প্রকাশ করা সম্ভব নয় বলেই । রাজিয়া নাজমী
প্রকাশিত হয়েছে : ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ৬:০৪ পূর্বাহ্ণ, | ৫৪৬ বার পঠিত
রমজানের ঘরের দরজায় টোকা দিতে গিয়েও থেমে গেলো আলমগীর। কদিনধরে জ্বরে ভোগা রমজান’কে গতকালই সে বাড়িতে রেখে গেছে। দ্বিতীয়বার টোকা দেওয়ার আগেই, রমজান দরজা খুলে বললো , জানলা দিয়ে দেখলাম তুমি দাঁড়ায়ে আছো। ভিতরে আসো।
আলমগীর একটু দ্বিধা করেই বললো, না-রে রমজান একটা কাজে আমাদের যাইতে হবে। তর শরীরে কুলাইলে চল আমার সাথে। পারবি?
রমজান উত্তরও দিলো না, বাড়তি কোন প্রশ্নও করলো না। অনেকটা নির্লিপ্তভাবেই বললো, সময় থাকলে আসো চা খাই, তারপর যাই।
আলমগীর মাথা নেড়ে বললো , আচ্ছা, তয় খুব দেরি করা যাইব না।
সতেরো ডিসেম্বরের শীতের সকাল— বিজয়ের উত্তাপের আগুনে পোহানো সকালে দুই মুক্তিযোদ্ধার হাতে চায়ের পেয়ালা, মাথা নিচু, মুখে আনন্দের মাঝেও বিষাদের ছায়া। স্বজনদের পাপের বিরুদ্ধে লড়াই করে বিজয়ের আনন্দের মাঝে কিছু ব্যর্থতা, কষ্ট আলমগীর মেনে নিলেও রমজান পারে নাই।
আলমগীরের দলের সবচেয়ে শক্তিশালী মুক্তিযোদ্ধা রমজান। যার তীব্র নিষ্ঠা ও দৃঢ়তা ছিল সবার জন্য অনুপ্রেরণার। সবার প্রিয় রমজান আজ এক গভীর দুঃখে ডুবে আছে— একটি হত্যায়। বিশ্বাসঘাতকতা দূরের কারো কাছ থেকে নয় এসেছিল ওর প্রিয় বন্ধুর কাছে থেকেই। বন্ধুকে হত্যা করার পরে রমজান কিছুতেই মানতে পারছিলো না; তার বন্দুকের নলের আগা বসে আছে শৈশবের সাথীর বুকে!
আলমগীরের ভীষণ মায়া হলো রমজানের জন্য— কেমন বদলায়ে গেলো তার বন্ধুটা । অথচ যুদ্ধের এত অনিশ্চয়তার মধ্যেও হাসিখুশি থাকতো । আজকাল ওর মুখে কোন হাসি নাই। সে আবার জিজ্ঞাসা করলো, রমজান,তুই যাইতে পারবি? শরীর তো মনে হয় এহনো দুর্বল।
খালি চায়ের পেয়ালা হাতে নিয়ে ঘরে যেতে যেতে রমজান বললো, তুমি বহ, আমি জামাটা পাল্টায়ে আইতাসি।
মিনিট বাদে রমজান ফিরে আসতেই আলমগীর তার হাতে ধরা সিগারেট রমজানের দিকে বাড়ায়ে দিয়ে বললো, চল যাই এবার।
রমজান ওর ঝাঁকড়া চুলে গামছা বেঁধে বললো, চল ।
আলমগীরের পিক-আপ ভ্যানের পিছনে আরও দুজন সহযোদ্ধা এসে বসলো।
শীতের হালকা কুয়াশা ঠেলে সূর্য উঠছে । খোলা রাস্তা ধরে আজ গাড়ি চলছে— নিশ্চিন্তে নির্ভয়ে। আলমগীরের পাশে রমজান বসে আছে এমনভাবে যেন তার কোলের উপরে রাখা ঠাণ্ডা বন্দুকের নল আবার গর্জে উঠবে বিশ্বাসঘাতকের বুকে— সে যেই হোক!
