সানজিদা ইয়াসমিন স্বর্ণা / ডায়রির কয়েকটি রঙ…
প্রকাশিত হয়েছে : ২৬ ডিসেম্বর ২০১৪, ৩:২১ পূর্বাহ্ণ, | ২৫৩০ বার পঠিত
রঙ…
ক্লাস থ্রি কিংবা টুতে পড়ি তখন! ঠিক তখনকার কোনো এক সময়ে সমালোচনা শব্দটার সাথে প্রথম পরিচয়।আগে কখনো শুনে থাকলেও খুব একটা গুরুত্ব দিই নি শব্দটি বোঝার ক্ষেত্রে! আমি যখন সমালোচনার মানে খুঁজতে ব্যস্ত তখন হয়ত নিজের অজান্তে অনেকেরই সমালোচনা করতাম! ঘুণাক্ষরেও টের পাই নি যে….” যা করছি বা বলছি সেটাই সমালোচনা!”
তো যখন আক্ষরিক দ্বন্দ্বের কাছে হার মেনে খানিকটা ভাব সংগ্রহের দিকে নজর দিতে গেলাম তখনই… দৈবক্রমে হোক বা ভাগ্যক্রমে… ছোটমামার সামনে পড়লাম! সচরাচর প্রয়োজন না হলে আমি মামার সামনে পড়ি না…কিন্তু যখনই বিপদে পড়ি তখনই তিনি সামনে এসে পড়তেন!
আর কিভাবে কিভাবে যেন বুঝে ফেলতেন যে আমি বিপদে পড়ছি! তাই বাধ্য হয়ে তাকে সমস্যার কথা বলতে হত! বাধ্য হয়ে বলছি এ কারণে… মামা একবার কথা শুরু করলে সাত-খণ্ড রামায়ণ শুনিয়ে তবে ছাড়তেন!সে যাত্রায়ও রক্ষা হয় নি…!রামায়ণের পুরো কাহিনী না বুঝলেও আমি আমার নিজের মতো করে সমালোচনার অর্থ দাঁড় করিয়ে নিয়েছিলাম! সেই পুঁচকে বয়সেই বন্ধু-মহলে অনেকের কাছ থেকে অনেক সমালোচনা শুনেছি।কখনো হয়তো নিজেও সেসবে যোগ দিয়েছি…আবার কখনোবা বুঝতে চেষ্টা করেছি সমালোচনার কারণ! মাঝে মাঝে খুব অবাক হতাম,”যে বেচারাকে নিয়ে কথা হচ্ছে সে তো এসবের কিছুই জানতে পারছে না!মধ্যখানে নিজস্বতা বলে যে একান্ত ব্যক্তিগত সত্তা ;সেটাকে উন্মোচিত করা হচ্ছে!” ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম… তখনকার সেসব সমালোচনার বেশিরভাগই অর্থহীন! কেননা অখ্যাত কাউকে বিখ্যাত করতে এরচেয়ে ভালো আর কিছুই হতে পারে না! তখন থেকেই ভাবলাম…যদি সমালোচনা করতেই হয় তবে সমালোচকদের সমালোচনাই বরং করব!
আর সেটা অর্থহীন ভাবে নয়….সমালোচনীয় ভঙ্গীতে
২. বাংলাদেশ বেতার এর সিলেট কেন্দ্রের সামনে দাঁড়িয়ে আছে নীরা।গত আধাঘণ্টা ধরে বারবার দৃষ্টিফেরী করছে যার-প্রতীক্ষায়… তার প্রতি এখন বিরক্তি জমতে শুরু করেছে!
শীতের ঝিরঝিরে বাতাসটা যেন জড়ানো মাফলার ভেদ করে ওর কানে ঢুকে যেতে চাইছে!ব্যস্ত রাস্তায় অজস্র মানুষের আনাগোনা। কেউ কেউ ফিরে দেখছে ওকে… কেউ আবার দেখেও পাত্তা দিচ্ছে না। নীরা আজ অনেক কিছু ভেবে বেরিয়েছিল! ভেবে রেখেছিল কি কি বলবে অনিকেতকে…কিন্তু! কিন্তু এখন মনে হচ্ছে… সেসব কিছুই বলা হবে না! এখানে অপেক্ষা করতে ওকে অনিকেতই বলেছিল।ওর এতটা দেরী নীরার মনের উত্তেজনাকে পরিণত করেছিল উৎকণ্ঠায়! তবে এখন তার প্রচণ্ড বিরক্তি লাগতে শুরু করেছে।অনিকেত এর ফোনটাও বন্ধ!এমনটা তো কখনো হয় না…! তাহলে! শেষমেশ হাঁটতে শুরু করল নীরা…”কেন এমন করল! ও তো সবসময়ই punctual!ফোনটাও বন্ধ!”
