গুন্টার গ্রাস ও আমাদের গ্যাস্ট্রিক আলসার । আখতারুজ্জামান ইলিয়াস
প্রকাশিত হয়েছে : ২৯ এপ্রিল ২০১৫, ৪:০৪ পূর্বাহ্ণ, | ২২১৫ বার পঠিত
গুন্টার গ্রাসের টিন ড্রাম পড়ি ১৯৭১ সালে।
পূর্ব বাংলায় তখন ঘোরতর পাকিস্তান এবং রাষ্ট্রটিকে টিকিয়ে রাখার জন্য সেনাবাহিনী একনাগাড়ে মানুষ খুন করে চলেছে। ঢাকার রাত্রিগুলি তখন কারফ্যু-চাপা, ব্ল্যাক-আউটের বাধ্যতামূলক অমাবস্যায় নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। গলির মাথায় বড় রাস্তায় আর্মির ট্রাক চলে যায়, গ্লাস ফ্যাক্টরির শ্রমিক কলোনিতে ব্রাশফায়ার চলছে শুনে বুঝতে পারি আরও কয়েকটা মানুষ লাশে পরিণত হল। গলির ভেতর জিপ থামলে নিজের হার্টবিট সারা ঘর জুড়ে গুলিবর্ষণের ধ্বনি হয়ে ওঠে। মিলিটারি বুটের সদম্ভ পদক্ষেপে আবার এই শব্দ চাপা পড়ে। এই বুট ঘা মারতে পারে আমার দরজায়, আবার থামতে পারে প্রতিবেশীর ঘরের ভেতর ঢুকে। পরদিন পাড়ার কয়েকজন মানুষকে দেখা যায় না। আর্মির জিপ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাদের কোথায় নিয়ে গেছে, তারা আর কোনোদিন ফেরে না। সকালবেলায় রাস্তায় বেরুলেও খালি মিলিটারি। তাদের কাজের বিরতি নেই। মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের খোঁজে গিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয় বস্তিতে, বাজারে। আগুনের গ্রাস থেকে পালাতে গিয়ে বাজারের লোকজন মারা পড়ে ব্রাশফায়ারের সামনে। বিকালবেলা হতে-না-হতেই রাস্তাঘাট শুনশান, সন্ধ্যা হতে-না-হতে গভীর রাত। আবার কারফ্যু, আবার ব্ল্যাক-আউট, বুটের সদম্ভ পদচারণা, ব্রাশফায়ার নরহত্যার যজ্ঞ। এই আতঙ্কে নিশ্বাসপ্রশ্বাসের কাজটা করতেই হাঁপিয়ে উঠি।
ঐ সময় পড়ি টিন ড্রাম। অসকার ড্রাম পেটায় আর তার আকাশ ফাটানো আওয়াজ কানে ঢোকে বজ্রপাতের মতো। এবং কানের পর্দা ছিঁড়ে চলে যায় মগজে, মগজ থেকে এ-শিরা ও-শিরা হয়ে পড়ে রক্তধারার ভেতর। অসকারের ঐটুকু হাতের বাড়ি এতটাই প্রচণ্ড যে তা ছাপিয়ে ওঠে মেশিনগান স্টেনগানের ব্রাশফায়ারকে। আমরা কয়েকজন বন্ধু একে একে বইটা পড়ি আর হাড়ের মধ্যে মজ্জার কাঁপন শুনিঃ ঘোরতর বিপর্যয়েও মানুষ বাঁচে। প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর সম্ভাবনা থাকলেও বাঁচা যায়। বাঁচার ইচ্ছা যদি তীব্র হয় তা হলে তা-ই পরিণত হয় সংকল্পে। তখন মৃত্যুর আতঙ্ক মাথা নত করে।
