গানপত্রিকা বাংলায় । জাহেদ আহমদ
প্রকাশিত হয়েছে : ২৯ মে ২০১৬, ১০:২২ অপরাহ্ণ, | ৬৮১৬ বার পঠিত
কয়েকটা আদ্দিকালিক খ্যাতি আছে এই ভূখণ্ডের, গোটা বাংলা মুলুকের, ছোটবেলায় ইশকুলপাঠ্য বইগুলো থেকে শুরু করে বয়োজ্যেষ্ঠদের মুখে সেই খ্যাতিচিহ্ন/প্রসিদ্ধি শুনে শুনে ব্যাপারটা আবহমান চিরন্তনী হিশেবেই বিশ্বাস করে গেছি বলা যায়। কিন্তু কোনোদিন মূলসুদ্ধু অমনতর প্রসিদ্ধির প্রকৃতি-প্রত্যয় তালাশিয়া দেখি নাই। ফিরিয়া ভাবি নাই বাপ-ঠাকুর্দার মুখে মুখে ফেরা আদুরে নামডাকগুলো অতিশয়োক্তি কি না। আমাদের এই সিলসিলা প্রায় বেবাক সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে দেখা যায় যে আমরা চালু জনশ্রুতিগুলো ঐতিহ্যজ্ঞানে আদর-কদর করে যাই টিল্ ডেথ! খুঁজে দেখি না ঢাকের বাদ্যির আওয়াজের আশপাশবাস্তবতা। আবহমান বাংলার, এবং তুলনামূলকভাবে সাম্প্রতিক বাংলাদেশের, যা-কিছু মশহুর তা-কিছু প্রকৃত প্রস্তাবে এবং দৃশ্যত উপস্থাপনে ব্যবধানদূরত্ব খুঁড়ে দেখা আশু দরকার।
পরের কাজ পরে, এবং যোগ্যতর অন্য কারোর জন্যই নির্ধারিত জগতের যাবতীয় পরের কাজগুলো, এখানে একবার শুনে দেখা যাক বাংলার প্রসিদ্ধ ডাকনামগুলো। বলা হয় তো কতকিছুই! বলা হয় বাংলা ধানের দেশ, প্রাণপ্রাচুর্যের দেশ, মাছভাতের দেশ, শান্তি ও সম্প্রীতির দেশ, সুখী মানুষের দেশ, সততার পরাকাষ্ঠার দেশ, সবুজের দেশ, জল-জঙ্গলশোভিত নৈসর্গিকতার দেশ, সংশপ্তকের দেশ, ষড়ঋতুর দেশ … ব্লা ব্লা। আসলেই কি বিজ্ঞাপনগুলো হক্-হালাল্ তথ্য প্রচার করে? এককাঠা জমিনে কয়মুঠা ধান হয় এখন এবং বাজারে উঠে সেই ধান কি খদ্দেরের এবং ধানজনয়িতা চাষার মুখে হাসি ফোটায় আখেরে? এই মৃত্যুমর্মরিত বদ্বীপে এখন চাপাতিশীৎকারের তলায় কে আছে প্রাণবন্ত? জলাশয়গুলো কি মাছ-খলবলিত? সুখ-শান্তি-পীরিতি-সততা গালগপ্পোকারীটিকেও খুঁজিয়া পাওয়া যায় কি ইহধামে? এবং প্লাস্টিকপ্যাকেটের পরিত্যক্ত নগরভাঁগাড়ে গাছপালাপাতালাতা আছে কি অবশিষ্ট যে দেশটাকে সবুজ দেখাবে? বেঁচে আছে একটাও টিলা-পাহাড়-ছড়া পাঁচবছরচুক্তির লুটপাটপ্রকল্পের বিগত দুইমেয়াদের দেশে? এবং সংশপ্তক কোথায় স্রেফ ফেসবুকিশ ধুমধাড়াক্কা আস্তিক-নাস্তিক ছাড়া? আর আষাঢ়ের বৃষ্টি হয় আগন মাসের শেষে, এখানে ঋতুচক্রও তো উল্টোবুজলি আজকাল। কাজেই বিজ্ঞাপনী প্রচারণাগুলোতেই যত আহ্লাদ আমাদের।
তথাস্তু! তবে একটা ডাকনাম উপরোক্ত অনুচ্ছেদে দেয়া হয় নাই। নিশ্চয় আঁচ করা যাচ্ছে সেই বিজ্ঞাপনোক্ত ধন্য-ধন্য পণ্যনাম ও পণ্যবালাটির চেহারা! হ্যাঁ, সেইটাই, যা ভেবেছেন তা-ই। বলা হয় বাংলা গানের দেশ। বলা হয় হাজার হাজার বছর ধরেই নাকি বাংলা গানে-গানে মাতোয়ারা যাবজ্জীবন কাটায়ে যেতেছে! এবং বলা বাহুল্য, বলা হয়, এখনও নাকি বঙ্গমাতা গানে-গানেই সুখেশান্তিতে শুইয়া-বসিয়া কাটাইছে দিবানিশি! নিশ্চয় লোকে যা বলে বেড়ায় তাতে কিছু-না-কিছু সত্যতা থাকিয়া যায় তলে তলে। সেই সত্যতা, আপাতত বোধিবিচারে, থাকতে পারে দুইভাবে : এক, মহাভারতপৌরাণিক কথাসূত্রে; এবং দুই, বিশ্রুত সেই লোককৌতুকীর কথাসূত্রে। সেই যে জঙ্গের ময়দানে সৈন্য মরে বেশুমার কাতারে-কাতার, শুমার করিয়া দ্যাখো কয়েক হাজার; অতিশয়োক্তিনিচয় এই প্রকারের। অথবা কাজির গরু আখ্যান। মানে, কেতাবে আছে কিন্তু গোয়ালে নাই। ধানের দেশ গানের দেশ বাংলাদেশ … এহেন স্লোগ্যানের ক্ষেত্রে একই তিলিসমাতি কারবার সংঘটিত হয়েছে এইটা হলফ করেই বলা যায়।
বাকি বিজ্ঞাপনগুলো ধর্তব্যে নেই না আপাতত, শুধু গানের দেশের খোঁজপতা চালাই কিছুক্ষণ, যদি কৃপাময় ফেভ্যরে থাকেন আমাদের তাহলে হেস্তনেস্ত না-হোক বুঝসমুজ কিছুটা পাবো। সত্যিই যদি বাংলা গানপাগল প্রজা-রাজা-সান্ত্রীসিপাইদের দেশ হতো, তবে এর হাজার বছরের ইতিহাসে একটা গানপত্রিকা নাই কেন? বর্তমান নিবন্ধের আওতায় আমরা কারণনির্ণয় কিংবা ব্যাখ্যাবিস্তারণে যেতে পারব না, হিম্মৎ ও মুরদ দুইটারই নিদারুণ ঘাটতি নিবন্ধকারের, আন্দাজ করার দিকেও হুদা যাইতে চাইছি না। আমরা অ্যাক্নোলেজ্/এন্ডোর্স করে নিয়েই আগাব যে এদেশের সহস্রবর্ষী ইতিহাসে একটাও গানপত্রিকা নাই। কিন্তু অনুপস্থিতির স্বরূপ অল্প-কিছুটা ঝালায়ে রেখে আমরা আমাদের মূল অনুষ্ঠান শুরু করব। মূল অনুষ্ঠান বলতে কেতাবি ভাষায় যারে বলে নিবন্ধের মূল প্রতিপাদ্য তথা আলোচকের ছকিয়ে-রাখা অভিপ্রায়ের অঞ্চলে প্রবেশিব।
বাংলায় গানপত্রিকার হাজিরা-গরহাজিরা
গানপত্রিকা বলতে এখানে গানকেন্দ্রী সাময়িক পত্রিকার কথা বোঝানো হচ্ছে। গানপত্রিকা বলতে অবশ্য বন্দুকবাজির পত্রিকাও বুঝে ফেলতে পারেন কেউ কেউ, অন্তত শব্দের আর্থস্তরে সেই ইশারা আছে যেহেতু, তবে এখানে গান মানে সামগ্রিক সংগীতের কথাটা বলা হচ্ছে। যেহেতু বন্দুকবাজির পত্রিকা হাজার বছরের বাংলায় বিস্তর বিরাজিছে, দৈনিক সংবাদপত্রগুলো ভরা মাস্তানি-রাহাজানির হর্ষবেদনার নানাবিধ প্রতিবেদনে এবং সেগুলো চলেও তো জঙ্গবণিক আর্মসডিলার-মার্সেইন্যারিদের স্পন্সর্শিপে, এখানে যা আছে তা নয় বরং যা নাই তা নিয়াই কিছুটা আলাপচালানি নিবন্ধাভিপ্রেত। কবিতাপত্রিকা বাংলায় কাতারে-কাতার সত্যিই, গল্পপত্রিকাও কম নয় সংখ্যায়, বিজ্ঞানপত্রিকা আর বিনোদনপত্রিকা আর দর্শনপত্রিকা আর কৌতুকপত্রিকা হাজারেবিজারে জন্মায় এবং মরে বছরে বছরে। কেবল গানপত্রিকার ভ্রূণেরও দেখা নাই। কিন্তু সংগীতপণ্ডিত, সংগীতরসিক, সংগীতকলালোচকের আনাগোনায় হাজার বছরের বাংলা নাকি বিদগ্ধ ও ভস্মীভূত প্রায়! বেদজ্ঞ পণ্ডিতেরা গানবাজনার আলোচনা দিয়াই ইয়ারবখশিদের আড্ডায় আগুন জ্বালিয়ে দেন হামেশা, কারণবারি পেটে দেড়ফোঁটা পড়লে তো কথাই নাই, মিয়া তানসেন তা-ও গলা আর ধ্যানজ্ঞান খাটিয়ে সুরের তেজে আগুন জ্বালাইতেন বলিয়া লোকালেখ্যে বর্ণিত। বঙ্গজ সংগীতরসিকেরা তাদের মুখেই বিশ্ব ফৌৎ করেন, চব্বিশঘণ্টায় আটচল্লিশবার স্যারা-জাহাঁ-স্যে-আচ্ছা ডিক্লেয়ার করেন নিজেরে, যদিও কামের নামে কোমর ভাঙেন নিত্য। মোদ্দা কথা, বাংলায় নিয়মিত সংগীতপত্রিকা নাই, ছিল না, বাংলায় গানপত্রিকা বার করবার কথা মাথাতেই আসে নাই কস্মিনকালে বেঙ্গল রেজিমেন্টের গানদেশপ্রেমীদের। মুখে এদিকে বিরাম নাই ‘গানের দেশ … গানের দেশ’ চিল্লানির।
কথাগুলো অনেকের কাছে এক্সট্রিম্ বিবৃতি মনে হতে পারে। সেক্ষেত্রে একটু টোন্-ডাউন্ করে ফের বলা যাক। অবাণিজ্যিক এবং বিচ্ছিন্নভাবে একপ্রকারের পত্রিকায় গান নিয়া কালেভদ্রে বেশকিছু ক্রোড়পত্র/কড়চা টাইপের আয়োজন লক্ষগোচর হয়েছে বটে হাজার বছরের বাংলায়, সেগুলো সমস্তই লিটলম্যাগ কিংবা বারোয়ারি বিভিন্ন প্রকাশনার আড়মোড়া ভাঙার খ্যাপ, কিন্তু শুধু সংগীত ও তদানুষাঙ্গিক বিষয়াশয় নিয়া বাণিজ্যিকভাবেই নিয়মিত ও বহুলবিতরিত পত্রিকা বাংলায় চির-গরহাজির। বছরে এক-আধখানা বাণিজ্যিক বিনোদন/সাহিত্যসুবোধ পত্রিকান্তরে স্পেশ্যাল্ সংগীতসংখ্যা পাওয়া যাইলেও দ্রব্যগুলো প্রায়শ ভক্তিমার্গীয় ও আধ্যাত্মিকতার উচ্চাঙ্গস্পর্শী হয়ে থাকে; সেখানকার কন্টেন্টগুলো ছকাবদ্ধ কয়েকটা রাস্তায় হাঁটে; একদিকে শেকড়ের খোঁজখবরের নামে অ্যাকাডেমিক্ অপাঠ্য ভঙ্গির রচনা/আলোচনা, বাউল আর পল্লিগীতিকা ছাড়া যাদের কাছে কিছুই গ্রাহ্য নয়, আরেকদিকে হিন্দুস্তানী ক্ল্যাসিক্যাল্ মিউজিকের সমুজদারগিরির নামে বেশকিছু অচেনা/চেনা রাগরাগিণীর নামাবলি মুখস্থ জপাজপি। কিঞ্চিৎ কপাল প্রসন্ন হইলে বেশি-থেকে-বেশি পুরাতনী বাংলা গানের তারিফি আলোচনা, তা-ও কথিত স্বর্ণযুগের ইন্ডিয়ান বাংলা ছায়াছবিগীতির বাইরে বেরোতে দেখা যায় না, আর আছে এক-আধটুকু গণসংগীতালাপ তথা আইপিটিএ নিয়া আহা-উহু। সংগীত নয়, গান নয়, সেসব রচনাপত্তরে দেখা যায় সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় ইত্যাদি নির্মাণ/নিরূপণের গলদঘর্ম ধর্মকর্ম। ছদ্ম-নৃতাত্ত্বিক অনুসন্ধিৎসার সেইসব প্রচেষ্টা হাজার বছর ধরে চলছে, মেশিন বোধহয় চলতেই থাকবে সভ্যতার অন্ত্যেষ্টি পর্যন্ত, এরপরও অনুসন্ধান ফুরাবার নয় ইহকালে। এত পরিচয়সঙ্কটে পর্যুদস্ত-দুশ্চিন্তিত বঙ্গবাসী মিউজিকমনস্ক হবে একদিন, দূর কোনো ভবিষ্যতে, এটুকু ওপ্টিমিস্ট হওয়া আদৌ দোষের নয়।
এদিকে এল কলের গান এবং গেল চলে, এল লং-প্লেয়িং-রেকর্ড এবং গেল চলে, এল ফিতার ক্যাসেট ও স্টেরিয়োপ্লেয়ার এবং গেল চলে, এল কম্প্যাক্ট-ডিস্ক এবং গেল চলে, এল ইউটিউব এবং চলেও যেতেছে … আমরা কই? আমরা আখড়ায়, আমরা বটতলায়, আমরা ধানের শীষে এবং নৌকায়, আমরা হারিক্কেন জ্বালিয়ে গেরামের গায়েন দিয়া সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ববোদ্ধা থাকিয়া যাইবার খায়েশে বিভোর। আমরা আসলে এখনও উনিশ-শতকী বিহঙ্গবিলাসী বাবুয়ানার বৈঠকখানার স্মৃতিনিষ্ঠ। ফলে আমাদের নগুরে নোশনগুলোর স্বীকৃতি দিতে এত কঞ্জুসি-কার্পণ্য। শহরের আলোবাতাসে এবং অনিবার্য শহুরে সুরে-সরগমে বেড়ে উঠলেও মুখে আমরা গ্রাম নিয়া আহাজারি করে চলি বেধড়ক। আমরা শুধু শেকড়ে পড়ে থাকতে চাই, ‘ফিরে চল্ মাটির টানে’ বেদিশা আওড়াই দিবানিশি কিন্তু কঙ্ক্রিট-সিমেন্ট-প্ল্যাস্টিক্ আর পোড়া কার্বন্-ডিজেলের আর্বান্ বাংলা আর তার আধাখেঁচড়া আর্বেইনিটি অ্যাভোয়েড করি, বৃক্ষের সমস্ত মধু ও রস তার মূলে বলিয়াই আমরা বাক্যবাগিশ বিবৃতি দিয়া যাই দিবারাত্রি, কিন্তু ফল ও পাতায় এবং শাখায় ও কাণ্ডে একফোঁটাও রসের খোঁজ কোনোদিনই করি নাই।
মিউজিক আমাদের চিত্তবৃত্তি, মিউজিক নিয়া আমরা বাণিজ্য করি না, মিউজিক মনের খোরাক ইত্যাদি বক্তব্যে আমরা হাজার বছর ধরে হ্যাজাকবাত্তি দিয়া আলো জুগিয়ে চলেছি স্বীয় কওমেরে। যে ব্যবসা করে, যে-গান ও যে-শিল্পী ব্যবসাবাণিজ্য করতে চায় গান দিয়া, তারে আমরা ত্যাজ্য করি গুণকীর্তনের আসরে। ব্যবসা কি ঠেকাতে পেরেছি? কিংবা গানের কি বিশ্বদরবারে আসন পাক্কা করে ফেলেছি চিত্তবৃত্তি দিয়া? আহাম্মকির চন্দ্র, ষোলোকলা পূর্ণ হতে এখনও বোধহয় একটু দূর-দিরং আছে। ট্যাগোরসংগীত আর নজরুলগীতি দিয়া আজকের দুনিয়ার গানস্টেশন চালানো সম্ভব হয় না, পাগলেও বোঝে এখন, লালন-হাসন-করিম দিয়াও বন্দেগি-জিন্দেগি চালানোর ধনুর্ভাঙা পণ করলেই তিনকিলোমিটারের বেশিদূর যাওয়া না-মুমকিন হবে বোধহয়।
গানের পত্রিকা বাজারে তেমন কাটতি পাবে না, গান বস্তুত শোনার জিনিশ পড়ার নয়, ধারণা যদি এমন হয় গানপত্রিকা না-প্রকাশের পেছনে, সেক্ষেত্রে এক-দুইটা বাড়তি বাক্যালাপ দরকার হয়। এদেশের জনগণ কি সাহিত্য খুব পড়ে? এদেশের ক্রেতাসাধারণ কি তিনবেলা কাব্য খায়? রিপ্লাই যদি হয় নাবোধক, তাহলে এত কবিতাকাগজ আর সাহিত্যসাময়িকী নিয়মিত হপ্তান্তে-মাসান্তে প্রকাশ হয় কেন? ভূতের বাসনা চরিতার্থ করবার গরজে? এত ঘটা করে বইমেলা হয় কেন বৎসরান্তে? হেন অনক্ষরের দেশে একলক্ষাধিক নবনিত্য বই প্রকাশ হয় কেন? প্রকাশনা ব্যবসায় কেন প্রতিবছর অর্থলগ্নি হয় এত? ওইটা দাতব্য বাণিজ্য? বইয়ের বিজনেস্ যদি টিকিয়া থাকতে পারে, এবং বই নিয়া সাপ্তাহিক রিভিয়্যু রচারচিও যদি পাব্লিশ হয় দেশে, গানের সঙ্গে ঘরসংসার করে এর অন্তত পঁচিশগুণে বেশি লোকে। কেন তবে একটা গানপত্রিকা, হাজারটা না-হোক পঁচাত্তরটা গানপত্রিকা, চালানো সম্ভব হবে না বাংলাদেশে? এরপরও বলা হবে এদেশ গানের দেশ, সুরের দেশ, সংগীতরসের দেশ!
