রেশমি ফেরারি । আহমদ মিনহাজ
প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ অক্টোবর ২০২২, ৪:৫৩ পূর্বাহ্ণ, | ৪৯৬ বার পঠিত
রেশমি ফেরারিকে আমি চোখের দেখাও দেখিনি। মহল্লায় যারা দেখেছে তারা তাকে ওই নামে ডাকত। ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছি সে নাকি দেখতে রেশমতন্তুর মতো হালকা আর মসৃণ ছিল। মা বলত, ‘ওই রূপে পাষাণ গইলা পানি হয়! তারে একবার যে দেখছে সে জীবনে ভুলবার পারব না।’ এইসব শুনতে-শুনতে এটুকু বুঝতে পেরেছিলাম রেশমি ফেরারি নামে লোকটি বড়ো রূপবান ছিল দেখতে। মা-খালারা একত্র হলে খুচরা আলাপের ভিড়ে রেশমি স্মৃতি হয়ে হানা দিত। কতবার বলতে শুনেছি, ‘পুরুষ মাইনসের এমুন রূপ চোখে সহ্য হয় না। মহল্লার রূপসী মাইয়ারা সেই রূপের সামনে খাড়াইতে পারত না। রেশমি ছিল মসলিনের লাহান মিহি। আংটির ভিতর দিয়া গইলা যাইব এমুন ছিল হের রূপের জাদু! ওই রূপের লগে ঘর করার খ্যামতা মাইয়াগো ছিল না।
মা-খালাদের এমনধারা কথাবার্তা তখন অতশত বুঝতাম না। বড়ো হওয়ার পর মনে প্রশ্ন জেগেছিল, —লোকটা রূপকুমার ছিল বুঝলাম কিন্তু সবাই ওকে ‘রেশমি’র সাথে ‘ফেরারি’ জুড়ে ডাকে কেন? ‘ফেরারি’ মানে তো পলাতক। নিজের জান বাঁচাতে লোকের চোখে ধুলা দিয়ে যে লোক এখানে-সেখানে পালিয়ে বেড়ায় সবাই তাকে ফেরার, ফেরারি ইত্যাদি বলে ডাকে। রেশমি কি ভয়ংকর কাণ্ড ঘটিয়ে ফেরার হয়? নাকি কারো ভয়ে তল্লাট থেকে লাপাত্তা হয়েছিল? অথবা অন্য কারণ ছিল সেখানে? খাবার টেবিলে রেশমির প্রসঙ্গ উঠলে বাবাকে একদিন প্রশ্নগুলো করেছিলাম। বাবা হেসে জবাব দিয়েছিল, ‘রেশমি হইছে গরিবের ঘরে পদ্মফুল। ওর বাপে নিচুপদের কেরানি ছিল। লোক নিরীহ। সাদামাটা ভালামানুষ। ধার-দেনায় সংসার চলত। পাঁচ ছাওয়াল-পাওয়ালের সংসারে রেশমি ছিল ছোট। ওর মায়ে সুন্দর ছিল দেখতে। মুক্তি সংগ্রামের সময় মিলিশিয়ারা তারে ক্যাম্পে নিয়া অত্যাচার করছিল। রেশমির বাপে কিন্তুক বউরে খেদাইয়া দেয় নাই। তারে খুব ভালোবাসত কিনা। লোকে কইত রেশমি ওর ছাওয়াল না। পাকিস্তান হইতে ছাড়া পাওয়ার পর শেখ মুজিবর দেশে ফিরা আইলেন আর সেইদিন রাইতে রেশমির জন্ম হইছিল। আকাশ জুইড়া তারার আতশবাজি চলছিল রাতে। রেশমির দাড়ি-গোঁফ গজানোর পর তার চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকানো যাইত না। আজিব জ্যোতি ছিল চউক্ষে। একবার তাকাইলে মনে হইত চক্ষু দুইটা বুঝি আন্ধাইর হইয়া যাইব! অন্ধ হওয়ার ভয়ে সগ্গলে চোখ ফিরাইয়া নিত। এমুন জ্যোতি সহ্য করা সহজ কাম না!’
বাবার কথা থেকে বুঝতে পারি রেশমির রূপ মহল্লাবাসীর জীবনে পুলক ও বিড়ম্বনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাই বলে ‘ফেরারি’ কেন! বিস্ময়টা পরিষ্কার হয় আরো পরে। রেশমিকে কাছে থেকে দেখেছে এমন এক মুরব্বি আমায় বলেন,—‘রেশমির ফেরার না হইয়া উপায় ছিল না। মহল্লায় সব্বাই তারে মনে-মনে বাসনা করত। মাইয়া মানুষ, পুরুষ মানুষ বইলা কোনো ভেদ ছিল না। সগ্গলে ওই রূপের আগুনে ঝাপ দিতে দিওয়ানা ছিল তখন। ইউসুফ নবির মতন রূপ ছিল তার। দূর থিকা দেখলে মনে হইত রেশম দিয়া কেউ লোকটারে বোনা করছে। আহা কী মোলায়েম! কিন্তু কাছে গেলে…’ —‘কাছে গেলে কী চাচা?’ আমার কৌতূহলে মুরব্বি খানিক বিমনা হয়ে পড়েন, ‘কাছে গেলে মনে হইত আগুনের শিখা জ্বলে চারধারে। হাত দেওয়ার খ্যামতা কারো নাই। হাত দিতে গেলে পুইড়া অঙ্গার হইব সব! কী আর কমু, ভাবলে শরীর এখনো কাডা দিয়া উঠে!’
