পশু ও মানুষ । আহমদ মিনহাজ
প্রকাশিত হয়েছে : ১০ জুলাই ২০১৯, ৮:১৩ অপরাহ্ণ, | ২০৮৮ বার পঠিত
কেউ আমায় ‘পশু’ বলে ডাকলে মনে খুশি হই ভেবে মানুষের সত্যিকার পরিচয়টি সে আমায় স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। ভয়ে কেঁপে উঠি যখন কেউ ‘মানুষ’ নামে ডাক দিয়ে ওঠে। মানুষের সঙ্গে এতদিন ধরে আছি তবু নিজেকে মানুষ ভাবতে খুব অস্বস্তি হয়। পশু হয়ে থাকাটা আমার জন্য মৌলিক ও সহজাত ছিল হয়ত; মানুষ হওয়ার নামে এই যে এত ভুলচুক, মাঝেমধ্যে হাঁপ ধরে বুকে, মনে-মনে ভাবি ভালোই ছিল সেই দিনগুলো যখন পশুকুলের একজন হয়ে মানুষ বন-বাদাড়ে ঘুরে বেড়াত। অন্য পশুর মতো ওরা পরস্পরকে ভালোবাসত এবং সুরক্ষার প্রয়োজনে হিংস্র হত! মানুষে পালটে যাওয়ার দিন থেকে এই এক ঝামেলা হয়েছে, ভালোবাসতে গেলে হিংস্র হতে পারি না আর হিংস্র হলে ভালোবাসায় টিকে থাকতে পারি না। পশুকুলে ফেরত যাবার বাই চাপে মাথায়। নিজেকে জাগিয়ে তুলি পশুর মতো। তবু কোথায় যেন ভুলচুক ঘটে যায়। পশু হওয়ার ক্ষণে টের পাই আমি আসলে মানুষের মতো আচরণ করে ফেলছি। মানুষের মতো হত্যা করছি মানুষকে, শ্লীলতাহানী করছি মানুষীর, ধারাল শ্বদন্ত বসিয়ে খুবলে খাচ্ছি সমুদয় প্রাণীর রক্ত-মাংস-কলিজা। আমার কাণ্ড দেখে তোমরা ভয়ে ঘৃণায় ফেটে পড়ে,—‘দেখ কী নিশৃংস কাণ্ড ঘটিয়েছে জানোয়ারটা! সাপের মতো ছোবল মেরেছে, হায়েনার মতো খুবলে খেয়েছে, কুমির হয়ে গ্রাস করেছে! ও আসলে মানুষ নয়, পশুর মতো খিদে ওর; ওকে মানুষ ভাবতে ঘেন্না হয়, গা গুলিয়ে ওঠে।’
তোমাদের এইসব ধিক্কার শুনে আমার বুকের ভিতর হাহাকার জেগে ওঠে। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হয়,—না…না…ভুল ভাবছ তোমরা। আমাকে দিয়ে পশুর মতো হচ্ছে না। পশুরা যেভাবে করে সেভাবে হচ্ছে না। বাঘ-সিংহ-হায়েনার মতো হচ্ছে না। সাপের মতো হচ্ছে না। কুমিরের মতো মোটেও হচ্ছে না। পশু, পতঙ্গ অথবা সরীসৃপ যেমনটি করে আমায় দিয়ে সেটা হচ্ছে না। আমার নৃশংসতাগুলো অবিকল মানুষের মতো হয়ে যাচ্ছে। আমি মানুষের মতো খুন করেছি। মানুষ যেভাবে করে ঠিক সেভাবে সারারাত ওকে বলাৎকার করেছি। যেখানে-সেখানে যাকে ইচ্ছা তাকে ধরে মানুষের মতো মেরেছি। পশুরা যেভাবে পশু ও মানুষ মারে সেভাবে পারিনি। ওদের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে শত্রুর টুঁটি চেপে ধরতে পারিনি। ওরা হচ্ছে জাত শিকারি; আমি ওদের মতো শিকারি হতে গিয়ে শেষমেষ মানুষের মতো করে শিকারি বনেছি। বিষধর কেউটে হয়ে ছোবল মারতে গিয়েছিলাম, কিন্তু পারিনি, বরং মানুষ যেভাবে ছোবল মারে ঠিক সেভাবে মেরেছি। আমার কোথাও ভুল হয়েছে বুঝলে, সবকিছু গড়বড় হয়ে যাচ্ছে।
