কবি জয় হার্জোর সঙ্গে যশোয়া বার্নেসের আলাপ অনুবাদ । এমদাদ রহমান
প্রকাশিত হয়েছে : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫, ৫:১০ অপরাহ্ণ, | ২৪৭৮ বার পঠিত
অনলাইন ম্যাগাজিন ‘স্যাম্পসোনিয়া ওয়ে’র সহযোগী সম্পাদক যশোয়া বার্নেসের নেওয়া কবি জয় হার্জোর এই সাক্ষাৎকার পড়ার পর পাঠকের মনে কিছু ভাঙচুর হওয়া অস্বাভাবিক নয়; নয় বলেই এই কবি সম্পর্কে খুঁজে বের করতে হয় কিছু দরকারি তথ্য, তাঁর কবিতা ও গান, তাঁর স্যাক্সোফোন, পাখি আর ঘোড়াদের কথা। খুঁজে দেখতে হয় বাংলায় এই কবিকে নিয়ে কোনো লেখাপত্র আছে কি না! নেট ঘেঁটে অবশ্য তেমন কিছু পাওয়া যায় না। সুতরাং আরো খুঁজতে হয়। পাওয়া যায় না তাঁর একটি কবিতারও অনুবাদ। হঠাৎ, ‘হৃৎকলম’ শীর্ষক এক ব্লগসাইটে পাওয়া গেল মহামূল্য একটি লেখা, জয় হার্জোকে নিয়েই! লিখেছেন কবি তাপস গায়েন। লেখাটা পেয়ে আনন্দ হয়। পাশের জানালা দিয়ে রাতের হ্যাম্পশায়ারের আকাশ দেখি। মেঘ করেছে। উইনচেস্টার স্ট্রিটে যুবক-যুবতীরা, চুম্বনরত। আগস্টের শেষদিকে হঠাৎ খুব ঠাণ্ডা নেমেছে। হাসান আজিজুল হকের গল্পের কথা মনে পড়ে- ‘এখন নির্দয় শীতকাল। ঠাণ্ডা নামছে হিম’, এইসব। খোলা জানালার কারণে ‘ঠাণ্ডা নামছে হিম’ ব্যাপারটা ভয়ানকরকম টের পাওয়া যাচ্ছে। বাইরের যুবকরা হাততালি দিচ্ছে, মেয়েরা চিৎকার করে গাইছে-ওলমৌস্ট হ্যাভেন, লাইফ ইজ ওল্ড দেয়ার, কান্ট্রি রোড টেইক মি হোম টু দ্য প্লেইস আই বিলং, ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া, ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া, ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া —বুকটা হু হু করে ওঠে। ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া! ঠাণ্ডা নামছে হিম আর ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া আমাকে কোথায় নিয়ে যায়? ছোট বোনটির কাছে? মায়ের কাছে? শমসেরনগরে? জানালা খোলাই থাকে, কবির কাছে ফিরে আসি। ইউটিউব-এ ডেনভারের গানটা চালিয়ে দিয়ে ইতিহাসের ভিতরে ঢুকে পড়ি। জয় হার্জো ইতিহাসের মানুষ। নির্বাসিত মানুষ। আবার, যে কবি বলতে পারেন — ‘যখনই আমি কবিতা শুনতে শুরু করলাম, তখন আমি যেন পাথরকে কথা বলতে শুনলাম, যেন শুনতে শুরু করলাম চলিষ্ণু মেঘ কী বলতে বলতে যায়; তখন আমি অন্যদেরকেও শুনলাম, চিন্তা করি আমাদের প্রত্যেকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আত্মার কথাগুলি শুনতে শেখা, তোমাদের আত্মার কথাগুলিকে, যে-আত্মা আমাদের সবার মাঝে আছে’, তখন তার আরও কথার প্রতি আমাদের আগ্রহ তৈরি হয়।
জয় হার্জোর কবিতায় ইতিহাস এক দুঃস্বপ্ন। এই দুঃস্বপ্নের নাম ক্রিস্টোফার কলম্বাস, যে-নাম নেটিভ আমেরিকানদের চৈতন্যে এখনো ক্রিয়াশীল, ইতিহাসে যার পুনরাবৃত্তি আছে এবং এ পুনরাবৃত্তি যেন দুঃস্বপ্ন; সেই অর্থে ইতিহাস, দুঃস্বপ্ন, এবং পুনরাবৃত্তি বাহ্যত এক। লেখায় এগিয়ে যেতে যেতে তাপস গায়েন এই কবির পুরো পটভূমি তুলে ধরেন। পড়ে মনে হয় আমাদের কাছে মনোযোগ দাবি করছেন জয় হার্জো! তাপস গায়েন জরুরি কিছু কথা বলেন। সাক্ষাৎকার পড়তে গিয়ে আমরা কবির কাছ থেকেও তার কিছু আভাস পেয়ে গেছি। তিনি বলেছেন- ‘আমাদেরকে আমাদের দেশ থেকে নির্বাসিত করা হয়েছে এবং মুছেও ফেলা