বহুবিধ সংগীতপ্রকাশ ও প্রচারমাধ্যমের এই সময়ে এসে এখন গানবাজনা ব্যবসাবাণিজ্যিক মুনাফা কামাচ্ছে প্রতিদিন কাঁড়ি-কাঁড়ি। লাভের গুড় খাচ্ছে কে সেইটা আলগ সওয়াল। উত্তর নাই, যেহেতু কেই-বা কারে যেয়ে জিগায়, কিংবা উত্তর ওড়ে হাওয়ায়। স্রেফ বাংলা গানের, বাংলাদেশের গানের, বাংলাদেশের তরুণদের গানের, এবং বাংলাদেশেরই হাতের তালুর মার্কেটে, এখন প্রত্যহ বিজনেস্ হচ্ছে সমস্ত মাধ্যম মিলিয়ে কোটি-কোটি বিডিটি। কিন্তু খতিয়ান নাই, জাব্দাখাতা নাই, হিসাবরক্ষা নাই, মিউজিকের নিয়মিত পত্রিকা নাই। কি হচ্ছে, কে কি করছে, কেমন করে লড়াই চালাচ্ছে কোনো সংগীতশিল্পী কিংবা গানদল, মোড়লদের মাতব্বরি এবং বিবিধ সংস্কৃতির মিথস্ক্রিয়া আর আধিপত্যের রূপ-রূপান্তর, কোথায় কি আগ্রাসন হচ্ছে গানে এবং কেমন করে সেইসব মুকাবিলা করছে আজকের বাংলা গান, শ্রোতাদের গাইয়েদের বাজিয়েদের গীতিকারদের প্রযোজকদের পরিবেশকদের বিপণনকারীদের কারোরই কোনো খবরাখবর বাংলার গানপণ্ডিত রাখে না। খালি পুরানা বইয়ের পাতা ঘাঁটে আর কাটপেইস্ট মারে আর সেমিনারে পেপার পড়ে আর ছাত্রসখা বাংলা রচনা লেখে। এবং গানগবেষক তকমা জুটিয়ে কেউ কেউ মঞ্চও লাভ করে বেশ পাকাপোক্ত। করুক, মঞ্চে আপত্তি নেই, গবেষণা চলুক থোড়-বড়ি-খাড়া, কিন্তু সমস্তকিছুর প্রতিবেদন ও প্রসববেদনা জানাবোঝার পত্রিকাটা কালবিলম্ব না-করেই যদি রিডারের কোলে ওঠে তবেই হয় কাজের কাজটা।
গানপত্রিকা নিয়া ঘ্যানঘ্যান করে লাভ নাই। কেননা এদেশে এখনও ম্যুভিক্রিটিক্ প্রোফেশন্যাল্ কোনো পত্রিকা নাই। কিন্তু নজির যা আছে সামনে, সেগুলো ম্যুভিম্যাগাজিন নয়, সেসব বস্তুত রটনাগাথা প্রচারকারী বিনোদনপত্র। তবুও যদি নিজের দেশের নায়ক-নায়িকার রটনা রটাত সেগুলো! বলিউডের, এবং ক্রমবর্ধমান সাম্প্রতিক টলিউডেরও, ব্রডশিট রঙিন রিপোর্টে সয়লাব আমাদের দৈনিক ও সাপ্তাহিক-পাক্ষিকগুলো। এইসব পত্রিকারই নিঝুম কোনো কর্নারে বাংলাদেশের কোনো মুমূর্ষু নক্ষত্রগায়কের মিনি ইন্টার্ভিয়্যু প্রকাশ পায় মাঝেমধ্যে। এইটুকু অন্তত মুখে বলবার সততা আমরা রাখি যে আমাদেরও পত্রিকায় আমরা বাংলাদেশের গানের পৃষ্ঠপোষকতা সুযোগ পেলেই করিয়া থাকি। কাজেই আলাদা গানপত্রিকা বার করবার বুজরুকি কে করতে যায় আব্বা! তারচেয়ে রূপচর্চার সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনটা আরও মশলাদার করবার দিকেই নিয়োজিত করতে চাই আমাদের মাল্যভূষিত ও মূল্যবান মেধা।
গানপত্রিকা বাংলাদেশে এবং দেশান্তরে
একেবারে নেই তা নয়, আগেই বলা হয়েছে, কিন্তু সমস্তই অপ্রাতিষ্ঠানিক ও যুগ-যুগান্তরে বেরোনো ডুমুরের ফুল যেন। ছোটকাগজের বিক্ষিপ্ত ও অপরিকল্পিত কিছু উদাহরণ রয়েছে গানসংখ্যা প্রকাশের। যদিও বাংলাদেশের ছোটকাগজগুলো সর্বকালে সর্বদশকে সর্বশতকে নিজেদের গণ্ডীগোষ্ঠীর কাব্যফুল আর সাক্ষাৎকার প্রকাশের বাইরে দর্শন-বিজ্ঞান-রাজনীতি-অর্থনীতি-ভয়ভীতি-বিপ্লবপ্রীতি ইত্যাদি বিভিন্ন বড় বড় মাপের বিষয় নিয়া খানিকটা মাতামাতি করলেও সংগীত নিয়া ভাবিত হতে তেমন নজির নাই। কিন্তু মুখরোচক বহুকিছুই বাংলাদেশের ছোটকাগজ করেছে অগ্রকর্তব্য বিবেচনাবোধ ছাড়াই, যেমন উদাহরণত বলা যায় বাংলাদেশেরই একটা ছোটকাগজ ঢাউস কলেবরে গালিসংখ্যা প্রকাশ করেছে, একাধিক কাগজ ভাষাসংখ্যা প্রকাশ করেছে, এতকিছু করেছে কিন্তু গান নৈব চ! গান নয়, কাজেই, আমাদের দরকার হয় গালি এবং ভাষা! বাংলাদেশী সিটি-(নেটি)-জেনেরা ভাষা আর গালি রপ্ত করিয়া নিয়া তারপরে গান গাইবে মনস্থির করিয়াছে, নিশ্চয়, তথাস্তু! অত্যন্ত অ্যাডভান্সড লেভেলের ন্যাশনস্টেইট আমরা, কাজেই, ভাষাশিক্ষা আর গালিদীক্ষা ছাড়া আমাদিগের আর-কোনো গমচিন্তা নাই।
মিউজিক ম্যাগাজিন তো দূর-কি-বাত, আমাদের একটা সিনেম্যাগাজিনই নাই। ছিল কিংবা আছে যা যা, তা সমস্তই ইয়েলো জর্নাল্, ভারতীয় ছবিছায়ার প্রোমো প্রচার করার পাশাপাশি কিছু ‘আ মরি বাংলা’ ছায়াছবিচর্চাও হয় বৈকি। হিরো-হিরোয়িনদের গসিপ্, কথিত ‘বিকল্পধারার’ ফিল্মের তারিফ-তোয়াজ, মেইনস্ট্রিম্ ম্যুভি নিয়া নাসিকা-সিঁটকানো অথবা ঠাট্টাইয়ার্কি, আর প্যাকেজ্ টিভিফিকশন্ অথবা টিভিসি নিয়া আলাপ ইত্যাদিই ঘুরেফিরে সেইসব দৈনিক-সাপ্তাহিক-পাক্ষিক সিনেম্যাগের বিনোদনায়োজন। সংগীতশিল্প নিয়া আলাপালোচনা যা-কিছু হয় তা-সবের ধারক ও বাহক ওই বারোয়ারি বিনোদনপত্রগুলোই। ফিল্মস্টারের সঙ্গে যেমন ফাইজলামি-ফিচলেমি করা হয়, মিউজিকশিল্পীদের সঙ্গেও অনুরূপ, মিনি-ইন্টার্ভিয়্যু নিতে যেয়ে জিগানো হয় মিউজিশিয়্যানের ডায়েট কিংবা ব্যাঙ্ক-বিমা ব্যালেন্স সংক্রান্ত প্রশ্নাদি।
ইন্ডিয়ায় এবং বাংলাদেশে যেসব ‘বড়পত্রিকা’ বার হয় নিয়মিত পক্ষকাল পরপর কিংবা মাসান্তে, যেমন ধরা যাক ‘দেশ’ কিংবা ‘সানন্দা’, দেশের ভেতরে যেমন ‘কালি ও কলম’ কিংবা ‘নতুনধারা’ ইত্যাদি, এদেরে নিশ্চয় গানের পত্রিকা পাগলেও বলবে না। তারপরও ওই কাগজগুলোতে কনভেনশন্যাল্ মিউজিক ও মিউজিশিয়্যান্ নিয়া আষাঢ়ে-হেমন্তে বছরের এমাথা-ওমাথা গালগপ্পো হয় মাঝেমধ্যে। ‘দেশ’ ক্ল্যাসিক্যাল্ সংগীত কিংবা বাংলার পুরাতনী গান নিয়া মাঝেমধ্যে স্পেশ্যাল্ ইশ্যু প্রকাশ করে থাকে। সেসব পড়ে অবশ্য পরীক্ষার খাতায় মার্ক্স স্কোর করা ছাড়া বাংলা গানের তেমন উন্নয়ন হয় বলে মনে করার কারণ অল্পই। কিংবা ‘দেশ’ পত্রিকাতেই প্রতি পাক্ষিকে মিউজিক্যাল্ ইভেন্ট ও অ্যালবাম রিভিয়্যু করা হয়। এই ব্যাপারটা ভারি ভালো এবং আমাদের দেশেও অনুসৃত হতে পারে। এর ফলে কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, নীলাক্ষ গুপ্ত, শোভন সোম প্রমুখ ক্রিটিক্ ব্যক্তিদের উদয় সম্ভব হতে পারে বাংলাদেশেও। গোটা গানের কন্টেম্পোরারি আপডেট নিরীক্ষণের এইটাই নির্ভরযোগ্য উপায়। কিন্তু বাংলাদেশে নাই-নাই করেও যারা ছিলেন, ধরা যাক আবদুশ শাকুর কিংবা ওয়াহিদুল হক বা খান আতাউর রহমান বা আসাফ-উদ-দৌলা বা আজাদ রহমান বা মাকসুদুল হক বা মৃদুলকান্তি চক্রবর্তী বা মোবারক হোসেন খান বা করুণাময় গোস্বামী বা ফরহাদ মজহার বা সানজিদা খাতুন বা সনৎকুমার সাহা, তাদেরে দিয়া আমাদেরই বিচিত্র সংগীত-তৎপরতার জ্যান্ত প্রতিবেদনভাষ্য বার করে আনবার মতো পত্রিকা আমাদের ছিল না। নাই। ফলে তারা বাধ্য হয়েই, নিবন্ধকারের বিশ্বাস, মিউজিক সংক্রান্ত নিরঙ্কুশ লেখালেখির পরিবর্তে রবীন্দ্রনাথনির্ভর ও রাবীন্দ্রিক গদ্যকেতায় কিংবা লালনভক্তিতে একপ্রকার সাহিত্যগন্ধী মিউজিকরচনাই লিখে গেছেন আগাগোড়া।
বাংলাদেশের দৈনিক/সাপ্তাহিক/পাক্ষিক পত্রিকাগুলোতে মিউজিক আর মিউজিশিয়্যান্ নিয়া ছাপানো প্রতিবেদনরচনাসমূহ মূলত ফোটোশ্যুটসর্বস্ব। চোখে পড়া মাত্র মনে হয় ফ্যাশন্ শোয়ের সচিত্র প্রতিবেদন। গর্ভে সারবস্তু বলতে প্রতিবেদিত ব্যক্তিটি কীভাবে রাইতে ঘুমান বা ডাইলে অম্বল পছন্দ করেন নাকি অম্বলে ডাইল ছিটাইয়া ভাত খাইতে প্রেফার করেন ইত্যাদি বিচিত্রা বাগেরা-বাগেরা। আমরাও পড়ি, কিনি পত্রিকাটা, মিউজিকের প্যাট্রোনাইজিং করি মহাতুষ্টি নিয়া।
গানপত্রিকা নাই, আমাদের দেশে, কিন্তু দশমিশালি পত্রিকায় গান নিয়া মাঝেমধ্যে বেশকিছু সংখ্যা কাভার করা হয়েছে বৈকি। বিশেষ সংখ্যা হলেও কন্টেন্ট বিবেচনায় সেগুলো অভিনব বলা যাবে না। ভারতীয় বাংলা সাংগীতিক রচনানুশীলনের পথানুসরণে সেখানে কেবল প্রথানুবর্তী বিষয়ের সম্মিলন চোখে পড়েছে সবসময়। ক্ল্যাসিক্যাল্ মিউজিক, পুরাতনী বাংলা গান, পঞ্চকবির কাব্যসংগীত, ফোকলোরকীর্তন আর বাউলফকিরি অ্যাপ্রিসিয়েশন্ প্রভৃতির বাইরে আমরা দৌড়াতে পারি নাই। কিন্তু বাংলা তার নার্ভ এবং নিঃশ্বাসে এরই মধ্যে নিয়ে নিয়েছে, নেয়ার চেষ্টায় ছটফটাচ্ছে, শতেক জাতবেজাতের সুর ও স্বরের ধুন। বহু নদী-সরোবরের পানি মিশিছে রোজ বাংলার সুরমা-আড়িয়লখাঁয়, হাজার চন্দ্রবণিক-সূর্যড্রাগন আর ডাকু-চণ্ডালের বাজনাবাদ্যি মিশিতেছে হামেশা বাংলার নিত্যকৃত্যবাদ্যিতে। সেসবের খবরান্তর নাই ‘শিক্ষিৎ সমাজে’ সার্ক্যুলেইটেড কোনো পত্রপত্রিকায়।
দৃষ্টান্ত দেয়া যাচ্ছে না এই নিবন্ধে, দেখাবার ন্যায় দৃষ্টান্ত মুক্তস্বাধীন বাংলাদেশে অ্যাবসেন্ট বিধায়, এমনকি বিচ্ছিন্নভাবে বেরোনো সংগীতায়োজনগুলো ঝটপট রোল্-কল্ করে নামডাকাও সম্ভব হচ্ছে না আপাতত বৈঠকে। যেহেতু বর্তমান রচনা আন্দাজের ভিত্তিতে একটানা বাজানো হচ্ছে, এখানে সেকেন্ডারি কোনো সোর্স থেকে তথ্যতল্লাশ করা হচ্ছে না মোটেও, স্রেফ স্মৃতি থেকে বিচ্ছিন্নভাবে এক-দুইটি বিক্ষিপ্ত পত্রিকানাম ডাকা যাক শুধু ধর্তাই দিয়ে যেতে। যেমন ধরা যাক এক-সময় ‘শৈলী’ নামে একটা পাক্ষিক বেরোত বাংলাদেশে, লেখালেখি ছাপানোর গল্পকবিতানির্ভর বাণিজ্যিক কাগজ, সেখানে এক-দুইটা গানসংখ্যা আয়োজিত হয়েছিল। প্রতিবছর রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলের জন্ম ও প্রয়াণদিবসে, লালনের আনুমানিক ‘আবির্ভাব’ ও তিরোধানের দিনে, দেশের দৈনিকগুলো সবিশেষ সাপ্লিপেইজ্ প্রকাশ করে থাকে; সেসব সাপ্লিতে এক-দুইটা গানালেখ্যনির্ভর পুরানা বাক্যবাগিশিভিত্তিক তারিফি নিবন্ধ লভ্য। এর বাইরে, অ্যাট-লিস্ট কমার্শিয়্যাল্ দেশজোড়া সার্ক্যুলেশনের পত্রপত্রিকায়, তেমন কোনো উদ্যোগ ইতিহাসে নেই বললেও হয়। চিপায়চাপায় থাকতে পারে বটে। সেইসব চিপা মাড়াই না আপাতত। প্রকাশ্য দিবালোকে যা আছে কিংবা ছিল তার কয়েকটা আলাপে আনি শুধু।
ছোটকাগজগুলোতে মাঝেমধ্যে স্পেশ্যাল্ গানসংখ্যা বার হয়েছে স্বীকার্য। দুই দিকের বাংলা মিলিয়ে বিগত পঞ্চাশ বছর ধরে এন্তার ছোটকাগজ বেরিয়েছে যেগুলো অত্যন্ত ছোট গণ্ডীর ভিতরেই বিতরিত ও পঠিত, অবাণিজ্যিক ও অমুনাফাজনক সমস্ত উদ্যোগ, বড় কোনো লক্ষ্যহীন ও অপরিকল্পিত উদযোগ অধিকাংশত। ফলে আক্ষরিক অর্থেই সীমাশুমারহীন সেইসব উদ্যোগের সমস্ত খবরাখবর লিপিবদ্ধ করা সাধ্যাতীত কোনো একলা ব্যক্তির পক্ষে। এখানে এক্সাম্পল্ হিশেবে একেবারে কড়ে-আঙুলরেখায় হিসাবরক্ষণযোগ্য কয়েকটা নাম স্মরণ করা যাক যারা গানসংখ্যা ছাপিয়েছিল তাদের প্রকাশসময়ের কোনো-না-কোনো পর্যায়ে। এর বাইরেই থেকে যাবে নির্ঘাৎ অযুত-নিযুত নামগুলো, বলা বাহুল্য।