মুরব্বির কথায় বুঝতে পারি রেশমির রূপে আধিভৌতিক বা অতীন্দ্রিয় টাইপের ব্যাপার-স্যাপার ছিল। এমন সেই রূপের টান যার প্রভাবে নারী-পুরুষের সহজাত ভেদাভেদ সকলে ভুলে গিয়েছিল। রেশমি ফেরারিকে ঘিরে কামবাসনার টানাপোড়েন ছিল সকলের মনে। বিপরীত লিঙ্গের রূপবান পুরুষের প্রতি নারীগণ আকর্ষিত হবেন এটা স্বাভাবিক, কিন্তু সমলিঙ্গের পুরুষরাও দেখছি রেশমি-জ্বরে আক্রান্ত ছিলেন সেই সময়। সমাজের চোখ দিয়ে ভাবলে দুটো ঘটনাই কমবেশি ব্যাভিচারের পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। সুতরাং মহল্লার আবালবৃদ্ধবণিতা রেশমির জন্য মনেপ্রাণে উতলা হলেও নৈতিকতার চাপা অস্বস্তি তাদের ওপর গুরুভার হয়ে চেপে বসেছিল। রেশমি হচ্ছে সেই পুরুষ যার রূপের আগুনে ঝাঁপ দেওয়ার লোভ সামলানো কঠিন, ওদিকে ঝাঁপ দিলে মরণকে মনে হবে সুনিশ্চিত।
মহল্লার ছেলে-ছোকরা যারা এখন বিয়েশাদি করে বয়স্ক ও সংসারী হয়েছেন রেশমি ফেরারির রূপে তারা এভাবে জমে গিয়েছিলেন। তাদের মনের অলিন্দে সেই রূপকে ধরার বাসনা নিয়মিত হানা দিচ্ছে তখন। অবদমতি কামবিষাদে নিজের যৌবন তারা অপচয় করছিলেন রেশম-মোলায়েম এক পুরুষের পেছনে। প্রবীণ হয়ে পড়া যুবাদের সঙ্গে বাবার মতের খানিক মিল পেয়েছি,—‘রেশমি দেখতে কেমন ছিল সেইটা বুঝাইয়া কওন ঝামেলার কাম বুঝলা।
আরেকটি ভাবনার বিষয় ছিল সেখানে। সেটা হলো রেশমির ধর্মীয় পরিচয়। মুসলমানের ঘরে জন্ম নেওয়া লোকটার রূপের টানে যারা অভিভূত ছিলেন সেখানে ধর্মের বাছবিচার গৌণ হয়ে পড়েছিল। হিন্দু-মুসলমান সকলেই রেশম মোলায়েম রূপে ঝাঁপ দিতে উতলা ছিলেন। বেলবটমের সাথে গলায় স্কার্ফ প্যাঁচিয়ে রেশমি দৃঢ় পা ফেলে মহল্লার গলি ধরে হেঁটে যাচ্ছে আর মেয়েরা জানালার গরাদ ও রেলিং ধরে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে তাকে একনজর দেখবে বলে;—দৃশ্যটি সেই সময় স্বাভাবিক ঘটনায় রূপ নিয়েছিল। ব্যস্ত সড়কের ধারে চায়ের দোকানে বসে গলা ভেজানোর ক্ষণে পাড়ার উঠতি বয়সী পোলাপান থেকে শুরু করে বুড়ো-হাবড়ারা তাকে দেখার সুখ মিটিয়ে নিতো।
সেকালে যারা ডানপিঠে যুবা ছিলেন তাদের মুখে শুনেছি মহল্লার সবচেয়ে ভয়ংকর ও দাপুটে এক নেতা রেশমির প্রেমে পড়েছিল। বাড়ি ফেরার পথে একদিন লোক লাগিয়ে রেশমিকে নিজের ঘরে তুলে নিয়ে যায়। প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ সত্য হলে লোকটির কপালে খারাবি ছিল বলতে হয়। রেশমি সেদিন তার আলিঙ্গন থেকে বারবার বাইন মাছের মতো পিছলে যাচ্ছিল। রেশম মোলায়েম পুরুষকে বুকের খাঁচায় পিষে মারার সুখ বেচারার পূরণ হয়নি। পুরুষের রূপ মসলিনের মতো সূক্ষ্ম বা পিচ্ছিল হলে তাকে বাগে আনা কঠিন হয়। মেয়েরাও সেখানে হার মানে। লোকটি চেষ্টার বাকি রাখেনি কিন্তু হয়রান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিল।
