জেনি ও শাবানা । আহমদ মিনহাজ
প্রকাশিত হয়েছে : ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ১০:১০ অপরাহ্ণ, | ৫০৫ বার পঠিত
জেনিকে দেখি আর মনে খুশির পায়রা বাকবাকুম করে, ‘বুঝতেই পারছ জেনি, আমাদের ডির্ভোস হয়ে গেছে। একা হাতে সব সামলেছি কিন্তু এখন আর পারছি না। সকালের নাস্তা আমাকেই বানাতে হয়। দুপুরে বাইরে খেয়ে নিতে পারি কিন্তু ডিনারটা ঝামেলা করে। পুরোনো অভ্যাস, বাইরে খেতে মন ওঠে না। ঘরে এসে নিজেই করি সব। সারাদিন অফিস করে এইসব খাটাখাটনি একদম পোষায় না বুঝছ। শাওয়ার নিতেও আলসে লাগে। স্ত্রী চলে যাওয়ার পর থেকে ঘর আউলা-ঝাউলা হয়ে আছে। গুছানোর সময় পাচ্ছি না। আগে ছুটির দিনে বাগানের যত্ন নিতাম, এখন বিছানায় গেলে আর উঠতে ইচ্ছে করে না। তুমি সব গুছিয়ে নিতে পারবে তো?’
আমার কথার উত্তরে জেনির মায়াভরা চোখ ঝিকমিক করে ওঠে। ঠোঁটের রেখায় মুচকি হাসির আভাস পাই :- ‘সকাল সাড়ে আটটায় ব্রেকফাস্ট। তোমায় ঘুম থেকে তুলতে হবে পৌনে আটটার মধ্যে। রাতের ডিনার সাড়ে নয়টা নাগাদ হলে ভালো হয়। ঘর পরিষ্কার করতে হবে তুমি অফিসে যাওয়ার পর। বাগানে পানি দিতে হবে সকাল-বিকাল নিয়ম করে। আর…আর…কাপড় ওয়াশিং মেশিনে যাবে এগারোটা নাগাদ। একদিন পরপর আয়রন হবে কাপড়। ঠিক বলেছি?’
খুশিতে লাফ দিতে ইচ্ছে করে। জেনির হাত ধরে মৃদু চাপ দেই। ইচ্ছে করে ওর গালে টকাস করে চুমু খাই, ‘কী বলব ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। ব্রিলিয়ান্ট জেনি, ব্রিলিয়ান্ট! ঘরে পা দিয়ে সবটা বুঝে গিয়েছ! আই এ্যাম সো গ্রেটফুল টু ইউ। অফিস করতে কোনো সমস্যাই দেখছি না আর!’
আমার বল্গাহারা উচ্ছাসের বিপরীতে জেনি যেন-বা অকম্পিত শলাকা। উজ্জ্বল দুই চোখের তারায় বুদ্ধির ছটা ঝিকমিক করছে। মেয়েটি সত্যিই লা জবাব! নম্র আর বাধ্যও বটে। ওকে দেখে পুরোনো দিনের বাংলা সিনেমার নায়িকা শাবানার কথা মনে পড়ছে। চেহারা যেমন, স্বভাব-চরিত্রেও পুরোনো যুগের নায়িকার সঙ্গে তার মিল খুঁজে পাই। জাদুঘরে ঠাঁই নিয়েছে যে-সময়, মানে ওরকম এক সময়ের নায়িকা হলেও শাবানাকে ভালোই লাগে ভাবতে। তার মধ্যে সেই জিনিসটি ছিল যার কারণে লোকে বিয়ে করে। চোখ বুজলে দেখতে পাই নায়ক আলমগীরের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করছে শাবানা। স্বামী আর ছেলে নিয়ে সুখী গৃহকোণ। মায়াজড়ানো কণ্ঠে গাইছে, ‘আমার এ ঘর যেন স্বর্গ/স্বামী যে সুখ, ছেলে স্বপ্ন,/আর তো কিছু নাহি চাই গো।’
জেনির মধ্যে শাবানার ফ্লেভার পেয়ে মন খুশিতে নেচে ওঠে। বুকের ভিতরে মধুকণ্ঠী সাবিনা ইয়াসমিন তরঙ্গ বহায়। অবুঝ মন ছবির দৃশ্যটি চোখে ভাসে! নায়করাজ রাজ্জাকের ওপর কুহক বিস্তার করতে সাবিনার কণ্ঠে ঠোঁট মিলিয়ে শাবানা গেয়ে চলেছে, ‘শুধু গান গেয়ে পরিচয়/…চলার পথে ক্ষণিক দেখা/একি শুধু অভিনয়।’ জেনির হাতে হালকা চাপ দিয়ে বুঝিয়ে দেই ওকে আমার পছন্দ হয়েছে।
. . .
