কথা একবার এবং শেষবার? । পলাশ দত্ত
প্রকাশিত হয়েছে : ০১ মে ২০২৩, ৭:০৬ অপরাহ্ণ, | ৬৪৬ বার পঠিত
কোনও মানুষ কবিতা লেখে কখন?
কেউ যদি আমাকে,
আমারই শরীর ছেনে, নিয়ে যায় ছিঁড়েআমি কিছু বলবো না!
আমারই শরীর ছেনে
কেউ যদি আমাকে ছিঁড়ে নেয়আমি কিছু বলবো না!!
ওপরের কথাগুলো আসলে কবিতা নয় কখনওই? কিন্তু এগুলো কবিতাই! তা আমরা জানি। এই কথাগুলো লেখা হয় প্রত্যাপমানের সুর শুনে, কণ্ঠ শুনে। শাহবাগ আজিজ কো-অপারেটিভ সুপার মার্কেটের কোনও এক তলায় কোনও ছেলের গায়ে ধাক্কা লেগেছে কোনও মেয়ের। হইচই। হইচই। প্রায় সবাই ছেলেটির পক্ষে। আমিও জানতে চাইলাম একজনের কাছে: হ্যাঁ, ধাক্কা তো লাগতেই পারে কোনও একজন মানুষের সাথে আর একজন মানুষের! তাহলে কী প্রয়োজন আছে মেয়েটির এতো উত্তেজিত হওয়ার? জানলাম পূর্ববর্ণ। জেনে, মনে মনে, ভুল মনে, আমিও ছেলেটির পক্ষেই গেলাম/গিয়েছিলাম।
শুধু চলে আসবার মুহূর্তে দূরে দাঁড়িয়ে দূর থেকে শুনতে পেলাম: কেউ আমার শরীরে হাত দিলে আমি কিছু বলতে পারবো না?— এই বাক্যটির শেষে বিরামের ওই চিহ্নটি আমার আরোপিত। আমি জানি না, আমি জানি নি, কী ছিল মেয়েটির কন্থে?—প্রশ্ন/ঘৃণা/বিস্ময়, নাকি সমস্তই? কিন্তু, ওই শব্দগুলোই আমাকে বুঝিয়ে দিলো আমি ভুল, আমি কতো ভুল। আমি বিস্মিত হই, কী করে আমি এবং আমরা না-ভেবেই, না-জেনেই ছেলেটির পক্ষে চলে যাই/গিয়েছি? ওই কন্থ/মুখ আমাকে তাড়া করতে থাকে আমাকে জুড়ে। কেউ আমার শরীরে…। কেউ আমার শরীরে…
আমরা বুঝে নিই যে, এই ‘আমরা’ হচ্ছি আমরাই, যখন যারা যারা আছি, যখন যারা যারা থাকি, যখন যারা যারা থাকবো, তারা; তারা সবাই। কিন্তু, পাঠক, মানুষকে, কোনও মানুষকেই তো নিজেদের সমস্ত সত্যিকথা বলি না আমরা মানুষেরা। আমাদের সবারই অনেকগুলোই মুখ। মুখ মানে জীবন হে পাঠক, যাপিতজীবন। এক একটি মুখে আমরা এক একটি জীবন যাপন করি। নমস্যপাঠক, যদিও আপনি সমস্তই জানেন, তবুও জানতে চাইতে পারেন যে, ‘জীবন’ আবার এক একটি হয় কী করে? আসলে, পাঠক, জীবন এক একটিই, মানে অনেকগুলো।
আমার কালের আরও কেউ আরও কোনও সময়ের কোনও-না-কোনও মুহূর্তে এইভাবে সামগ্রিক সমস্তঅভিজ্ঞানদের কি দেখেন নি, শোনেন নি? শুনেছেন সবাই। দেখেছেনও। কিন্তু, কোথায়, আমাদের কবিতায় সেই সমস্তসময়েরা কোথায়? কবিতাকে ধরে বেঁধে লেখা যে যায় না সে-কথা আমরা জানি, কিন্তু ওই যে বলে, অভিজ্ঞান থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসা প্রক্ষেপ, অভিক্ষেপ কই? পাই না তো আমাদের কবিতায়!
কিছুতেই ক্ষতি নেই কোনও?