ধরো বাবা কেউটে মা কেউটে সাপের সঙ্গে দীর্ঘ রতিমিলন শেষে ওকে ছেড়ে চলে গেছে। মিলনসুখে বিভোর মা কেউটে তারপর গর্তে ঢুকে অনেক ডিম পেড়েছিল। ডিম ফুটে ছানাপোনারা বেরিয়ে এসেছে। দারুণ মিষ্টি দেখতে হয়েছে বাচ্চাগুলো! পরস্পরের সঙ্গে লেপ্টে থাকার পর গর্ত থেকে মাথা তোলার মহড়া দিচ্ছে ওরা। ওদিকে ক্ষুধার জ্বালায় অস্থির বাবা কেউটে শিকার না পেয়ে গর্তে ঢুকে পড়েছে। মা কেউটে তখন সবে জলে নেমেছিল শরীর জুড়াবে বলে। বাবা কেউটে এই সুযোগে বাচ্চাগুলোকে সাবাড় করছে। মা কেউটের রাগ হওয়ার কথা ছিল; ও কিন্তু বাবা কেউটের ওপর রাগ করে থাকতে পারছে না। ক্ষুধার চোটে এরকম ভুল ওর নিজেরও মাঝেমধ্যে হয়, ছানাপোনা সাবাড় করে ফেলে মনের ভুলে। মা কেউটে বাবা কেউটেকে তাই ক্ষমা করে দিয়েছে সংক্ষিপ্ত তিরস্কারে,—‘ছিঃ! কী করলে এটা! বাচ্চাগুলো একা সাবাড় করে দিলে! মানুষের মতো হ্যাংলা হয়েছ, দিনরাত খালি খাই খাই। যখন-তখন যাকে-তাকে ছোবল মারছ মানুষের মতো। তোমাকে কেউটে ভাবতে ঘেন্না হচ্ছে আমার। ছিঃ!’
জগতে সর্পকুল প্রেম, খাদ্য ও রমণে সহজাত চিরকাল! আমার প্রেমের পিপাসা কেউটের মতো মোটেও হয়নি। খাদ্য ও পানীয়ের তেষ্টা কিংবা ধরো কাউকে রমণের লিপ্সা সহজ অভ্যাসের তাড়নায় পূরণ করার অধিকার আমি হারিয়েছি। আমাকে খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ করতে হয় বিচিত্র পদ্ধতিমাফিক। কামবাসনা মিটাতে হয় অনেক ভেবেচিন্তে, বহুবিধ সামাজিক নিষেধের শর্তে দাসখত লিখে দিয়ে। জৈবস্বভাবের ছাড়পত্র আমার জন্য অবাধ নেই আর। জৈব অভ্যাসের দাসত্ব থেকে সামাজিক অভ্যাসে নিজের রূপান্তর আমাকে হিসাবী ও চতুর করেছে। মানুষ ও জগতের সমুদয় প্রাণকে ভক্ষণ, হত্যা ও বলাৎকারে আমি তাই পশুর সহোদর নই। পশুর মতো করলেও আমি সেই পশু নই যে ওটা করে সহজাত বাসনার ক্ষুধা মিটায়। মানুষ যেমন কারণে ও অকারণে এইসব করে বেড়ায় ঠিক সেরকম আমি মানুষকে আঘাত করেছি, বিচিত্র প্রাণকে বিনষ্ট করার শক্তি ধারণ করেছি বক্ষে।
তোমরা পশুর থেকে পৃথক হয়েছ বলে এত ভুলচুক এত অবদমন। ঘৃণা ও ভালোবাসা, ইচ্ছা ও অনিচ্ছা, সম্মতি ও অসম্মতি, জৈব ও বায়বীয় প্রেমের এত ভ্যানতারা। কী লাভ হল বলো? আটকাতে কি পারলে সেই পাশবতা যার নাম দিয়েছ ‘হত্যা’; যাকে প্রয়োজন মনে করে ডাকছ ‘জীবনযুদ্ধ’; গালভরে যার নাম রেখেছ ‘হংসমিথুন’; যার ব্যতিক্রম হলে ঘৃণায় নাক কুঁচকে বলে উঠছ,-ইস ‘বলাৎকার’ করেছে পশুটা! তোমাদের ওইসব প্রলাপবাক্য থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য আমি বেরিয়ে পড়েছিলাম। আকাশে তখন পাক খাচ্ছিল অযুথ হংসবলাকা। ওদের মতো উড়ার ক্ষমতা থাকলে আমি হয়ত ঠিক পৌঁছে যেতাম হংস সরোবর। সেখান থেকে হয়ত উড়াল দিতাম মহাশূন্যে। ওরা স্মরণ করিয়ে দিল আমার ডানা নেই। উড়োজাহাজে করে উড়াল দিতে পারি বটে, ঢুকে যেতে পারি মেঘের দেশে, তবু কখনও উড়তে পারব না ওদের মতো করে, ওরা যেভাবে নির্বিকার ডানা মেলে উড়ে হাজার