হয়েছে। ইতিহাসের এক ফিকে-কুয়াশায়-ঢাকা অনুভূতি হল এই অন্তর্ধান আর সেই ইতিহাস — কীভাবে আমরা এই দেশটাতে এলাম! কালো আফ্রিকানদের বাদ দিয়ে আফ্রিকাকে চিন্তা করুন। আজ আদিবাসীদের কতজন এখানে আছে? এক শতাংশেরও অর্ধেক। কতোগুলি ট্রাইবের নিজেদের কোনো জমি নেই, কিংবা শুধুমাত্র একটুকরো জমি কোনোমতে ধরে রেখেছে? এই ধরে-রাখাটাই একটা সংগ্রাম। আমি মনে করি এটা আমাদের নির্বাসন। তবে, হয়তো, বেশিরভাগ আমেরিকানই অন্তর্জগতের মর্মবস্তু থেকে নির্বাসিত, আর তারা এই আত্মিক নির্বাসনের ব্যাপারটাই জানে না।’
জয় হার্জো একজন ক্রিক ইন্ডিয়ান কবি, গীতিকার, গায়ক, সুরস্রষ্টা। জন্ম ১৯৫১ সালে, অ্যামেরিকার ওকলাহোমা’র তুলসায়। হাও উই বিকেইম হিউম্যান, নিউ এন্ড সেলেক্টেড পোয়েমস : ১৯৭৫-২০০১, এ ম্যাপ টু দ্য নেক্সট ওয়ার্ল্ড, দ্য উইম্যান হু ফেল ফ্রম দ্য স্কাই, ইন ম্যাড লাভ এন্ড ওয়ার, সিক্রেট ফ্রম দ্য সেন্টার অব দ্য ওয়ার্ল্ড, দ্য লাস্ট সঙ ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য কবিতার বই। ১৯৯৮ সালে তাঁর সম্পাদনায় বের হয়েছে-রিইনভেন্টিং দ্য এনিমিজ ল্যাংগুয়েজ : ‘কন্টেম্পোরারি ন্যাটিভ উইম্যান্স রাইটিং অফ নর্থ আমেরিকা’ বইটি, সমসাময়িক বিশ্বইতিহাসের চর্চায় যাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বই বলা হচ্ছে। তিনি নাটক লিখেছেন, লিখেছেন শিশুদের জন্যও। ২০১২ সালে বের হয়েছে তাঁর স্মৃতিকথা — ক্রেজি ব্রেইভ : এ মেমোয়ার। আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রাইটার্স ওয়ার্কশপের একজন গ্র্যাজুয়েট তিনি। এখন ইলিনয়জ বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যামেরিকান-ইন্ডিয়ান স্টাডিজ বিভাগে পড়াচ্ছেন।
তাপস গায়েনের গদ্যে ফেরা যাক। তিনি জানাচ্ছেন — ‘জয় হার্জোর কবিতা স্থানকাঠামোর অধিবিদ্যায় পাঠ জরুরি হয়ে পড়ে, কারণ ভৌগোলিক মানচিত্রের পবিত্রতা এবং সেই ভূগোলে লিপ্ত থাকার বিষয়টি তাঁর কবিতার মৌল বিষয়। হার্জোর ভাষায় — এই ভূমি হলো কবিতা যা উৎসারিত গৈরিক মাটি এবং তপ্ত বালু থেকে, যা আমি কখনো লিখতে পারতাম না, যদি না এই কাগজ হয়ে উঠত আকাশের পবিত্র দলিল এবং কালি হয়ে না উঠত দূরদিগন্তে ধাবমান বন্য ঘোড়ার ভগ্ন সারি। কারণ, ইন্ডিয়ানদের কাছে সময়ের ধারাবাহিকতার ঘটনার পারস্পর্যের থেকে অনেক বেশি অর্থবহ তার পবিত্র ভূমি, হোক তা একটি নদী কিংবা একটি পাহাড়, অথবা একটি উপত্যকা। সেই ভূগোলের মানুষ একমাত্র প্রতিভূ নয়, বরং হরিণ, চিতাবাঘ, সরীসৃপ, ঘোড়া, অর্থাৎ প্রতিটি প্রাণের সাড়া মেলে এখানে এবং সেই স্পন্দনে পৃথিবী এখানে জাগ্রত। সেই জাগৃতির গান জয় হার্জোর কবিতাজুড়ে।’
আত্মজা ও একটি করবী গাছের ‘ঠাণ্ডা নামছে হিম’ এখন খুব তীব্রভাবেই টের পাওয়া যাচ্ছে আর খোলা জানালায় হ্যাম্পশায়ারের আকাশ! বাইরের রাস্তায় যুবক-যুবতীদের কোরাস —কান্ট্রি রোড টেইক মি হোম টু দ্য প্লেইস আই বিলং, ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া, ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া; ইউটিউব-এ, জন ডেনভার! কান্ট্রি রোড! আমি যেন শমসেরনগর থেকে আমাদের গ্রামের পথে হাঁটছি! আশা করছি সারারাত তারা এই গানটি গাইবে। তাদের কোরাসে উইনচেস্টার স্ট্রিট আজ ঘুমাবে না!