রমজান হঠাৎ করেই বিড়বিড় শুরু করলো— শুরু আস্তে করলেও ভিতর থেকে কেঁপেকেঁপে ওঠা রমজানের আকুতি আর চুপসারে থাকলো না। যেন জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকে চলছে সে।
চোখের পানি মুছতে মুছতে বলেই চললো— নয়মাস— মাত্র নয়মাসে একটা যুদ্ধ শেষ! কিন্তু ক্ষয়ক্ষতি? ক্ষয়ক্ষতির হিসাব মেলান যাইবো কোনদিন? এই এত্তজন যুদ্ধে গেলাম— কয়জন ফিরলাম আর কত্তজন মরলো ! এর কোন ঠিক হিসাব হইবো? দ্যাশের মধ্যে আর যে কতকিছু ঘটলো, ঘরের মাইয়ারা মিলিটারির হাতে বন্দী হইলো। অসহায় মাইয়াগো ইজ্জত নিলো। কাউরে রাইখ্যা দিলো আবার কত্তজনেরে ব্যবহার কইরা কাইটাছাইট্টা রাস্তায় ফালায়ে দিছে,
ঘরের মধ্যেই স্বামী বাপ ভাই পোলাপানের সামনে ইজ্জত কাড়ছে— এর কি কোন হিসাবে কেউ রাখছে?
বাড়িঘর পুড়ছে— কত্ত বাড়ি! হিসাব মিলবো না! কোনদিন মিলবো না।
ছোটছোট বাচ্চাগুলারেও হারামখোররা ছাড়ে নাই। বেয়নেটের গুঁতায় শেষ করছে। পোয়াতির পেট কাইটা বাচ্চা ফালায় দিছে। বুড়া, জোয়ান ব্যাটা লাইনে দাঁড়াইয়া গুলিতে ঝাঁজরা হইয়া মাটিতে পড়ছে— গণকবরে গ্যাছে কতজন! ফাঁকেজোকে দুইচার জন বাঁচলেও ল্যাংড়া-লুলা হইয়া ফেরত আইছে – হিন্দু মুসলমান কি খ্রিস্টান, সক্কলে!
বানের পানির লাহান মানুষ ইন্ডিয়াতে গ্যালো— শরণার্থী! ভিটামাটির মায়া ত্যাগ কইরা হইয়া গ্যালো শরণার্থী। যতলোক গ্যালো- তারা কি সবাই ফেরত আইবো? না রইয়া যাইবো, কতজন যে মরছে ওইখানেও, সেই হিসাব কেমনে হইবো?
আহারে জান, জান বাঁচাইতে হিন্দুরা বুড়ো বয়সে খৎনা করাইয়া মুসলমানের নমুনা দেখাইছে বেবাক মানুষের মধ্যে লুঙ্গি, প্যান্ট খুইলা। গীতা শ্লোক বাদ দিয়ে পাঁচ কলেমা মুখস্থ করছে- এই পাপ কেমনে দূর করবো?
অ্যাই রমজান চুপ করবি? সেই তখন থিকা এক প্রলাপ বকে যাইতেছিস। দ্যাশ কেবল স্বাধীন হইলো— একদিন যার বয়স, তার ক্ষয়ক্ষতির হিসাব আছে না পানিতে গেছে সে দেখনের সময় গেছে?
