খানসাহেবের খণ্ডজীবন – পর্ব ১ । সিরাজুদ দাহার খান
প্রকাশিত হয়েছে : ২২ আগস্ট ২০১৬, ১১:০৪ অপরাহ্ণ, | ১৭৮১ বার পঠিত
হোয়াট আ শট!
১৬ জুন ২০১৬
পাড়ার শিশু-কিশোর ও তরুণদের সাথে ৬০ বয়েসি খান সাহেবের বেশ সখ্য। মাঝেমাঝে পাড়ার রাস্তায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও খেলাধুলার আয়োজন করেন। সবার সাথে হৈটৈ ও মজা করেন — সে’ থেকেই এ সখ্য গড়ে উঠেছে। সেদিন সন্ধ্যার প্রাক্কালে নিচে নামতেই তার ছেলের সাথে খেলায় মত্ত কয়েকজন খুব করে ধরলো এক-ওভার ব্যাট করার জন্য। না না করেও অগত্যা রাজি হলেন তার পুরোনো অভ্যাস ঝালাই করার জন্য। ১ম বলেই বাউন্ডারি এবং তরুণদের অভ্যাসবশত বাহ্বা ধ্বনি! ২য় বলে ক্যাচ মিস্। ৩য় বলে ব্যাটে-বলে ঠেকিয়ে দেওয়া। ওয়াউ!! চতুর্থ বলে দারুণ স্যুইপ। সমস্বরে চিৎকার — হোয়াট আ শট!
খান সাহেবকে আর পায় কে! তরুণ বোলারের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। তার এবারের বল আরও কৌশলী। লেগ ব্রেক। খান সাহেব শো-অফ করার জন্য ডান হাতের কব্জিতে মোচড় দিয়ে উইকেটকিপারের মাথার ওপর দিয়ে মুশফিকের মতো বল ঠেলে দিলেন ওভার-বাউন্ডারি। ছক্কা! পাড়া প্রকম্পিত করে তরুণদের সমস্বরে আবারও চিৎকার — হোয়াট আ শট!! তার ছেলের মুখে বিজয় ও গর্বের মুচকি মিষ্টি হাসিটা তার নজর এড়ালো না।
সাথে সাথে তিনি এ্ও টের পেলেন যে, ব্যাটের ওজনটা কব্জি বোধহয় সইতে পারে নাই। চিন্ করে উঠলো ডান হাতের ডান কব্জির একেবারে গোড়ায়!
তিনি বিষয়টি আমলে নেয়ার আগেই ৬ষ্ঠ বল — ওভারের শেষ বল। তরুণ-কিশোর বোলার এবার মরিয়া হয়ে বল করেছে। সরাসরি মিড উইকেট বরারব বেশ বেগে। নিশ্চিত আউট! কিন্তু খান সাহেব এবার শেষ মুন্সিয়ানা প্রদর্শন করলেন। তিনি উইকেট ছেড়ে দিয়ে এক-পা ডানদিকে সরে গিয়েই বিদ্যুৎগতিতে বল ঠেলে দিলেন লেগ স্টাম্প দিয়ে সীমানার বাইরে। তরুণেরা হতবাক!! হোয়াট আ শট! তাকে ঘিরে উদযাপন শুরু হয়ে যাবার পালা।
ততক্ষণে খান সাহেবের মুখ বিবর্ণ ও ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে। আগের শটে যেখানে ব্যথায় চিন্ করে উঠেছিল সেখানে আরেকটি জোরে টান লেগেছে। ছেলেপেলেরা ঘিরে ধরার আগেই তিনি দ্রুত সটকে পড়লেন খেলা থেকে। তার বিচক্ষণ কন্যা তাকে অর্থোপেডিক দেখাতে বললেও তিনি ও তার পরিবার তাতে আমলই দিলেন না। ও এমনিতেই সেরে যাবে। শুধুশুধু ডাক্তারকে পয়সা দেওয়ার কী দরকার!
এভাবে ২০ দিন গড়িমসি করে কাটিয়ে কোনো উন্নতি না দেখে এক্সরে করে ধরা পড়লো — কব্জির গোড়ায় হাড়ে ক্র্যাক। আজ ১৫ দিন হলো ডান হাতের কব্জিতে ডাক্তারের দেয়া প্লাস্টারের মতো কী একটা পরে প্রায় নিষ্কর্মক দিন কাটাচ্ছেন; আর এ বয়সে ছেলেপেলেদের সাথে খামখেয়ালিপনা করতে গিয়ে এ-রকম একটা হ্যাপায় পড়ার জন্য পরিজনের কাছে ভর্ৎসনা পাচ্ছেন অনিয়মিত।
হোয়াট আ শট!
ওনারে চ্যাংড়ামিতে পাইছে!