যশোয়া বার্নেস-জয় হার্জোর এই বৈঠক হয় ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে, আমেরিকার পিটাবুরায়, জ্যাজ পোয়েট্রি কনসার্ট চলাকালে। কথা হয় হার্জোর শিল্প-কৌশল, ভাঙাগড়া, তাঁর পরিবার আর পূর্বপুরুষ, রাইটার্স ব্লক, আমেরিকায় নেটিভ অ্যামেরিকানদের জোরপূর্বক নির্বাসন আর তাঁর দুই প্রেমিক- কবিতা ও সংগীতের ভারসাম্য নিয়ে।
ভূমিকা এতোটুকুই। এখন, সাক্ষাৎকারটি পড়বার আগে, কবি তাপস গায়েনের অনুবাদে, হার্জোর ‘যে ভাষা বজ্রের, যে ভাষা সরীসৃপের’ শিরোনামক একটি দীর্ঘ কবিতার কয়েকটি পঙক্তি পড়ে ফেলা যাক : —
‘এইসব হলুদ পাখি, যারা ধূমায়িত আগ্নেয়গিরির ওপর
চক্রাকারে ঘুরে, তাদের সংলাপে জেগে ওঠে গান
এই পাথরের।’
যশোয়া বার্নেস : কবিতা এবং সংগীতের সঙ্গে আপনার যাত্রা সম্পর্কে বলুন।
জয় হার্জো : সঙ্গীত আমার জীবনে এসেছে মায়ের কাছ থেকে। মা গান করতেন। রান্নাঘরের টেবিলে বসে গান লিখতেন। আরেকটা ব্যাপারও ছিল, বাবা তখনও আমাদের সঙ্গে আছেন, সে সময় অনেক মানুষ আমাদের বাড়িতে আসতেন, যারা জ্যাজ আর লোকসংগীতের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন। তারা এখানে থেকে আমাদের সঙ্গে জ্যাজ গাইতেন। তুলসা কান্ট্রি গানের জন্য বিখ্যাত।
আমার মা গানগুলি লিখতেন, তাদের ভিতর কয়েকটি ছিল বিশেষ উদ্দেশ্যে মানে আয়োজন করে লেখা, এমনকি তিনি গানগুলির মধ্যে কোনো একটিকে ভালো লেগে গেলে রেকর্ডও করে নিতেন। তিনি খুব কবিতা পড়তে ভালবাসতেন, বিশেষ করে গীতিধর্মী কবিতা, আর ব্লেইকের কবিতা থেকে মুখস্থ বলতেন। অষ্টম গ্রেড পর্যন্ত পড়ার পর দারিদ্র্যের কারণে তাকে স্কুল ছাড়তে হয়। বই কিনবার টাকা তার ছিল না, ইশকুলে প্রতিদিন একই পোশাক পরে যেতে হত। এরপর,আমার মা এমন একজনকে অর্থাৎ আমার বাবাকে বিয়ে করলেন, যিনি গ্রিক ইন্ডিয়ান, কিন্তু সেটা কোনোভাবেই নন্দিত মিল ছিল না।
প্রকৃত অর্থে, আমি সংগীতের জগতে আসি যখন একেবারেই শিশু, কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো দীর্ঘ ৪০ বছর ধরেই আমি সংগীতের সঙ্গে আছি। ‘উন্মাদ সাহসী’ (ক্রেইজি ব্রেইভ : এ মেমোয়ার) বইয়ে আমি এই বিষয়ে বিস্তারিত বলেছি। আমার বয়স যখন ১৩ কি ১৪, আমার বিপিতা আমাকে ঘরে গান গাইতে নিষেধ করেন। তখন আমি ইশকুলের ব্যান্ডদলে যোগ দিই, জুনিয়র হাইক্লাস সেমিস্টারে। সেখানে ক্ল্যারিওনেট বাজাতে পারতাম, কারণ, ব্যান্ডের শিক্ষক মেয়েদেরকে স্যাক্সোফোন বাজাতে দিতেন না। তখন অভিমানে দুঃখে নীরবে সংগীত থেকে দূরে সরে গেলাম।
২০ বছর বয়সে চলে যাই নিউ মেক্সিকো বিশ্ববিদ্যালয়ে আর তখনই কবিতার জগতে পা দিই যখন বহুবিচিত্র সংস্কৃতির মিলনক্ষেত্র বিনির্মাণের জন্য ইসমায়েল রীড অত্যন্ত তৎপর ভূমিকা পালন করছেন। সত্তরের দশকের শেষদিকে নিউইয়র্ক সিটিতে বিরাট এক সাহিত্য সম্মেলন হয়, সেখানে প্রথমবারের মতো আমার পরিচয় হয় কবি ও শিল্পী জেইন কোর্তেসের। আমার জীবনে বিশাল প্রভাব ফেলেন তিনি। রীডও মাঝে মাঝে নিউ মেক্সিকোতে আসতেন কবি, উপন্যাসিক লেসলি মারমন সিল্কো আর চিনের কবি মেই মেই বারজেনবুরগের সঙ্গে দেখা করত। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ছাত্রী। ১৯৯০ সালে আমি নিজের ব্যান্ডদল ‘পোয়েটিক জাস্টিস’ গড়ে তুলি এবং স্যাক্সোফোন বাজাতে শুরু করি। আমার প্রথম অ্যালবাম ‘লেটার ফ্রম দি এন্ড অভ দ্য টোয়েনটি আর্থ সেঞ্চুরি’ বের করার সময় স্যাক্সোফোন বাজাতে শিখি, আর পরের অ্যালবামটায় কীভাবে গান গাইব, তাও শিখতে শুরু করি। নতুন অ্যালবামটিতে থাকবে রক, জ্যাজ এবং ব্লুজ।
যশোয়া বার্নেস : এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে আপনার পেশার ভিত্তিমূলেই রয়েছে বহুমানুষের একটি স্বর — না। কেউ মেনে নিচ্ছে না, ‘না’ বলে প্রত্যখ্যান করছে। আমার মনে পড়ছে শ্যারম্যান আলেক্সির একটি কথা, ‘কবিতা ক্রোধ, সময় আর কল্পনার সমার্থক’। আপনার সংগ্রামী অগ্রযাত্রায় এই কথাটির সঙ্গে কোনও যোগসূত্র খুঁজে পান?