টিন ড্রাম কিন্তু আমাদের বিজয়ের ডঙ্কা শোনায়নি। বিজয় সম্পর্কে আমাদের প্রধান প্রেরণা ও একমাত্র ভরসা ছিল আমাদের প্রতিরোধের অদম্য স্পৃহা। সেনাবাহিনীর নৃশংস নির্যাতনে এই স্পৃহা নতুন নতুন শিখায় জ্বলে উঠেছিল। কিন্তু কবুল করতে দ্বিধা নেই, ১৯৭১ সালের শেষ কয়েকটা মাস অসকারের ড্রামের ডম্বরু আমাদের ভয় ও আতঙ্ককে শ্লেষ, কৌতুক, বিদ্রুপ ও ধিক্কার দিয়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে দেখতে আমাদের প্ররোচিত করে। নিজেদের আতঙ্কের এই ময়না-তদন্তের ফলে আতঙ্ককে বাগে আনা সহজ হয়েছিল।
ঐ বছরের শেষে আমাদের দেশ থেকে পাকিস্তান লুপ্ত হয়, ঐ ভয়াবহ আতঙ্ক ও উত্তেজনা থেকে আমরা রেহাই পাই।
দিন যায়। আরও অনেক বইয়ের সঙ্গে গুন্টার গ্রাসের আরও বই জোগাড় করে পড়ি। তাঁর কবিতা পড়ি। এখানে-ওখানে আঁকা তাঁর স্কেচও দেখি। বেশির ভাগই আত্মপ্রতিকৃতি। অদ্ভুত, ভয়াবহ ও বীভৎস সব ছবি। ১৯৮৫ সালে এক সন্ধ্যায় টিন ড্রাম চলচ্চিত্রটা দেখে ফেলি।
চলচ্চিত্র তো দেখা ও শোনার মাধ্যম। কিন্তু, ১৯৭১ সালে বই পড়ার সময় ড্রামের যে-পিটুনি কানে তালা লাগিয়ে দিয়েছিল, বরং বলা যায় কানের তালা খুলে দিয়েছিল, ১৯৮৫ সালে ফিল্মে তা অনেকটা ফাঁপা মনে হল। কিন্তু ফিল্ম হিসাবে তো টিন ড্রাম বেশ ভালো। তবে? হয়তো ফিল্মের দোষ নয়, কয়েক বছরে আমার কানও বোধহয় ভোঁতা হয়ে গেছে।
গুন্টার গ্রাস কিন্তু ভোঁতা হননি। এই দেড় দশকে তাঁর ধার অনেক বেড়েছে। তিনি এখন খুব বড় ব্যক্তিত্ব, কেবল জার্মানিতে নয়, তাঁর তৎপরতা ও প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে গোটা পশ্চিম ইউরোপ জুড়ে। বড় শিল্পীর মতো কেবল নিভৃত শিল্পচর্চায় তিনি মগ্ন থাকেন না, কিংবা ব্যাপক ও প্রশস্ত কর্মকাণ্ডকে তিনি মনে করেন শিল্পচর্চার অংশ। পরাশক্তির আণবিক ষড়যন্ত্রকে ধিক্কার দেওয়ার জন্য ইউরোপের যুবকদের সঙ্গে তিনি মিছিলে নামেন, বড় সমাবেশের আয়োজন করেন। স্ফীতোদর পুঁজিবাদের সর্বগ্রাসী চোয়াল বন্ধ করার তাগিদে উদার গণতন্ত্রী নেতা উইল ব্রান্টের নির্বাচনী প্রচারণায় শামিল হন। স্ফীতোদর পুঁজিবাদের মেদ চেঁছে ফেলার জন্য ইউরোপে যেসব তৎপরতা চলছে তাতে কেবল সমর্থন দিয়েই ক্ষান্ত হন না, এর সমস্ত উদ্যোগেই তিনি তৎপর। শেষ পর্যন্ত ইউরোপেও সীমাবদ্ধ থাকতে পারেন না। পুঁজিবাদের শোষণে ক্লিন্ন ও ক্লিষ্ট তৃতীয় বিশ্বের চেহারা দেখতে ছুটে আসেন এই উপমহাদেশের জনাকীর্ণ শহরে। মুমূর্ষু কলকাতা, অবক্ষয়ী কলকাতা, রুগণ ও নোংরা কলকাতা তাঁকে ক্ষিপ্ত করে তোলে। একটি উপন্যাসের কয়েক পাতা জুড়ে এই ক্ষোভের প্রকাশ ঘটে, এই শহরকে তিনি মনে করেন নরকের বিষ্ঠা।
এবার তাঁর পদার্পণ ঘটছে ঢাকায়। শুনলাম, আমাদের এই পুরনো শহরটির নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনযাপন দেখার জন্য তিনি উদগ্রীব। কলকাতা সম্বন্ধে প্রতিক্রিয়া দেখে ভয় হয়, আবার আশাও হয়, এখানকার কাণ্ডকারখানা দেখে অসকারের ড্রামের কাঠি এবার হয়তো তিনি নিজের হাতে তুলে নেবেন।