মাইল! এই অক্ষমতা আমায় পাগল করে দিল আর আমি গুলি চালিয়ে মাটিতে ঝটপট ফেলে দিলাম হংস সরোবরের পথে নামতে থাকা বলাকার ঝাঁক। বলাকার রক্ত দিগন্তে ছলকে উঠলে কে যেন ‘বলাৎকার’ বলে চিৎকার দিয়ে উঠেছিল। কেশরবাই ততক্ষণে তীব্র হয়েছেন পটমঞ্জরী রাগে। আমার তখন মনে পড়ল জীবনের এইসব রাগ–রাগিণীর মায়া ছেড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার পথে আমি মানুষকে খুন করে এসেছি; পিচঢালা সড়ক ধরে মেঠোপথে নেমে যাওয়ার মুহূর্তে মানুষীকে ধরে আচমকা সারারাত করেছি; যেন কেউ আমাকে মানুষ বলে কখনও ডাক দিতে না পারে।
বিশ্বাস করো, পশু ও সরীসৃপের মতো করতে পারলে আমি বরং খুশিই হতাম, কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও সেটা হচ্ছে না। সহজ অভ্যাসের বশে আমি কিছু করতে পারছি না এখন। মায়ের পিচ্ছিল গর্ত থেকে বেরিয়ে আসার পর আমি শিখেছিলাম কেউটে সাপের বাচ্চা থেকে মানুষের বাচ্চা কেমন করে আলাদা হয়ে যায়। আমাকে শেখানো হয়েছিল কেউটে ফণা তোলে আত্মরক্ষার তাড়নায়, আর মানুষের বাচ্চা ফণা তোলে হৃদয়ের সুপ্ত বাসনার পিপাসা মিটায়। তোমাদের পৃথিবীতে এসে আমি শিখেছি পশুর কায়দায় কাউকে হত্যা করলে ওটা হত্যা হবে না, সকল প্রাণকে ধরে-ধরে পশুর কায়দায় বলাৎকার করলে ওটা বলাৎকার হয়ে যাবে না, ওটা খুব বেশি হলে পশুর জৈবস্বভাবকে স্মরণ করিয়ে দেবে, যাকে ক্ষমাঘেন্না করে মানুষ নিজেকে পশুর থেকে পৃথক করে নিয়েছিল। এই পার্থক্য তোমরা না দেখার ভান করছ ভাবলে হাহাকার জাগে মনে।
আশ্চর্য এই পৃথিবীতে আসার পর জেনেছি মানুষ হচ্ছে সেই প্রাণী যে তার নিজেকে অথবা অন্যকে কারণবশত এবং নিছক অকারণে বিনষ্ট করতে পারে। সগুণ এই ক্ষমতার মহিমায় নিজেকে সে অমৃতের বরপুত্র ঘোষণা করেছে। পশুরা আপন স্বভাবের দাস। মানুষ তার স্বভাবকে অতিক্রম করে অন্যকিছু হওয়ার জন্য নিজেকে খাটায়। ওর মধ্যে পশুর সহজাত ভাব রয়েছে, আবার পশুভাব দমন করার অপ্রতিরোধ্য শক্তিও ধারণ করে হৃদয়ে। মানুষ তাই পশুর সহোদর হলেও পশু নয়। তোমরা ভাবছ খুনগুলো করার সময় আমি অবিকল পশু হয়ে গিয়েছিলাম, ওই মানুষীকে বলাৎকার করার ক্ষণে পশুর মতো চড়াও হয়েছিলাম ওর ওপর…তোমরা ভুল ভাবছ। খুন ও বলাৎকারের মুহূর্তে নিজের মধ্যে কোনো রূপান্তর আমি টের পাইনি। খুনের আগে আমি মানুষ ছিলাম, খুনের পরেও তাই রয়েছি। ওই মানুষীর ওপর লালসা মিটানোর আগে যেরকম শান্ত ও ছটফটে ছিলাম, সবকিছু চুকেবুকে যাওয়ার পরে অবিকল সেরকম আছি। পশুভাব আমার মধ্যে জেগে উঠলে আমি কিন্তু ওভাবে পারতাম না, যেভাবে হত্যা করেছি মানুষকে, উদগ্র লালসায় রক্তাক্ত করেছি মানুষীকে। আমাকে পশু বলে তিরস্কার করার আগে একবার ভাবো জগতের সবচেয়ে হিংস্র পশুর পক্ষে ওভাবে করা সম্ভব কি না, আমি যেমনটি করেছি ওই মানুষকে, ওই পশুকে, আর ওই মানুষীকে!