রেশমিকাণ্ডে ঘটনাটি নতুন মাত্রা যোগ করে সেই সময়। যারা তাকে পথেঘাটে একলা পেয়ে উত্যক্ত করেছে এতদিন তারা এই ঘটনায় ভয় পেয়ে যায়। রেশমিকে আড়াল থেকে দেখে আফসোস করা অথবা ‘হায় জান’ বলে দূর থেকে সিটি বাজানোর মাঝে মহল্লার বখাটেরা নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল। তাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি বিপদের কারণ হতে পারে এই ভয় তাদেরকে তখন তাড়া করে ফিরছে। চোখের সামনে দাপুটে নেতার গ্যাজলা ওঠা মুখচ্ছবি হয়ত ভেসে উঠত। রেশমিকে দেখে যাদের দাঁড়িয়ে যায় অথবা সবসময় দাঁড়ানোই থাকে, তাদের ওটা নিস্তেজ হয়ে পড়ার ক্ষেত্রে এই মুখচ্ছবির শুনেছি যথেষ্ট প্রভাব ছিল।
রেশমির নয়ন-মনোহর রূপ মহল্লার সকলের ভয় ও অস্বস্তির কারণ ছিল; —এই অনুমানটুকু ছাড়া ঘটনার সত্য-মিথ্যা সম্পর্কে আমি কিছু নিশ্চিত হতে পারিনি। তার এই রেশমবোনা কাপড়ের মতো মৃসণ রূপের কত গল্পই তো শুনেছি! নামের সাথে জোড়া ‘ফেরারি’র মতো রহস্যময় ছিল সেই রূপ। লোকটি সত্যি দেখতে কেমন ছিল সেটা আজ পর্যন্ত কেউ আমায় ঠিকঠাক বুঝিয়ে বলতে পারেনি। একজনের বিবরণের সাথে আরেকজনের মিল খুঁজে পাই না! মা বলত ওর গায়ের রং ছিল সোনালি আর উচ্চতা মানানসই। মহল্লার খালা-মাসিদের বলতে শুনেছি, একহারা গড়ন রেশমির গায়ের রং ছিল চাঁপাফুল! সূর্যের আলো পড়লে চাঁপাফুল থেকে সোনালি আভা ঠিকরায়, তার গা থেকে সেরকম আভা নাকি ক্ষণে-ক্ষণে চমকে উঠত।
মা-খালাদের এইসব কথায় বাবাকে চোখের চশমা নাকের ডগায় নামিয়ে মুচকি-মুচকি হাসতে দেখেছি, ‘আরে দুর! মাইয়ারা পুরুষ মানুষের রূপের কি বুঝব! রেশমিরে পাথর কাইটা খোদাই করছে এমুন একখান ভাস্কর্য বলা যাইতে পারে। একরত্তি খাদ ছিল না সেইখানে। রইদ পড়লে পাথর চমকায়। সেও যখন-তখন চমকাইত। সকালের রইদ পড়লে তারে সোনালি মনে হইত। বিকালে মনে হইত সোনালির মাঝে গোধূলি আইসা নামছে! রাইতের আলো-আইন্ধারে চিনতে কারো অসুবিধা হইত না। কথাবার্তা বেশি কইত না। সে যাউকগা, আমারে খুব সম্মান করতে দেখছি।
বাড়ি ফিরতে একদিন রাত হইছিল আমার। মহল্লায় তখন লোডশেডিং চলে। চারদিক আন্ধাইরে ডোবানো ছিল। ক্যান জানি মনে হইল হলুদ একখান আলো আমার গায়ে আইসা পড়ছে। পিছন ফিরা দেখি রেশমি পিছন-পিছন আসতেছে। আমারে সালাম দিল। ভালমন্দ দুচারটা কথা হইছিল তখন। বাড়ির গেটে পা দিয়া তারে কইলাম, ‘আসো। চা খাইয়া যাও।’ —‘আজ না চাচা। রাত হইয়া গেছে। আরেকদিন আমুনে। ভালো থাইকেন।’ কথাগুলা বলতে-বলতে পাশের গলি দিয়া নাইমা গেল। হের লগে কথা কওয়া কঠিন ছিল। কথা কইতে গেলে মনের উপরে কী জানি ভর করত! মন অভিভূত হইয়া যাইত তখন। একবার ভাইব দেখ, রক্তমাংসের এক লোক তোর লগে হাঁটতেছে। তার শরীরের গড়ন, গায়ের রং আমাগো থিকা আলাদা না, লোকটারে তবু অন্যরকম মনে হইত! নিশ্চিত হওয়া যায় না এমুন এক লোক ছিল সে। বুইঝাও বুঝন যায় না এমুন। এরপর কি আর তার লগে কথা আগান যায়!’
