শৈলেশ্বর ঘোষ : এক অন্তর্গত আগুনের নাম / স্বপন সৌমিত্র
প্রকাশিত হয়েছে : ১৫ নভেম্বর ২০১৪, ১২:১৯ অপরাহ্ণ, | ২৮৩৪ বার পঠিত
‘মানুষ মানুষের সঙ্গে কম্যুনিকেট করার জন্যই লেখে, আমি যদি কারও লেখা পড়ে কম্যুনিকেটেড হই, সেই লেখা তখন কেবলমাত্র আমার নিজস্ব ব্যাপারটাকেই জাগাতে সাহায্য করবে’ —
. মানুষের জীবনের অবক্ষয় …
. ভালোবাসা …
. ভালোবাসার সূত্র …
. ক্ষতস্থান …
. অন্তর্ভেদী চিৎকার …
নামহীন অভিজ্ঞতার স্পর্শে জেগে ওঠে আমাদের প্রকৃতি ও মানুষের মনস্তাত্ত্বিক সুখ ও দুঃখ।
আমি আমার জীবনকে খুব ভালোবাসি। আমি আমার অভিজ্ঞতাকে ভালোওবাসি আবার ঘৃণাও করি। আমার জীবনের প্রয়োজনে স্থান-কাল-পাত্রের পরিপ্রেক্ষিতে আমার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করি। আমার অভিজ্ঞতা অন্য কোনো ব্যক্তির কোনো কাজে লাগে না, লাগবেও না জানি! তবুও আমার জীবনের সময় ও অভিজ্ঞতাতে যখন দেখি আমার মতো অন্য কারোর মধ্যে অনুরূপ চিন্তার সাদৃশ্য খুঁজে পাই, তখনই সে আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় আর প্রিয়তর হয়ে ওঠে —
চিন্তার সাদৃশ্য :
— প্রত্যেকের কিছু ঘুমহীন রাত থাকে; যাকে চিরদিন নষ্ট চোখের আয়নায় রেখে অন্যের প্রতিবিম্ব খোঁজে, পৃথিবীর মায়া আবেগ দেহ এমন বিশুদ্ধ কিছু নয়।
— সম্পদ, ক্ষমতা ও সুখ (আনন্দ-দুঃখ) — এরাই হলো মায়া যা সত্যকে আড়াল করে রাখে। জীবন এবং পৃথিবী মায়া নয়। আমাদের পৃথিবী কিন্তু সম্পদ, ক্ষমতা এবং সুখ — এই তিনটিকেই বেশি কামনা করে।
— স্মৃতিভূক মানুষ! আবার একদিন শিউলিফুলের ঘ্রাণ থেকে উড়ে-যাওয়া প্রজাপতির মতো ফিরে আসে।
আত্মবিস্মৃত মানুষ নিজেকে পুনরায় এই পৃথিবীর জীব বলে বুঝতে পারে — ‘নিজের ক্রুশ নিজে বহন করার নামই জীবন!’
জগৎ ও জীবন :
আমাদের বাস্তবতা বা বর্তমান সময়ে আমাদের জীবনযাপনকে জগৎ ও জীবনের সঙ্গে প্রকাশ করা প্রয়োজন। পরিবর্তন জীবনের মৌলিক ধর্ম : পরিপূর্ণ আনন্দ পাওয়া যায় কি না তা জানি না আজও, আবার হতে পারে আনন্দ শব্দটাই একটা শূন্য অর্থহীন অবস্থা … দুঃখ মানুষের জীবনকে বেশি-সময় ধরে রাখে বলেই মানুষ দুঃখকে জয় করতে চায়। কিন্তু দুঃখকে জয় করতে পারে না কেউই!
অর্থনৈতিক সামাজিক রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যক্তি তার পছন্দ ও অপছন্দের বিষয় নির্ণয় করে সবসময়। মানবিক ভীতি, দুর্বলতা, সংশয়, দ্বিধাদ্বন্দ্ব দিয়েই মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠে। মানুষের ভাবনায় বড় হয়ে দেখা দেয় তার বর্তমান জগৎ ও সময় …
আমি শৈলেশ্বর ঘোষের কবিতা পড়ে আমার নিজের পরাজিত অস্তিত্বকেই খুঁজে পাই। পরাজিত সত্তা বা অস্তিত্বকে চিহ্নিত করতে পারি বলেই শৈলেশ্বর ঘোষ আমার কাছে ‘গুরুত্বপূর্ণ’। ক্ষমতার এই পৃথিবীতে মানুষের সমস্ত প্রচেষ্টা উদ্যমতা থাকা সত্ত্বেও শেষে পরাজিত হওয়াই তার নিয়তি বা পরীক্ষিত রূপ … আমি দাঁড়িয়ে থাকার জন্য মাটিকেই ভালোবাসি।
শৈলেশ্বর ঘোষের আছে সেই চোখ, যা ‘বেশি ও গোপন কিছু দেখেছিল।’ কবি শৈলেশ্বরকে অননুকরণীয় শৈলেশ্বর হিসেবেই দেখি এবং দেখব। আমাকে ভীষণভাবে অনুপ্রেরণা জাগায় তাঁর শেষ বইয়ের ‘এত আলো আসে’র কবিতার অমোঘ পঙক্তিগুলি —
‘একহাতে রিভলবার ও তিনটি আওয়াজ — মৃতদেহ দুটি পাশাপাশি পড়ে, একটি সেই যুবকের যে সকলকে পরীক্ষা করতে এসেছিল — আশাতীত নির্জনতার হত্যাকাণ্ড হবার পর পকেট থেকে একটুকরো কাগজ পড়ে গেছে, এসো, রমণশীল মানুষ, সূত্র ধরে খুঁজে যাও তোমার বংশানুক্রমিক অপরাধীদের!’