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে, ইন্ডিয়ায়, এন্তার ছোটকাগজ প্রকাশিত হয়েছে বিগত পাঁচ-দশকের পথপরিক্রমায়। এর মধ্যে বেশিরভাগই বিলুপ্ত। গুটিকয় কাগজ আছে যেগুলো লিটলম্যাগ আর বিগম্যাগের একটা মাঝামাঝি অবস্থানে নিজেদেরে নিয়ে যেয়ে এখনও প্রকাশিত হয়ে চলেছে। এমনই একটা কাগজ ‘অনুষ্টুপ’ যারা গানসংখ্যা প্রকাশ করেছে। তেমনি বাউলগান নিয়া কাগজের বিশেষ ক্রোড়পত্র করেছে এন্তার লিটলম্যাগ গোত্রীয় পত্রিকা। বাউলগানের আলোচনা সংবলিত সংগ্রহণযোগ্য সংখ্যা ছাপিয়েছিল ‘ধ্রুবপদ’; যেমন বাংলাদেশের একটা কাগজ ‘খোয়াব’ করেছিল একটা গানসংখ্যা প্রায় অঘোষিতভাবে, সেইটাও মূলত পল্লিগান তথা শাহ আবদুল করিম বিষয়ক আলোচনা-সাক্ষাৎকার নিয়ে। ‘এবং জলার্ক’ নামে একটা ভারতীয় বাংলা পত্রিকায় বিপুল কলেবরে গণজাগরণমূলক বাংলা গান নিয়া ‘যুদ্ধজয়ের গান’ শীর্ষক সংখ্যা বার হয়েছে। ‘তেহাই’, ‘তীব্র কুঠার’, ‘অমৃতলোক’ প্রভৃতি পত্রিকাতেও কখনো-কখনো সংগীত উপজীব্য করে সংখ্যা বার হয়েছে স্মরণ হয়। এছাড়া তাদের অগণিত লিটলম্যাগ এবং গোনাগুন্তির বিগম্যাগের শারদীয় সংখ্যাগুলোতে ফি-বছর গাননিবন্ধাদি ছাপা হয়, কিন্তু সোনার তরীগুলো ভরা খালি হিন্দুস্তানী শাস্ত্রীয় সংগীতের ওস্তাদজিদিগের বংশলতিকায়। ইন্ডিয়ার দুইটা পাব্লিশিং হাউজ্ ‘মনফকিরা’ এবং ‘প্রতিভাস’, এরা গানের দুইটা ভালো সংখ্যা বার করেছিল তাদের যথাক্রমে ‘ত্বষ্টা’ এবং ‘শহর’ পত্রিকায়। এগুলো স্মরণযোগ্য সমস্তই।
কিংবা বাংলাদেশের আরও কয়েকটা কাগজের নাম স্মরণ করা যায় যেখানে বিভিন্ন সময়ের অধ্যায়ে একেকটা গানসংখ্যা বার হয়েছে। একটা প্রায়-গানকেন্দ্রী পত্রিকা বার হয়েছে এক-সময় নারায়ণগঞ্জ থেকে, ‘ধাবমান শিল্পীগোষ্ঠী’ কর্তৃক, ‘ধাবমান’ নামেই। সিলেট থেকে প্রকাশিত ছোটকাগজগুলোতে গল্পকবিতা ছাপাছাপির পাশাপাশি গানকেন্দ্রী নিবন্ধ প্রকাশের পরম্পরা গোচরে এসেছে সবসময়। কিন্তু যত-না গানের উদযাপন, তারচেয়ে বেশি শেকড়ানুসন্ধান আর মাটির গন্ধ খোঁজাখুঁজিই নিবন্ধসমূহ ভরে রেখেছে। এবং গান মানেই পল্লির মেঠো পদাবলি কিংবা বাউলসংগীত, এই-রকম একটা মাইন্ডসেট সেসব রচনায় পীড়াদায়ক। তবু কয়েকটা কাগজ হয়েছে এখান থেকে কেবল গানবাজনা সাজিয়ে। এদের মধ্যে ‘খোয়াব’ নামটা আগেই নেয়া হয়েছে; এছাড়া ‘সাঁই’, ‘কীর্তনিয়া’, ‘লোকচিহ্ন’, ‘সহজিয়া’, ‘সূনৃত’ প্রভৃতি পত্রিকার নামোল্লেখ করা যায়। শেষোক্ত পত্রিকার পঞ্চম সংখ্যায় ইংরেজি গানের সর্বসাম্প্রতিক প্রবণতা-ভাবগতিক, রক্ ঘরানার গানবাজনার বিচিত্র খোলনলচে, দুনিয়াজোড়া গানের বাজার ও বিপণনগত যুগপরিবর্তন ধরার চেষ্টা দৃষ্ট হয়েছে যা বাংলাদেশের সাময়িক পত্রিকার ইতিহাসে এর আগে দেখা গিয়েছে বলাটা বাড়াবাড়িই হবে।
এক-সময়, আশির দশকে, ঢাকা থেকে একটা মাসিক বেরোত ‘সংগীত’ নামে। এই কিছুদিন আগেও, ২০০৬/২০০৭ সন পর্যন্ত, ঢাকার ফুটপাতের পত্রিকাছাউনিগুলোতে ‘সারগাম’ (বা ‘সারেগামা’, নামটা ঠিকঠাক ইয়াদ নাই) নামে একটা মাসিক কিছুদিন দেখা গিয়েছিল, যদিও দেশব্যাপী এর সার্ক্যুলেশন্ ছিল বলে মনে হয় না, অচিরে এইটাও অদৃশ্য। ‘সচিত্র সন্ধানী’ কিংবা ‘ভারত বিচিত্রা’ পত্রিকাদিতেও সংগীতকেন্দ্রী নিবন্ধ-প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে বিস্তর। যদিও নব্বইয়ের দশক জুড়ে বাংলাদেশে অডিয়োবাজার যেভাবে প্রসারিত হয়েছিল, অতিকায় ব্যবসাবাণিজ্য হয়েছিল তখন ফিতার ক্যাসেটের, অস্বাভাবিক ছিল না পাঁচ-সাতটা পাক্ষিক/মাসিক সংগীতপত্রিকা থাকা। তা তো ছিলই না, উপরন্তু সমসাময়িক সংগীত নিয়া আলাপালোচনা প্রায় নিশ্চেষ্টভাবেই নিরালোকে থেকে গেছে বরাবরের মতো।
শুধু একটা ব্যতিক্রম জন্ম নিয়েছিল ওই সময়ে, নাইন্টিজে, এবং দশক অতিক্রান্ত হবার অব্যবহিত পরেই জিনিশটা চিরসমাধিস্থ হয়ে যেতে পেরেছে। এইটা গানপ্রেমীদের, বিশেষভাবেই নাগরিক ইটসিমেন্টপ্ল্যাস্টিকের সুরসন্ধিৎসুদের, বিশেষভাবেই ইয়াদ থাকার কথা। ‘আনন্দভুবন’ নামে একটা পাক্ষিক বিনোদনপত্রিকা বার হতো তখন, অত্যন্ত সমাদৃত হয়েছিল পত্রিকাটি বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্তমহলে এবং ভারতীয়া ‘সানন্দা’-‘আনন্দলোক’ পত্রিকাসমূহের বাংলাদেশে একচেটিয়া কাটতিতে একটা থাবা মারতে পেরেছিল, ওখানে প্যপমিউজিক তথা বাংলাদেশের এবং গোটা বিশ্বের রকমিউজিক নিয়া ভালোমন্দ খবরবার্তা জায়গা পেত উল্লেখযোগ্য যত্ন ও কলেবরে। এবং অচিরে মূল পত্রিকার অভ্যন্তরে একটা আলাদা জায়গা জুড়ে ‘সারেগারে’ শীর্ষক সংগীত-উপজীব্য-করা আয়োজন শুরু হয়। ম্যাগাজিন উয়িদিন্ ম্যাগাজিন ছিল ‘সারেগারে’, একফর্মা ব্যাপ্তির গানায়োজন প্রত্যেক পনেরোদিনে, এবং যতদিন ‘আনন্দভুবন’ জীবিত ছিল ততদিন ‘সারেগারে’ সার্ভ করে গেছে বাংলাদেশের জ্যান্ত সংগীত-তৎপরতাগুলোকে। এর প্রথম সংখ্যায় কাভার করা হয়েছিল বাংলাদেশের প্যপকিংবদন্তি আজম খান ও তার সংগীতলিপ্ততার আদ্যোপান্ত। পরবর্তীকালে জেমস, আইয়ুব বাচ্চু, মাকসুদ, লাকী আখন্দ প্রমুখ শিল্পীদিগেরে নিয়া মুল্যাঙ্কনধর্মী বিভিন্ন প্রতিবেদন ও প্রবন্ধনিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে একাদিক্রমে। অ্যালবামরিভিয়্যু, কন্সার্টরিভিয়্যু, স্টুডিয়োসংবাদ ইত্যাদি ছিল পত্রিকার নিয়মিত সেগ্মেন্টগুলোর মধ্যে কয়েকটা। হ্যাঁ, বাউলঘরানা আর পল্লিবাংলার পদাবলি নিয়াও ‘সারেগারে’ স্পেশ্যাল্ ইশ্যু করেছে; সে-সমস্তই ছিল সম্প্রসারিত নগরসংস্কৃতির বাংলাদেশভূমি বিবেচনায় রেখে একেবারে আপডেটেড প্রেজেন্টেশন্। অনলাইন পত্রিকার যুগে এসে আমরা দেখেছি যে ইংরেজি ভাষায় পাব্লিশড অসংখ্য গানপত্রিকার যে-প্রেজেন্টেশনধারা, কন্টেন্ট ধারণের যেমনটা ব্যাপ্তি এবং গভীরানুগামিতা, ‘সারেগারে’ সেই-সময়ে ঠিক ওই কায়দায় প্রেজেন্টেড হচ্ছিল। ওই প্রথম, ওই-ই শেষ, পরে এমনটা আর হয়নি।
কিন্তু তথ্য সংরক্ষণের খাতিরে হলেও বলা দরকার যে, এদেশে আরও কিছু পত্রিকা বার হয় যেগুলোতে গানসংক্রান্ত রচনাপত্তর ছাপা হবার কথা। বাংলাদেশের পাব্লিকের ট্যাক্সের পয়সায় সেই ইন্সটিট্যুশনগুলো চলে ব্যাপক জনবল ও লটবহর নিয়ে। সেইসব প্রতিষ্ঠান থেকে রেগ্যুলার পিরিয়োডিক্যাল্ বেরোবার কথা এবং বেরোয় বলেও শোনা যায় লোকমুখে। হেরি নাই নয়নে কভু, অতএব, বলা নাহি যায় ভালোমন্দ কিছুই। কিন্তু ‘নজরুল অ্যাকাডেমি পত্রিকা’, ‘বাংলা অ্যাকাডেমি পত্রিকা’, ‘শিল্পকলা অ্যাকাডেমি পত্রিকা’ নামের পয়সাভাসা কাগজপত্রগুলো কোনোদিনও কি মানুষের পড়ার মতো পত্রিকা হয়ে উঠবে না? নাগাল পাবে এগুলোর, দূর কোনো ভবিষ্যতেও, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জনগণ? নাকি সরকারি মাল চিরকাল দরিয়ায় ঢেলে যাওয়া হবে বেজবাবদিহি? নিশ্চয় এই বিশুষ্ক রোগজীর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো অচিরে লক্-আউট ঘোষণা করে দেশের সম্পদের অপচয় নিকেশ করার বোধোদয় হবে দেশভাবুকদিগের। বন্ধ হবে বেহুদা সাংস্কৃতিক অফিসারগিরি।
ডিজিটাল সোনার বাংলায় গানপত্রিকা
বাংলাদেশে ম্যাগাজিনজগতে একটা বাঁধভাঙা বানের পানির ঢল নেমেছে এখন অনলাইন প্রযুক্তিকৃপায়। দেখতে দেখতে এরও দশক পূর্ণ হয়ে গেছে এরই মধ্যে। এন্তার ফ্রি ব্লগসাইটের ম্যাগাজিন, ওয়েবপোর্টাল্, দৈনিকী-ঘণ্টিকী-মৌহূর্তিকী ইত্যাদি বিরাজিছে বেঙ্গলের বনেজঙ্গলে-ভদ্রাসনে; এর মধ্যে একটাও নয় গানের লেখা ছাপাছাপির জন্য উৎসর্গিত। যদিও বাংলায় আল্লা নিয়া মারামারিতেই রিলিজিয়্যন্ এবং আল্লা মারার মধ্যেই বিজ্ঞান প্রচারকারীদের খপ্পরে এখনও অনলাইন অ্যাক্টিভিটিগুলো ঘুরপাকরত, তবু কবিতা আর সাহিত্য করাকরির প্রচুর ওয়েবজিন ইতোমধ্যে বেরিয়েছে এবং নিয়মিত সচল রয়েছে অজস্র। কোনোটাই নিরঙ্কুশ মিউজিকের ওয়েবজিন নয়। কিন্তু রচনা ছাপা হয় বেশকিছু ওয়েবজিনে দেশবিদেশের মিউজিক নিয়া। তাদিগের মধ্যে বেশিরভাগ রচনাই নিতান্ত তাৎক্ষণিকতার হুজুগবৈশিষ্ট্যধারী। কিন্তু সমস্ত হ্রস্বায়ত রচনাদির মধ্যে একটা ব্যাপার দ্রষ্টব্য, কোথাও গ্রন্থমণ্ডূক অভিজ্ঞতা দিয়া গানের বিচার করা হচ্ছে না, সকলেই নিজের জিভে-চাখা অভিজ্ঞতাটা আখ্যানভাগে এনে রাখতে চাইছে। এইটা সাংঘাতিক শক্তির দিক একটা, আগে এমনটা বাংলায় দেখা যায় নাই। কিন্তু রচনাপ্রাচুর্য যেমন অনুপস্থিত, অনলাইনের পত্রিকায় ছাপা গাননিবন্ধগুলোর কথা বলা হচ্ছে, যেন হুড়োহুড়ির বাক্যগুচ্ছ, রচনাপ্রাখর্য-রচনাগাম্ভীর্যও গরহাজির, রচনায় নেই রচনার স্বাবলম্বিত স্বধর্ম রক্ষার প্রচেষ্টা। তা সত্ত্বেও রচনাগুলো প্রযত্নের যোগ্য।
অল্প কয়েকটা সাইটে দেখা যায় কাব্য-গল্প-মশকরা আর ধর্মবিজ্ঞানরাজনৈতিকতামাস্তানি কিংবা পাণ্ডিত্য নয়, গানের লেখা ছাপাবার দিকে সাইট-সঞ্চালকদের বিশেষ ঝোঁক। গান এবং গানেরই পাড়াপ্রতিবেশী নিয়া সাইটগুলো যত্নশীল বোঝা যায় তাদের উত্তোলিত রচনাতালিকার দিকে তাকালে। এমন গুটিকয় সাইটের মধ্যে একটা ‘লাল জীপের ডায়েরী’, যেখানে দেশবিদেশের গান শ্রবণের বাংলা অভিজ্ঞতাগুলো মুদ্রিত হতে দেখা যায় অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে। এমন আরেকটা গানপ্রধান রচনা ছাপাবার স্থান ‘নয় নাম্বার বাস’, যেখানে কবিতা ইত্যাদি ছাপানো ছাড়াও মুখ্যত ইংরেজি বিচিত্র ঘরানার গানের অভিজ্ঞতা বাংলাশ্রোতার বয়ানে গৃহীত। সংখ্যায় এখনও ওই দুই সাইটের মতো সমৃদ্ধ না-হলেও ‘রাশপ্রিন্ট’ আরেকটা সাইট যেখানে গানকেন্দ্রী নিবন্ধ-খবরবার্তা ছাপানোর ঝোঁক লক্ষণীয়। ‘নকটার্ন’, ‘বাছবিচার’ প্রভৃতি কিছু কিছু পত্রিকায় গান নিয়া টুকটাক লেখা মাঝেমধ্যে দেখা যায় ছাপা হতে। এগুলোর, এতক্ষণ বর্ণিত ওয়েবপত্রগুলোর, কোনোটাই নিবেদিত সংগীতপত্রিকা নয়। এসব জায়গায় গানের রচনা বাইপ্রোডাক্ট হিশেবেই যেন প্রকাশিত হয় বেশিরভাগ সময়, নিশ্চয় লেখক ও লেখা প্রাপ্তির অনটন একটা ব্যাপার। তবুও সঞ্চালক/সম্পাদক পর্ষদের পত্রিকানীতিও বড় ভূমিকা রাখে লেখকসঙ্কট/লেখাপ্রাপ্তিসমস্যা কাটিয়ে উঠতে। নিশ্চয়। একেবারে রিসেন্টলি ‘বানান’ নামে একটা ম্যাগ দেখা যাচ্ছে, ওয়েবে, যেখানে রিটেন্ এবং ভিশ্যুয়্যাল্ দুই ফর্মেই গানের টেক্সট তথা গানরিলেটেড রচনা পাব্লিশ্ করা হচ্ছে। এর কন্টেন্ট ও অন্যান্য কুশলতায় থিম্যাটিক্ লক্ষ্যানুসৃতির ছাপ পাওয়া যায়। এই ম্যাগেরও অভিপ্রায় সেই শিকড়ানুসন্ধান, ইন্ সার্চ অফ রুটস্ এবং আইডেন্টিটি বিনির্মাণ, সম্ভবত, অন্তত শুরুয়াতের আলামত তা-ই ইশারা করছে। এইটা ভালো উদ্যোগের একটা হতে চলেছে, একেবারেই নির্ঝঞ্ঝাট গানের উদযাপন-পর্যালোচনার জন্যই নিবেদিত পরিসর, অবশ্য যদি কন্টিনিউ করে তবে।