মায়ের পেটে থিকা বাচ্চা বাহির হওয়ার সাথে সাথে কি কওয়া যায় বাচ্চা বড় হইয়া খাটি সোনার মত হইবো না, শয়তানের লাটি হইবো। নাকি বাচ্চা মায়ের পেটে থাইকা বাইর হবার পরেই বোঝা যায় এই নয়মাসে মায়ের শরীরের কি ক্ষতি হইছে! সব ধীরে ধীরে বাইর হয়। মাথা ঠাণ্ডা কর ভাই।
আলমগীর তার পাশে বসা রমজানের কাঁধে হাত দিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করলো।
রমজান বরাবরই ক্ষ্যাপাটে ধরনের ছিলো তবে ওর মন বড় বেশি মায়ায় ভরা। পাকসেনাদের মেরেও সে কাঁদতো আর বলতো, কেন তগোরে মারতে হইলো? কেন, কি দোষে আমাগো মারতে আইলি। নিজের দেশ কইয়া আবার সেই দেশের লোকের বুকে বেয়নেট দিয়ে ফালাফালা করলি…।
রমজানের বিলাপ চুপ হয়ে গেলেও দুইগাল বেয়ে চোখের পানি পড়ছে— চারদিকের পোড়া ঘরবাড়ি দেখে। গাড়িতে বসা বাকি সঙ্গীরা রাস্তার দুইধার ধরে অগুনতি লোকের উল্লাসে সারা দিয়ে ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে রক্ত লাল, রক্ত লাল, রক্ত লাল জোয়ার এসেছে জন-সমুদ্রে ‘ গান ধরেও রমজানের বিলাপে চুপ মেরে গেলো।
রমজানের বিলাপ কি বিলাপ নাকি ও কিছু আগাম দেখতে পারছে— এ কি রমজানের জোরালো ষষ্ঠেন্দ্রিয়! সোজাসরল সহযোদ্ধা রমজানের দিকে তাকিয়ে ওদের একটু যেন একটু ভয় লাগলো। জীবন বাজী রেখে যুদ্ধ করে যে দেশ স্বাধীন করলো— তার সবকিছু ঠিক থাকবে তো!
আলমগীরের বাড়িয়ে দেওয়া হাত না ধরে সে মিনতি করে বললো , আমি বাইরে যাব না । আমারে মাইরা ফেলেন। আলমগীরের সামনে সম্পূর্ণ উলঙ্গ শরীরে সে দাঁড়াতেই, চোখে পড়লো তার গোপন অঙ্গে ধর্ষণের কাটাছেঁড়া আলামত। পায়ুপথ থেকে রক্ত গড়িয়ে অত্যাচারের চিহ্ন শুকিয়ে আছে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত। হাতে পায়ে, গলায়, বুকে, সিগারেটের পোড়া দাগ। যেন ওর শরীরটাই ছিল সিগারেটের ছাইদানি।
আলমগীর গাড়িতে বিজয়ের পতাকা উড়িয়ে তার চার সহযোদ্ধাদের নিয়ে চলছে গ্রামের পথ ধরে। ক্ষয়ক্ষতির হিসাবে প্রথমেই তাদের কাজ শুরু হলো আর্মির হাতে বন্দিদের উদ্ধার। মা-বোনদের উদ্ধার।
আলমগীরের আজ বাড়ি ফিরে যাবার কথা ছিল। কমান্ডারের হুকুম আসায় বাড়ির পথে যাওয়ার বদলে চলছে সে অজানা গ্রামের এক কলেজে মিলিটারিদের খালি ক্যাম্পে।
আধা-উন্নত গ্রামের এক কলেজের সামনে ওদের গাড়ি এসে থামতেই লোকজন ওদের ঘিরে ধরলো। কেউ জানে না মিলিটারিদের কবলে থাকা কলেজের ভিতরে কি অবস্থা। কেউ ভিতরে ঢুকতে সাহস করছে না।