শৈলেশ্বর ঘোষের কবিতা ভূতগ্রস্ত — একা একা, নিবিড় সূক্ষ্মতায় হৃদয়ে প্রবেশ করে তারপর ভাঙচুর করে বুকের ভেতর … তাঁর কবিতায় অদ্ভুত এক বোধ ‘জ্ঞানের ভেতর জ্ঞান’ হয়ে থাকার কাজ করে। কবি শৈলেশ্বর আমার কাছে সত্যপরায়ণ — অচরিতার্থ কবি কালপুরুষ বলেই মনে হয়েছে।
শৈলেশ্বর ঘোষ একহাতে ধারালো অস্ত্রে নিজেরই রক্ত-মাংস দান করেছেন অবলীলায়, একটা আত্মসর্বস্বদান ‘আমি কেবল নিজেকেই ব্যবহার করি।’ তাঁর সরল স্বীকারোক্তি —
‘বনে আজ আর কোন ফুল নাই, আমার শরীরেই তারা আজ ফোটে সেদিনের গতিশীল দুঃখ আজ ভালবাসা হয়ে আসে।’ [কবি শৈলেশ্বর ঘোষকে পড়ার সময় বাংলা সাহিত্যের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা মাথায় এসে যাবেই, সে হলো হাংরি জেনারেশন সাহিত্য আন্দোলন।]
শৈলেশ্বর ঘোষের কবিতা পড়ার পর বুঝতে পারলাম প্রত্যক্ষ বাস্তবতার স্বরূপ … কেটে যেতে থাকল আমার মনের ভেতরের সব ভ্রান্তি, দুর্বলতা, ভীরুতা আর জনপ্রিয় কবি হবার মোহ … আমার ভেতরে এক-ধরনের নৈরাজ্য, অবদমন আর অস্তিত্বহীনতাকে অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান করার সাহস পেলাম, আমার মধ্যে চেতনার সম্প্রসারণ ঘটল। এই চেতনাই আমাকে মৌলিক সত্তার কাছে জীবন মেলে ধরার প্রেরণা যোগায়, জীবনের অন্যসব ভিন্ন রূপ-তাৎপর্য; গাণিতিক পদ্ধতিতে স্রষ্টাকবির কবিতা পাঠে চিন্তার পুনর্জন্ম ও প্রতিবাদী চেতনার অভিব্যক্তি যা ঘটে শৈলেশ্বর ঘোষের কবিতা-আকাশের ‘সপ্তর্ষি’র সাথে কথা বলে। ভালোবাসতে শিখি : সৌন্দর্যরহস্য, নতুন দিগন্ত, অন্য আলো — যে আলো উদ্ভাসিত করে জীবনের অজানা পথগ্রন্থি, স্মৃতির মায়া-আবেগ, চেতনার অন্ধকারাচ্ছন্ন চোরাগলি … ।
আমার প্রিয় কবি শৈলেশ্বর কবিতায় স্পষ্টবাদী — মানুষকে স্পষ্টবাদী হতে সাহস জোগায়; আত্মোপলব্ধির পথপ্রদর্শক হতে প্রেরণা দেয়, জীবনের অজানা রহস্যময় অধ্যায় চিনতে সাহায্য করে। আমার ভালো লাগে তাঁর দ্রোহ, প্রতিবাদী চেতনা, দৃঢ়চেতা মনোভাব, আপোসহীন চরিত্র, মনস্তাত্ত্বিক মনোবীক্ষণ, অন্বেষার আকাঙ্ক্ষা, জাগ্রত চেতনার সম্প্রসারণ, সত্যপরায়ণ জ্ঞান, ধর্মবোধ, দর্শন, ন্যায়নীতি, শাসনপ্রণালি, মানবতা এইসব যুক্তিহীন জগৎ-এর কাছে প্রশ্ন রেখে জীবনকে জাস্টিফাই করে কবিতাকে অন্যভাবে প্রকাশ করতে চেয়েছেন হৃদয়-অভ্যুত্থানের কবি শৈলেশ্বর ঘোষ।
আলোক উদ্ভাস অনুভব :
‘পৃথিবীতে এত আলো অথচ মানুষ কিছুই দেখে না।
একটি ফুল আমি ছিঁড়েছি, তাতেই ভেঙে গেলো পৃথিবী আমার …’
— এ কোন ফুল? এবং ভেঙে গেল কোন পৃথিবীটি? এই ফুল ছেঁড়া কি নিছক এক হত্যাকাণ্ড? নাকি ক্ষমতা প্রতিষ্ঠানের কোলে বসে-থাকা সুবিধাবাদী ব্যক্তিকে খুন করা? কিংবা বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থাকেই সরাসরি আক্রমণ? কিন্তু শুধু আক্রমণ বা ধ্বংসই তো আলোকসন্ধানী এই কবির শেষ কাজ নয়, বরং তিনি শুরু করেন এই পর্বটি থেকে — হত্যাকাণ্ডকে পরিবর্তিত করে দেন সৃষ্টির নতুন সম্ভাবনায় —, আর এখানেই তাঁর মহত্ত্ব।
যখন নতুন সম্ভাবনাকে ধ্বংস করার আয়োজনে মানুষ সোনা ও লোহার দাম এক করে দেয়ার ষড়যন্ত্রে ব্যস্ত তখন নপুংসক ব্যক্তি, সমাজকে ঘৃণা করে প্রতিবাদী কবি শুধু প্রতিবাদ বা আক্রমণেই থেমে থাকেন না, সৃজন করেন এক বিশাল জগৎ … জীবন …, কবিকণ্ঠে গেয়ে ওঠেন —
‘একটি আলোর কণা আত্মাহুতি দিয়ে দেখিয়ে
দিলো আমার অন্ধকারের ছবি —’
আলোর কণাটি ধ্বংস হলো ঠিকই — কিন্তু সে আলোকিত করে তোলে অন্ধকারের বিপন্নতাকে। কবির অন্তর্জগৎকে। কবির অন্তর্জগৎ আলোকিত হয় বলেই সে আলোকিত করে তাঁর চারপাশ-পরিবেশ। এ এক তুলনাহীন কবিতাভাষা। তাঁর আলোয় আমি আমার অন্ধকার জীবনকে দেখি, তাই আমার এত প্রিয় কবি শৈলেশ্বর ঘোষ।
সামাজিক মানুষের দ্বৈত রূপটি খুব নিবিড়ভাবে উদ্ঘাটন করেছেন কবি শৈলেশ্বর ঘোষ। তাঁর নিজস্ব ভাষাটিকেই ধরে রেখে —
১. ‘সনাক্তকরণের পর সকলেই ছাড়া পেয়ে যায়, খুনিটি তবে কে?’
