অনিঃশেষ প্রেমকথা । জাকির জাফরান
প্রকাশিত হয়েছে : ০৩ এপ্রিল ২০১৬, ১১:০৫ অপরাহ্ণ, | ১৯৩৯ বার পঠিত
মূল : পাওলো কোয়েলহো ।। প্রকাশিতব্য Manuscript Found In Accra বইয়ের বঙ্গানুবাদ থেকে নির্বাচিত পরিচ্ছেদ ।। তর্জমা : জাকির জাফরান
প্রেমের কথা শুনতে হলে প্রেমকে অবশ্যই কাছে আসতে দিতে হবে।
তথাপিও, প্রেম যখন নিকটবর্তী হয়, আমরা ভয় পাই এটা আমাদেরকে কী বলতে পারে, কারণ প্রেম স্বাধীন এবং আমাদের ইচ্ছা কিংবা কার্য দ্ধারা তা চালিত নয়।
সকল প্রেমিকই তা জানে কিন্তু তা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। তারা ভাবে যে বিনয়, ক্ষমতা, সৌন্দর্য, সম্পদ, অশ্রু এবং হাসির মাধ্যমে তারা প্রেমকে প্রলুব্ধ করতে পারবে।
আসলে প্রকৃত প্রেমই মানুষকে প্রলুব্ধ করে এবং কখনও নিজেকে প্রলুব্ধ হতে দেয় না।
প্রেম পরিবর্তন আনে, প্রেম উপশম করে। তবে মাঝে মাঝে তা ভয়ানক ফাঁদ পাতে এবং যে-ব্যক্তি নিজেকে পুরোপুরি প্রেমের কাছে সঁপে দেয় তাকে ধ্বংস করার মধ্য দিয়েই এর যবনিকা টানে। যে-শক্তিটি বিশ্বকে চলমান রাখে এবং নক্ষত্রমণ্ডলীকে নিজ নিজ জায়গায় অটল রাখে, কি করে তা একইসঙ্গে এত সৃষ্টিশীল ও ধ্বংসাত্মক হতে পারে?
আমরা এটা ভাবতে অভ্যস্ত যে আমরা যা দিই প্রতিদানে সে-রকম কিছুই গ্রহণ করি। কিন্তু যেসব মানুষ ভালোবাসা পাওয়ার আশায় ভালোবাসে, তারা তাদের সময়ের অপচয় করছে।
প্রেম বিশ্বাসের বিষয়, বিনিময়ের নয়।
মতানৈক্য প্রেমকে বেড়ে উঠতে সাহায্য করে। দ্বন্দ্ব হলো সেই শক্তি যা প্রেমকে আমাদের পাশে রাখে।
গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতিগুলো রাখার জন্য জীবন খুবই ছোট। উদাহরণস্বরূপ, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’ কথাটি আমাদের হৃদয়ে তালাবদ্ধ অবস্থায়ই থেকে যায়।
কিন্তু প্রতিউত্তরে সর্বদা একই কথা শুনবে এই আশা করো না। আমরা ভালোবাসি কারণ ভালোবাসাটা আমাদের প্রয়োজন। অন্যথায় প্রেম তার সমস্ত অর্থই হারায় আর সূর্যও আলো দেয়া বন্ধ করে দেয়।
একটি গোলাপ মৌমাছিদের সঙ্গ উপভোগের স্বপ্ন দেখে, অথচ কেউই দেখা দেয় না। তখন সূর্য জিজ্ঞেস করে : ‘তুমি কি অপেক্ষায় অপেক্ষায় ক্লান্ত নও?’
‘হ্যাঁ’, গোলাপ জবাব দেয়, ‘কিন্তু আমি যদি আমার পাপড়িদল গুটিয়ে নেই, আমি আর বাঁচব না, ক্ষয়ে যাব।’
তথাপিও, এমনকি যখন প্রেম দেখাও দেয় না, আমরা এর উপস্থিতির প্রতি উন্মুখ থাকি। মাঝে মাঝে যখন নিঃসঙ্গতা সবকিছুকে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে বলে মনে হয়, তখনও প্রতিরোধের একমাত্র উপায় হলো ভালোবাসতে থাকা।
***
আমাদের জীবনের মহান লক্ষ্য ভালোবেসে যাওয়া। বাকিটা শুধুই নীরবতা।
আমাদের দরকার ভালোবেসে যাওয়া। এমনকি যখন তা আমাদেরকে এমন জায়গায় নিয়ে যায় যেখানে হ্রদ তৈরি হয় অশ্রু দিয়ে – সেই গোপন রহস্যময় স্থান, অশ্রুজলের উপত্যকা!