জয় হার্জো : আমার নীতি একটুখানি ভিন্ন। আসলে, ক্রোধ ব্যাপারটা খুব সংবেদী। এটা স্নায়বিক, কিন্তু এই বিষয়গুলি সত্যিকার অর্থেই ইমাজিনেশন : কবিতা, বিজ্ঞান, আমাদের বেঁচে থাকা। এসব আমাদের অবিরাম কল্পনা। নিরেট বাস্তব হচ্ছে —কীভাবে আমরা ম্যাকডোনাল্ড থেকে একখানা পে-চেক নেব, বাচ্চাদের খাওয়াব আর ঘরভাড়া পরিশোধ করব। কবিতা এই অর্থে খুব শক্তিশালী যে এই মাধ্যমটি আমাদের ভাবনাগুলিকে সংক্ষেপে প্রকাশ করে ফেলে, আর অবশ্যই স্বপ্ন এবং ইমাজিনেশন। শব্দ হলো এক বাহন, শব্দ এমন এক চলক, জীবনের কাছে যা তাৎপর্যপূর্ণ কিছু বিষয়কে নিয়ে আসে : শান্তির এক দৃষ্টিভঙ্গি, মায়া, পারস্পরিক যোগাযোগ, গল্প বলার কৌশল আর সেই গল্পটি হচ্ছে আমরা কে, আমরা কী করছি, কী করেছি, কোথায় চলেছি আর যেখানে আমরা যাচ্ছি।
আমি আরো বলতে চাই, আমার জন্য সংগীত হচ্ছে এমন একটি জায়গায় পৌঁছতে চাওয়া যেখানে আছে আমাদের যুগের পর যুগের নৈঃশব্দ্য, শব্দ যাকে স্পর্শও করতে পারে না। এই হল সংগীত সম্পর্কে আমার একটা বিশেষ ধারণা। বিশেষ করে বাজাতে বাজাতে সুর সৃষ্টি করা, আপনি জানেন না কীভাবে আমরা সেখানে যাব, কিন্তু এটা জানেন যে কোথায় আমরা যাচ্ছি, সুরও তৈরি হচ্ছে; হাওয়া যদি একটু হলেও দিক পালটায়, আপনি সানন্দে আপনার পথরেখা বদলাবেন!
যশোয়া বার্নেস : এইসব সীমাবদ্ধতা ছাড়াও আর কী কী কারণে সংগীতের সঙ্গে এতো গভীর বন্ধনে জড়ালেন?
জয় হার্জো : আমিও সঙ্গীতের অংশ, সব সময় সংগীতে নিমজ্জিত এবং আমি আমার আত্মার দিক থেকেও একজন শিল্পী। কবিতাকে আমি এমন এক সত্তা মনে করি যা শব্দের সঙ্গে তার ভ্রমণ সমাপ্ত করে। এই অনুধ্যান আমার কাছে শারীরিক। আমি অনুভব করি, তীব্রভাবে।
৮০’র দশকের শুরুতে চূড়ান্ত রূপেই আমার মনে হতে থাকে যে আমি সংগীতের সঙ্গে জীবন কাটাতে চলেছি। আমি যখন সান্তা ফে-তে, আমেরিকান-ইন্ডিয়ান আর্টস ইন্সিটিউট-এ শিক্ষকতা করছি, তখন প্রায় প্রতিদিনই বাইরে চলে যেতাম, জ্যাজ সংগীত শুনতাম। পরে যখন ডেনভার যাই, গিয়েই সেখানকার জ্যাজ ক্লাবে যেতে শুরু করি, উইক-এন্ডে। আর এখান থেকেই এটা শুরু হয়েছিল। জ্যাজ সবসময়ই আমাকে ভীত করেছে, কিন্তু এটা এমন একটা কিছু, যাকে আমি পুরোমাত্রায় ভালোবাসি। আমি আসলে জ্যাজের ভেতরেই বাস করি।
এখনো, লোকেরা যখন আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করে, তখন সকলেই এই প্রশ্নটি করতে বাদ রাখে না যে আপনি এই দুটি বিষয়কে একসঙ্গে নিয়ে কীভাবে কাজ চালিয়ে যান?উত্তরে আমি বলি- আমি আসলে দুটোকেই এক মনে করি, আসলে এর মানে হলো, এভাবে বলতে পারি — একসঙ্গে দু’জন প্রেমিক থাকার মতো ব্যাপার এটা। আমি মাঝে মাঝেই ভাবি একজনের সঙ্গে চলছি কিংবা আছি অন্যজনের সঙ্গে আর এভাবেই আমার দিনরাতগুলিকে তারা উভয়ে ঘিরে রাখছে। আর এখন তো আমি একেবারে ব্যতিক্রম কিছু কাজ করছি প্রত্যেক সপ্তায় আর কাজটাও খুব কঠিন।
যশোয়া বার্নেস : পড়াশোনা আর লোকের সামনে সংগীত পরিবেশনের ক্ষেত্রে নিজেকে কি ভিন্নভাবে তৈরি করেন?