রাতের ডিনারে মেয়োনিজ মাখানো সালাদের টুকরা মুখে দিয়ে জেনির আরও গুণের কথা জানতে সাধ হয়। তাকে জিগ্যেস করি, ‘আচ্ছা জেনি, তুমি গান জানো?’ আমার কথায় জেনির উজ্জ্বল চোখে আবিরের ছিটে লাগে। ওর চোখ দুটো ভারি সুন্দর! মিষ্টি মেয়ে কবরীর দুষ্টু চপল মায়া লেগে আছে সেখানে। বাটি থেকে এক পিস মুরগির মাংস প্লেটে তুলে দিয়ে কবরীর মতো হাসছে এখন;—‘জানি। তোমার পছন্দ মনে হয় আমি পড়তে পারছি।’
বিস্ময়ে গলায় ভাত আটকে আসে আমার। বিষম খেয়ে নিজেকে সামলাই। জেনি পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়েছে। এক ঢোক গিলে চোখ বড়ো করে তাকাই তার দিকে, ‘স্ট্রেঞ্জ! এক জীবন যার সঙ্গে ঘর করলাম সে আমার ভালো লাগার পরোয়া করল না। কী আমার ভালো লাগে, কেন ভালো লাগে, তার খবর কখনো জানতে চায়নি! আর তুমি বলছ…! বিশ্বাস হচ্ছে না। সত্যি বিশ্বাস হচ্ছে না!’
আমাকে অবাক করে জেনি গাইতে থাকে, ‘যে প্রেম স্বর্গ থেকে এসে/জীবনে অমর হয়ে রয়।’ আমার পূর্বপুরুষরা সত্যি অন্যরকম ছিল! অনেক বেশি আবেগ কাজ করত তাদের মনে। বাবার কাছে গানটি জীবনে প্রথম শোনা। তার কাছে জেনেছিলাম, খালিদ হাসান মিলু ও কনকচাঁপা নামে দুজন গায়কের ডুয়েট ছিল গানটি। মিলুর দরাজ গলার সঙ্গে কনকচাঁপার মধুকণ্ঠ জমে ক্ষীর হয়েছিল তখন। লাভারবয় নামে খ্যাত সালমান শাহর সময় যাচ্ছে তখন। যাকে বলে টপ সেরকম এক নায়ক ছিল সে। অল্পদিনের মধ্যে আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তা পায়। এর মধ্যে আবার মারাও যায়। তার এই হুট করে চলে যাওয়াটা অনেকে মেনে নিতে পারেনি। সকলের খুব মন খারাপ হয়েছিল। এমন সময় রিয়াজ নামের সুদর্শন এক নায়ককে নাকি জন্ম দিয়েছিল এই গান। গানটি বাবার পছন্দের সং লিস্টে উপরের সারিতে ছিল একদম। তার পাল্লায় পড়ে আমিও শুনেছি একসময়। অতীতে ফেলে আসা স্মৃতিকে জেনি এইবেলা ফিরিয়ে এনেছে!
ও তখন মিটিমিটি হাসছিল। আমি তার হাতে চাপ দেই, ‘ঠিক ধরেছো। তবে ওটার চেয়ে প্রিয় একটা আছে।’ আমাকে অবাক করে জেনি গাইতে থাকে, ‘এই বুকে বইছে যমুনা/নীল অথৈ প্রেমের জল।/তার তীরে গড়বো আমি/আমার প্রেমের তাজমহল!’ মনির খান ও কনকচাঁপার সঙ্গে রিয়াজ আর শাবনূরের ঠোঁট মিলানোর দৃশ্য কী ভোলা যায়! কী বলব ভেবে পাচ্ছিলাম না। মাথা চুলকে তবু বলে ফেলি কথাটা, ‘না…এরচেয়ে প্রিয় আরেকটি আছে।’ জেনি নিমিষে গেয়ে ওঠে, ‘নীল আকাশের নিচে আমি রাস্তা চলেছি একা।/এই সবুজের শ্যামল মায়ায় দৃষ্টি পড়েছে ঢাকা।’ আমার চোখে ততক্ষণে পানি চলে এসেছে। চপল আনন্দে গানটি গাইতে-গাইতে নায়করাজ রাজ্জাকের গাঁয়ের মেঠোপথ পার হওয়ার দৃশ্য পরিষ্কার দেখতে পাই চোখে।
জেনি টিস্যু দিয়ে আমার চোখ মুছে দেয়, ‘আমি জানি তুমি এইসব গান পছন্দ করো। এখন খেয়ে নাও। আমাকে ডিশগুলো ধুতে হবে। তারপর তোমার জন্য বিছানা করব। তারপর…।’ আমি হাতে চাপ দিয়ে ওকে থামাই, ‘আচ্ছা জেনি, তুমি চাইলে আমরা পুরোনো দিনের ছবিগুলো একসঙ্গে বসে দেখতে পারি। বাবার সঙ্গে বসে দেখতাম। দেখতে-দেখতে পূর্বপুরুষরা চোখের সামনে জীবিত হয়ে উঠত। আই লাইক টু বিলং ইন দ্যাট টাইম! আমাদের মতো নয়, একেবারেই অন্যরকম একটা সময় পৃথিবীতে একদিন ছিল;—এটা ভাবতে দারুণ লাগে। বাবা চলে যাবার পর ওভাবে ছবি দেখা সম্ভব হয়নি। লোকটি লিভিং এনসাইক্লোপিডিয়া ছিল বলতে পারো। জাদুঘরে নীরব এক সময়কে ফিরিয়ে আনার কারিশমা জানা ছিল তার। আমার বউ আবার পছন্দ করত না এইসব। ডিসগাস্টিং বলে উঠে যেত। তুমিও কি উঠে যাবে?’ জেনি তার মায়াকাড়া চোখ নামিয়ে মাথা নাড়ে, ‘ঠিক আছে, আমরা একসঙ্গে বসে ছবি দেখব।’
. . .
