বিবর্ণা জার্নাল । জাহেদ আহমদ
প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ মে ২০১৭, ১০:১২ অপরাহ্ণ, | ২৩১৬ বার পঠিত
যা-ইচ্ছে-তাই, মিনিংফ্যুল্ বা মিনিং-না-থাকা, যাচ্ছেতাই লেখার জন্যই তো জন্ম হয়েছে ডায়রি/দিনপত্রী/নিশিদিনলিপি/খেয়ালখাতা-র! সাজানো-গোছানো এই তিনকোণা-চারকোণা জ্যামিতিপনার জগতে মানুষের এখনও যদি কোনো নির্ভরযোগ্য জায়গা থাকিয়া থাকে যথেচ্ছাচারের, সত্যিকারের স্বাধীনতাভোগের, তবে সেই জায়গাটি এ-ই — ডায়রির ভূভাগ, ডায়রিপৃষ্ঠের শাদা/রুলটানা ত্বক। কোনো ধরনের কোনো ফর্ম-নর্ম ইত্যাদির কোনো কড়াকড়িতা নাই, শিল্প প্রণয়নের কোনো ঐশী প্রেশার-প্ররোচনা নাই, সকাল-সন্ধ্যা পাড়াসুদ্ধু সবাই সোৎসাহে শিব গড়বার সত্যিমিথ্যা নাই, কিংবা নাই বিপ্লবের বাঁদরঝম্প, মহাকালের মোয়া পাতে পাবো কি পাবো না তেন টেনশন নাই, অপরূপ আনন্দগ্রন্থনার কোনো গুরুভার নাই বিধায় ডায়রি লিখতে বসে রবীন্দ্রকথিত ওই বক্ষে কোনো-কিসিমের বেদনাবোধটোধ নাই … বলা যায় বেশ নির্বোধ-নির্ভার-নিশ্চাপ নির্ঝরের মতো লিখে চলা যায় পাতার পর পাতা এই খেয়ালখুশির খাতা, এই খেলোকথার পাতা, এই যেমন-ইচ্ছে যখন-তখন যা-তা … এই খেয়ালখাতা! যেমন মনে হয় বা যেভাবে মনে আসে ঠিক সেভাবেই লিখে ফ্যালো, ব্যাস্! এটুকুই আসলে, একটা ডায়রির সংজ্ঞা/পরিচয় হিসেবে আদর্শ, শুদ্ধ সেন্সে। অবশ্য বাঙালি-বয়ানবর্ণনে অতিবিখ্যাত জীবনানন্দীয় ওই উক্তিটির আদলে কেউ বলতেই পারেন, ডায়রি কি — এ-প্রশ্নের উত্তর দেয়ার আগে বলা বাঞ্ছনীয় যে ডায়রি অনেক রকম! জার্নাল্ আর ডায়রির মধ্যকার সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্যগুলো বুঝায়ে বলো তো ভদ্রে! এহ্ বাহ্য! ধরণী বাই-দিস্-টাইম দ্বিধা হতে লেগেছে — তেমন যদি বলতে উদ্যত এ-মুহূর্তে কেউ, তাহলে তারই সম্মানার্থে এখন এখানেই এতদ্বিষয়ক বচনের অমৃত প্রকাশ স্থগিত রেখে প্রসঙ্গান্তরে যাচ্ছি। আপাতত এই বাক্যের অন্তেই হোক অনুচ্ছেদান্তর।
বৈশাখোৎসব ১৪২৩
আগাচ্ছে না পিছাচ্ছে ঠিক ঠাহর করা যাচ্ছে না। একদিকে এই স্থিতাবস্থানির্জীবিত চলন-বলন, মন্দ-ভালো উভয়ত ওই একই রসুনের পশ্চাদ্ভাগ, কর্পোরেটোক্রেসি-এনজিওতন্ত্র-ব্যবসাব্যাকুলজনপ্রতিনিধি-অস্বচ্ছপ্রশাসন, রাস্তায়-রাজধানীতে হাঁটতে গেলে দেখতে পাবে হেজাব্ পরিধানের পরিমাণ তুলনামূলে বেড়েছে অনেক; অন্যদিকে বৈশাখোৎসবের এই দিন — বাংলা-বছরের প্রথম — কি বলবেন আপনি, আগাচ্ছি না পিছাচ্ছি? ঠিক বলা যাবে না যে এইবার স্বতঃস্ফূর্ত উৎসব হয়েছে। একদমই ভিড় বা যাকে বলে লোকারণ্য ছিল না শহরে। এখানে এই নিবন্ধে একটি ডিভিশন্যাল্ টাউনের নিউজ্ ব্রডকাস্ট হচ্ছে, ক্যাপিট্যালের নিউজ্ পাবেন অন্যান্য বহু জায়গায়, বলা বাহুল্য খবরের দৃশ্যমালা ব্যক্তিগত চক্করের ভিত্তিতে গৃহীত হয়েছে। এর পেছনে, এই ভিড়মুখরিত উৎসব না-হওয়ার নেপথ্যে, কে কলকাঠি নেড়েছে বা কি কি নীতিসূত্র ক্রিয়া করেছে সেসব নিয়া আলাপ না করে কেবল দিনপ্রতিবেদন উপস্থাপন করা যাক। অবশ্য হতেও পারে যে আগের দিনের সন্ধ্যার ভূমিকম্প লোকের স্পন্টেনিটি রদ করেছে, হ্যাঁ, হতে পারে অবশ্য। দুপুরের অব্যবহিত পরে, বেলা আড়াইটা থেকে, রাত এগারো অব্দি সিটি অ্যারিয়ার কয়েকটা জায়গা রাউন্ড দিয়া যা যা বোঝা গেল তা তা নিয়াই বক্ষ্যমাণ প্রতিবেদন-নিবন্ধ। ১৯৯৪ সন থেকে এতাবধি দেখা কার্নিভ্যালপ্রতিম বৈশাখদিনের যে-উদযাপন, এবারে ব্যত্যয় কিছু চোখে পড়ল কি না ইত্যাদি। কিংবা আমরা তো ধুলায়-আন্ধার ব্যাপারস্যাপার দেখছি সকলেই সমভাবে। এখানে নিজের ভিয়্যু জুড়িয়া না-দিয়া আগানো যাক।
বেশ ক-বছর থেকেই অবশ্য সূচনাবৈশাখে এখানে এই মফস্বল শহরে (হোক-না তা বিভাগীয় শহর, কিন্তু গ্রামগন্ধ এখনো খুব-একটা খুঁজতে হয় না) বেশ সরগরম ক্রিয়াকলাদি হয়, বেজে ওঠে ঢাক-ঢোল-ঝাঁঝর। কিন্তু এ স্রেফ একটি বয়স-বলয়ে সীমায়িত ছিল একটা সময় পর্যন্ত, পরিসর ছিল শহরের কয়টি মাত্র বিদ্যায়তনিক আয়োজন-উদ্যোগের চৌহদ্দিতে আবদ্ধ। রমনায় বোমা হামলা এবং বাংলাভাই কিসিমের সেই ভয়াল বছরগুলোতে এর একটা সামাজিক বিস্তার ঘটেছিল সংকোচনের পরিবর্তে এবং বুদ্ধিবিজ্ঞ অনেকেরই ফোর্কাস্ট ভ্রান্ত প্রমাণিত করে। এখনও যে খুব বৈপ্লবিক বিস্তৃতি পেয়ে গেছে দিবস-উদযাপনাটি, তা নয় আদৌ। তবু কোথাও যেন কিছু-একটা ঘটছে এইটা ভালো বোঝা যাচ্ছিল। ঘটছে, এবং তা যে খুব ধীর — যেমন আমরা কথার বার্তা হিসেবে ‘খুব ধীরগতির পরিবর্তন’ ইত্যাদি চালুকথা হামেশা বলে থাকি — তা কিন্তু নয়; ধীর নয়, দ্রুত — ধরতে পারছিলাম না আমরা হয়তো। যদ্রুপ আমাদের জাতীয় কর্ণধারগণ ধরতে পারছেন না জাতির-জনের পাল্স্ আজও, লেখক-সমাজব্যাখ্যাতাবৃন্দ নিরূপণে ব্যর্থ যদ্রুপ ব্যক্তির হৃৎস্পন্দ, গতি-অভিমুখ — তদ্রুপ; তদ্রুপ অধরা থেকে যাচ্ছে আমাদের সংস্কৃতির স্বাভাবিক পথচলা-পরিক্রমা, সংস্কৃতির শক্তি-সিদ্ধির দিকটি। বোঝা যাক না-যাক, বুঝতে পারুন চাই না-পারুন, মহোদয়গণ, দৃশ্য তো বদল হচ্ছেই!
