ধারা বহমান । নাহিদা আশরাফী
প্রকাশিত হয়েছে : ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ৯:১৬ অপরাহ্ণ, | ৩৪২ বার পঠিত
—টাকাটা কবে পাঠাতে পারবি, বল তো?
—আজ তো বৃহস্পতিবার। ব্যাংক বন্ধ হয়ে গেছে। সকালে যদি বলতি দিতে পারতাম। শুক্র-শনি তো বন্ধ। চাইলেও পাঠাতে পারব না। রবিবারে জমা দিয়ে দিই?
—আচ্ছা। এর বেশি দেরি করিস না যেন। বুঝিস তো।
—আমি তো দেরি করিনি। এ মাসেই ফেরত দেওয়ার কথা বলেছি। নয় কি?
—হুম, তা বলেছিস।
—তো দেরির কথা বললি কেন? আমি বিপদে পড়েই ধার নিয়েছিলাম। নেওয়ার সময়ই বলেছিলাম যে জুলাই মাসে দেব। কথার অন্যথা আমি করিনি, করবও না। বরং তুই করেছিস। কী কথা ছিল তোর সাথে? ইমার্জেন্সি লাগলে এক সপ্তাহ সময় দিয়ে চাইবি। তা না, ধুম করে বললি আজ টাকাটা দে ।
—আচ্ছা বাবা এত প্যাঁচানোর দরকার নেই। রবিবারেই দিস। টাকাটা খুব দরকার।
—প্যাঁচাইনি শুভ্র। রবিবারেই টাকাটা পাবি । ভালো থাক ।
শুভ্রকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই কট করে লাইনটা কেটে দিল ধারা। না দিয়ে উপায়ও ছিল না। কথা বাড়ালে নিশ্চিত নিজেকে সামলাতে পারত না। এরই মধ্যে টপটপ করে ক ফোঁটা জল গড়িয়ে ওর কোলের কাছে শাড়িটা ভিজিয়ে দিয়েছে।
দিনটা আজ শুরু থেকেই রাতের আঁধার কোলে নিয়ে বসে আছে। চাকরিটা হয়েও হলো না। দিনের শুরুতেই টানা সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা খেয়ে ফেলল ইন্টারভিউটা। খেয়েও যদি সন্তুষ্ট হতো আপত্তি ছিল না ধারার। কই, উল্টো ভাবখানা এই- মাত্র সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা, চারখানা সার্টিফিকেট, হোক না সব প্রথম শ্রেণির, আর তিন বছরের অভিজ্ঞতা দিয়েই ভেবেছ আমাদের সন্তুষ্ট করতে পারবে? এত সহজ! ফিজিক্সে ফার্স্টক্লাস পেলেই হলো? কত সহজ প্রশ্নের আর একটা ছোট্ট এসএমএসের উত্তর দিতে পারলে না।
ছানা দুহাত দিয়ে চটকালে বেশি মসৃণ হয়, না এক হাতে চটকালে? সানিলিওন আর বিপাশা বসু- কে বেশি উত্তেজক? এইসব সাধারণ প্রশ্নের উত্তর জানো না। না জানলেও চলত অবশ্য। ওই যে এসএমএস তোমার মোবাইলে, ‘আজ রাতে… চলবে? তাহলে কাজ কনফার্ম।’ তুমি একটু ওকে লিখলেই সব সেট হয়ে যেত। চাকরি, নিশ্চিন্ত জীবন। মাকে রোজ অফিসে যাই বলে মিথ্যে বলা লাগত না, বাড়ি ছাড়ার নোটিশ পেতে হতো না, মুদি দোকানদার দেনা না মেটালে নতুন করে সওদা দেবে না বলে শাসাত না। আর নিজের ইচ্ছে, চাহিদা এসব না হয় না-ই বললাম। ধুর মেয়ে, তুমি কিস্যু পারো না। কিস্যু না । আর পেরেছ তুমি !