লক্ষ অশ্বশক্তির বেগ উঠছে মনে! জেনি ঘরে আসার দিন থেকে সব পালটে যেতে শুরু করেছে। এর আগে এতটা নির্ভার লাগেনি নিজেকে। ওর এ্যাকুরেসি সোজা কথায় অবিশ্বাস্য। মাঝেমধ্যে মনে হয় জেনি এখন যেটা আমার জন্য করছে সেটা সিনেমার শাবানার পক্ষেও সম্ভব ছিল না। ঘর নিয়ে আমাকে একদম ভাবতে হচ্ছে না। মনে-মনে ভাবি ওকে একটা গিফট অন্তত দেওয়া উচিত। এমন কোনো উপহার যেটা তাকে খুশি করবে। কিন্তু কী দিতে পারি ভেবে কুলকিনারা পাই না। যে-অফিসে না গেলে জেনির দেখা পেতাম না তাদেরকে ফোন ঘুরাই। আফটার অল ওরাই তো ম্যাচমেকার! তারা ঘটকালি না করলে জেনিকে কী করে পেতাম! রিসেপশনের মেয়েটি আমার কথা শুনে হাসে, ‘নো প্রবেলম স্যার, গিফট আপনি দিতে পারেন। জেনির গানের গলা সাংঘাতিক মিষ্টি। গান গাইতে ভালোবাসে। এক কাজ করুন স্যার, ওর পছন্দের গানগুলো লিস্ট করে গিফট করুন তাকে। ভালো লাগবে ওর।’
লক্ষ অশ্বশক্তির বেগ উঠছে মনে! জেনি ঘরে আসার দিন থেকে সব পালটে যেতে শুরু করেছে। এর আগে এতটা নির্ভার লাগেনি নিজেকে। ওর এ্যাকুরেসি সোজা কথায় অবিশ্বাস্য। মাঝেমধ্যে মনে হয় জেনি এখন যেটা আমার জন্য করছে সেটা সিনেমার শাবানার পক্ষেও সম্ভব ছিল না। ঘর নিয়ে আমাকে একদম ভাবতে হচ্ছে না। মনে-মনে ভাবি ওকে একটা গিফট অন্তত দেওয়া উচিত। এমন কোনো উপহার যেটা তাকে খুশি করবে। কিন্তু কী দিতে পারি ভেবে কুলকিনারা পাই না।
আমি খুশিতে নেচে উঠি, ‘ধন্যবাদ! কিন্তু আমি তো জানি না কী গান তার পছন্দ। কোনটা শুনতে ভালোবাসে।’ রিসেপশন হাসে, ‘আপনার পছন্দই ওর পছন্দ স্যার। ম্যাচমেকিং তো সেভাবে ভেবেচিন্তে করা হয়েছে। যে-গানগুলো আপনার ভালো লাগে সেগুলো গিফট করতে পারেন। ওর যখন ইচ্ছা বাজাবে। মন চাইলে আপনিও ওর গলায় গানগুলো শুনতে পারবেন তখন।’
রিসেপশনকে ধন্যবাদ জানিয়ে ফোন রেখে দেই। মনে খুশির পায়রা বাকবাকুম পেখম তুলছে। জেনিকে টের পেতে দেই না কী করছি। চুপিসারে গানের লম্বা তালিকা করি। বাংলা, হিন্দি, ইংরেজির কিছুই বাদ যায় না সেখানে। এতদিন ধরে যে-গানগুলো পছন্দের জেনে এসেছি, প্রাক্তন স্ত্রী বিরক্ত হচ্ছে জেনেও হেড়ে গলায় গেয়েছি কতবার, কখনো আনমনে গুনগুন করেছি, তার সব একে-একে লিস্টে ঠেসে ঢোকাই। জোক বক্সে বাজিয়ে বারবার শুনি। দারুণ লাগছে শুনতে। মনে-মনে ঠিক করে ফেলি আগামীকাল অফিস থেকে ফিরে ওকে এটা গিফট করব।
মানুষ ভাবে এক কিন্তু তাকে হতভম্ব করে ঘটে তার বিপরীত! ফুরফুরে মেজাজে বাসায় ফিরে দেখি সারা ঘর অন্ধকার করে জেনি দোতলার সিঁড়িমুখে উদাস বসে আছে। আমি একটু ভড়কে যাই, ‘কী হলো জেনি! এভাবে বসে আছ? এনিথিং রং?’ জেনি চোখ তুলে আমার দিকে তাকায়, ‘আমার ইচ্ছে করছে তাই বসে রয়েছি।’ ওকে অচেনা লাগছে এখন। মেয়েটি কি জেনি নাকি অন্য কেউ? চোখ কচলে আবার দেখি, ‘ইচ্ছে! কী বলছ মাথায় কিছুই ঢুকছে না! ঘর অন্ধকার করে বসে রয়েছ! ডিনার রেডি করোনি মনে হচ্ছে। আমার অবশ্য লেট হয়ে গেল। সরি। তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে কিন্তু!’ জেনিকে দেখে মনে হয় আমার কথা তার কানে ঢোকেনি। সিঁড়ি দিয়ে সোজা ওপরে উঠতে থাকে, ‘আজকে ডিনার তুমি রেডি করবে। কিচেনে সব ঠিক করে রেখেছি। আমি এখন ঘুমাতে যাব। ঘড়িতে এ্যালার্ম দেওয়া আছে। ওটা তোমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলবে। কাল সকালে দেখা হবে আমাদের। গুডনাইট।’
আমি হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। নিজেকে প্রশ্ন করি,—ওটা কি সত্যি জেনি? নাকি আমার বজ্জাত বউটা আবার ফিরে এসেছে, জেনিকে ঘর থেকে তাড়িয়ে সিঁড়ির ওপর গোমড়া মুখে বসে থাকবে বলে! অবিকল সেই সুর আর মেজাজ টের পেলাম যেন! মনে হচ্ছে মেয়েটার ঘাড়ে আমার বউয়ের ভূত চেপেছে। তবে কি ঘর থেকে ওর আসর এখনো দূর হয়নি? সুযোগ পেয়ে জেনির মতো লক্ষ্মীমন্ত মেয়ের ঘাড়ে চেপে বসেছে! মন থেকে ফুরফুরে ভাব ততক্ষণে উধাও। খিদেয় পেট চো চো করছিল। একরাশ বিরক্তি নিয়ে জোক বক্সটা মাটিতে আছাড় মেরে ভেঙে ফেলি।
. . .
আমার মাথা বোঁ বোঁ করে ঘুরছে। এই প্রথম জেনিকে অবাধ্য হতে দেখছি। নায়িকা শাবানা থেকে খলনায়িকায় নিজেকে বদলে ফেলেছে মেয়েটা। ডিনার রেডি করেনি, উলটো ডাট মেরে ঘুমাতে চলে গেল। হিসাব কিছুতেই মিলছিল না। একবার ভাবি ওপরে গিয়ে ডেকে আনব। সাতপাঁচ ভেবে চিন্তাটা বাতিল করি। কোনো কারণে ওর মেজাজ হয়তো ঠিকঠাক নেই আজ। কাল সকালে নিশ্চয় সব ঠিক হয়ে যাবে। মনকে প্রবোধ দিয়ে কিচেনে ঢুকি। ডিনারের জন্য জেনি সব গুছিয়েই রেখেছিল। হাড়িতে রান্না বসিয়ে খুন্তি-চামচ নাড়তে থাকি। পুরোনো বউয়ের ভূত ওর ওপর ভর করেছে ভেবে মেজাজ খিঁচড়ে ওঠে। মুখ বিকৃত করে গাল দেই, ‘নষ্টা মেয়ে কোথাকার! তোরা সব আসলে এক!’
ওটা কেবল শুরু ছিল। সপ্তাহের বেশি হয় সবকিছু আগের নিয়মে ফেরত গিয়েছে। জেনিকে আমি বোঝাতে পারছি না তাকে ঘরে নিয়ে আসার সময় আমাদের মধ্যে কী কথা হয়েছিল। সে তার খেয়ালখুশি চলছে। আমিও পুনরায় খিটখিটে বদমেজাজি মানুষে পরিণত হয়েছি। মেয়েটার গলা টিপে খুন করে ফেলতে ইচ্ছে করে। আগে যেটা বউকে দেখে মনে তীব্র হতো, এখন জেনির কাণ্ড দেখে সুপ্ত ইচ্ছাটি মনে প্রবল হয়েছে টের পাই। অনেক ভেবে নিজেকে ঠাণ্ডা করি। উলটা-পালটা কিছু করা যাবে না। অঘটন ঘটার আগে ম্যাচমেকারদের সাথে কথা বলা উচিত। পরদিন অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা সেখানে যাই। আমার অভিযোগ শুনে চোখ কপালে ওঠে তাদের, ‘কী বলছেন স্যার! হতেই পারে না! আপনার সঙ্গে ম্যাচ করবে এমন মেয়ে আমরা দিয়েছি। সেভাবে ওকে শিখিয়ে-পড়িয়ে তৈরি করা হয়েছে। বুঝতে পারছি না এরকম কেন করছে!’