তোমরা আমাকে ‘পশু বা জানোয়ার’ বলে যখন ডাকো কষ্ট হয় ভেবে এই তোমরাই ওদের থেকে নিজেকে পৃথক করে ‘মানুষ’ নাম নিয়েছ, জাঁক করে বলছ, —‘ওদের জন্য যেটা স্বভাব, মানুষের জন্য সেটা হল কু-ভাব।’ তোমাদের কথা যদি সত্যি হয় তবে জেনে রাখো আমি অনেক চেষ্টা করেও ওই মানুষটিকে চিতার মতো ঘাড় মটকে মারতে পারিনি; সিংহের মতো রয়েসয়ে রাজকীয় বিক্রমে ওর রক্ত চাটতে পারিনি; হাজার চেষ্টা করেও ওই মানুষীকে ষাঁড়ের মতো আচমকা আঘাতে রমণের শিহরণে অপ্রস্তুত ও উতলা করতে পারিনি। আমি যেটা করেছি সেটা বলাৎকার, —মানুষ যেমনটা করে; যেভাবে আমি ওর মুখে কাপড় গুঁজে দিয়েছিলাম, যেন অনিচ্ছায় রাগমোচনের ক্ষণে সে চিৎকার দিতে না পারে। স্বেচ্ছায় রাগমোচনকে তোমরা ‘ভালোবাসা’ বলে ডাকো, অনিচ্ছায় হলে ওটাকে ‘বলাৎকার’ বলে চেঁচাও। আমি দুটোর বাইরে গিয়ে পশুকুলে ভিড়তে চেয়েছিলাম। রমণের ঋতু ওদের মনে ঘনীভূত হলে ওরা আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়ে, আমিও সেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়তে ব্যাকুল ছিলাম। আফসোস! আমায় দিয়ে হয়নি! ঝাঁপ দেয়ার ক্ষণে আমাকে ওর মুখে কাপড় গুঁজে দিতে হল, হাত পিছমোড়া করে বাঁধতে হল, আর ওকে বিদ্ধ করার ক্ষণে টের পেলাম ও কাঁদছে। পশুরা রমণের মুহূর্তে কাঁদে না। ওরা একে অন্যকে খেলায়, তারপর খেলা শেষ হলে আচমকা ওটা শুরু হয়, শেষ হয় যেন কিছুই ঘটেনি এতক্ষণ! ওই দেখ, সবুজ মাঠে দাঁত দিয়ে ঘাস ছিঁড়তে ওরা ব্যস্ত এখন!