২. ‘মানুষের দুই হাত ভাল করে জানে, কীভাবে ভেঙে দেয়া হয় সরল পাখির ডানা —’
৩. ‘নিজের খাবারটুকু তুলে নিয়ে অন্যের খাবার নষ্ট করা, মাছির দ্বৈতজ্ঞান আমরা পেয়েছি;
৪. ‘প্রত্যেকে আমরা যে আগ্নেয়াস্ত্র পেয়েছি ইতিহাস তাকেই হৃদয় বলে।’
৫. ‘একজনের মৃত্যু আরেকজনের স্বাধীনতা বাড়িয়ে দেয়।’
৬. ‘ঈশ্বরের কথা ভাবতে গিয়ে অনেকদিন আমি যৌন আবেগ হারিয়ে ফেলেছি।’
৭. ‘ভালোবাসাহীন সূর্য কি একদিন এই পৃথিবীকে ধরে রাখবে আর!’
কে খুনি? সাধুই বা কে? অপরাধী কে? কে অবতার?
এই অমোঘ প্রশ্নগুলির দ্বান্দ্বিক মীমাংসা শৈলেশ্বর ঘোষের কবিতায়, অনেকটা দার্শনিক ভঙ্গিতে উচ্চারিত। এই সমস্ত দ্বিপ্রান্তিক বিশ্লেষণমূলক বিশ্লেষণগুলি বাস্তবে একই হাতের দুই তল মাত্র। এইসব আবিষ্কার অসাধারণ, কবিতায় শৈলেশ্বরের সম্পূর্ণ নিজস্ব। স্বতন্ত্র ভাষা। এসব কারণেই শৈলেশ্বর ঘোষের কবিতাও ‘প্রতিবাদী সাহিত্য’। শৈলেশ্বর ঘোষ সেই স্রষ্টাকবি, যিনি বাংলা কবিতার গতিপথকে সম্পূর্ণ পালটে দিয়েছেন। বাংলা সাহিত্যের যাবতীয় উত্তরাধিকারকে অস্বীকার করে তিনি জন্ম দিয়েছেন সম্পূর্ণ নতুন এক কবিতাভাষার। প্রকৃত প্রতিবাদীর মতোই অরণ্যের গভীর থেকে গভীরতর জগতে তাঁর চলাচল। তাই কবিকণ্ঠে জেগে ওঠে — ‘মানুষের অরণ্যে মুকাভিনয়ের কণ্ঠস্বর যে শুনতে পায় সেই হয় জ্ঞানী…।’
প্রিয় কবি শৈলেশ্বর ঘোষ ‘অবিচলিত থেকেই কেবলি ভেবে যান জীবনের বিন্যাস, নিজের জীবনযাপনকে সমস্ত অর্থেই মিলিয়ে দিতে চান তাঁর কবিতার সাথে।’ তাই শৈলেশ্বর ঘোষ আমার কাছে এক অনন্য ব্যতিক্রমী ক্ষতিকর কবি, যা আমার সমস্ত মোহকে গ্রাস করেছে এবং আমি নিজেকে ফিরে পেয়েছি। ‘দশ পয়সার ম্যাজিক’ বা ‘ঘোড়ার সঙ্গে ভৌতিক কথাবার্তা’য় যেভাবে কবিতার একটা আত্মদিগন্ত ধরতে পেরেছিলেন প্রিয় কবি; শব্দের দ্বারা অতিলাঞ্ছিত হবার ভয় তার ছিল না। নিজের ভেতর থেকে খুঁজে নেবার নিমগ্ন সাধনা, অধ্যবসায় আমার উপলব্ধিতে উঠে আসে তাঁর ‘সন্ন্যাস’ কবিতার এই টুকরো আভাস —
‘এসো সন্ন্যাসী, তোমার
সাধনা — গোপন ভয়ের কথা চিৎকার করে জানিয়ে দাও,
গৃহ অভিমুখে এই যাত্রা মৃত্যুর প্রস্তুতি নিয়ে বেঁচে থাকা
কান্নাশব্দ জীবরোল একবার মিথ্যা মনে করো, দেখবে
শরীরের স্বভাব দরজা — কী বিষণ্নতা ঘিরে রাখে আমাদের!