কিন্তু, অবাক কাণ্ড, দৃশ্য হয়তো অচিরে আপনার অনভিপ্রেত দিকেই বদলাতে যাচ্ছে! স্টেইট মেশিনারিগুলো হয়তো বলদ বানাচ্ছে আপনাকে এবং আপনি নিজেই দিশাহারা সাপোর্টার ক্ষমতাকাঠামোর। অবশ্য কোনদিনই –বা তা না ছিলেন আপনি, বলেন? তবু ন্যূনতম প্রতিরোধের যে-একটা হাজির নজির ছিল প্রোক্ত ভয়াল বছরগুলোতে, এখন ঠিক উল্টো। নতজানু বুদ্ধিবলদ হয়ে আপনার, মানে আমারও, আব্দার-ধরা কালচার বজায় রেখে সবকিছু অটুট রাখবার বৈপ্লবিকতা আর কপালে জুটছে না। ট্রাপে আপনি পড়েছেন বুঝতে পারছেন কিন্তু স্বীকার করছেন না। সান্ধ্য আইন বলবৎ হচ্ছে দিকে দিকে আর আপনি বিটকেলে বগল বাজাচ্ছেন উচ্চতর দার্শনিক বিভেদ নিয়া, মানুষের আর্থিক নিরাপত্তা সামাজিক নিরাপত্তা ব্যাহত-বিঘ্নিত হচ্ছে নিত্যি আর আপনি নিজের কম্ফোর্ট জোন্ বহাল তবিয়তে দেখে খুশি রইছেন, গ্যাস্-বিদ্যুৎ ইত্যাদি ছোটলোকের বিলাসিতার মাসকাবারি মূল্যবৃদ্ধিতে কিচ্ছু যায় আসে না আপনার বিকজ্ অফ রিডিউসিং পেট্রোলের দাম; এইবেলা দাদন দিয়া বাইক্ কিনতে পারবেন একখান মোটরচালিত, অথবা বাগিয়ে নেন গাড়িই একখান মর্টগেজ্ দিয়া। আর, বাব্বা, বাকস্ফূর্তিতে গলা প্রায় বিকল হবার পথে! আর সংস্কৃতি, আর বিভাজন, এত সাধের ময়না আমার শেষমেশ বলে কি না বাকস্বাধীনতা আজিকালি হয়ে গ্যাছে ফ্যাশনের নামান্তর! হিপ্ নাচায়ে হোররে! হায় মুক্তি, হায় চিন্তা, হায় মুক্তচিন্তা! ক্ষমতার কাছে আমরা আব্দার জারি রাখিয়া যাই, নিশ্চয় নেক্সট ইয়ার থিংস্ গেটিং ওভার, ঠিক পরের বছর না-হলে তার পরের বা তারও পরে অ্যাট-লিস্ট টোয়েন্টিফোর্টি নাগাদ সব সমস্যার সল্যুশন্ হয়ে যাবে আলেম-ওলামাদের দোয়ায়। আই সাপোর্ট ইট। আমার কম্ফোর্ট জোন্ হ্যাম্পার্ড না-হলেই ঠিকাছে। ঠিকাছে বন্ধু? ‘ঠিকাছে, আমি বলি ঠিক আছে’ … এক্সপ্রেশনটা পাওয়া যায় জেমসের গানে।
এইবার, ১৪২৩ সালের এই বিভাগীয় নগরকেন্দ্রে, দেখা গেল উৎসবের ভিড়বাট্টা নাই। ঠিক আগের বছর বা তার আগে কিংবা বাংলা হইতে মোল্লা তাড়াবার বছরেও ঘটনা অতটা প্যাঁচ খায় নাই। গত বছরের সকাল-দুপুর বিছানায় চিৎ-কাৎ অবকাশযাপনকালে বাড়ির সামনেকার বড়রাস্তা দিয়া ব্যান্ডবাজিয়ে ভ্যান্ যাইতে শোনা গিয়েছিল। পোলাপানদের ভিড়ে পড়ন্ত দুপুরে বেরিয়ে আধাপথে আটকে থেকে বহু কষ্টে বাদ-সন্ধ্যে ডেরায় ফেরত আসতে হয়েছে গন্তব্যে না-যেয়ে। গেল বছর-দশ ধরে এই দিনে রাস্তায় বেরিয়ে দেখা যেত মানুষ অনেক। শুধু চ্যাংড়াপ্যাংড়া নয়, সব বয়সেরই। যার যার মতো ঘুরছে-ফিরছে, দাঁড়িয়ে আছে একলা বা জটলায়। নতুন জামা সকলেরই। বিশেষ বিশেষত্ববহ জামা — মেয়েদের শাদা-লাল শাড়ি-কামিজ, মেরুন কিংবা হলুদও কোথাও কোথাও; ছেলে-পুরুষের গায়ে পাঞ্জাবি-ফতোয়া-টিশার্ট — নানান মোটিফ, নানান নকশা। মুসলমান-অধ্যুষিত দেশ, অধুনা কারো-কারো মনে এবং মাথায় চাড়া দিয়ে উঠছে একে ইসলামি প্রজাতন্ত্র বানাবার খায়েশ — অন্যদিকে যেমন মুসলমান হঠানোরও বৈজ্ঞানিক তন্ত্রমন্ত্র — তবু পয়লা বৈশাখকে থামানো যাচ্ছিল না কোনো কসরতেই, এত বোমাবাজির পরেও! দিনটি যেন তৃতীয় ঈদের মর্যাদা পেয়ে গেছিল, অথবা দ্বিতীয় দুর্গাপূজার। ধীরে-ধীরে? চোখের মাথা না-খেয়ে থাকলে দেখতে পাবে, ধীরে নয়, দ্রুতই। অতি দ্রুত। সংস্কৃতির শক্তি, ঐতিহ্যের রেনেসাঁ বোধহয় বলা যায় একে। এখন? এইবার তো মুখোশে নিষেধ, মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়া ঠাট্টাতামাশা আর পাঁচটার পূর্বে সংস্কৃতি খতম করবার হন্তদন্ত, পরেরবার মুখে নিষেধাজ্ঞা জারি হবে না মর্মে মুচলেকা বুঝিয়া পাইয়াছেন তো? মহোদয়গণ, সংস্কৃতিকর্ম দিনের আলো ফুরাবার আগে বেলাবেলি ফিনিশ্ করে ডেরায় ফিরবেন নয়তো নিজদায়িত্বে মরবেন। কে কারে মারে, বলেন তো?
মূলত চক্কর দিয়েছি চিরদিন শহরের দুইটা জায়গায় ফিরে ফিরে, এমসি কলেজ আর ইউনিভার্সিটি অ্যারিয়ায়। এত জট হতো শহর জুড়ে! যানজট। জনজট। আনন্দমিছিলজট। নারীজট। পুরুষজট। নারীপুরুষজট। বন্ধুজট। প্রেমিক-প্রেমিকাজট। থোকা-থোকা অতর্কিত আনন্দমিছিল। গান গেয়ে, ঢোল-শোহরত পিটায়ে। সে-এক ব্যাপার বটে এই বৈশাখবাদ্য! স্রোতে স্রোত মেশে যেমন, মানুষে মানুষ। মিশেছে। মিলেছে। গেয়েছে গুচ্ছে-গুচ্ছে। এদ্দিন এ-ই ছিল গতিধারা। মানুষ দেখলে মানুষ আসে। মানুষ ভাসে। বাসে, মানুষ দেখলে মানুষ, ভালো। এ আমরা জানি সবাই, খালি ভুলে যাই। আর ভুলে যাই। আর পিছাই। আর ভুলে যাই, আর পিছাই, আর ভুল করি বেমক্কা। সাময়িক। মানুষের পিছানো সাময়িক, এগিয়ে-যাওয়া শাশ্বত-চিরকালিক। মানুষ উৎকর্ষের অভিলাষী। আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত। সত্য বলতে যদি কিছু থাকে, তো, এইটাই। কিন্তু ক্রমে আক্কেলগুড়ুম হয়ে আসছে হে! আক্কেল, ক্রমে, যাইছে প্যারালাইজড হয়ে! হরি দিন তো গেল, পাঁচটা বাজল, বাড়ি ফেরাও মোরে …
কবিরেট্রো ২০০৬
তা বলা যেতে পারে একটা বেশ ঘটনাই ঘটেছে সেদিন। ঘটনাটা ঘটার আগে, ঘটনাটা ঘটছিল যখন এবং ঘটনাটা ঘটে যাবার পরেও খুব মজা/আমোদ পাচ্ছিলাম, আমোদ আপন মনে। এইবেলা আস্ত ঘটনাটুকু খুলে ফেলা যাক প্রকাশ্যলোকে। এক কবির বাড়িতে গেছিলাম সেদিন। সন ২০০৬, পড়তি গ্রীষ্ম, অপরাহ্নে। গেছিলাম কবিনিবাসে। সেই কবির নামের আগে পরিচয়-তকমা লাগানো হয় এই বলে যে, ছেলেবেলা থেকেই শুনে এসেছি, তিনি ‘গণমানুষের কবি’। কোনো তকমা তর্পণ না-করেও আমি নিজের ভেতরে নিজে-নিজে এইটুকু জানি যে, তার কবিতা — তার আজীবনের লেখাপত্র — প্রায় সমস্তই পড়েছি আমি, বেজায় ভালো না-হলেও মন্দ নন তিনি কবি হিশেবে আমার বিবেচনায়। এই সেদিন পর্যন্ত, বুড়ো-বয়সেও, সমান স্পিডে লিখে গেছেন তিনি, তার যে-কোনো-কোথাও-ছাপা-হওয়া কবিতা আমি আগ্রহ নিয়ে পড়েছি, পড়তে আগ্রহ পেয়েছি। এটুকুই এনাফ, যথেষ্ট, একজন কবির জন্য সম্মানের। আজকাল এই সম্মানটুকুও ঘন-ঘন দেখানোর সুযোগ খুব বেশি পাওয়া যায় না অবশ্য। তূর্কিনাচনে নৃত্যমত্ত তরুণদের কবিতা পড়েও মনে হয় প্রায়শ পড়ছি অশীতিপরের অসহায় হা-হুতাশ, মাজাব্যথার কাতরানিমাখা কফ-শ্লেষ্মা। আজকাল এমনই অবস্থা। আসলে এইটা চিরকালেরই পরিস্থিতি।