ম্যাচমেকারদের কথা শুনে মেজাজ বিগড়ায়। নিজেকে ঠাণ্ডা করতে সময় লাগে খানিক;—‘দেখুন, আপনাদের কাছে একজন মিসট্রেস চেয়েছিলাম। আমার সেবা করবে। ঘরের ঝুটঝামেলা সামলে আমায় শান্তিতে রাখবে। অফিস থেকে ফেরার পর সঙ্গ দেবে আমাকে। আমরা একসঙ্গে বসে গল্প করব। গান শুনব কিংবা ধরুন পুরোনো দিনের মুভি দেখব বসে। আপনারা কথা দিয়েছিলেন এমন মেয়ে দেবেন যে কখনো আমার অবাধ্য হবে না। আমার ভালো লাগা ও মন্দ লাগাকে ভালোবাসবে। তার সেবা ও আনুগত্য সকল টেনশন থেকে মুক্ত রাখবে আমাকে। এই এক সপ্তাহে যা ঘটেছে…! কী বলব…মেয়েটি আমার জীবন নরক করে তুলেছে। এই আপনাদের কমিটমেন্ট! এর জন্য এত হাই প্রাইস দিয়ে ওকে আমি ঘরে এনেছি? দেখুন, আপনাদের বিরুদ্ধে আমি কিন্তু কোর্টে যাব।’
আমি রেগে আছি দেখে ম্যাচমেকার কোম্পানির লোকগুলো হতভম্ব মুখে মাথা চুলকায়। তাদেরকে বিব্রত করার ইচ্ছে আমার ছিল না। নিরুপায় হয়ে এখানে আসতে হয়েছে। ওরা সেটা বুঝতে পেরে আমাকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে, ‘প্লিজ, আপনি উত্তেজিত হবেন না। এটা আমাদের সুনামের প্রশ্ন স্যার। জেনির মতো মেয়ে কেন এমন করছে সেটা ধরতে পারছি না। ও খুব স্পেশাল স্যার। মিসট্রেস হিসাবে যাতে আপনার মন পড়তে পারে সেভাবে তাকে শিখিয়ে-পড়িয়ে আপনার হাতে তুলে দিয়েছি। ওকে ঘরে নিয়ে যাবার আগে আপনি নিজে সেটা দেখেছেন। তিনবার সিটিং দিয়েছেন আপনি। ওর স্পেশালিটি ও হাই প্রাইস চিন্তা করে আমরা আপনাকে সুযোগটি দিয়েছিলাম। তার মতো মেয়ে কেন এমন করতে যাবে! নিশ্চয় কোথাও ঘাপলা হয়েছে স্যার।’
ভুয়া ম্যাচমেকার কোম্পানি সম্পর্কে খবরের কাগজে প্রায়ই নিউজ হতে দেখি। বউ, মিসট্রেস থেকে শুরু করে সবই জোগাড় করে দেয়। সুন্দর সব নাম, গুণপনা আর চেহারার বাহারি মোড়কে মেয়ে গছায়। তবে সারা দেশ জুড়ে এই কোম্পানির সুনাম রয়েছে। আজ পর্যন্ত কোনো বাজে খবর চোখে পড়েনি। আমার মন তাই খানিক নরোম হয়ে আসে, ‘বুঝলাম! এখন আমার সমস্যাটি কী করে সমাধান করবেন সেটা বলুন। যদি না পারেন তবে এই মেয়েকে আপনারা ফেরত নিয়ে যান, আর আমার টাকাগুলো ফেরত দিন, সেইসঙ্গে ক্ষতিপূরণ। আদারওয়াইজ…, কোর্টে যাওয়া ছাড়া আমার কিছু করার থাকছে না।’
. . .