প্রাজ্ঞ মাত্রই মূক— কথাটির মূল ইংরেজি। কথাটি কার? সে-কথা জানা নেই। কিন্তু যখনই এই ”a wise head keeps a mouth close”-এর —wise headএর কথা মনে আসে তখনি অরুণ মিত্র তাড়া করেন: প্রাজ্ঞের মতো নয়, অন্ধের ছুঁয়ে দেখার মতো করে বলো। অন্ধের ছোঁয়ায় গভীরতা, স্নেহ, সঠিকটা সমস্তই আছে; আছে প্রাজ্ঞের দেখাতেও। তাহলে, কেনো অরুণ মিত্র প্রাজ্ঞের মতো ক’রে বলতে নিষেধ করেন? প্রাজ্ঞ দেখার সাথে সাথে অবলোকনও করেন বলেই কি?
আর এক দিকে বন্ধুকে লেখা লেখা বন্ধুর চিঠি—
মানুষেরই সাথে মানুষের সম্পর্ক। যে-সম্পর্ক নিখাদ তা নিয়েই ভাবে কেউ কেউ এবং থাকে ব’লেও জানি। তুমি কবিতার কথা বল, বল নিখাদ মানুষের কথা। সুন্দরকে কালো করতেও বাঁধে না তোমার! সবটাই তাহলে কথা? বচন? অভিনয়? মুখোশ?— যেনো একা হয়ে আলাদা থাকা যায়? স্বরূপ তো উন্মোচন হবেই। একদিন। হয়েছেও। নিজের মুখ, কোথাও যদি দেখতে পাওয়া যায়, দেখো একবার। আত্মবিস্তারের স্বার্থমুখী চিন্তার চেয়ে শুভসংকীর্ণতাও ভালো। অনেক ভালো। এরকম শাস্তি আমাকে দেয়ার মানে কী? সাথে করেই নিয়ে এলাম তোমাকে। অথচ, তুমি, প্রয়োজন মেটাতে আসবে ব’লেও এলে না। ঘরে গেলাম তোমার। এখানেও আসতে হলো। পেলাম না তবুও। মুখোশের কাছ থেকে কবিতা মুক্তি পাবে কবে? তুমি ভাবো তুমি আমারও নাগালের বাইরে?
কবিতায় মানুষ সত্যি বলে, বুঝেই হোক কি না-বুঝেই। গদ্যে অসম্ভব মিথ্যে বলি আমরা। গদ্য মানেই মুখোশ। মুখোশ মানেই মুখ। আর মুখ মানেই অসংখ্যতা। অসংখ্যতা মানেই অসীম সঠিকতা; কিন্তু আপাতসঠিকতা। আবার আপাতসঠিকতাও নয়। কেননা, মানুষের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই বিচ্ছিন্নভাবে, এককভাবে সত্য, এবং সত্যি নিয়ে বাস্তব; হ’তে পারে, এই মুহূর্তের সত্যি পরের মুহূর্তেই বদলে যেতে পারে অসত্যে; এবং যায়ও। আর সাপেক্ষী সেই পূর্ববর্তী মুহূর্তটি পরবর্তী মুহূর্তের কাছে হ’ইয়ে উঠতে পারে অসত্য। কখন পৌঁছুই আমরা এই সমস্ত পরিণতিতে? পৌঁছুই অসত্যের যাপন থেকে পালাতে চেয়ে, আর তখনই বুঝি, মুখোশ আমরাই পড়ি, পড়ে কবিতাও—
চিত্রকলার ক্ষেত্রে স্পেসকে ফ্রেমের একপাশে ছেড়ে দিয়ে দিয়ে চিত্রদের দাঁড় করিয়ে দেয়া যায়, অসম্ভব গতিতে ধাবমান অবস্থায়, অনন্ত গতির দিকে। চলচ্চিত্রেও স্পেস ব্যবহৃত হয়েছে, হচ্ছে। স্পেস ব্যবহারের, ব্যবহার করার প্রবণতা পৃথিবীর সব শিল্পমাধ্যমকেই, মাধ্যম মৌলিক হোক কি যৌগিক, তাড়িত করেছে ব’লেই ব্যাপারটা ঘটে গিয়েছে নিরন্তর। এই অবস্থায়, কবিতায় স্পেসের ব্যবহারের কোনও কথাকে, আপাতদৃষ্টিতে, সামঞ্জস্যহীন মনে হ’তে পারে এবং এই মনে হওয়াটা মোটেই অস্বাভাবিক কিছু নয়। কেননা, কবিতার আধারই হচ্ছে স্পেস (আবার এই স্পেসই কবিতার মুখোশ, কবিতার মুখ; এবং মানুষেরও)। ফলে, কবিতায় আবার স্পেস