বলো স্বদেশ অভিমুখে যাবার আগে পরস্পরের মুখের
দিকে তাকিয়ে দুঃখ হবে না আর! বলো।’
সত্যের উপর নির্ভর করে আছে যে জীবন, তাকে বিচিত্র অভিজ্ঞতার সংঘর্ষে দেখাই কবিতার সত্য। এই সত্যের সামনে কবির ‘আমি’ আর তাঁর বাইরের সমাজ-মানুষের সাথে প্রতিদিন মুখোমুখি হই; প্রতিদিন সংঘর্ষ, আর সেই সংঘর্ষের থেকে প্রতিদিনই আরেকটি তৃতীয় সত্তার উদ্ভাস দেখা দেয় আমার মনে।
শৈলেশ্বর ঘোষের বিচ্ছিন্নতাবোধ থেকে আমার মধ্যে চেতনার নতুন অনুভব দেখা দেয়। উপেক্ষা, আক্রমণ ও বিচ্ছিন্নতা — এসব দেখে আমার আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায় — মানুষের অবহেলা দেখে আর নিজের কষ্ট লাগে না।
‘কাগজে খুনির যে ছবিটি বেরিয়েছে, আমাদের প্রত্যেকের সঙ্গে তার মিল আছে’
শৈলেশ্বর ঘোষের কবিতার মধ্যে মানুষের উদ্বেগ ও অসহায়তার রূপ এবং এসবের উত্তর আমি খুঁজে পাই। আমার সময় ও জীবনকে নতুন তাৎপর্যের মধ্যে আবেগ, যন্ত্রণা, উদ্বেগ, অসহায়তা, ক্রোধ ও বিদ্রোহ দেখা দেয় এবং অবদমনকে ধ্বংস করে।
শৈলেশ্বর ঘোষের প্রথম এবং শেষ পরিচয় তিনি কবি। যদিও তাঁর কাব্যভাবনায় সবসময় দেখা যায় সমকাল এবং প্রতিবাদী চরিত্রকে। তাঁর অবস্থান জলস্রোতের অনুকূলে নয়। এ কারণেই ‘মূলধারা’ শব্দটি তাঁর কাছে গ্রহণীয় হয়নি। তিনি অসম্ভব কবিপ্রতিভার পরিচয় দিলেও আজও সত্যিকার অর্থে আলোচিত নন বরং রাষ্ট্রক্ষমতার অনুমোদিত ভাষায় কবিতা লিখেননি বলে কবিতা লেখার ‘অপরাধে’ তাঁকে অপরাধী করা হয়। তাঁর একমাত্র পরিচয় — তিনি গেরিলা কবি।
‘সমস্ত ঘোড়ার আড়ালেই আমার পাখিবিষয়ক গদ্য
তার ভিতর আমার আমার দিবারাত্রি আবহমানকালের কবিতা …’
কোনো ভূমিকা না করেই বলা ভালো যে, এমনভাবেই আমার কাছে কবিতায় রহস্যময় শৈলেশ্বর ঘোষ কিংবা শৈলেশ্বরের ঘোড়া। ঘোড়ার ভাবলেশহীন মুখাবয়বের মধ্যে একসময় হারিয়ে যায় ওর গতিশীলতা আবার স্তব্ধতায় ফুটে ওঠে রঙধনুর হঠাৎ-রাঙিয়ে-দেয়া মুখ। শুধু বলব, যে-আন্দোলনের বিষয় ক্ষুধা, মলাটহীন দুঃখ-দারিদ্র্য, কবিতায় অপ্রতিরোধ্য জীবনযাপন, হৃদয়যাপন, সেই ‘ক্ষুধিতপ্রজন্ম ষড়যন্ত্র মামলার’ প্রথম আসামী কবি শৈলেশ্বর ঘোষ। ২ সেপ্টেম্বর ১৯৬৪ সালে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও কবিতায় অশ্লীলতার অভিযোগে গ্রেফতার হন তিনি।
শৈলেশ্বর ঘোষের কবিতায় মানুষের অস্তিত্বের সংকট, দ্বিধাদ্বন্দ্বের রূপকে মিথ্যা করে কবিতায় উদ্ভাসিত হয় এক অনঘ শব্দ ‘জীবন’ ও ‘ভালোবাসা’। এই ভালোবাসাই এই বিধ্বস্ত, কুৎসিত, বীভৎস, মুখোশাবৃত পৃথিবীর বুকে ছুঁড়ে দিতে চায় প্রতিরোধ — শৈলেশ্বর ঘোষের এমন এক বিশ্বাস অবয়ব-রূপ পায় — ‘পরিবহনযোগ্য রাস্তা বহুদূর শূন্য পড়ে থাকে।’
শৈলেশ্বর ঘোষের কবিতা পড়লে আমার মনে হয় — আমি একটা বটবৃক্ষের নিচে এসে দাঁড়িয়েছি, সূর্যের আলোয় আমার প্রতিচ্ছায়া তীর্যকভাবে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, আমার ছায়াশরীর আবেদন করছে পরিচিত বস্তুজগৎ থেকে অন্য স্বপ্নকল্পনার অবচেতনরাজ্যের প্রাপ্তি-আকাঙ্ক্ষা; এ এক দুর্লভ ও অপ্রাপণীয় অভিজ্ঞতা — ‘অন্য এক জগতে কেঁপে উঠছে লোকসূর্য, কীটমুক্ত হৃদয় আমাদের মৃত্যুর কাছাকাছি আছে আনন্দ, বিধর্মী হয়ে এবার ফিরে যাব।’
কবি ক্রান্তদর্শী। কবি অভিজ্ঞতার শেষ সীমানায় এসে দাঁড়াতে চায় … মানুষের ষড়যন্ত্রময় মুখাবয়ব দেখতে চায়; তাই সে সভ্যতার কাছে অপরাধী। কবি বিদ্রোহী — পূজার আবেগ নিয়ে সে আক্রমণকারী … তার হারাবার কিছু নেই মৃত্যুর সময়ে …। ‘সাফল্য’ও কবির কাছে কাম্য নয়। কবির কাজ — নৈরাজ্য থেকে পলায়ন নয়। নৈরাজ্যকে ভালোবেসে অবক্ষয়কে জয় করে জীবন ও সত্যকে সুশৃঙ্খলভাবে বহন করে অন্তর্জগৎ, বহির্জগৎ প্রকৃতির সাথে সাদৃশ্যময় করে সময় ও ভাষাকে নতুন করে মানুষের মনে আলোড়ন সৃষ্টি করার অভিপ্রায় জাগানো। সুখ-দুঃখের পার্থক্য থেকে সময়কে চিহ্নিত করে কবি এসে দাঁড়াবেন গাছের ছায়ায় … রোদ, বৃষ্টি আর পাখির গান শুনে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র থেকে দূরে সরে যাবেন না। মৃতপ্রায় ভাষাকে জল দিয়ে মৃত গাছে ফুল ফোটাবেন। কোনো কৃত্রিমতাই জীবনকে দেখতে সাহায্য করে না। অভিজ্ঞতাই জীবনের চলমান সিঁড়ি এবং কবিতার হৃদয়যাপন-বসতবাড়ি। প্রচলিত বিশ্বাস, শিক্ষা, রাজনীতি, মানবিক জটিল সম্পর্ক, সকল কুসংস্কার ভেঙে নিজের সত্যরূপ প্রকাশ করা প্রকৃত কবির অহমিকা…।
পৃথিবীর সকল কবিই আমার মতো অন্ধকার এবং আলোকে ভালোবেসে প্রকৃতির সাথে সাদৃশ্য বহন করে যায় এবং যাবে।
‘চেতনা দিয়েই অপসভ্যতার বিরুদ্ধে কবির লড়াই এবং এ লড়াইয়ে সে সরাসরি জিততে পারবে না তা সে জানে, পরোক্ষ জয়ের অস্পষ্ট একটা ধারণা তাকে চালিত করে। তার ভাষা প্রয়োগ পদ্ধতি হয় গেরিলাদের মত আকস্মিক, অপত্যাশিত এবং অভ্রান্ত।’ [কবির বিশ্বরূপ : শৈলেশ্বর ঘোষ]
আমার ‘অগ্নি’ আজ জয়শ্রীর নদী … অগ্নির তাপে বরফ গলে জল হয়ে নদীতে মেশে… নদীপাড়ের আমারই অন্ধকার গাছে সে ফুল হয়ে ফোটে। ‘বনলতা সেন’ এখন আমারই গ্রামে বাস করে। পরিচিত জগৎ ইন্দ্রিয়জাত অভিজ্ঞতা অবলম্বন করেই কবি চলে যান ‘অন্য এক আকাশে, অন্য এক পৃথিবীতে।’
কবি প্রশ্ন করেন ‘হৃদয়হীনতাই ধর্ম যদি আমাদের, তবে ফুল কেন আবার প্রস্ফুটিত হয়?’