মহল্লার ছেলে-ছোকরা যারা এখন বিয়েশাদি করে বয়স্ক ও সংসারী হয়েছেন রেশমি ফেরারির রূপে তারা এভাবে জমে গিয়েছিলেন। তাদের মনের অলিন্দে সেই রূপকে ধরার বাসনা নিয়মিত হানা দিচ্ছে তখন। অবদমতি কামবিষাদে নিজের যৌবন তারা অপচয় করছিলেন রেশম-মোলায়েম এক পুরুষের পেছনে। প্রবীণ হয়ে পড়া যুবাদের সঙ্গে বাবার মতের খানিক মিল পেয়েছি, —‘রেশমি দেখতে কেমন ছিল সেইটা বুঝাইয়া কওন ঝামেলার কাম বুঝলা। সুন্দর স্বাস্থ্য ছিল তার। মুখে দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল থাকলেও আজিব এক আলো ছিল সেইখানে! চোখের মণির দিকে তাকানো কঠিন মনে হইত। মণিডা কালা না সোনালি না বাদামি সেইটা নিশ্চিত কইরা বলা সম্ভব না। এক-এক সময় এক-একরকম মনে হইত। নাক-ঠোঁট আমাগো মতন হইলেও গড়নে আল্লায় কী জানি দিয়া দিছিল! মাইয়াগো মতন মোটেও ছিল না, আবার বেটাছেলে কইবা সেই উপায় নাই। অন্যরকম ঠাউর হইত।
সেই সময় ঘাড় অব্দি লম্বা চুল রাখার চল ছিল। রেশমি লম্বা চুল রাখত। দিনের আলোয় চুলডা সোনালি মনে হইলেও রাইতের আলোয় তারে অন্যরকম লাগত। গলার স্বর ভারী ছিল না আবার মাইয়াগো মতন পলকাও না। শুনতে খুব মিঠা-মিঠা লাগত। জীবনে বহুত সুন্দর মানুষ দেখছি কিন্তুক রেশমি ফেরারি সগ্গলের থিকা আলাদা ছিল। মনে হইত তেজি ঘোড়ার উপরে রাজা বইয়া আছে, হের কানে সোনার দুল আর সেই দুলের থিকা আলো চারধারে ঠিকরাইয়া পড়ছে! একবার দেখলে বারবার দেখবার মন চাইত!’
. . .
সময়ের সঙ্গে প্রবীণ হওয়া যুবাদের কথা থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না অনেকদিন ধরে নিখোঁজ হলেও রেশমিকে তারা আজো ভুলতে পারেনি। ওই রূপ দেখার চাপা বাসনা তাদের তাড়া করে বেড়ায়। কিন্তু এইসব বিবরণ রেশমির রূপের ব্যাপারে বিমূর্ত ও হতভম্ব হওয়া ছাড়া অন্য কোনো পথ আমায় দেখাতে পারেনি। যেমন পারেনি এই প্রশ্নের উত্তর দিতে কেন সে ফেরারি। বেশ বুঝতে পারছিলাম মহল্লাবাসীর বিমূর্ত বিবরণের পাল্লায় পড়ে মনের অজান্তে রেশমি ফেরারির কাল্পনিক রূপে আমি নিজে ডুবতে চলেছি। তার রূপের প্রতি আমার আসক্তি বেড়েছে বৈকি। মানুষটিকে নিয়ে কৌতূহলের পারদ খালি বাড়ছেই। মহল্লার প্রবীণ মাসিমার সাথে বাতচিত করতে গিয়ে মনে হলো খানিক আলোর দেখা পাচ্ছি। মাসিমা মুখে পান ঠেসে আমায় বলছিলেন, ‘রেশমি তোরে পাইয়া বইছে মনে হয়। তুই তো শুনি লেখালেখি করস। হেরে নিয়া লিখবি তাই না?’ মাসিমার জিজ্ঞাসার উত্তরে আমি মাথা নাড়ি, ‘হ মাসিমা। মনে করো তাই। তোমাগো ঘরে তো হের যাতায়াত ছিল। কও না সে দেখতে কেমন ছিল? কী কথাবার্তা হইত তার লগে।’
আমার কথায় মাসিমা পিকদানিতে থুক করে একদলা পানের পিক ফেলে খিলখিল হেসে উঠেন, ‘আবাল ছাওয়াল একখান! রেশমি তো আইত আমার বাপের লগে দেখা করতে। জোয়ান মাইয়া-মর্দাগো চাইতে বুইড়া আর দুধের শিশুগো লগে হের ভাবভালোবাসা বেশি ছিল। রেশমি জোয়ান হওনের দিনে হের বাপে মারা গেল। মায়েও বেশিদিন টিকে নাই। ভাইবোনগুলার লগে বনাবনি ছিল না। ওরা তারে খুব হিংসা করত। দুই চউক্ষে দেখতে পারত না। এমুন রূপ সহ্য করে এক ঘরে থাকনডা কঠিন। রেশমি ফেরার হওয়ার পর তারা কোথায় জানি চইলা গেল! এখন তুই জানবি কেমনে সে কেমন ছিল দেখতে?’