১৫ বছর আগে এলে রাষ্ট্রের নির্যাতন ও মানুষের প্রতিরোধের আগুনে হয়তো উষ্ণ হতে পারতেন। সেই উত্তাপ এখন কোথায়? এক রাষ্ট্রের পতন ঘটেছে, অভ্যুত্থান ঘটেছে আরেক রাষ্ট্রের। কিন্তু দেশের বদল হয়নি। আগেকার রাষ্ট্রের শোষণ বর্তমান রাষ্ট্রেও অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু নির্যাতনের সরাসরি পদ্ধতিটা বাতিল হয়ে গেছে, এখন নতুন নতুন পথ খোলা হচ্ছে। পুরনো রাষ্ট্রের নৃশংস নির্যাতনের বিরুদ্ধে যে-প্রতিরোধ স্পৃহা মানুষকে দারুণভাবে জ্যান্ত করে রেখেছিল সেই স্পৃহা এখন স্তিমিত। রুখে দাঁড়াবার বদলে মানুষ এখন ভোঁতা হতাশায় নিস্তেজ। উপমহাদেশের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের এখানকার কর্ণধার কারা? গুন্টার গ্রাস তরুণদের উদ্দেশে যে-বয়স্ক লোকদের পঙ্গু ও নপুংসক বলে রায় দিয়েছেন, আমাদের রাষ্ট্রীয়-রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃত্ব সেইসব চির-অপরিণত পঙ্গু ও নপুংসক লুম্পেনদের হাতে। এদের সকলের ওপর চেপে বসে রয়েছে বিদেশি পরাশক্তি। ঘাড় থেকে তাদের সরাবার কোনো ইচ্ছা বরদাস্ত করা হবে না। আর সেরকম ইচ্ছা হবেই-বা কেন? নিজেদের স্বার্থ যাতে ঠিক থাকে তার জন্য এখানকার নেটিভ নেতাদের আসন অটল রাখার উদ্দেশ্যে প্রভুরা সবসময় সতর্ক। পুঁজিবাদের গতর আরও মোটাসোটা করতে হলে এই ভাড়াটে ঠ্যাঙাড়েদের টিকিয়ে রাখাটা খুব দরকার। এজন্য কত ফন্দিফিকিরই-না বার করা হয়।
কোথাও ব্যবস্থা দেওয়া হয়, পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের চওড়া সিঁড়ি ধরে ধাপে ধাপে ওঠো। উঠতে উঠতে একদিন সমস্ত দেশবাসীর সামগ্রিক মুক্তির সোনার কাঠিটি পাওয়া যাবে। মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী মহা উৎসাহে বাণী ছাড়েন, পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের শিকড় গভীরে প্রোথিত হয়ে গেছে, এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। যারা এসব কথা বলেন তাঁরা কোথাকার লোক? এঁদের বাড়ি সেই দেশে যেখানে প্রধানমন্ত্রী নিহত হলে তাঁর রাজনীতিবিমুখ পেশাদার পাইলট পুত্রসন্তানকে ককপিট থেকে ধরে এনে প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসাতে না-পারলে সংসদীয় দল তো দল, রাষ্ট্র পর্যন্ত ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। যেসব দেশে দলনেতার মৃত্যুর পর নেতার বিধবা স্ত্রী বা কন্যাকে নেতৃত্বে বসাতে না-পারলে দলের লোকজন একসঙ্গে বসতে চায় না, সেসব জায়গায় ওয়েস্টমিনস্টার গণতন্ত্র প্রয়োগ করার জন্য এত উৎসাহ কেন? শোষণের বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিরোধ-স্পৃহাকে নিভিয়ে দেওয়া ছাড়া এই উৎসাহের আর কি কারণ থাকতে পারে? এর অন্তর্নিহিত বাণী একটিই, তা হল এইঃ বেশি জ্বলে ওঠা ভালো নয়। মানুষ জ্বলে উঠলে এইসব পঙ্গু ও চির-অপরিণত সাবালকদের হাতে নেতৃত্ব থাকে না।