সাধারণ মানুষ চাঁদকে ‘জড় পদার্থ’ ভেবে আবেগে আপ্লুত হয় না, কিন্তু একজন কবি চাঁদকে দেখে ‘জীবনের উলঙ্গ উত্তালতায় নিজেই জীবনাহত’ হয়ে আবেগে-উন্মাদনায় স্পর্শ করতে চায় জীবনকে। এখানে একজন কবির সাথে সাধারণ মানুষের পার্থক্য বোঝা যায়।
‘ধর্মহীন হয়ে আমিও বুঝেছি স্বাধীনতা’ — ধর্মহীন হওয়া মানে নিজেকে সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করা; ভয় ছিল বলেই কবি আজ পরাধীন … মানুষের যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায় তখন সে রুখে দাঁড়ায় … প্রতিবাদ করে নিজের শূন্যতার বিরুদ্ধে, শুরু করে সংগ্রাম — সত্য অন্বেষণ : মাটির কাছে এসে বুঝে সে মাটির ওপরেই দাঁড়িয়ে আছে এবং দাঁড়িয়ে থাকবে কবি একা; নিঃসঙ্গ। নিঃসঙ্গতাকে জয় করা মানে আরো নিঃসঙ্গতা বহন করে যাওয়া … তবেই কবির সার্থকতা।
প্রত্যেক কবি নিজের যুক্তির বাইরে খোঁজে নতুন সময়ের অচেনা প্রতিধ্বনি। কবি প্রতিষ্ঠিত কাঠামোর জন্য আক্রমণাত্মক — তাই কবি বিপজ্জনক : আর এই কারণে সময়ের অন্বেষা অনিবার্যভাবেই জটিল রূপ হয়ে ওঠে কবির কাছে।
কবিরা ‘অন্ধকারের সাধক।’ সমাজের তো কোনো স্থায়ী সত্তা নেই। সে সর্বদা পরিবর্তনশীল, কবির নিজের যে অভিজ্ঞতা, তা তৈরি হয় জীবনের সাথে তার সম্পর্ক থেকেই, তা তিনি প্রকাশ করেন কবিতায় … এটা একজন কবির দায়বদ্ধতা। একজন অন্ধের কাছে এই দৃশ্যমান বস্তুসর্বস্ব পৃথিবী প্রকৃত অর্থে সত্যিই রহস্যময় … অন্ধের অন্তর্দৃষ্টিতে জেগে ওঠে অন্ধকার জীবনের সকল রহস্য, পৃথিবীর যে-কোনো সত্যদ্রষ্টা কবির ক্ষেত্রে একথা সত্য! ‘অন্ধ যারা সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা।’
কবিতা লেখা শেষ হলে কবির সত্যিকারের অস্তিত্বটাই ধরা পড়ে। সেটা হোক সুখের বা দুঃখের। জীবনকে উপলব্ধি করার কিছু মৌলিক উপাদান আছে। যেমন : আমাদের অন্ধকার জীবনে স্বর্গোদ্যানের নিষিদ্ধ ফল ছুঁয়ে দেখা … প্রত্যেক কবির জীবনেই আসে নানা বাঁক। এক-একটা বাঁক মানেই এক-একটা জীবন। ‘প্রতিটি বাঁক থেকেই চেনা যায় সরলরেখা।’ ছায়াপথ। এই ছায়া প্রকৃত প্রস্তাবে মহাকাল … জীবনের নানা ছায়াপথ দেখতে দেখতে কবি শেষে পৌঁছে যায় এক অখণ্ড জীবনসত্যে।
‘কবির ধর্ম — আমি মনে করি আত্মবিস্ফোরণ, আত্মাআবিষ্কার ও আত্মউন্মোচন। অস্তিত্বের সামগ্রিক বিশৃঙ্খলাকে সত্য সৌন্দর্যে সাযুজ্য দান করে কবি নিজেই এক ধর্ম। … আর অসত্যে জারিত জীবনকে আক্রমণ করে তবেই তাকে পৌঁছতে হয় সত্য-ধর্মে।’ — শৈলেশ্বর ঘোষ।
‘প্রকাশ্য দিবালোকে মৃত্যুকেই আজ প্রধান উৎসব মনে হয়।’ এই তো আমাদের অভিজ্ঞতার জগৎ। এই জগতের আবরণ উন্মোচন করে আমাদের দেখিয়ে দেবার জন্যে একজন কবির দরকার হয়। ‘কোনো সৎ কবিরই বাণী নেই, আছে তাৎপর্যময় অভিজ্ঞতা’ — এই অভিজ্ঞতার চরম সত্যের উলঙ্গ প্রকাশের প্রয়োজনেই কবির কবিতা লেখা।
নদীর জলে যখন ঢেউ ওঠে, তখনই নদী পেয়ে যায় এক অলৌকিক শক্তি … কবিও রহস্যময়তার পথে নিজের জীবনের বাস্তবতাকে খুঁজে দেখতে চায়। সময়ের লুকানো অস্তিত্বকে কবিতায় না-ধরলে আধুনিকতার অবক্ষয় ধরা সম্ভবই নয়। যে-কবি সময়ের লুকানো সত্তাকে ধরতে না পারেন, সেই কবি সময়ের প্রয়োজনে হারিয়ে যান।