কিন্তু গেছিলাম যার বাড়িতে সেদিন, তার কবিতানিষ্ঠা অনুসরণীয়, অনুস্মরণীয়। বলা বাহুল্য, অনুসরণীয় কবিতার প্রতি তার নিষ্ঠা, তার কাব্যশৈলী নয়; যার যার লিখনভঙ্গিমা তাকেই খুঁজে নিতে হয়, ওই জিনিশ পড়ে রয়েছে যার যার ব্যক্তিগত বাদামপাহাড়ে, কাজ কেবল কুড়িয়ে নেবার; — হেন অভিজ্ঞান উৎপলকুমার না-বললেও বুঝে নিতে বেশি দিরং হতো না। তার ছন্দচেতনা তর্কাতীত। অবশ্য প্রথানুবর্তী রিদমের বাদ্যিবাজনা। আর সবচেয়ে বাজেবিচ্ছিরি কবিতায় তার খামাখার বক্তব্যচারিতা। আমি মূল্য দেই তার সনেটগুলো, সনেটগুলোর বাঁধুনি-বুনট, চৌকো ও লম্বরৈখিক প্রকরণভঙ্গি। বিরক্তিকর যদিও গণপরিবর্তনের বেহুদা আশাবাদী চিল্লাচিল্লি। বিষয় প্রথাপথের হলেও, প্রকরণ নিয়মানুগ হলেও, এই জেনে-বুঝে নিয়মানুশাসন চর্চাও মূল্য পাবে আজকের আকালের কবিতাবাজারে। যে-সমস্ত কবিসিংহবৃন্দ বেহিসাব ঢোল-শোহরত আর ঢাকের কাঠির সংবর্ধন পান নিতিদিন, খুব চড়া দরদাম যে-দু-চারজনের কবিতাসার্কিটে, যে-এক-দুজন ‘প্রধান’/‘সব্যসাচী’ ইত্যাদি সাইনবোর্ডের তলায় বসে জম্পেশ বিক্রি করছেন মজমা আতর কী মলম, তাদের থেকে কোনো অংশেই কম নন আমাদের এলাকার, আক্ষরিক অর্থে আমার বাড়ির পাশের পাড়ার এই কবি। আমি এ-রকমই মনে করি। অথচ কোনোদিনই মনে হয়নি একবারও, যে যাই, কবির পদধুলা/চরণনিধি/মুখামৃত(!) নিয়া আসি! কোনোদিনই মনে হয়নি এই ত্রিকালোত্তীর্ণ বয়সে একবারও। বরং গুণীজ্ঞানীদিগেরে আমি এড়িয়ে যাই, এড়িয়ে গিয়েছি সবসময়, সচেতন সিদ্ধান্তে। সেদিক থেকে ভাবলে ঘটনাটি ঐতিহাসিক বটে, ঘটে গেছে যা সেদিনের সেই বিকেলে।
গেছিলাম আপিশ থেকেই, আপিশেরই কাজ নিয়ে, অনুষ্ঠাননিমন্ত্রণ দিতে; অতিথি-বক্তা হিশেবে আপিশের একটা অনুষ্ঠানে তার অংশগ্রহণ করার সম্মতি নিতে। যেয়ে দেখলাম, বয়স হয়েছে তার। বিস্তর বয়স্ক হলেও স্বচ্ছ স্মৃতিপ্রাখর্য। ২০০০ সালের ২৬ মার্চ তারিখের একটি বিশেষ দিনের ঘটনা মনে পড়ছিল আমার, ইচ্ছে করছিল জিগাইতে সেই ব্যাপারে কবির বছর-ছয় পরেকার অবস্থানগত পরিবর্তন বা অনুশোচনা আছে কি না; কারণ ওই দিনটার ঘটনাবলির সঙ্গে ব্যক্তিগত জীবনে কুনোব্যাঙস্বভাবী আমারও যোগ রয়েছে খানিকটা। বিশেষ একটা ডেমোন্সট্রেশন্ প্রোগ্র্যামে পার্টিসিপেইট করতে যাবার মাঝপথে একটি বিশেষ গণধিক্কৃত সংগঠনের ষণ্ডাদের দৌড়ানি খেয়েছিলাম আমরা সাতবন্ধু, সত্যি সত্যি সাতজনই, পথিমধ্যে সেই ষণ্ডাদের পথরোধকারী গাজোয়ারি গামাপালোয়ানি স্ট্রিটমিটিঙে ঠিক সেই সময়টায় স্পিচ দিচ্ছিলেন গণমানুষের শ্রদ্ধেয় কবিব্যক্তিত্বটি। জীবনে এহেন কয়েকটা চাক্ষুষ ঘটনায় আমি নিতান্ত অনিচ্ছেয় বেশকিছু সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্যই হয়েছি। কিন্তু ওসব কথা থাক।
বললেন, আন্তরিকভাবেই বললেন, বাইরে বেরোনো এড়িয়ে চলেন আজকাল। শরীরে কুলায় না। আমরাও চাপাচাপি করি নাই আর। কিন্তু ততক্ষণে বকতে-বকতে কবিপ্রবর আমার মাথার অ্যান্টেনা ছিঁড়েফেড়ে একসা করে দিয়েছেন। টানা দু-ঘণ্টা শুনে যেতে হলো তার আত্মসঙ্কীর্তন! বাপ রে বাপ! অবশ্য বছর-দুয়েক পরের এক সুরম্য সময়ে আরেক কবিনিবাসে যেতে হয়েছিল দায়ে পড়ে, এক বন্ধুর চাপাচাপিপীড়িত হয়ে, সেবারকার কবিটি ছিলেন শরীরস্বাস্থ্যে দেখতে-শুনতে মধ্যযৌবনের, কিন্ত বকবক-করা আত্মপ্রচারণায় যে-কোনো প্রৌঢ়কেও হার মানাবার হিম্মতওয়ালা তিনি তথা আমার বন্ধুর কাছে দেবতুল্য ওই বিস্ময়কর হাঁদা ব্যবসাজান্তব বকাসুর কবিযশলোভী মিনিয়েচার ফর্মের মালদার ব্যক্তিটি। ইনি অবশ্য রাজধানীনিবাসী। দ্বিতীয় ঘটনাটি সংঘটনের পর থেকে বালবৃদ্ধ নির্বিশেষে যে-কোনো কবিনিবাসের দুয়ার পরিগ্রহ করি নাই, জিন্দেগি-বন্দেগির প্রয়োজনে ঠেকে না গেলে সেই বিপদগ্রহের ফেরে পুনর্বার পড়তেও চাই না।
তা যাক, বকমবকম ব্যামোর শিকার এবং শিকারী উভয়েরই বয়সের কোনোপ্রকার ধরনবাঁধন নাই প্রমাণিত হয়েছে। একটা বিস্ময় যে, ইন্ রেট্রো অফ ২০০৬, শরীর অশক্ত তবু কথা বলতে পারেন কটকট, স্মৃতিশক্তি টলটলে, বই পড়তে পারেন স্বচ্ছ দেখে! বলছিলাম কবি দিলওয়ারের কথা। আলাপের বিস্তারিত মজাসে তুলে রাখা যেত এখানে, কিন্তু ইচ্ছে করছে না আর।
জন্মদিন
তো, রবিনাথের জন্মদিন। কততম কে জানে। কেউ একজন বলল, সার্ধশততম। বুঝলাম না। আমি গলা অব্দি মূর্খ, যথেষ্ট সংস্কৃত নই, যাকগে। পঁচিশে বৈশাখ। হ্যাপি বার্থ ডে ট্যু য়্যু! হ্যাপি বার্থ ডে ট্যু য়্যু!! হ্যাপি বার্থ ডে ডিয়ার রবি, হ্যাপি বার্থ ডে ট্যু য়্যু!!! তোমার আশি বছরের অনাথ ঠাকুরপোকে এবার কী গিফ্ট্ দিচ্ছ, বৌঠান? জন্মদিনের আদর? ফরাশি না বাংলা কেতায়? মুখের ভেতর মুখ-চুবানো শঙ্খলাগা জিভ? নাকি চকাস্ করে বাঙলাস্টাইলে শিশুতোষ হামি-খাওয়া? লাফিং আউট লাউডলি …
আচ্ছা, রবীন্দ্রনাথ কী লিখতে গেলেই ঘুমে ঢুলতেন? সিলেটি কথ্যরূপে তন্দ্রা-ঢুলুঢুলু অবস্থাকে ‘উঙ্গানি’ বলে। রবিবাবু কি উঙ্গাতেন, লিখতে বসে? শ্রী শ্রী প্রশান্তকুমার, জানা আছে আপনার? রবীন্দ্রনাথ কি ক্লান্ত বোধ করেননি কখনো, লিখতে লিখতে? সেভাবে না-হলেও, একই কাজ করতে-করতে ক্লান্তিবোধ-একঘেয়েবোধ নিশ্চয়ই করেছেন, নইলে বিশ্বভারতী আর শান্তিনিকেতন এসব করতে যাবেন কেন!