আলমগীররা সবাইকে সরিয়ে কলেজের একতলা দোতলায় একটা একটা করে রুমের তালা ভেঙে ভেঙে ছিন্নভিন্ন অবস্থায় পড়ে থাকা একেকজনকে তুলে আনলো। কাউকে কাউকে কোলে তুলেই আনতে হয়েছে ওদের।
সবাইকে বের করার আনার পর, সঙ্গীদের কিছু না বলে, আলমগীর একাই আবার ফিরে গেলো দালানের ভিতরে। তারা তো সবগুলো রুম চেক করেছিলো। তবু যেন
শেষবারের মত বের হয়ে আসার সময় সে একটু অন্যরকম আওয়াজ শুনতে পেয়েছিল। সন্দেহটা উড়িয়ে না দিয়ে আলমগীর মনে মনে ভাবলো, নাহ; আরও কয়েকটা রুম তল্লাসি করা দরকার। বলা যায় না আরো কোন মাইয়ামানুষ আধমরা হইয়া পইড়া আছে কিনা কোন রুমে। হারামখোরের জাত কি টর্চার না করছে একেকজনের শরীরে।
ভাঙা বোতল আর রক্তাক্ত ছেঁড়া কাপড় জুতা দিয়ে সরাতে সরাতে আলমগীর আবারও একেক দরোজার কপাট খুলে উঁকি দিতে দিতে বললো , মা বোনরা ভয় নাই— বাহির হয়ে আসেন । হাত পা বাধা থাকলে ডাক পারেন।
আবারো একটা আওয়াজ, একটা মিহি কান্নার আওয়াজ ভেসে এলো। কলেজের এতগুলো রুম— সে কিছুতেই ঠাহর করতে পারলো না কোথা থেকে কান্নার আওয়াজ আসলো । সে কান পাতলো। এবার তার সন্দেহ সত্যি মনে হলো। একটা কান্নার আওয়াজ সে শুনছে।
সাধারণত মিহি কান্নার গতি অনেকক্ষণ ধরে চলে। কিন্তু এটা তেমন না। কেমন অনেকক্ষণ পরে পরে একফোঁটা চুইয়ে পড়া বৃষ্টির পানির মত। আলমগীর এবার দুহাত মোনাজাতের মত করে মুখে চেপে আবার বললো , মা বোন বাহির হইয়া আসেন, নয় আরো জোরে আওয়াজ করেন। একটা কিছু দিয়া জোরে জোরে শব্দ করেন। আমি আপনাদের ছেলে, ভাই। আমি আপনাদের এই দোজখ থেকে উদ্ধার করতে আসছি। আওয়াজ করেন।
আলমগীরের আবেদন শেষ হলে, অনেকক্ষণের চুপচাপ নীরবতা ভেঙে ঠাস-ঠাস করে আওয়াজ এলো।
আলমগীরের যেদিক থেকে এতক্ষণ বাকিদের উদ্ধার করেছিলো তার উল্টোদিক থেকেই মনে হয় আওয়াজ আসছে। সে পা না তুলেই একটা ঘুরানি দিয়ে আবার কান পাতলো; বললো, আবার আওয়াজ করেন। জান দিয়ে আওয়াজ করেন, থামবেন না। আওয়াজ করতে থাকেন।
ঠাস-ঠাস-ঠাস, আওয়াজের সুরে সুরে তার পা চলল— যত যাচ্ছে ঠাসঠাস শব্দের আওয়াজ তত বাড়ছে। একবারে বারান্দার শেষমাথা ঘুরে অন্যদিকে একটি ঘরের সামনে এসে সে থামল। বাহির থেকে তালা দেওয়া নয়। ভিতর থেকে তালা দেওয়া এই ঘর থেকেই আওয়াজ আসছে। আলমগীরের কাছে ব্যাপারটা পরিষ্কার— আর্মিরা এই ঘরের ভিতরের অন্য কোন দরজা ব্যবহার করেছে বিশেষ গোপনীয়তার জন্য।
