মোহিনী নিঃসঙ্গতা । জাকির জাফরান
প্রকাশিত হয়েছে : 20 April 2016, 9:29 pm, | ২২৯০ বার পঠিত

মূল : পাওলো কোয়েলহো ।। প্রকাশিতব্য Manuscript Found In Accra বইয়ের বঙ্গানুবাদ থেকে নির্বাচিত পরিচ্ছেদ ।। তর্জমা : জাকির জাফরান
নিঃসঙ্গতা ছাড়া ভালোবাসা বেশিক্ষণ তোমার পাশে থাকবে না।
কারণ ভালোবাসার বিশ্রামের প্রয়োজন হয়, যাতে সে স্বর্গের মধ্য দিয়ে ভ্রমণ করতে পারে এবং নিজেকে অন্য আঙ্গিকে প্রকাশ করতে পারে।
ভালোবাসা ছাড়া কোনও প্রাণী বা তরুলতা টিকে থাকতে পারে না, কোনও মাটি উৎপাদনশীল থাকতে পারে না, জীবন সম্পর্কে শিখতে পারে না কোনও শিশু, কোনও শিল্পী সৃষ্টি করতে পারে না কিছু, কোনও কাজের বৃদ্ধি বা রূপান্তর ঘটে না।
নিঃসঙ্গতা মানে প্রেমের অনুপস্থিতি নয়, বরং এর পরিপূরক।
নিঃসঙ্গতা মানে সঙ্গের অনুপস্থিতি নয়, বরং এমন মুহূর্ত যখন আমাদের আত্মা আমাদের সঙ্গে কথা বলতে ও জীবনের করণীয় সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে।
সুতরাং আশীর্বাদপুষ্ট তারাই যারা একাকিত্বকে ভয় পায় না, যারা আপন সঙ্গী নিয়ে ভীত নয়, যারা সর্বদা কিছু-একটা করার জন্য মুখিয়ে থাকে না, এমনকি কোনও বিনোদন বা কিছু মুল্যায়ন করার জন্যও নয়।
তুমি যদি কখনও একা না-হও, নিজেকে জানতে পারবে না।
আর নিজেকে যদি জানতে না-পারো, তুমি শূন্যতাকে ভয় পেতে শুরু করবে।
কিন্তু শূন্যতার কোনও অস্তিত্ব নেই। এক প্রকাণ্ড বিশ্ব আবিষ্কৃত হওয়ার অপেক্ষায় আমাদের আত্মায় লুকিয়ে থাকে। এটা তার সমস্ত অক্ষত শক্তি নিয়ে আমাদের মধ্যে বিরাজিত। কিন্তু এটা এত নতুন এবং এত ক্ষমতাবান যে আমরা এর অস্তিত্বকে স্বীকার করতে ভয় পাই।
আত্ম-আবিষ্কারের কাজটি আমাদেরকে এটা গ্রহণ করতে বাধ্য করবে যে আমরা আমাদের চিন্তার চেয়েও দূরে যেতে পারি। আর এটা আমাদেরকে ভীত করে তোলে। আমরা তখন ভাবি, ভালো হয় কোনও ঝুঁকি না-নিলে। আমরা এও বলতে পারি : ‘আমার যা করা উচিত ছিল আমি তা করিনি কারণ তারা আমাকে তা করতে দেয়নি।’
এটাই বেশ সুবিধার মনে হয়। নিরাপদও বটে। আর একইসাথে এটা তোমার নিজের জীবনকে অস্বীকার করার শামিল।
করুণা তাদের জন্য যারা এ-কথা বলে জীবন কাটিয়ে দিতে পছন্দ করে : ‘আমি কখনও কোনও সুযোগ পাইনি।’
কারণ প্রতিটি দিন চলে যাওয়ার সাথে সাথে তারা তাদের নিজস্ব সীমাবদ্ধতার কুয়োয় তলিয়ে যাচ্ছে। এমন সময় আসবে যখন তারা কুয়ো বেয়ে ওঠার শক্তি পাবে না এবং মাথার ওপর জ্বলজ্বল-করা উজ্জ্বল আলোটি পুনরাবিষ্কারেরও শক্তি থাকবে না।
তবে তারাই আশীর্বাদপ্রাপ্ত যারা বলে : ‘আমি তেমন সাহসী না।’