এত লোকে গান শুনে, এত বড় বাজার গানের, এরপরও সুস্থায়ী একটা গানপত্রিকা নাই এমনকি আন্তর্জালপরিসরেও! অন্তত যত লোকে কবিতা সাবস্ক্রাইব্ করে, এরচেয়ে অ্যাট-লিস্ট চব্বিশগুণ বেশি লোকসংখ্যা গানগ্রহিতা হওয়া সত্ত্বেও সংগীতপত্রিকা নাই কেন দেশে, এর পেছনকার কারণ কিছুটা আন্দাজ করা যাবে না তা নয়, কিন্তু বর্তমান নিবন্ধে সেই ইনিশিয়েটিভ গ্রহণ করা হচ্ছে না সাধ্যি ও সময়ের অভাব থাকায়। কিন্তু ঘটনাটা কি এমন হতে পারে যে এদেশের লোকে গান ব্যাপারটাকে তেমন ‘সিরিয়াস্’ কিছু মনে করে না আজও? সুর শুধু গুনগুনানোর, গান শুধুই প্রেমাস্পদ পটানোর, হুদাই বিনোদনের ‘অনর্থনৈতিক’ কাণ্ড বলে মনে করে বেশিরভাগ ‘শিক্ষিৎ মানুষ’, অন্তত মুদ্রিত সংগীতপত্রিকার অনুপস্থিতি এই-রকম অনুসিদ্ধান্ত নিতে প্ররোচিত করে বৈকি। কিন্তু বলবার কথাটা এ-ই যে, আগে প্যাশন্ থাকলেও পয়সাকড়ির টানাটানিজনিত মুসিবতে একটা কাগজ করতে ব্যাপক জান্-কুর্বান্ করতে হতো; তবে এখন তো অর্থ কোনো অন্তরায় হবার কথা নয় একটা ব্যক্তি-উদ্যোগী মিউজিককেন্দ্রী লেখালেখির সাইট সঞ্চালনার ক্ষেত্রে, এরপরেও কেন সংগীতপত্রিকা নাই ওয়েবে? এবং আরও ভাববার যে, কেন পয়সাকুবেরেরা রাজ্যির ব্যবসাবাণিজ্য করে বেড়ালেও সংগীতের একটা বাণিজ্যিক নিয়মিত পত্রিকা বাজারে এনে ওঠায় না?
গানপত্রিকা আংরেজিতে
দেখা যাচ্ছে গানের দেশে গানপত্রিকা নাই। কিন্তু যারা নিজেদেরে গানের দেশ বা গাঁজাখুরি ইত্যাদি কোনোকিছুরই দেশ বলিয়া আহ্লাদী বিজ্ঞাপন প্রচার করে না, তাদের অবস্থা একবার সরেজমিন দেখা দরকার না? হ্যাঁ, দেখা যাক, দেখার চেষ্টা যাক করা। আমরা দান্তের দেশের ভাষা জানি না, জার্মান্-স্প্যানিশ্-ফ্রেঞ্চ-অ্যারাবিক্ জানি না, কাজেই সেসব দেশের খবরান্তর করা সাধ্যিতে কুলাচ্ছে না। বাংলা ছাড়া যে-ভাষাটা আমরা জানি, ইভেন্ বাংলার চেয়েও যত্নশীল যে-ভাষানুশীলনে, ইংলিশ তার নাম। দ্য ইংলিশ। আমাদের প্রাণের ভাষা, প্রভুযোগাযোগের ভাষা, আ মরি ইংলিশ ভাষা! সাধে কিংবা শখে নয়, নিতান্ত প্রয়োজনেই আরও বহুকাল আমাদিগেরে এই ভাষার চর্চা জারি রেখে যেতে হবে। এর সঙ্গে গানের প্রসঙ্গও জড়িত বৈকি।
ইংরেজিতে অ্যাট-লিস্ট তিনটা গানপত্রিকা আমরা আজকের প্রযুক্তিকৃপায় নিয়মিত অঙ্গুলিস্পর্শে পাই, কিংবা পাঠদরিশনও করি নিয়মিতভাবে, এদের মধ্যে একটা ‘রোলিংস্টোন্’ বা আরেকটা ‘বিলবোর্ড’ ইত্যাদি। কিন্তু সহস্রাধিক না-হলেও শতাধিক গানপত্রিকা চাহিবামাত্র অঙ্গুলিতে এসে যায় আগ্রহী রিডারের। পুরাটা মাগনা পাঠের মওকা পাওয়া না-গেলেও অংশবিশেষ নজর বুলাতে দেয় এবং ঠাহর হয় এর ভেতরকার কন্টেন্ট সম্পর্কে। এরপরে কেউ চাইলে অল্প ডলারে সংখ্যাটা সাবস্ক্রাইব্ করে নিতে পারে। একটু অপেক্ষায় একেবারে ফ্রি পড়ার মওকাও চোরাই পথে বের করে নেয়া যায় কিছুদিনের মধ্যে। এসবের মধ্য দিয়ে যেয়ে বোঝা যায় গান সম্পর্কে একটা আখাম্বা আধ্যাত্মিক স্যাঁতসেঁতে আবেগ ছাড়া বাংলার কোনো ধারণাই আসলে নাই। কিন্তু কথাটা কি ছোটমুখে বেশি বড় হয়ে গেল? অতি বৃহৎ শোনায় কি কানে? এক্সট্রা লার্জ? তবে একগাদা আংরেজি পত্রিকার নামতালিকা টাঙানো যাক নিম্নানুচ্ছেদে, যেখানে কেবল নাম থেকেই অনুমানের প্রয়াস নিতে হবে গান বিষয়ে বাংলা বারফট্টাই-বড়াইয়ের ফাঁপা লাফঝাঁপ কতটা ভারী। নিম্নানুচ্ছেদের পত্রিকাগুলো সমস্তই ইন্টার্নেটে দেখে নিতে পারে দুনিয়ার যে-কেউ। অস্ট্রেইলিয়্যায়, ক্যানাডায়, ইংল্যান্ডে, অ্যামেরিকায় এইধারা হাজারেবিজারে গানপত্রিকা বাণিজ্যিকভাবেই বিরাজিছে বিশ্বাস করতে নিশ্চয় বাংলার কেউ অনাস্থা আনবেন না। আন্তর্জালিক অনুসন্ধানপৃষ্ঠায় সার্চ দিলেই বিস্তর ইংরেজি মিউজিকম্যাগাজিনের নামলিস্টি বেরিয়ে আসে, এর মধ্য থেকে অল্প কয়েকটা নাম যাক এইখানে পড়া। আমরা এখানে একগাদা নামই নিচ্ছি শুধু। পত্রিকানামগুলো, একে একে, কমা দিয়ে দিয়ে।
অ্যাক্যুয়্যাস্টিক্ গিটার, অ্যাক্যুয়্যাস্টিক্ ম্যাগাজিন, অল্টার্নেটিভ প্রেস্, অ্যামেরিক্যান্ স্যংরাইটার, ব্যাজ্ গিটার ম্যাগাজিন, ব্যাজ্ প্লেয়ার, বিবিসি মিউজিক, বিগ্ চিজ্, বিলবোর্ড, ক্যান্যাডিয়্যান্ মিউজিক ম্যাগাজিন, সিয়েলো, ক্ল্যাসিক্ রক্ প্রেজেন্টস্, ক্ল্যাসিকা রেপের্টোয়ার, ড্যান্স ম্যাগাজিন, ডিজে, ডাউনবিট ম্যাগাজিন, ড্রাম্, ড্রামার ম্যাগাজিন, ডামি, ইলেক্ট্রোনিক্ মিউজিশিয়্যান্, এন্টার্টেইনমেন্ট উইক্লি, ফ্রুটস্, ফিউচার মিউজিক, গ্র্যামোফোন্, গিটার প্লেয়ার, গিটারিস্ট, হাফটাইম্ ম্যাগাজিন, ইন্টার্ন্যাশন্যাল্ মিউজিশিয়্যান্, ইন্টার্ন্যাশন্যাল্ রেকর্ড রিভিয়্যু, জ্যাজ্ জার্নাল্ ইন্টার্ন্যাশন্যাল্, জ্যাজটাইম্, জ্যাজোয়াইজ্, কিবোর্ড, লিভিং ব্লুজ্, মিক্স, মিক্সম্যাগ, মোজো, মোজো স্পেশ্যাল্, মিউজিক টিচার, মিউজিক উয়িক্, এনএমই স্পেশ্যাল্, অপেরা নিউজ্, পয়েন্টি ম্যাগাজিন, প্রিমিয়ার গিটার, প্রোফেশন্যাল্ সাউন্ড, পিয়্যুর কান্ট্রি, রেকর্ড কালেক্টর, রেলিক্স ম্যাগাজিন, রক্ সাউন্ড, রক্ হিটজ্ ম্যাগাজিন, রক্-অ্যা-রল্যা, রোলিংস্টোন্, সাউন্ড অন্ সাউন্ড, স্ট্রিংস্, সাবস্ট্রিম্ ম্যাগাজিন, দি মিউজিক্যাল্ টাইমস্, টোট্যাল্ গিটার স্পেশ্যাল্, আনকাট, আন্ডার দ্য রাডার …
অসংখ্য, অবিরল, বহুবৈচিত্র্যের গানপত্রিকা আংরেজিতে সুলভ। যন্ত্র নিয়ে, যন্ত্রী নিয়ে, লিরিসিস্ট নিয়ে, রেকর্ডিং টেক্নিক্ এবং টেক্নোলোজি নিয়ে একেবারেই নিয়োজিত-নিবেদিত সংগীতপত্রিকা। আর ভৌতিক নয় একটাও যে একুশ বছর পরে একেকটা বার হয়; এদের বেশিরভাগেরই ফি-বছর ছয় থেকে বারো সংখ্যা বার হয়, বায়ান্ন সংখ্যা বার হয় একবছরে এমন পত্রিকা প্রোক্ত তালিকায় একডজন আছে অন্তত।
বঙ্গজ সংস্কার, শাস্ত্র, ধর্মানুশাসন ও সংগীতবৃত্তি
বিষয়টা আলোচনাসাপেক্ষ হলেও নোক্তা হিশেবে এইখানে একটু বলে রাখা যাক, বাংলায় গানবাজনা শাস্ত্রাচারসিদ্ধ কোনোকালেই ছিল না। বাংলায়, মানে ‘হাজার বছরের’ বাংলা কালচারে, মিউজিক জিনিশটা আনুশাসনিক ধর্মধ্বজাগুলোর কারণে সামাজিকভাবে সিদ্ধ অথবা গ্রাহ্য ছিল না। হারাম্ বিবেচিত হয় যেমন ইসলামে, তেমনি হিন্দু ধর্মশাস্ত্রেও সংগীত ও চিত্রকলাজীবিকা আদি বৈধানিক বিবেচনায় নিষিদ্ধ ও নিন্দিত। হরিনাম নিতে যেয়ে যেটুকু কীর্তন আর আল্লাজিরে ডাকতে যেটুকু মুর্শিদি, কিংবা হামদ্-নাত্ আর ভজন-আরতি, এর বাইরে বেঙ্গল ভদ্রসমাজে গানবাজনা মোটামুটি গর্হিত। বরং সংগীত তার শাঁস আর ওজস্বী বলকারক বৈশিষ্ট্যসমেত উপস্থিত রয়েছে এখানকার ‘আদিবাসী’ বা ‘নৃগোষ্ঠী’ হিশেবে ট্যাগড্ জনপদে, যেখানে গানকে জ্ঞানকাণ্ড অথবা ব্রাহ্মজনোচিত দৈব উচ্চ-উচ্চ গুণকীর্তনের ভারবাহী জিনিশ করা হয় নাই। কিন্তু বঙ্গের ‘মূলধারা’ মানুষরতনের হাতে গান স্রেফ পার্পাস্ সার্ভ করার হাতিয়ার হয়েছে সর্বত্র। অথবা খাঁচা-পাখি ইত্যাদির জ্ঞানগর্ভ। তবে যে-অংশটা ব্রাহ্মণ্য বুজরুকির বাইরে থেকেছে, নানা কারণে থেকে যেতে পেরেছিল যে-অচ্ছ্যুৎ নমশূদ্রাতিশূদ্র জনগুচ্ছ পুরোতানুশাসনের বাইরে, এদের মধ্যে একটু হলেও সংগীতের উদ্দাম অংশ লভ্য। ভদ্রবলয়ে উন্মাদনা আর উদ্দামতা আদিকাল থেকেই নিন্দার্হ। অল্পবিস্তর উন্মাদনা অ্যালাও করা যাইতে পারে কেবল পরমেশ্বরের দরিশনার্থে, এশেকে আল্লায় ফানাফিল্লা দশায়, বেমক্কা ভাবান্দোলনে কেষ্টারতিমত্ত পরমহংসদেবের বাহ্যি যাওয়ায়। এনলাইটেনমেন্টের বাংলায় ‘প্রেম’ শব্দটা স্বাদেশিক মুক্তিপ্রশ্নে সর্বোচ্চ ‘দেশাত্মবোধ’ বা ‘দেশপ্রেম’ পর্যন্ত উন্নীত হতে পেরেছিল। অথবা ‘দেহহীন চামেলী’ কিংবা আখাম্বা ‘অনঙ্গ’, ওয়েস্টার্ন রোম্যান্টিসিজম্ হস্তে লইয়া বাংলায় যেটুকু শরীরী উদযাপন ছিল চর্যা আর বৈষ্ণব/বৈষ্ণবপূর্ব রসসাহিত্যে, সেটুকুও হয়ে গেল অতি মিস্টিক্; রবি ও ওই বিদ্যাদীপ্ত অন্যান্য স্টলোয়ার্ট কবিদিগের কবিতাকাজগুলো মোটা দাগে এইধারা কাণ্ডেরই ভাণ্ড; সংগীতের প্রভাবাভিঘাতে হেথা অঙ্গদোলাচল মোটামুটি নিন্দনীয় ও অভিশংসনযোগ্য। রবির গানে এই ব্যাপারটা ভালো বোধগম্য। শুধু ‘শরীরী প্রেম’ এবং তৎসঞ্জাত সংগীত বঙ্গখণ্ডে এখনও গর্হিত। রকগান কিংবা আরও বহুবিধ জঁরার দুনিয়ামাতানো সংগীত বঙ্গশ্রোতার সমুজদার কানে এই কারণেই অসহ্য সম্ভবত। বড়জোর মস্তকনর্তন বঙ্গসমুজদাররা পার্মিট করেন, বড়জোর সুফি তরিকায় মাস্ত্-হাল্ পরমাত্মাপ্রেমাবিষ্ট ভক্তিঘূর্ণি বরদাশ্ত করা যায়, সর্বশরীরের স্বেচ্ছাচার মুক্তিনৃত্য সহন বেজায় ক্লেশকর সমুজদারি বিধানে। যেসব গানবাজনায় একটা স্পার্ক জেনারেইট করে দেহের গিরায়-গিরায়, ব্যান্ড বা প্যপ্ বলিয়া বাংলা যারে একঘরে করে রেখেছে, সেইসব গানাবাজানা বাংলাল্যান্ডে ন্যাক্কারজনক ও অলমোস্ট অচ্ছুৎ বলিয়া আজও গণ্য।