পশুর এই সহজাত বন্যতাকে কী বলে ডাকবে এখন? এর নাম দেয়া যেতে পারত ‘অবিকার মিলন’। রাগমোচন শেষ হলে অবিকারচিত্তে বেঁচে থাকার ময়দানে ফিরে যাওয়া। আমি সেই ভাবের বশীভূত থাকতে চেয়েছিলাম আজীবন। পশু থেকে নিজেকে পৃথক ভাবার কারণে সেটা হল না। যা হয়েছিল সেটা হয়ত বলাৎকার;—মানুষ যেটা আচমকা করে ফেলে যেখানে-সেখানে যখন-তখন; অতঃপর অপরাধবোধ হানা দেয় মনে, আর নিজেকে সে অপরাধী করে পশু ভেবে। মানুষ ভুলে যায় পশুরা কখনও অপরাধ করে না। ওরা হত্যা ও রমণে উতলা হয় জৈব নিয়মের ফেরে। হরিণী ঋতুচক্রের ফেরে হরিণে উতলা হয় আর সুগন্ধে মাতাল হয় চম্পাচামেলির বন। ওরা দায়িত্বশীল নিজের সহজ স্বভাবের টানে। তোমরা যাকে ‘নিষেধ ও ব্যাভিচার’ বলো পশুরা দায়মুক্ত তার থেকে।
একবার ভাবো, মা পশু কতটা দায়িত্বশীল তার নিজের স্বভাবে! মা কুমির বাচ্চাদের আগলে রাখে ক্ষুধার্ত বাবা কুমির থেকে। বাঘিনী চণ্ডকালী হয়ে বাচ্চাদের আগলায় ক্ষুধায় পাগল বাঘের থাবা থেকে। জগতের সমুদয় স্তন্যপায়ী মাতৃপ্রাণ আপসহীন আগলে রাখে শিশুপ্রাণ ঘর ও বাইরের শত্রুর থেকে। ওরা এভাবেই স্বাভাবিক নিজের জীবনে। তাকিয়ে দেখ, জলের সন্ধানে সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দিচ্ছে হাতির দল। জলকষ্টে বাচ্চা হাতিটি লুটিয়ে পড়েছে ঊষর প্রান্তরে। বয়স্ক হাতির দল ওকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের চোখে বাঁধভাঙা অশ্রুর ঢল নেমেছে, শুঁড় দিয়ে ক্ষণে-ক্ষণে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করছে দলের কনিষ্ঠ সদস্যটিকে। এই মমতা হচ্ছে ‘দায়িত্বশীলতা’। পশু থেকে নিজেকে পৃথক করার দিন যখন এল তোমরা ‘দায়িত্বশীলতা’র নাম দিলে ‘মমতা ও ভালোবাসা’; ‘সুরক্ষা’ বলতে পশুরা যেমন বুঝে তোমরা তার নাম পালটে রাখলে ‘মানবতা’! একবার ভাবো, পশুরা এইসব বিশেষণ ছাড়াই দায়িত্বশীল হয়। পশু হতে গিয়ে দেখেছি আমি ওদের মতো নাই আর। নিজের সুরক্ষার জন্য মরিয়া হয়ে অন্যকে অরক্ষিত করেছি বহুবার। পশুর সঙ্গে আমার তুলনা শোভন নয়। তোমাদের ভুল হচ্ছে কোথাও। তোমরা বরং বলতে পারতে আমি পশুর মতো হত্যা ও রমণ করতে শিখিনি, মানুষের মতো বিনষ্ট করছি মানুষ ও সমুদয় প্রাণ।
আমাকে পশু, সরীসৃপ অথবা জানোয়ারের নাম ধরে ডেকো না। ওদের অতুলনীয় মারণবিষ, নিজেকে সুরক্ষিত রাখার আয়ুধ আমার জানা নেই। আমাকে অস্ত্র বানিয়ে নিতে হয়েছিল। একদিন ওটা সত্যি প্রয়োজন হয়েছিল। গুহার বাইরে বুনো শ্বাপদের গরগর আওয়াজ পেয়েছিলাম। ও ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে বুঝে শুকনো কাঠে পাথর ঘষে আগুন জ্বালিয়েছি আর বল্লম হাতে পালটা হুংকার দিয়েছিলাম ওকে ভয় দেখাতে। বনের মধ্যে ভরদুপুরে গাছের ডালে ফণা তুলেছিল বিষধর সাপ। ওকে নিশানা করে তীর ছুঁড়ে মেরেছিলাম ছোবল মারার আগে। সাগরে আচমকা হাঙ্গরের লেজের ঝাপটা টের পেয়ে চকিত বেগে তুরপুন ছুঁড়ে রক্তাক্ত করেছি ওর শিরদাঁড়া। এসবের প্রয়োজন ছিল। বিষাক্ত বিছে পিষে মারাটা আমার জন্য প্রয়োজন ছিল। রক্তচোষা ঝোঁকের মুখে নুন ফেলে ওকে হত্যা করা দরকারি ছিল। সুরক্ষার জন্য পশুরা যেমন করে আমিও সেটা করেছি নিঃসঙ্কোচে। সেই প্রয়োজন এখন খেয়াল হয়ে গিয়েছে। আমি হচ্ছি খেয়ালি সম্রাট। হত্যা ও বলাৎকার করেছি খেয়ালি বাসনা মিটানোর নেশায়। আহা! আবার যদি পশুর জীবনে ফেরত যাওয়া যেত! আমি হয়ত দায়িত্বশীল হওয়ার চেষ্টা করতাম একবার; পশুরা যেমন দায়িত্বশীল হয় একে অন্যকে খাদ্যে পরিণত করা ও আগলে রাখার প্রকৃতির বিধানে!
