পিয়াস ওঝা স্মারক আয়োজন
প্রকাশিত হয়েছে : ১৫ জানুয়ারি ২০১৫, ২:৩৩ পূর্বাহ্ণ, | ৩১৭৫ বার পঠিত
আরও একজন কবির প্রস্থান। অকালপ্রয়াত শব্দটি দিয়ে এই মৃত্যুক্ষতি বর্ণনা করা যাবে না। বাংলা কবিতার আরও এক তন্নিষ্ঠ কবি ফিরিয়ে নিলেন মুখ সৌরসংসারের উল্টোদিকে। এখনই ছিল না যাবার সময়, এখনও অনেক চরিতার্থতা বাকি ছিল তাঁর, এখনই নিরালোকে দিব্যরথ ছোটানোর কথা ছিল না। অগত্যা, জানাই বিদায়, জানাই সশ্রদ্ধ স্বাগতম!
পিয়াস ওঝা। জন্ম ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে, নেত্রকোনায়, সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ থেকে চিকিৎসাবিদ্যায় অধ্যয়ন শেষে পেশাগতভাবে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কবিতা লিখেছেন খুবই নিভৃত সুরভিমাখা ধ্যানভঙ্গিমায়। ‘উজানগাঁ’ ‘অর্কিড’ ‘কহন’ ‘লিরিক’ প্রভৃতি পত্রিকায় লিখেছেন। বই করেছেন, কবিতার, ২০০৬ সালে। ‘নুড়িপাথরের জন্মান্তর’ কবির প্রথম, সম্ভবত একমাত্র, কবিতাবই। সেই বই থেকে কয়েকটি কবিতা ‘রাশপ্রিন্ট’ পুনঃপ্রকাশ করছে এখানে। — সঞ্চালক, রাশপ্রিন্ট।
নুড়িপাথরের জন্মান্তর থেকে কয়েকটি কবিতা
মিথ
ভাঙা বাড়ি। কাঁটাঝোপ।
নারিকেল ছায়ায় মিশেছে দ্বিপ্রহর।
ছোট ছোট সরীসৃপ।
সরু খাল। অসমাপ্ত সাঁকো।
বুড়ো কদমের গাছ।
ডালপালা মেলবার ইচ্ছে দেয়ালে দেয়ালে…
রান্নাঘর বেয়ে কাঁটালতা পৌঁছায় অসীম গ্রন্থসরোবরে।
জ্বলন্ত গল্পের শেষে এক মুঠো ভাত, এক মুঠো ছাই।
ভাঙা বাড়ি। কাঁটাঝোপ। পোকামাকড়ের সহবাস।
সংসার বাড়ন্ত ঘাসে
পুরনোকে এতদিন কেউ ভালোবাসে?
উঠোনে হলুদ দাগ
ভাতের থালায় গোলাকার ভোর;
কেন্দ্রে বসা প্রজাপতি, ঠোঁটে অলসতা
ছেদবিন্দুতে তুমি দাঁড়ালে ভাবি—
বৃত্তচাপ কেটে বানানো যাবে অন্নের উপাদান
কেননা, বৃত্তই তোমার সুখাদ্য
টলমলে ভোর কোনোদিন আমাদের
. মেধায় প্লাবিত হলে
উঠোনে হলুদ দাগ ফেলে
প্রজাপতি ওড়ে আহত স্মৃতির কোষে কোষে…
কোমরের মাটি
আমাকে ঝিঁঝিঁর ডাক থেকে বেরিয়ে আসার পথ দেখিয়েছো তুমি। রাতির
পিছনপথে সাড়ে তিন মাইল আমার পলায়ন;
সাড়ে তিন মাইল বলতে—দু’পাশে হোগলাঝোপ, শিশির ওড়ার শব্দে উঁচু
হয়ে আসা খরগোশের মেধাবী কান, ধানমহিলার পদচ্ছাপ ঘিরে রাখা,
অতীতের রোদ।
রাত্রি ঘুরিয়ে তোমার মুখের দিকে ফিরাই ভরা আমাবস্যা। সকল গানের প্রান্ত
ভেঙে খুলে নিয়েছি অপরিচিত সুর; পড়ে আছি কবিতাবিহী গোলাপজঙ্গলে।
আমি তো এই রাত্রির পিছনপথে দৌড়াই
আমার হাঁটুতে লেগে আছে তোমাদের কোথরের মাটি।
স্মৃতি-২
আমি আছি—অসংখ্য পাতার ভিড়ে
. বর্ণচোরা পাখির মতন
আমাকেই বিদ্ধ করে শ্রাবণের রোদ
জড়জগতে রক্তের চলাচল সাদা সাদা প্রত্যুষের দিকে
শ্যাওলাশিশুর প্রথম কান্নাকে যদি
কবিতার সিঁড়িতে বসাই—
দুপুরের শয্যায় যে ছিল ব্যাধির জাতক
সন্ধ্যাবেলা সে কি প্রকাশিত উঠোন-জ্যোৎস্নায়?
কাশফুলের আড়ালে
কী সুন্দর হাসে অমরার দেবী;
আকাঙ্ক্ষার গভীরে বসেছে ম্লান পানকৌড়ি
ভাবনায় নড়ে ঘাসপাতা
ধীবরের নৌকো হারিয়েছে অনাদিকালের বাষ্পে
অশ্বত্থের ডালে বৃষ্টিভূত কৈশোরের জামা
ভারতবর্ষ ঝরছে মুষলধারায়…
ময়ূর বিষয়ে
ময়ূর বিষয়ে লিখি—
মুহূর্তে সকল ঋতু পার হয়ে পৌঁছি দীঘল বর্ষায়
ডায়েরির কিনারে কিনারে বৃষ্টিশৃগালের দৌড়
মীনবংশে সুনাম রটেছে নাতিদীর্ঘ জলজ মেধার
শাপলার কোরকের মধ্যে জমা দিগন্তপানীয়
নখশীর্ষে কদম ফোটার ভঙ্গি
ওই পুচ্ছের নিকট বেশ ঋণী;
বাক্যে বাক্যে সাঁতারের আয়োজন
ঝিঁঝিঁরমণীর হাসি চিরে ঝরাপালকের স্রোত…
লেখা শেষ হলে
ময়ূরঝুঁটিতে ভেসে ভেসে পৌঁছে যাব বনবারান্দায়।
বাঁশপাতায় বর্ষা
অনেক দূরে বাঁশপাতার ঘ্রাণ;
বেণিপথে বর্ষা এসেছিল, এখন সকল দৃশ্য শুকিয়েছে
কাদায় কাদায় খুঁজি হস্তলিপি
চরসহ জেগে ওঠে মৃত সাঁতারের ছোট ছোট অংশ
শালুকফলে আমার ঘর
লোকালয় ঘিরে শুয়েছি প্রতিটি ধানগাছ
বর্ষা এলেই আমার সামনে দাঁড়াত
দু’জন খোঁড়া উদ্ভিদ, কখনো বা দু’জন বাতাস
অনেক দূরে বাঁশপাতার চোখ; জন্মান্ধ দেখুক—
মোহময় কল্পনার চাষ!