মুসলমানদের শাস্ত্রে এতদসংক্রান্ত বক্তব্যগুলোর ইন্টার্পিটেশন্ মোটামুটি ‘বিজ্ঞানী’-অবিজ্ঞানী সকল মহলেই জ্ঞাত; অনেকেই মনে করেন যে সনাতন হিন্দু ধর্মের শাস্ত্রাখ্যানে গানবাজনার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা নাই। কিন্তু মনুসংহিতা বলছে অন্য। উপস্থিত মুহূর্তে বেদের বা উপনিষদের কোনো শ্লোক চয়ন করা যাচ্ছে না, ছান্দোগ্য উপনিষদে সুর-অসুর বাইন্যারি অপোজিশন্ দিয়া গানের চেয়ে বরং মানবজৈবনিক অন্যান্য দর্শনালাপের অবতারণ করা হয়েছে ভাবাটা একেবারে বেমূলক হবে না, হাতের কাছে পেয়ে যাওয়ায় মনুশ্লোক দুই-তিনটা হাজির করা যাক। সংহিতা বিধান দিচ্ছে, “কিতব ও কুশীলবেরা রাষ্ট্র থেকে বহিষ্কারযোগ্য (৯/২২৫)।” মোটামুটি প্লেটোর রিপাব্লিকচিন্তা ‘হাজার বছরের’ বাংলাতেও হাজির দেখে আহ্লাদিত হওয়া যাইতে পারে। অ্যানিওয়ে। এইখানে ‘কিতব’ বলতে বোঝানো হচ্ছে শঠ, প্রবঞ্চক, জুয়াড়ি ইত্যাদি; এবং ‘কুশীলব’ তো সর্বজ্ঞাত তথা গায়ক, বাদক, নর্তক ও অভিনয়কারী ইত্যাদি। কিংবা আরেক শ্লোকে যেমন “গানবাজনা করে জীবিকানির্বাহ করা অনুচিত (৪/১৫)” বলা হয়েছে। এইভাবে আরও অনেক জায়গায় গানের ব্যাপারে বারণ ও তুচ্ছতাচ্ছিল্যকরণ মনুসংহিতায় পাওয়া যাবে। এমনই একটা, “কামার, নিষাদ, নট, গায়ক ও অভিনেতার অন্ন ভক্ষণযোগ্য নয় (৪/২১৫)” যেখানে একঘরে এই বিশেষ বৃত্তিজীবীদেরকে সমাজঘোষিত পতিত/পতিতা বলয়ের অন্তর্ভুক্ত করে রাখা হয়েছে। এই সেদিন পর্যন্তও অবস্থা অপরিবর্তিতই ছিল। বর্তমানে হেরফের হয়েছে কি ইতিবাচক অর্থে? এখন অবশ্য পুঁজিরিলিজিয়নের যুগে এসে খেলা পাল্টেছে, বেশ্যা/বাঈজি ট্যাগিং বন্ধ হয়েছে এই বছর-পঞ্চাশ ধরে, সেলিব্রেটিরা দাপটের সঙ্গে সমাজের রোল্-মডেল্ হচ্ছেন এবং উচ্চাসীন বর্গের সমীহ ও শ্রদ্ধা কাড়ছেন; এরপরও মনোজাগতিক ছাপ তথা মাইন্ডসেট খুব-একটা পাল্টেছে বলা যাচ্ছে না চারপাশ রেকি করে। এদেশের চিত্রকলায় এই সেদিন পর্যন্ত, উনিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত, পোটো/পটুয়া নামে একটি বিশেষ শ্রেণি ছাড়া আর-কেউ প্রবেশ করে নাই। অবন ঠাকুরেরা এলেন এই সেদিন মাত্র। ধ্রুপদ সংগীতের সোনালি দিনের প্রচুর মজাক্-মর্দানা আর বাবুবিলাসপনার নজির ঠাসা একটা বই ‘মজলিস’, লিখেছেন কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, যেখানে এই ‘শিক্ষিৎ’ বাঙালির ‘হাজার বছর’ সংস্কৃতিপীরিতির দর্প ফুট্টুশ করার মতো প্রচুর অ্যানেকডোট্যাল্ লভ্য; সংগীতকলাজীবীদের নিয়া বাংলার তথাকথিত ঘুমনিদ্রা-হারাম-করা ভাবুক সমাজের মনোবৃত্তি এবং বিহেইভিয়্যরাল্ অ্যাটিট্যুড কেমন ছিল বোঝা যায় তাদের মুখনিঃসৃত বচন থেকে। এই সেদিন পর্যন্তও ম্যুভিমেইকার ঋত্বিক ঘটক স্বভাবসুলভ খিস্তিভাষায় ‘রামবাগানের মাগি’ বলতেন ইন্দুবালাকে, এই-রকম অজস্র তথ্যাকীর্ণ ‘মজলিস’ বইয়ের বারো-বৈঠকী আখ্যানের গোটা কাঠামোটা।
তাহলে, দেখা যাচ্ছে, প্যাট্রন্-ক্লায়েন্ট রিলেশনশিপের বাইরে মিউজিক ও মিউজিশিয়ানের সঙ্গে এদেশের উচ্চাসীন শ্রেণি এবং পরবর্তীকালে গোটা মধ্যবিত্তবলয়ের জনগোষ্ঠীর কোনো সমপাটাতনের লেনাদেনা ছিল না। আজও তথৈবচ। শুধু রবীন্দ্রনাথকাল ও তৎপরিপার্শ্ব স্বল্পকালীন একটা অধ্যায় এখানে ব্যতিক্রম বলিয়া আপাতত ধর্তব্য। গত শতকের উল্লেখযোগ্য একটা কাল পর্যন্ত ভদ্রলোকালয়ে গানাবাদ্য চরিত্রদোষ তথা স্খলন ও মতিবিভ্রাট হিশেবেই গণ্য হতো। বর্তমানে এর ক্যারিয়ারমূল্য উচ্চ যদিও। রূপভেদ তো পরিবর্তন বলিয়া গ্রাহ্য হতে পারে না। আজকের কর্পোরেট স্পন্সর্শিপের আদলে সেই জিনিশটাই দৃশ্যমান। উপচানো পুঁজির/মুনাফার একাংশ সংস্কৃতিক্রীড়ায় দানখয়রাতি দিলে পরে সিএসআর দেখানো হয়, ফেঁপে-ফুলে ওঠে সোশ্যাল্ স্ট্যাটাসের ওজনদার সিম্বল্, ট্যাক্স রিবেইট পাওয়া যায়, ফাও হিশেবে একটা হাল্কাপাৎলা অমরত্বও অনায়াসলভ্য। তদুপরি তেজারতিও তো মন্দ হয় না, গানবাজনা ভালোমতো বেচতে পারলে যায় বিয়ন্ড মার্জিন্ প্রোফিট হাঁকানো, বলা বাহুল্য। মুনাফা আরও অনেক পণ্যাদি দিয়াও করা যায় যেহেতু, উনারা প্রায়শ প্রচার করেন গানবাজনা জিনিশটা উনাদের মনের খোরাক, সর্বাগ্রে প্যাট্রনদের চাই মিজাজখোশ জমিদারতন্ত্র। হয়তো এই কারণেই নিত্য সংঘটিত শহুরে সংগীত বাংলার ধনকুবের কুতুবদের পৃষ্ঠপোষকতা পায় না, অ্যাক্লেইম্ পায় না দাতা হাতেমতাই মিডিয়ার, নাগরিক গানের কারিগরেরা প্যাট্রনের যথাযোগ্য মর্যাদাই দিতে পারে না; মাথা নুয়ায় না প্যাট্রনের সামনে, হ্যালো-হাই দিয়াই খাল্লাস হইতে চায়, প্যাট্রনের জ্ঞানগরিমা গ্রাহ্যিগণ্যি করে না সেভাবে। এর উপর দিয়া আবার এনাব্লিং সোসাইটি-নেটোয়ার্কের ক্রিটিক্ করে! স্ট্যাটাস্-ক্যু নস্যাৎ করতে চায় কিংবা আবহমান স্থিতাবস্থায় চিড় ধরাতে ব্যগ্র হয়! এদিক থেকে এখনও উস্তাদজিবৃন্দ উন্নত সোহবৎসম্পন্ন। উনাদের খান্দানে লেনাদেনা আদাব-সালামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। এর ফলে এখনও মনজমিন্দার বাংলা বাবু-জনাবেরা শাস্ত্রীয় সংগীতে এবং লিমিটেড কিছু ফোকের ঝাড়ফুঁকে মেতে থাকেন। উনারা বাউল তথা লালনগানের একটা মার্গীয় মর্তবা কালক্রমে এমনভাবে বেঁধেছেঁদে টাইটফিটিং দিয়ে সেরেছেন যে এখন হিন্দুস্তানী ক্ল্যাসিক্যালের ন্যায় লালনগানও হয়ে উঠতে চাইছে ‘অসাধারণ’ উদ্গারের আহা-উহু। ফলে সাধারণের নিঃশ্বাসগ্রহণ-বর্জন-বিনিময়ের রাস্তা লালনগানেও ক্রমে রুদ্ধ হয়ে এসেছে। একই পথে যেতে দেখা যাচ্ছে অধুনা শাহ আবদুল করিম প্রমুখের গানবাজনাগুলোকে। ব্যবসা আর প্রযুক্তিওয়ালাদের কৃপায় এ-যুগে সুরসংগীতের ‘শুদ্ধ’ তত্ত্ববাগীশেরা তেমন সুবিধে করতে পারবে বলে মনে হয় না। আজকাল ‘শুদ্ধ সংগীতের আসর’ আয়োজন করলে ব্যাপক লোকহাসাহাসি হয়, তাই বিচিত্র পাঞ্চ আইটেম্ সহযোগে ‘বেঙ্গল মিউজিক কনফারেন্স’-এর উদয়, নেস্ক্যাফে আর সাউন্ডক্লাউড আর কোকস্টুডিয়ো যুগে এখন ফোকফেস্টগুলো শুদ্ধগর্বীদের আখলাক্ পরিবর্তনে একটু হলেও ভূমিকা রাখবে মর্মে আশা ব্যক্ত করা যায়।
এই বেদজ্ঞ সোসাইটি বিদ্যাকে/বেদকে সেপারেইট করে রেখে এসেছে সংগীত থেকে। একটা প্র্যাক্টিক্যাল্ উদাহরণ, স্যিলি শোনাতে পারে কিন্তু দ্রষ্টব্য, বইদোকানগুলোতে এদেশে গানের সিডি বিক্রি হয় না; বা গানদোকানগুলোতেও সংগীত বিষয়ক বইখাতা রাখা হয় না। গানবাজনার সঙ্গে এদেশের বিদ্যাজগৎ/‘বিদ্বজ্জন’ উন্নাসিকতার সূত্রে সম্পর্কিত, মুখে মুখে সংগীতমুখর, অন্তরে তথা কামেঘামে সেভাবে সংগীতান্তপ্রাণ বলিয়া বিশ্বাস করার মতো যথেষ্ট দলিলপ্রমাণ নাই। যেটুকু সংগীত বঙ্গের নিত্যকৃত্যাদিতে দেখা যায়, সেসবের জন্ম ও বিকাশ ও প্রবহমানতা প্রাতিষ্ঠানিক প্রথানুবর্তী রিলিজিয়ন্ বাইপাস্ করে গড়ে উঠেছে, সেসবের জন্ম ও লালন হয়েছে নিম্নকোটির লোকেদের ঘরে এবং ঘরানায়, বেদজ্ঞ/বিদ্বান তথা গানপণ্ডিতদের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে। এই দিগন্তে একটু খোঁজপাত্তা চালালে বাংলায় গানপত্রিকার গরহাজিরা সম্পর্কিত অনুসন্ধানে ব্রেইক্-থ্রু পাওয়া যাবে মনে হয়। কে চালাবে খোঁজপাত্তা? বাংলায় চারণকবিদের কাল অস্তমিত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু শুরু হয়েছে চারণক্রিটিকের ধুন্দুমার উরাধুরা কাল। স্বভাবসমালোচকের দৌরাত্ম্য ও দাপটে সুর-অসুর চিনবর্ণ নাই। ঈশ্বর-নিরীশ্বর রেস্লিং ছাড়া বাংলার আকাশে আজ আর কোনো অভাব-অভিযোগ নাই, ইকোনোমিক্-সোশ্যাল্-পোলিটিক্যাল্-জিয়োগ্র্যাফিক্যাল্ জনগুরুত্বপূর্ণ কোনো দরবারদেওয়ান নাই, দিনরাত খালি ঈশ্বর-নিরীশ্বরের পশ্চাদ্ধাবন। সুর ও সুরার অভাবে বেঙ্গল কোনোদিন শুকাইয়া গাত্রচর্মসার হয়েছে বলিয়া ইতিহাসে সাক্ষ্য নাই। উল্টোটা আলবৎ আছে। বেঙ্গল গানের দেশ বলিয়া আহ্লাদে গদগদতা আছে। সে-ই আমাদের একটিমাত্র সুখ। আজ্ঞে হ্যাঁ। গানে গানে বাংলা গানপত্রিকাহারা মাতোয়ারা আসমুদ্রহিমাচল চিরকাল। চন্দ্রবিন্দু ব্যান্ডের সেই গানটা মনে আছে? সেই যে, “পাগলা খাবি কী? / ঝাঁঝেই মরে যাবি”, যেখানে একটা লাইনে আছে ‘শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত লড়ে যাবি’ ইত্যাদি, আমাদের আর লড়াচড়া, আর গানপত্রিকা বার করা, আহ্লাদেই বাঁচি না, বারফট্টাই আর বড়াই-বিফাই করেই আমাদিগের মরি-মরি দশা। বাছারা গান গাইবে কি, সিন্স থাউজ্যান্ড ইয়ার্স সমুজদার উহারা, বিটকেলে আহ্লাদেই বাঁচে না বাছারা।
আধুনিক সমুজদার শ্রোতা আর তার দুই-তিনটে টেন্ডেন্সি
বিতিকিচ্ছিরি কিছু প্রবণতা সাধারণদৃষ্ট বঙ্গজ সংগীতসমুজদারদিগের মধ্যে। এখানে সেসব নিয়া আলাপের হাট বসানো অন্যায় হবে, এমনিতেই নিবন্ধের সম্ভাব্য দর্শকশ্রোতা প্রায় পীড়িত বোধ করছেন নিশ্চয় ইতোমধ্যে, একটানে একটা হাল্কা ছায়াছবি দেখা যাক যার শ্রেষ্ঠাংশে হেথাকার নানান সাইজের সংগীতসমুজদারবৃন্দ। শুধু ওই সিন্ দুই-তিনটে দেখতে চেষ্টা করি, ঠিক যে-কারণে এখানে একটা গানপত্রিকা অ্যাবসেন্ট আজও।
প্রথমত, বঙ্গেতে যে-জনের জন্ম তার মধ্যে একটা আজব প্রৌঢ়তার প্রবণতা কাজ করে; সে ভূমিষ্ট হবার পর থেকে তার চারপাশে বুড়াদের অ্যাক্টিভিটি এবং সামাজিক শানশওকাত দেখে বেড়ে ওঠে এবং স্বপ্ন লালন করে নিজেও বুড়ো হবে সাততাড়াতাড়ি। ইন্-ফ্যাক্ট পঁচিশ পেরোনোর প্রাক্কালে সে পুরোদস্তুর প্রৌঢ় হবার সোহবৎ অর্জন করে ফেলে। এবং বাকি জিন্দেগি কৃত্রিম কাশি দিতে দিতে এক-সময় কাশির দমকটাকেই দি বেস্ট মিউজিক অফ দি ইউনিভার্স সাব্যস্ত করে বসে এবং তদনুযায়ী নিজেকে বেঙ্গল মিউজিক ও গোটা কালচারের কমেন্টেটর ভাবতে শুরু করে। এর ফলে তার কাছে সংগীতের বৈচিত্র্য বলতে এক/দুই কিসিমের কাশি শুধু। অন্যান্য সমস্ত সংগীতব্যাপারে তার চক্ষু-কর্ণ-নাসিকা চিরতরে ডিজ্যাবল্ হয়ে যায়।
দ্বিতীয়ত, জমিজিরেতের পাহারাদার তথা সামন্ত ভূস্বামীদিগের আচরণটাকে এখনও বঙ্গজ আধুনিক সমাজে ‘কৌলীন্য’ বা ‘আভিজাত্য’ বলিয়া ভাবা হয়ে থাকে। এইটা গানের অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রক্রিয়া, তারিফি আর খারিজি কীর্তিকলাপ, সামগ্রিক মিউজিকের ‘রুচিবোধ’ সমস্তকিছুতেই প্রকট। ফলে প্যাট্রন আর স্পন্সর সকলেই চায় নিজের কুক্ষিগত করে রাখতে মিউজিকটাকে। পারলে কেবল নিজের ‘জলসাঘর’ বা বৈঠকখানায় ইয়ারবখশিদিগেরে নিয়া গানের সমুজদারি করে। কিন্তু উন্মুক্ত প্রযুক্তির এই ছোটলোকের জমানায় সেইটা তো সম্ভব নয়। কাজেই পৃষ্ঠপোষক সামন্তপ্রেতাত্মারা জাত্যাভিমানে মিউজিকের হাজারদুয়ারি ইনিশিয়েটিভে ইনভেস্ট করতে চায় না।
আরও শুমারবিহীন প্রবণতা আছে বেঙ্গলের সমুজদারদিগের মধ্যে, সেসব বলতে বসার জন্য পৃথক বৈঠকঠেক দরকার পড়বে। এইখানে এটুকু আন্দাজ করা যায় যে, পঁচিশ হবার আগেই যে-ন্যাশন্ বুড়িয়ে যায় এবং তার আশৈশব শোনা গানবাজনা নিয়া আলোচনায় দ্বিধান্বিত রয়, সেই ন্যাশনের গানের ডেভেল্যপমেন্ট দূরপরাহত। সংগীতের পত্রিকা বার করবে কি, সে তো ঘনযামিনী জেগে থেকে স্টেডিয়ামে ফুচকা আর কোকাকোলা সাবড়ে মরাহাঁজা রাজা আর ভাঁড়দের প্রেতাত্মার সনে প্ল্যানচেটে ব্যস্ত অধুনা। বাংলা এখন ডোভারলেইন্ মিউজিক্ কনফারেন্সের মন্দা ব্যবসা চাঙ্গা করিবার নির্ভরযোগ্য শাখা। জ্যান্ত সংগীত এখানে এক্সপেক্ট করা বাতুলতা।