কারণ তারা জানে এটা অন্য কারও দোষ না। আর আগে হোক পরে হোক, তারা নিঃসঙ্গতা ও এর রহস্যের মুখোমুখি হতে প্রয়োজনীয় বিশ্বাসটুকু ফিরে পাবে।
***
যারা একাকিত্বকে ভয় পায় না, যা সমস্ত রহস্যের ঢাকনা খুলে দেয়, তাদের জন্য প্রতিটি জিনিসই ভিন্ন ভিন্ন রূপ রস নিয়ে হাজির হবে।
যে-প্রেম অন্য সময় অগোচরে থেকে যেত, একাকিত্বের মধ্যে সে-প্রেম তারা আবিষ্কার করবে। যে-প্রেম তাদেরকে ছেড়ে চলে গেছে, একাকিত্বের মধ্যে তারা সে-প্রেমকে বুঝবে ও শ্রদ্ধা করবে।
হারানো প্রেমকে ফিরে আসতে বলা ঠিক হবে কি না, না কি তারা একে এক নতুন পথে চলতে দেবে — নিঃসঙ্গতার কালে এ বিষয়েও তারা সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হবে।
নিঃসঙ্গতায় তারা এটা শিখবে যে ‘না’ বলাটা সবসময় উদারতার অভাবকে প্রকাশ করে না, আর ‘হ্যাঁ’ বলাটা চিরন্তন কোনও গুণও নয়।
আর এই সময়ে যারা একাকী থাকে শয়তানের এ-কথায় তাদের ভয় পাওয়ার দরকার নেই : ‘তুমি তোমার সময়ের অপচয় করছ।’
অথবা দানবপ্রধানের আরো শক্ত কথায়ও ভয় পাওয়া উচিত নয় : ‘কেউই তোমার খবর রাখে না।’
আমরা অন্য মানুষের সঙ্গে কথা বললে স্বর্গীয় শক্তি তা শোনে। তবে আমরা যখন স্থির ও নীরব থাকি এবং নিঃসঙ্গতাকে আশীর্বাদ হিশেবে গ্রহণ করতে সক্ষম হই, তখনও স্বর্গীয় শক্তি তা শুনে থাকে।
আর সেই মুহূর্তে এর আলো আমাদের চারপাশের সবকিছু আলোকিত করে, আমরাও-যে প্রয়োজনীয় এটা দেখতে সাহায্য করে, আর পৃথিবীতে আমাদের উপস্থিতি এর কার্যপ্রণালির মধ্যে প্রচণ্ড পার্থক্য রচনা করে।
আর আমরা যখন সেই সম্প্রীতি অর্জন করি, আমরা যা চাই তারচেয়েও বেশি পেয়ে থাকি।
***
যারা নিজেদেরকে একাকিত্ব কর্তৃক নির্যাতিত মনে করে তাদের এটা মনে রাখতে হবে যে জীবনের সবচে’ তাৎপর্যপূর্ণ মুহূর্তেও আমরা একা থাকি।
একটি শিশু তার মায়ের পেট থেকে আবির্ভূত হবার বিষয়টি ধরা যাক : কতজন লোক উপস্থিত আছে তাতে কিছু যায় আসে না, বেঁচে থাকার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত বাচ্চাটির মধ্যেই নিহিত থাকে।
ধরা যাক শিল্পী ও তার কাজের বিষয়টি : নিজের কাজটিকে প্রকৃতপক্ষে ভালো করার জন্য তার স্থির থাকা ও শুধু দেবদূতদের কথা শোনার প্রয়োজন হয়।
আমাদের সবার কথাই যদি ধরি, আমরা যখন অপ্রত্যাশিত আগন্তুক মৃত্যুর মুখোমুখি হই : আমরা সকলেই আমাদের অস্তিত্বের সেই সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ ও সবচে’ ভীতসন্ত্রস্ত মুহূর্তেও একা থাকি।
ঠিক যেমন প্রেম এক স্বর্গীয় অবস্থা, তেমনি নিঃসঙ্গতাও হলো এক মানবীয় অবস্থা। আর যারা জীবনের অলৌকিকত্ব অনুধাবন করতে পারে, তাদের ক্ষেত্রে ঐ দুটি অবস্থা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে থাকে।