একজন প্রকৃত কবি জীবনের বাইরে কী কী ঘটছে তাকে দেখার দৃষ্টি অর্জন করেন চারপাশ সম্পর্কে পূর্ণতর সচেতন হয়েই; কবিতায় আনতে চান জীবন-চিত্রকল্পের উপলব্ধির স্পন্দন : ব্যবহার করতে চান মানুষের গভীর অনুভূতির সূক্ষ্ম অনুরণনের অস্তিত্বের সংকটকে। কবিতার উঠোনে আজ উৎসবের আয়োজন : ‘আসুন ভালোমানুষেরা আপনাদের প্রেম-প্রীতি-দয়া ও ত্যাগের মুখগুলি নিয়ে উপভোগ করুন এই নৈসর্গিক ঘটনা।’ কবির কাজ শব্দের মূলশক্তিকে পুনরুদ্ধার করা। কেননা, ‘পরিশুদ্ধ শব্দই শুদ্ধ চেতনাকে ধরে রাখে।’ যে শব্দ এতদিন চৈতন্যহীন অসত্যের দাসত্ব করে এসেছে, সেই সত্যকে বহন করতে গেলে কবিকে ঝুঁকি নিতে হয়।
‘যারা আজ কবিতা লেখেন তারা সকলেই কি মনোরঞ্জক হতে অস্বীকার করছে, না — দু’চারজন মাত্র। পিছনে মুখ ফিরিয়ে একবার রবীন্দ্রনাথের দিকে তাকানো যাক্। রবীন্দ্রনাথের রচনার মধ্যে এমন কিছু রচনা আছে যাকে বলা যাবে তখনকার ইতিহাস ও সমাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, খুবই স্পষ্ট ভাষায় এই প্রতিবাদ উচ্চারণ করেছিলেন — এমনকি জগতের ন্যায় ও সত্য সম্পর্কেও তাঁর গভীর সংশয় দেখা দিয়েছিল, যদিও তাঁর রচনার বড় একটি অংশ উপনিষদের সেই সংক্রামক অস্তিবাদে আক্রান্ত — মনে হয় জীবনের শেষদিকে এসে জগৎকে আর উপনিষদের দৃষ্টিতে না দেখে নিজের দৃষ্টিতে দেখতে চেয়েছিলেন, যে-কোনো প্রকৃত কবির কাজ তাই — তাই দেখা দিলো সংশয় ও প্রতিবাদ — তবে রবীন্দ্রনাথ যেখানে প্রতিবাদী, সেখানে দুর্বল তার রচনা, জীবনের কোনো মূল বিন্দু পর্যন্ত সেই প্রতিবাদ পৌঁছাতে পারে না। কিন্তু মনে হয় অন্যভাবে কিছু গুরুত্ব আছে এই প্রতিবাদের, বাংলা ভাষায় লেখা সাহিত্যে অন্তত — গুরুত্ব এই জন্য যে সচেতনভাবে প্রতিবাদের সাহিত্যের সূত্রপাত এখান থেকেই এবং আমরা ভুলতে পারি না যে রবীন্দ্রনাথ এইসব লেখা লিখেছিলেন জীবনের শেষদিকে। কিন্তু প্রায় ঐ সময়েই যিনি সমগ্র রচনাকে প্রতিবাদী করে তুলেছিলেন তিনি জীবনানন্দ। তিনি লিখেছিলেন, ‘মরণের পরপারে বড় অন্ধকার এই আলো প্রেম ও নির্জনতার মতো’ — এখানকার প্রেম, প্রগতি, আলো, ইতিহাস, কর্মপ্রচেষ্টা, শান্তিস্থাপন, মিলন, ভালোবাসাবাসি সবকিছুই তার কাছে এক অতি জটিল অন্ধকার বলে প্রতিভাত হয়েছিল, সমস্ত সৃষ্টিব্যাপী চিৎকারকে মনে হয়েছিল শত শত শূকরীর প্রসববেদনার আড়ম্বর। সেই সমস্ত কবিতা আর আলাদা করে চেনা যায় না, বিষয় হিসাবে রাজনীতি বা অপ্রেম বা বেশ্যাবৃত্তির কালো অঙ্গার বা শোষণের নিকষ বিষ — সবই এ অস্তিত্বে মিলে একাকার জটিলতা লাভ করে সৃষ্টি হয়েছে দীর্ঘতম শব্দস্রোত-এ — সে এক মূল সত্যকে বহন করে নিয়ে আসছে আমাদের হৃদয়ে মস্তিস্কে — যেখান থেকে আরেক, আরও এক হৃদয়ে মস্তিস্কে — এক প্রতিবাদ জাগিয়ে তুলতে চাইছে আরও আরও হৃদয়ের মধ্যে, বাংলা কবিতার যদি কোনো সত্যধারা আজ গোপনেও বহমান থাকে তবে তা সুনিশ্চিতভাবেই প্রতিবাদের — এই সমাজে, এই বিকারে, এই জীবনে কবিতার অন্য কোনো রূপ সম্ভব বলে মনে করি না। প্রকৃত অর্থে প্রতিবাদীর সংখ্যা এখনও পর্যন্ত খুবই নগণ্য। এখনও পর্যন্ত ব্লকহেডেডরা যা যা লিখে চলেছে, যাদের বলা হয় প্রোলিফিক রাইটার — রোবোট পাঠককুল গোগ্রাসে তাই গিলে চলেছে।’ [প্রতিবাদের সাহিত্য : শৈলেশ্বর ঘোষ]