দুই
অমন উদভ্রান্ত আর ছন্নছাড়া সময়টাতে শুভ্রর ফোন ভাবনাকে কিছুটা হলেও অন্য রাস্তায় নেবে এমনটিই ভেবেছিল ধারা। সে রাস্তা মসৃণ, অমসৃণ, পিচঢালা, মেঠো যা-ই হোক, অসহ্য এই সময়টা থেকে পালাতেই শুভ্রর ফোনটা ধরল। কিন্তু ব্যাপারটা যে এমন হবে কে ভেবেছিল? ছোটবেলায় শেখা প্রবচনের সার্থক রূপায়ন বড়বেলার ধারাকে এমন দ্বিখণ্ডিত করছে যে ও পালাবার পথও পাচ্ছে না। বিপদ কি সত্যিই কখনো একা আসে না? যে অস্থির মুহূর্ত থেকে পালাতে সে শুভ্রর ফোন ধরল, সেই মুহূর্ত যেন সিন্দাবাদের ভূত। ওকে আরও চেপে ধরল। ধারার মাথায় আসছে না শুভ্র এমন কেন করল। তবে কি নীরার কথাই ঠিক? শুভ্রকে দুদিন নীরা যে মেয়েটির সাথে দেখেছে সে নাকি দারুণ সুন্দরী। ধারা মানতে চায়নি। গত কয়েক মাস শুভ্রর পরিবর্তন ওর চোখে লেগেছে কিন্তু অফিসে ওর দ্রুত প্রমোশনে মনকে সান্ত্বনা দিয়েছে। নিজেকে যোগ্য প্রমাণ না করতে পারলে কি আর প্রমোশনটা পেয়েছে? তবু মনের ভেতরের খচখচানি ভাবটা দূর করতেই একদিন শুভ্রকে আকার-ইঙ্গিতে কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু শুভ্র হঠাৎই ওদের বিয়ের প্রসঙ্গ টেনে আনায় ধারা নিজেই নিজের সংকীর্ণতায় লজ্জা পেল। ছি ছি, ধারা তুমি নিজেই দেখো তুমি কত ছোট মনের! তুমি শুভ্রকে নিয়ে কী ভাবছ আর শুভ্র তোমাকে নিয়ে কী ভাবছে। নিজেকেই নিজে শাসিয়েছে অনেক। অথচ শুভ্রর আজকের আচরণ তো নীরার কথাকেই সমর্থন দিচ্ছে। তবে কি সেদিন কথার প্রসঙ্গ পাল্টে দিতেই শুভ্র…।
তিন
অনেকটা হঠাৎই নীরার বিয়েটা ঠিক হলো। ছেলে পূর্বপরিচিত। যদিও লেখাপড়ায় তেমন এগোতে পারেনি, তবু দেখতে ভালো, টাকাপয়সাও বেশ আছে। এসব দেখে ধারাও আপত্তি করেনি। নিম্নমধ্যবিত্ত সংসারের সন্তানরা যে অনুপাতে শরীরে বাড়ে, তার চেয়ে অনেক বাড়ে তাদের মনের হাহাকার, ক্ষুধা, অভাব আর দারিদ্র্য। এসব অপশক্তি দূরে ছুড়ে ফেলার জন্যে যে মনের জোর দরকার, খুব কম ছেলেমেয়েরই তা থাকে। ভালোমন্দবোধ, জাগতিক জ্ঞান, যৌক্তিকতা- এসব খুব গৌন হয়ে পড়ে তখন । নীরাকে নিয়ে এই ভয়টা সবসময়ই ছিল ধারার। খুব বেশি আবেগী মেয়েটা। যুক্তি দিয়ে বিচার করার ক্ষমতা সবার সমান নয়। ধারা কিছু করতে যেমন দশবার ভাবে, নীরা তার উল্টো। কিছু না ভেবেই ধুম করে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। ছেলেটির কথা যখন নীরা ওকে জানাল, ধারা দ্রুতই খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করল। খোঁজ নিতে গিয়েই জানল ছেলেটি ওদের চাচাতো বোনের দেবর। পরিবারের গণ্ডির মধ্যে হওয়ায় দুপক্ষই আর দেরি করতে চাইল না। তাছাড়া ছেলের তাড়াও অনেক। বিয়ে করে বউ নিয়ে ইতালি পাড়ি দেবে।