চোখের জলেরা নিজেদের জন্য কথা বলে। আর যখন আমরা অনুভব করি যে আমরা কেঁদেছি কারণ আমাদের কান্না করা প্রয়োজন ছিল, তখনও অশ্রু বয়ে যেতে থাকে। আর ঠিক যখন আমরা বিশ্বাস করি যে দুঃখের উপত্যকার মধ্য দিয়ে এক দীর্ঘ যাত্রাই আমাদের জীবনের নিয়তি, তখন অকস্মাৎ চোখের জলও হাওয়া হয়ে যায়।
কারণ অনেক বেদনা সত্ত্বেও আমরা আমাদের হদয়কে উন্মুক্ত রাখতে পেরেছি।
কারণ আমরা অনুধাবন করতে পেরেছিলাম যে, যে-মানুষটি আমাদের ছেড়ে চলে গেল, সে সূর্যকে তার সঙ্গে নিয়ে চলে যায়নি কিংবা সে-জায়গায় অন্ধকারও ফেলে রেখে যায়নি। তারা কেবলি চলে গেছে, আর প্রতিটি বিদায়ের সাথে সাথে জন্ম নেয় লুকায়িত আশা।
কখনও ভালো না-বাসার চাইতে ভালোবেসে হেরে যাওয়া অনেক ভালো।
***
আমাদের এক প্রকৃত পছন্দ হলো সেই অদম্য শক্তির প্রহেলিকার মধ্যে ঝাঁপ দেওয়া। আমরা বলতে পারি : ‘আমি আগে অনেক কষ্ট করেছি, এবং আমি জানি যে এই কষ্ট আর থাকবে না’, আর এতে করে আমরা ভালোবাসাকে আমাদের দরোজা থেকে তাড়িয়ে দেই। কিন্তু আমরা যদি তা করতাম আমরা জীবনের প্রতি নিশ্চেতন হয়ে যেতাম।
কারণ প্রকৃতি হলো ঈশ্বরের প্রেমের বহিঃপ্রকাশ। আমরা কি করি না-করি তার হিসেব না নিয়েও প্রকৃতি আমাদেরকে ভালোবেসে যেতে থাকে। সুতরাং আমরাও চলো প্রকৃতি যা শিক্ষা দেয় তাকে সম্মান করি ও বুঝতে চেষ্টা করি।
আমরা ভালোবাসি কারণ ভালোবাসা আমাদেরকে স্বাধীনতা দেয়। আমরা এমনসব জিনিস বলতে শুরু করি একদা যা নিজেদেরকে কানে কানে বলার সাহসটাও আমাদের হতো না।
আমরা সেসব বিষয় নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারি যেগুলো এতদিন আমরা মন থেকে সরিয়ে রেখেছিলাম।
‘না’ বলতে শিখি আমরা, অনেকটা এ-শব্দটির অভিশাপ সম্পর্কে চিন্তাভাবনা না করেই।
আমরা ‘হ্যাঁ’ বলতেও শিখি এর পরিণতিকে ভয় না পেয়ে।
প্রেম সম্পর্কে যা-ই আমাদের শেখানো হয়েছিল তার প্রতিটি পাঠই আমরা ভুলে যাই। কারণ প্রতিটি সাক্ষাৎই স্বতন্ত্র। প্রতিটি সাক্ষাৎই এর নিজস্ব যন্ত্রণা ও আনন্দ বয়ে আনে।
ভালোবাসার মানুষটি যখন অনেক দূরে থাকে আমরা তখন উচ্চস্বরে গান গাই, আর যখন সে কাছে থাকে আমরা তখন গুনগুন করে কবিতা আওড়াই। যদিও প্রেমাস্পদ না শোনে আমাদের গান, না মনোযোগ দেয় আমাদের কবিতার প্রতি।
আমরা মহাবিশ্বের প্রতি আমাদের চোখ বন্ধ করে অভিযোগ করি না : ‘এটা অন্ধকার।’ আমরা আমাদের চোখ খোলা রাখি এ-কথাটি জেনে যে আলো আমাদেরকে স্বপ্ন-না-দেখা কাজগুলো করতে তাড়িত করতে পারে। এর সবই প্রেমের অংশ।
আমাদের হৃদয় ভালোবাসার জন্য উন্মুক্ত এবং আমরা কোনো ভয়ভীতি ছাড়াই এর কাছে আত্মসমর্পণ করি। কারণ আমাদের হারানোর বেশি কিছু নেই।
তারপর বাড়ি যাই আমরা। আমরা দেখতে পাই কেউ সেখানে আমাদের জন্য প্রতীক্ষা করছে। আমরা যা খুঁজছিলাম সেও তা-ই খুঁজছিল, আর আমাদের যেমন দুশ্চিন্তা ও আকাঙ্ক্ষা হচ্ছিল তারও তেমনই হচ্ছিল।
কারণ প্রেম হলো জলের মতো যা মেঘে পরিণত হয় : প্রেম স্বর্গে আরোহন করে যেখানে তা প্রতিটি জিনিসকেই একটা দূরত্ব থেকে দেখতে পায়, আর এটাও জানে যে, একদিন, তাকে এই ধরণীতে ফিরে আসতে হবে।
কারণ প্রেম হলো মেঘের মতো যা বৃষ্টিতে রূপান্তরিত হয় : এটাকে পৃথিবীতে আনয়ন করা হয় যেখানে তা বিস্তীর্ণ প্রান্তরকে জলসিক্ত করে।
প্রেম হলো একটি শব্দ মাত্র, যতক্ষণ-না আমরা এটাকে তার সমস্ত শক্তি দিয়ে আমাদেরকে অধিকার করে নিতে দেই।
প্রেম কেবলি একটি শব্দ, যতক্ষণ-না কেউ এসে একে অর্থবহ করে তোলে।
হাল ছেড়ে দিও না। মনে রেখো, চাবির ঝুটার সর্বশেষ চাবিটাই সবসময় দরোজা খোলে।