আমার ঘৃণার কোন অশ্রু নেই । রাজিয়া নাজমী
প্রকাশিত হয়েছে : ১০ নভেম্বর ২০২৩, ৪:০৩ অপরাহ্ণ, | ৩১৪ বার পঠিত
টিভি বন্ধ করো না। ভয় করো না আমি কাঁদবো না।
আমি বেশ বুঝি মিথ্যে খবর পড়ে যাচ্ছে যে নিউজম্যান
সে ব্রুকলিন,কিংবা প্যারিসে থেকেছে চিরকাল,
সাইরেন আর জ্যাজ মিউজিকের আওয়াজের তফাৎ সে জানে না।
আমি ওকে তাই ঘৃণা করি না।খাকি পোশাকে হিরহির করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে
যে ছেলেটিকে তাঁকে দেশপ্রেমিক না বলে দেশদ্রোহী
বলছে বলে আমি দুঃখ পাই না।উদ্বাস্তু আমি শতশত বাড়িতে মাথা গুঁজেছি একটি বাড়ির অভাবে।
আমার যে কোন সমস্যা নেই আর। অ্যাসাইলাম পেয়ে আমি বেশ আছি।
আমার পকেটে লিখিত অনুমতি, আমাকে কেউ তাড়াবে না।
আমি তাই অ্যামেরিকার উপরে রাগ করি না।
কিছু প্রাণ নেবে কিছু প্রাণ উদ্বাস্তু হয়ে
আমার মত ওরাও পাবে আশ্রিতের ঠাই।
খেলার মাঠ, সিনেমা হল এমনকি পার্কে
আমি সারাদিন চিত হয়ে শুয়ে থাকতে পারি।টিভিটা বন্ধ করো না।
ধ্বংসস্তূপের নিচে যেটুকু মাটি দেখা যায় আমাকে দেখতে দেও।
দেখো, কত দামী এই মাটি। ছয় হাজার মাইল দূরে থেকেও গোলাবারুদের ব্যারেল যায়।
যায় আমারই মাথার উপরে দিয়ে।
ট্যাঙ্কের গায়ে নুরী পাথর ছোড়ার অপরাধে গুলিবিদ্ধ চোখ দেখে ওদের অট্টহাসি।
শতশত প্রাণের রক্তে ভেজা মাটির উপরে দখলদারের পতাকা ওড়ে।টিভি বন্ধ করো না। ভয় করো না আমি কাঁদবো না।
আমার সব সহ্য হয়ে গেছে। আমার বংশধরদের সন্ত্রাসী খেতাবে
গ্রেফতার করার দৃশ্য আমাকে কাঁদায় না।বহু দেশ ঘুরে আমি এদেশে এসেছি।
অকৃতি অধম আমাকে এদেশ কম কিছু তো দেয়নি।
আমার আর কোন সমস্যা নেই।
টিভি বন্ধ করো না।
আমার চোখের পানি একজন রিফিউজির। আমার নয়।আমার প্রার্থনা ওদের পছন্দ নয়। আমার পতাকা ওদের পছন্দ নয়।
বিশৃঙ্খলাবাদী নামে আমাকে ওরা তাড়া করেছে।
আমি মার খেতে চাইনি। হামাগুড়ি দিয়ে নিঃশব্দে দেয়ালের পিছে,
গুলিবিদ্ধ লাশের নিচে লুকিয়ে থেকে লাশ হতে চাইনি।আমি সন্তানের লাশ পিঠে নিয়ে বাড়ি যেতে চেয়েছি।
কিন্তু বাড়ির দরোজায় জল্লাদের মুখ। ঘর গোলাবারুদের গুদামঘর
আমার স্ত্রী ওদের অধিকারে।আমি তাঁর চিৎকার শুনেছি।আমি সব পিছে ফেলে হেঁটেছি, পোড়া রাস্তায়,মরুভূমির তপ্ত বালুতে,
সমুদ্রের ঢেউয়ের মধ্যে হেঁটে যাওয়া নৌকায়,আমি ডুবেছি, ভেসে উঠেছি।
আমি ভিক্ষা করেছি একটুকরো রুটির জন্য।
আমি তৃষ্ণা মিটিয়েছে শরীর থেকে নিঃসৃত পানি পান করে।আমি চাইনি, আমার জমির চেয়ে নিরাপদ কোন আশ্রয়ের খোঁজে,
ট্রেনে,বাসে,ট্রাকের পেটে লুকিয়ে অজানা সীমান্তে এসে অপেক্ষায় থেকে,
নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে ধরা পড়তে।
তবুও নোংরা কাপড়ে, ক্ষুধার্ত আমি হাত মাথার উপরে তুলে হাঁটু গেড়ে
অপেক্ষা করেছি আমেরিকার সীমান্তে আশ্রয় ভিক্ষায়।আমি আকাশের বুক চিরে গোলাবারুদের প্লেনের আওয়াজ শুনে
চোখের পানি শুখনো জিভ দিয়ে শুষে নিয়েছি।
কেননা আগুনে পোড়া আমার জন্মভূমির চাইতে কারাগার নিরাপদ।
কারারক্ষীর দুর্বোধ্য ভাষা আমার পেটে খাবারের আশ্বাস দেয়।
আমি তাই ওদের চোখের আর কোন ভাষা পড়তে চাইনিআমার আরব ঘামের গন্ধে ওঁর নাক চেপে ধরলেও আমি অপমানিত বোধ করিনি।
ধ্বংসস্তূপের নিচে পড়ে থাকা হাড়মাংস পচা গন্ধে বেঁচে থাকা আমি।
জালিমের বুটের লাথির চেয়ে,সন্তানের বিচ্ছিন্ন শরীর কোলে নিয়ে বসে থাকার চেয়ে
এই অপমান সয়ে নেওয়া সহজ। আমি সব সহ্য করেছি। সব অপমান তুচ্ছ করেছি।
বেঁচে থাকার জন্য নির্বাসিত আমি আমার অহংকার নির্বাসন দিয়েছি।
টিভি বন্ধ করো না। আমার ঘৃণার কোন অশ্রু নেই।