আমার এখন সেই সিংহের কথা মনে পড়ছে, পছন্দের সিংহীকে পাওয়ার জন্য অন্য সিংহকে সে তার নিজের ডেরায় ঢুকতে দেয়নি। সিংহী ওটা দিয়ে মেপে নিয়েছিল প্রেমিকের শক্তি ও বুদ্ধির ধার। আমার মধ্যে কোনো এক ধূসর কালে এই গুণ সহজাত ছিল। মানুষ নাম ধারণের পর থেকে বুঝে গেছি আমি আর দায়িত্বশীল নই নিজের সহজ পরাক্রমে, আমি বরং পছন্দের মানুষ ও মানুষীকে বীরত্ব দিয়ে মোহিত করার ছলে খুন অথবা বলাৎকার করে ফেলতে পারি অনায়াস। সিংহ নিজের সিংহীকে কখনও খুন করে না, সে বরং খুন হয় লড়াইয়ে ক্ষুরধার অন্য সিংহের কাছে। এর নাম হচ্ছে পশুত্ব। যাকে ভালোবাস তাকে পাওয়ার জন্য বলি দিও নিজেকে, মোহিত করো ওকে নিজের পরাক্রম দেখিয়ে। আমিও পশুর পরাক্রম দেখিয়ে মোহিত করতে চেয়েছিলাম ওই মানুষীকে। পারিনি। কারণ আমার মধ্যে তখন মানুষ জেগে উঠেছিল! আহা মানুষ! সে জানে না পশুকুলের সঙ্গে পৃথক হওয়ার দিন থেকে দুটানার সঙ্গে তার বসবাস। সে আজও ঠিক করে উঠতে পারল না তার এইসব হত্যা ও বলাৎকার পশু নাকি মানুষের মতো হয়ে যাচ্ছে বারবার!
কী মনে হয় তোমাদের, প্রবৃত্তির টানে আমি ওই মানুষীকে সারারাত করেছি? পাশব স্বভাবের টানে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম কামের বাসনা মিটাতে? ওই দেখ, পুকুরের জলে স্ত্রী হাঁসকে দলবেঁধে ঝাপটে ধরেছে পুরুষ হাঁসের দল। রমণের পুনঃপুনঃ আঘাতে বুদুবদ উঠেছে জলে। ছটফটে স্ত্রী হাঁস পালাতে ব্যাকুল কিন্তু নাচার পলায়নে! ওটা দেখে একমাত্র মানুষ বলবে হাঁস ও হাঁসিনীর মিথুন চলছে জলে। হংসমিথুন! —আহা শুনতে মধুর লাগে! আনন্দভৈরব রাগে নিমগ্ন শ্যামা শাস্ত্রী যেন ইতিহাসের ধূসর নদীতে হংস হয়ে সাঁতার কাটছেন আর সেই রাগের স্বরধ্বনিতে রাগমোচন ঘটছে জগতের! পুকুরের জলে পুরুষ হাঁসের পাশব আঘাতে অস্থির স্ত্রী হাঁস ছটফট ডানা জাপটায় পাশব পুলকে। ওরা মানুষ নয় তাই ওদের এই পাশবতাকে বলাৎকার বলতে তোমাদের খুব আটকাচ্ছে। কাব্য করে তাই বলছ ‘হংসমিথুন’। বলাৎকার সামলে স্ত্রী হাঁস এখন জলে ভাসছে। ওর ভেজা ডানায় পুরুষ হাঁসের পরাক্রম লেগে রয়েছে। ও সাঁতার কাটছে যেন জলে কিছু ঘটেনি, যেন সচ্চিদানন্দ ব্রহ্মা হংসকমল হয়ে অনন্তকাল ধরে জলে ভাসছেন আর টিএম কৃষ্ণা ‘তত্ত্বাব জীবাত্মম’ বলে হাঁক ছাড়ার ক্ষণে বেহালা ও মৃদঙ্গম রাগ কিরওয়ানির সুর তুলছে জলে-স্থলে ও আকাশে। হংসযূথের পরাক্রমী এই বলাৎকার পাপ-পুণ্যের ঊর্ধ্বে। পুকুরের জলে ঘটা এহেন রমণে পাপ নেই, পুণ্য নেই, বিকার নেই, বাতিক কিংবা স্বার্থের লেশ নেই, শুধু বীভৎসরসের আধিক্য রয়েছে। হংসের কাছে ওটা পরাক্রম হলে হংসীর কাছে পাশবিক স্থৈর্য; ওরা এভাবে কী সহজ মিলন ও মৈথুনে!