গানপত্রিকা বাংলায় এবং একটা বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপনবিরতি
কিছুদিন আগে একটা কাগজের মলাটগাত্রে শীর্ষনামের নিচে ‘গানের কাগজ’ শব্দদ্বয় দেখতে পেয়ে একদম পয়লা ধাক্কায় ব্যাপারটা স্ট্রাইক্ করে এই নিবন্ধকারের মাথার ভিতরে; এবং চকিতে খেয়াল হয় যে, হ্যাঁ, তাই তো! গুচ্ছের সাময়িক পত্রিকার এই দেশে একটাও পত্রিকা নাই যেখানে অ্যাট-লিস্ট মলাটমুখে লেখা ‘গানের কাগজ’ পরিচয়লিপিটুকু, অন্তত স্মরণকালে হেন নজির কভু হেরিয়াছি ইয়াদ হয় না; ‘গানের কাগজ’ পরিচয় নিয়া আশপাশ অনেক বিষয়াশয় ইনক্লুড করুক পরে, যেমন ম্যুভির গান ও আবহনির্মাণ কিংবা রাজনৈতিক আন্দোলনে এবং সামাজিক বিরোধ নিষ্পত্তিকরণে গানবাজনার অবদান, ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে সুরের সাম্পান প্রভৃতি বিচিত্র খোলকর্তাল সহযোগে একটা গানকাগজ রোজকার হট্টমেলায় নিজের হাজিরানা জারি রাখিয়া যাইতে পারে কাগজকর্তৃপক্ষের দম যতদূর ও যতদিন পর্যন্ত না-ফুরায়। সেক্ষেত্রে গানানুষাঙ্গিক প্রসঙ্গের অভাব হবে না। স্কাই ইজ্ দি লিমিট।
হয়ে গেছে দেখতে-দেখতে দুইবছর পার, ওই গানপত্রিকা বাজারে বেরোবার, শিগগির পরের সংখ্যা বাজারে আসবে মনে হলেও পরে এর কোনো নতুন/দ্বিতীয় সংখ্যা বার হয় নাই। রিপোর্ট ২০১৬ সনের অন্তিম মে মাস পর্যন্ত। অস্বাভাবিক নয় এহেন সম্পাদকীয় প্রতিজ্ঞা সত্ত্বেও পত্রিকা দুই কিংবা কুড়ি কুড়ি বছরের পার পুনরোদিত না-হলেও। কেননা কাগজটা লিটলম্যাগের আদলে বেরিয়েছে, এবং কমার্শিয়্যাল্ কোনো সহায়তা না-নিয়ে স্রেফ সম্পাদকের জেবের পয়সায় কিংবা ক্রেডিট কার্ডে, এর জের দুই কিংবা তারও অধিক বছর টেনে যাওয়া আদৌ অস্বাভাবিক নয়। এমনও হতেই পারে যে লেখাপ্রাপ্তির সঙ্কট, অন্তত সম্পাদক-অভিপ্রেত রচনা না-পাওয়া, আর্থিক সঙ্কটের চেয়েও ভোগান্তিতে রেখেছে এডিটর ও এডিটিং-সংশ্লিষ্ট সবাইকে। এমন অনেক কারণ থাকতে পারে এহেন অবাণিজ্যিক একটা কাগজ একসংখ্যাতেই নিভিয়া যাইবার পিছনে। এরপরেও পত্রিকাটা, ‘গানের কাগজ’ পরিচয় নিয়ে বেরোনো পত্রিকাটা, ভাবিয়েছে এই নিবন্ধকার ও অন্যান্য যারা কাগজটা দেখেছেন/পড়েছেন তাদের মধ্যেও নিশ্চয় আরও অনেককে।
এবং খুব বেশি লোকে দেখেছেন বলেও ভরসা নাই। লিটলম্যাগ ধাঁচের কাগজপত্রাদির এইটা আরেক সমস্যা। ছাপা হয় এতই অল্প, যোগাযোগ প্রায় থাকেই না বলতে গেলে দেশের বিপণনকাঠামো ও বিপণীসমূহের সঙ্গে, বড়জোর ৩০০ থেকে ৭০০ বা হাজার হয়ে থাকে এ-ধারা কাগজের মুদ্রণসংখ্যা সাকুল্যে। এর ফলে ‘এলিট’ একটা পাঠকগণ্ডী ছাড়া কাগজ রিচ্ করতে ব্যর্থ হয় দেশের সত্যিকারের ধমনী ও শিরায়, দেশের গানপ্রেমী এবং গানানুশীলক বিপুলসংখ্যক দূরবর্তীদের কাছে, ফাইন্যালি শিক্ষাদীক্ষা আর পড়াশোনা আর পড়ুয়া-লিখুয়াদের লাভ হলেও সংগীতের/সংগীতানুশীলকদের লাভালাভ হয় না কিচ্ছুটি। টিমটিম করে হলেও তবু চৌষট্টি জেলায় একদিন পত্রিকা যাবে, অ্যাট-লিস্ট ৬৪০০ মুদ্রণসংখ্যায় উন্নীত হবার মতো তৌফিক হবে একদিন কাগজটার, এই সবকিছুর জন্য দরকার প্রথমত কাগজের শরীরী অস্তিত্ব ও আয়ু।
তবে এক্সাম্পল্ ক্রিয়েট করার জন্য যদি ছাপাছাপি হয়, এমনও হয় বটে এদেশে হামেশা, সেক্ষেত্রে কথা নাই। কিন্তু যদি মিউজিকে একটা সার্ভিস্ দেয়ার মানস থাকে সম্পাদক-প্রকাশকের, তবে রেগ্যুলার বেইসিসে পত্রিকা মার্কেটে ক্রেতার সামনে এবং ক্রয়সাধ্যিসীমায় রাখা জরুরি। ঠিক এইখানে অ্যামেচারিশ্ পত্রিকাগুলোর হার। দরকার প্রোফেশন্যাল্ পত্রিকার প্রবর্তনা। ‘গানের কাগজ’ পরিচয়ের এই একটা পত্রিকা দেখে এত কথাবার্তা মাথায় এসেছে নিবন্ধকারের। এবং এই পত্রিকাটা তারিফ করার জন্য মূলত অবতারণা ‘গানপত্রিকা বাংলায়’ শীর্ষক বর্তমান নিবন্ধের। পরবর্তী প্যারাগুলোতে, অ্যাট-লিস্ট দুই কি তিনটে এপিসোডে, সেই কাজটুকু করে সেরে এ-যাত্রা আমরা ক্ষান্ত হব। ‘মূল অনুষ্ঠান’ বলতে এই নিবন্ধের পরবর্তী অংশটুকু ধর্তব্য।
দইয়ল, মৌসুমী, ইউটিউবগুরু …
শব্দার্থ, শুরুতেই, অথবা নামকরণের সার্থকতা প্রতিপন্নকরণের প্রয়াস চালানো যাক। না, আপনাদের দিক থেকে ভুরু কুঁচকে এমনটা ভাবা আদৌ অস্বাভাবিক নয় যে এ এত ফর্ম্যাল্ ইন্ট্রো দিয়া আলাপচক্র শুরুয়াৎ করে কেন বাপু! উপরন্তু, যথেষ্ট কি হয় নাই, শিরোপরে প্যারাগুলো, গৌরনিতাইচন্দ্র? যত-যা-ই বলুন, বিসমিল্লায় শীর্ষস্থানীয় শব্দত্রয় — যথা দইয়ল, মৌসুমী, ইউটিউবগুরু — কি মিনিং অফার করছে, ব্যবহৃত শব্দত্রয়ীর অর্থ ও প্রয়োগপ্রসঙ্গসূত্র বলিয়া লইব। যথাক্রমে দইয়ল, মৌসুমী ও ইউটিউবগুরু পরপর তিনটে প্যারাগ্রাফে।
দইয়ল মানে হলো দোয়েল, বাংলাদেশের ন্যাশন্যাল্ বার্ড, জাতীয় পৈখ, সুমিষ্টস্বরা সাধারণদৃষ্ট অথচ অসামান্য, দোয়েলপৈখের নাম কোমলরূপে দইয়ল, সিলেট অঞ্চলে দোয়েলকে দইয়ল নামেই ডাকাডাকি করা হয়, দইয়লও সাড়া দেয় এই কোমল সম্বোধনে। সিলেটি রিয়্যাল্ অধিবাসীদের কাছে এইসব বলা বাহুল্য। তবে এইখানে এই নিম-নিবন্ধে দইয়ল একটা কাগজের নাম, গানের কাগজ, ২০১৪ অক্টোবরে বেরিয়েছে গানগ্রস্ত সুমনকুমার দাশ কর্তৃক সম্পাদিত হয়ে জেলাশহর সিলেট থেকে। এইটা ভালো কাজ হয়েছে একটা, গানের কাগজ দইয়ল, আপনি সিন্ডিক্যাট সাহিত্যের সোহবৎসম্পন্ন না-হইলে এই কাগজ এক-নজর দেখিয়াই প্রীত হইবার একটা চান্স অত্যন্ত জোরালো বলা যায়। অ্যানিওয়ে। এক নয় দুই নয়, একুশটা গানপ্রাসঙ্গিক রচনা কালেক্ট করা এবং পরিচ্ছন্ন প্রিন্টিং হুটহাট কোনো ঘটনা না। অনেকদিনের প্ল্যান্-পরিশ্রম-ড্রিম্ জড়িত, সহজেই বোঝা যায়, এর সঙ্গে। এখন যেইটা হয়েছে যে এই বার্ধক্যে এসে বেহুদা কবিতা নিয়া ফালাফালি-ক্যাচালপাড়া কাগজপত্রাদি লিখিতে-পড়িতে-বলিতে পারা আর ভালো তো লাগে না। কাঁহাতক আর! বুড়াহাবড়া শালিখগুলার ঘাড়েগর্দানে কেবলই হিংসার রোঁয়া, মাবুদ-এ-এলাহি, পোষায় না আর-কি। কাজেই গানের কাগজ, যা-ই-হোক, সই।
কিন্তু মৌসুমী ! সিজন্যাল্! আক্ষরিকার্থে ব্যাপারটা তা-ই, কিন্তু মৌসুমী স্ট্যান্ডস্ ফর মৌসুমী ভৌমিক এইখানে। এভার্গ্রিন্, নট সিজন্যাল্, বলা যায় ইটার্ন্যাল্। তো, মৌসুমী ভৌমিক কে, এই সওয়াল এইখানে বাহুল্যই বিলকুল। তাহার নামটা জানে গাঁয়ের পাঁচজনা। “আমার ঘরের পাশে গাছ আছে এক / তাতে বাসা বেঁধে ছিল পাখি / প্রসূতিকালে / ডিম ফুটে ছানা হলো / ছানাদের ডানা হলো / ডানা মেলে উড়ে গেল / বাসাটা ফেলে # # যখনই ভাবি আমি পাখির ওড়ার কথা / দু-ডানা মেলে / তখন আমার সেই হাসন রাজার কথা / হাসন রাজার গান মনে পড়ে — / লোকে বলে, বলে রে, ঘরবাড়ি ভালা নায় আমার” — এই ও অন্যান্য অনেক বোষ্টুমিবিধুর কীর্তনভাঙা গানের গীতিকার-সুরকীর্তনীয়া-গায়েন মৌসুমী ভৌমিক।
আচ্ছা। তাহলে, এইবার, রইল বাকি ইউটিউবগুরু । উল্লিখিত ‘দইয়ল’ শীর্ষক গানের কাগজ এবং মৌসুমী ভৌমিকের সঙ্গেই রিলেটেড প্রসঙ্গটি। তিনি, মৌসুমী ভৌমিক, একটা ভালো বৈঠকী ঢঙের অন্তরার্দ্র রচনা লিখেছেন ‘মনসামঙ্গল ও একটি এটলাস্ ছাতার গল্প’ শিরোনামে এই কাগজের যাত্রাশুরু সংখ্যায়। ‘নিউ ওর্যালিটি’ বিষয়টিকে প্রশ্নচিহ্ন/সংশয়চিহ্নের দ্বারা দাগিয়ে ইউটিউবগুরু প্রসঙ্গটি উক্ত রচনায় এনেছেন মৌসুমী, ইন্ট্রেস্টিং ব্যাপার মনে হওয়ায় এর উদ্ধৃতি টুকে রেখে যেতে এখানে এসেছি, জিনিশটা আগে টুকি :
সত্যিই ছেলেটার গলা আর গায়ন, দুইই খুব মধুর। করিম শাহ-র ‘কেন পিরিতি বাড়াইলা রে বন্ধু ছেড়ে যাইবায় যদি’, ভণিতাবিহীন উকিল মুনশির ‘সুয়াচান পাখি, আমি ডাকিতেছি তুমি ঘুমাইছ নাকি?’ — এইসব গাইল লিংকন। ভণিতা গাইলে না? আমরা জিজ্ঞেস করলাম। … লিংকনের খুবই নম্র স্বভাব, সে … আমতা আমতা করে বললো, ‘আমি আসলে ভণিতাটা পাই নাই। বারী সিদ্দিকী তো ভণিতা গান নাই।’ লিংকনের গান নিয়ে আমরা পরে অনেক কথা বলেছি। লিংকন বড় হয়েছে হাওরে, এই জল বাতাস ওর রক্তে, অথচ ওর গায়ন, উচ্চারণে ওর অঞ্চলের ছাপ বড় একটা নেই। সুকান্ত বলছিল, লিংকনের গলা থেকে ওর অঞ্চল মুছে গেছে। ঠিকই। লিংকনের পছন্দ বলিউডের সোনু নিগমের গান। ও হয়তো স্বপ্ন দেখে সেই ২০০৫-এর বাংলাদেশের ক্লোজআপ-ওয়ানের আইডল, জামালপুরের নোলকের মতন ওরও একদিন নামডাক হবে। বস্তুত, এই বারী সিদ্দিকী যেন এই একটা নতুন প্রজন্মের শিক্ষক হয়ে গেলেন। নোলককে আমি ইন্টারভিউ-এ বলতে শুনেছি, আমি শ্রদ্ধেয় বারী সিদ্দিকীর ‘সুয়াচান পাখি’ গানটা গাইলাম ক্লোজআপে। # # এই যে শুনে শুনেই শেখা, কিন্তু শোনার মাধ্যমটা পাল্টে যাচ্ছে, একে কোনো নতুন মৌখিকতার ধারা বলে চিহ্নিত করা যায় কি? A New Orality? মজা হচ্ছে যে, এই শোনার মাধ্যম কিন্তু শুধু এমন জায়গায় পাল্টাচ্ছে না যেখানে ট্র্যাডিশন্যাল মৌখিকতার ধারার আর কোনো অস্তিত্ব নেই। শাল্লার মতন জায়গায়, এমনকি সিলেট শহরেও পুরনো ধারা এখনো বহমান। এবং সেইসঙ্গেও লিংকনদের জীবন জড়িয়ে আছে। অথচ এই রেকর্ডিং শুনে গান শেখা, গান ‘দেখে’ (কারণ বেশিরভাগ গানেরই মিউজিক ভিডিও পাওয়া যায় এখন) গান শেখা, এর সঙ্গে যেন অনেক সহজে কানেক্ট করতে পারছে লিংকনরা। এবং এর প্রভাব শুধুমাত্র গাওয়ায় পড়ছে না, গানের ইন্টারপ্রিটেশনেও পড়ছে। কারণ মৌখিকতার ধারায় গুরুর বাণী, গুরুর ভাব খুব জরুরি একটা বিষয়। Youtube-এ বারী সিদ্দিকীর সুয়াচান পাখির মিউজিক ভিডিওটি যিনি দেখেছেন, তিনি আমার কথার মানে সহজেই বুঝতে পারবেন। বারী সিদ্দিকী যেখানে এক বাংলা সিনেমার নায়কসম। তাঁর সুয়াচান পাখিটি আক্ষরিক অর্থেই চিরঘুমে শায়িত। এই গানের গল্পে নায়ক ছুটে আসছে আর নায়িকার নাকে-তুলো-গোঁজা লাশ পড়ে আছে বাড়ির দাওয়ায় … ব্যাকগ্রাউন্ডে বারী সিদ্দিকীর কান্নাভেজা গান ইত্যাদি ইত্যাদি। লিংকন কিন্তু ঠিক ওইভাবেই ভাসিয়ে ভাসিয়ে গানটা গায়, যেমন নোলকও গেয়েছিল। সে গুণী এবং নিষ্ঠাবান, তাই তার গাওয়ায় কোনো খাদ থাকে না। গুরুর কাছে যা শিখেছে, তা-ই সে যত্ন করে গায়। আসলে গুরু এখানে কোনো বিশেষ শিল্পী নন, গুরু এখানে মিডিয়া। গুরু Youtube। আর আসর বসেছে মুঠোর ফোনে বা ঘরের টিভিতে অথবা কোলের কম্পিউটারে। সেই আসরের শিষ্য/শ্রোতা একাধারে বর্তমান এবং অলীক; real and virtual.