জয় হার্জো : সম্ভবত না। আমি সঙ্গীত চর্চা করি, আমার পক্ষে ঠিক যতটুকু সম্ভব, আমার অফিস ‘ডিপার্টমেন্ট অভ আমেরিকান ইন্ডিয়ান স্টাডিস’—এ। এখানে আমি যখন প্রথম আসি, আমি এখানকার সবাইকে বলেছিলাম- ‘আশা করছি কেউ ব্যাপারটাকে খারাপভাবে নেবেন না, আমাকে এখানেই গাইতে হবে।’ আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন ব্যাপারগুলো এভাবে প্রতিকূলতায় থেকে কিছু করে যাওয়ার ফলেই অর্জিত হয়েছে।
একদিন ছাত্রদের বললাম— তোমাদেরকে যা খেতে হবে তা হচ্ছে শিল্পের আত্মা! তারপর দীর্ঘ সময় ধরে, প্রকৃত অর্থেই আমরা যেন কিছুই করছি না এমন ব্যাপার চলতে থাকে। আর আমি তখন যা করতে চাইছিলাম, মনে হল, আমি যেন এই ব্যাপারটাকেই খুঁজে চলেছি।
যশোয়া বার্নেস : যখন লেখেন, তখন কি কোনো নিয়ম বা পরম্পরা মেনে চলেন?
জয় হার্জো : আমি এটা আকাঙ্ক্ষা করি। পরম্পরা বা নিয়ম-মেনে-চলাকে ভালোবাসি। গত বছরের প্রতিটি সপ্তাহ আমাকে বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয়েছে; ফলে, আমাকে অনেক কিছুই লিখতে হয়েছে চলার পথে, রাস্তায়। আমার ব্যাগে সবসময়ই কয়েকটি নোটবুক থাকে, বিভিন্ন আকারের, আর থাকে কম্পিউটার। মাথায় আসা প্রচুর আইডিয়াকে আমার লিখতে হয়েছে দীর্ঘ পথ যেতে যেতে।
যশোয়া বার্নেস : কবিতা আপনার কাছে কীভাবে আসে?
জয় হার্জো : প্রায়ই তার রিদম, একটি ইমেজ, আরও কিছু বিষয় আছে যা বারবার ফিরে আসে। যদি আমি একটি কবিতা লিখতে চাই, লিখে ফেলি, তারপর তার ওপর কিছু কাজ করি, কিছু অদলবদল। তাই, বলতে পারেন যে আমি সব সময়ই প্রচুর খণ্ড খণ্ড বিষয় নিয়ে বেঁচে থাকি, নিজের ভিতরে তাদের বহন করি। অন্য বিষয়গুলি একটু চমৎকারভাবেই আসে, অনেকটা একবারেই চূড়ান্ত হয়ে যায়, এই গীতিকবিতাটির মতো ‘একদিন সেখানে কিছু ঘোড়া থাকবে’। আরো একটা ব্যাপার আছে যা হঠাৎ করেই এসেছিল, ‘সকলেরই আছে হৃদয়ের ব্যথা’। কোনও এক এয়ারপোর্টে বসে লেখা হয়েছিল, খুব খারাপ আবহাওয়ায়, আমি শুধু লোকদের দিকে তাকাচ্ছিলাম, তাদের মুখ দেখে মনে হচ্ছিল ‘প্রত্যেকের হৃদয়ে ব্যথা’; লিখেছিলাম খুব দ্রুত, পরে অবশ্য বেশ কিছু ঘষামাজা করেছি। এখন বেশ কিছুদিন ধরে আমি একটি সংগীতনাট্য (মিউজিক্যাল) নিয়ে ব্যস্ত আছি। এই ফেব্রুয়ারিতেই আমি উক্রশ-এ সানড্যান্স স্ক্রিনরাইটিং রেসিডেন্সিতে যাচ্ছি, সংগীতনাট্যের ওপর তিন সপ্তাহের কাজ। ভাবছি ফিরে আসব প্রথম খসড়াটি নিয়ে, কিন্তু দ্বিতীয় সপ্তায় এর সবকিছুই ছুঁড়ে ফেলব আর তৃতীয় সপ্তায় আমি একেবারেই নতুন করে কাজটা শুরু করব। চূড়ান্তরূপে, সংগীতনাট্যের ছন্দ আর ভাষাকে আমি খুঁজে পাব, অথবা আমি ছন্দ আর ভাষাকে তাড়া করে বশ করব। কিছু কিছু একক-সৃষ্টি আছে, ঠিক যেন ভিড়ের জনতা কিংবা শিশু।
যশোয়া বার্নেস : কীভাবে বুঝতে পারেন কখন কোনোকিছু করতে পেরেছেন?