বলি তবে বিষয়টা। বাঙালির বেশ পুরনো একটা সুনাম আছে গ্রামসেবা/পল্লীসেবা বিষয়ে বা সমাজসেবক/সমাজসংস্কারক হিসেবে। কিন্তু আজকে যাকে লোকে ডেভেল্যপমেন্ট অ্যাইড/অ্যাজেন্সি বলে, এভাবে সংগঠিত শক্তি-সামর্থ্যে নারায়ণসেবা খুব বেশিদিনের নয়। মজার ব্যাপার, হর-কিসিমের ভালো-মন্দের পথিকৃৎ হবার পাশাপাশি, এই এনজিওবাজির পথিকৃৎও কিন্তু ওই রবীন্দ্রনাথই! প্রমাণ হিসেবে ভাবা যায় তার শান্তিনিকেতন/বিশ্বভারতী প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানগুলোকে। তাছাড়া তার ‘ছিন্নপত্রাবলী’ পড়লে বোঝা যায়, শাঁসালো কোনো এনজিও-র একজন এক্সিকিউটিভ হওয়ার সমস্ত গুণাবলি উপস্থিত ছিল রবীন্দ্রচরিত্রে। এই মজার ভাবনাটি মাথায় এসেছিল ‘রাশিয়ার চিঠি’ পড়তে যেয়ে, বেশ বছর-কয়েক আগে।
যা-ই হোক, রবীন্দ্রনাথ সারাজীবন লিখে গেছেন। রচনা করেছেন ঝরঝর অজর কবিতা-গান-নাট্য-গদ্য-গল্প-উপন্যাস-ভ্রমণসাহিত্য-চিঠিপত্র-চিত্রকলা-প্রতিষ্ঠান-পাঠসূচি — কত কী! তার কাজের বহর বেশুমার। বৌঠান, সে একটু রেস্ট নিক, তোমার কাঁধে মুখ রেখে বড়ো-বেদনার-মতো-বেজে-ওঠা বুকখানি তার হাল্কা করুক!
মৃত্যুদিন
চলে গেলেন শামসুর রাহমান! চলে গেলেন, শামসুর রাহমান? বাচ্চু তুমি, বাচ্চু তুই, চলে গেলে, চলে গেলি?
চলে গেলেন শামসুর রাহমান। দ্বিতীয় তার এই মৃত্যুর আগে রেখে গেলেন তার অজস্র অজর গান, অঝোর শুশ্রূষাধারা।
মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল কত? মৃত্যুকালে কতটা বয়স হওয়া উচিত একজন কবির? আর কবির মৃত্যুকালই-বা কী বস্তু? তা, দ্বিতীয় এই মৃত্যুকালে কত বয়স হয়েছিল কবির? তথ্যটি জেনে নেয়া যাবে যে-কোনো দৈনিক পত্রিকায়। এসব জানা জরুরি নয়, জরুরি হলো কবিকৃতি পাঠ, পড়া তার পঙক্তিপ্রাণ, পদাবলি।
শামসুর রাহমানের দাফনকাজও হয়ে গেল। নয়-বছর-আগে-লোকান্তরিত কবির মায়ের কবরগর্ভেই কবর হয়েছে কবির। ব্যাপারটা ভাবতেই ভীষণ ভালো লাগে — প্রিয়জনের গোরগর্ভে শেষ শয্যাগ্রহণ — মায়ের কোলে/গর্ভে সন্তানের ফিরে যাওয়া, এবং এটি ঘটেছে তাঁর অর্থাৎ কবির অন্তিমেচ্ছানুযায়ী। এ-রকম ঘটনা আগে কখনো আমার গোচরে আসেনি। ধর্মীয় বিধি নিশ্চয়ই এটা অগ্রাহ্য/অন্যায্য ভাবে না, নিশ্চয়ই এ শরিয়তগ্রাহ্যই হবে, না-হলে তো কাঠমোল্লারা কাউকাউ কিছু-একটা করতই। দেখো, কতকিছু এখনো জানি না আমরা! কতকিছুই-না আমাদের অভিজ্ঞতা-অগোচরে রয়ে যায় দীর্ঘকাল! এ-দৃষ্টান্তটি আজকের এই নিদারুণ ভূমি-আক্রার কালে, ছোট হতে হতে ক্রমে কোণঠাসা এ-ক্ষীণসামর্থ্য লোকালয়ে সকল ‘মুমিন-মুসলমানের’ অনুসরণ করা উচিত। তাতে করে জায়গা বাঁচে, উৎপাদন কিংবা গ্রাসাচ্ছাদনে অর্থকরী জমি ব্যবহারের মাধ্যমে বেঁচে-থাকা মানুষগুলো দুটো দিন বেশি আয়েশে-আরামে শ্বাস নিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে পারে। স্রেফ সংরক্ষিত গোরাঞ্চলের জন্য সারাদেশে কত-না জমির অপচয় হচ্ছে! সেকালের সোভিয়েত রাশিয়ায় জমির আইল্ একাকার করে যৌথ চাষাবাদের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়ানোর উদাহরণটি, সবার জন্য শস্য নিশ্চিতকরণের সেই সুন্দর স্বপ্নটি, মনে রাখা যাক।
ভাব
সাধারণত স্নানঘরে লোকের জবর ‘ভাব’ আসে বা লোকেরে ‘ভাব’ এসে চেপে ধরে, এমনটাই শোনা যায়। কথাটা, আমার চেনাজানা মানুষজনের স্বীকারোক্তি অনুসারে, মিথ্যে নয় আদৌ। আর, মিথ্যে যে নয় তার প্রমাণ তো আরো নানাভাবেই পাওয়া/দেওয়া যাবে। যেমন, চিন-পরিচিত আঞ্চলিক কবি/কবিরাজদের লেখাপত্র পড়ে/দেখে মনে হয়, বা আপনার মনে হতে পারে যে, এরা চানঘরে গিয়া ‘ভাব’ ধরে, প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে যেয়ে বসে বসে ‘ভাব’ ভাঁজে! যার ফলেই হয়তো এত মচৎকার (চমৎকার) অবস্থা এদের, ইহাদের ‘ভাব’-এর — ইহাদিগের বেধারা ‘ভান’-এর।
আমারেও ‘ভাব’ পাকড়াও করে, আমারও ‘ভাব’ আসে — তবে অন্যত্র, সেল্যুনে চুল ছাঁটাতে/কাটাতে যেয়ে; অন্তত সেদিন এমনটাই হলো — প্রায়ই অমনটা হয় — চুল-ছাঁটান দিতে যেয়ে নরসুন্দরগৃহে। সেদিনের, দিন-কয়েক-আগের, ঘটনাটাই/ভাবটাই বিবৃত করি তবে সংক্ষেপে : পৃথিবীতে প্রফেশনক্ষেত্রে সবচে সৎ প্রজাতি, মানবখানায় (‘চিড়িয়াখানা’-র বিকল্পশব্দ), এই নাপিত বা কেশ-কর্তক কিংবা সাধুবুলির নরসুন্দর। কিভাবে? আজ তক্ এমন একটি ঘটনাও শোনা যায়নি যে, চুল ছাঁটতে/কাটতে যেয়ে কান কেটে ফেলেছে কোনো ক্লায়েন্টের অথবা দাড়ি কাটতে যেয়ে গলা! অথচ তার কাছে চুল-কাটাতে-আসা খদ্দেরলোক/ভদ্দরনোকদের কারো সঙ্গে তার বৈরী ভাব যে একেবারে নেই এমনটি কি বলা যাবে? শহরে তো সকলে সকলের থেকে বিচ্ছিন্ন, কিন্তু গ্রামদেশে? দেখা যায়, যে-লোকটা নাপিতের আয়না-সামনে সরল ভরসা বুকে নিয়ে সৌম্য বসে চুল/দাড়ি কাটাচ্ছে/ছাঁটাচ্ছে, সে-ই আগেরদিন বা দিনকয়েক আগে নাপিত বেচারার ভিটের সামনা-অংশ চালিয়াতি করে কিংবা জবরদস্তি চালিয়ে নিয়ে নিয়েছে। নাপিত কিন্তু নিতে পারত শোধ। কচ্ করে কানপাশে কাঁচি চালিয়ে বা গিচ্ করে গলাতলে ব্লেড বসিয়ে পারত সে ওই খবিশ খদ্দেরলোকের/ভদ্দরনোকের ভবলীলা সাঙ্গ করে দিতে। কিন্তু করে না। করেনি কখনো। পৃথিবীতে এমনতর প্রতিশোধসংবাদ শোনা যায়নি এখনো।
সেল্যুনে, চুল কাটাবার পাটাতনে তথা কেদারায় বসবার আগে, অনেকক্ষণ সবিরক্তি থম-ধরে বসে থাকতে-থাকতে আরেকটি ‘ইউনিক্’ ‘আনপ্রেডিক্টেবল্’ ভাব আসিয়া হানা দিলো বা স্ট্রাইক্ করল ব্রেইন্-এ। কী-রকম! বাংলাদেশে আদর্শ গণতন্ত্রচর্চার স্থানটি কোথায়? উত্তর — বুদ্ধিমানবৃন্দ বুঝে যাচ্ছেন আগেভাগে — ওই আগেরটাই, হেয়ার কাটিং সেল্যুন্! ওখানে দেখা যায়, আমি আমার বহু উমরের দেখনাভিজ্ঞতা থেকে দৃষ্টান্ত দিচ্ছি, লাইনে যিনি আগে তিনি আগেই কাটাবেন, পরের জন পরে। নাপিত কখনো লাইন ব্রেইক্ করে না। তা আপনি যত বড়বাবু হোন, মহামহিম হোন না, নাপিত কখনো তার ধর্ম থেকে নড়ে না একচুল। একেবারে মিলিটারি ডিসিপ্লিন্। অবশ্য কেউ কারো আগে, লাইন ডিঙিয়ে, কর্তনের জন্য আব্দারও ধরে না। ওইখানে গেলেই মানুষ এত গণতান্ত্রিক হয়ে যায় কীভাবে! আহা, আমাদের দেশটা যদি সেল্যুনঘর হতো! সাধের সংসদটা হতো যদি, হায়, নরনন্দনগৃহ!