ব্যবহারের কথা আসে কীভাবে! কবিতায় স্পেসের ব্যবহার, বলতে গেলে, কবিতার আদিতেই, শুরুতেই, শুরু হয়েছিলো (এখানে, কবিতার আদি বলতে অবশ্যই কবিতার মুদ্রিত-রূপে-আসতে-শুরু-করার শুরুর কথা বলা হচ্ছে), যার সর্বপ্রকাশ্য রূপটি হচ্ছে কবিতার অনুচ্ছেদ বিভাজন। এবং এই অর্থে গদ্যেও স্পেস ব্যবহৃত হয়। তবে গদ্যে সুবিধা এই যে, সেখানে কথা বেশি বলার সুযোগ থাকে, ফলে লেখক যা দেখাতে চান তা তিনি তৈরি ক’রে নিতে পারেন শব্দের পর শব্দ, শব্দের পর শব্দ… ক্রমাগতভাবে শব্দ ব্যবহার ক’রে (এ-কথা বলবার সময় আমরা ভুলছি না যে, কেবলই শব্দ দিয়ে ছবি বা ধারণা তৈরি ক’রে ফেলা যায় না); কিন্তু কবিতায় তা সম্ভব হয় না, মানে বেশি বেশি শব্দ ব্যবহারের সুযোগ নেই কবিতায়; থাকে না। কেননা, কবিতা হচ্ছে আলো-আঁধারের, বলা-না-বলার, দেখা-না-দেখার মাঝামাঝি অস্পষ্ট এক জগৎ, অস্পষ্ট এক পর্যায়।
তাহলে কী, কীভাবে সেই স্পেস—
এত বেশি কথা বলো কেন? চুপ করো
শব্দহীন হওশষ্পমূলে ঘিরে রাখো আদরের সম্পূর্ণ মর্মর
লেখো আয়ু লেখো আয়ু
ভেঙে পড়ে ঝাউ, বালির উত্থান, ওড়ে ঝড়
তোমার চোখের নিচে আমার চোখের চরাচর
ওঠে জেগেস্রোতের ভিতর ঘূর্ণি, ঘূর্ণির ভিতরে স্তব্ধ
আয়ু
লেখো আয়ু লেখো আয়ু
চুপ করো, শব্দহীন হও।[আয়ু : শঙ্খ ঘোষ]
কবিতাটির প্রথম দুই লাইনের পরই খানিকটা স্পেস ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, আর এই স্পেসটুকু যেনো আমাদের কিছুটা সময় দিচ্ছে উচ্চারিত সাবধানবাণী মর্মমূলে প্রোথিত করে নেয়ার জন্যে। তারপরই ”লেখো আয়ু লেখো আয়ু” এবং আবার কিছুটা স্পেস ছেড়ে দেয়া, (যেনো বা) আমাদের বলছে: খানিকটা সময় দিলাম, বুঝে নাও কী লিখবে। এবং এরপরই ব’লে দেয়া, যা-কিছু আছে লেখার যোগ্য, জীবনে; ব’লেই আবার স্পেস ছেড়ে দিয়ে আমাদের সময় দিচ্ছে ধাতস্থ হবার। তারপরই সেই অমোঘ সত্যের পুনঃউচ্চারণ।
জয় গোস্বামীর ”দম্পতি : হৃদয়ে প্রেমের গল্প শেষ হলে—” কবিতাটির অংশবিশেষ দেখা যাক—
সামান্য আলো, সামান্য পথরেখা
এর বেশি আমি আশাও করি না আর
কবিতাটির প্রথম লাইনের পর, স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি স্পেস ছেড়ে দিয়ে, দ্বিতীয় লাইনটি লেখা হয়েছে। যেনো পাঠককে ভাববার সময় দিচ্ছে এই আলোর উৎসমুখ সম্পর্কে ভাবতে, ভাবতে কোথায় গিয়ে শেষ হল পথরেখাটি। ভাবতে যে, এই ‘সামান্য’ আসলে কতোখানি? ওই একটু বেশি স্পেস ছেড়ে দেয়াই যেনো পাঠককে কবিরই সাথে ক’রে নিয়ে যায়, নিয়ে যাচ্ছে সেই ভাবনাসময়ে, একই সাথে অতীতে এবং অতীত-ভবিষ্যতে।
এবার সমর সেনের একটি কবিতা (অংশবিশেষ) দেখা যাক—
আকাশে চাঁদ নেই, আকাশ অন্ধকার,
বাতাসে গাছের পাতা নড়ে,
আর দেবদারুগাছের পিছনে পাতাটি কাঁপে আর কাঁপে;
আমাকে কেন ছেড়ে যাও
মিলনের মুহূর্ত হতে বিরহের স্তব্ধতায়?