মাসিমার বলা কথাগুলো আমার জানা নেই এমন নয়, তবু বলি, ‘তোমার কাছে হের লাইগা আইছি মাসিমা। মহল্লায় তোমাগো ঘর একমাত্র যারা রেশমিরে কাছে থিকা দেখছে। তার লগে মিলামিশা করছে। কও না তুমি কী জানো।’ আমার কথায় মাসিমা মুখ উদাস করে তোলে, ‘কী আর কমু! মহল্লার সগ্গলে তারে লোভ করছে। তার রূপের দিওয়ানা হইছে। লাজ-শরমের মাথা খাইয়া সেই রপ ভোগ করবার চাইছে। পোলাডার মনের ভিতর কি ছিল বুঝতে চায় নাই। কেউ কি খবর নিছে কেমনে হের দিন চলে? কই থাকে? কী খায়? কার লগে ঘুরেফিরে? কেউ জানবার চায় নাই। তারা ধইরা নিছে সগ্গলের ভোগে লাগনের জইন্য ভগবান এই মানুষডারে পাঠাইছে। রূপের চটক দিয়া মহল্লার লোকেগো তুষ্ট করা হইছে তার কাম। মানুষডার দেখভাল করনের ঠেকা আমার বাপে ছাড়া কেউ কিন্তুক লয় নাই।’
মাসিমার কথায় এই প্রথম আমার মনে প্রশ্ন জাগে, সত্যিই তো গরিব বাপের ঘরে জন্ম নেয়া রেশমির দিন চলত কী করে! খবর নিয়ে জেনেছি তার চলাফেরা বেশ পরিপাটি ছিল। গরিব ঘরের ছেলে এত পরিপাটি থাকে কী করে! পড়ালেখাও জানত শুনেছি। মাসিমার কথায় এই প্রথম অতীন্দ্রিয় রূপের অধিকারী রেশমি রক্তমাংসের জীবিত মানুষ হয়ে আমার মনে কৌতূহল জাগিয়ে তোলে, ‘এই কথাডা ভাবি নাই মাসিমা! তুমি কিছু জানো? জানলে কও না।’ মাসিমা আরেক খিলি পান মুখে পুরেন, ‘বোকা ছাওয়াল! জানুম না ক্যান। আমার বাপে রেশমির বাপরে চাকরি জুটাইয়া দিছিল। রেশমির পড়ার খরচ সে জুগাইছে। পরে শহরে কাজও দিছিল। কী কাজ সেইটা অবশ্য ভাইঙ্গা কয় নাই। শুনছি কী একটা ব্যবসা দেখাশুনার দায়িত্ব হেরে দিছিল। ক্যান দিছিল জানস?’
মাসিমার প্রশ্নের উত্তরে আমি মাথা নাড়ি, ‘কেমনে জানুম মাসিমা! আমার তখন জন্ম হয় নাই!’ আমার কথায় মাসিমা মৃদু হেসে উদাস হয়ে যায়, ‘ব্যবসায় লস খাওনের পর বাপের কঠিন অসুখ করছিল। মনের বিমার। সারাদিন মনমরা হইয়া বিছানায় পইড়া থাকে। ঘরের লোক, ডাক্তার-কবিরাজ কেউ কিছু করতে পারে নাই। একদিন মায়েরে ডাইকা কয় রেশমিকে খবর দাও। হেরে দেখতে মন চায়। রেশমি তখন বাপজানরে দেখতে আইছিল। তার গায়ে-মাথায় হাত বুলাইয়া কয় বাপ যদি মনমরা হইয়া বিছানায় পইড়া থাকে তবে অসুখ সারব না, কিন্তুক সে যদি ঠিক করে বিছানায় পইড়া থাকব না তবে আপনা থিকা সাইরা উঠব। রেশমির গানের গলা ভীষণ মিষ্টি ছিল। রামপ্রসাদ, লালন, রবি ঠাকুরের গান শুনাইছিল সেদিন। পরের দিন দেখি, ওমা, বাপে বিছানা থিকা ভোরবেলা উইঠা পড়ছে। যেন কিচ্ছু হয় নাই! আমারে কইল, ‘রেশমিকে তোর ভাই বইলা জানবি। সে এই ঘরের ছাওয়াল। মুসলমান হইতে পারে কিন্তুক আমাগো পর না।’
রেশমি আমাগো বাড়িতে যাওয়া-আসা করে দেইখা লোকে কত কথা কইছে তখন। বাপে ওইসব কথা কানে তোলে নাই। কানে না তোলার খ্যামতা ছিল তার। সগ্গলের সেইটা থাকে না। ক্যান, রেশমি তো মহল্লায় অনেকের ঘরে যাওয়া-আসা করছে। যাগো ঘরে গেছে তারা মনে-মনে ভয় খাইছে। কারণ কি জানস?’ —‘না মাসিমা, কী কারণ?’ আমার প্রশ্নে মাসিমা হাসেন, ‘লোকের মন বড়ো আজিব চিজ বুঝলি। মহল্লায় সগ্গলে মনে-মনে চাইছে রেশমি তাগো ঘরে আসুক। সে যদি তাগো ঘরে যায় তবে তারা বড়াই কইরা কইতে পারব রেশমি খালি চক্কোত্তিগো ঘরে যায় নাই, রূপের ডালি নিয়া তাগো ঘরেও আইছিল। ভাব-ভালোবাসার কথা কইছিল। মহল্লার লোকেগো কাছে সে ছিল রূপের বাকশো। এর চায়া বেশি কিছু না। সে হইছে পুরুষ মাতারি। তার রূপের লগে ভাব-ভালোবাসা করন যায় কিন্তুক মনডারে পুছনের কাম নাই। ভগবান হের বডিতে রূপ ঠাইসা দিছে। লোকের সেই বডির লগে কারবার, মনের ধার কেডা ধারে! রেশমি যাগো ঘরেই গেছে তারা মনে-মনে ভাবছে সে একবার আইছে এইডা ঠিক আছে, তাই বইলা বারবার আসনের কি দরকার! তারা এমুন কইরা ক্যান ভাবছে জানস?’
