।
‘এই রোস্টটা বোধহয় পুড়ে গেল!’ — এই বলে তার পরিবার হাতছাড়া হয়ে যান। যথারীতি বিফল মনোরথ হয়ে খানসাহেব মুখ প্যাঁচার মতো করে বসে থাকেন এবং একসময় ক্লান্ত হয়ে তন্দ্রাচ্ছন্ন হন। মেয়ে ঘুম থেকে উঠে ডেকে তোলে তাকে। বাবার মনকে চাঙা করতে মেয়ে ও বাবা দুজনে বসে আবারও প্ল্যান শুরু করেন।
বাসায় লোক সমাগম শুরু হয়। খানসাহেব বিরক্ত হতে শুরু করেন। কারণ তার ঈদের প্ল্যানই এখনও শেষ হয়নি। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি প্ল্যানের কথা ভুলে গিয়ে তাদের সাথে আড্ডা জমিয়ে তোলেন। সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়। খানসাহেবের মতোই হাল্কা গড়িয়ে নিয়ে দুপুরটা একসময় বিকেল হয়ে যায়। এর মধ্যে খানসাহেবের পরিবার রান্না-স্নান ইত্যাদি সেরে তার নিজের গতিতে মেঝেতে শুয়ে আয়েশ করে টিভি দেখতে শুরু করেন। খানসাহেব মুখ ব্যাজার করে তাদের সঙ্গ দেন। একসময় নিজেও নিজের অজান্তে ঈদের নাটকে আটকে যান। এবং নাটক শেষ হলে তার সেই পুরনো সংলাপ আওড়ান, ‘একটি জঘন্য নাটক!’
সন্ধ্যার প্রাক্কালে খানসাহেবের পরিবার হঠাৎ সদয় হন। এবং খানসাহেবকে নিয়ে রিকশায় চড়ে রোমান্টিক ভাব নিয়ে শহরের বিভিন্ন রাস্তায় ঘণ্টাচুক্তিতে চক্কর দিয়ে ঘুরে-ফিরে আসেন। কিন্তু খানসাহেবের মাথা থেকে ঈদের প্ল্যানের ভূত নামে না। ঘুরপাক খেতেই থাকে। বাসায় ফিরতে-না-ফিরতেই মেহমানের আবার আনাগোনা শুরু হয়। খানসাহেবের প্ল্যান আর ফাইনাল হয় না!
খানসাহেবের ঈদের প্ল্যান এভাবেই ভেস্তে যাচ্ছে গত ১০/১৫ বছর। এতদিনে তার বোধোদয় হয়েছে : সেই ঢাকা মেইল নেই তো আর! নেই পদ্মার ইলিশ মাছ! ঈদের রাতে সতীনাথের গাওয়া নজরুলের কালজয়ী গান ‘রমজানের ওই রোজার শেষে এল খুশির ঈদ’ ছেড়ে দিয়ে হৈ হৈ করে ঈদ জমানোর চেষ্টা ছাড়া তার আর কোনো প্ল্যানই সফল হয় না। তাই খানসাহেব এবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন : ‘তয় হালায় আর যুদ্ধেই যামু না। ফ্যুল্ পরিবারে যা কয় তা-ই সই!’
পুনশ্চ : এ-বছর ঈদের ৫ দিন আগে ঘটে-যাওয়া রোমহর্ষক গুলশান ট্রাজেডির কারণে গোটা জাতির মতো খানসাহেব ও তার পরিবারের সবাই শোকাতুর হয়ে পড়ায় এবারে ঈদের প্ল্যান নিয়ে কোনো মাতামাতি হয় নাই।