ইদানীং কথায় কথায় বেশ ইংরেজি বলার চেষ্টা করে নীরা। বলতে গিয়ে ঠোঁট এতটা বাঁকায় যে দেখতে খুব অদ্ভুত লাগে। ধারা একবার ভাবল নীরাকে বলবে। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিল। থাক, মধ্যবিত্তের বলয় থেকে বেরিয়ে আসার এও এক বিচিত্র চেষ্টা বটে।
ঝটপট বিয়ের তারিখ পড়ে যাওয়ায় অথৈ জলে পড়ল ধারা। আর কিছু না হলেও তো এক লাখ টাকার ধাক্কা। পাত্রকে সরাসরিই জানিয়েছিল ধারা তার অর্থনৈতিক দৈন্যদশার কথা। এই মুহূর্তে আনুষ্ঠানিকতা একেবারেই অসম্ভব। পারিবারিকভাবেই জনা তিরিশেক আত্মীয়, বন্ধুদের উপস্থিতিতে নীরার বিয়ের কাজটা সেরে ফেলা হলো। বলা যতটা সহজ কাজটি কি অত সহজ? কাজের সহযোগী যা-ও বা দু-একজন পাওয়া যায়, আর্থিক সহযোগী পাওয়া অসম্ভব ব্যাপার। ধারা নিজের আঠারোতম জন্মদিনে যে চেইনটা পেয়েছিল বাবার কাছ থেকে, শেষ স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে খুব যত্ন করে রেখে দিয়েছিল সেটি। মাঝে মাঝে নেড়েচেড়ে দেখত। হাতে নিলে কেমন বাবার ছোঁয়া পেত। শেষে এক জংধরা বিকেলে উপায়হীন হয়ে দু ভরি ওজনের চেইনটা সুশান্ত বাবুর কাছে দিয়ে এল। তাতে হাজার পঞ্চাশেক হলো বটে কিন্তু তারপরও আরো পঞ্চাশের ধাক্কা। মাকে বলে লাভ নেই। ম্যানেজ ওকেই করতে হবে। লাজলজ্জার মাথা খেয়ে শুভ্রকে বলেছিল ধারা। এগারো বছরের সম্পর্কে ও কখনো কিছু চায়নি শুভ্রর কাছে। চাকরি নেই, না খেয়ে থেকেছে। তবু শুভ্রর সামনে প্রকাশ করেনি। কিন্তু এবার আর উপায় ছিল না। শুভ্র টাকাটা দিয়েছিল ওকে। শুধু তা-ই নয়, খুব আনন্দের সাথেই দিয়েছিল। টাকাটা পেয়ে ধারা হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। উল্টো সুশান্ত বাবুকে কেন চেইনটা বন্ধক দিল এ নিয়ে খানিকটা রাগও দেখাল ধারার সাথে।
চার
তিন মাস হলো নীরা শ্বশুরবাড়িতে। মাঝে মাঝে এসে মাকে দেখে যায়। মায়ের জন্যে আপেল, হরলিক্স নিয়ে আসে। শুক্রবার বিকেলটা ধারা নিজের মতো কাটাতে চেষ্টা করে। আজ আর তা হলো না। নীরা এসে সুনসান বিকেলের নীরবতা নাড়িয়ে দিল। মায়ের সঙ্গে জমিয়ে গল্প জুড়ে দিল। শ্বশুর-শাশুড়ি কত আদর করে, হানিমুনে ইউরোপের কোন দেশে যাবে, এক মাসের মধ্যে ভিসাও হয়ে যাবে- আরও কত কী। যাওয়ার সময় সেলফিও তুলল নতুন স্মার্ট ফোন দিয়ে। বন্ধুদের নিয়ে কেএফসিতে গেটটুগেদারের ছবি দেখাতেও ভুলল না। ধারা ভীষণ খুশি হওয়ার অভিনয় করল। অভিনয়ই তো। নইলে যে ও কষ্ট পেত। নীরা যখন কথা বলছিল ধারা লুকিয়ে লুকিয়ে ওর চোখ দেখছিল। অনেক কষ্টেও সেই চোখে মা-বোনের জন্যে কোনো ভালোবাসার ছায়া খুঁজে পেল না। ওকে দেখলে মনেই হয় না মাত্র তিন মাস আগেই ও এই দুটি মানুষের সাথে জীবনকে যাপন করেছে। ধারা দ্বন্দ্বে পড়ে গেল। আসলে নীরার যাপিত জীবন কোনটা? ওদের সাথে এক রুমে কায়ক্লেশে কাটিয়ে দেওয়া নিম্নমধ্যবিত্তের রংচটা জীবন নাকি বিত্তবৈভবের র্যাপিংয়ে মোড়ানো চকচকে উচ্চবিত্তের জীবনটা?