মাসিমার প্রশ্ন শুনে আমার খটকা লাগে। তার মানে দাঁড়াচ্ছে মহল্লার অনেক ঘরে রেশমির যাতায়াত ছিল। অথচ যাদের সাথে কথা বলেছি তারা সেটা কেন চেপে গেল বুঝতে পারছি না। আমি মাথা চুলকে মাসিমাকে উত্তর করি, ‘কই মাসিমা, কেউ তো একবারও কয় নাই রেশমি তাগো ঘরে গেছিল!’ আমার কণ্ঠে বিস্ময় টের পেয়ে মাসিমা পিকদানিতে পানের পিক ফেলে মুখ ঝামটার ভঙ্গি করেন, ‘সরমে কয় নাই। মনে-মনে তুষ্ট হইলেও বদনামের ভয় খাইছিল তারা! তাগো মনের ঘরে চোর, মুখে ঠাকুর ঠাকুর। বুঝস না ক্যান, মহল্লার লোকের কাছে রেশমি ছিল পুরুষ মাতারি। তাগো ছেলেমেয়ের জন্য আপদ। আচিয্যি রূপের জাদু দিয়া কারে কখন ফুসলায় কে কইতে পারে! আদর কইরা ঘরে বইতে দিলেও মনে-মনে ভয় পাইত। লোকে কানাকানি করছে রেশমি নাকি আমার বাপের পুরুষ ভাতারি। বাপে তারে দিয়া বাসনা মিটায়! বাপ যদি এইগুলা পাত্তা দিত তাইলে রেশমিকে আমরা চিনবার পারতাম না। আমাগো ঘরে সে ছিল মনের বিমার দূর করার দাওয়াই। যখন ঘরে ঢুকত মনে হইত ভগবান তারে পাঠাইছে ঘরের লোকজনরে রূপ আর কথা দিয়া আরাম দেওয়ার জন্য। বাপে জিনিসটা ধরতে পারছিল বইলা তারে স্নেহ করছে।’
মাসিমা কথার মাঝখানে বিরতি দিয়ে আরেক খিলি পান মুখে পুরেন, ‘আসল কথা হইছে রূপ দিয়া মানুষের মন ভুলান যায় কিন্তু মন দিয়া মানুষকে চাঙ্গা রাখনের খ্যামতা সগ্গলের থাকে না। ভগবান সেই খ্যামতা দিয়া রেশমিরে মহল্লায় পাঠাইছিলেন। দুঃখ কি জানস, তার এই শক্তিডারে কেউ পুছে নাই। সগ্গলে খালি হের রূপের পিছনে ছুটছে। রূপের বাইরে একডা সুন্দর মন ছিল। মানুষরে শান্তি দেওয়ার খ্যামতা ছিল। ওইডা কেউ বিচরাইয়া দেখে নাই। যদি বিচরাইত তবে তারে ফেরার হইতে হয় না। তার কথা শুনলে রূপের বিগার দূর হইয়া মনের আরাম মিলত। মহল্লার কেউ তো ভালোবাইসা দুইডা কথা তার লগে কয় নাই। তারা খালি কাছে পাইতে চাইছে। বাসনা পুরা করনের লাইগা হেরে সোহাগ করতে চাইছে। একডা কথা কই তোরে, আচিয্যি রূপ দিয়া ভগবান যারে গড়ছে তারে সোহাগ করা এক জিনিস আর সাদা মনে কাছে টানা অন্য জিনিস। আমার বাপে রেশমিরে কাছে টাইনা নিছিল, অন্যগো মতন সোহাগ করা বা ডাট মারার জইন্য ব্যবহার করে নাই।’
মাসিমার কথা শুনে বেশ বুঝতে পারছিলাম তার বাবা উদার প্রকৃতির লোক ছিলেন। জাতপাতের বাছবিচার বা এইসব বাতিক ছিল না। রেশমি হয়ত তার কাছে ঔষধী হয়ে ধরা দিয়েছিল, যার কথায় ও স্পর্শে মনের জ্বালা দূর হয়। লোকটিকে এই প্রথমবার রক্ত-মাংসের মানুষ মনে হচ্ছিল। যদিও সে দেখতে কেমন ছিল সেটা পষ্ট হচ্ছিল না কিছুতেই। আমার মাথায় তখন অন্য ভাবনা খেলা করছে। এতদিন এটা কেন মাখায় আসেনি ভেবে নিজেকে বোকা বোকা লাগছিল। চট করে মাসিমাকে জিগ্যেস করে বসি, ‘আচ্ছা মাসিমা, রেশমির তো তোমাগো ঘরে যাতায়াত ছিল। তার ফটো নাই?’ আমার কথা শুনে মাসিমা মুচকি হাসেন, ‘বেক্কল কারে কয় দেখো! থাকব না ক্যান, ঢের আছে। কিন্তুক ফটো কি আর আসল মানুষডারে চিনাইবার পারে? পারে না। রেশমির লগে আমার বাপের ছবি আছে। আমার নিজের আছে। আমাগো ঘরের সগ্গলের ছবি আছে। দেখবার চাস?’