মাঝে-মাঝে চকিতে যেন অনুভব করিতোমার নিঃশব্দতার ছন্দ;
[কবিতাটির নাম এবং বইয়ের নাম ঠিক এই মুহূর্তে মনে করা যাচ্ছে না]
এবারে, ওই কবিতাটিকেই দেখা যাক অন্যভাবে—
আকাশে চাঁদ নেই, আকাশ অন্ধকার,
বাতাসে গাছের পাতা নড়ে,
আর দেবদারুগাছের পিছনে পাতাটি কাঁপে আর কাঁপে;
মাঝে-মাঝে চকিতে যেন অনুভব করি
তোমার নিঃশব্দতার ছন্দ;
ওপরের অংশটুকু সমর সেনের কবিতাটিকে, কবিতার কিছু অংশকে, নতুন ক’রে লেখা, স্পেস ছেড়ে দিয়ে। এই ছেড়ে দেয়া স্পেসটুকু কি আমাদের মনে একজন শঙ্কাতুর, আশাহত মানুষকে তুলে ধরে না?! কবি মাঝের অতিরিক্ত লাইন দুটিতে যা বললেন, তার চেয়ে অনেক বেশি শঙ্কা, বেদনা কি আমরা ওপরে স্পেস-ছেড়ে-দিয়ে-লেখা অংশে অনুভব করি নি?!
আমাদেরও এরকমই ঘটে। এবং এইই অনিবার্য!
পাঠক, এবারে আমরা কারণ/প্রকরণ ছেড়ে বেরিয়ে আপনাকে একটা কথা জানাতে চাই; আপনি বাক্যগুলো পড়ুন : আমরা। আমরা একজন। আমরা একজন মানুষ। আমরা একজন মানুষের কথা। আমরা একজন মানুষের কথা বলতে চাই। আমরা একজন মানুষের কথা বলতে চাই আপনাকে।
প্রণম্যপাঠক, বাক্যকথাগুলি আরও একভাবে বলি আপনাকে?—
আমরা। আমরা একজন।
আমরা একজন মানুষ।আমরা একজন মানুষের কথা।
আমরা একজন মানুষের কথা বলতে চাই।আমরা একজন মানুষের কথা বলতে চাই আপনাকে।
প্রণমিত পাঠক, এই যে দুই ধরনের বলা, কথা বলা, বলাকথা, এই বলাগুলো মূলত ছাপার-হরফে-কথা-বলার দুটো ধরণ। দ্বিতীয় ধরনটিকে আমরা, মানুষেরা, কবিতা বলি। কবিতা নামে চিনি। ধরনটি আসলেই কবিতা। স্তবকের মাঝখানকার ফাঁকা জায়গাটুকু আপনাকে, মানে আমাকে, অনুভব উপলব্ধির সময় দেয় ব’লে (এবং স্তবকে বলা কথাগুলো অনুভূত হওয়ার মতো ব’লে) এই ধরনটি কবিতা। প্রথম ধরনটিকে আমরা বলি গদ্য; তবে কথা বলার ভঙ্গির কারণে এই ধরনকেও, এই ধরনে লেখা (পাঠক লক্ষ্য করুন ‘লেখা’ শব্দটি) কথাকে আমরা কবিতাও বলি। বলি গদ্যকবিতা। যদিও ‘গদ্যকবিতা’ কথাটিতে বিস্তর ঝঞ্জাটের অবকাশ আছে। সে যাই হোক। আপাতত প্রথম ধরনটিকে আসুন আমরা গদ্যই বলি। এই ধরনটিতে যে-বাক্যগুলো লেখা হয়েছে (এবং দ্বিতীয় ধরনটিতেও) তাতে বাক্যটি পূর্ণাঙ্গভাবে লেখা হয়েছে সবার শেষে। অহেতুক বাক্যটিকে একবারে পুরোপুরি না-লিখে প্রথম শব্দের পর, দ্বিতীয় শব্দের পর, তৃতীয় শব্দের পর… বিরামচিহ্ন বসিয়ে দেয়া হয়েছে!