বিসমিল্লা
‘হাত পেতে নিয়ে চেটেপুটে খাই / বিসমিল্লার পাগলা সানাই’ … ট্রিবিউট জানিয়েছিলেন কবীর সুমন এইভাবে এই লিরিকের পাখায় চেপে সানাইলিজেন্ড বিসমিল্লা খাঁ পার্থিব কর্মকাণ্ড গুটিয়ে শেষবিদায়ের সময়ে। এই গানটা ‘পাগলা সানাই’ অ্যালবামে একদম পয়লা গান হিশেবে পাওয়া যায়। আমার মতে, এই একটিমাত্র যন্ত্র — বাদ্যযন্ত্র — যার থেকে উঠে আসে নিখাদ আনন্দ, নির্ঝর বেদনা; স্ফুরিত হয় আনন্দের শুদ্ধ রূপ, বেদনার শুদ্ধ রূপ। অবশ্য সুরযন্ত্র মাত্রেই হরিষ-বিষাদ, আনন্দ-বেদনা, শোক ও সঞ্জীবনী নির্ঝরের বেদ প্রকাশিতে সক্ষম। নির্ভর করে যন্ত্রীর উপর। উন্নত কলাকৌশলরপ্ত যন্ত্রী, ইন্সট্রুমেন্টে দক্ষ কব্জি ও অন্যান্য প্রত্যঙ্গের বাদক, ইহবিনোদনভবে বেহতর পাওয়া যায়। কিন্তু সবাই শিল্পী কি? বিসমিল্লা প্রসঙ্গে এই কথা পাড়া হচ্ছে না। কারণ সানাই ইজ্ ইক্যুয়্যাল্ টু বিসমিল্লা অ্যান্ড ভাইস্-ভ্যার্সা। আমরা শুনে এসেছি বিসমিল্লার সানাই, স্টিরিয়ো প্লেয়ারে, বিসমিল্লা খাঁর সানাই শিরোনামে হস্তলিখিত কাগজ-সাঁটানো ফিতার ক্যাসেট একখানা থাকতই সেকেলে গেরস্তালিতে। একটা ক্যাসেটেই মোটামুটি জীবন চালানো গিয়েছে। একটাই ক্যাসেট ফিতা ফেঁসে গেলে সযত্ন রোদেও শুকোতে দিত লোকে।
এবং এ-ই একমাত্র যন্ত্র যার বাজনা শুনে সুরমূর্খও এক-লহমায় বলে দিতে পারে সুরটা আনন্দের না বেদনার। শিশু এমনকি পাগলও বলে ওঠে অস্ফুটে : আহা! বলে ওঠে সস্ফুটে : আহ্! অন্যান্য যন্ত্রের ব্যাপারে একাধটু সুরসাক্ষর হওয়া আবশ্যক হলেও সানাইয়ের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা প্রায় নৈব চ। অধিকন্তু এবং, এই একটি যন্ত্র যা মৃত্যুমুহূর্তে মৃতজনের দারা-পুত্র-পরিবার বেদনা প্রশমনে শুনতে পারে, এবং শোনে, শোক সামাল দিতে শোনে; আবার শোনে বিবাহ কি মিলনমুহূর্ত উদযাপনে। এই বিস্ময়ের বিপন্নতা যার মাধ্যমে ঘটে, যেই যন্ত্রের মাধ্যমে, সেই যন্ত্রের নাম সানাই। সুমন বলেছে ‘পাগলা সানাই’, বলেছে ‘কেউটে সানাই’, বলেছে ‘ক্ষ্যাপাটে সানাই’; সুমন বলতে পেরেছেন অনেক সুন্দর ও অনেক যথার্থে, যে-কোনো বিষয়েই তিনি তা পারেন এবং পেরেছেন, তার অধিগত সকল বিষয়েই তিনি ভীষণ সুন্দর বলতে পারেন। মুশকিল হলো, সুমনের মতো অমন ভালো অনেকেও বলতে পারেন আরও — শুধু এই জিনিশটা উনি ঠিক মন থেকে স্বীকার করতে পারেন বলিয়া মনে হয় না; খালি নিজেকেই দেখতে পান, দেখতে চান, ওবভিয়াস্লি নিজেকে দেখাইতে চান বলেও মনে হয়; এবং এই নিজেকে দেখাইতে যেয়ে যেটুকু জরুরি ঠিক ততটুকু অতিশ্রদ্ধায়-বিগলিত দুইচাইরজন পূর্বসূরি স্টলোয়ার্টের প্রতি নিবেদন করেন তার কথাপ্রাচুর্য। রবীন্দ্রনাথ যদি সুমনস্বভাবের হতেন, ভাগ্যিস যে ট্যাগোর তা ছিলেন না, বাংলা সাহিত্যসংগীতের আর-কেউ তাহলে তিষ্ঠোতে পারতেন বলে মনে হয় না।
যা-হোক, কথা এইখানে স্যাটানতাড়ানো আউজুবিল্লা নিয়া না, কথা এইখানে বিসমিল্লা নিয়া। সানাই বললেই লোকে বোঝে বিসমিল্লা খাঁর সানাই, যেমন বাঁশি বললেই আসে চৌরাসিয়া, সেতার বললেই রবিশঙ্কর। যেন আর-কেউ সানাই-বাঁশি-সেতার বাজায় না, বাজায়নি কখনো! — এমনই কিংবদন্তি এরা, সাধনযন্ত্রটিকে নিজেদের নামের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য করে নিতে পেরেছিলেন একেবারে সূচনাজীবনে, জীবদ্দশাতেই। গুণীজন শব্দটি এদের জন্যই, সর্বার্থে। অ্যানিওয়ে।
বাঁশি বললেই চৌরাসিয়া মনে পড়লেও যন্ত্রটার সঙ্গে একটা নাম অঙ্গাঙ্গী সাঁটা, বাঙালিরই নাম, পান্নালাল ঘোষ। অরিজিন্যালি বরিশালের লোক। আড়বাঁশি যন্ত্রটাকে ইনিই বৃহত্তর মাইফেলে পরিবেশনের উপযোগী করেছেন প্রথম, বাঁশিটা আলগ ও পূর্ণাঙ্গ সুরযন্ত্রের শেইপ্ পেয়েছে পান্নালালের হাতে, এর আগ পর্যন্ত বংশী যন্ত্রটা সাপোর্ট অর্গ্যান্ ছিল বড়জোর। জেনেছি যে পান্নালালের আগে বাংলার বাঁশি ছিল গানের সঙ্গে স্রেফ আবহ তৈরির নিমিত্তে ব্যবহৃত যন্ত্র, স্বকীয় স্বরের কম্পোজিশন্ সম্ভব হতো না তাতে। পান্নালাল পয়লা সাতফুটোর বাঁশি ইন্ট্রোডিউস্ করেন এবং বাঁশি হিন্দুস্তানী ক্ল্যাসিক্যালের মান্যিগণ্যি ইন্সট্রুমেন্ট হয়ে ওঠে তারই হাতবাহিত হয়ে। হরিপ্রসাদজি পিআর বাড়ানোর যুগে স্টেজ্ মাতিয়েছেন যে-বাঁশি ফুঁকে, পান্নালালের আবিষ্কৃত সপ্তছিদ্র বংশী ছাড়া তা আদৌ কল্পনাতেও অসাধ্য ছিল। পান্নালালের সঙ্গে বিসমিল্লার সাদৃশ্যগত তুলনা এইখানেই করা যায় যে, হিন্দুস্তানী ক্ল্যাসিক্যাল্ মিউজিকের সম্ভ্রান্ত উন্নাসিকতাব্যাপ্ত মঞ্চে সানাই ইন্সট্রুমেন্টটাকে ইনিই একহাতে কৌলীন্য ও প্রতিষ্ঠা দান করেছেন।
মনে পড়ছে, মৃত্যুর মাত্র বছর-তিনেক আগে বাংলাদেশে বাজাতে এসেছিলেন খাঁ সাহেব। ঢাকায় এবং আরও কোথায়-কোথায় যেন শো করে গেছেন, পরে টেলিভিশনে দেখেছি টুটাফাটা। বয়স হয়েছে, অশীতিপর বা তদুর্ধ্ব। আগের সেই দম নেই, লম্বা ফুঁ দিতে গেলে বোধহয় ফুসফুস কুলিয়ে-উঠতে পারে না, কেঁদে উঠে কঁকিয়ে উঠে খাঁ সাহেবের কাছে বেচারা শ্বাসধারণযন্ত্রখানা হাতজোড়ে মাফ চায় — মনে হচ্ছিল দেখতে-দেখতে। কিন্তু তবু আলবৎ বোঝা যাচ্ছিল যে যন্ত্র তার যন্ত্রীকে কেমন সমীহ করে, কুর্নিশ করে, কদম-মোবারকে অর্ঘ্য রাখে — সুরের! বোঝা যাচ্ছিল সঙ্গতকারদের আদব দেখে, তমিজ দেখে। সংগীতে একেবারেই উম্মি আমি, আকাট সংগীত-অজ্ঞ মানুষ, আমারই মনে হচ্ছিল : এ-ই তবে জোড়! একে বলে মীড়! জোড়ের কাজ, মীড়ের কাজ নিশ্চয়ই এগুলো! খুব স্বচ্ছ বুঝতে পারছিলাম ‘ধরা’, ‘ছাড়া’; বুঝতে পারছিলাম সমলয়, যুগলবন্দি বাদন! আশ্চর্য বৈকি, রগরগে রকগান শুনে কান-তৈরি/বড়-হওয়া বার্ধক্যন্যুব্জ পোলা আমি, আমারও ভালো লাগছিল যে!