কেলিমত্ত হংসযূথের মতো আমিও ঝাপটে ধরতে চেয়েছিলাম ওই মানুষীকে। ভুলে গিয়েছিলাম আমি ওদের কেউ নই, ওদের জন্য যা সহজাত আমার জন্য সেটা পাশবতা। কারণ মানুষ নিজেকে হংসযূথ থেকে পৃথক ভাবে। আমাকে শেখানো হয়েছিল ওদের জন্য যেটা মিলন তোমার জন্য সেটা বলাৎকার। আমি তখন বনবাদাড় থেকে অনেকটা পথ হেঁটে আচমকা পৌঁছে গিয়েছিলাম মেঠো পথে, সেখান থেকে শানবাঁধা পথ পেরিয়ে উঠে পড়েছিলাম পিচঢালা সড়কে। সড়কের পাশে ঝোঁপঝাড় ছিল। সেখানে এক মানুষ আরেক মানুষকে বলাৎকার সেরে প্যান্টের জিপার টেনে উঠে দাঁড়িয়েছিল। যে বলাৎকার হয়েছে তার নিম্নভূমিতে রক্তের স্রোত বইছিল। গালে-পিঠে গভীর জখম। সে কথা বলার অবস্থায় ছিল না। হাঁসের মতো যেন কিছুই হয়নি ভাব করে জলে সাঁতার কাটার শক্তিতে গরিয়ান ছিল না। সুতরাং তোমরা যখন বলো, ‘দেখো মেয়েটার কী অবস্থা করেছে শুয়োরের বাচ্চা, তখন ভুল হয় তোমাদের সম্বোধনে। স্ত্রী শুয়োর কিন্তু জানে কখন পুরুষ শুয়োর চড়াও হবে ওর যন্তরমন্তর নিয়ে। ওরা একে অন্যের থেকে পালিয়ে বেড়ায়, লুকোচুরি খেলে, পুরুষ শুয়োর অতঃপর স্ত্রী শুয়োরকে ঠিক খুঁজে বের করে, ঘোঁত ঘোঁত শব্দে আচমকা প্রবেশ করে ওর পিচ্ছিল সুড়ঙ্গে।
আমাকে শুয়োরের বাচ্চা বলার ক্ষণে তোমাদের হয়ত মনে রাখা প্রয়োজন, শুয়োর যেমন করে আমি সেভাবে ওই মানুষীর পিছু নিতে পারিনি। ওই মানুষী টের পায়নি আমি ওর পিছু নিয়েছি। ওর সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে চাইছি। খেলতে-খেলতে আচমকা উৎপীড়নের শিহরণে ওর মনে পুলক জাগাতে চাইছি। আমাকে নিয়ে লুকোচুরি খেলার কোনো কারণ তার জানা ছিল না। আমি শুধু সুযোগের ফেরে ওকে ঝাপটে ধরে মুখে কাপড় গুঁজে দিয়েছিলাম, অতঃপর দীর্ঘ শাবলে অজস্র ঘাই তুলে জখম করেছি। ও এখন নিশ্চেতন শুয়ে আছে। স্ত্রী শুয়োরের সহ্যশক্তি নেই, বোকা মানুষী তাই নিশ্চুপ শুয়ে আছে পরপারে, যখন পুকুর থেকে পাশব মিলন শেষে হংসযূথ ডাঙায় উঠছে। ওই মানুষীর জন্য কোনো জল কিংবা ডাঙা আর অবশিষ্ট নেই। কারণ সে শুয়োর কিংবা হংসযূথের কেউ নয়। ওর সঙ্গে আমার পাশব মিলন সাপের মতো হয়নি, হংসের মতো করে ওটা ঘটেনি, শুয়োরের মতো করে হয়নি। মিলন শেষে আমরা দুজন নির্বিকার মুখ করে রেঁস্তোরায় ডিনার সারতে যাইনি। তোমরা বরং বলতে পারো