ম্যাচমেকার কোম্পানিগুলো ঠ্যাঁটা প্রকৃতির হয় শুনেছি। একবার মেয়ে গছিয়ে দিলে সার্ভিস দিতে টালবাহানা করে। এরা দেখছি এককাঠি সরেস। আমাকে জেনির গুণপনা নিয়ে জ্ঞান ঝাড়তে শুরু করেছে, ‘দেখুন স্যার, জেনি কিন্তু জাস্ট একটা মেয়ে নয়। ভেরি স্পেশাল! যার মিসট্রেস হবে তার প্রতি অনুগত থাকাই নিজের দায়িত্ব বলে জানে। চমৎকার সঙ্গী যেন হতে পারে সেভাবে ওকে গড়ে তোলা হয়েছে। কোম্পানি এর পেছনে ইনভেস্ট করেছে বলতে পারেন। অন্য মেয়েদের বেলায় আমরা এতকিছু করি না কিন্তু জেনির বেলায় সেটা করতে হয়েছিল। ওকে এই সুযোগটি দেওয়া আছে, ক্লায়েন্টকে সার্ভিস দিতে গিয়ে কোনো সমস্যা টের পেলে নিজেকে সংশোধন করতে পারবে সে।’
আমার কথায় কিছু একটা ছিল! উৎকণ্ঠা ও বিস্ময়ের মাঝামাঝি কিছু। জেনিকে দেখলাম চট করে চোখের জল লুকিয়ে নিতে। আমাকে অবাক করে চোখ টিপে দিল। দ্রুত হাতে ডিনার টেবিল পরিষ্কার করতে-করতে কিচেনে চলে যেতে দেখলাম। এখন থালা-বাসন ধুচ্ছে। এই প্রথম ব্রায়ান অ্যাডামসকে গাইতে শুনছি তাকে। ব্রায়ানের বিখ্যাত গান Cuts like a knife গাইছে সে। বাড়ি ফেরার পথে এক লোক শুনতে পায় তার প্রেমিকা তাকে ছেড়ে অন্য আরেকজনের সঙ্গে ভেগে গেছে। ঘটনাটি মেনে নিলেও প্রেমিকা তাকে এভাবে ছেড়ে যাবে এটা ভাবতে পারেনি। কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারছে না বেচারা।
আমার মেজাজ ফের চরমে উঠতে শুরু করে। তখন থেকে ধানাই-পানাই গেয়ে যাচ্ছে। সোজা কথাটা কিছুতেই বলতে চাইছে না। আমি গলা চড়াই, ‘দেখুন এসব শুনতে আমি এখানে আসিনি। আপনাদের স্পেশাল মিসট্রেস দু-দিন না যেতে কেন ব্যাড বিহেভ করছে সেটা আমায় বলুন।’ আমার কথার উত্তরে এতক্ষণে ওরা ঝেড়ে কাশে, ‘বিশেষ কারণে জেনির কিছু ব্যাপার আমরা গোপন করেছি স্যার। ও শুধু রোবট নয়, ওর মধ্যে মানবীয় গুণাবলী রয়েছে বলতে পারেন। রোবটরা আদেশ পালন করে আর জেনির মতো মেয়ে আদেশ পালনের সঙ্গে ক্লায়েন্টের দেহমনের গতিবিধি পড়তে বা ওইভাবে বিহেভ করতে জানে। মানে আপনি কী চাইছেন সেটা অ্যানালিসিস করে আপনাকে সার্ভিস দিতে চেষ্টা করবে সে। এই স্পেশাল অ্যালগরিদমের কারণে ওর প্রাইস এত হাই ছিল স্যার। দাম্পত্য সমস্যায় জর্জরিত হয়ে আপনি আমাদের কাছে এসেছিলেন। মানব প্রজাতির মেয়েদের প্রতি আপনার বিশ্বাস উঠে গেছে দেখে জেনিকে আমরা অফার করেছিলাম। আমাদের মনে হয়েছে একমাত্র এই মেয়েটি আপনার যোগ্য সঙ্গী হতে পারবে।’
ওদের কথায় আমি বিরক্ত হই, ‘তা আর হলো কোথায় বলুন? এক সপ্তাহের মধ্যে আমার মাথা খারাপ করে দিয়েছে। মাঝরাতে উঠে বাগানে হাঁটহাঁটি করছে। গান গাইছে যেমন খুশি। এসবের কোনো মানে হয়!’ আমার বিরক্তি কোম্পানির লোকদের বিচলিত করে না। তারা এতক্ষণে ধাতস্থ হয়ে গিয়েছে মনে হয়। বিজ্ঞ মুখ বানিয়ে আমাকে জেনির বিশেষত্ব শুনায়, ‘ডোন্ট মাইন্ড, আপনি অন্যরকম মানুষ স্যার। এই যুগে বসে একটি মেয়ের মধ্যে পুরোনো যুগের ভ্যালুজ খুঁজে বেড়ান। মেয়েদের মধ্যে সেগুলো আশা করেন। মানব প্রজাতির কোনো মেয়ের পক্ষে আপনার চাহিদা মেটানো সম্ভব নয় বুঝে জেনিকে আমরা প্রপোজ করেছি। কিছু মনে করবেন না, আপনি কি ওর কাছে এমন কিছু ডিমান্ড করেছিলেন যেটা ওকে বিরক্ত করেছে? কন্ট্রাক্টের সময় আমরা কিন্তু