বন্ধুকের বাট আর তার পিঠের ধাক্কায় দরজার একপাল্লা মেঝেতে সটান। পড়ে গেলো। ঘরে কোন আলো নেই— সে কাউকে দেখতে পাচ্ছে না— কাগজের খসখস শব্দ ছাড়া আর কোন আওয়াজ নেই। সে এবার বন্ধুকের ট্রিগারে হাত রেখে কোমলস্বরে বললো, মা বোন; আর কোন ভয় নাই -উঠে আসেন।
না; কেউ উঠে দাঁড়ালো না। খসখস শব্দই আরো বেড়ে গেলো। আলমগীর তার সিগারেটের লাইটার জালিয়ে ঘরের সুইচ অন করতেই যা দেখলো তা দেখার কথা সে এই জন্মে কেন, কোন জন্মেই বোধ হয় ভাবতে পারতো না।
এতক্ষন ধরে যে ঘর সে খুঁজছে , সেই ঘরেই এখন সে দাঁড়িয়ে আছে। সে দেখলো, যুগ যুগের বস্তা বস্তা পরীক্ষার খাতা, ফাইল রাখার গুদামঘরের এক কোণায় বসে আছে একজন— হাতে পরীক্ষার খাতা নিয়ে। তখনও সেই খাতা দিয়ে ঠাসঠাস শব্দ করে যাচ্ছে।
আলমগীর পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলো। হাঁটু গেরে বসে পড়লো থরথর করে কাপতে থাকে একটি মানুষের সামনে। দুইহাঁটুর উপরে তার থুতনি রেখে চেয়ে আছে তার উদ্ধারকারীর দিকে। দুইচোখ থেকে জলের ধারা গরিয়ে পড়ছে ফোলা ঠোঁটের উপরে।
অন্যদের উদ্ধার করতে যত তাড়াতাড়ি পেরেছিল আলমগীর,তারচেয়ে একটু বেশি সময় লাগলো লজ্জায় নুয়ে থাকা শরীরকে দুইহাত বাড়িয়ে দিয়ে তুলে নিতে।
নিজেকে সামলে নিয়ে আলমগীর ওর মাথায় হাত দিয়ে বললো ,আর আওয়াজ করতে হবে না, ওঠো…
আলমগীরের বাড়িয়ে দেওয়া হাত না ধরে সে মিনতি করে বললো , আমি বাইরে যাব না । আমারে মাইরা ফেলেন। আলমগীরের সামনে সম্পূর্ণ উলঙ্গ শরীরে সে দাঁড়াতেই, চোখে পড়লো তার গোপন অঙ্গে ধর্ষণের কাটাছেঁড়া আলামত। পায়ুপথ থেকে রক্ত গড়িয়ে অত্যাচারের চিহ্ন শুকিয়ে আছে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত। হাতে পায়ে, গলায়, বুকে, সিগারেটের পোড়া দাগ। যেন ওর শরীরটাই ছিল সিগারেটের ছাইদানি।
আলমগীর কোন প্রশ্ন করেনি, তবু বোধহয় তাঁর চোখে প্রশ্ন ছিলো আর সে তাই মাথা নিচু করে বলল, দুইজন আর্মি আমারে…।
আলমগীরের এবার আর বুঝতে বাকি রইলো না কেনো ওকে সবার চোখের আড়ালে এই ঘরে একা রেখেছিলো। কারণ, আর্মির নিয়মে সমকামী, উভকামিদের আর্মিতে জায়গা নেই। এবং এটা জানলে তাদের কোর্ট মার্শালে বিচার হবে। তাই এইটুকু একটা ছেলেকে একটা গুদামঘরে লুকিয়ে রেখেছে অন্য কোন অপরাধের নাম দিয়ে।
ছেলেটির এখন গোঁফ পুরুষ হয়ে ওঠে নাই। বয়ঃসন্ধিকালের কণ্ঠস্বর! লজ্জায় ঘৃণায় দুহাত দিয়ে শিশ্ন আড়াল করে গুমরে গুমরে কেঁদে কেঁদে বললো, ভাইজান আমারে মারেন, মাইরা ফালান, আমি সক্কলের সামনে যাইতে পারুম না। ভাইজান আমারে বাইরে নিয়েন না…।