—একটু মুটিয়ে গেছিস রে নীরা। নিজের দিকে যত্ন নিস ।
—ইস্ দি । তুমি বললে । ও তো আমাকে স্কাইপেতে দেখে আঁতকে উঠেছে। কী বলে জানো, ‘মাত্র একমাস আগে ইতালি এলাম । এর মধ্যেই এই অবস্থা? সোনা প্লিজ জিমে যাও। আজই ভর্তি হয়ে আসো।’ জিমে গিয়ে খোঁজ নিয়ে তো আমার চোখ ছানাবড়া। তিন মাসের কোর্স ফি পঁচাত্তর হাজার টাকা। কান ইউ বিলিভ ইট?
ধারা হাসে। ইদানীং কথায় কথায় বেশ ইংরেজি বলার চেষ্টা করে নীরা। বলতে গিয়ে ঠোঁট এতটা বাঁকায় যে দেখতে খুব অদ্ভুত লাগে। ধারা একবার ভাবল নীরাকে বলবে। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিল। থাক, মধ্যবিত্তের বলয় থেকে বেরিয়ে আসার এও এক বিচিত্র চেষ্টা বটে।
—ভর্তি হয়েছিস?
—হ্যাঁ দি। না হয়ে উপায় আছে? ইতালি যাওয়ার আগে যে করেই হোক স্লিম হতে হবে । নইলে ওর বন্ধুদের সামনে ও কতটা ছোট হয়ে যাবে বুঝতে পারছ?
—হুম।
—জানো দি, গতকাল না শাম্মা আমার জন্যে আড়ং থেকে এই শাড়িটা এনেছেন । বলো তো কত নিল?
—শাম্মা!
—ওহ দি, তুমি না এখনো ব্যাকডেটেড রয়ে গেলে। শাম্মা মানে শাশুড়ি মা। সংক্ষেপে শাম্মা ।
—ওহ।
—বলো না।
—কী?
কত নিল শাড়িটা?
আমি কী করে জানব ।
—তবু আন্দাজ করো না।
—দশ হাজার।
—ও মাই গড! দি তুমি আমাকে বলেছ ঠিক আছে। আই এম সো লাকি যে শ্বশুরবাড়ির কারো সামনে বলোনি।
কেন রে? বেশি বলে ফেলেছি?
—ইউ নো এই শাড়িটার দাম বাইশ হাজার টাকা। আর তুমি কিনা বলছ দশ হাজার। উফ। তুমি না !
এরপর আরও কী কী যেন বলছিল নীরা। ধারা তখন অন্য জগতে। একটা শাড়ি বাইশ হাজার। এমন দুটো শাড়ির দাম অথবা দুমাসের জিমের ফি পেলে তো ও শুভ্রর টাকাটা পরশু অনায়াসে দিয়ে দিতে পারত। কাল এক দিনের মধ্যে কেমন করে কোথা থেকে টাকাটা জোগাড় করবে ওর মাথায় আসছে না। ধারা শুধু জানে যেমন করেই হোক শুভ্রকে টাকাটা ফেরত দিতে হবে। কোনোভাবেই শুভ্রর কাছে ছোট হবে না।
পাঁচ
দুশ্চিন্তা কষ্টের। তারচেয়ে বড় কষ্ট সেটাকে চাপা দিয়ে স্বাভাবিকের অভিনয়। এর মধ্যে মা তিনবার জানতে চেয়েছেন ধারার কিছু হয়েছে কি না, চোখমুখ শুকিয়ে কেন এত। লাভ কী বলে? অহেতুক একটা অসুস্থ মানুষকে আরও অসুস্থ করে তোলা ভেবে চেপে যায় ধারা। মায়ের চোখ এড়াতেই পুরোনো ট্রাংকটা খুলে বসে। ও জানে এখানে কিছু নেই যা ওকে পঞ্চাশ হাজার টাকার ব্যবস্থা করে দিতে পারে। তবু নিজেকে ব্যস্ত রাখার এ এক ছেলেভোলানো আয়োজন।
বেশ পুরোনো একটা নীল ফুলতোলা ফ্রক, দুটো নকশা তোলা কাঁথা, একজোড়া ঘুঙুর। হাতে নিতেই বুকের ভেতর বেজে উঠল নূপুরজোড়া। আঠারো বছর পার হয়েছে কিন্তু স্মৃতিগুচ্ছ এখনো মনে হয় বারান্দার টবে রাখা মানিপ্লান্টের মতোই তরতাজা।