১৮ জুন ২০১৬
খান সাহেব গেছেন তাঁর পরিবারকে সাথে নিয়ে মহল্লার দন্তচিকিৎসকের কাছে। রুট ক্যানেলের ৩য় দিন; দাঁতে ব্যথা। ডান হাতে যথারীতি স্প্লিন্ট বাঁধা। ইতোমধ্যে তিনি মাজায়ও ব্যথা বাঁধিয়েছেন। মাজায় ফিজিও থেরাপিস্টের দেয়া চওড়া বেল্ট।
তবে এতে তার ভীমরতির কোনো দোষ নাই। সেদিন তার পরিবারের ঘাড়ের এক্সরে করাতে সাথে গেছেন ল্যাবে। কিছুক্ষণ অপেক্ষমাণ বসে থেকে কী একটা জানতে বা আনতে চেয়ার ছেড়ে উঠতে গেছেন। হঠাৎ পিঠের নিচের দিকে মাংসপেশীর ভেতর থেকে কী একটা যেন ওপর দিকে বেয়ে উঠলো বা নিচের দিকে নামলো — দ্রুত গতিতে। চিড়িৎ করে উঠলো। ব্যাস! কাজ হয়ে গেল। মুহূর্তের মধ্যে এসি-রুমের ঠাণ্ডার মধ্যে তিনি দরদর করে ঘামাতে লাগলেন। পুরোনো এ রোগে অতিঅভিজ্ঞ খান সাহেব তাৎক্ষণিক বুঝে গেলেন — মাজায় টান লেগেছে। পুরোনো রোগের পুনর্জন্ম। ডাক্তারেরা আদর করে যাকে বলেন — লাম্বার মাসল্ স্প্যাজম। এর পরের দুর্বিষহ ৪দিনের অবস্থা ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন।
যা-হোক, পরিচিত দন্তচিকিৎসকের দরবারে গিয়ে বসার জায়গা না পেয়ে মুখ কাঁচুমাচু করে নির্বোধের মতো দাঁড়িয়ে আছেন খান সাহেব। সাথে যাওয়া তার পরিবার একটা সোফায় জায়গা পেয়ে গেলেন আরেকজনের পাশে; তিনি খান সাহেবের মতো হতবিহ্বল বা দ্বিধাগ্রস্ত না। তাই তার তড়িৎ হস্তক্ষেপে তিনিও আরেকটা সোফায় ঠেলেগুঁজে জায়গা পেয়ে গেলেন; এবং এককোণায় কোণঠাসা হয়ে বসে রইলেন।
এমনিতেই একহাত অকর্মক, তার ওপর আবার মাজায় অনিশ্চিত ব্যথা; যে-কোনো সময় বিগড়ে যেতে পারে। হঠাৎ তার চোখ পড়ল সামনের সোফায় বসা তার পরিবার আর তার পাশে বসা আরেকজন নারীর প্রতি। সাদামাটা সাধারণ নারী; নিম্নমধ্যবিত্ত বা শ্রমজীবী। দুজনে বেশ হাসিঠাট্টায় জমে উঠেছেন। তাও আবার খান সাহেবের দিকে ঈঙ্গিত করে। এমনিতেই তিনি এ ক’দিনে গজিয়ে-ওঠা খোঁচাখোঁচা শ্মশ্রুমণ্ডিত চেহারা নিয়ে অস্বস্তিতে আছেন। তাকে দীনহীন মনে হচ্ছে নিজের কাছেই। কুলি-মজুর-ট্রাকের ড্রাইভারের মতো অনেকটা। তরুণ বয়সে দেশে প্রলেতারিয়েত-রাজ কায়েমের স্বপ্ন ছিল বুকের ভেতর; এখনও আছে। কিন্তু নিজেকে তাদের মতো লাগছে — এটা কেমন যেন অস্বস্তিকর। তার ওপর আবার তার দিকে ঈঙ্গিত করে হেলেদুলে হাসাহাসি। যা-হোক, কিছু বুঝে ওঠার আগেই ভেতরে যাবার ডাক পড়লো—‘আঙ্কেল আসেন’। স্বল্পসময়ে ডাক্তার কাজ সারলেন। কাজ সেরে বাইরে এলেন খান সাহেব।
বাসায় ফিরে পরিবারের কাছে তাদের হাসিঠাট্টার কারণ জানতে চাইলে তিনি যা বললেন তাতে তিনি ভিমরি খাওয়ার জোগাড়। দুজনের মধ্যেকার আলাপচারিতাটা এ-রকম ছিল :
: উনি কে?
: আমার হাসব্যান্ড।
: হাতে ব্যান্ডেজ ক্যান? গাড়িগুড়ি চালায় বুঝি?
: নাহ্! পোলাপানের সাথে ক্রিকেট খেলতে নামছিল। ব্যাট করতে গিয়ে হাত মচকায়ে গেছে।
: ও বুঝছি! ওনারে চ্যাংড়ামিতে পাইছে।
এরপর দুজনের হাসি আর মসকরা দেখে কে? যেন দুজনে কতদিনের আপনজন!
পুনশ্চ :
ডান হাতে প্লাস্টারের বিনিময়ে নিজে হাতে ভাত মাখিয়ে গালে তুলে তিনবেলা খাওয়াচ্ছেন খান সাহেবের প্রাণপ্রিয় পরিবার। আহ্, কী পরম শান্তি!! মাঝে মাঝে এমন অসহায় হওয়া মন্দ না!