কথাগুলো অন্তরঙ্গম করবেন তারা, যারা বেসরকারি একটি টেরিস্ট্রিয়াল টিভিচ্যানেলে নিতিদিনকার নিউজ্-অ্যাট-টেন্ পরবর্তী প্রায়-প্রাত্যহিক প্রচারিত মিনিট-তিনচারেকের ওই বিসমিল্লাসানাই — বাংলাদেশে-বাজিয়ে-যাওয়া বিসমিল্লা খাঁর সানাই — নিয়মিত শুনতেন/দেখতেন।
ধ্যান
ধ্যান! ধ্যান — এই শব্দ এবং এই শব্দের অন্তরে নিহিত ক্রিয়াকাণ্ডের উপস্থিতি আমাদের জীবনে-জগতে অধুনা বিরল। বস্তুতপক্ষে, দীর্ঘদিন এই শব্দটির উচ্চারণ আমি নিজে তো করিইনি, শুনিওনি কোথাও। গত ক-দিন ধরে ভাবছিলাম এর উপযোগিতা নিয়ে। আমি যে নিজে ভুলে গেছিলাম ধ্যান শব্দের অবস্থিতি এবং আমার পরিবেশ-প্রতিবেশে হুমকি-সম্মুখীন বক ছাড়া অন্য কোনো ধ্যানী মূর্তি চোখে পড়ে না — তার কারণ তবে ধ্যান-এর কার্যকারিতা/উপযোগিতা স্রেফ স্কিল ও অ্যাক্টিভিজমের পূজারী আজকের পৃথিবীতে নেই বলেই? বিষয়টা ভাবাচ্ছে বেশ। ধ্যান অনুপযোগী? তাই তো মনে হচ্ছে এই মাথাভাঙা অ্যাক্টিভিস্টদের গ্লোবাল গোলার্ধে। অবশ্য এক-প্রকার মেকী ধ্যান আজকাল খুব ফ্যাশন্যাবল্, সেটির শিরোনাম মেডিট্যাশন্!
ধ্যান কোথাও নাই বলেই, আমার মনে হয়, আজকের এই অবস্থা; সমস্তকিছুতে এই পপ্ কালচার : পপ্ আর্ট, পপ্ মিউজিক, পপ্ লিট্রেচার … বাংলার কবিতাকাশে আজ কেবল পপ্ পোয়েট্রির ঘনঘটা … কোথায় যাচ্ছেন, তারাপদবাবু? — কেন, কবিসভায়!
মানুষ, তোমাকে ফিরতেই হবে — ধ্যানে! রেডিমেড রেফারেন্স দিয়ে কতদূর যাবে আর! লেখক, জগতের সর্বজনের দুঃখ অবলোকনের পর তোমাকে যেতেই হবে — তপোবনে!
যা-হোক, ধ্যান বিষয়ক ভাবনার সুতোটি একটুখানি বের করে রেখে দেয়া গেল আগের অনুচ্ছেদে; পরে ভাবা যাবে খন। দেখো দিকি, ধ্যান নিয়ে ধ্যানে বসব সে-সময় কোথায়! ধ্যান তফাৎ যাক, আপাতত। বরং শুনি শেয়ালের ডাক। খুব ডাকছে আজ। ডাকছে গত কয়েকদিন ধরেই, রাত জাগার ফলে কর্ণগোচর হচ্ছে। কোথায়-যে থাকে এরা! চাদ্দিকে কলকব্জাগৃহ-ইমারত-বিদ্যুৎবাতি — ঝোপ-জংলা তো হাপিস হয়ে গেছে অনেক বছর হলো — এদের, এই শেয়াল-শেয়ালিনীদের সংসার-গেরস্তি কোথায়? সেটাও একটা বিস্ময়ের ও গবেষণার বিস্তর। সমীক্ষা-শিরোনাম হতে পারে সম্ভাব্য এমন : ‘শহরে শেয়াল : প্রজনন ও আবাসন অনুসন্ধান’!
বাছাধন! কান ভরে শুনে নাও শেয়ালকোহল। শোনো শৃগালসংগীত। শোনো শৃগালিনীর আহ্বান ও শৃগালের এগিয়ে-আসা। আর হয়তো হবে না শোনা আগামী বছর। হয়তো বলছ কেন, নিশ্চিতই শোনা যাবে না শেয়ালডাক আগামী সিজনে। যেভাবে বহুতল বাড়ছে, যেভাবে বন বিনাশ হচ্ছে, যেভাবে বিস্তার পাচ্ছে নিষ্প্রাণ নগর! শেয়ালের ডাক যে শুনতে পেলে, শুনতে যে পাচ্ছ আজ এই দু-হাজার-বিদায়ী যিশুবর্ষে বসে, সেও ভাগ্য বলে মানো! হ্যাঁ, আমি তা মানি। কেননা শেয়ালের হুক্কাহুয়ার সঙ্গেও জড়িয়ে আছে আমার আশ্চর্য ছেলেবেলাকাল! আমাদের শীতরাত্রিগুলো অপরূপায়িত ছিল অতিজাগতিক সব শেয়ালের ডাকে …
সিদ্ধার্থপূর্ণিমা
পায়রাপালকবিধৌত জ্যোৎস্না ঝরছে। পাতা-বুজে-থাকা রেইনট্রি, নির্বাতাস নারকৈল, আবেদনময়ী আমগাছ — সকলেই গোসল সারছে ঝরা জ্যোৎস্নাজলে। বেবাক দুনিয়া আজি উড়ন্ত বলাকার শাদারঙা পাখা। আজ এই রাতে। আজ জ্যোৎস্নারাতে কারা গেল বনের দিকে হেঁটে? আমার তেমন ইচ্ছেটি করছে না, ঠাকুরের করেছিল, বনের দিকে যেতে আমার ইচ্ছেটি করছে না। কিচ্ছুটি করতে আমার ইচ্ছেটি করছে না। এইখানে, এই বারান্দায়, এই দুর্বৃত্ত বিদ্যুতের আসা-যাওয়ার খেলার ফাঁকে নেহাৎ লেখার স্বার্থে, এই নিবন্ধভুক্তিটি লেখার স্বার্থে এই বারান্দায় আধখানি মোম জ্বালিয়ে বসে থাকতেই ভালো লাগছে আমার। কতিপয় খুব জনতোষিত লেখকের মধ্যে জুলজুলে চোখে আহা-উহু জ্যোৎস্না দেখার ব্যাপার ও বিবরণ পাওয়া যায়। এবং এই জ্যোৎস্না, আশ্চর্য ও অতিব্যক্ত কিংবদন্তি এক, প্রকৃতি ও নিসর্গের অন্য আর-সমস্তের থেকে বেশি মনোযোগ পায় সকলের। পাগল, ব্যর্থ লেখক, প্রেমিক, প্রেমে বিফল-মনোরথ ভগ্ন বিরহী কবি, নববিবাহিত গণিতের অধ্যাপক পর্যন্ত কেউ বাকি নেই জ্যোৎস্নাকে একেবারে নিজের জায়া মনে করেননি জীবনে একবার। যার ফলে, প্রকৃতির/নিসর্গের সমস্ত নিয়ামকের প্রতি প্রেম রেখেই বলছি, জ্যোৎস্নাকে বেশ বাজারি-বিষয় আর শস্তা বলে মনে হয় আমার; আর প্রোক্ত পাইকারি জ্যোৎস্নাভোক্তাদের মনে হয় ন্যাকা। এ নিয়ে অধিক বাক্যব্যয় করাটা আমার কাছে সবসময় আদিখ্যেতা/আদেখলামো মনে হয়। যেমন এ-মুহূর্তে আমি যেইটা করছি : বাড়াবাড়ি আদিখ্যেতা!
ঠাকুরের মশহুর সেই গানটায় তিনি অবশ্য বনে যান নাই নিজে, গেছিল অন্য সবাই, এবং ওইটা ছিল অন্য জ্যোৎস্না। ২২ চৈত্র ১৩২০, তথা ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে, রচিত হয়েছে এই গান; গীতবিতানের তথ্য বলছে, তার মানে একশদুই বছর হয়ে গেল ওই জ্যোৎস্নারাতের! মাতাল সমীরণ ছিল বসন্তের, স্পষ্টত গানের কথাভাগে বলা আছে, এবং সবাই বসন্তরজনীবিহারে বাইরে গেলেও ‘রইনু পড়ে ঘরের মাঝে’ রবি নিজে ধ্যানে রইছেন অন্য জ্যোৎস্নার, গানে যদিও বলছেন এইভাবে যে “আমার এ ঘর বহু যতন করে / ধুতে হবে মুছতে হবে মোরে” এবং আরও বলছেন যে কে-একজন আসবে তাই তিনি জেগে রইবেন, কেননা “কী জানি সে আসবে কবে / যদি আমায় পড়ে তাহার মনে / বসন্তের এই মাতাল সমীরণে” ইত্যাদি। বিরহ এবং পূজা — এই দুই বিভাগেই গানটা গাঁথানো রয়েছে দেখা যায়। অ্যানিওয়ে। বসন্তজ্যোৎস্না আর সিদ্ধার্থজ্যোৎস্না দুইটা নিশ্চয় দুই জিনিশ! সত্যি কি তা-ই? একই জিনিশের দুই রকম উৎসারণ নয়?