ভবিষ্যৎ মানেই অজানা। ভবিষ্যতের কথা ভেবে কবিতা লেখা আমার কাছে অন্ধকার প্রতিযোগিতা … কবি তো সময়েরই সৃষ্ট সন্তান — মনোজাগতিক সময়ের। কবি তার আবেগটা মানুষকে জানাতে চায় আত্মোপলব্ধির পথপ্রদর্শক রূপে … এখানে সাফল্য বা ব্যর্থতার কিছুই নেই। কবি যখন ক্ষমতার মোহ, লোভ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়, তখনই সে তার প্রার্থিত স্বাধীনতা পায় আর তার সংবেদনার দরজাগুলি খুলে যেতে থাকে; জীবনের সত্য তখন সে দেখতে পায়। কবির উপস্থিতি কবিতায় প্রধানত বিমূর্ত …, বাস্তব বা বস্তুনিরপেক্ষ উপস্থিতি খুবই কম। তাঁর ব্যক্তিত্ব আর মনন-কর্মশক্তির রূপ কবিতায় ফুটে ওঠে। ঝর্ণার জল পর্বত থেকে গড়িয়ে পড়ে প্রথমে নতুন জলধারায় মেশে তারপর রূপ-প্রকৃতি ও গতি পরিবর্তন করে সমুদ্রের দিকে অগ্রসর হয়। প্রত্যেক মানুষের ব্যক্তিত্বের একটা মৌলিক দিক থাকে। একজন কবি নিজের সৃষ্টিকর্মের ক্ষেত্রেও তার ব্যক্তিত্বের মৌলিক দিকটিই অনুসরণ করবে, এটা তার পক্ষে প্রকাশ করা সহজ। মৌলিক সূত্রটি হারিয়ে গেলে সৃষ্টিও হারিয়ে যায়। যেকোনো সৃষ্টির ক্ষেত্রে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
‘আমরা, মানুষেরা যতক্ষণ হৃদয় খুলে দেখাতে পারব না, ততক্ষণ আমাদের মুক্তির কোনো সম্ভাবনা নেই।’ কে দেখাতে পারে হৃদয় খুলে! একমাত্র পারেন কবি, কারণ ‘জীবনের ষড়যন্ত্রময় বস্তুসমূহের মারাত্মক অবস্থানকে যে মেনে নিতে অস্বীকার করে ও বেঁকে বসে সে-ই কবি। ’ ক্ষমতা থেকেই যায়, কেবল তার নিয়ন্ত্রক আর রূপটি বদলায় মাত্র। কবির কাজ সময় ও জীবনকে জাস্টিফাইড করা। এখানে অন্য কোনো মোটিভ কাজ করতে পারে না। সর্বোপরি কবিও মানুষ।
শৈলেশ্বর ঘোষের কাব্যগ্রন্থসমূহের নামকরণ সমষ্টিচেতনার সাক্ষ্য প্রমাণ করে :
‘জন্ম নিয়ন্ত্রণ’ (১৯৬৭) — জনস্ফীতির এক তীব্র অবদমন।
‘অপরাধীদের প্রতি’ (১৯৭৪) — বহুজনতা ও অবদমনের অনুষঙ্গ।
‘দরজাখোলা নদী’ (১৯৮০) — অবদমনের উন্মোচন। প্রবল বেগ-সত্তার প্রকাশ।
‘পূর্ণগ্রাস’ (১৯৮৫) — সম্পূর্ণতা। খণ্ডগ্রাস নয়।
‘উৎসব’ (১৯৮৮) — সম্মেলন।
‘এই আমাদের বীজক্ষেত্র’ (১৯৯৩) — অস্তিত্বভাবনা।
‘এত আলো আসে’ (২০০৩) — চেতনার সামগ্রিক রূপ … ।
এই সমষ্টিচেতনা একজন কবির সৃষ্টির ক্ষেত্রে থাকলে কবিতার মৌলিকতার বিষয়টি ভাবতে ভালো লাগে। ‘যতই জ্ঞানের কাছে যাই, স্পষ্ট হয়ে ওঠে নিজেরই নগ্নতা।’ কবিদের আত্মগত ভাবোচ্ছ্বাস অতিক্রম করা প্রয়োজন — নতুবা কবিতা সার্বজনীন রূপ লাভ করে না। কবিরা এ ব্যাপারে খুবই উদাসীন … ।
কবিতার বোধ ‘জ্ঞানের ভেতরে জ্ঞান’ হয়ে থাকার কাজ করে। কবিতার ‘মৌলিক’ ব্লুপ্রিন্ট আমার কাছে নেই জেনেই দাঁড়িয়ে আছি উদাসীনভাবে — কবির ভবিষ্যৎচিন্তা সাধারণ মানুষের মতো নয় — একজন প্রকৃত কবির আছে সেই চোখ, যা ‘বেশি ও গোপন কিছু দেখেছিল’। কবিকণ্ঠে জেগে ওঠে, ‘তোমরা ধনী বলিয়া আমাদের দেখতে পাও না কিন্তু গরিব বলিয়া আমরা সবসময়েই তোমাদের দেখি।’ ভালোবাসাহীন হলেই বুঝতে পারি, ভালোবাসা প্রয়োজন। এই চেতনা দিয়েই কবি জীবনকে নতুন করে পুনর্গঠন করে। সৃষ্টি করে আরেক জীবন, যার নাম নিত্যানন্দ … জীবনই কবির কাছে চূড়ান্ত ঘটনা, মৃত্যু কবির কাছে হয়ে ওঠে এক অনাবশ্যক অধ্যায়। কবি কবিতায় প্রত্যক্ষ করতে চায় মনোজগতের সেই সৌন্দর্যকে, যা তাদের এই একজন্মের ক্লেদ ও গ্লানি থেকে এক মুহূর্তের জন্যে হলেও মুক্তি দেবে, তারপরেই মৃত্যু! কবির ধ্রুব সত্তা হারিয়ে গেলেই সে চলে যায় নদী ও নক্ষত্রের কাছে …।