আমার মন খুশিতে নেচে ওঠে, ‘হ মাসিমা, দেখবার চাই।’ মাসিমা খাটের পাশে সিন্দুকে হাত ঢুকিয়ে পুরোনো দিনের অ্যালবাম বের করে আনেন। সময়ের চাপে অ্যালবামটি জীর্ণ হয়ে পড়েছে। রঙিন ছবির যুগ শুরু হলেও সাদা-কালোর রাজত্ব তখনো শেষ হয়নি। অ্যালবামের ছবিগুলো সাদা-কালো। আমি পাতা উল্টাতে থাকি। রেশমি ফেরারিকে চিনে নিতে অসুবিধা হয় না। ছবি দেখে হতাশ হয়ে পড়ি। ছবিতে যাকে দেখছি সে সুন্দর তাতে সন্দেহ নেই। হলিউড সিনেমার পর্দা কাঁপানো নায়ক ক্লার্ক গ্যাবলের সাথে চেহারায় খানিক মিল রয়েছে। ওর মতো রমণীমোহন এক পুরুষ সে। কিন্তু এতদিন ধরে যা শুনে এসেছি তার ছিটেফোঁটা ছবিতে খুঁজে পাই না। তাহলে কি রেশমি ফেরারির সৌন্দর্য শুধুই গল্পগাছা! লোকের বানোয়াট কল্পনা দিয়ে বোনা কিংবদন্তি!
আমার বিস্মিত ও হতভম্ব মুখপানে চেয়ে মাসিমা খিলখিল হেসে উঠেন, ‘বোকা ছাওয়াল একখান। যে মানুষের গায়ে আলো পড়লে চমকায় ছবি তারে কেমনে ধরব? যার চোখের দিকে একবার তাকাইলে মনে হইত সব ভাইসা যাইব, তার চোখের ওই আলোডারে ছবি কেমনে ধরব ক? মানুষডা পাশে বইলে মনে হইত গা থিকা চাঁপা ফুলের ঘেরান আসতাছে। তারে তুই ছবিতে কেমনে পাইবি? ওরে বেক্কল, তুই কি ভাবছস ছবির মানুষডা সেই মানুষ মহল্লার লোক যারে সামনে থিকা দেখছে! রেশমির ছবি দেইখা তুই হের কলাডাও বুঝবি না। বুঝন যাইব না হেয় কী কইরা মানুষরে জাদু করত। যা, ঘরে যা। আমার আর কিছু কওনের নাই।’
আমি তখন হতাশা ও ভ্রান্তির মাঝে থম মেরে বসে আছি। ছবির রেশমি আমাকে ধাম করে মাটিতে নামিয়ে এনেছে। একজন সুন্দর চেহারার মানুষের চেয়ে বেশি কিছু নয় লোকটা! রূপের যে-বিস্ময় তাকে কিংবদন্তি করে তুলেছে ছবির মানুষটির চাউনি ও অবয়বে সেরকম কিছু খুঁজে না পাওয়ায় নিজের ওপর রাগ হচ্ছিল। রেশমি ফেরারিকে নিয়ে মহল্লাবাসীর অতিকল্পনার জগৎকে বড়ো বেশি পাত্তা দিয়ে ফেলেছি আমি। ভুলেই গিয়েছি এই দেশ লোকজন আবেগী ও কল্পনাপ্রবণ হতে ভালোবাসে। তুচ্ছ বিষয়কে কল্পনার রংতুলি দিয়ে প্রকাণ্ড করার ক্ষমতা তাদের জন্য ডালভাত। এই কারণে হয়ত কিংবদন্তির এত ছড়াছড়ি এখানে! রেশমি ফেরারির ঘটনা হয়ত-বা সেরকম কিছু ছিল।
ওদিকে মাসিমার কথাগুলো মন থেকে তাড়ানো যাচ্ছে না। রেশমির রূপ নিয়ে সে বাড়িয়ে কিছু বলেনি। রক্ত-মাংসের মানুষ সাধারণের চেয়ে অধিক রূপবান হলে অন্য মানুষের মন কাড়ে, মানুষ তাকে মনের আশ মিটিয়ে দেখে, কল্পনার রংয়ে পল্লবিত হয়, মনে-মনে বাসনা করে, মাসিমার কথা থেকে মনে হয়েছে রেশমির রূপের সেই বিশেষত্ব ছিল। মহল্লার নারী-পুরুষের তার প্রতি মোহের এটা বড়ো কারণ। বাকিটা লোকের অতিকল্পনা হলেও হতে পারে। রেশমির মনের খবর মাসিমা আমায় দিতে পেরেছে। একটি প্রচণ্ড সুন্দর মন ছিল তার। মিতভাষী লোকটির কথার মধ্যে জাদু ছিল। লোকের মনে এই জাদু আরাম এনে দিত। মহল্লার বাকিরা সেই মনের হদিশ পায়নি কিন্তু মাসিমার পরিবার সেটা পেয়েছিল। একটি লোকের কিংবদন্তি হওয়ার জন্য এটা কম কিসে!
. . .