গোটা লেখাটা আন্তরিক, অনুভবস্পর্শী, চিন্তা-উর্দ্রেকী। সিলেটে মৌসুমী ভৌমিকের হামেশা যাতায়াত, প্রধানত গানেরই টানে, প্রাণেরও হয়তো-বা; ভ্রাম্যমাণ বাংলা গানের একটা সাইট, আর্কাইভ্যাল ওয়েবক্ষেত্র, সঞ্চালন করেন মৌসুমী, ‘দি ট্র্যাভেলিং আর্কাইভ’ নামে, আমরা জানি। সেইটার জন্যও গান রেকর্ড করেন একদম ফিল্ডলেভেলে যেয়ে, ক্ষেত্রসমীক্ষার কাজটাও করেন, এবং ধারণ করেন আনকোরা গ্রামীণ গলায় কৃত্রিমতাবর্জিত কণ্ঠের গান ও কথা। হাওরভাসা গানমর্মদ্রাবী দিরাই-শাল্লা ইত্যাদি এলাকায় ২০১২ সালের রোজার দিনে লিংকনদের বাড়িতে বসেছিল গানের আসর। পদ্মপুরাণের মাস, মনসা পূজার দিন, আবার রমজানেরও। সুনামগঞ্জ-তাহিরপুর-দিরাই-শাল্লার দিকটায় মনসাদেবীর পুজোআচ্চাটা ভালো রকমেই হয়। পানির দেশ, পদ্মপুরাণের, মনসারই রাজপাট। ইফতারির ছোলা-পেঁয়াজু খেতে খেতে হচ্ছিল গান। এইসবের সুন্দর বর্ণনা পাওয়া যায় লেখাটার পরতে পরতে। লেখাটা গাজোয়ারি ছাড়া, এত সহুজে ন্যারেটিভের, মৌসুমীসৃজিত গানেরই ন্যায়। এইখানকার এই উদ্ধৃতিটি গোটা রচনার কিয়দংশ মাত্র। এই আসরে উপস্থিত সকলেরই অবয়ব অল্পকথায় ডেপিক্ট করেছেন মৌসুমী, সপ্রেম-সস্নেহ। ওই আসরে সঙ্গী ছিলেন সুকান্ত মজুমদার, দ্য ট্র্যাভেলিং আর্কাইভের শব্দধারক, যিনি নিজে একটা দারুণ রচনা লিখেছেন ‘শ্রবণ’ নামে এই সংখ্যা কাগজেরই পাতে। এই রচনাটা নিয়া আলাদাভাবে কোথাও বলা যাবে এক-সময়। এই নিবন্ধেই সে-চেষ্টা চালানো যাবে। এছাড়া লিংকন তো সিলেট শহরে ‘বইপত্র’ নামে একটা দোকানে চাকরি করে, গান গায়, ঊনিশ-কুড়ি বয়স, শাল্লায় তাদের বাড়ি, ওদেরই ভিটেতে বসেছিল গানের আসর সেবার, এইগুলো মৌসুমী দিয়েছেন মিশায়ে লেখায়। এছাড়া আরও অনেকেই ছিলেন গ্রামের, গান গেয়েছেন অনেকেই, এবং সর্বোপরি ছিলেন সুমনকুমার দাশ — দইয়লসম্পাদক, লেখক ও লোকসংগীতগবেষক।
পত্রিকার শুরুর দিকটায় প্রিন্টার্স লাইনের পরে একটা উৎসর্গপঙক্তি — পৃষ্ঠা জুড়ে একটা লাইন — ‘পণ্ডিত রামকানাই দাশ / আমাদের সংগীতপ্রতিভা’। মাত্র-পরলোকগত শিল্পী রামকানাই দাশ (১৯৩৫-২০১৪) বাংলাদেশের এই অঞ্চলেই জন্মেছিলেন, জীবনভর গানই গেয়ে গেলেন, পত্রিকায় এইটুকু অনাড়ম্বর শ্রদ্ধার্ঘ দেখে ভালো লাগল। সাড়ে-সাতফর্মা কাগজটির রিটেইল্ প্রাইস্ রাখা হয়েছে কুল্লে পঞ্চাশ টাকা। আশি গ্রাম্ অফসেট, মনে হলো কাগজের থিক্নেস্ বুড়ো-ও-তর্জনী আঙুলের টিপে চেপে পরখ করে; একশ গ্রামও হতে পারে অবশ্য। ঝকঝকে সুমুদ্রিত, নয়নমোহন ফর্ম্যাটিং, বাহুল্যবর্জিত ও বিজ্ঞাপনবিহীন। সবটুকুই পাঠকের, তথা ক্রেতার, প্লেটে যাবে লাভের গুড়; সন্দেহ নাই তাতে। অবশ্য বইবেচুয়াদের লাভ নিয়া প্রকাশ্যে কথা উঠাইতে নাই, বইবেচুয়া দোকানিরা বাংলাদেশে সাহিত্যসেবায়েত বলিয়া মশহুর। সম্পাদকের লাভ? একটা গানের কাগজ করার ড্রিম্ ছিল, পূরণ করা গেল, এইটুকু চরিতার্থতার বোধ আপনমনে, অনুমান করি। দইয়ল আমাদের মেগাসিটির বিরলপ্রায় মরা গাছের ডালে, পাতার আড়ালে, বসুক বারেবারে — এটুকু মনে মনে নিশ্চয় চাইব আমরা।
পুনশ্চ দইয়ল
পাঠক, আপনাকে যদি প্রশ্ন করি আপনার ঘরটি কেমন দেখতে, কোথায় কি রয়েছে সে-ঘরের, আপনি প্রায় নির্ভুল উত্তর দিতে খুব বেশি সময় নেবেন না। কিন্তু আপনাকে যদি প্রশ্ন করা হয়, আচ্ছা কেমন শুনতে আপনার ঘরখানি? আপনি থমকাবেন হয়তো। ভাববেন এ আবার কি প্রশ্ন? ঘর কি বাজনা নাকি যে শুনব!
সুকান্ত মজুমদার শ্রবণ রচনায় এই কথাগুলো বলছেন এবং পরে বেশ সপ্রমাণ দেখাচ্ছেন যে, হ্যাঁ, গেহও সংগীত বৈকি! দৃশ্য যতটা, আপনার সাধের ঘরখানি, ঠিক ততটাই সংগীত অথবা তারচে বেশিও বলতে প্রলুব্ধ হবেন কেউ স্বগৃহটিরে। অ্যানিওয়ে। কে এই মজুমদার মশাই, যিনি মিউজিক্যাল এই বিচিন্তা চাইছেন প্রচারিতে? একজন প্রোফেশন্যাল সাউন্ডরেকর্ডিস্ট, কলকাতাবাসী, দ্য ট্র্যাভেলিং আর্কাইভ-এ একনিষ্ঠ শব্দসংরক্ষণের কাজ করে চলেছেন অনেকদিন হলো। তো, আচ্ছা, তারপর?
অতঃপরকর্তব্য ও কথাবার্তা আরেকটু পরে যেয়ে, এখন বরং রিওয়াইন্ডে একটু প্রসিড করি। শীর্ষস্থ সূচনা-উদ্ধৃতি যেখানটায়, ঠিক আগের তিনটা লাইন :
আমাদের চারপাশের জগৎ মূলত দৃশ্যময়। আমরা দৃশ্যের সঙ্গে যেভাবে যোগাযোগ তৈরি করতে অভ্যস্ত শব্দের সঙ্গে ততখানি করি না। মানে নিজে থেকে উদ্যোগী হয়ে মনোযোগের সঙ্গে করি না।
তারপর ফের মিস্টার মজুমদার আপনাকে বেমক্কা আতান্তরে ফেলতে চেয়েছেন এহেন মোক্ষম একটা আঁচড়ানি দিয়া :
আমি বলতে পারি, আপনার ঘর তো চিত্রকরের ছবিও নয়, চলচ্চিত্রও নয়, তবু তো দেখেন! একটা ছবি তৈরি করেন আপনার প্রিয় ঘরটিকে ঘিরে। ভাবেন কোথায় কি রাখলে সুন্দর দেখাবে আরো। # # কিন্তু যে-শব্দজগৎ ঘিরে রয়েছে আপনার ঘরকে, আপনার ও পরিবারের সকলের কণ্ঠস্বর, ভেসে আসা নানা শব্দ, প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে গৃহস্থের অন্দরমহলের নানা আওয়াজ, তা তো আপনার পরিবারেই নির্মিত। সেই শব্দজগৎ হয়তো, বা হয়তো কেন, নিশ্চিতভাবেই খুব ভেবেচিন্তে নির্মিত নয়। যতখানি মনোযোগ আপনি ব্যয় করেছেন ঘরটিকে সাজাতে, তার ছিঁটেফোঁটাও ভাবেননি তার আবহ সম্পর্কে। ঘরের সিলিংফ্যানটি হঠাৎ ঘটর ঘটর শব্দ করতে শুরু করলে বড়জোর মিস্ত্রি ডেকে তাকে নীরব করেছেন। কিন্তু এই সিদ্ধান্তই-বা আপনি নিলেন কেন, যদি শব্দ সম্পর্কে আপনি এত উদাসীনই হন? নিলেন, কারণ দৃশ্যসজ্জা সম্পর্কে আপনার পছন্দ-অপছন্দ যেমন তীব্র শব্দ সম্পর্কেও আসলে তাই-ই। আপাতদৃষ্টিতে তা কেবল চোখে পড়ে না।
তা, আমরা জেনেছি যে, এই রচনার লেখক একজন প্রোফেশন্যাল্ সাউন্ডরেকর্ডিস্ট। অতএব রচনাটা লাইভ একটা অভিজ্ঞতাই হবে, লেখকের দিক থেকে ডেলিভারি যেমন লাইভ হবে তেমনি রিসিপিয়েন্ট পাঠকের দিক থেকেও এক্সপেরিয়েন্সটা লাইভ প্রাপ্তি নিশ্চয়, এইটুকু অতিপ্রত্যাশা নয়। এবং হয়েছেও তা-ই। ইন্ট্রো অনুচ্ছেদ থেকে একাংশ টোকাই :
কলকাতায় আমাদের বাউল-ফকির উৎসবে প্রত্যেক বছর সমগ্র অনুষ্ঠানটির রেকর্ডিং হয়। ভিডিও নয় অডিও। মেলার মঞ্চে গাওয়া সব গানই যন্ত্রবদ্ধ হয়ে, ঘটনাচক্রে আমার কাছেই থাকে। তারপর বছর শেষে নতুন মেলার আয়োজনের আগে এইসব গান থেকে ঝাড়াই-বাছাই করে কিছু গান মেলায় প্রকাশিত অ্যালবামে রাখা হয়। এই কাজ করতে গিয়ে অনেক অনেক গান শোনা হয়ে যায়। একই গান বারেবারেও শোনা হয়। আর পেশাগতভাবে শব্দমিশ্রণের কাজ করে থাকি বলে এ-কাজ আমার উপরেই বর্তায় বছরের পর বছর।
শ্রবণ যখন হয় নিবন্ধ/প্রবন্ধের নাম, রচয়িতা যখন জনৈক শব্দপ্রকৌশলী, স্বভাবতই মনে হয় ফিজিক্সের কচকচানি হবার কথা। আশ্চর্য! রচনাটা মোটেই তা না। আদ্যোপান্ত স্বচ্ছ গদ্যবাংলায় ফিনফিনে গুড্ডির ন্যায় সিন্ট্যাক্সে এভ্রিডে-এক্সাম্পল্ দিয়ে শকটচালকেরও বোঝার মতো করে লেখা গোটা আর্টিক্যলটা। সাউন্ডগ্রাহক যেহেতু, প্রচুর শোনাশুনির ভিতর দিয়াই তো যাইতে হয়, অবধারিত অতএব গান শোনা। আর সে-বছর ওই ফ্যাস্টিভ্যাল্ চলাকালীন শব্দগ্রহণের কাজটা সাধন করতে যেয়ে লেখক জনৈক রাধেশ্যাম দাস বাউলের গাওয়া একটা গান শোনেন, যে-গানটার পদকর্তা রাজকৃষ্ণ নামের কেউ — লেখকেরই যোগানো তথ্যে এসব জানা যাচ্ছে — ওই গানের গুটিকয় চরণের ছুঁতো ধরে এ-লেখার অবতারণা ঘটায়েছেন লেখক, গানটার চতুষ্পঙক্তি নিম্নোদ্ধৃত :
পরের কথা শুনে হরি বলে নাচিছো,
হরি কোথায় আছে তারে কি দেখেছো?
কেবল কানেতে শুনেছো, শোনা কি পশেছো?