বাবার হাত ধরে প্রথম যেদিন শৈলেন কাকার নাচের ক্লাসে যায়, ধারা রীতিমতো ভয়ে গুটিসুটি মেরে ছিল। অবশ্য ধারা কেন, কাকুকে দেখলে ভয় পেত না এমন কেউ কি ছিল পাড়ায়? ইয়া লম্বা, একহারা গড়ন, পেটানো স্বাস্থ্য। পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় মনে হতো একটা পাহাড় তার অবিচল ভাবগাম্ভীর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে। মুক্তিযুদ্ধকালীন একটি গেরিলা গ্রুপের প্রধান ছিলেন শৈলেন কাকু। গ্রুপের কোডনেম ছিল ধলা পাহাড়। কাকু ওই গ্রুপের প্রধান ছিলেন। তাকে দেখেই নামটা রাখা হয়েছিল। বাবার কাছে এসব গল্প কম শোনেনি ধারা। যুদ্ধ শেষে বাড়িতে ফিরে ধর্ষিত বউ ছাড়া আর কাউকেই পাননি। তবু মনোবল হারাননি, দেশ ছেড়েও যাননি। অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়েই নতুন জীবন শুরু করেন। নিজ বাড়িতে নাচের স্কুল খোলেন। সম্মানী হিসেবে যে যা দিয়েছে তা-ই নিয়েছেন। অনেককে বিনে পয়সায়ও নাকি নাচ শিখিয়েছেন। সব প্রতিবন্ধকতা জয় করে ঠিক যখন গুছিয়ে উঠেছেন, তখনই কাকিমা এক যুদ্ধশিশুর জন্ম দিতে গিয়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে।
কাকাবাবুর জীবনে আর এক নতুন যুদ্ধের শুরু। সামাজিক সব কূটতর্ককে আবর্জনার স্তূপে ফেলে সেই যুদ্ধশিশুকে নিজ সন্তান হিসেবে বড় করে তুলতে তাঁর চেষ্টার কমতি ছিল না। ছেলে সুশান্তও বাবার চেষ্টা বৃথা যেতে দেয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েছে। বাবার মৃতপ্রায় ব্যবসার হাল ধরেছে। তীক্ষ্ণ বুদ্ধি আর অমায়িক আচরণ পুঁজি করে সুশান্ত গড়ে তুলেছে তার বিশাল ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য। সাথে বাবার ছোট্ট নাচের স্কুলকে এমন অবস্থানে দাঁড় করিয়েছে, দেখলে অবাকই হতে হয়। চোখের সামনে এই বদল দেখেছে ধারা। শৈলেনবাবুও অনেকটাই দেখে গেছেন। ওপারে থেকে এখনো নিশ্চয়ই দেখছেন।
সেই শৈলেন বাবু আর ধারার বাবার বন্ধুতা ছিল দেখার মতন। শুক্রবার আসরের আজানের আগেই মসজিদের বারান্দায় এসে বসতেন তিনি। নামাজের পরে বাবা বের হলে দুজন একসাথে ঘুরতে যেতেন। শুক্রবার বিকেলটা ছিল ওদের দুজনের। একবার ধারার বাবা গাজীপুর গেলেন অফিসের কী কাজে। সাধারণত বাবা দূর থেকে ফেরা মানেই দু বোনের বাড়তি আনন্দ। বাবার ব্যাগ মানেই জাদুর বাক্স। কত কী আনতেন মেয়েদের জন্যে। অথচ সেবার গাজীপুর থেকে ফিরে বাবা কিছুতেই ওদের হাতে ব্যাগ দিতে নারাজ। উল্টো মুখ গম্ভীর করে ঘোষণা দিলেন যেন কেউ এই ব্যাগে হাত না দেয়। নিষিদ্ধ বস্তুর আকর্ষণে দু বোনের দূরে থাকা কঠিন হলো। কিন্তু ব্যাগ খুলে দেখবার সাহস ঠিক পেল না ।