যেখানে দেখা যায় এসব ব্যবস্থায় ঠিক জুত হচ্ছে না সেখানকার ব্যবস্থাপত্র একটু আলাদা। বাইরে থেকে সেখানে প্রভুরা লেলিয়ে দেয় সেনাবাহিনী। কোন সেনাবাহিনী? না, না, বাইরের লোক নয়। দেশের মানুষ দিয়ে গঠিত সেনাবাহিনী। কিন্তু সেনাপতিদের মুণ্ডু থেকে ল্যাজ পর্যন্ত বাঁধা পুঁজিবাদের স্ফীতোদর শক্তির হাতের শক্ত দড়িতে। প্রভুরা ঝাঁকে ঝাঁকে অস্ত্র পাঠায়। পঙ্গুর হাতে, নপংসকের হাতে অস্ত্র পড়লে নিরন্ন ও নিরস্ত্র দেশবাসীর ওপর ছাড়া আর কোথায় তার প্রয়োগ হতে পারে?
এদের ওপর গুন্টার গ্রাসের ক্রোধ নানাভাবে বিস্ফোরিত হয়েছে তাঁর বিভিন্ন লেখায়, তবে সরাসরি পাই তরুণদের উদ্দেশে তাঁর ভাষণে। পুঁজিবাদের ক্রমপ্রসারমাণ মেদ চেঁছে ফেলার আন্দোলনের তিনি একজন সক্রিয় সদস্য। আর আমাদের এই উপমহাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী বা ঠ্যাঙারে সেনাবাহিনী–দুইই হল আত্মসম্প্রসারণে তৎপর পুঁজিবাদের নপুংসক ও পঙ্গু সেবাদাস। স্ফীতোদর পুঁজিবাদের মেদ চেঁছে ফেললে কি তার সাঁড়াশি থেকে বেরুনো সম্ভব? পুঁজিবাদের মেদ কমলে তার শক্তি কমবে না, বরং মেদহীন ছিপছিপে চেহারা দেখিয়ে উপমহাদেশে আরও বেশি মানুষকে দলে টানা তার পক্ষে সহজ হবে। তারপর সুযোগ পেলেই তার আসল মূর্তি ফের প্রকট হয়ে উঠবে। তখন তার সম্প্রসারণ ঘটবে নতুন বেগে।
আজ থেকে সোয়াশো বছর আগে গুন্টার গ্রাসের আরেকজন দেশবাসী পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো আমাদের এই উপমহাদেশের শোষিত মানুষের সুখদুঃখের শরিক হতে চেয়েছিলেন। নাম তাঁর কার্ল মার্কস। সমসাময়িক ঘটনা থেকে তিনি বুঝতে পারেন তখনকার ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ এই দেশে রাজ্যগ্রাসী তৎপরতা চালিয়ে কী করে তাদের নির্মম শোষণের প্রসার ঘটাচ্ছে। ১৮৫৭ সালে ভারতীয় সিপাইদের স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হলে নতুন পাশ্চাত্য শিক্ষায় আলোকিত ভারতীয় বুদ্ধিজীবীদের কেউ-কেউ এটাকে উৎপাত বলে গণ্য করেন। আর হাজার হাজার মাইল দূরে বসেও সিপাহিদের ওপর হামলে-পড়া-ইংরেজদের মার্কস অভিহিত করেন কুত্তা বলে এবং ইংরেজকুত্তাদের সেবায় লিপ্ত ভারতীয় দালালদের ধিক্কার দিতে তাঁর কিন্তু এতটুকু দেরি হয়নি।