রেশমি ফেরারিকে নিয়ে আমার কৌতূহলের ইতি মাসিমার ওখানে ঘটে গিয়েছিল। একটা জিনিস কেবল জানার বাকি ছিল,—তার পরিণতি! মহল্লা থেকে কী কারণে সে হুট করে হাওয়া হয়ে গেল সেই জট কিছুতেই খুলছিল না। মাসিমা ততক্ষণে আমার হাতের অ্যালবামটি সিন্দুকে ঢুকিয়ে বিছানায় পাশ ফিরেছেন। এর অর্থ হলো আমায় এখন যেতে হবে। আমি তবু ইতস্তত করে তাকে জিগ্যেস করি, ‘যাই মাসিমা। যাওনের আগে একটা কথা জিগাই, রেশমি ফেরারি মহল্লা থিকা নিখোঁজ হইছিল ক্যান? নিখোঁজ হওয়ার পর সে কি ফিরা আসছিল কুনুদিন? ব্যাস, এই কথাখান জিগানোর ছিল। তুমি কিছু জানো?’
আমার প্রশ্নের উত্তর মাসিমা পাশ ফিরেই দিয়েছিলেন, ‘সে তো নিখোঁজ হয় নাই। তারে খুন করা হইছিল। যাগো কাজ করত হেরা নিখোঁজ কইয়া ধামাচাপা দিছে। রেশমি তাগো ব্যবসার গোপন কিছু জাইনা ফেলছিল। সত্যমিথ্যা জানি না তবে শুনছি খুন করার পর কী একটা এসিড দিয়া তার বডির নিশানা তারা মুইছা দিছিল। আমরা অনেক খোঁজখবর করছি কিন্তুক লাশ পাই নাই। পুলিশ কেস হইছিল। তদন্ত কইরা তারা কিছু বাইর করতে পারে নাই। থানার রেকর্ডে রেশমি নিখোঁজের লিস্টিতেই আছে। বাপে বাইচা থাকলে ঘটনাডা ঘটত না। আমার কিন্তুক বিশ্বাস হয় না সে খুন হইছে। হইতে পারে একদিন মহল্লায় ফিরা আসব। ভগবানের কাছে আমি হেই মিনতিই করি।’ মাসিমা তখন ফুপিয়ে কাঁদছেন। তার গলা ধরে এসেছে বুঝে আমি আর কথা বাড়াইনি। ‘যাই মাসিমা’ বলে বেরিয়ে আসি।
মনের মধ্যে ঝড় উঠেছিল সেদিন। সুন্দরের জন্য ঈশ্বরের পৃথিবী উপযুক্ত জায়গা নয়;—কথাটি কেন জানি বারবার মনের দুয়ারে কড়া নাড়ছিল। রেশমির দেহ তার মিত্র না হয়ে বরং প্রতিপক্ষে পরিণত হয়েছিল। কবে কোথায় পড়েছিলাম, কেউ একজন লিখেছিল, ‘মানুষের সংসারে সুন্দর বলে কিছুর অস্তিত্ব নেই। সুন্দর এখানে দাঁড়াতে পারে না। অসুন্দরকে স্থান করে দিতে তাকে অকালে বিদায় নিতে হয়। অসুন্দরের রাজত্বে সুন্দর হচ্ছে জল্পনা। এমন এক জল্পনা যেটি ঘটতে পারত কিন্তু কভু ঘটে না।’
কথাগুলো পড়ার পর খুব রাগ হয়েছিল। যে-লোক কথাগুলো লিখেছে তার প্রতি মন বিরূপ হয়ে উঠেছিল। কী ভয়ানক নিরাশা এই লোকের! মনে হয়েছিল নিজেকে সে ঘৃণা করছে। বেঁচে থাকার সুন্দর অভিজ্ঞতাকে ঘৃণা করছে। চারপাশে জীবনের তরঙ্গ ও ঘাত-প্রতিঘাতের খেলাকে কুৎসিত মনে হচ্ছে তার! কথাগুলো আমি ভুলে থাকতে চেয়েছিলাম। এতদিন মনে পড়েনি। আজ, আমায় আশ্চর্য করে স্মৃতিতে হুবহু উদয় হলো দেখে অসাড় লাগে নিজেকে।
মাসিমার ঘর থেকে বেরিয়ে এলোপাথাড়ি হাঁটছিলাম। ঘড়িতে তখন রাত দশটার সংকেত দিয়েছে। বাড়ি ফেরা প্রয়োজন। মা এতক্ষণে উতলা হয়ে উঠেছে নিশ্চয়। রাতের আকাশে আজ খুব মেঘ করেছে। একটু পরে বৃষ্টি নামবে মনে হয়। মহল্লার প্রায়ান্ধকার গলি ধরে হাঁটার সময় মনে হলো কেউ একজন পেছন-পেছন আসছে। সোনালি আলোর ক্ষীণ রেখা চুইয়ে পড়ছে আমার পায়ের পাতায়। চমকে পেছন ফিরে তাকাই। কাউকে দেখতে পাই না। গলিরাস্তা যথারীতি শুনশান। ‘দুর যত্তসব!’ বলে পা চালিয়ে হাঁটা শুরু করি। মনে-মনে ভাবি, ঘরে ফিরে রেশমি ফেরারি নামের রূপবান পুরুষটিকে চিরতরে স্মৃতি থেকে মুছে দিতে হবে।