জয় হার্জো : আপনি যখন আপনার কানকে পূর্ণতর করবেন, তারপর চর্চা করবেন স্যাক্সোফোনের মতো!
যশোয়া বার্নেস : কাজের অনুপ্রেরণা কোথা থেকে আসে?
জয় হার্জো : আমি অন্য মানুষকে শুনবার চেষ্টা করি। ‘ফ্রম দ্য পোয়েট্রি অব লাইফ অ্যান্ড মিউজিক।’ বেন ওয়েবস্টার আমি সবসময়ই শুনি আর খেয়াল করি এই সময়ের স্বতঃস্ফূর্ত এক-চরিত্রের কমেডিগুলো। কবিতা আর গান উভয়ের ভিতর আপনি আসলে লেখেন এইসবের খণ্ড-খণ্ড টুকরোগুলো, ছবি তোলার আলোকসম্পাতের মতো। একজনের পরিবেশিত কমেডিও আপনাকে অনেক কিছু দিতে পারে, তাদের পাওয়া হাততালিগুলো ছাড়া এমন একটা কিছু যা আপনার কাছে বহুমূল্য।
যশোয়া বার্নেস : আপনার অভিজ্ঞতায় যখন রাইটার্স ব্লক-এর মতো ব্যাপার ক্রিয়াশীল থাকে, তখন কী করেন?
জয় হার্জো : ‘রাইটার্স ব্লক’ বলতে সাধারণত বোঝায় যে আপনি ভুলপথে চলেছেন বা খুব জোর করে কিছু করার চেষ্টা করছেন। তখন আপনার দরকার কিছুদিন থেমে থাকা, কারণ, এখন আপনার অন্য কিছু লাগবে। অথবা, আপনি খুব ভুল কিছু করে ফেলেছেন, হয়ত পুরো প্রজেক্টটাই বাজেভাবে সম্পাদিত হয়েছে। যখনই এই উপলব্ধিটি হয়, আমি সবকিছু থেকে দৌড়ে পালাই আর বলি- ‘ঠিক আছে, চলো এখন এই ২০টি পৃষ্ঠাকে ছিঁড়ে ফেলি, এগুলোকে আর রাখার দরকার নেই’। তার মানে কিন্তু এই নয় যে আমি সময়টুকু অযথাই নষ্ট করেছি বা বাজেভাবে খরচ করে ফেলেছি; এটা করার খুব দরকার ছিল। আপনি হয় আপনার ভিতরের দানবগুলোকে ধ্বংস করবেন নয় তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করবেন, আপ্যায়ন করাবেন এবং তাদেরকে তাদের পথে যেতে দেবেন।
যশোয়া বার্নেস : বোঝা যাচ্ছে ভ্রমণ আর সময় আপনার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ; তারাই আপনার সবকিছু দেখে রাখে।
জয় হার্জো : আমরা সময়কে নির্মাণ করেছি একটি সড়করৈখিক ফ্যাশনে, তবে নিশ্চয়ই সময় হলো এমন কিছু, হয়তো আপনার বা আমার মতো কিছু, একটা সত্তা। এখন মনে পড়েছে আমি একটি নাটক লিখেছিলাম, নাম ছিল ‘রাত আকাশের ডানা, ভোরের আলোর পাখা’। নাটকে, চরিত্রের বাবা বলছিলেন, কীভাবে তার বাবা জানতে পেরেছিলেন সময়কে কেমন করে থামিয়ে দিতে হয়। আমাদের পরিবারে এমন কিছু মানুষ আছেন যারা জানতেন বিষয়টা কী অথবা কীভাবে এটা করতে হয়। আমার খালা আমাকে সেইসব গল্প বলেছিলেন, মোনাউইয়েকে নিয়েই ছিল সে গল্প, সাত প্রজন্ম আগের আমার এক পিতামহ জানতেন সময়কে স্থির করবার কৌশল। যখনই তিনি তার যোদ্ধা বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে বের হতেন, সবসময়ই তারা বহুদূর যাবার আগেই থেমে পড়তেন কেননা তারা জানতেন কীভাবে সময়স্রোতের অশ্বারোহী হতে হয়। ব্যাপারটা আসলে এক কাব্যিক ধারণা বা স্বপ্ন-সময়, কিন্তু এটা সম্পাদিত হয় শারীরিকভাবে। একদিন আমার বেলাতেও এমনটি ঘটেছিল।
যশোয়া বার্নেস : কীভাবে?