এই বলাৎকারটা অবিকল মানুষের বাচ্চার মতো ছিল। মানুষ যেমনটা করে আর কী, ঠিক সেভাবে হারামিটা ওকে সারারাত জখম করেছে! আনন্দভৈরবী রাগ অন্তিমে এসে খুশির আবির ছড়ায় অম্বরে, অবিকল সেভাবে ওই মানুষী বাধ্য হয়েছিল রাগমোচন ঘটাতে। হায় মানুষী! তুমি পশু নও তবু বাধ্য হয়েছিলে পাশব মিলনের ক্ষণে রাগমোচনের। আমি যেমন পশু না হয়েও নিজেকে বাধ্য করেছি রেতঃস্খলনে।
তোমরা পশুর থেকে পৃথক হয়েছ বলে এত ভুলচুক এত অবদমন। ঘৃণা ও ভালোবাসা, ইচ্ছা ও অনিচ্ছা, সম্মতি ও অসম্মতি, জৈব ও বায়বীয় প্রেমের এত ভ্যানতারা। কী লাভ হল বলো? আটকাতে কি পারলে সেই পাশবতা যার নাম দিয়েছ ‘হত্যা’; যাকে প্রয়োজন মনে করে ডাকছ ‘জীবনযুদ্ধ’; গালভরে যার নাম রেখেছ ‘হংসমিথুন’; যার ব্যতিক্রম হলে ঘৃণায় নাক কুঁচকে বলে উঠছ, —ইস ‘বলাৎকার’ করেছে পশুটা! তোমাদের ওইসব প্রলাপবাক্য থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য আমি বেরিয়ে পড়েছিলাম। আকাশে তখন পাক খাচ্ছিল অযুথ হংসবলাকা। ওদের মতো উড়ার ক্ষমতা থাকলে আমি হয়ত ঠিক পৌঁছে যেতাম হংস সরোবর। সেখান থেকে হয়ত উড়াল দিতাম মহাশূন্যে। ওরা স্মরণ করিয়ে দিল আমার ডানা নেই। উড়োজাহাজে করে উড়াল দিতে পারি বটে, ঢুকে যেতে পারি মেঘের দেশে, তবু কখনও উড়তে পারব না ওদের মতো করে, ওরা যেভাবে নির্বিকার ডানা মেলে উড়ে হাজার মাইল! এই অক্ষমতা আমায় পাগল করে দিল আর আমি গুলি চালিয়ে মাটিতে ঝটপট ফেলে দিলাম হংস সরোবরের পথে নামতে থাকা বলাকার ঝাঁক। বলাকার রক্ত দিগন্তে ছলকে উঠলে কে যেন ‘বলাৎকার’ বলে চিৎকার দিয়ে উঠেছিল। কেশরবাই ততক্ষণে তীব্র হয়েছেন পটমঞ্জরী রাগে। আমার তখন মনে পড়ল জীবনের এইসব রাগ-রাগিণীর মায়া ছেড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার পথে আমি মানুষকে খুন করে এসেছি; পিচঢালা সড়ক ধরে মেঠোপথে নেমে যাওয়ার মুহূর্তে মানুষীকে ধরে আচমকা সারারাত করেছি; যেন কেউ আমাকে মানুষ বলে কখনও ডাক দিতে না পারে।
মানুষ শব্দে খুব অস্বস্তি হয় এখন। পশু শব্দেও অরুচি টের পাই, হৃদয় আর ছলকে ওঠে না সুখে। আমি তাই আবার ফিরে যাব বিজন গুহায়, যেখান থেকে একদিন মানুষ হওয়ার জন্য হামাগুঁড়ি দিয়ে বেরিয়ে এসেছিলাম। এবার ঢুকব, যদি অন্যকিছু হয়ে ফিরতে পারি কোনোদিন!
:::::::::