বিকেলে শৈলেন বাবু এলেন। বাবা খুব সাবধানে ব্যাগটা আলমারির ওপর থেকে নামিয়ে আনলেন। দু বোন এমনকি মাও এসে দাঁড়ালেন পাশে। বাবা একটা পুঁটলি বের করে কোলের ওপর রাখলেন। বাবার গায়ের চাদর দিয়ে খুব সাবধানে প্যাঁচানো মোড়ক খুলতেই বেরিয়ে এল মাটির তৈরি রাধাকৃষ্ণ আর গণেশের দুটি মূর্তি। আহা, কী সুন্দর! কাকাবাবু মিটিমিটি হাসছেন। ধারা আর নীরা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। খুব শখের এই কাশ্মীরি চাদর বাবা কাউকে ধরতেও দিতেন না। আর সেই চাদরে বাবা রাধাকৃষ্ণ আর গণেশ মূর্তি জড়িয়ে এনেছেন কাকার জন্যে। কাকাবাবুর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বাবার আনা এই দেবমূর্তি দুটোই ও বাড়ির পুজোর আসনে বসানো ছিল। কাকাবাবুর কাছে প্রতি শনি ও রবি দুদিন বিকেলে গিয়ে ধারা নাচ শিখত। বেশ ক বছর শিখেছিল। তাঁর মৃত্যুর পর সব শেষ হয়ে যায়। কাকা চলে যাওয়ার দু’বছরের মাথায় বাবাও চলে গেলেন। এরপর সবটাই শ্রম ও সংগ্রামের ইতিহাস। জীবন ওকে এমন নাচিয়েই ছাড়ল যে এই নাচের কথা ধারা মনেই আনতে পারে না।
হঠাৎ কী মনে করে ধারা ট্রাংকটার একোণ-ওকোণ খুব উৎকণ্ঠা নিয়ে খুঁজতে শুরু করল। খুঁজতে খুঁজতে পেয়েও গেল। আজ অবধি ধারার জানা হয়নি সেই পনেরোটি গোলাপি চিঠির রহস্য। এখনো ধারা জানে না চিঠিগুলো তাকেই পাঠানো নাকি অন্য কাউকে। প্রাপকের নাম নেই, নেই প্রেরকের ঠিকানাও। কখনো ঘরে ঢোকার পথে ভাঙা দেয়ালের ওপরে, কখনো বাড়ির ছাদে, কখনো শিউলি গাছটার নিচে ঝরে থাকা শিউলির ওপরে, আরও কত কত জায়গায়। গুনে গুনে এমন পনেরোটি চিঠি পেয়েছিল ধারা। সদ্য কৈশোর পেরোনো সময়টাতে চিঠিগুলোই তাকে প্রেম, ভালোবাসা আবার একই সাথে বিরহের সূক্ষ্ম অনুভূতির সাথে পরিচয় করিয়েছিল। প্রথমটায় চিঠিগুলো তেমন কোনো আগ্রহ তৈরি করেনি ধারার জন্যে। শুধু পড়তে বেশ লাগত। অন্যের চিঠি ভেবে কী এক অপরাধবোধও কাজ করত। কিন্তু কদিন যেতে না যেতেই একটা অপেক্ষা আর আগ্রহের পাখি ডানা ঝাপটাতে শুরু করে। সকালে ঘুম ভাঙতেই অথবা স্কুল ফেরার পথে, নয়তো নাচের ক্লাস শেষে ধারার চোখ কিছু একটা খুঁজত। কতদিন চিঠির অপেক্ষায় লুকিয়ে কেঁদেছে। অজানা প্রেমিকের প্রতি অকারণ অভিমান ওকে বিদ্ধ করেছে। সযত্নে লুকিয়ে রাখা চিঠিগুলো বের করে আপনমনেই কথা বলেছে। সেই পরিপূর্ণ আবেগ আর কখনোই খুঁজে পায়নি ধারা। শুভ্র ওর সবটা জুড়ে থাকলেও এই পনেরোটি চিঠি ওর হৃদয়ে এক অনাবিষ্কৃত মহাসাগরের তলদেশের মতো রয়ে গেছে। সেখানে শুভ্রর প্রবেশাধিকার নেই। ওই পনেরোটি চিঠি আজও মুক্তোদানার মতো গুছিয়ে রেখেছে ধারা।
এরপর হঠাৎ করেই চিঠি আসা বন্ধ হলো। কত খুঁজেছে ঘরের বা উঠোনের আনাচেকানাচে, চিঠি আর আসেনি। মায়ের ডাকে আচমকাই বর্তমানে ফিরতে হলো ধারাকে। মায়ের ওষুধ দেওয়ার সময় হয়েছে। এসব চিঠি কিছু সুখানুভূতিই দিতে পারবে। কিন্তু ধারার যা প্রয়োজন তা কখনোই কি দিতে পারবে? দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে মাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সারারাত ঘুম এল না ওর। কার কাছে যাবে? কে দেবে পঞ্চাশ হাজার টাকা? একদিনের মধ্যে এই টাকাই সে কেমন করে জোগাড় করবে? দুশ্চিন্তা তাকে এতটাই তাড়িত করল যে একবার আত্মহননের চিন্তাটাও মনে উঁকি দিতে ছাড়ল না।