জয় হার্জো : বছরখানিক আগে আটলান্টার একনেস স্কট কলেজে আমি দুই সপ্তার জন্য কাজ করতে যাই। সেখানে, মার্চে, ‘অশ্বখুরের যুদ্ধ’ নামক ব্যান্ডের একটি অনুষ্ঠান ছিল, যেখানকার নায়ক এই মোনাউইয়ে। আমি সেখানে গেলাম, সঙ্গে নিয়ে গেলাম বেশ ক’জন বিদেশি ছাত্রকে। জোরালো বিটের জ্যাজনৃত্য করছিলাম যখন, তখন সমবেত সংস্কারবাদী শিল্পী, অভিনেতা ও কলাকুশলীরা একযোগে বিভেদরেখার সরকারি আইনগুলিকে মানুষের জীবন থেকে মুছে ফেলতে চাইছেন, পরের দিন খুব উৎফুল্ল মনে তাদের সঙ্গে যোগ দিলাম, তাদের মতো পোশাক গায়ে দিয়ে। আমরা সেখানে একসঙ্গে নাচতে নাচতে ভাবছিলাম : ‘ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত। আমাদের আছে একমাত্র এই ভাঙাচোরা গল্পটি আর তারা আবারও সেই গল্পটিকে ভাঙতে চাইছে।’ যে-রাস্তা দিয়ে এসেছিলাম, ফিরছিলামও সে-রাস্তা ধরে, পাশে ছিলেন দুই তরুণী। ঘুমাচ্ছিলেন তারা। হাইওয়েতে যেতে যেতে কিছু যেন, হয়ত কোনও সাইনপোস্ট খুঁজছিলাম; হাইওয়ে ধরে যাচ্ছি আর সাইনপোস্ট বলছে : ‘আটলান্টা ৯০ মাইল’। এটা দেখার পর পরই আমার মনে আছে, আমি যেন মোনাউইয়ের দ্রুতগামী ঘোড়ার ক্ষুরের আওয়াজ শুনতে পেলাম, অনুভব করলাম তার ধাবমান গতি, নাকে লাগল ঘোড়া আর মানুষের ঘামের গন্ধ। তারপর পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আরেকটি সাইনপোস্ট দেখলাম, তাতে লেখা : ‘আটলান্টা ৬০ মাইল’। ভাবলাম : ‘হ্যাঁ, এভাবেই ব্যাপারটা ঘটেছিল’। কাব্য আর সংগীতের মধ্যে ঠিক এইরকম ব্যাপারগুলো ব্যাপকমাত্রায় থাকে। ভিতরকার ছন্দই হলো সবকিছু।
যশোয়া বার্নেস : আরো বিশদে যাবার আগে, আমি আসলে সেই জায়গাটিতে যেতে চাচ্ছি, আপনি বলছিলেন বিভেদকারী আইনের পুনঃপ্রবর্তন নিয়ে। আপনারা কি এই কথাটাই বলতে চেয়েছিলেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নেটিভ অ্যামেরিকান মানুষের, তাদের নিজেদের বলার অধিকারটা বা কণ্ঠটা আসলে নির্বাসিত মানুষেরই কণ্ঠ?
জয় হার্জো : অবশ্যই। আমাদেরকে আমাদের দেশ থেকে নির্বাসিত করা হয়েছে এবং অদৃশ্যও করা হয়েছে। মুছে ফেলা হয়েছে। ইতিহাসের এক ফিকে-কুয়াশায়-ঢাকা অনুভূতি হলো এই অন্তর্ধান আর সেই ইতিহাস কীভাবে আমরা এই দেশটাতে এলাম! কালো আফ্রিকানদের বাদ দিয়ে আফ্রিকাকে চিন্তা করুন। আজ এখানে কতজন আদিবাসী আছেন? এক শতাংশেরও অর্ধেক। কতোগুলি ট্রাইবের নিজেদের জমি নেই, কিংবা শুধুমাত্র একটুকরো জমি কোনওমতে ধরে রেখেছে? এই ধরে-রাখাটাই একটা সংগ্রাম। আমি মনে করি এটা আমাদের নির্বাসন। তবে, হয়তো, বেশির ভাগ আমেরিকানই অন্তর্জগতের মর্মবস্তু থেকে নির্বাসিত, তারা এই আত্মিক নির্বাসনের ব্যাপারটাই জানে না। তারা বিস্মিত হয়ে ভাবে কেন তারা সুখী নয়, কেন তারা অবিরাম এক ঘোরলাগা সংশয়ের ভিতর বাস করছে, কেন তারা আরো কিনতে চায়।
যশোয়া বার্নেস : প্রকাশনাজগতের যে প্রান্তিকতা, এ-সম্পর্কে কী বলবেন?