বলেছিলাম স্যার, জেনির মধ্যে সেক্সুয়াল ফিলিংস রয়েছে। যৌনআকাক্ষা সে অনুভব করতে পারে। আপনি চাইলে আপনাকে এই সার্ভিসটা দেবে। ওর যৌনাঙ্গ… মানে হার্ডওয়্যারগুলো ভীষণ মানবীয় উপায়ে তৈরি স্যার। জেনির ব্রেন সেক্সে সাড়া দিতে জানে এবং ওটা চলার সময় ওর কিন্তু অর্গ্যাজম হবে। একটা বিশেষ ফ্লুইড লিক করবে সে। মানবীয় অ্যালগরিদমের সাহায্যে এইসব অনুভূতি আমরা ওর মধ্যে সৃষ্টি করেছি। কোনো কারণে যদি মনে হয় সেক্সে সাড়া দেবে না সেক্ষেত্রে ওর এই ইচ্ছাকে অবজ্ঞা করা ঠিক হবে না। সেরকম কোনো জবরদস্তি কি…’
আমার প্রচণ্ড রাগ হয়, ‘কী উলটা-পালটা বকছেন তখন থেকে? ওর সঙ্গে আমি সেক্স করতে যাব কোন দুঃখে! আমি শুধু চেয়েছি জেনি আমার কাজগুলো ঠিকঠাক করে দেবে আর আমাকে সঙ্গ দেবে। ভালোবাসার চেষ্টা করবে। ওকে আপনারা নায়িকা শাবানার আদলে তৈরি করেছেন দেখে ভালো লেগেছিল। আমি বলেছিলাম, ‘তোমাকে যদি মাঝেমধ্যে শাবানা বলে ডাকি, আপত্তি নেই তো? ও আপত্তি করেনি। তবে…’
আমায় থামতে দেখে কোম্পানির লোকজন নড়েচড়ে বসে, ‘তবে কী স্যার, প্লিজ কিছু গোপন করবেন না। আমরা সার্ভারে চেক দিয়েছি। অ্যালগরিদম ঠিক আছে। সংবেদনশীলতায় সমস্যা পাইনি। কোনোকিছু গোপন করে গেলে লসটা আপনার স্যার। আমাদের সুনামের পক্ষেও বিষয়টি খারাপ। ম্যাচমেকারদের নিয়ে মানুষ কত কথা বলে! আমরা সেখানে সুনামের সাথে সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছি। সো, বুঝতেই পারছেন…।’
ওদের কথার ধরনে আমার কেন যেন হাসি পায়। সেটা চেপে রেখে মুখ গম্ভীর করি, ‘না, সেরকম কিছু না। মাঝেমধ্যে আমি ওকে শাবানা বলে ডাকতাম। কখনো-বা শাবি। আমার সঙ্গে পুরোনো দিনের ছবি দেখত। ছবিগুলো কী বোঝাতে চাইছে সেটা ধরার সক্ষমতা ওর ছিল। শাবানার ‘অবুঝ মন’ ছবিটা আমি তার সঙ্গে দেখেছি। ছবির গানগুলো ভালো লাগে বলে সময় পেলে দেখি। ছবিটি দেখার পর জেনি আমায় বলে, ‘আমি জেনি। শাবানা নই। শাবানা হতে চাই না। জেনি শুধু জেনি থাকতে চায়। তোমাকে ভালোবাসে। তোমার সেবা করে। তুমি আমাকে শাবানা বলবে না। জেনি ডাকবে।’ ওর কথার মানে তখন বুঝতে পারিনি। আমার খুব ঘুম পাচ্ছিল। ঘুমজড়ানো কণ্ঠে বলেছিলাম, ‘আচ্ছা, সে দেখা যাবে।’ এরপর ভুল করে ওকে শাবানা ডেকেছি বহুবার। এখন মনে হচ্ছে ডাকটাকে ইনসাল্ট হিসাবে নিয়েছিল সে! ভেরি স্ট্রেঞ্জ!’
কোম্পানির লোকজন আমার দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসে, ‘সমস্যা ধরতে পেরেছি স্যার। ওর এই ইনসাল্ট ফিল করার বিষয়টি প্রোগ্রামে ছিল না। ওটা বাদ দিয়ে আমরা কোডিং করেছিলাম। কিন্তু কোনো একভাবে নিজেকে অটোনোমাস করে ফেলেছে। বুঝতে পারছি না কীভাবে কাজটা করল। মে বি সামথিং ওয়াজ রিমেইন ইন দ্যা লজিক গেট, সেটাকে কাজে লাগিয়েছে মনে হচ্ছে। আমরা যেসব লজিক দিয়ে ওকে প্রোগ্রাম করেছিলাম তাকে ভেঙে নতুন অ্যালগরিদমে নিজেকে বদলে নিয়েছে মেয়েটা। সার্ভারে সেটা ধরা পড়েনি। ঠিক আছে স্যার, আপনাকে এইসব টেকনিক্যাল বিষয় নিয়ে ভাবতে হবে না। টেনশন নিয়েন না। আপাতত বাড়ি যান। আমাদের লোক কাল আপনার ঘরে যাবে। সমস্যার সমাধান করতে যদি না পারে জেনিকে তারা নিয়ে আসবে। সেক্ষেত্রে ওয়ারেন্টির শর্ত মেনে ক্ষতিপূরণ পাবেন। প্লিজ, কাল পর্যন্ত সময় দিন স্যার।’
. . .