আজকের দিনটা অন্যরকম হতে পারত… অন্যরকম গল্প…অন্যরকম খুনসুটি…. অন্যরকম প্রাপ্তি! কিন্তু না… সেরকম কিছুই হয় নি! অনিকেতকে অনেক কিছু বলার ছিল নীরার!অনেক কিছু….! হয়তো এবারও বলা হবে না…! হয়তো আর কখনোই না!: নীরা হেঁটে চলেছে…ক্লান্ত…স্তব্ধ…আর খানিকটা বিস্মিত! ওর মনে হল…যা হতে পারত তারচেয়ে যা হয়েছে… সেটাই যেন ঢের ভাল! অজস্র প্রতীক্ষাকে অস্বীকার করে সে হাঁটতে লাগল….ব্যস্ত রাস্তার পথিকদের কেউ অনুভব করল না যে হিম শীতল বাতাস ক্ষণিকের জন্য নিস্তব্ধ হয়ে গেছিল!
৩. ঘুড়িটা ছিল হলুদরঙা। স্বচ্ছ আকাশে যেন বিশুদ্ধ শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দিতে উড়ছিল। কয়েক মুহূর্তের জন্য আমার মাঝে একটা স্ফূর্তির ভাব কাজ করছিল!কিন্তু যেই ঘুড়িটার নিয়ন্ত্রণকারীর দিকে চোখ পড়ল, আমি একেবারে থমকে গেলাম!
কি সাবলীলভাবেই না নিজেকে ঘুড়ির সাথে তুলনা করেছিলাম! ভেবেছিলাম ঐ নীল আকাশে ডানা মেলে উড়তে কত আনন্দ! কিন্তু একবারও মাথায় আসেনি যে আমারও একজন নিয়ন্ত্রণকারী আছে!
ঘুড়ির সুতো যদি কাঁটা পড়ে তখনই কেবল তা মুক্ত!অথচ তখন তার সাবলীলতার নিশ্চয়তা দেয়া যায় না…হয়ত মুক্তির আনন্দ পূর্ণ হওয়ার আগেই সে পড়ে থাকবে কোনো অজানা গহীন জঙ্গলে!
এই ভেবে তখন আবার স্বস্তি পেলাম! আমারও একজন নিয়ন্ত্রক আছে!
তবে সবকিছুর ভিড়ে মাঝে মাঝে মুক্ত হওয়াটা খুব একটা খারাপ না! বরং অনুভবকে অনুরক্ত করতে সেটারও একটু বেশিই প্রয়োজন…
৪. কিছু লুকোনো অনুভূতি বাবার সেদিন কি একটা কাজ ছিল! খুব তাড়াহুড়ো করে বেরচ্ছিলেন! হঠাৎ,আমার আট মাসের ছোট্ট বোন কান্না শুরু করল, কিছুতেই যেতে দিবে না! বাবা সিঁড়ির কয়েকটা ধাপ পেরিয়ে নিচে নেমে পড়েছিলেন! তখনই সে ক্রন্দনরত অবস্থায় ডেকে উঠল, আব্বু! তার প্রথম আহ্বান! বাবা থমকে দাঁড়িয়ে উঠে এলেম উপরে! আমার কেন জানি মনে হল, তার চোখের কোণটা চিকচিক করছে! কি আশ্চর্য! আমি তো বাবা মায়ের প্রথম সন্তান! সেদিন তাদের অনুভূতিটা কেমন ছিল সেটা হয়ত বলতে পারব না! তবে নিঃসন্দেহে সেই লুকোনো ভালোবাসার আবার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল আমার বোনের কল্যাণে!
৫. স্বপ্নটা সত্যি হবে! খুব যখন ছোট তখন না বুঝেই একবার লিখেছিলাম, বড় হয়ে আমি মনের রহস্য উদ ঘাটন করব! মনস্তত্ব শব্দটির সাথে তখনো পরিচয় ঘটেনি। তবে এখন জীবনের লক্ষ্যই সেটা! অবুঝের মতো সেদিনের যে স্বপ্নটি দেখেছিলাম, সেটি আজ ভাবুকের মত পূরণের স্বপ্ন দেখি!
৬. আকাশ ভরা আলো! চারপাশে তো কত কিই না আছে! সবকিছু দেখবার বা সবকিছু নিয়ে ভাববার তাড়না হয়তো তৈরি হয় না! কিন্তু আকাশ! তা কত বিশাল! কত চমৎকার! চলতি পথে থমকে দাঁড়িয়ে যদি আকাশের পানে তাকাই…কত চিন্তার খোরাকই না জুটে যায়! তাই আমার আকাশ ভরা স্বপ্ন, আকাশ ভরা আলোয়!
৭. আমরা দুজন বোন হলাম! স্যারের বাসায় ভুল করে এক মেয়েকে আপু ডেকেছিলাম! সে তো তখন রেগে-মেগে আগুন! তাকে আপু ডেকে কেন মুরুব্বী বানিয়ে দিলাম!? আমারই বা কি দোষ! আমি তো আর ওর নাম জানতাম না।
তারপর অনেকটা সময় পেরোল। আমরা একজন আরেকজনকে চিনলাম! কিন্তু আমি ওকে আপুই ডাকতে থাকলাম…আর ও আমাকে ডাকত আন্টি!
দিনকাল চলছে যেমন চলার কথা ছিল! কিন্তু আমাদের এই মজার সম্পর্কটার মধ্যে যোগ হয়েছে একটা নতুন মাত্রা। আমরা দুজন এখন থেকে বোন! আর আমাদের ভগ্নী-ত্ব বোধ এর উদযাপন করেছিলাম বন্ধুদের মাঝে চকলেট ভাগ করে…