জয় হার্জো : একজন আদিবাসী আমেরিকান লেখক হিসাবে বিষয়টা আমার জন্য কিছুটা ভিন্ন হয়তো। আমি খুবই ভাগ্যবতী এই জন্য যে একজন খুব ভালো প্রকাশক পেয়েছিলাম, কিন্তু আমাকে তাদের লেখক হিসাবে গ্রহণ করবার আগে আমি অন্তত তিনবার নর্টনে গেছি। এই যে আপনি ব্যাপারটা তুললেন, এর ভিতর আসলে অনেক হিসাবনিকাশ আছে, মানে অনেক লড়াই করেই জায়গা পেতে হয়। তবে আমি সবসময়ই মনে করি যে-কোনও আদিবাসী মানুষের জন্যই ব্যাপারটা সত্য। মনে আছে, শিশুদের জন্য লেখা প্রথম বইটি যখন আমার পূর্ণাঙ্গ পরিচয়সহ বের হলো, প্রকাশককে জিজ্ঞেস করলাম ‘আমাকে কি প্রেস-রিলিজটা দেওয়া যাবে, তাতে বইয়ের প্রকাশ-প্রচারণায় সাহায্য পেতে পারি।’ তারা বললেন ‘ওহ, আমরা এই কাজে যাব না, কারণ এখানে তেমন অভিবাসী কেউ নেই।’ আমি বললাম, ‘এই গল্প তো একটি মেয়ে আর তার বিড়ালকে নিয়ে। এটা একটা বিড়ালের গল্প। লোকে বিড়ালের গল্প পছন্দ করে।’
একজন আদিবাসী লেখক হিসাবে আপনার কাজকে যথাযথভাবে গ্রহণযোগ্য করে তোলাটা অত্যন্ত কঠিন কারণ লোকে জানে না আপনি কে। একটা উপায় হলো স্টেরিওটাইপ কিছু করা। মানুষ স্টেরিওটাইপকে সহজেই গ্রহণ করে। তারা আমাদেরকে দেখতে চায়-আমরা নেচে চলেছি, নির্দিষ্ট কিছু উপায়ের খোঁজ করছি, বিশেষ পোশাক পরেছি। আমি প্রায়সময় খুব মজা করে বলি, যদি প্রত্যেকটি এলবামে একটি করে স্বপ্নধরা মানুষের জন্য সমবেত সংগীত দিয়ে দিই, অনেক অ্যালবামের চেয়ে এটা শতগুণ বেশি বিক্রি হবে।
যশোয়া বার্নেস : আপনি কাদেরকে আপনার পাঠক বা শ্রোতা বলবেন?
জয় হার্জো : আমি মনে করি বেশির ভাগ লেখকই লিখে থাকেন তাদের ভিতরকার বিশেষ কোনও অভিপ্রায় কিংবা শক্তির তাড়নায়, যার মাধ্যমে তারা একটা নির্দিষ্ট পথে চালিত হয়ে থাকেন। আমি প্রথমেই লিখতে শুরু করি আমেরিকান ইন্ডিয়ান ফ্রিডম মুভমেন্টের প্রতি শ্রদ্ধা আর সমর্থনের তাড়নায়। আমার অনেক কবিতা এসেছে, মানে, ভয়ানক কিছু বৈষম্য আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে কবিতাগুলি, ভালবাসা আমাকে তাড়িত করেছে, সমানাধিকারের আন্দোলন আমাকে তাড়িত করেছে, আর করুণা, সমবেদনা এইসব ব্যাপার আমার কবিতার ভরকেন্দ্রজুড়ে আছে। আমার লেখালেখির শুরু হয় বা লেখালেখি সাড়া দিতে চায়, আমার নিজের আর অন্যান্য কালচারের, সম্প্রদায়ের প্রাজ্ঞ লোকেরা কী বলছেন বা ভাবছেন- সেই জায়গা থেকে। আমি শুনি, আরও বেশি করে প্রাজ্ঞকণ্ঠের স্পিরিটকে মন দিয়ে শুনি। যদিও, এখানকার অভিবাসী লোকজন সংগীত বলেন, বইপত্র বলেন, খুব একটা কিনতে চায় না। এখানে অসংখ্য আদিবাসী আর্টিস্ট আছেন, তাদের কাজের ক্রেতা হিসাবে ঝোঁকটা বেশি দেখা যায় এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া আর যারা কাজ করতে আসেন বাইরে থেকে, তাদের মধ্যে। আমার বিপুল পাঠক, শ্রোতারা সবাই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে আর এর বাইরে যারা আছে তাদের বয়স এখন ২০।
যশোয়া বার্নেস : তরুণ লেখকের কোন ব্যাপারটি জানা খুব দরকার? প্রত্যেক লেখকেরও জানা থাকা দরকার?
জয় হার্জো : স্যাক্সোফোন আমাকে লেখালেখি সম্পর্কে তিনটি জিনিস শিখিয়েছে। আপনাকে নিজের ওপর দৃঢ় বিশ্বাস রাখতে হবে, সংগীতের স্পিরিটের ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে, ভালবাসতে হবে, আর করতে হবে নিরন্তর চর্চা।
অন্য কিছু বলতে হলে বলব- ধৈর্য হারিয়ে না ফেলা। কিছু মানুষ আছেন, ৭০ বছরেরও বেশি হয়ে গেল, এখনও তারা কিছুই প্রকাশ করেননি। আপনার শিল্পের স্পিরিটকে লক্ষ্য করুন। শুনুন, দেখুন, পড়ুন। নিজেকে কখনোই অন্য কারো সঙ্গে তুলনা করতে লাগবেন না। আপনাকেই কাজটুকু করতে হবে কারণ আপনি শিল্পকে ভালোবাসেন।
দুই বছর হলো আমি আমার কাজের ধরনকে, আমার পদ্ধতিকে আমূল পাল্টে নিয়েছি। নিজেকে চালিয়ে দিয়েছি এর ভিতর দিয়ে আর উপলব্ধি করেছি যে আমি কাজটা করতে পেরেছি, কারণটা আর কিছুই না, কারণ হলো আমি কাজটাকেই ভালোবেসেছি। মনে রাখবেন, আপনি কাব্য আর সংগীতের ভিতরকার শক্তিকেই প্রকাশ করছেন। আপনি শুধু নিজেকে এর ভিতর ঢেলে দিন, তার সঙ্গে যোগ করে দিন নিজের সমস্ত ঘূর্ণন-গতি। তাতেই হবে।