‘প্রত্যেক যুগেই সভ্যতা একটা closed circle করে নেয়, নিজের চারিদিকে, সে যত উন্নত সভ্যতাই হোক না কেন… নিজের একটা রূপ ও রূপক তার চাই যা দিয়ে সে সম্মোহিত করে রাখবে সকলকে… একমাত্র কবিরাই দ্রষ্টা বলে বহু আগে থেকেই তার বিরুদ্ধে বলতে থাকে … রূপকের আড়ালে লুকানো থাবাটাকে প্রকাশ করে দেয়। এজন্য সভ্যতা কবিদের, মানে সত্যদ্রষ্টা যারা তাদের, দেখতে পারে না …’ [কবির বিশ্বরূপ : শৈলেশ্বর ঘোষ]
একজন কবিই সঠিকভাবে তার সময়কে বুঝে উঠতে পারেন, মনের ভেতর ও বাইরের যে দিকগুলো অন্ধকারাচ্ছন্ন … সেগুলো চোখ দিয়ে মানুষ দেখতে পায় না, কবি তা দেখেন … ‘যে অন্যকে স্বাধীনতা দিতে চায়, সেই প্রকৃত সন্দেহভাজন, ক্ষমতাবান চিরকালই ভয় পায় স্বাধীন আত্মা।’ এই স্বাধীন আত্মাই ধারণ করেন একজন প্রকৃত কবি। সে শুধু ভাবেই না সে মানুষকে মনের স্বাধীনতা দান করে কবিতা রূপে … আমাদের অস্থিরতা উদ্বেগ এবং অনিশ্চয়তার উত্তর দেবার মতো জগৎ শুধু সাহিত্যেই আছে। আমরা এই জগৎ-বর্তমানেই বসবাস করি।
যিনি প্রকৃত কবি তিনি রাষ্ট্রের নির্দেশিত ভাষায় না লিখে পরাজিত হয়েও প্রমিথিউসের মতো মানুষের হাতে তুলে দেন ‘আগুন ভাষা’ — যা দিয়ে লেখা হয় প্রকৃত কবিতা। কবির মনোরজ্যে যে নৈরাজ্য ও অবক্ষয় বাসা বাঁধে সেই নৈরাজ্যকে অবক্ষয়ময় ভাষায় তুলে ধরেন ও অবদমনকে স্পষ্ট করে দেন — ‘সব কান্নাই তো আর দুঃখের জন্য নয়, সব সহবাস সন্তান জন্ম দেবার জন্যও নয়।’ মানুষ — অযৌন সত্তা নয়। ‘যৌনতার নন্দনতত্ত্ব’ থেকে কবি দূরে সরে যেতে পারে না। কবি সরে গেলে কবিতায় শ্রেণীবৈষম্য ধরা পড়ে তাৎপর্যময় সময়ে … ।
‘সৎ চেতনার’ জয় আজও হয়নি। আমাদের জীবন-পরিবেশ আজ আরও তিক্ত-রক্তাক্ত। তবু স্বাধীনতার দিকে, মুক্তির দিকে, মানুষের চলা থেমে যায়নি। বরং তাতে আরও কিছু নতুন অনুসন্ধানমূলক যাত্রা শুরু হয়েছে। অস্তিত্বের অন্ধকার অংশের মানচিত্রটা জানাও খুব জরুরি হয়ে পড়েছে এখন। কবি জীননানন্দের যাত্রাও শুরু হয়েছিল এই পথেই।
. ‘ব্যর্থ র্যাবো তোমার যাদুকবিতা
. ব্যর্থ জীবনানন্দ তোমার যৌনমরণ
. ব্যর্থ ফ্রয়েড তোমার কাম তামাশায়
. ব্যর্থ মার্ক্স তোমার ক্ষুধা প্রশমন
. ব্যর্থ গান্ধী তোমার শরীরের লোল নিপীড়ন
. ব্যর্থ হয়ে গেল আমাদের মৃত্যু স্বীকার’
. [উদ্ধারহীন শব্দপ্রপাত : শৈলেশ্বর ঘোষ]
উপরোক্ত কবিতার লাইনগুলি ল্যান্ডমাইনের মতো মাটিতে পুতে রাখা যাক, হাঁটতে গিয়ে পরস্পরের মুখের দিকে তাকাবো আমরা!
মানুষ প্রথম যেদিন আগুন আবিষ্কার করল সেদিন থেকেই যাত্রা শুরু হলো মানবসভ্যতার। অথচ আজ সভ্য মানুষ আগুনকেই নঞর্থক মনে করে; আগুনের যে শুদ্ধ-সুন্দর রূপ আছে তা অস্বীকার করে। কিন্তু আমার প্রিয় কবি নিজের হাতে নিজের কবিতা-উদ্যানে যখন আগুন লাগিয়ে দিল, আগুন তখন অন্য মাত্রা পেয়ে যায়। সংবেদনশীল কবি-আত্মা সে আগুনে পুড়ে শুদ্ধ হয়ে শূন্য আকাশের দিকে চেয়ে ‘সপ্তর্ষী’র কাছে বলে এক অন্তর্গত আগুনের নাম : শৈলেশ্বর ঘোষ।
শৈলেশ্বর ঘোষ : জন্ম ৩১ ডিসেম্বর ১৯৩৮, রাজাপুর, বগুড়া, বাংলাদেশ; মৃত্যু ১৮ অক্টোবর ২০১২, বালুরঘাট, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।