জবরদস্ত, বাপ রে বাপ, জ্যোৎস্নাযাম! বাণিজ্যিক বাংলা সিনেমার পরিচালকেরা যদি জেগে থাকে এখন, আমার মনে হচ্ছে, তারা এমনি-এমনি বসে থাকবে না ঠুঁটো জগন্নাথের মতন। জেগে যদি থাকে এবং মাল খেয়ে টাল না-থাকে যদি, তবে, নায়ক-নায়িকাকে ঘুম থেকে হাঁকিয়ে-ডাকিয়ে জাগিয়ে ক্যামেরা-অ্যাকশান্-কাট শুরু করে দিয়েছে এতক্ষণে। আর-কিছু না-হোক, এতে করে বেশ মোটা অঙ্কের আলোখর্চা বেঁচে যাবে বেচারা ছায়াছবিডিরেক্টরের। আলাদা আলো ফেলে নায়িকার নখরামো ফোটানোর কসরত করতে হবে না তাকে। এ এমন আলো, বেঢপ-বদখত নায়িকাকেও এইক্ষণে এ-আলোয় দেখাবে অতি খুবসুরত লাবণ্যসিঞ্চিতা। ন্যাকা নায়কেরও জেল্লা কম বাড়বে না। বরং স্ট্রিটবয়-মার্কা অ্যাক্টর ব্যাটাকেও দিব্যি উত্তমকুমার মনে হবে; উত্তম কুমার — পৃথিবীর সেরা রোম্যান্টিক-রূপবান নায়কদের মধ্যে শীর্ষ একজন; বাঙালির মহানায়ক — কথাটি অতিরাঙানো নয়, অ্যাট লিস্ট, তার ক্ষেত্রে।
এই মুহূর্তে কেন জানি মনে পড়ছে রাজন সিদ্ধার্থ ওর্ফে গৌতম বুদ্ধের কথা। আমার মনে হতেছে এখন এ-মুহূর্তে : সিদ্ধার্থ মশাই জীবনে ওই একবারই জ্যোৎস্না দেখেছিলেন, দেখে গৃহত্যাগী হয়ে গেছিলেন। অতঃপর তিনি অন্ধ হয়ে গেছিলেন আসলে। জ্যোৎস্নান্ধ। দ্বিতীয়বার জ্যোৎস্না দেখলে তার আবার সংসারে ফিরতে ইচ্ছে করত। রগরগে রতিরক্তময় সংসারে। কামনা-বাসনা জাগত তার, জাগতিক বোধ-ভাবনায় জুলজুল করে উঠত তার সুখ্যাত সেই নির্বাণলাভের সাধনায় সুপ্ত চক্ষুযুগল। যেমন এই মুহূর্তে এই নিবন্ধের নায়কের, — লেখকের নয় কিন্তু! — খুব লোনলি লাগছে। বেচারির খুব সঙ্গ ইচ্ছে করছে। বেচারি ভারি সঙ্গ মাগিছে কায়মনোবাক্য। জ্যোৎস্নাসঙ্গ। আহা! বেচারা বুদ্ধ! অকালে নির্বাণের নাড়ুর লোভে গেল চলে তিব্বতের কোন গুহায়, নিষ্কাম নিরক্ত সাধনায় ভুগে মর্ত্যধাম থেকে তুলে নিল দেহ। হায়! দ্বিতীয় জ্যোৎস্না দেখলে অমনটি হতো না আলবৎ।
আমারও, বর্তমান নিবন্ধকারের, টেবিলে মোম নিভে আসছে। টেবিলকাঠ ছুঁয়ে-ফেলছে-প্রায় মধুচন্দ্রা মোমগুড়ি। উঠোনে জ্যোৎস্না যেন ভরপুর পুকুর। আমার কিছু অশান্তি অচিন্তা-কুচিন্তা এই রাতে থিতু হলো খানিক। আমার ভালো লাগছে সব। কিছুই তবু লাগছে না ভালো। নিরর্থ-নিদান-নির্মম লাগছে সমস্ত জগৎটা। না, জ্যোৎস্নায় আমার অমন নির্বাণাকাঙ্ক্ষা জাগে না কখনো। বোধিবৃক্ষতলে গিয়ে গ্যাঁট হয়ে আসন নিতে ইচ্ছে জাগেনাকো। জগতের শোক-তাপ-জরা নিয়া ভাবতে বা ভাবিত হতে ভাল্লাগে না মোটে। জ্যোৎস্নায় আমার খুব কামনা-বাসনা জাগে। যমুনা-মেঘনা জাগে। জ্যোৎস্নায় আমার ভেতর জাগে জাগুয়ার। জাগে জলের জোয়ার। জ্যোৎস্নায় আমি আজকাল — অদ্ভুত! — ভালুক দেখতে পাই! আমার প্রিয় সে-ভালুক! প্রিয় সে সবুজ ফল … ! আমি বলি, সমাদরে বলি : তুলতুল ভালুক! এসো করি দোঁহে মিলে গানে ও জ্যোৎস্নাস্নানে রতিসিক্ত রাত্রি গুজরান! বলি : “প্রিয় হে, সবুজ ফল, তোমাকে কঠিন হতে দেবো না, সবুজ ফল, আমাদের স্বীয় ভবিষ্যতে দেখা হবে সে-রকম কথা নেই। দূরে সূর্য ও আঁধার একইসঙ্গে দেখা যায় — যেন উপাসনা ভেঙে দিয়ে ডেকে ওঠে কাক, প্রিয়, সর্বস্বতার কিছু আজ পড়ে নেই, শৃঙ্খল ছাড়া, ঐ অস্থিগুলি ছাড়া আজ কিছু আর পড়ে নেই, ফল, প্রিয় হে, সবুজ তুমি কীটে নষ্ট হও তবু তোমাকে কঠিন হতে দেবো না আমার প্রতারণা এই” … না, উপমান ও উপমেয়র মধ্যবর্তী ব্যবধান তবু থেকে গেল বিস্তর। উৎপলকুমারের কথা দিয়া তো বর্তমান নিবন্ধে অঙ্কিত প্রধান চরিত্রের, এবং এই নিবন্ধপ্রণেতার, কিংবা কারোরই ভিন্ন ভিন্ন মনোবাস্তবতা ধরা যায় না। আসলে তার সাদৃশ্য অনেকটা পান্ডার সঙ্গেই। আমার দেখা সবচে মায়াকাড়া নরম-তুলতুলা আর শিশুদৃষ্টিস্নিগ্ধ সুন্দর প্রাণী এই নিভৃত নির্জন পান্ডা। গাওগেরামে লোকে তারে জ্যোৎস্না নামেই ডাকে। গাত্রধর্ম ও চরিত্রচলনে সে অমনটাই সুসহনীয়, সুমমতাময়ী। সিমি গারোয়ালের সঙ্গে এই ম্যুনলাইট স্যোন্যাটাকে গুলায়ে ফেললে হবে না। নাইন্টিনসেভেন্টিটু রিলিজড ‘সিদ্ধার্থ’ ম্যুভিতে, কনরাড রুক্স পরিচালিত, সুদৃশ্য ফোটোগ্র্যাফি ছাড়া গারোয়াল আর শশি কাপুরের নগ্নতা আছে সিনেমাটায়। আননেসেসারিলি লিঙ্গার করা হয়েছে ক্যাথার্সিস্ এবং বিউটি ভিশ্যুয়্যালাইজেশন্ ছাড়া আর-তেমনকিছুই নাই মনে হয়েছে। এমনকি হের্মান্ হেস্ এই জ্যোৎস্না আঁকতে পারেন নাই তার আখ্যানভাগে। এইটা আঁকার অপেক্ষায়। এই অপেক্ষাও জ্যোৎস্নাগাম্ভীর্যপূর্ণ। অনেকটা আবহমান এই অপেক্ষা। কাতরতা নাই, কিন্তু উদার আয়ত নয়ন রয়েছে আগাগোড়া। আজীবন। আমৃত্যু।
বৃষ্টিমিউজ্
একডজন গান শুনলাম সেদিন, ২০০৬ সনের কোনো-একদিন মূলত, হয়ে গেছে একদশক দেখতে দেখতে এরই মধ্যে! এক্কেবারে পাক্কা একদশক, কম নয়, ভাবো! রবীন্দ্রগান, সাহানা-র গাওয়া। সাহানা — সাহানা বাজপেয়ী, শান্তিনিকেতনে শৈশব কাটানো, সংগীতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাদীক্ষাও সেখানেই — একেবারেই তরুণ বয়সের এই ইন্ডিয়ান-বাংলা গায়িকা; তার জীবনসঙ্গী ছিলেন — এই কিছুদিন আগেও, বর্তমানে বিবাহবিচ্ছিন্ন দুইজনা আলগ বটে — এ-দেশের অল্প-অগ্রসর আধুনিক বাংলাগানে মেধাদীপ্ত তরুণ : অর্ণব। অর্ণবের সুরসৃজন ও সংগীতায়োজনের সেন্স ইতোমধ্যে প্রমাণিত। এই সংকলনেও, ‘নতুন করে পাবো বলে’ অ্যালবামটা, তার বাদ্যযন্ত্রযোজনা ও সংগীতবিন্যাস সর্বাধুনিক ও সুশ্রী হয়েছে। এক্ষেত্রে রিস্ক ছিল অনেক, খুব-একটা শ্রুতিপীড়াকর হয়নি যা-হোক। দুই-তিনটা গান তো খুবই সুন্দর ও সুচারু গেয়েছেন সাহানা। ‘তোমার খোলা হাওয়া লাগিয়ে পালে’, ‘আমার নিশীথরাতের বাদলধারা’, ‘কোন পুরাতন গানের টানে ছুটেছে মন মাটির পানে’ ইত্যাদি রেন্ডিশন্ আলাদাভাবেই উল্লেখ্য। অবশ্য গান শোনার ব্যাপারে উন্নাসিক যারা, উঁচ্-কপালে যারা, তাদের শ্রবণাভিজ্ঞতা ভিন্ন হতে পারে। আমার গানগম্যি খুব অল্পদৈর্ঘ্য (জ্ঞানগম্যির দৈর্ঘ্য-প্রস্থে অল্পতা আরও অধিক