আলমগীর ওর এই আকুতির কারণ অস্বীকার করতে পারে না। ডিসেম্বরের ঝকঝকে রোদের আকাশ। বাইরে লোকে লোকারণ্য। তাদের সামনে একদল ধর্ষিতা মা-বোন বসে আছে বাড়ি ফেরার অপেক্ষায়— যদিও তাঁরা জানে না পরিবারে তাদের আর ঠাই হবে কিনা। তবে, সংসার এদের না মানলেও সকলেই জানে গোটা দেশ জুড়ে শতশত মেয়েদের ইজ্জত লুণ্ঠিত হয়েছে— বাড়ির মেয়েরা মিলিটারি ক্যাম্পে মাসের পর মাস বন্দী ছিল। এদেরকে তাই সকলের সামনে বের করে আনতে আলমগীরের কোন দ্বিধা হয়নি।
কিন্তু দিনের পর দিন গোপনে দুইজন পাক সেনাদের দ্বারা ধর্ষিত একটি কিশোর ছেলেকে সে ওদের সাথে কেমন করে এক কাতারে বসাবে?
হঠাৎ বিদ্যুৎচমকের মত তার মাথায় কেউ যেন লিখে দিলো সহজ একটি উপায়। আলমগীর নিজের গায়ের সোয়েটার খুলে দিয়ে বললো, আমি রাতের আঁধারে আইসা তোমার বাড়িতে তোমারে নিয়ে যাব। ভয় কইরো না। কেউ জানবে না। কেউ বুঝতে পারবে না!
শোনো ভাই, এই কাজ তামাম দুনিয়ার অনেক ছেলেদের সাথে ঘটে, যুদ্ধে ঘটে, এমনি ঘটে। ছেলে বইলা তাগো কথা কেউ জানতে পারে না। মাইয়াগো উপরে অত্যাচারের নিশানা দেখা যায়। পুরুষলোকর বোঝা যায় না। তাই বলে আমাগো সাথে এমন হয় নাই কোনদিন, এইটা তুমি ভাইবো না।
ছেলেটির মাথায় হাত রেখে আলমগীর আবার বললো, এতে তোমার কোন দোষ ছিল না। যেমন দোষ নাই আমাদের মা বইনদের।
আলামগীর মনে মনে ভাবল, তফাৎ এই যে মা বইনদের দোষ না থাকলেও তাগো সারা জীবন এই নির্যাতনের জের টানতে হবে। মা বইনের ইজ্জত একবারে গেলে যে আর ফেরত আসে না। সংসারে তার মান আর বাড়ে না।
আলমগীর ছেলেটির চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো, তুমি চিন্তা কইরো না । তোমার কথা কেউ জানব না । এইটা যে জানান সম্ভব না। যা হয়ে গেছে তা মন থাইকা ঝাড়া দিয়ে নতুন করে বাঁচবা।
ধইরা নেও আমরা অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ করছি আর মা বইনের মত তুমি করলা ইজ্জত দিয়া। মনে কর যে যার জান— জীবন দিয়ে যুদ্ধ করছি নিজেগো স্বাধীন করতে। মনে রাখবা এখন আমরা স্বাধীন— এখন তুমি স্বাধীন।
আলমগীর উঠে দাঁড়াতেই ছেলেটি তার হাত ধরে বললো, আমি কই যাবো? মিলিটারি আমার বাবা মা সবাইরে মাইরা ফালাইছে। আমাগো গ্রাম জ্বালায় দিছে। আমি কই যাবো? আমারে কার কাছে নিয়ে যাবেন?
আলমগীর ঘুরে তাকায় একটা নিষ্পাপ মুখের দিকে, বলে, গায়ে সোয়েটারটা দিয়ে ঘুমাও— আমি সবার আড়ালে তোমারে নিতে আসবো।