ছয়
ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। পাখির কিচিরমিচিরে বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই আশ্বিনের আলতো শীত-বাতাসের ঝাপটা শরীর জুড়িয়ে দিল। কী মায়া বিছানো চারদিকে। এই সময়টাকে বড্ড আপন আর নির্মোহ মনে হয় ধারার। কেমন টুপ করে অনন্তের পথে চলে যায়, যেমন শিউলি জন্মবোঁটা ছেড়ে দ্রুত ঝরে পড়ে মাটির কোলে। খুব আফসোস হয় ক্ষণস্থায়ী এই সময়ের জন্যে। আরো কিছু সময় এই ক্ষণটুকু স্থির থাকলে জগৎসংসারে কি খুব ওলটপালট হতো? গ্রিল দেওয়া বারান্দাটা এই মুহূর্তে খাঁচা মনে হচ্ছে ওর।
দরজাটা খুব সাবধানে খুলে শিউলিতলায় ছড়ানো ফুলের কাছে এসে থমকে দাঁড়াল ধারা। কী দেখছে এসব! এ কি সত্যি? নাকি সারারাত না ঘুমানোর ফল? নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। এক দৌড়ে ঘরের দরজার কাছে ছুটে এল । লম্বা নিঃশ্বাস নিল। ওর মনে হচ্ছে হ্যালুসিনেশন। কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা নয়। নাহ, ভুল দেখেনি। এত বছর পর! ধারা এগোতে গিয়ে দেখে পা চলছে না। মনে হচ্ছে দশ কদম পথ পাড়ি দিতে তার দশ জনম লেগে যাবে। অনেক কষ্টে ধাতস্থ হয়ে দাঁড়াল শিউলিতলায়। কাঁপা হাতে খামটা তুলে নিল। বুকের ভেতর দূরবর্তী কারখানার ঘণ্টাধ্বনি ঢংঢং বেজেই চলেছে। উত্তেজনায় চিবুকেও ঘাম জমেছে। সেই গোলাপি খাম। এত বছরে এতটুকু বদলায়নি। খামটা খুলতে গিয়ে আঙুলগুলো কেমন লজ্জায়, ভয়ে একে অপরের সাথে পেঁচিয়ে যাচ্ছে। ঠিক আগের মতোই। দশ-বার লাইনের চিঠি। সম্বোধনহীন।
‘ঠিক ষোলো বছর তিন মাস সাত দিন পর তোমায় লিখছি। কাকিমাকে দেওয়া প্রতিজ্ঞা রাখতে গিয়ে আর যা-ই হোক তোমায় হারাতে পারব না। না পাওয়ার দুঃখবোধ চাপা দিয়েছিলাম দূর থেকে দেখবার আনন্দে। শান্তি না পেলেও স্বস্তি জাগত এই ভেবে, তোমায় দেখতে তো পাচ্ছি। কিন্তু গত কদিনে দুশ্চিন্তা তোমায় এতটাই গ্রাস করেছে যে নিজেকেই হারাতে বসেছ। তোমাকে চিনি নিজের থেকে বেশি, হয়তো তোমার থেকেও বেশি। ভেবো না, শুভ্রর টাকা আগামীকাল ঠিক ওর একাউন্টে জমা হয়ে যাবে। নিজের দিকে যত্ন নিও। তোমায় না পাই দুঃখ নেই। হারানোর কষ্ট সইবে না। ভালো থেকো। আরেকটা কথা, দুপুরের আগে কাউকে পাঠিয়ে কাকাবাবুর দেওয়া চেইনটা আনিয়ে নিও। ওটা বাবাকে দেওয়া কাকাবাবুর শেষ চিহ্ন রাধাকৃষ্ণের গলায় পরিয়ে রেখেছি। ওটা তোমার গলাতেই ভালো মানাবে।’
একটানে চিঠিটা পড়েই ধারা ব্যাকুল হয়ে কাউকে খুঁজতে লাগল। প্রেরককে, নাকি সে নিজেকেই খুঁজল, কে জানে? এই প্রথম আলো-আঁধারের সময়টুকু বড্ড দীর্ঘ মনে হলো ওর।