অকহতব্য), ফলে ওভারঅল্ শ্রবণ অপ্রীত হয়েছে বলা যাবে না; প্রীতই হয়েছি। বিশেষত বিচিত্র বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারে আবহ আয়োজন বেশ অন্তরঙ্গই হয়েছে বলতে হবে। এই সময়ের উপযোগী একটা পার্ফেক্ট ড্রইংরুম-প্রেজেন্টেশন হয়েছে অ্যালবামটা। তা, সাহানা প্রমুখের গাওয়া আজীবন ইম্প্রিন্টেড থাকবে কানে, এমনটা আমার কাছে মনে হয়নি। শিল্পীর গলাটা অ্যাট লিস্ট লম্বা দৌড়ের গাওয়ার জন্য যুৎসই নয় স্বীকার করতে হবে। একেবারেই অল্প দমের গলা। ফ্লেক্সিবিলিটি নাই। কিন্তু চক্লেটি একটা মিষ্টতা আছে বৈকি, বিষাদস্ফূরিত কৈশোরক কণ্ঠস্বরমধুরিমা সাহানার সম্পদ, এইটুকু সম্পত্তি নিয়া গানদরিয়ায় বেশিদূর সম্ভব না যাওয়া। আলগোছে বেছে বেছে নিজের দমের অনুকূল গানগুচ্ছ করে গেলে নিশ্চয় টেকসই জনপ্রিয়তা থাকবে বেশ বহুদিন। মৌলিক মন-কেমন-করা গানমালা সাহানা ইতোমধ্যে বেশ-কয়েকটা গেয়েছেন এবং সমাদৃতও হয়েছেন কৈশোরোত্তীর্ণ উঠতি তরুণবলয়ের কাছে। এবং সর্বোপরি সাহানার আছে একপ্রকার ইনেইট বিউটি, ইনোসেন্স বলে বোধহয় যে-ছাপটাকে, জীবনবাবুর কবিতায় যেমন আছে যে ‘বাসমতি চালে ভেজা শাদা হাতখান রাখো বুকে হে কিশোরী / গোরোচনা রূপে আমি করিব যে স্নান’ ইত্যাদি, সেই চালধোয়াকালীন শঙ্খের সমুদ্রফেনিল সকরুণ শুভ্রতা সাহানার ডিস্পোজিশনে একটা আলাদা মাত্রা দিয়েছে অবশ্যই। ইদানীং চেহারায় এবং চোখে একটা চুরট-আগ্নেয় পোড়া আভার ডিভেস্টেইটিং সিডাক্টিভিটি এসেছে যদিও-বা। পার্ফোর্মিং আর্টের অ্যারেনায় ফিমেল্ আর্টিস্টিদের ফেশিয়্যাল্ বিউটি ইজ্ মাস্ট। অস্বীকার করার জায়গা নাই যে এই মিডিয়াবাইটের বানানো মহাতারকারাজ্যে ফেশিয়্যাল্ এবং অন্যান্য ফিজিক্যাল্ অ্যাল্যুরেন্স বজায় রেখে ফের এর থেকে বেরিয়ে নিজের শিল্পীসত্তাটাকে মেনিফেস্ট করার মধ্যেই শিল্পীর সফলত্ব। সময় বয়ে যায় নাই নিশ্চয়, সাহানা পারবেন বা হয়তো এদ্দিনে পেরেও গিয়েছেন নিজের শর্টকামিংগুলো মোকাবিলা করে ঈপ্সিত বেদিতে নিজেরে স্থাপিতে। এখন, আজকাল, সাহানার মতো অসংখ্য না-হলেও অনেক ট্যালেন্টেড শিল্পী বিচ্ছিন্নভাবে নেস্কাফে বেইসমেন্ট বা কোকস্টুডিয়ো বা মুর্চাং বা সাউন্ডক্লাউড বা ইউটিউবে পেশাদারিতার বাইরে থেকে গাইছেন। সকলে সমানভাবে না-হলেও অনেকেই ভীষণ ভালো করছেন। তবে শেষমেশ যেইটা জরুরি তা হচ্ছে গানটাকে সাবসিডিয়ারি না-রেখে কেন্দ্রে নেয়া আপন মনোযোগের। সাহানা গানটাই করে যেতেছেন ভালো হোক বা মন্দ প্রোফেশন্যালি এবং বলা বাহুল্য যথেষ্ট সিরিয়াস্লি। কিন্তু যতটা-না গেয়েছেন এতাবধি তারচেয়ে বেশি প্রচারের সাপোর্টটা লাভ করে ফেলেছেন পারিবারিক ও অন্য নানাবিধ এলিটিস্ট পরিকাঠামোর সুবাদে। এমনিতে ব্যক্তিগতভাবে নবাগত কোনো কবি/শিল্পীর কাজ উপভোগ করতে যেয়ে কখনো পূর্ববর্তী মহারথীদের সঙ্গে মেলানো অপছন্দ আমার। সবকিছুতেই আইকন্ খোঁজার চেষ্টা বাঙালির একটা বিচ্ছিরি বাতিক বৈকি। গান শুনতে গেলেও এটা চাগিয়ে ওঠে যত্রতত্র। নতুন একজনকে বরণ/আবাহন করার প্রবণতা দূর থাক, মনোযোগে শোনার আগেই বলে বসে : আরে অমুকের গলায় যদি এই গানটা শুনতেন, তবেই-না বুঝতেন … ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি! রবীন্দ্রনাথের গান শোনার বেলায় প্রতিমা-কণিকা-সুচিত্রা-জর্জ-সুবিনয়-গীতা ঘুরেফিরে আসবেই। রিডিকিউলাস্! অর্থাৎ সমস্তকিছুতে অহেতুক অতীতচারণের ভয়াবহ বাতিক।
ডায়রি
একজন মানুষ তার প্রতিদিনের দেখা-শোনা-ভাবনা-দূরভাবনাগুলো দিনলিপিপৃষ্ঠে ধারণ করতে যায় কেন? ফের অন্য-একজন তার প্রাত্যহিক প্রভৃতি ও অন্যান্য অনুভূতিমালা কবিতা/গল্প/উপন্যাস সংরূপে ধরে রাখতে চায় কেন, যেখানে কেজোগোছে একটা দিনলিপি রাখলেই তো হতো; হতো না? কিসের তাড়নায় একজন মানুষ লিখতে প্রণোদিত-প্ররোচিত হয়? মানুষ লেখে কেন? মানুষ তো তার অভাব-স্বভাব-অনুভূতি-উপলব্ধি-অভিজ্ঞতা লিখেই রাখবে — এমন যদি ধরে নেয়া হয় স্বাভাবিক, তো সব মানুষ লেখে না কেন? বেশিরভাগ মানুষ যেমন করে থাকে, তার/তাদের প্রতিদিনের কথাবার্তা-বোধ-দূরবোধ পার্শ্ববর্তী অন্য/দূরবর্তী/নিকটজনের কাছে ব্যক্ত করে রাখে, একজন যে কি-না লেখে প্রতিদিন, সেও-তো অমন করলেই পারত। ওর চেয়ে বেশি এগিয়ে অর্থাৎ লেখার বাড়তি শ্রম ও আয়োজন না-করলেই কী হতো না! লেখা কি অনিবার্য/অবধারিত তবে, অন্তত কিছু মানুষের জন্য? রচনা/লিখে-রাখা বা সঙ্কেতায়ন, বিশেষত সৃজনাশ্রয়ী সঙ্কেতায়ন, কাউকে কি ধরে-বেঁধে করানো যায়? সঙ্কেতায়ন/কোডিং মাত্রই তো বি-সঙ্কেতায়নের অপেক্ষায় থাকে; বি-সঙ্কেতায়ন/ডিকোডিং ব্যতীত কি সঙ্কেতায়ন নেই পৃথিবীতে? ডিকোডিং ব্যতীত কোডিং হয় না? এই যে, এই দিনলিপিকার — এ-ও কি তবে আশা করে আছে, কেউ এসে একদিন তার নিশিদিনলিপিপত্রের সঙ্কেতোদ্ধার করবে? সবকিছু, সমস্তকিছুর সঙ্গেই তবে কোনো-না-কোনোভাবে একটা ‘চাওয়া’ জড়িত? প্রকাশালোকে এসে গেলেও কি দিনলিপি নিজের চরিত্র রাখতে পারে অক্ষুণ্ণ?
সুজাতাকে ভালোবাসতেন কবি, বর্তমানেও বাসেন কি না ভালো — অবসরে ভাববেন বলেছিলেন; “সুজাতাকে ভালোবাসতাম আমি — / এখনো কি ভালোবাসি? / সেটা অবসরে ভাববার কথা, / অবসর তবু নেই; / তবু একদিন হেমন্ত এলে অবকাশ পাওয়া যাবে; / এখন শেল্ফে চার্বাক ফ্রয়েড প্লেটো পাভলভ ভাবে / সুজাতাকে আমি ভালোবাসি কি না।” আমাদেরই মধ্যে কেউ, লোকেন বোস হবে, লিখে রেখেছিল জর্নালে এই ভুক্তিটুকু। অবসর কি মিলেছিল পরে? এবং, ওই যে, “মনে হয় যেন অমিতা সেনের সাথে সুবলের ভাব, / সুবলেরই শুধু? অবশ্য আমি তাকে / মানে এই — এই অমিতা বলছি যাকে — / কিন্তু কথাটা থাক; / কিন্তু তবুও —” … পুনরায় জিজ্ঞাস্য, “অমিতা সেনকে সুবল কি ভালোবাসে? / অমিতা নিজে কি তাকে? / অবসরমতো কথা ভাবা যাবে, / ঢের অবসর চাই; / দূর ব্রহ্মাণ্ডকে তিলে টেনে এনে সমাহিত হওয়া চাই;” … এহেন প্রশ্নে এ-যাত্রা খামোশ রহা যাক। ফির বলেঙ্গে।