এই বিরামচিহ্নগুলিই কিংবা যতিপাতগুলোই আমাদের দৃষ্টি-আক্রান্ত। এই নিয়েই আমরা কথা বলতে চাই। এই যে বিরামচিহ্ন, প্রণম্যপাঠক, এ আমাদের লেখ্যরীতির থেকে প্রাপ্তসুবিধা, এবং প্রাপ্যসুবিধাও বটে। ”আমরা একজন মানুষের কথা বলতে চাই আপনাকে”— এই বাক্যটি আমরা যদি আপনাদের মুখে উচ্চারণ-ক’রে বলি, তাহলে আপনাদের যা বোঝাতে পারবো না, তা বোঝানোর সুযোগ দিচ্ছে, দেয়, এই লেখনপদ্ধতি, এই ছাপনপদ্ধতি। তাহলে, প্রণম্যপাঠক, এই বাক্যকথাগুলো লেখছাপা পদ্ধতিতে উপস্থিত হ’তে পারলেই কেবল এদের গুরুত্ব আছে। অন্যথা নাই। এই কথা সত্য। কেন নাই, সেই কথা, প্রণম্যপাঠক, আমি আরও দু’চার কথা বললেই আমি নিজে বুঝতে পারবো, সাথে সাথে বুঝবেন আপনারাও ।
মিতপ্রণাপাঠক, এই যে আমরা ‘আমরা’ লিখে বিরামচিহ্ন বসালাম, মানে কী আছে এর। মানে আছে? মানে আছে হে প্রণম্য। যখন আমি লেখছাপা পদ্ধতির কল্যাণে আপনার সামনে ‘আমরা’ শব্দটিকে একটি যতিচিহ্ন দিয়ে হাজির করতে পারলাম, তখন, পাঠক আপনি, মানে আমি, একবারের জন্যে হলেও ভাবি কে এই ‘আমরা’? এবং, পাঠক, আমরা বুঝে নিই যে, এই ‘আমরা’ হচ্ছি আমরাই, যখন যারা যারা আছি, যখন যারা যারা থাকি, যখন যারা যারা থাকবো, তারা; তারা সবাই। কিন্তু, পাঠক, মানুষকে, কোনও মানুষকেই তো নিজেদের সমস্ত সত্যিকথা বলি না আমরা মানুষেরা। আমাদের সবারই অনেকগুলোই মুখ। মুখ মানে জীবন হে পাঠক, যাপিতজীবন। এক একটি মুখে আমরা এক একটি জীবন যাপন করি। নমস্যপাঠক, যদিও আপনি সমস্তই জানেন, তবুও জানতে চাইতে পারেন যে, ‘জীবন’ আবার এক একটি হয় কী করে? আসলে, পাঠক, জীবন এক একটিই, মানে অনেকগুলো। কিন্তু সমান্তরাল নয় এই সমস্ত জীবন। এরা একটি বিন্দুতে মেলে, কিন্তু পরস্পর পৃথকিত রেখায়, পাঠক, নিজনিজ ইচ্ছানুযায়ী, সঞ্চারমান। তারা, মানে জীবনেরা, মেলে এসে আপনার মধ্যে, মানুষে; আপনিই, প্রণমিত পাঠক, মানুষই ওই জীবনদের কেন্দ্রের বাস্তববিন্দু। তো পাঠক, এখন আমার, মানে আপনাদের, বুঝতে কোনও অসুবিধা হয় না যে, পরবর্তী বাক্যকথাটি ‘আমরা একজন’ হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু, তারপর যতি কেনো? প্রণমিত পাঠক, যতি আমাদের, মানে আপনার, ভাবনক্রিয়া সম্পাদিত হওয়ার জন্যে প্রয়োজনীয় সামান্য সময় মাত্র। যদিও মানবসংলগ্ন এবং জীবনপৃক্ত সমস্ত কথা বলি আমরা আপনাকে, মানে আপনি কাউকে, মানে আপনাকে কেউ বলার জন্যে ”আমরা।”, ”আমরা একজন।”,… ”আমরা একজন মানুষের কথা বলতে চাই আপনাকে।” ইত্যাকার বাক্যগুলিতে যে-মানবিক জীবন প্রবেশ করিয়ে স্থৈর্যে অস্থির করে দেয়া হয়েছে বাক্যটিকে/বাক্যগুলিকে সেই বিষয়টি বোঝার জন্যে আপনার, হে পাঠক, ক্ষণেক মাত্র সময়ের প্রয়োজন হয়; এতোই গতির দ্রুততা মানুষের মানবিক চিন্তাক্রিয়ার। এই কারণেই এই যতি, হে পাঠক। এ যতি দাঁড়ি হ’তে পারে; হ’তে পারে সেমিকোলন; হ’তে পারে… হ’তে পারি আমি; প্রতিটি প্রতিটি মানুষ। কেননা, আমরা একজন মানুষের কথা বলতে চাই আপনাকে; মানে, আপনি একজন মানুষের কথা বলতে চান কাউকে; মানে, কেউ একজন মানুষের কথা বলতে চায় আপনাকে। তখন, ওই ”আমরা”, ওই ”আপনি”, ওই ”কেউ”—সবাই, সবাই-ই ।