(খ্যাপা) শোনা কথা মুখে এনো না এনো না।
গানধৃত কূটাভাস লক্ষ করেও সুকান্ত মজুমদার সুরমঞ্জুষা বা বাণীবিমুগ্ধতা না-জানিয়ে যেতে চাইছেন অভিপ্রেত এ-দিকটায় :
… এবং আরো বিস্তৃত যুক্তিজালে না-জড়িয়েও বলা যায়, শ্রবণ সম্পর্কে আমাদের একটা সাধারণ মানসিকতার পরিচয় এই পদে আছে। সেটা হলো, দেখাটাই primary. সেই প্রক্রিয়ার প্রামাণ্যতার সঙ্গে শ্রবণের তুলনা চলে না। শ্রবণ প্রামাণ্য না-ও হতে পারে। আমি আলোচনাটা এখানেই আনতে চাইছি। … শ্রবণ সম্পর্কে এই আপাত নিস্পৃহ মনোভাবের কারণ কি?
এমন করে এগোতে থাকে লেখাটা। পাঠককে হাজির-নাজির রেখে লেখক দৈনন্দিন টানেন, সমাজ টানেন, বিজ্ঞান টানেন। শ্রবণ ব্যাপারটা মানুষের আদিতম অনুভূতির অন্যতম, খোলামেলা উদাহরণ দিয়ে এই-সমস্ত সহজ কথাও খোলাসা করে নেন রচয়িতা আরেকটাবার সংক্ষেপে। এরপর হিয়ারিং ও লিসেনিং উভয়ের মধ্যকার বৈ-ও/অথবা-সম সাদৃশ্য, উভয়ের অন্তর্বর্তী ফারাক, শব্দের অন্তর্গত বার্তা প্রভৃতি বিষয়ে টর্চ ফেলেন।
… আমরা যে-পরিবেশে বাস করছি তার শাব্দিক উপস্থিতি অস্বীকার করতে শুরু করেছি। তৈরি করছি এক নিজস্ব শব্দজগৎ, যেখানে প্রিয় গান, প্রিয় মানুষের কণ্ঠ, প্রিয় বাদ্য ছাড়া আর কিছুই নেই। এই সঙ্কুচিত, সঙ্কীর্ণ শব্দজগৎ, যে-বিচ্ছিন্নতা তৈরি করছে মানুষের ও তার প্রাত্যহিক অভ্যেসের পরিবেশের মধ্যে, তার ফল খুব সুবিধের না-ও হতে পারে। … ফিল্ডরেকর্ডিঙের অভিজ্ঞতায় বারেবারেই দেখেছি, সর্বগ্রাসী টিভি, মোবাইল ফোনের অত্যধিক ব্যবহার কতখানি প্রভাব বিস্তার করছে একটি গোষ্ঠীর নিজস্ব শব্দজগতের উপর। … মানুষের আর-পাঁচটা বৈশিষ্ট্যের মতো ধ্বনিবৈশিষ্ট্যেও একমাত্রিকতার প্রবণতা সুস্পষ্টভাবে লক্ষণীয়।
অতএব করণীয়? সুকান্ত মজুমদারের প্রস্তাব, কন্সিডারিং দি অ্যাবোভ সার্কাম্সট্যান্সেস্, “শোনা কথাকে বা যে-কোনো শোনাকেই শোনা/listening-এর মর্যাদা দেবার সময় উপস্থিত।” নয়তো ঘোরতর সঙ্কট। পড়ছিলাম আর স-আফসোস ভাবছিলাম, আমাদের দেশে হবে সেই সাউন্ডরেকর্ডিস্ট কবে …
কিন্তু কোথায় মিলবে এই রচনা? সুকান্ত মজুমদারের শ্রবণাভিজ্ঞতার এহেন অভিজ্ঞান কোথায় অ্যাভেইলেবল্? তথ্যের জন্য পূর্ণায়ত নয়নে এটুকু দ্রষ্টব্য :
দইয়ল, গানের কাগজ, প্রথম সংখ্যা, কার্তিক ১৪২১, সম্পাদক সুমনকুমার দাশ, যোগাযোগ ৪৩-৪৪ রাজা ম্যানশন জিন্দাবাজার সিলেট। সেলফোন ০১৭১২ ৮৫৬ ৩৫৩।
দইয়ল পুনরাগম
বিলকুল অবাণিজ্যিক অভিপ্রায় থেকে এ-কাগজের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে, এইটা কাগজের চেহারাসুরত দেখলেই মেহসুস হয় বটে। পেপার্ব্যাক্-বাউন্ড পত্রিকার পয়লা থেকে শেষাব্দি লিটলম্যাগের মেকাপ্-গেটাপ্, কম্যার্শিয়্যাল্ কোনো স্পন্সর্শিপ্ গোচরীভূত হয় নাই কোত্থাও, ফোঁটাছিঁটা বিজ্ঞাপনও অনুপস্থিত। সবচেয়ে বড় প্রমাণ বোধহয়, এ-পত্রিকার ননকম্যার্শিয়্যাল্ স্ট্যান্ডপয়েন্টের পক্ষে এভিডেন্স, এর লেখক ইন্ডেক্স, অবদায়কবৃন্দের সূচি। তিন-চারজন ছাড়া কেউই রোজগেরে লেখক নন, অর্থাৎ রচনা বেচিয়া বেড়ান না তারা। আর যেহেতু ছোটকাগজ টেম্প্যারামেন্টের প্রকাশনা, তদুপরি গানের বিষয়াশয় নিয়া কারবার এর, কাজেই এহেন প্রকাশনা কন্টিনিউ করবে না ধরেই নেয়া যায়। কিন্তু না, সম্পাদক তা মানতে নারাজ; সম্পাদকভাষ্যের সূচনাপ্যারাতেই দইয়লসম্পাদক সুমনকুমার দাশ স-প্রত্যয় জানাচ্ছেন : “শুধু গান নিয়ে একটি কাগজ প্রকাশের পরিকল্পনা ছিল দীর্ঘদিনের। অবশেষে সেই পরিকল্পনা বাস্তবে রূপ পেল, বেরোলো দইয়ল । … পাখি যেমন গান গায় মনের আনন্দে, তেমনি এ কাগজও আপন স্বভাবগুণে গান নিয়ে নানান লেখকের ভাবনা-চিন্তার প্রকাশ ঘটাবে অব্যাহতভাবে, শুরুতেই এই প্রতিশ্রুতি জানিয়ে রাখলাম।” তা, আশ্বস্ত হওয়া যায়? কিন্তু সংখ্যায় কি-বা আসে-যায়? একটামাত্র সংখ্যা দিয়েও ঘটনা যা ঘটাবার তা ঘটানো সম্ভব। পত্রিকার কাজ তো অন্তহীন সচল থাকাই নয় একমাত্র; প্রবহমান রইতে পারলে মন্দ হয় না যদিও; পত্রিকা ঝাঁকুনি দেবে স্থিতাবস্থায়, প্রথানুবর্তী নন্দনবীক্ষায় একটা বাইপাসের রাস্তা দেখায়ে দেবে, চেইঞ্জ করবে চাল্লু মাইন্ডসেট।
দুটো রচনার প্রতি বর্তমান নিবন্ধকের পক্ষপাতিতা আগের দুটো পর্বে পরপর প্রকাশ করা হয়েছে। এক মৌসুমী ভৌমিক, দুই সুকান্ত মজুমদার। একুশটা লেখা আছে সব মিলিয়ে। ফেলনা নয় একটাও। সব-কয়টাই মিউজিক রিলেটেড। মেমোয়্যার ধাঁচেরই লেখাগুলো। তত্ত্বকপ্চাকপ্চি নাই। কিংবা কাঠমণ্ড তথ্যছড়াছড়িও অল্পদৃষ্টই। স্মৃতিনির্গলিত রচনা হবার কারণে সুবিধে যেইটা হয়েছে তা এ-ই যে লেখাগুলো সুরপ্রাণস্ফূর্ত হতে পেরেছে। এহেন মধুমন্থিত রচনার পাঠাস্বাদন যে-কোনো পড়ুয়ার কাছেই মনোরম অভিজ্ঞতা নিঃসন্দেহে। ব্যক্তিস্মৃতিভিত্তিক লেখা আছে একাধিক। একটা লেখার নাম ‘মোহরদি’, একটা যেমন ‘রামকানাইদা’, আরেকটা লেখাশিরোনাম ‘লোকগানের রণেন রায়চৌধুরী’। নামেই পরিচয় মেলে লেখাগুলোর বক্তব্যকেন্দ্রভাগে ব্যক্তিত্ব কে বা কারা। বিষয় উপজীব্য করে লেখাপত্র তো থাকবেই, রয়েছেও; খটমট নয় একটাও। একটা লেখার নাম ‘গানের রবীন্দ্রনাথ’, আরেকটা লেখাশীর্ষ ‘প্রসঙ্গ আগমনী গান’। মোটামুটি বৈচিত্র্যঋদ্ধই, বলা যায়, ডেব্যু সংখ্যাটা।
একটা আশঙ্কা যায় না অবশ্য। আশঙ্কাটা এইখানেই যে, এক-দুই সংখ্যা বাদেই পত্রিকা-না আবার গানের আনন্দধাম ছেড়ে গানপাণ্ডিত্য শুরু করে দেয়! একঘেয়ে শাস্ত্রীয় সংগীতের গানহীন গালগপ্পো, উস্তাদজির পশমিনা শাল-আলোয়ান আর কয়েকটা রাগনাম মুখস্থ হড়বড়ানোর বিমুগ্ধ স্তবস্তুতিবাক্য, অথবা বাউলফকিরি হিলবাবা। বালাই ষাট! “দইয়ল বাংলাগানের বিচিত্র সব ধারা নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী। বাংলাগানের বর্তমান পরিবেশ ও বিবর্তন, গীতিকার থেকে শিল্পী — সব বিষয়ে আগ্রহী সবার ভাবনা-চিন্তা, মতামত, মূল্যায়ন আমরা ছাপতে চাই।” — জানাচ্ছেন দইয়লসম্পাদক, ভূমিকালাপে। কেবল মাটির গান আর ভাটির গান দিয়া আনন্দফুর্তির ছুটি দিতে চায় না দইয়ল, বোঝা গেল। ভরসা বাড়লো আরও, অতি সম্প্রতি, একটা হাওয়াবাহিত পত্রিকা ‘লাল জীপের ডায়েরী’-তে সম্পাদক পত্রিকাপ্ল্যান্ জানাতে যেয়ে কবুল করছেন : “কেবল যে বাংলাগানের বহুতর দিক নিয়েই দইয়ল কাজ করবে, সেটা কিন্তু নয়। আমরা বাংলাগানের সঙ্গে ভিনদেশের গানের পরম্পরা এবং তুলনামূলক বিশ্লেষণধর্মী লেখাও ছাপতে আগ্রহী। এক কথায় গানপ্রিয় পাঠকগোষ্ঠী গড়ে তোলাই আমাদের মূল উদ্দেশ্য।” লিংক শুভ অভিপ্রায়। কাজেই, রুনা লায়লার গলায় সেই গানের ন্যায়, সমুখে সুন্দর আগামীকাল …
স্বাগত দইয়ল ও অন্যান্য পৈখপাখাল
তবু পৈখপাখালের দেশ হিশেবে একটা মর্যাদা আছে এই নিঝুম পলিদ্বীপের, যদিও এক্সটিঙ্কটিং বিচিত্র স্বরবল্লরীর পৈখেরা, গলায় এখনও তারা গান ধরে বেতালা ক্লাইমেটের হেন ধ্বংসোন্মত্ত দিনে। কেবল শোনার কান থাকা চাই। আর চাই পৈখপাখালির অভয়ারণ্য তথা স্যাংচ্যুয়্যরি নির্মাণের উদযোগী ড্রিমার। জন লেননের সেই গানের রেফ্রেন্স মনে পড়ে যাবে, “য়্যু ম্যে স্যে আয়া’ম্ অ্যা ড্রিমার / বাট আয়া’ম্ নট দ্য ওনলি ওয়ান্” …
দইয়ল কি পারবে একলা ধারণ করতে এই তেরোশ’ নদীর দেশের সুর-স্বরলিপিগুলো? দইয়ল কি পারবে এঁকে তুলতে এই বারোবাজার-তিপ্পান্নগলির গানচিত্রাবলি? দইয়ল কি পারবে এই তিনশ’ চৌষট্টি কলার রাগরাগিণীনিচয় রেকাবিতে সাজিয়ে মেজবানি দিতে? এই দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম-উত্তর-পূর্ব, গোটা বিশ্বের গগন ও গাঙ-সমুদ্দুর, সহস্র নগর-গঞ্জ-পথঘাটে ভেসে ভেসে বেড়ানো সুরস্বরকথিকাগুলো দলিলায়নে দইয়ল সমর্থ হবে কি? নিশ্চয় সঙ্গত্ দেবে দইয়লের সনে লেজঝোলা ফিঙে, টিয়া, গাঙবগ্লা, শালিক, চড়াই, তিলাঘুঘু, ঢুপি, দুর্গাটুনটুনি এবং আরও আরও শত শত জলঝর্ণা-গাছপাতালির পৈখপাখাল।
…
বি.দ্র. / নিবন্ধকারের সনির্বন্ধ স্বীকারোক্তি এ-ই যে, এই নিবন্ধ মোটেও পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন নয়; এইটা আবছাভাবে, একদৌড়ে, একটা ঘাটতি/অভাবের দিকেই দৃষ্টি নির্দেশ করতে চেয়েছে। এবং উল্লেখ বাহুল্য, সংগীত বিষয়ে আরও অনেক ছোট-বড় কাগজ রয়েছে উনিশ থেকে বিশ শতক ব্যাপিয়া; ঠাকুরের আমলে একটা সাড়ম্বর সাংগীতিক জাগৃতি নিশ্চয় আজকের শিশুকিশোরেরও অজানা নয়; এবং তখন নানান মর্তবা ও মেয়াদী ব্যক্তি-উদ্যোগী গীতের কাগজ বেরিয়েছে আমরা জানি। কিন্তু এসবের বিস্তারিত তথ্যতালিকার বিবরণ অন্যত্র সুলভ; যেমন, ‘বাংলা সাময়িকপত্রের ইতিহাস’ বিষয়ক একাধিক কাজকর্ম হয়েছে এই ‘বৃহৎ’ বঙ্গে এবং ওই ‘ক্ষীয়মাণ’ অঙ্গবঙ্গে; সেসব বই তিরিশ-চল্লিশ পাতা উল্টে গেলে আরও অনেক কাগজের নামঠিকানা পাওয়া যাবে এবং চাক্ষুষমাত্র বোঝা যাবে যে সেসবখানে বিষয়সূচিতে সংগীতের অন্তর্ভুক্তি ছিল যথেষ্ট জোরের সঙ্গেই। কিন্তু সময়াভাবে, এবং নিছকই নিবন্ধকারের কমজোরির কারণে, এহেন তথ্য-তত্ত্ব-বস্তুনিষ্ঠারিক্ত অসার রচনা ফাঁদা। তা, ‘হাজার বছরের বাংলায়’ হাজারটা গানপত্রিকাও যদি রিসার্চার মহোদয় বেচারি-নিবন্ধকারটিকে একহাত দেখে নেয়ার সঙ্কল্পবদ্ধ ভঙ্গিতে দেখায়ে দিতে আসেন আস্তিন গুটিয়ে, এই নিবন্ধের মূল ফোকাস্ তথা বাংলায় গানপত্রিকা নাই কিংবা বাংলায় গানপত্রিকা চাই শীর্ষক বক্তব্য অপ্রমাণ হয়ে যায় না নিশ্চয়। নিবন্ধের কলেবর এমনিতেই গিয়েছে বেড়ে। এখানে যে-গুটিকয় কাগজের নামোল্লেখ হয়েছে, এগুলোর বাইরে নিশ্চয় আরও পত্রিকা রয়ে গিয়েছে, এমনকি নিবন্ধকারের ব্যক্তিগত কুলুঙ্গিতে বেশকিছু পত্রিকা আছে যেগুলো উপস্থিত-মুহূর্তে খুঁজে না-পেয়ে নামোচ্চার কিংবা কাভারফোটোগ্রাফ দেখানো সম্ভব হয়নি। কিন্তু ওতে এই নিবন্ধের তেমনটা হানি হয়েছে বলে মনে হয় না। কারণ এর অভিপ্রায় একটু মোটা দাগে একটা ব্যাপার আলাপের টেবিলে ওঠানো। সমস্তই সম্ভব হয়েছে ‘দইয়ল’ পত্রিকাটার আবির্ভাবসূত্রে এক ঝটিতি স্মৃতিঝড়বশত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, নিবন্ধের সঙ্গে সাঁটানো পত্রিকাগুলোর চারটি স্থিরচিত্র ধরে দিয়ে ঋণী করে রেখেছেন গিটারবাদক ও গ্র্যাফিক্ আর্টিস্ট উসমান গনি।