শৈশবের কয়েকটি ভোর / সুবর্ণা সাহা
প্রকাশিত হয়েছে : ১৩ জানুয়ারি ২০১৪, ৯:১২ পূর্বাহ্ণ, | ২৭৮০ বার পঠিত
১. সন্ধ্যায় আমার নিকট কাছের দুইজন মানুষ আমার বাসায় এলেন, উচ্ছ্বাসের সাথে চা করতে গিয়ে হাত একটু পুড়ে গেল। পুড়ে যাওয়ার সময়টা বা তার পরের মূহুর্ত গুলোতে একবারও বিষয়টা নিয়ে সামান্য পরিমাণেরও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হল না। দীর্ঘ দিনের আড্ডা দেওয়ার যে প্রতীক্ষা ও আনন্দ এ যেন তারই অংশ।
হাসি আর কান্না সুখ আর দুঃখ অবস্থান খুব কাছাকাছি । আড্ডার যে বিভিন্ন ধরনের হয় এটা সবাই জানে। শৈশব থেকেই বাড়িতে পারিবারিক আড্ডা গুলো থেকে মানুষ এর রস আস্বাদন করতে থাকে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যায়; পেশা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড সব ধরনের আড্ডা করতে করতে ঘরোয়া আড্ডায় কোথায় যেন এক শূন্যতা…
২. সময়’ যা জীবন থেকে চলে যায় আর ফিরে আসে না। সময়ের ঘোরপাকে জীবনের অনেক স্মৃতি মানুষকে নাড়া দেয়। মানুষের শৈশবটা তেমনি একটা সময়। আবদার দুষ্টুমি আরও কত কিছুতে সময়টা চলে যায়। জীবনের গভীরতা কী, কোন ধারনাই থাকে না। আজ একটা আবদারের কথা মনে হল । তখন আমি ক্লাস ওয়ানে পড়ি। বার্ষিক পরীক্ষার কিছুদিন আগে, বাবার ডায়াবেটিস ধরা পড়ল। ওষুধ পথ্যের পাশাপাশি বাবা আরেকটা জিনিস খাওয়া শুরু করলেন। প্রতিদিন সকালে খেতেন। আর আমার শুধু মনে হত বাবা যা নিয়ে আসেন কোন কিছুই তো আমাদের না দিয়ে খানা না, তাহলে এটা কেন দেন না। পরীক্ষা শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম, না এবার আর না– একদিন শুক্রবার সকালে বাবা যখন সেটা খাবেন তখন একেবারে আবদার করেই বললাম যে আমাকে একটু দাও। মা আর বাবা বার বার বলছিলেন খেতে পারব না। কিন্তু বাসার অন্য সবাই মোটামোটি উশকে দিলেন যে খেয়ে নে, খুব স্বাদ। কাপ নিয়ে বাবার কাছে দাঁড়ানো, পুরো কাপ ভরে খাবার প্রচণ্ড লোভ, জিহ্বায় পানি এসে গেছে, কিন্তু কপালে জুটল কাপের তলানিতে পড়ে থাকা সামান্য যা অতি কষ্টে চামচ দিয়ে তুলতে সক্ষম হলাম, মুখে দেবার ২/৩ সেকেন্ডের মধ্যেই বাসার সবাই শুনলেন আমার চিৎকার আর কান্না। মা সাথে সাথে আমার নাক চেপে ধরলেন আর পানি খাওয়াতে শুরু করলেন। ঐ জিনিসটা ছিল চিরতার জল। তারপর সময় গড়িয়ে গেছে অনেক। আজকের এই সময়টাতে এসে বিষয়টা উপলব্ধি করতে পারি যে মা বাবা সন্তানের সব সময় ভালোই চান। অথচ সন্তানদের, কিছু না পেলেই তাদের মনে হয় মা-বাবা তাদের জন্য কিছুই করেন না। আর ও কত ভ্রান্ত ধারনা। চিরতার জল খেতে না দেবার পেছনের যে কারণ গুলো ছিল তার উপলব্ধি আজ প্রায়ই আমায় নাড়া দেয়।
৩. সমাজবিজ্ঞান পড়তে গেলে তিনটি ধারণা পড়া লাগে। পরিবার, সংক্কৃতি, সভ্যতা, ছাত্রজীবনে শিক্ষকেরা আমাদের পড়িয়েছেন। কর্মজীবনে আমরা এখন পড়াচ্ছি। মানুষ আবেগপ্রবণ। পড়াতে পড়াতে এক সময় ঐ সংজ্ঞা গুলোর সাথে আবেগ জড়িয়ে যায়। একজন মানুষের সবচেয়ে বড় শিক্ষক তার মা বাবা বাকি সদস্যরাও কিন্তু তার আপন। যখন থেকে জীবনটা বুঝতে শিখছি তখন থেকেই সংগ্রাম করে চলছি। সংস্কৃতি সেই সংগ্রামকে ছায়া দিয়েছে। চূড়ান্ত দুর্যোগ পূর্ণ অবস্থায় মানুষ তার পরিবারকেই কাছে চায়। অন্য কারো বলতে পারবা না। তবে সভ্যতা এই স্তরেও এসে আমি পেয়েছি ‘সংস্কৃতি’ নামক এক শক্তির পরশ। কোথায় রক্তের সম্পর্ক? এই বাস্তবগুলো এক প্রতি বেশীর সাথে আলাপচারীতায় তিনি বললেন ‘বুঝলে, যাদের দায়িত্ব আছে তারাই মানুষ, তাদের নিয়েই পরিবার।’’
‘গীতা’-র মূল বক্তব্যই হল ‘পরিবর্তনই সংসারের নিয়ম।
কিন্তু পরিবর্তন গুলোর স্তর পার হতে আমরা যে কত কষ্ট আর যন্ত্রণা বয়ে যাই তা হয়তো কোনদিনই সুখে প্রকাশ করতে পারব না।
আজ সকালে এক হাস্যকর Thank you বললাম। সুখ ধুব তার জন্য মাকে সোয়েটারের হাত কনুই পর্যন্ত টঠিয়ে দিতে বললাম এবং মা তা করে দিলেন। Thank You বলার ৫/৬ সেকেন্ড পর মনে মনে হাসি পেল মার তাকানো দেখে যে আমি এসব কী বলছি?