মার্কস জানতেন শান্তিপূর্ণ উপায়ে, বিনা রক্তপাতে, পুঁজিবাদী শক্তিকে পরাভূত করা যায় না। একটি রুগণ ও শোষিত সমাজের জন্য ‘শান্তি’ হল বিলাসিতা। তরুণ নাগরিকদের উদেশে গুন্টার গ্রাসও বলেন, ‘দীর্ঘস্থায়ী শান্তি বড় ভালো জিনিস’। কিন্তু এটা অস্বস্তিকর, বিরক্তিকর। শান্তি দিয়ে আমরা করবটা কী? এতে দম বন্ধ হয়ে আসে। ফলে গ্যাস্ট্রিক আলসার দেখা দিতে পারে।
গুন্টার গ্রাসকে আমরা আশ্বাস দিতে পারি যে, পরাশক্তির প্রভুত্ব নিশ্চিত করার উদেশ্যে ওয়েস্টমিনস্টার-মার্কা গণতন্ত্রের ভেলকি দেখিয়ে কিংবা তোপের মুখে তাদের এদেশি দালালরা শান্তিপূর্ণ অবস্থার মায়াসৃষ্টির যত আয়োজনই করুক-না, ওরকম শান্তি আমাদের দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। পেটে যাদের খাবার নেই, আর কিছু না-হোক পেটটা তাদের জ্বলবেই। আমাদের গ্যাস্ট্রিক আলসারের উৎস আমাদের দমবন্ধ-করা-শান্তি নয়–দীর্ঘদিনের অনাহার-অর্ধাহার। হ্যাঁ, অনাহার ও অর্ধাহারই হল আমাদের আলসারের প্রধান কারণ। বহুকাল থেকে আমরা ঠিকমতো খেতে পাই না। এক হাজার বছর আগে লেখা সবচেয়ে পুরনো বাংলা কবিতা শুরু হয়েছে অন্নহীন হাঁড়ির খবর দিয়ে। অনাহারে-অর্ধাহারে পেটের অসুখের ঐতিহ্যও আমাদের বহুকালের। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আমাদের বহু লোকালয়, বহু জনপদ উজাড় হয়ে গেছে কলেরায়। কার্ল মার্কস, এমনকী, ১৮১৭ সালের একটি মহামারির কথা উল্লেখ করেছেন। এই কলেরা প্রথম দেখা দেয় আমাদের যশোরে, সেখান থেকে এশিয়া হয়ে তা চলে যায় ইউরোপে, সেখানে প্রচণ্ড লোকক্ষয় করে যায় ইংল্যান্ডে এবং সেখান থেকে আমেরিকায়। আজ আণবিক অস্ত্র তৈরির জন্য পরাশক্তিগুলো কোটি কোটি টাকা খরচ করে, আর আমাদের দেশের মানুষের অনাহারজনিত পেটের রোগ উপশমের কোনো লক্ষণই চোখে পড়ে না।
আমাদের আলসারের ব্যথা দিনদিন অসহ্য হয়ে উঠছে। স্ফীতোদর সর্বগ্রাসী পুঁজিবাদকে শ্লেষ আর বিদ্রুপে বিদ্ধ করে এই ব্যথাকে চিরে চিরে দেখার মতো সময় শেষ হয়ে এসেছে, সেই বিলাসিতা আমাদের পোষায় না। পুঁজিবাদের গতর রোজই একটু একটু করে মোটা হচ্ছে, উপমহাদেশের বিভিন্ন পয়েন্টে মোতায়েন তাদের নপুংসক ও পঙ্গু কুকুরগুলোর দাঁতের ধারও বাড়ছে। অবস্থা এমন যে এদের কামড়ে আলসার-ভোগা মানুষের জলাতঙ্ক হবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। তাদের হাত থেকে অস্ত্র নিয়ে তাদের দিকে তাক করতে না-পারলে আমাদের আলসার ও সম্ভাব্য জলাতঙ্ক থেকে রেহাই পাওয়ার কোনো উপায় নেই।
গুন্টার গ্রাস আমাদের এইসব রোগের কারণ নিশ্চয়ই শনাক্ত করতে পারেন। অসকারের বয়স এখন ৬০ বছর। তবু আমাদের কাছে সে চিরকালের তরুণ। পঙ্গু ও নপুংসক সাবালকদের লিস্টে সে নাম লেখায়নি। তার হাতে এবার আরও শক্ত, আরও কর্কশ একটি ড্রাম তুলে দেওয়ার কথা গুন্টার গ্রাস কি বিবেচনা করে দেখবেন?