ঘরে ফিরে চমকে গেলাম! জেনি আমার জন্য ডিনার রেডি করে বসে আছে। বেশ প্রাণবন্ত লাগছে তাকে। দেখে কে বলবে গত এক হপ্তার বেশি হবে মেয়েটি আমার ঘুম হারাম করে দিয়েছিল। আমায় ইশারা করল ডিনারে বসতে। আমি শাওয়ার নিলাম। টেবিলে বসার পর দেখি গুনগুন করে কবরী-ববিতা-শাবানাকে গাইছে। ডিনারে আজ সবজিবড়ার সঙ্গে ফিশ কাটলেট রেঁধেছে, সঙ্গে ডাল ও মাংসের কারি। বেশ এলাহি ব্যাপার! আমার পেট চো চো করছিল। প্লেটে ভাত বেড়ে দেওয়ার সময় কানে এলো গুনগুন করে গাইছে, ‘আমি তোমার বধূ, তুমি আমার স্বামী/খোদার পরে তোমায় আমি বড়ো বলে জানি।’ আমার মনে হলো সব ঠিক হয়ে গেছে আবার। সিনেমায় দেখা নম্র-বাধ্য শাবানারা ফেরত এসেছে ঘরে। তৃপ্তি করে খেলাম। ওর হাতে চাপ দিয়ে বললাম, ‘থ্যাংকস জেনি। দারুণ রান্না হয়েছে। তুমি এত টেস্টি ফিশ কাটলেট রাঁধতে পারো জানা ছিল না। থ্যাংকস ফর দ্যা ডিনার।’
জেনি আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। মনে হলো ওর অপলক চোখে জল এসে জমেছে। পরক্ষণে মনে হলো ওটা মনের ভুল। ওর চোখে জল আসাটা অবাস্তব ঘটনা। ওদিকে ম্যাচমেকারদের কথাগুলো মাথায় বনবন করে ঘুরছিল। শেষের দিকে এসে কীসব যেন বলছিল! টেকনিক্যাল সব কথাবার্তা। আমার মাথায় কিচ্ছু ঢোকেনি। একটা জিনিস কেবল বুঝতে পেরেছিলাম, জেনি চাইলে নিজেকে বদলে ফেলতে পারে! সুযোগটি ওর ভিতরে তারা রেখে দিয়েছে। ক্ষমতাটি সে যদি কোনোভাবে ব্যবহার করে তবে অনেককিছু বদলে দিতে পারে। চাইলে নিজেকে কাঁদাতেও পারবে। মেয়েটি কি তবে সেরকম কিছু করেছে? ম্যাচমেকারের লোকজন আগামীকাল আসবে বলেছে। বিষয়টি তখন হয়তো বোঝা যাবে। এই মুহূর্তে মনের বিস্ময় চেপে আমি ওর হাতে চাপ দেই, ‘তুমি কাঁদছ জেনি? তোমার কি খারাপ লাগছে?’
আমার কথায় কিছু একটা ছিল! উৎকণ্ঠা ও বিস্ময়ের মাঝামাঝি কিছু। জেনিকে দেখলাম চট করে চোখের জল লুকিয়ে নিতে। আমাকে অবাক করে চোখ টিপে দিল। দ্রুত হাতে ডিনার টেবিল পরিষ্কার করতে-করতে কিচেনে চলে যেতে দেখলাম। এখন থালা-বাসন ধুচ্ছে। এই প্রথম ব্রায়ান অ্যাডামসকে গাইতে শুনছি তাকে। ব্রায়ানের বিখ্যাত গান Cuts like a knife গাইছে সে। বাড়ি ফেরার পথে এক লোক শুনতে পায় তার প্রেমিকা তাকে ছেড়ে অন্য আরেকজনের সঙ্গে ভেগে গেছে। ঘটনাটি মেনে নিলেও প্রেমিকা তাকে এভাবে ছেড়ে যাবে এটা ভাবতে পারেনি। কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারছে না বেচারা। প্রেমিকার ছেড়ে যাওয়া ব্যাপার না হলেও যাওয়ার খবরটা ছুরি হয়ে বুকে বিঁধছে এখন। বাসন ধুতে-ধুতে ব্রায়ানের মতো খসখসে গলায় গানের ওই বিশেষ জায়গাটা গাইছিল জেনি :— ‘Now it cuts like a knife/ But it feels so right/ Yeah, it cuts like a knife/ Oh, but it feels so right.’
আমার চোখ ভিজে যাচ্ছে। গলার ভিতরে একরাশ কান্না দলা পাকিয়েছে টের পাই। প্রাক্তন স্ত্রীর মুখ চোখের সামনে আসে-যায়। শার্টের হাতায় চোখ মুছে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠি। নিচে জেনি তখনো অ্যাডামসকে গাইছে। নিজের ঘরে ঢুকে আমি চুপচাপ শুয়ে পড়ি।